২.৫
আবার সেই বাদ্য বাজছিল। ঢাক-ঢোল-সানাই বাজছে। জল ভরতে গেছে মেয়েরা। মাথা নেড়া করছে সোনা লালটু পলটু। উৎসবের বাড়ি, কত আত্মীয়-কুটুম। তাদের সন্তান-সন্ততি। সব ছেলেপুলে চারপাশ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বুঝি তামাশা দেখছে—এমন এক ভাব চোখেমুখে। ওরা কেউ কেউ ঠাট্টা-তামাশা করছে। সোনা শক্ত হয়ে বসে আছে, সে মাথা নেড়া করবে না। তাদের তাড়িয়ে না দিলে মাথা নেড়া করবে না। যারা হাসছিল তাদের তাড়িয়ে দিল ঈশম। এবার মাথা পেতে দিয়েছে সোনা। ঈশমের এমন খুচরো কাজ কত। ঈশম অবসর পাচ্ছে না। সে এইমাত্র নয়াপাড়া থেকে ঘুরে এসেছে আবার তাকে বিশ্বাসপাড়া যেতে হবে। যাবার আগে সে গাছে উঠে আমের শুকনো ডাল, বেলপাতা, পল্লব, হোমের জন্য পেড়ে রেখে দিয়েছে।
রান্নাঘরের পাশে কাল সারাদিন খেটে ঈশম একটা নতন চালাঘর তুলেছে। বড় বড় ডেগ, হাঁড়ি, পেতলের বালতি, মালসা চালার নিচে। ফুলকপি, বাঁধাকপি কাটছে হারান পালের বৌ। বড় মাছ কাটছে দীনবন্ধুর দুই বউ। বড় ডেগে গরম হচ্ছে দুধ। মুসলমান পাড়া থেকে সবাই দুধ দিয়ে যাচ্ছে। শচি সব দুধ মেপে রাখছে।
এই উৎসবের বাড়িতে একমাত্র ধনবৌ কিছু করতে পারছে না। পেটে তার সন্তান। সন্তান পেটে নিয়ে শুভকর্মে হাত দিতে নেই। ধনবৌ চুপচাপ বারান্দার এক কোণে বসে শুধু পানের খিলি বানাচ্ছে। সুতরাং বড়বৌর উপরই চাপ বেশি। বড়বৌ এই শীতেও ঘেমে গেছে। খুব ভোরে উঠে স্নান করেছে বড়বৌ। লালপেড়ে গরদ পরেছে। আত্মীয়স্বজনদের জন্য সকালের জলখাবার ঠিক করতে হয়েছে। দক্ষিণের ঘরে ফরাস পাতা হয়েছে। পঞ্চমীঘাট এবং ভাটপাড়া থেকে বড় বড় পণ্ডিত এসেছেন। ওঁরা ধর্মাধর্মের তর্কে ডুবে আছেন। ওঁদের জন্য বাটিতে গরম দুধ এবং মুড়ি, দুটো সন্দেশ জলখাবার গেছে। সন্ধ্যা-আহ্নিকের জন্য ঘাটের পাড়ে জমি সাফ করে দেওয়া হয়েছে। সারা সকাল পণ্ডিতেরা সেখানে বসে আহ্নিক করেছেন।
যারা দূর থেকে আসছে তাদের চন্দ্রনাথ দেখাশোনা করছেন। ভূপেন্দ্রনাথ টাকা-পয়সা এবং কোথায় কি প্রয়োজন হবে সারাক্ষণ তাই দেখাশোনা করছেন। কেউ বেশিক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়াতে পারছে না। শশীভূষণ বৈঠকখানায় পণ্ডিতদের সঙ্গে ন্যায়নীতির গল্পে ডুবে গেছেন।
মাঝে মাঝে ভূপেন্দ্রনাথ কাজ ফেলে পণ্ডিতপ্রবরদের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন। কোনও ত্রুটি যদি হয়ে থাকে—মার্জনা ভিক্ষার মতো মুখ—আমাদের এই পরিবারে আপনাদের আগমন বড় পুণ্যের শামিল। এভাবে তিনি ঘুরে ঘুরে সবার কছে পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। আপনাদের আগমনেই এই উৎসব সফল, এমন নিবেদন করছেন।
শচীন্দ্রনাথ তখন শশীবালার কাছে গিয়ে বললেন, মা, তোমার আর কি লাগবে?
শশীবালা আলু, বাঁধাকপি, পটল, কুমড়ো এসবের ভিতর ডুবে ছিলেন। যত লোক খাবে তার হিসাব মতো সব বের করে দিচ্ছেন শশীবালা। মায়ের পাশে শচীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। সুলতানসাদির বাজারে আর বারদীর হাট থেকে মাছ এসেছে। তবু মাছে কম হবে কি-না, একবার দেখা দরকার। পুকুরে জাল ফেলা যদি দরকার হয়, সেজন্য গগনা জেলে জাল নিয়ে পুকুরপাড়ে বসে রয়েছে। তিনি গগনা জেলেকে কিছু মাছ তুলে দিতে বললেন।
তা ছাড়া শচির পকেটে ঘড়ি, তিনি মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখে কখন বিদ্ধিতে বসার সময়, ক’টার ভিতর চলন দেওয়া হবে এবং হোম ক’টা থেকে কটার ভিতর শেষ করা দরকার, আহ্নিক হোমের আগে না পরে করাতে হবে এসব হিসাব রাখছেন বলে ভূপেন্দ্রনাথ আর তাঁকে অন্য কোনও কাজের ভার দেন নি।
তিনি তাড়াতাড়ি পুকুরপাড়ে এসে দেখলেন এখনও কামানো হয়নি। সোনার মাথার অর্ধেকটা চাঁচা হয়েছে। সাদা ধবধবে মাথা, পিঠে চুল, শীতে সোনা কাঁপছে। সোনা জবুথবু হয়ে বসে রয়েছে। কান ফুটো করা হবে এই বলে সকলে ওকে ভয় দেখাচ্ছে। সে ভয়ে শক্ত হয়ে আছে। ভূপেন্দ্রনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, না কান তোমার কেউ ফুটা করবে না। ভূপেন্দ্রনাথ সোনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন। যারা পুকুরে জল ভরতে গেছে ওরা ফিরে এলেই স্নান। হলুদ রাঙানো কাপড় পরেছে সোনা। হলুদ মেখে স্নান করানো হবে। স্নানের শেষে ওরা নতুন কাপড় পরবে। সোনার মাথা নেড়া হলে ভূপেন্দ্ৰনাথ মাথায় হাত রাখলেন। ছোট্ট একটা শিখা তালুতে। সোনা দু’বার শিখাতে হাত রেখে কেমন পুলক বোধ করল।
