২.৪
শীত পড়তে পড়তেই চন্দ্রনাথ চলে এলেন বাড়িতে। ভূপেন্দ্রনাথ আসবেন মাঘ মাসের সতেরো তারিখে। কারণ সেই তারিখে শচীন্দ্রনাথ ছাড়া পাচ্ছেন। কোর্ট-কাছারি অথবা কী করে কী যে হয়েছিল সোনা জানে না। ছোটকাকা ফিরে আসছেন। ছোটকাকা ছাড়া পাচ্ছেন এটাই এখন সুখবর। ওরা শীতের মাঠে রোদে পিঠ দিয়ে জোরে জোরে পড়ছিল।
এই শীতকালটা পড়ার চাপ কম। নতুন বই, নতুন চাদরের মতো, গায়ে দিলেই কী রকম একটা গন্ধ যেন, সোনা নতুন বই পড়তে পড়তে নাকের কাছে এনে গন্ধটা শোঁকে। নতুন বই এলেই শীতের ভোরে রোদে পিঠ দিয়ে গাছের নিচে পড়তে বসে ওরা। অর্জুনগাছের নিচে বড় একটা শতরঞ্জ পেতে দিয়ে যায় ঈশম। সকাল হলেই রোদ এসে নামে গাছটার নিচে। খুব ঘন পাতা বলে গাছের নিচে তেমন শিশির পড়ে না। ওরা সকালে মাস্টারমশাইকে ঘিরে পড়তে বসে। তখন ঠাকুমা ডালায় করে গরম মুড়ি তেলে মেখে রোদে পাঠিয়ে দেন। গাছের নিচে নরেন দাসের পেঁয়াজ খেত। লালটু কোনও কোনওদিন চুপি চুপি পেঁয়াজকলি তুলে আনে। মাস্টারমশাই যেন জানতে না পারে সে এমনভাবে যায়। কোনওদিন পলটু যায় মাঠে। শিশিরে পা ভিজে যায়। সে খেত থেকে ধনেপাতা তুলে আনে। পেঁয়াজকলির কুচি, ধনেপাতার কুচি তেলেমাখা মুড়ি, কাঁচালঙ্কা, হুসহাস ঝালের শব্দ আর পিঠে শীতের রোদ্দুর—সামনে নতুন বই, নতুন ছবি এসব মিলে সোনার এক ঐশ্বর্যভরা জগৎ। তিনজন তখন জোরে জোরে পড়ে। পড়ে না কাঁসর-ঘণ্টা বাজায় বোঝা দায়। কারণ অনেক দুর থেকে মনে হয় শীতের ভোরে কয়েকটা মোরগ লড়াই করছে।
সেই শীতের সকালে চন্দ্রনাথ বাপের পায়ের কাছে বসেছিলেন। তিনি বাপের পা টিপে দিচ্ছেন। শীত এলেই বুড়ো মানুষটার শ্বাসকষ্ট বাড়ে। কফের টানে এসময় তিনি খুব কষ্ট পান। হাত-পা-মাথা সব গরম কাপড়ে ঢাকা থাকে। ফ্লানেলের লম্বা টুকরো দিয়ে বুকে-পিঠে যেন ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। কাছে এলেই কেমন কর্পূরের গন্ধ এবং কফের গন্ধ। গলায় গরম উলের মাফলার, পায়ে গরম মোজা এবং মাথায় ফেটি বাঁধা। শ্বাসকষ্ট এত প্রবল যে জানালায় শীতের রোদ, গাছে কামরাঙা ফুল, ফুলে মধু, মধু খেতে এসেছে পাখিরা—সে-সব কিছুই তিনি টের পাচ্ছেন না। লেপ-কম্বলে শরীর ঢেকেও শীত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। পৃথিবীর সর্বত্র বুঝি তুষারপাত আরম্ভ হয়ে গেছে। পৃথিবীর শেষ উত্তাপ শেষ সুখ বুঝি কেউ হরণ করে নিচ্ছে। নতুবা সারা রাত তিনি