প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১৮

২.১৮

দিন-দশেক পর শশীভূষণ এবং ঈশম ফিরে এল। ওরা মহাদেব সাহার লোককে সঙ্গে নিয়ে গেছে। এত বড় মানুষকে দেশ-দেশান্তরে খুঁজতে যাওয়া ভাগ্যের কথা। ওরা এসে খবর দিল, না পাওয়া গেল না।

বড়বৌ, শচীন্দ্রনাথ, এমন কী বাড়ির সবাই, ওরা ফিরে আসছে দেখতে পেয়েই পুকুরপাড়ে নেমে গেল। সেখানেই শশীভূষণ সবাইকে বললেন, না, তিনি সেখানে নেই। যাঁকে সন্দেহ করে খুঁজতে যাওয়া তিনি ছ-সাত দিন আগে কামাখ্যা দেবী দর্শনে চলে গেছেন।

—তিনি কে? বড়বৌ সহসা লোক-লজ্জার মাথা খেয়ে একদল লোকের সামনে এমন প্রশ্ন করে বসল।

—কেউ এমন কিছু খবর দিতে পারল না। বিশ্বনাথের মন্দিরে কিছু পাণ্ডাদের কথাটা বললাম। ওরা বলল, তিনি তো মৌনী-বাবা। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। প্রথম দিন এসেই পিপুল গাছের নিচে বসেছিলেন। ওঁর কি চেহারা! রাজপুরুষের মতো চেহারা। সংসারবৈরাগ্যে যেন তীর্থে চলে এসেছেন।

—ওঁর হাতে কোন কালো কালো দাগ ছিল?

শশীভূষণ বললেন, ওরা কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল, ত্রিকূট পাহাড়ের নিচে তিনি চুপচাপ পিপুল গাছের নিচে বসেছিলেন। পরনে যতদূর মনে পড়ে লালকাপড়

শচীন্দ্রনাথ বললেন, ওঁর গালে অশৌচের দাড়ি থাকার কথা।

—না, তেমন কোন অশৌচের দাড়ি ছিল না। মাথা মুণ্ডন করা। রাশি-রাশি লোক ওঁকে দেখেই ভিড় করেছিল। বোধ হয় তিনি এত মানুষের ভিড় দেখেই সেখান থেকে পালিয়েছেন।

—কিন্তু বললেন যে, কামাখ্যা দর্শনে গিয়েছেন?

—ওটা ওদের অনুমান। কেউ কিছু ঠিক বলতে পারছে না।

সবাই বাড়ি উঠে এল। মানুষটার খোঁজ পাওয়া না গেলে যা হয়, বড়বৌ আবার সেই সংসারের কাজের ভিতর ডুবে গেল। তিনি ফিরে আসবেন। যখন নিরুদ্দেশে গেছেন তখন ফিরে আসবেন।

তারপর এলেন ভূপেন্দ্রনাথ। তিনি সঙ্গে নিয়ে এলেন এক বড় তান্ত্রিক। তান্ত্রিক নখের উপর এক মায়া দর্পণ সৃষ্টি করবেন। তাতে মানুষটা কোথায় বসে আছেন অথবা হাঁটছেন দেখা যাবে। সবচেয়ে যে প্রিয় মানুষ তাঁর নখে সবচেয়ে ভালো ছবি ফুটে ওঠে। তিনি আরও কিছু খবর নিয়ে এলেন এ সময়। দেশভাগের খবর। শরৎ বসু মশাই ময়মনসিং-এ মিটিং করে গেছেন। তিনি এই দেশভাগের বিরুদ্ধে। পণ্ডিতজী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল খুব এগিয়ে গেছেন। কেবল এখন মহাত্মাজীর উপর সব নির্ভর করছে!

তান্ত্রিক থাকবেন দু’দিন। তাঁর খাদ্যদ্রব্যের বিরাট তালিকা। নিশি রাতে তিনি তন্ত্র আরাধনায় বসবেন। সুতরাং তন্ত্রাচারের যা-যা দরকার তার একটা ফর্দ করতে করতে বললেন, তবে মহাত্মাজী বাইচা থাকতে দেশভাগ হবার নয়। যা কিছু আশা এখন আমাদের তাঁর ওপর।

শশীভূষণ বললেন, যেভাবে চারপাশে দাঙ্গা হচ্ছে, কী যে হয় কিছু বলা যায় না।

তান্ত্রিকমশাইর জটা খুলে দিলে মাটিতে এসে পড়ছে। সোনা, পলটু, লালটু, এবং শোভা আবু অথবা কিরণ এবং গ্রামের ছেলেরা ভয়ে আর ওদিকে যাচ্ছে না। চোখ বড়-বড়। টোপা কুলের মতো লম্বা চোখে কাজল এবং ভস্মমাখা শরীর। লাল রঙের আলখাল্লা এবং বড় কমণ্ডুল, হাতে ত্রিশূল। ওঁর মুখে বম্-বম্ ভোলানাথ শব্দ। শশীভূষণের বড় রাগ হচ্ছিল। কারণ এই মানুষটা তাঁর ঘরে রাত কাটাবে আজ। ওঁর কেমন ভয় ধরে গেল প্রাণে। অথচ মুখে কিছুই বলতে পারছেন না। ভূপেন্দ্রনাথের উপর মনে-মনে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন। ভূপেন্দ্রনাথ যে দেশভাগের ব্যাপারে এত কথা বলে যাচ্ছেন তাঁর কথার আর একটাও জবাব দিচ্ছেন না। দিলেই যেন বলতে হয়, এগুলো যে আপনার কী হয়! যত সব আজে-বাজে লোক ধরে আনা।

ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, বোঝলেন মাস্টারমশাই, এবার ঠিক দাদার খোঁজ পাইয়া যামু।