এবং তখন গান হচ্ছিল পুকুরপাড়ে। যারা জল ভরতে গেছে তারা গান গাইছে। সুর ধরে অদ্ভুত সব গান। সোনা, লালটু, পলটুর মঙ্গল কামনায় গান গাইছে। এরা এই সংসারে বড় হচ্ছে। বড় হতে হতে ওরা এক ধর্ম প্রচারে ডুবে যাবে—সে ধর্মের নাম হিন্দুধর্ম। নানাবিধ ক্রিয়াকলাপের ভিতর তুমি মহাভারতের মানুষ, এমন যেন এক বোধ গড়ে দিতে চাইছে তারা।
সোনা যেন একবার নদীর পাড়ে ল্যাণ্ডোতে ফিরতে ফিরতে ভেবেছিল—সে ক্রমে উপকথার নায়ক হয়ে যাচ্ছে, আজও সে তেমনি নায়ক, তার জন্য কী সব জাঁকজমক! এদিনে ফতিমা কাছে নেই। থাকলে কী না সে খুশি হতো।
কিন্তু নতুন কাপড় পরার সময়ই যত গণ্ডগোল দেখা গেল। পিসিমার ছোট ননদের মেয়ে দীপালি দাঁড়িয়ে আছে। শীতের রোদে ওদের স্নান করানো হচ্ছে। সেই ঢাক-ঢোল বাজছে, সানাই বাজছে। শুভকার্যে উলুধ্বনি, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ওড়ার মতো যেন ওদের মাথায় পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু সোনা কাপড় পরে না, পরার অভ্যাস নেই। সে কাপড় পাল্টাবার সময় দেখল ভিড়ের ভিতর থেকে দীপালি তাকিয়ে আছে। ওর ভীষণ লজ্জা লাগছিল। সে দু’হাতে দশহাতি কাপড় কোমরে জড়িয়ে রেখেছে, ছাড়তে পারছে না, ছেড়ে দিলেই সে নেংটো হয়ে যাবে। নেংটো হয়ে গেলে দীপালি ওর সব দেখে ফেলবে—সে শীতের ভিতর হি হি করে কাঁপছে অথচ কাপড় ছাড়ছে না।
সোনা এ-সময় তার জ্যেঠিমাকে খুঁজছিল।
পিসিমা বললেন, কাপড়টা ছাড়।
সে কাপড় ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
মেসোমশাই এসে বললেন, কি সোনা! শীতে কষ্ট পাইতাছ ক্যান? কাপড় ছাড়।
সোনা আবার তাকাল।
লালটু বলল, কী আদর আমার! জ্যেঠিমা না আইলে তিনি কাপড় ছাড়তে পারতাছে না।
তখন এল বড়বৌ।—কী হয়েছে সোনা? এখনও তুমি ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছ!
সোনা এবার চারপাশের ছোট ছোট মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
বড়বৌ বলল, ও তার জন্য। বলে সে সোনার হাঁটুর কাছে পা ভাঁজ করে বসল।—আমার কত কাজ সোনা! তোরা যদি এমন করিস তবে কাজের বাড়িতে চলে?
সোনা কিছু শুনছে না মতো হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
বড়বৌ শুকনো কাপড়াটা আলগা করে আড়াল দিয়ে ভিজা কাপড়টা খুলে ফেলল। তারপর সুন্দর করে ধুতিটা কুঁচি দিয়ে পরিয়ে দিল। কাপড়টা সোনার মাপ মতো নয়। বড় বলে কিছুটা জবুথবু অবস্থা সোনার। সে নিজের কাপড়ে প্যাঁচ খেয়ে কখনও উল্টে পড়ে যেতে পারে। সেজন্য বড়বৌ কাপড়ের কোঁচাটা কোমরে গুঁজে দিল।
এবার ওরা গিয়ে বসল আচার্যদেবের সামনে। আচার্যের আসনে বসে আছেন পণ্ডিত সূর্যকান্ত। তিনি দীর্ঘ এক পুরুষ এবং সূর্যের মতোই আজ তাঁর দীপ্ত চোখ-মুখ।
তিনি যেন তিন বালককে, কঠোর চোখে দেখতে থাকলেন। হে বালকেরা তোমাদের পুনর্জীবন হচ্ছে, এমন চোখে দেখছেন। বালকদের মুখ দেখে তিনি বুজতে পারছেন, এত বেলা হয়ে গেছে, এখনও সামান্য জলটুকু পর্যন্ত ওরা খেতে পায়নি। ফলে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। এবার তিনি হাঁক দিয়ে জানতে চাইলেন, ষোড়শ মাতৃকার কতদূর, বিদ্ধি শেষ হল কিনা, না হলে এই ফাঁকে চলনের কাজ সেরে নেওয়া যেতে পারে।
পাল্কিতে বসার সময় সোনা দেখল দীপালি ওর ও-পাশে চুপচাপ উঠে বসে আছে। সোনার গলায় পদ্মফুলের মালা। কপালে চন্দনের ফোঁটা। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, হরিণের চামড়ার ওপর সে বসে রয়েছে। আর কত রকমের ফুল ছড়ানো সেই হরিণের চামড়ার ওপর। তিনটে পাল্কি যাত্রা করবে। ওরা যতদূর প্রতিদিন গ্রাম-মাঠ ভেঙে নদীর পাড়ে যায় ততদূর এই পাল্কিতে ওরা চলে যাবে।
সোনা দীপালিকে পছন্দ করে না। কারণ দীপালি ঢাকা শহরে থাকে। সে বড় বড় কথা বলে সোনাকে অযথা ছোট করতে চায়। আজ সে দেখছে সেই দীপালি সব সময় কাছে কাছে থাকতে চাইছে।
সোনা প্রায় ভিতরে বরের বেশে বসেছিল। সে দীপালির দিকে তাকাচ্ছে না। পাল্কিটা দুলছে। ওর ভয় ভয় করছিল। কিন্তু চলতে থাকলে ওর আর ভয় ভয় করল না। পিছনে বাজনা বাজছে। সানাই বাজছে। প্রতিবেশীরা সকলে নেমে এসেছে। ওরা নরেন দাসের মাঠে এসে নামল। তারপর গোপাটে। গোপাট ধরে অশ্বত্থ তলা পার হবার সময় মনে হল পাল্কি টোডারবাগের কাছে এসে গেছে।
দীপালি বলল, সোনা, আমারে দ্যাখ।
—কি দ্যাখুম?