শীতে এত কষ্ট পাবেন কেন! সারা রাত উত্তাপের জন্য আর্তনাদ করবেন কেন! খাটের নিচে পাতিলে তুষের আগুন—সারা রাত তুষের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে বড়বৌ। তবু মানুষটা উত্তাপ পায়নি। হাত-পা কী যে ঠাণ্ডা! সূর্য কি তবে পলাতক বালকের মতো সৌরজগতের অন্য কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছে। পৃথিবীকে সে সামান্য উত্তাপটুকু পর্যন্ত দিতে পারছে না। কবে একবার সূর্যোদয় দেখবেন বলে বের হয়েছিলেন আর বের হতে পারেন নি। এখন একবার যে বলবেন, অথবা তার বলার ইচ্ছা, পৃথিবীতে কি আর সূর্যোদয় হবে না! আমাকে তোমরা গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে সূর্যোদয় দেখাবে না! আমি কি সত্যি এভাবে ঠাণ্ডায় মরে যাব? তিনি বলতে পারছেন না। বললেই যেন তাঁর সন্তানেরা পায়ের কাছে এসে বসবে, যেমন এখন বসে রয়েছেন চন্দ্রনাথ, বলবে, সবুজ বনে মৃত বৃক্ষ হয়ে বেঁচে আর কি লাভ! এবারে চন্দ্রায়ণটা তবে করে ফেলি। এবং এ সময়েই তিনি শুনতে পেলেন তাঁর তিন নাতি জোরে জোরে পড়ে চলেছে। নতুন বই এলেই ওরা এভাবে পড়ে। কঠিন যা কিছু শব্দ আছে ঘুরে ফিরে বার বার পড়ে। পড়ে বুঝি জানায়, এই যে আমরা বালকেরা আছি, আমরা কত কিছু শিখে ফেলেছি, আমরা পৃথিবীর কত খবর এনে দিচ্ছি তোমাদের। তোমরা কিছু জানো না। আর নতুন বই পুরানো হলেই শরীরের মতো জরাজীর্ণ অবস্থা!—আর কতকাল পৃথিবীর জায়গা আপনি আটকে রাখবেন। এবার চন্দ্রায়ণটা করে ফেলি। তারপর বলহরি হরিবোল বলে আপনাকে আমরা নিজহাতে আপনি যে গাছ রোপণ করেছেন তার নিচে দাহ করি। আর কতকাল! শতবর্ষ পার হতে আর বাকি কি!
ফলে মহেন্দ্রনাথ গলার কাছে যে কাশিটা উঠে আসছে তা আটকে রেখেছেন। তিনি কিছুতেই ধরা পড়বেন না, ভালো নেই তিনি, ভীষণ কাশি, শরীর দুর্বল, হাত-পা ঠাণ্ডা। যেন তাঁর যথার্থই কোন কষ্টবোধ নেই। পায়ের কাছে ছেলে তাঁর বসে আছে। তিনি কত সবল দেখানোর জন্যই যেন লেপের ভিতর থেকে শীর্ণ হাতটা বের করার চেষ্টা করলেন। হাওয়ার ওপর দুলিয়ে দেখাতে চাইলেন, তিনি কত সবল আছেন, সুস্থ আছেন। চন্দ্রায়ণের সময় তাঁর এখনও হয়নি।
চন্দ্রনাথ বাপের এসব বোঝেন। মনে মনে তিনি হাসলেন। কষ্ট আর চোখে দেখা যায় না। চন্দ্ৰনাথ হাতটা আবার লেপের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, আমি চন্দ্রনাথ বাবা
—তুমি যে চন্দ্রনাথ, তা বুঝি আমি টের পাই নাই মনে কর?