শশীভূষণ একটা ইংরেজি বই পড়ছিলেন। তিনি সেটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। এখন নানা রকমের তিনি কথা বলবেন। এই জটাজুটধারী তান্ত্রিক মানুষ সম্পর্কে এমন ইমেজ তৈরি করবেন যে, তাঁর আর শোনার ধৈর্য থাকবে না। মাথা তাঁর গরম হয়ে যাবে। সেজন্য তাড়াতাড়ি একটা জামা গায়ে দিয়ে গোপাটের দিকে বের হয়ে গেলেন।

—একেবারে ম্লেচ্ছ। লেখাপড়া শিখলে এই হয়। যেন ভূপেন্দ্রনাথের এমন বলার ইচ্ছা।

তান্ত্রিকের কথামতো বড়বৌ সকাল-সকাল স্নান করেছে। হোমের বিবিধ-ব্যবস্থা তাকেই করতে হয়েছে। লালপেড়ে শাড়ি এবং কপালে বড়বৌ আজ অন্য দিনের চেয়ে অনেক বড় সিঁদুরের ফোঁটা দিয়েছে। তাকে সেই মানুষের সামনে চুপচাপ বসে থাকতে হবে। হোমের নানাবিধ আচারের পর বড়বৌর বাঁহাতের বুড়ো আঙুলের নখে ঘি মেখে আগুনের উপর কিছুক্ষণ ধরে তিনি বললেন, নখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন মা?

–না।

—ভাল করে দেখুন। বুড়ো আঙ্গুলটা চোখের আরও কাছে নিয়ে আসুন-এবারে নখে মায়া দৰ্পণ সৃষ্টি হবে।

—না, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

খুব গম্ভীর গলায় হেঁকে উঠলেন, ভালো করে দেখুন। দর্পণের উত্তর দিকটায় ছায়ামতো কিছু ভেসে উঠছে কিনা দেখুন।

সবাই গোল হয়ে চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। উঠানে সব গ্রামের লোক ভেঙে পড়ছে। বড়বৌ ঘামছে। রোদ এসে ওর কপালে পড়েছে। সিঁদুর গলে গিয়ে সারা মুখ লাল। বড়বৌ কাঁপছিল!

–দেখতে পাচ্ছেন?

—দেখতে পাচ্ছি।

—কী দেখতে পাচ্ছেন?

—তিনি হেঁটে যাচ্ছেন।

—কোন্ দিকে?

—উত্তরের দিকে।

—তারপর কী দেখছেন?

—একটা গাছের নিচে বসলেন।

—এখন কী করছেন?

—কিছু না।

—কিছু দেখতে পাচ্ছেন আর?

—কিছুই না। হ্যাঁ, একটা আমবাগান মনে হচ্ছে।

—আর কিছু?

–চারপাশে কত লোক বসে রয়েছে।

—আর কিছু?

—সবাই ওঁর কাছে কিছু চাইছে।

—কাউকে কিছু বলছেন না?

—না।

—এবারে দর্পণের পশ্চিমদিকে তাকান। কেউ ওঁর দিকে হেঁটে আসছে মনে হয় না?

—একজন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী।

— সে কে?

—আপনার মতো মুখ।

—না-না, আমার মতো মুখ হবে কেন? ভাল করে দেখুন।

বড়বৌ কিছু আর বলতে পারল না। মাথা ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে। সবাই ধরাধরি করে ওকে তুলে নিয়ে পুবের ঘরে শুইয়ে রাখল।

সোনার মনে হল, এক লাথি মারে সবকিছুতে। সে সন্তর্পণে ভিড়ের ভিতর থেকে ওর কমণ্ডুল চুরি করে নিয়ে ঘাটের জলে ডুবিয়ে রাখল। খোঁজ এবার। দেখাও বাবু তোমার কত হিম্মৎ, নিরুদ্দেশে গেছে কমণ্ডুল। বের কর খুঁজে।

বিকেলের দিকে কমণ্ডুল খুঁজতে গিয়ে তান্ত্রিক মানুষ দেখে ওটা ওর থলের ভিতর নেই। কে নিল সারা বাড়ি হৈচৈ খোঁজাখুঁজি। সারা বাড়িতে কেউ বলতে পারল না কমণ্ডুল হেঁটে-হেঁটে কোথায় চলে গেছে। সোনা বলল, আমি বলতে পারি মাস্টারমশয়।

—কোথায়?

—দাঁড়ান। বলে সে নখ নিজে দেখে বলল, মনে হয় কমণ্ডুল হেঁটে যাচ্ছে।

—কোনদিকে?

—পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে।

—তারপর?

—টুপ। জলে ডুবে গেল।

মাস্টারমশাই এবং সোনা উভয়ে হেসে উঠল। যা, বের করে দিয়ে আয়। নয়তো আবার তোকে ছোটকর্তা মারবে। তান্ত্রিক ব্যাটা বড় ফাঁপরে পড়ে গেছে।

সোনা বলল, আমার একা যেতে ভয় লাগে।

—কোথায় ডুবিয়ে রেখেছিস?