—আমি কি সুন্দর ফ্রক পরেছি।
সোনা বলল, বাজে ফ্রক।
দীপালি বলল, তুই কিছু জানিস না।
সোনা উঁকি দিল এবার। আর তখন সে আশ্চর্য হয়ে গেল। দেখল মঞ্জুর মিঞার বড় বটগাছের নিচে অনেকের সঙ্গে ফতিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে কোন পাল্কিতে সোনাবাবু যায় দেখতে এসেছে।
বড় দ্রুত যাচ্ছিল বেহারা। নিমেষে মুখটা মিলিয়ে গেল। সোনা উঁকি দিয়েও মুখটাকে ভিড়ের ভিতর আর খুঁজে পেল না।
পাল্কিটা পাশ কাটিয়ে গেল ফতিমার। কী সব সুমিষ্ট ফুলের সুবাস ছড়িয়ে গেল। ভুর-ভুর গন্ধে চারপাশটা ভরে গেল। সোনাবাবু ফুলের ওপর বসে আছে। প্রায় যেন রাজপুত্রের শামিল। পাশে কে একটি মেয়ে। ফতিমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেছে। অভিমানে ওর চোখ ফেটে জল আসছে। সে সোনাবাবুর সঙ্গে একটা কথা বলতে পারল না।
সামুর মা সাদা পাথরের রেকাবিতে তিনটে তাঁতের চাদর এবং তিনটে আতাফল রেখে দিয়েছে। ওর কোমরের ব্যথা আবার বাড়ছে। মাঝে কিছুদিন বিছানায় পড়েছিল, এখন সে লাঠি ঠুকে চলাফেরা করতে পারছে। ঠাকুরবাড়িতে উপনয়ন। সে বাবুরহাট থেকে তিনটে তাঁতের চাদর আনিয়ে রেখেছে। এ-সব নিয়ে তার যাবার কথা। কিন্তু এই শরীরে সে যাবে কী করে! সামুর স্ত্রী অলিজানও চিন্তিত। এই উপনয়নে অথবা বিবাহে, যখন যা কিছু হয়, সামুর বাপ বেঁচে থাকতে কিছু-না-কিছু দিয়েছে। এবং সামুর বিয়েতেও বুড়ো কর্তা নারায়ণগঞ্জ থেকে পাছা পেড়ে শাড়ি আনিয়ে দিয়েছিলেন।
এমন শুভ দিনে, এমন উৎসবের সময়ে ফতিমা সোনাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারল না—ওর ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছিল খুব। সে দেখল, মা একটা সাদা পাথরের রেকাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাকে দিয়ে যে পাঠায়! ফতিমা বলল, মা, আমি নিয়া যামু। দাও আমারে।
তখন সেই পণ্ডিত সূর্যকান্ত, আচার্যদেব, ঋজু চেহারা—বয়সের ভার যাকে এতটুকু অথর্ব করতে পারেনি, নামাবলী গায়ে, সাদা গরদ পরনে এবং শিখাতে জবাফুল বাঁধা—তিনি জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন এবং সাধুভাষায় নানারকম নির্দেশাদি সহ; মানবক ক্ষৌরাদিকার্য সমাপনপূর্বক স্নান করিয়া গৈরিকাদিরঞ্জিত বস্ত্র পরিধান করিবেন। পৈতা উপলেপনাদি মোক্ষণ সংস্কারান্ত কর্ম করিয়া যথাবিধি চরু গ্রহণ করিবেন, যথা—সদাসম্পতয়ে জুষ্টং গৃহ্বামি, এই বলে তিনি আঃ আঃ আঃ যেন অগ্নেহ স্বাহা—আঃ আঃ অনেক দূরে দূরে এই উচ্চারণ প্রতিনিয়ত বাতাসে ধ্বনি তুলে গ্রামে মাঠে ছাড়িয়ে পড়ছে। ফতিমা গ্রাম থেকে নেমে গোপাটে পড়তেই সেই গম্ভীর শব্দ শুনতে পেল। যেন কোনও মহাঋষি হাজার হাজার হোমের কাষ্ঠ জ্বেলে কলসী কলসী ঘি ঢেলে দিচ্ছেন। তেমন এক পূত পবিত্র ধ্বনি ফতিমাকে আপ্লুত করছে। সে মাথায় রেকাবি আর কোঁচড়ে আতাফল নিয়ে ছুটতে থাকল।
অতঃপর আচার্যদেব বলিলেন, সমস্ত কার্য সমাপনপূর্বক একটি যজ্ঞোপবীত দক্ষিণ স্কন্ধাবলম্বনভাবে কুমারের বাম স্কন্ধে দিবে। মন্ত্রক যথা—ওঁ যজ্ঞোপবীতং পরমং পবিত্রং…এমন সব মন্ত্র সূর্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিতে লাগিলেন।
সোনা আচার্যদেবের সামনে এবার অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে বলল, ওঁ উপনয়ন্তু মাং যুগ্মৎ পাদাঃ।
আচার্যদেব বলিলেন, ওঁ উপনেষ্যামি ভবন্তম। অনন্তর আচার্য অগ্নির উত্তরদেশে গমনপূর্বক চারিটি ঘৃতাহুতি প্রদান করিলেন। তাহার পর আচার্যদেব অগ্নির দক্ষিণ দিকে দণ্ডায়মান হইলেন।
সোনার সম্মুখে যজ্ঞের কাষ্ঠ প্রজ্বলিত হইতেছিল। উজ্জ্বল অগ্নিশিখায় তাহার মুখমণ্ডল কম্পমান হইতেছে। মনে হইতেছে মুখমণ্ডলে কে তাহার দেবীগর্জন লেপন করিয়াছে। মাথায় কিরণ পড়িতেছে। সেই আদিত্যের কিরণ। ক্ষুধায় কাতর। মুখমণ্ডল বড় বিষণ্ণ। ক্লান্ত। সে দণ্ডায়মান থাকিতে পারিতেছে না। তার ঊরু কাঁপিতেছে। সে তবু আচার্যদেবের সম্মুখভাগে করপুটে দণ্ডায়মান। যজ্ঞ হইতে ধূম উত্থিত হইতেছে। ওর চক্ষুদ্বয় সহসা লাল অগ্নিবর্ণ ধারণ করিতেছে এবং সুবাসিত হোমের যজ্ঞকাষ্ঠ হইতে মন্ত্রের মতো এক অপরিচিত বোধ ও বুদ্ধি উদয় হইবার সময়ে ভিতরে কী যেন গুড়ু গুড়ু করিয়া বাজিতেছে। সোনার বলিতে ইচ্ছা হইতেছে, আমি তৃষ্ণার্ত,জলপান নিমিত্ত তৃষ্ণার্ত।
আচার্যদেব হাসিলেন। হাসিতে বিষাদ ফুটিয়া উঠিল। কৃচ্ছ্রসাধন নিমিত্ত এই উপবাস অথবা বলিতে পার সন্ন্যাস জীবনযাপন। তিনি এইবার ধীরে ধীরে ওর অঞ্জলিতে জলসিঞ্চন করিলেন। অতঃপর সেই অঞ্জলিতে স্বীয় অঙ্গুলি মিশ্রিতপূর্বক কহিলেন, বশিষ্ঠ ঋষিস্ত্রিষ্টুপ ছন্দো অগ্নিদেবতা জলাঞ্জলিসেকে বিনিয়োগ। তিনি কুমারকে অভিষেক করিলেন।
অনন্তর আচার্য মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক সূর্য দর্শন করাইলেন এবং জিজ্ঞাসিলেন, কিম নামাসি?