একেবারে বালক হয়ে গেছেন তিনি। চন্দ্রনাথ পাছে চন্দ্রায়ণের কথা বলে, ভয়ে এমন বলছেন মানুষটা। তিনি এবার বললেন, সোনা, লালটু, পলটুর উপনয়ন দিতে চাই। মাঘ-ফাল্গুনে দিন আছে।
—তা ভাল। বলেই যে কাশিটা এতক্ষণ গলার কাছে আটকে ছিল সেটা মুখে তুলে আনলেন। তারপর কোৎ করে গিলে ফেললেন কফটা। চন্দ্রায়ণ করতে বলবে এই ভয়ে তিনি শরীর শক্ত করে রেখেছিলেন এতক্ষণ। কিন্তু ছেলে যখন বলছে উপনয়নের কথা তখন একবার উঠে বসা যায় কিনা চেষ্টা করা যাক।
—আমারে চন্দ একটু ধর। উইঠা বসতে পারি কিনা দ্যাখি।
চন্দ্রনাথ বললেন, বারান্দার রোদ নামুক, আপনেরে নিয়া যামু বারান্দায়
বুড়ো মানুষটা এবার যথার্থই প্রাণ ফিরে পেলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, ধনবৌমার দিকে লক্ষ রাইখ। সন্তানাদি পেটে। সন্তানাদি কথাটা বললেন এই জন্য যে,পৃথিবীতে এই যে একটা জগৎ মা জননীরা গর্ভের ভিতর সৃষ্টি করে রাখে,সেই জগৎ সম্পর্কে এখন তার শিশুর মতো পুলক অথবা কৌতূহল, ক্রমে ছোট হতে হতে একবারে অণুর মতো হয়ে যাওয়া, এবং সেই সৃষ্টির আঁধারে প্রবেশ করা, প্রবেশ করার আগে অন্ধকারের ভয়। একবার প্রবেশ করে গেলে ভয় থাকে না। সেই জগৎ, যেখানে তিনি কিছুক্ষণের জন্য বিচরণ করবেন। অন্তহীন নীহারিকাপুঞ্জে তার অস্তিত্ব ক্ষণে ক্ষণে নক্ষত্রের মতো আকাশের গায়ে জ্বলতে থাকবে। তারপর তিনি শিশিরপাতের মতো কোনও ঝিনুকের অন্ধকারে টুপ করে একদা ঝরে পড়বেন পৃথিবীর মাটিতে। তার জন্ম হবে আবার। আবার সেই শৈশবের খেলা আরম্ভ হয়ে যাবে এই বৃক্ষের নিচে সেই আদি অন্তহীন আঁধারের প্রতি সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার না করে পারলেন না। প্রায় যেন গৌরবে বহুবচনের মতো। সুতরাং তিনি সন্তান না বলে সন্তানাদি কথাটা ব্যবহার করলেন।
চন্দ্রনাথ বসে বসে বাবার মুখ দেখলেন। বাবার সেই মহিমান্বিত চেহারার সাদৃশ্য এই মানুষের মুখে কোথাও খুঁজে পেলেন না। কতকাল থেকে তিনি এই বিছানায় কালাতিপাত করছেন। এবং এই কালাতিপাতের সময় শরীর ক্রমে ছোট হয়ে যাচ্ছে। হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। এত হাল্কা যে চন্দ্ৰনাথ কত অল্প আয়াসে তাঁকে একটা ডলপুতুলের মতো পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে এলেন বারান্দায়। বারান্দায় যেখানে রোদ এসে নেমেছে সেখানে দু’পাশে বালিশ দিয়ে এক ছোট্ট পুতুলের মতো বসিয়ে দিলেন। বসতে পারেন না, তবু দুহাত সামনে বিছিয়ে যেমন শিশুদের ছবি তোলা হয় তেমনি তাঁকে চারপাশের বালিশে রেখে দেওয়া হল। দাঁত নেই! চোখ অন্ধ। এক বীর্যবান মানুষ এই সংসারে শতবর্ষের আয়ুতে আবার সেই আঁধারে ভ্রূণের মতো প্রবেশ করবেন। ক্রমে ভ্রূণ থেকে কীটে এবং তারপর সেই পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলে পৃথিবীর শস্যভরা মাঠে নতুন আলোক বর্ষিত হবে। তখন সাদা জোৎস্নায় উপনয়নের বালক সন্ন্যাসীরা মাথা নেড়া করে নদীর জলে দাঁড়িয়ে থাকবে। হাতের অঞ্জলিতে নদীর জল পূর্বপুরুষকে জলদান করবে। বাপের তৃষ্ণার্ত মুখ দেখে, চন্দ্রনাথের এমনই মনে হল।