—আমগাছটার গোড়ায় যে ঘাট তার ডান দিকে শ্যাওলার নিচে।

শশীভূষণ কমণ্ডুল তুলে এনে তান্ত্রিকমশাইর সামনে রেখে চুপি-চুপি বললেন, ভড়ংবাজি ছাড়ুন।

বেশি বাড়াবাড়ি করলে ছাল চামড়া তুলে নেওয়া হবে।

তান্ত্রিক মানুষটি মুখ গম্ভীর করে ফেলল।

পরদিন সকালে সবাই দেখল মানুষটি নেই। দুপুররাতে চলে গেছে কাউকে না বলে।

ভূপেন্দ্রনাথ ভয় পেয়ে গেলেন। কোথায় কী অনিয়ম হয়েছে, তিনি না বলে চলে গেলেন। এসব মানুষের রোষে পড়লে নানাভাবে অমঙ্গল দেখা দিতে পারে সংসারে। সেজন্য সারাদিন ভূপেন্দ্ৰনাথ বড়ই বিমর্ষ থাকলেন।

তার কিছুদিন পরই সোনা বের হল জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে। সবশেষে সে একবার চেষ্টা করে দেখছে।

সে সকাল-সকাল দুটো খেয়ে নিল। মাকে সে কিছু বলল না। সে দুটো বঁড়শি নিল। নদীর জলে মাছ ধরতে যাচ্ছে বলে বের হয়ে গেল। কারণ, এখন নদীতে জল কম। সোনা বঁড়শিতে ভালো মাছ ধরতে পারে। এখন বেলে মাছেরা বর্ষার জল পেলেই উঠে আসবে। খুব বড় নয়। ছোট-ছোট বেলে। সে বঁড়শি এবং একটা ঘটি সঙ্গে করে মাঠে নেমে গেল। ওর শরীরের সেই রুগ্‌ণ ভাবটা কেটে গেছে। এখন সে খুব তাজা। সামনে সব মাঠ আছে। মাঠে পাট গাছ ওর বুক সমান। দু’দিন যেতে না যেতেই সব পাট ওর মাথার উপর উঠে যাবে। উঠে গেলে তাকে কেউ আর দেখতে পাবে না। তাজা পাট গাছের নিচে সোনার রুগ্‌ণ ভাবটা একেবারে মুছে যাবে।

গোপাটে নেমেই মনে হল ফতিমা এখনও ঢাকায় যায়নি। ফতিমাকে সে সঙ্গে নিতে পারে। কিন্তু ফতিমা হয়তো যাবে না। সে বড় হয়ে গেছে। ফতিমা বড় হয়ে গেছে। সে একা-একা কোথাও এখন চলে যেতে পারে, কিন্তু ফতিমা পারে না। তবু কেন জানি সে যে জ্যাঠামশাইকে মাছ ধরার নাম করে খুঁজতে বের হচ্ছে সেটা একবার ফতিমাকে না জানালে যেন নয়। কারণ, কেন জানি সোনার অসুখের ভিতর বার-বার মনে হয়েছে সে না গেলে জ্যাঠামশাই ফিরে আসবেন না। তাকে দেখলেই জ্যাঠামশাই ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর থেকে উঠে আসবেন। এই যে সোনা, আমি। এতদিন সবার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছি, কিন্তু তোকে দেখে আর থাকতে পারলাম না। চল, বলে তিনি সোনার কাঁধে হাত রাখবেন। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখবে, সোনা জ্যাঠামশাইকে নিয়ে ফিরছে। জ্যেঠিমা সোনাকে নিশ্চয়ই তখন আশীর্বাদ করবে। সোনা, তুমি বড় ভালো ছেলে, তুমি দীর্ঘজীবী হও। সোনাকে কেউ আদর করে বললে সে সবকিছু তার জন্য করতে পারে। আর এ তো তার পাগল জ্যাঠামশাই। জ্যাঠামশাইকে সে বন জঙ্গলে ঢুকে ডাকলে তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারবেন না। ঠিক হাসি-হাসি মুখটি নিয়ে উঠে দাঁড়াবেন। এসে গেছিস! আমি তোর জন্যই বসেছিলাম। আরও কত কিছু ভাবে সোনা। মনে হয় তার জ্যাঠামশাইকে কেউ তেমন করে খোঁজেনি। খুঁজলে একটা মানুষকে পাওয়া যায় না এটা তার বিশ্বাস হয় না। সে থাকতে না পেরে একা-একা ট্যাবার পুকুরপাড়ে চলে যাচ্ছে। কারণ সোনার বার-বারই যে ঝোপ-জঙ্গলের কথা মনে হয়েছে সেটা ট্যাবার পুকুরপাড়ে, সেই বৃক্ষ, বৃক্ষ তুমি কার? রাজার! এখন কার? তোমার। আমার হলে তুমি বল আমার পাগল জ্যাঠামশাই কোথায় বসে আছেন? তাকে তুমি খুঁজে আনো। চল, তুমি আমার সঙ্গে তাঁকে খুঁজবে।

সেই গাছটির কথা মনে হল, গাছ তো নয়, বৃক্ষ। বড় ডালপালা মেলে দিয়েছে আকাশে। আর সেই অজস্র শকুন কোনওটা উড়ছে, কোনওটা মগডালে বসে ঘুমোচ্ছে। কোনওটা শিকার কোন দিকে, বাতাসে গন্ধ আসছে কি-না, এই ভেবে গলা বার করে বসে আছে। সোনার দৃশ্যটা মনে হলেই ভয় হয়। কত বড়-বড় সব হাড়, মানুষের অথবা মাছের। সে হাড় ঠিক চিনতে পারে না। বড় হাড় হলেই মানুষের মনে হয়। সেই সব হাড়, মরা ডাল ডিঙিয়ে যেতেই তার যা ভয়। ফতিমা সঙ্গে থাকলে কিছুতেই ভয় থাকে না। সারা মাঠে পাট গাছ। এদিকের জমিতে আগে চাষ করা হয়েছে বলে সে কখন টুপ করে ডুবে গেল পাটের জমির ভিতরে। এবং গিয়ে যখন দাঁড়াল অন্য পাড়ে, ঠিক সামনে সেই পেয়ারা গাছ ফতিমাদের। সে কারও সাড়া পাচ্ছে না। কেমন নিঝুম বাড়িটা। নিঝুম থাকারই কথা। ওর নানী চলাফেরা করতে পারে না। ঘরের ভিতর চুপচাপ বসে থাকে। চোখে ভালো দেখে না। অথবা সারা বিকেল মাদূরে শুয়ে ঘুমায়। ধনু শেখ সারাদিন মাঠে থাকে। ওদের বাড়িটার পরে হাজিসাহেবের বাড়ি কেউ বড় আসে না এ-বাড়িতে। কারণ, সংসারে যে মানুষ থাকলে কথাবার্তা বলা যায় তেমন মানুষ বলতে এক ফতিমা। সে সারাক্ষণ বই নিয়ে একটা আলাদা ঘরে শুয়ে থাকে, পড়ে। কখনও কখনও ডাকলে সে নানীকে সাড়া দেয়। আজকাল আবার সে পড়ায় এত মনযোগী হয়ে উঠেছে যে নানী ডাকলেও বিরক্ত হয়। আমি তো নানী এ-ঘরে বসে আছি। তুই আমারে বারে বারে ডাকলে পড়া হয়! ফলে নানী তাকে ডাকে না। সোনা সে-ঘরটা চেনে। সে চুপি-চুপি ডাকল, এই ফতিমা!