—শ্রী অতীশ দীপঙ্কর দেবশর্ম্মাহং ভোঃ!
আচার্যদেবের পুনরায় প্রশ্ন, কস্য ব্রহ্মচাৰ্য্যাসি?
এবার আচর্যদেব খুব আস্তে আস্তে কিছু মন্ত্র পাঠ করিলেন। সে তাহার বিন্দুবিসর্গ বুঝিতে পারিল না। সে সেই মুখের প্রতি অবলোকনপূর্বক অধোবদনে নিবিষ্ট হইল।
এভাবে সোনা যেন ক্রমে অন্য এক জগতে পৌঁছে যাচ্ছে। যা সে এতদিন দেখেছে এবং শুনেছে—এই জগৎ তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে সকালে উঠে যে সোনা ছিল, আর সে তা নেই। সে অন্য সোনা, সে পূত এবং পবিত্র। চারপাশে তার পবিত্রতার বর্ম পরানো হচ্ছে। মন্ত্র সে ঠিক ঠিক উচ্চারণ করতে পারছে না, না পারলে চুপচাপ আচার্যদেবের দিকে তাকিয়ে থাকছে। কারণ আচার্যদেব এত দ্রুত মন্ত্র পাঠ করছিলেন যে সোনার পক্ষে অনুসরণ করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। সে শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকছে। হরিণের চামড়ার ওপর সে বসেছিল। সামনে কোষাকুষি, গঙ্গাজল, হাতে কুশের আংটি এবং বিচিত্র বর্ণের সব ফুল, দুর্বা, বেলপাতা, তিল, তুলসী।
আচার্যদেব কহিলেন, আচমন কর। সোনা আচমন করিল।
আচার্যদেব কহিলেন, কুশের দ্বারা মাথায় জল সিঞ্চন কর।
সে মাথায় জল সিঞ্চন করিল।
মন্ত্র পাঠের পর আচার্যদেব সন্ধ্যা পাঠের নিগূঢ় অর্থ প্রকাশ করিলেন।
তিনি কহিলেন, একদা সন্দেহ নামক মহা বলিষ্ঠ ত্রিংশতকোটি রাক্ষস মিলিত হইয়া সূর্যের সংহারার্থে উপস্থিত হইয়াছিল। তখন দেবগণ ও ঋষিগণ সমবেত হইয়া জলাঞ্জলি গ্রহণপূর্বক সন্ধ্যার উপাসনাকরতঃ সেই সান্ধ্যোপসনাকৃত বজ্রভূত জল প্রক্ষেপ দ্বারা সমস্ত দৈত্যের বিনাশ সাধন করেন। এইজন্য বিপ্রগণ নিত্য সান্ধ্যোপাসনা করিয়া থাকেন। তারপরই তিনি কহিলেন, ওঁ শন্ন আপো ধন্বন্যাঃ শমনঃ সন্তু নৃপ্যাঃ…মরুদেশোদ্ভব জল আমাদের কল্যাণ করুক, অনুপদেশজাত জল আমাদিগের মঙ্গলপ্রদ হউক, সাগরবারি আমাদিগের শ্রেয় বিধান করুক, এবং কূপজল আমাদিগের শুভদায়ী হউক। স্বেদাক্ত ব্যক্তি তরুমূলে থাকিয়া যে প্রকার স্বেদ হইতে মুক্তিলাভ করে, স্নাত ব্যক্তি যেইরূপ শারীরিক মল হইতে মুক্ত হয়, জল আমাকে তদ্রূপ পাপ হইতে পরিত্রাণ করুক। হে জলসকল, তোমরা পরম সুখপ্রদ; অতএব ইহকালে আমাদিগের অন্ন সংস্থান করিয়া দাও এবং পরলোকে সুদর্শন পরম ব্রহ্মের সহিত আমাদিগের সম্মিলন করাইয়া দাও। স্নেহময়ী জননী যেমন স্বীয় স্তন্যদুগ্ধ পান করাইয়া পুত্রের কল্যাণ-বিধান করেন, হে জলসমূহ, তোমরাও তদ্রূপ ইহলোকে আমাদিগকে কল্যাণময় রসের দ্বারা পরিতৃপ্ত কর। হে বারিসমূহ, তোমরা যে রস দ্বারা জগতের তৃপ্তি করিতেছ, সেই রস দ্বারা আমাদিগের যেন তৃপ্তি জন্মে তোমরা আমাদিগের সেই রসভোগের অধিকার প্রদান কর।
মন্ত্রপাঠের দ্বারা সোনার মুখমণ্ডল নানা বর্ণে রঞ্জিত হইতেছিল। মাথার উপর দ্বিপ্রহরের রৌদ্র। সম্মুকে সেই হোমাগ্নি। এবং কোষাকুষিতে তাহার হাত। আর আচার্যদেব যেন নিরন্তর তাঁহার নাভি হইতে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক তাহার অর্থ ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। সোনা এইসব ক্রিয়া-কর্মাদির ভিতর এক দুয়ে রহস্যে প্রোথিত হইতেছিল।
তিনি কহিলেন, মহাপ্রলয় কালে কেবল ব্রহ্মা বিরাজমান ছিলেন। তখন সমস্ত অন্ধকারাবৃত ছিল। তদনন্তর সৃষ্টির প্রাক্কালে অদৃষ্টবশে সলিলপূরিত সাগর সমুৎপন্ন হইল। সেই সাগর-বারি হইতে জগৎ-সৃষ্টিকারী বিধাতা সজ্ঞাত হইলেন। সেই বিধাতাই দিবা প্রকাশক সূর্য ও নিশা প্রকাশক চন্দ্ৰ সৃষ্টি করিয়া বৎসরের কল্পনা করেন অর্থাৎ সেই সময় হইতে দিবারাত্রি, ঋতু, অয়ন, বৎসর প্রভৃতি যথানিয়মে প্রতিষ্ঠিত হইল।
সোনা ভাবছিল, তাহার নাম শ্রী অতীশ দীপঙ্কর দেবশর্মা। দেবশর্মা ভোঃ। ভোঃ শব্দ উচ্চারণে তাহার মনে হাসির উদ্রেক হইল। সে তাড়াতাড়ি হাসি নিবারণার্থে কহিল, সূৰ্য্যশ্চ মেতি মন্ত্রস্য ব্ৰহ্ম-ঋষি…
আচার্যদেব কহিলেন, ‘সূর্য্যশ্চ মা’ মন্ত্রের ঋষি ব্রহ্মা। প্রকৃতি ইহার ছন্দ। জল-দেবতা, এবং আচমন কর্মে ইহার প্রয়োগ হয়।…সূর্য, যজ্ঞ ও যজ্ঞপতি ইন্দ্রাদি অমরগণ অসম্পূর্ণ যজ্ঞজনিত পাপ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন। আমি রাত্রিকালে মন, বাক্য, হস্ত, পদ, জঠর ও শিশু দ্বারা যে পাপ করিয়াছি দিবা তাহা বিনষ্ট করুন। আমাতে যে পাপ আছে, তৎসমস্ত এই সলিলে সংক্রামিত করিয়া, এই পাপময় সলিল হৃৎপদ্ম মধ্যগত অমৃতযোনী জ্যোতির্ময় সূর্যে সমর্পণ করিলাম। উহা নিঃশেষে ভস্মীভূত হউক।