ফতিমা চিত হয়ে পড়ছিল। ওর এই বয়সে চুল কত বড়। সে বুকের ওপর বই রেখে পড়ছে। স্কুল খুললেই পরীক্ষা। সে পড়ায় ফাঁকি দেয় না। কিন্তু সোনাবাবুর মুখ জানালায় উঁকি দিতেই বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। সে তার পড়ার কথা ভুলে গেল।

ফতিমা বলল, আপনে, সোনাবাবু!

—আমি ভাবলাম তর লগে একবার দেখা করে যাই।

—কই যাইবেন?

—জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে যাচ্ছি।

—একলা?

—কে আর যাবে সঙ্গে। সবাই খুঁজে দেখেছে, পায়নি। এবার আমার পালা।

—আমাকে সঙ্গে নেবেন?

—যাবি তুই! তোর নানী বকবে না?

—টের পাইলে ত। বলেই খড়ম পায়ে নেমে এল। ফতিমার এটা শহরে থেকে হয়েছে। সারা দিন লাল রঙের খড়ম পরে থাকে। নীল রঙের স্ট্র্যাপ খড়মে। সে হাঁটলেই কেমন খট-খট শব্দ হয়। সোনার এটা কেন জানি পছন্দ হয় না। মেয়েরা জুতো পরে সে সেটা মুড়াপাড়ায় দেখেছে। অমলা কমলা জুতো পরত। সেবারই যে গেল ওরা, আর ওদের যাওয়া হল না। কী যে কারণ সোনা জানে না। আর নৌকা আসত না মুড়াপাড়া থেকে। ওরা যেতে পারত না। পরে সে যা শুনেছে তা সত্যি নয়—কারণ, সে বিশ্বাসই করতে পারে না। এত বড় বাড়ির আদায় পত্র কমে গেছে। মহালে তেমন আদায়পত্র নেই। বাবুদের বড় বড় কারবার ছিল। ঋণসালিশি বোর্ড ওদের আদায়পত্র কমিয়ে দিয়েছে—সে বিশ্বাস করতে পারত না। ওর কেন জানি মাঝে মাঝে অমলাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু সে এতটুকু ছেলে অমলার কাছে কী লিখবে! কিছু লিখতে গেলেই মা বকবে। এসব কী পাকামি তোমার সোনা। তুমি চিঠি লিখছ অমলাকে।

ফতিমা বলল, এদিক দিয়া আসেন।

ফতিমা খালি পায়ে পা টিপে টিপে একবার নানীর ঘরে উঁকি দিল। দেখল নানী একটা মাদুরে কাঁথা পেতে শুয়ে আছে। সূর্য মাথার উপর না উঠতেই নানী খেয়ে নেয়। সেও তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়েছে। ওর সামনে তারপর থাকে অফুরন্ত সময়। সে মাঝে-মাঝে পেয়ারা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। দূরে অর্জুন গাছের নিচে কোনও ছায়া-ছায়া কিছু দেখা দিলেই তার মনে হয় সোনাবাবু দাঁড়িয়ে আছে। সে তখন আর স্থির থাকতে পারে না। জন্মাষ্টমীর মিছিলে সোনাবাবুর জন্য যা-যা কিনে রেখেছিল, সেইসব দিতে চলে আসে। এবার সে কিছু আনতে পারেনি। কেবল ঢাকা থেকে ফিরে এসেছিল সোনাবাবুকে দেখতে পাবে এই ভেবে। ফতিমা যত বড় হচ্ছে কেন জানি এই গাছপালা পাখির ভিতর সোনাবাবুর সুন্দর নীল রঙের জামা, লম্বা-লম্বা হাত-পা বড় তার ভালো লাগে। আর চন্দনের গন্ধ শরীরে–শহরে চলে গেলেও তার মনে হয় নাকে গন্ধটা লেগে রয়েছে। এমন পবিত্র গন্ধ সে যেন আর কোথাও পায় না। সুতরাং সে এই সুযোগ ছেড়ে দিলে আর সময় হবে না, মনে মনে সেও জানে বড় হয়ে গেলে আর মাঠে-ঘাটে একা নেমে আসতে পারবে না।

ওরা মাঠে নামতেই পাট গাছের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। জমির আলে ওরা ছুটছে। শাড়ি পরায় ফতিমাকে সোনার চেয়েও লম্বা মনে হচ্ছে। পাট গাছের নিচে থাকলে তারা টের পাবে না কোন দিকে যাচ্ছে। সুতরাং মাঝে-মাঝে গাছ ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে ওরা ঠিকমতো যাচ্ছে কি-না। সেই খাল। দালানবাড়ির খাল তারপর কিছু ধানের জমি। ধানের জমির ওপর দিয়ে গেলে ওরা ধরা পড়ে যাবে, ওরা একটু ঘুরে আলে-আলে পাটের জমি ভেঙে উঠে যেতে থাকল।

ফতিমা ডাকল, এই সোনাবাবু।

সে দাঁড়াল। পিছন ফিরে তাকাল। দেখল ফতিমা ধীরে ধীরে হাঁটছে। আয়। দেরি করিস না?