সোনা আর পারছে না, ওর তেষ্টা পাচ্ছে। সে বোধহয় পড়ে যেত—ফতিমা ঠাকুরঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। সে আলগাভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একা। সে নাকে নথ পরেনি। পায়ে মল পরে আসেনি। ওর লম্বা ফ্রক ঝলমল করছে এবং ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা। সোনা জানে না ওর ঠিক পিছনে এক বালিকা চুপচাপ বসে সোনাবাবুর মন্ত্রপাঠ শুনছে। যত শুনছে তত বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে। সে এইসব সংস্কৃত শব্দ জানে না। সে কোনও অর্থ বুঝতে পারছে না। অথচ কেমন এক ভাবগম্ভীর আওয়াজ এই উৎসবকে মহিমামণ্ডিত করছে। বাবু যে দাঁড়াতে পারছে না, পা কাঁপছে, সে শেফালি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে তা টের পাচ্ছিল।
সূর্যকান্ত বুঝতে পারলেন উপবাসে সোনা কাতর। তিনি তাকে এক গ্লাস জল খাবার অনুমতি দিলেন। সে এক নিঃশ্বাসে জলটুকু খেয়ে ফেলল। ফতিমার মনে হল এবার সোনাবাবু ওর দিকে তাকাবে। সে তিনটে চাদর তিনটে আতাফল এবং তিনটে আমলকী নিয়ে এসেছে। এগুলি সে মাটিতে রেখে দিলে, বড়বৌ গঙ্গাজল ছিটিয়ে ঘরে নিয়ে গেছে। গঙ্গাজল বড় দুর্লভ বস্তু। একঘটি জল এনে সেই জল শিশি করে বাড়ি বাড়ি এবং এক কলসি জলে এক ফোঁটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের মতো ব্যবহার। ফতিমা জানে গঙ্গাজল ছিটিয়ে না নিলে এই উৎসব ওদের পবিত্র থাকবে না। বড়বৌ ওকে গাছটার নিচে বসতে বলে গেছে। সে বলে না গেলেও বসে থাকত। এত কাছে এসে সে সোনাবাবুর পৈতে হচ্ছে, না দেখে চলে যেতে পারত না। সোনাবাবু কখন ওকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবে সেই আশায় অপলক তাকিয়ে আছে।
এবার ওরা পুবের ঘরে ঢুকে যাবে। এই ঘরে ঢুকলে ওরা আর তিনদিন বের হতে পারবে না। এই তিনদিনের অজ্ঞাতবাস সোনা অথবা লালটু পলটুর কাছে প্রায় বনবাসের মতো। ওরা ঘরে ঢুকে গেল। এবং দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ফতিমার দিকে সোনাবাবু একবারও তাকাল না।
ওরা তিনজন পাশাপাশি দাঁড়াল। হাতে বিল্বদণ্ড। কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি, গৈরিক রঙের একখণ্ড কাপড় কোমরে জড়ানো। প্রথমে ধনবৌ এবং বড়বৌ এল ডালা সাজিয়ে। ওরা তিনজনকে তিনটে সোনার আংটি দিল।
সোনা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ভবতু ভিক্ষাং দেহি।
ভিক্ষা দিতে গিয়ে সোনার মুখ দেখে ধনবৌ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। একেবারে ঋষি বালকের মুখ। যেন কোন অরণ্যের ছোট্ট বিহারে ভিক্ষু বিদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এমন মুখ দেখলেই ধনবৌর ভয় হয়। পাগল মানুষের কথা মনে হয়। বংশের কেউ-না-কেউ কোনও না কোনওদিন নিরুদ্দেশে চলে যাবে। সোনার মুখ ঠিক ওর পাগল জ্যাঠামশাইর মতো। সোনা মাকে দেখছে। ধনবৌ ছেলের মুখের দিকে আর তাকতে পারছে না। যেন এক্ষুনি জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলবে। লালটুর জন্য ধনবৌর এত কষ্ট হয় না। সে মায়ের পাশে শোয় না। সে আলাদা শোয়। নিজের দায়িত্ব যেন নিজেই নিতে পেরেছে। ধনবৌ সোনাকে ভিক্ষা দিয়েই তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল।
বড়বৌ তখন এক ছোট্ট হাঁড়িতে নানা রকমের মিষ্টি সাজাচ্ছিল। খুব যত্নের সঙ্গে কলাপাতা দিয়ে মুখটা বেঁধে দিয়েছে। ঈশম, এত লোকজন যে পা ফেলতে পারছে না। কখন কাকে ছুঁয়ে দেবে এই ভয়। সে ফতিমাকে নিয়ে এল। বড়বৌ ঈশমের পঙ্গু বিবির জন্য আলাদা একটা বাসনে কটা মিষ্টি তুলে রাখল। ফতিমাকে বলল, এটা নিয়ে যা। তোর নানীকে বলবি, শরীর ভালো হলে যেন একবার আসে। ওদের যেন আশীর্বাদ করে যায়। কতদিন দেখি না।
ফতিমা ঘাড় নাড়ল।
—তোর বাবা এসেছে?
—ফতিমা বলল, না।
—নিয়ে যেতে পারবি তো? না ঈশম দিয়ে আসবে?