—এত তাড়াতাড়ি ছুটছেন ক্যান?

—ফিরতে দেরি হলে মা বকবে।

–কেউ বকবে না। কি সুন্দর পাটগাছ, না সোনাবাবু?

—খুব সুন্দর। তুই আয়।

—আপনের লগে আমি হেঁটে পারি। আপনে পুরুষমানুষ না?

সোনা এবার দাঁড়াল। সত্যি ফতিমা কেন পারবে? সে বলল, তুই নাকে নথ পরে থাকিস না কেন?

—নথ পরলে আমাকে দেখতে ভাল লাগে?

—খুব ভাল লাগে না। তবে না পরলে খারাপ লাগে। তোর পায়ে মল নেই। ঝুমঝুম শব্দ হয় না আগের মত!

—এখন বড় হয়েছি না! ঝুমঝুম বাজলে লোকে টের পাবে সোনাবাবুর লগে ফতিমা যায়। লোকে পাপ ভাবতে পারে।

সোনা বলল, অঃ পাপ! তা চলে আয়। পাপ ভাবলে পাপ। আমরা তো কিছু পাপ করছি না।

—আমার হাত ধরবেন সোনাবাবু?

—তোর হাত! দেখি কেমন?

সোনা হাতটা নিয়ে দেখল। এগুলো লাল-লাল কি মেখেছিস ছিট-ছিট?

–মেহেদি পাতার রং।

—মাখলে কি হয়?

—কি আবার হবে! বাড়ি এলেই মাখতে ইচ্ছা করে।

সোনা বলল, তোর বাবা বকে না?

—বকবে কেন?

—তুই চোখে বড় লম্বা কাজল দিয়েছিস। তোর চোখ ছোট। বড় চোখে কাজল মানায়। ছোট চোখে মানায় না।

ফতিমার কেমন ভিতরে-ভিতরে অভিমান হল। অভিমানে সে বলল, হাঁটেন, তাড়াতাড়ি ফিরতে হইব। বলেই ওরা দেখল সেই গাছের নিচে এসে গেছে। গাছের নিচটা পার হয়ে যেতেই যা ভয়। তারপর লতা-পাতার ঝোপ। বৃষ্টি হওয়ায় ঝোপজঙ্গল সবুজ হয়ে গেছে। ওরা দু’জনই জোরে-জোরে ডাকল, জ্যাঠামশয় আছেন? আমি সোনা।

ফতিমা বলল, জ্যাঠা আছেন! আমি ফতিমা। আপনাকে নিতে এসেছি।

কোনও সাড়াশব্দ নেই। ঘুরে-ফিরে ওরা কোথাও ডেকে-ডেকে সাড়া পাচ্ছে না। ওরা দু’জন দু’দিকে খুঁজছে। এই অঞ্চলে খুঁজে আবার ওরা ছুটতে আরম্ভ করবে। কারণ, যদি হাসান পীরের দরগায় ওঁকে পাওয়া যায়! ওখানে গেলেই দরগার ভিতর অথবা, যেসব ভাঙা মসজিদ এবং পাঁচিলঘেরা কবরের ঘর আছে সেখানে খুঁজে দেখলে পাওয়া যেতে পারে। ফতিমা ডাকতে ডাকতে পুকুরের উত্তর পাড়ে চলে গেছে। সোনাবাবুর ডাক সে এখান থেকে শুনতে পাচ্ছে না। সে ভাবল ডাকবে, সোনাবাবু আপনে আর বেশি দূর একা-একা যাইয়েন না। কিন্তু অভিমান ওর ভিতর বাজছে। কেবল অবহেলা। সে সুন্দর করে আজকাল চুল বাঁধতে শিখেছে। সে কপালে সেই কাঁচপোকা পরে থাকে। যা সোনাবাবু এক বর্ষায় ওর জন্য ধানখেত থেকে তুলে রেখেছিল। এখনও সেই কাঁচপোকা কী উজ্জ্বল! সে যে এমন সুন্দরভাবে সেজে বসে থাকে তার জন্য কোন টান নেই সোনাবাবুর। একবার বলল না, কী রে ফতিমা, সেই কাঁচপোকাটা তুই যত্ন করে রেখে দিয়েছিস? সে ভাবল, না আর ডাকবে না। অথবা কথা বলবে না। সে এসেছে পাগল মানুষটাকে খুঁজতে। তাকে খুঁজেই চলে যাবে।

কিন্তু এতক্ষণ হয়ে গেল কোনও সাড়াশব্দ নেই সোনাবাবুর। কী ব্যাপার! কোনও ডাক শুনতে পাচ্ছে না। কেমন নিঝুম হয়ে গেছে বনটা। বনের ভিতর সোনাবাবু হারিয়ে গেছে ভেবে ফতিমার বুক কেঁপে উঠল।

এখন জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ের গরম। সাপ-খোপের খুবই উপদ্রব এই প্রাচীন বনে। কতকালের সেই সব বনজঙ্গল কে জানে! বড় কড়ুই গাছের নিচে কত সব মৃত ডাল। আর চারপাশে এত বেশি লতাপাতা যে, একটু দূরে গেলেই কিছু দেখার উপায় নেই। সে এবার অভিমানের মাথা খেয়ে সামনের যত ডালপালা ফাঁক করে ডাকতে থাকল, সোনাবাবু, আপনে কোনদিকে?

না, কেউ উত্তর দিচ্ছে না। কারও কোনও সাড়া নেই।

ফতিমা আরও দক্ষিণে ছুটতে থাকল, সোনাবাবু আপনি কথা বলছেন না কেন?

সব নিঝুম এমন কী পাতার খস্থস শব্দ শোনা যাচ্ছে না। এত যে শকুন বসে রয়েছে মগডালে ওরা পর্যন্ত পাখা নাড়ছে না। কেবল কক্কক্‌ একটা শব্দ হচ্ছে। তক্ষকের ডাকের মতো শব্দটা ওকে চারপাশ থেকে গিলতে আসছে।

—সোনাবাবু, আমি এখন কী করি!

কক্কক্‌ শব্দটা থেমে গেছে। অন্য এক দ্রুত শব্দ। সে দৌড়াচ্ছে। যেন বালিকা বনে পথ হারিয়ে ফেলেছে। পাগলের মতো ডাকছে, আমি সোনাবাবু আপনার উপর রাগ করিনি! এই দেখুন, আমাকে দেখুন। আপনি কেন যে ওদিকে খুঁজতে গেলেন!

না, সে আর পারছে না। ছুটে ছুটে ক্লান্ত। এ-পাশের ঝোপটা নড়ছে। সে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল। না কিছু নেই। দুটো ছোট্ট বানর বসে রয়েছে ডালে। ওরা লাফালাফি করছে।

—আমি মরে যাব সোনাবাবু। আপনি কাছে না থাকলে আমি মরে যাব। বলে শিশুর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকল ফতিমা।

সোনা আর পারল না। সে ঝোপ থেকে উঠে এসে ফতিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল।

—তুই বোকার মত কাঁদছিস?

—আপনি আমাকে ভয় দেখালেন কেন? বলতে-বলতে হেসে ফেলল।

ওরা দু’জন এত কাছাকাছি, আর কী সুন্দর উভয়ের চোখ—এখন মনেই হয় না যাবতীয় পৃথিবীতে কোনও গণ্ডগোল আছে। ওরা পরিশ্রান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে বসল। তারপর ধীরে-ধীরে সোনা বলল, আমার জন্য তোর খুব মায়া না?

ফতিমা বলল, আপনাকে বেশি দিন না দেখলে মনটা আমার কেমন করে! বলে আবার হাত দুটো ঘাসের ওপর বিছিয়ে দেখাল, দু’হাতে দুটো পদ্মফুল এঁকেছি সোনাবাবু। দেখেন কী রকম দেখতে।

—বাড়িতে বসে-বসে বুঝি এই করিস?

—নোখে লাল রং দিয়েছি আপনি দেখবেন বলে।

কী অকপট আর সরল ওরা। ওদের এই ভালো লাগার ব্যাপার গাছের নিচে দুটো ছোট্ট পাখির মতো, অবিরাম কাছাকাছি থাকা, একটু দেখা, তারপর ছোটা, ছুটে-ছুটে সেই মানুষটাকে খোঁজা, যে বনের ভিতর ভালোবাসার খোঁজে নিখোঁজ হয়ে গেছে।

সোনা বলল, এ বনে জ্যাঠামশাই নেই। হাসান পীরের দরগায় যাবি?

—চলেন।

—ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

—তা হউক।

ওরা দরগার মাটিতেও পাগল জ্যাঠামশাইকে খুঁজেছিল। কোথাও কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সে কবরের পাশে পাশে ডেকে গেল, না কোনও সাড়া নেই। ওরা দেখল তখন কিছু কালো মেঘে আকাশ সহসা ছেয়ে গেল। এবং বৃষ্টি পড়তে থাকল। বর্ষা এসে গেছে এদেশে। একটা লোক দূর দিয়ে যাচ্ছে। সে বলতে-বলতে যাচ্ছে, বাংলাদেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ওর মাথায় এক অদ্ভুত রঙের নিশান। সে একা। সে বলতে-বলতে যাচ্ছে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ এবার আলাদা হয়ে যাব।

সোনা বলল, কী বলছে রে লোকটা?

ফতিমা এ-সব ব্যাপারে সোনার চেয়ে বেশি খবর রাখে। সে অসহায় চোখে সোনার দিকে তাকিয়ে থাকল। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। ওরা সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে আর অনবরত একজন মানুষকে খুঁজছে—যিনি এক অদ্ভুত ভালোবাসার মায়ায় এই সব গাছপালা পাখির ভিতর নীলকণ্ঠ পাখি খুঁজে বেড়াতেন।

সোনা সেই রাতে বাড়ি ফিরে এসে সব শুনেছিল। শশীভূষণ কাগজ পড়ে সবাইকে শোনাচ্ছেন। ভূপেন্দ্রনাথ মুড়াপাড়া থেকে কাগজ নিয়ে এসেছেন—তাতে লেখা, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বেতার বক্তৃতা—আমার আলোচনার মধ্যে প্রথম প্রচেষ্টা ছিল, মন্ত্রী মিশনের ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে তারিখের প্রস্তাবটি সম্পূর্ণভাবে গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করা। ঐ প্রস্তাবটিকে অধিকাংশ প্রদেশের প্রতিনিধিরাই মেনে নিয়েছেন এবং আমার মনে হয়, ভারতের সমস্ত সম্প্রদায়ের স্বার্থের পক্ষে এরচেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কিছুই হতে পারে না। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, মন্ত্রী-মিশনের কিংবা ভারতের ঐক্যরক্ষার অনুকূলে অন্য কোনও পরিকল্পনা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। কিন্তু কোনও একটি বৃহৎ অঞ্চল, যেখানে এক সম্প্রদায়ের লোকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে অঞ্চলে তাদের বলপ্রয়োগে অন্য সম্প্রদায়ের প্রাধান্যবিশিষ্ট গভর্নমেন্টের অধীনে বাস করতে বাধ্য করবার কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। বলপ্রয়োগে বাধ্য না করবার যে উপায় আছে, সেটা হল অঞ্চল বিভক্ত করে দেওয়া।

শশীভূষণ বললেন, শেষপর্যন্ত পার্টিশানই ঠিক হল?