ফতিমা বলল, পারমু।
—ফেলে দিস না কিন্তু
ঈশম মিষ্টির হাঁড়িটা ওর হাতে দিল। কিন্তু হাতে নিতে অসুবিধা। ফতিমা অর্জুন গাছটার নিচে এসেই হাঁড়িটা মাথায় তুলে নিল। তারপর যেমন সে গোপাটে নেমে এসেছিল সাদা পাথরের থালাতে তিনটে তাঁতের চাদর নিয়ে, আতাফল নিয়ে, তেমনি সে এখন মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে ছুটছে। ছুটছে আর সোনাবাবু তার দিকে তাকাল না ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। সে কতক্ষণ থেকে শেফালি গাছটার নিচে বসেছিল—একবার অন্তত দেখুক সোনাবাবু, সুন্দর ফ্রক পরে সে এসেছে, সে তার সবচেয়ে ভালো ফ্রক গায়ে দিয়ে এসেছে। সে কত কথা বলবে বলে এসেছিল অথচ সোনাবাবু একবার চোখ তুলে তাকাল না। ফতিমা এখন অভিমানে ফেটে পড়ছে। আর তখন দেখল হাজিসাহেবের সেই খোদাই ষাঁড়টা। টের পেয়েছে ছোট্ট এক বালিকা হাঁড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে। ষাঁড় তো এখন আর জীব নেই। ধর্মের ষণ্ড হয়ে গেছে। সে ফতিমাকে দেখেই শিঙ বাগিয়ে ছুটে আসছিল।
ফতিমার প্রাণ তখন উড়ে যাচ্ছে। এক চোখ কানা যণ্ডটা ওকে দেখে ছুটে আসছে। পাগলের মতো, উন্মত্তপ্রায় ছুটে আসছে। কে কাকে রক্ষা করে—তাবৎ জীবের ওপর রোষ তার। মুখের একটা দিক পুড়ে বীভৎস। চামড়া ঝুলে গেছে। যণ্ডের সঙ্গে লড়াই করতে হলে যেদিকে চোখটা নেই, সেদিকে লড়াই আরম্ভ করতে হয়। মেয়েটা হা হা করে চিৎকার করতে করতে ছুটছে, লেজ তুলে ধর্মের যণ্ড ছুটছে। পাগল মানুষ অশ্বত্থের ডালে বসে মজা দেখছেন। মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। এই দুপুরে সহসা এই চিৎকার শুনতে পাচ্ছে না কেউ। সামনে শীতের মাঠ। মেয়েটা কিছুতেই মিষ্টির হাঁড়িটা ফেলে দিচ্ছে না। প্রাণপণ সে চেষ্টা করছে গ্রামে উঠে যাবার। কিন্তু পিছনে তাকাতেই সে আর নড়তে পারল না। যণ্ডটা ক্ষেপা ঝড়ের মতো ওকে ফালা করে দেবে। ফতিমা ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।
আর কী এক জাদুর মায়া, পাগল মানুষ যেন সব জানেন, তিনি সেই গাছের ডালে বসে বুঝেশুনে কোন ফ্রন্ট থেকে ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই চালানো যায়, এই ভাবতেই মনে হল, গাছের ডাল নিচু—অনেকদূর পর্যন্ত শাখা-প্রশাখা জমিতে চলে গেছে। সে ডালে বসে হাত বাড়ালেই মেয়েটাকে তুলে নিতে পারবে! এক চোখ কানা জীব টের পাবে না কোথায় গেল সামুর মেয়েটা। ক্ষেপা ঝড়ের মতো ষণ্ডটা যেই না এসে পড়ল তিনি হাতে আলগোছে যেমন এক দৈত্য ছোট্ট পুতুল তুলে নেয়, তেমনি তুলে নিয়ে ডালে বসিয়ে দিলেন ফতিমাকে আর হা হা করে হাসতে থাকলেন। ষণ্ডটা ভীমরুল কামড়ালে যেমন এক জায়গায় ঘুরে ঘুরে ছুটে বেড়ায় তেমনি সে ছুটে বেড়াতে থাকল। আর পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ গায়ের জামা খুলে ষণ্ডটাকে নিচে দোলাতে থাকলেন। যেন তিনি যণ্ডের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছেন। তাঁর হাতের কাছে ফতিমা। কাঁপছে। চোখ বুজে আছে। মৃত্যুভয়ে চোখ খুলতে পারছে না। আর তখন মানুষটা যণ্ডটাকে নিয়ে খেলায় মেতে গেছেন। সে পা দিয়ে জামাটা দোলাতেই ওটা ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে আসে, সে জামাটা ওপরে তুলে নিলে যণ্ডটা সামনের একটা কাফিলা গাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বার বার এমন হচ্ছে। এক সময় ফতিমা চোখ খুলল। দেখল যণ্ডের মুখ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, শিঙ দিয়ে রক্ত পড়ছে আর পাগল মানুষের সঙ্গে ফতিমাও খেলাটা বড় মজার ভেবে গাছের ডালে বসে উঁকি দিতে থাকল।
ষণ্ডটা এক সময় বোকা বনে মাঠের দিকে চলে গেল।
ফতিমা এখন গাছের ডাল থেকে ইচ্ছা করলে লাফ দিয়ে নামতে পারে। কিন্তু ষণ্ডটা ভিটাজমিতে গিয়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোনওদিকে তাকাচ্ছে না। শুধু বড় অশ্বত্থ গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে।
এখন গাছের ডালে ওরা দু’জন পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দু’জনের মাঝখানে মিষ্টির হাঁড়ি। মণীন্দ্ৰনাথ হাঁড়িতে কি আছে দেখার জন্য উঁকি দিলেন। ছেঁড়া কলাপাতার ভেতর থেকে তিনি দেখতে পেলেন, সব রকমের মিষ্টি একসঙ্গে মিশে গেছে। ফতিমা হাত দিয়ে একটা বের করে মণীন্দ্রনাথের মুখের কাছে নিয়ে গেল। বলল, খাইবেন?
মণীন্দ্রনাথ হাঁ করলেন।
ফতিমা প্রথম একটা দিল। তারপর একটা। আবার একটা। দিচ্ছে আর খাচ্ছে। ফতিমার কী যে ভালো লাগছে! কৌতূহল ফতিমার এই মানুষ পাগল মানুষ, পীর না হয়ে যান না—যেন কথা ছিল এই দিনে ফতিমা যখন গাঁয়ে উঠে যাবে তখন এক ধর্মের ষণ্ড তাড়া করবে। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে—এই পীর মানুষ বুঝি জানতেন। তিনি আগেভাগে এসে অশ্বত্থের ডালে বসে আছেন। সে দেখল এবার আর একটা মিষ্টিও নেই। ফতিমা বলল, আর কি দিমু খাইতে?
মণীন্দ্রনাথ এবার হাঁড়িটা তুলে যে রসটুকু পড়েছিল চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেললেন।
ফতিমা বলল, বাড়িতে নিয়া যামু কি?
মণীন্দ্রনাথ এবার লাফ দিয়ে গাছ থেকে নেমে পড়লেন। তারপর মেয়েটাকে কাঁধে তুলে খালি হাঁড়িটা হাতে নিয়ে গোপাট ধরে হাঁটতে থাকলেন।
বাড়িতে উঠে মণীন্দ্রনাথ অর্জুন গাছটার নিচে খালি হাঁড়ি নিয়ে ফতিমার সঙ্গে বসে থাকলেন। ওরা দু’জন যেন এ-বাড়িতে অনেক দূরদেশ থেকে উৎসবের খবর পেয়ে চলে এসেছে। সবাই খেয়ে গেলে যা কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে—ওরা পাত পেতে খাবে।
ঈশম খালি হাঁড়ি দেখে অবাক হয়ে গেল। ফতিমা এবং পাগল মানুষ উভয়ের ভিতর যেন কতকালের আত্মীয় সম্পর্ক। ফতিমা মণীন্দ্রনাথকে ছেড়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ ষণ্ডটা ঠিক সেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
ঈশম বলল, তুই বাড়ি যাস নাই?
—না।
—বড়কর্তার লগে তর কি কাম?
ফতিমা দুষ্টুমি করে বলল, তাইন আমার সব মিষ্টি খাইয়া ফেলছে।
এই না যেই শোনা, ভূপেন্দ্রনাথ ছুটে এলেন। কি যে হবে! আবার মানুষটার পাগলামি বেড়ে গেল। ঈশমকে বললেন, আবার একটা হাঁড়ি নিয়ে আয় মিষ্টির। হাঁড়িটা ঈশম তুই দিয়া আয়।
মণীন্দ্রনাথ বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা!
ফতিমা বলল, তাইন মিষ্টি খাইতে চায় নাই। আমি তাইনের খাওয়াইছি।
ঈশমের মাথায় বজ্রাঘাত। সে তেড়ে গেল।—মাইয়া, তুই আর খাওয়ানের মানুষ পাইলি না। কী একটা অপরাধ হয়ে গেল। ঈশম বলল, মাইজা মামা, পোলাপান মানুষ, বোঝে না কিছু।
ভূপেন্দ্রনাথ কিছু বললেন না। বড়বৌ মিষ্টির হাঁড়ি আবার পাঠিয়েছে। ঈশম ওটা নিয়ে যাচ্ছে। পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ ফতিমাকে নিয়ে ঈশমের পিছনে হাঁটছেন। তিনি ফতিমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। বাড়ি পৌঁছে না দিলে যণ্ডটা আবার ঈশম এবং ফতিমা উভয়কে তেড়ে আসতে পারে। তিনি যণ্ডটাকে ভয় দেখাবার জন্য অর্জুনের ডাল ভেঙে নিলেন। পাতা ছিঁড়ে ডালটা মাথার উপরে পাইক খেলার মতো বারবার ঘোরাতে থাকলেন।
তখন সারাদিন পর সোনা একটু কাঁচা দুধ, গণ্ডুষ করে ঘি এবং কিছু ফল আহার করছে।
বড়বৌ ওদের দেখাশোনা করছে। সে আর বের হবে না। বাটিতে কাঁচা মুগ ভিজিয়ে রেখেছে। নানা রকমের ফল, তরমুজ ফুটি সব একটা পাথরে কেটে রেখেছে বড়বৌ।
লালটু হাপুস হাপুস ঘি খাচ্ছে। কাঁচা দুধ খেতে গিয়ে সোনার ওক উঠে আসছে। সে মধু খেল সামান্য। বেলের শরবত খেল। আর খেল দু টুকরো ফুটি। আর কিছু সে খেতে চাইছে না।
বড়বৌ নানাভাবে ওকে খাওয়াবার চেষ্টা করছে। তার কম বয়সে পৈতা। এত ছোট বয়সে পৈতা হচ্ছে বলে ওর আদর বেশি। লালটু দু’তিনবার খেঁকিয়ে উঠেছে। বড়বৌ তখন ধমক দিয়েছে ওকে। তোমার এত মাথাব্যথা কেন। আমি তো খাওয়াচ্ছি ওকে। বলে দুটো কাঁচা মুগ ওর মুখের কাছে নিয়ে গেল। সোনা আর কিছুতেই খেল না।
বড়বৌ বলল, রাতে চরু হবে। খেয়ে দেখবি ভালো লাগবে।
সোনা উঠে পড়ল। সে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল সবাই খাচ্ছে।
বড়বৌ বলল, এই, কী হচ্ছে তোমার! এ-সব দেখতে নেই। দরজা বন্ধ করে দাও।
সোনা দরজা বন্ধ করে ফের এসে জ্যেঠিমার কাছে বসল। সে ভেবেছিল ক্ষুধার জন্য পেট ভরে খেতে পারবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে আর কিছুই খেতে পারবে না। পেটে যেমন ক্ষুধা ছিল তেমনি আছে। উঠানে সবাই খাচ্ছে, সে কিছু খেতে পারছে না, মাছ এবং বাঁধাকপির তরকারির গন্ধ আসছে। জিভে জল চলে আসছিল। যত জল চলে আসছিল তত সবার উপর তার রাগ বাড়ছে। সকাল থেকে তাকে নিয়ে যে কী সব হচ্ছে।
বড়বৌ বলল, তুই সোনা যদি এটুকু খেয়ে নিস তবে একটা আতাফল পাবি। সে আতাফল খেতে ভালোবাসে। সে বলল, কই দ্যাখি।
বড়বৌ তিনটা আতাই দেখাল।—তুই যদি আর একটু খাস তবে দেব।
সোনা শেষবার চেষ্টা করল, কাঁচা মুগের সঙ্গে নারকেল দিয়ে খেতে চেষ্টা করল। কোনওরকমে পাথরের সবটুকু খেয়ে হাত পাতল।
বড়বৌ একটা আতা দিল সোনাকে। সে তিনদিনে তিনটা আতা পাবে। এই আতাফলের লোভে যেন সোনা অনায়াসে তিনদিন এই ঘরে বনবাসী হয়ে কাটিয়ে দেবে। অথবা প্রায় সবটা ওর অজ্ঞাতবাসের মতো। সব সমবয়সী আত্মীয়স্বজনেরা এসে গোল হয়ে বসেছে। দীপালি আসছে বার বার। কেউ কেউ গল্প জুড়ে দিয়েছে এবং এক সময় রাত গভীর হলে বড়বৌ একপাশে, মাঝে সোনা লালটু পলটু এবং সব শেষে পাগল মানুষ খড়ের ওপর কম্বল পেতে শুয়ে পড়বে।
ঠিক জানালার নিচে মাটির গাছা। তার উপর প্রদীপ। তিনদিন অনির্বাণ এই প্রদীপশিখা ওদের শিয়রে জ্বলবে। বড়বৌ রাতে ঘুম যেতে পারেব না ভালো করে। সলতে তুলে না দিলে কখন সলতে প্রদীপের বুকে এসে একসময় নিভে যাবে। নিভে গেলেই অমঙ্গল হবে ওদের—বড়বৌর প্রায় সারারাত জেগে থাকার মতো, লক্ষ রাখা প্রদীপ না নিভে যায়। প্রদীপ নিভে যাবার আশঙ্কায় কিছুতেই ঘুম আসে না চোখে।
তখন স্মৃতির ভিতর বড়বৌকে ডুবে যেতে হয়। বালিকা বয়সের কথা মনে হয়। যেন কোন কনভেন্টের সবুজ মাঠে সে ছুটছে। পাশে গীর্জা, গীর্জার চূড়োয় সোনালী রোদ, এবং তার ছায়ায় লম্বা আলখাল্লা পরে ফাদার দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে স্মিত হাসি। সব কিছু দেখছেন। গীর্জার ছায়ায় তাঁর অবয়ব কেন জানি বড়বৌর বড় দীর্ঘ মনে হত। তিনি বলতেন, আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর শূন্য ছিল তখন। এবং অন্ধকার জলধির উপর ভাসমান এই জগতে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক, তাহাতে দীপ্তি হইল। ঈশ্বর, দীপ্তির নাম দিবস এবং অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন। তখন বড় বেশি বালিকা বড়বৌ, বড় বেশি চঞ্চল, অথচ ফাদার গীর্জার বেদিতে উঠে দাঁড়ালেই সে কেমন গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই ঈশ্বরপ্রতিম মানুষের কথা শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে যেত। বাইবেলের প্রচীন মানব-মানবীর ভিতর হারিয়ে যাবার ইচ্ছা হতো। অথবা কোনও কোনও রাতে কেন জানি মনে হতো সেই প্রাচীন মানব-মানবী আর কেউ নয়, সে নিজে। এবং অন্য একজন মানুষ কোথাও নিষিদ্ধ ফল খাবার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে তখন। সে মাঝে মাঝে স্বপ্নে সেই মানুষের সঙ্গে নিষিদ্ধ ফল খাবার লোভে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হতো সামনে এক নীল বর্ণের নদী। পাড়ে সে এবং তার প্রিয় পুরুষটি। ফাদার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছেন। যেন তিনি আর ফাদার নন। একেবারে দেবদূত। তিনি বলছেন হাত তুলে, দেয়ার ইজ লাইট। এমন কথায় গীর্জার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বড়বৌর ঘণ্টা বাজাবার ইচ্ছা হতো। সংসারে সবাই পাগল মানুষকে ভালো করার জন্য সব কিছু করেছে, কেবল কেউ তাকে গীর্জায় নিয়ে যায়নি। বলতে পারেনি কেউ, দেয়ার ইজ লাইট। সিঁড়িতে উঠে গীর্জার সেই সুন্দর পবিত্র ধ্বনি শুনলে হয়তো তিনি আর পাগল মানুষ থাকতেন না। গীর্জার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফাদারের মতো প্রিচ করতেন। তিনি ভালো হয়ে যেতেন। তিনিও বলতেন, দেয়ার ইজ লাইট।
আবার এও মনে হয় বড়বৌর, মানুষটা এ পৃথিবীর মানুষ নয়। অন্য সৌরলোকের মানুষ তিনি তাঁকে বুঝে ওঠার ক্ষমতা কারও নেই। সংসার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন এই মানুষ নদীর পাড়ে পাড়ে বেঁচে থাকার রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন বুঝি।
এখন সেই মানুষ ঘুমোচ্ছেন না জেগে আছেন টের পাওয়া যাচ্ছে না। ওঁর জন্য দুটো আলাদা বালিশ রেখেছিল বড়বৌ। কিন্তু তিন বালক শুয়ে আছে, শিয়রে তাদের কোনও বালিশ নেই, শক্ত খড়কুটোর উপর কম্বলের উপর শুয়ে আছে এবং তদের গায়ে কম্বল, আর কিছু নেই, নেই মানে থাকতে নেই, তাদের এই কৃচ্ছ্রতার প্রতি সমবেদনা জানানো বুঝি তাঁর ইচ্ছা, তিনি বালিশে মাথা রাখেননি। আলাগ শুয়েছেন। ওদের মতো কম্বল গায়ে শুয়েছেন। বড়বৌ যতবার শিয়রে বালিশ দিয়ে এসেছে ততবার তিনি তা সরিয়ে দিয়েছেন।
সোনা ঘুমের ভিতর গায়ে কম্বল রাখছে না। সে দুপুরবেলায় কাপড় ছাড়ার সময় লজ্জায় ম্রিয়মাণ ছিল। এখন তার গৈরিক কাপড় খুলে কোথায় সরে গেছে। একেবারে সেই আদি মানব। বড়বৌ কম্বলটা ফের তুলে ওর শরীর ঢেকে দিল। এইসব কাজ তার এখন এই ঘরে। কে বালিশ রাখছে না মাথায়, কার হাত কম্বলের বাইরে এবং প্রদীপের আলো কমে গেলে বাড়িয়ে দিতে হবে—এইসব কাজের ভিতর তার রাত কেটে যাচ্ছে। পাগল মানুষ, ঘিএর প্রদীপ, ফলমূলের গন্ধ আর রাতের নির্জনতা এবং পাখিদের ডাক তাকে বার বার অন্যমনস্ক করছে। মালতী নিখোঁজ। রঞ্জিত এখন কোথায়? ওর মনে হল তখন রাত পোহাতে বেশি আর দেরি নেই। সে এবার পুবের জানালাটা খুলে দিল। সে দেখল অনেক দূরে মাঠের ওপর দিয়ে লণ্ঠন হাতে কেউ এদিকে উঠে আসছে। যেন অর্জুন গাছটার নিচে উঠে আসার জন্য প্রাণপণ হাঁটছে। কে মানুষটা! সবাই যখন এ-পৃথিবীতে ঘুমিয়ে পড়েছে এমন কি কীট-পতঙ্গ, তখনও একজন মানুষের কাজ থাকে। তার কাজ ফুরোয় না। এতক্ষণে মনে হল এ নিশ্চয়ই ঈশম হবে। সূর্যকান্ত পণ্ডিতকে বারদীর স্টিমারঘাটে তুলে দিয়ে ফিরে আসছে। এসে লণ্ঠন রাখবে দক্ষিণের ঘরে। হাত-পা ধোবে। নামাজ পড়বে। তারপর বালির চরে নেমে তরমুজ খেত পাহারা দেবে।
ঈশম বলেছিল, সাদা জ্যোৎস্নায় যখন বালির চরে পাতার ভিতর তরমুজ ভেসে থাকে এবং নদীতে যখন রাতের পাখিরা নামতে শুরু করে, দূরের মসজিদে আজান শুনলে তখন তার দু’হাত উপরে তুলে কেবল দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তার ঘুম আসে না চোখে। সে সেই এক জগতের মায়ায় জড়িয়ে যায়। নির্জন মাঠে তার তখন কেবল মনে হয়, আল্লা এক, তার কোনও শরিক নেই।
বড়বৌ বলেছিল, আমায় একবার নিয়ে যাবে? সাদা জ্যোৎস্নায় আমি তোমার তরমুজ খেত দেখব। তোমার আল্লার করুণা দেখব।
ঈশম বলেছিল, গেলে আর ফিরতে ইচ্ছা হইব না।
বড়বৌ বলেছিল, কেন আমি কি সেই মায়ায় জড়িয়ে যাব?
সাদা জ্যোৎস্না, নদীর চর এবং তরমুজ খেত আর নির্জন রাতের কোন এক দূরবর্তী আলোর মায়া বড়বৌকে টানে। কে জানত এই মায়ার টানে যথার্থই বড়বৌ এক রাতে পাগল মানুষের পিছু পিছু প্রায় সেই আদম ইভের মতো নদীর চরে নেমে যাবে।
সেটা এক বসন্তকালের ঘটনা।