শচীন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক ছিলেন। বললেন, কিছু বললেন?

—তা হলে কপালে পার্টিশান আমাদের।

—তাই মনে হয়। শচীন্দ্রনাথকে বড় ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

সোনা যে সারাদিন বাড়ির বাইরে ছিল কারও খেয়াল নেই। কারণ, দুপুরেই এসব খবর নিয়ে এসেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ। শচীন্দ্রনাথ বাড়ি ছিলেন না। শচীন্দ্রনাথ বাড়ি এলে শশীভূষণ পড়ে-পড়ে শোনালেন। সারাটা দিন বাড়িতে এ-নিয়ে একটা উত্তেজনা গেছে। ঈশম বসে বসে কেবল শুনছে। সে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। সে এইটুকু বোঝে, দেশ ভাগ হলে, এ-দেশটার নাম পাল্টে যাবে। পাকিস্তান হবে। বাংলাদেশের নাম পাকিস্তান—ঈশমের কষ্ট হয় ভাবতে। আর একটা অংশ হিন্দুস্থানে চলে যাবে। এটাও ওর মনে কেমন একটা দুঃখের ছাপ বহন করছে। এত বড় বাংলাদেশের নিজস্ব বলতে কিছু থাকবে না। এটা সামু করছে। ওর সঙ্গে দেখা হয় না। দেখা হলে যেন সে বলত, কী লাভ তর, দেশটারে ভাগ করে দুই দেশের কাছে ইজারা দিলি!

বিষয়টা সোনা ঠিক বুঝতে না পেরে সে কিছুটা শুনে উঠে গেল। ওর এ-সব শুনতে ভালো লাগে না। ছোটকাকার মুখ কী গম্ভীর! মেজ জ্যাঠামশাই সারাদিন কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন বিছানায়। গ্রামের লোকজন সব আসছে যাচ্ছে। ওদের মুখ ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে।

মা বলল, সোনা, তর বঁড়শি কই? মাছ পাইলি?

সে বঁড়শি নিয়ে গেছে, সঙ্গে একটা পেতলের ঘটি ছিল মাছ রাখার—সে এখন এসব কোথায় ফেলে এসেছে মনে করতে পারে না। তবু যতটা মনে পড়ছে ফতিমাদের বাড়িতে সে ঘটি এবং বঁড়শি রেখে গল্প করছিল। ওদের বাড়িতে থাকতে পারে। কাল সকালে সে অথবা ঈশম গিয়ে নিয়ে আসবে। সে মাকে বলল, মা, মাছ পাই নাই। ফতিমাদের বাড়ি গেছিলাম। ওর নানীর খুব অসুখ। দেখতে গেছিলাম। সোনার আজকাল কারণে-অকারণে দুটো একটা মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস হয়েছে। ধনবৌ সোনাকে আর কিছু বলল না। কারণ তারও মনটা ভালো নেই।

পরদিন ফতিমা নিজেই এসেছিল ঘটি এবং বড়শি নিয়ে। সোনা ওর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে অর্জুন গাছটার নিচে চলে গেছে। সে বলল, দেশ ভাগ হলে আমরা চলে যাব!

—কোনখানে যাইবেন?

—তা জানি না। মাস্টারমশয় কইছে ওদের দেশটা হিন্দুস্থানে পড়বে। বাবা জ্যাঠামশাই কেউ থাকবেন না।

—কেন থাকবেন না। ফতিমার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল।

—জ্যাঠ্যামশাই খেতে বসে বলেছেন, এদেশে থাকলে নাকি আমাদের মান-সম্ভ্রম থাকবে না।

ওরা আর উভয়ে কোনও কথা বলতে পারল না। গাছের নিচে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। সামনে সেই ফসলের জমি, জমিতে শুধু পাট গাছ—কী সজীব! আর এই পরিচিত পুকুর, শাপলা ফুল, অর্জুন গাছ, ঠাকুরদার চিতার উপর শানবাঁধানো বেদী এবং বর্ষাকালে নদীর জল সোনাবাবুর বড় প্রিয়। শীতের মাঠ, তরমুজের জমি সব ফেলে চলে যেতে পারবেন সোনাবাবু! কষ্ট হবে না! মায়া হবে না এসব ভালোবাসার সামগ্রী ফেলে যেতে! ফতিমার চোখ দেখলে এখন শুধু এমনই মনে হবে। সে এমনই যেন সোনাকে বলতে চায়।

সোনার ইচ্ছা করছিল না কথা বলতে। সোনার ভারি অভিমান হচ্ছে ফতিমার উপর। দেশভাগের জন্য ফতিমার বাবাই যেন দায়ী। সে বলল, আমার কেবল জ্যাঠামশাইর জন্য কষ্ট হবে। তিনি এখনও এলেন না। কোথায় যে গেলেন। তাঁকে ফেলে আমরা কোথায় যাব! আমরা চলে গেলে যদি তিনি আসেন, তুই বলে দিস আমরা হিন্দুস্থানে চলে গেছি। বলবি ত?

ফতিমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কেবল জ্যাঠামশাইর জন্য সোনাবাবুর কষ্ট হবে। ওর জন্য কষ্ট হবে না সোনাবাবুর। কিন্তু চোখ ঝাপসা বলে সে সোনাবাবুর দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। তাকালেই ধরা পড়ে যাবে। ধরা পড়লে তিনি নির্বিকার থাকবেন। খুব বেশি বললে হয়তো বলবেন, তোর আবার কান্নার কি হল! সুতরাং সে মুখ ফিরিয়ে রাখল। এবং নদীর জল পাটের জমি দেখতে দেখতে বলল, জ্যাঠামশাই ফিরে এলে আমরা তাঁকে ঠিক পৌঁছে দেব সোনাবাবু। তাঁকে আমরা আটকে রাখব না।

তারপরই দেশভাগের ছবি চারাপাশে ফুটে উঠতে থাকল—বর্ষাকাল এসে গেল। চারপাশে সব বড় বড় নৌকায় লাল নীল রঙের পতাকা, কত রঙ বেরঙের চাঁদমালা, কাগজের ফুল, নতুন লুঙ্গি পরে, নতুন জামা গায়ে মাথায় ফেজ টুপি পরে ছেলেরা, মেয়েরা নাকে নোলক পরে, নদীর চরে নৌকা ভাসিয়ে সারি সারি চলে গেল—ওরা চলে গেল। সোনা মার হাত ধরে অজুর্ন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। মেজদা বড়দা চুপচাপ খেজুর গাছটার নিচে বসে দেখছে। জ্যেঠিমা দাঁড়িয়ে আছেন তেঁতুলগাছের নিচে। নরেন দাস, শোভা আবু, দীনবন্ধুর দুই বউ এবং হারান পাল সবাই নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ বেজার। শচীন্দ্রনাথ বাড়ির ভিতর। তিনি এই উৎসবের দিনে চুপচাপ শুয়ে আছেন। মাস্টারমশাই বসে বসে দুঃখী মানুষের মতো একটা দেশাত্মবোধক গান গাইছিলেন—বঙ্গ আমার জননী আমার। মনে হয় তিনি বসে বসে বাংলাদেশের জন্য গানটা গাইতে গাইতে শোক করছিলেন। সোনা চোখ বুজে গানটা শুনছিল আর মাস্টারমশাইর মুখ, বড় জ্যাঠামশাইর মুখ মনে পড়ছিল। এবং বাংলাদেশ ভাবতে সে বোঝে ঈশম, ফতিমা, পাগল জ্যাঠামশাই আর সে নিজে, এই দেশ যখন বাংলাদেশ, তবে ভাগ কেন! সোনার চোখেও জল এসে গেল।

ঈশম দাঁড়িয়েছিল। সে নির্বিকার। সে সকাল থেকে কোনও কথা বলছে না। সারা সকাল আশ্বিনের কুকুর ঘেউঘেউ করে ডাকছে। কুকুরটা কেন জানি সকাল থেকেই ঈশমের সঙ্গ ছাড়ছে না। কুকুরটা এর ভিতর কিছু টের পেয়ে গেছে।

আর মাটির নিচে দুই মানুষ। জলের নিচে দুই মানুষ। পাগল মানুষ আর ফেলু। ওরা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ওদের কঙ্কাল মাটিতে ঢেকে গেছে। কী সাদা আর ধবধবে কঙ্কাল এই মানুষের। বেঁচে থাকতে তা কিছুতেই টের পাওয়া যায় না। বড়বৌ জানালা খুলে এখনও দাঁড়িয়ে থাকে। নিরুদ্দেশ থেকে মানুষটা তার আজ হোক কাল হোক ফিরবেনই।

দেশভাগের কিছুদিন পর মুড়াপাড়া থেকে ভূপেন্দ্রনাথ ফিরে এলেন। সেটা ছিল এক আশ্বিনের সকাল। মুড়াপাড়া থেকে নৌকা এলেই এ-সংসারের জন্য কিছু-না-কিছু চাল ডাল তেল নুন সবজি মাছ আসে। বড় মাছ নিয়ে আসেন ভূপেন্দ্রনাথ! আখের দিন আখ, আনারসের দিন আনারস। বাড়ির ছেলেপেলেরা নৌকা এলেই ঘাটে চলে যাবার স্বভাব। সব কিছুর ভিতর তাদের চোখ সেই আখ অথবা আনারসের দিকে। সুতরাং এই ভেবে সবাই ছুটে গেলে দেখল ভূপেন্দ্রনাথ নৌকা থেকে ধীরে ধীরে নামছেন। কিছুই তিনি এবার সঙ্গে আনেন নি। খালি নৌকা। তিনি নেমেই বললেন, তোমরা ভাল আছ? কেমন রোগা দেখাচ্ছে তাঁকে। ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ মুখ। জীবনের সব শান্তি যেন কারা কেড়ে নিয়েছে। দুশ্চিন্তার ছাপ চোখে মুখে এবং বিষণ্ণ মুখ দেখলেই বোঝা যায় দিনের পর দিন মানুষটা অনিদ্রায় ভুগছেন।

তিনি এসে সকাল সকাল স্নান করে সন্ধ্যাআহ্নিক করলেন। তারপর সামান্য জলযোগ করার সময় শচীকে ডেকে পাঠালেন।

শচী এলে বললেন, তোমারে একটা কথা কই। বাবুগ লগে পরামর্শ করলাম। তারা বলল, যত তাড়াতাড়ি পার দেশ ছাইড়া পালাও। তোমার কী মনে লয়?

শচী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তিনি জানেন তাঁর মানসম্ভ্রম, পারিবারিক মানসম্ভ্রম আর থাকছে না। তবু এই দেশ এবং মাটির জন্য সবার মতো ভিতরে একটা ভীষণ হাহাকার আছে। ছেড়ে যেতে যে কী কষ্ট! ভূপেন্দ্রনাথ শচীর মুখ দেখে সব টের পাচ্ছেন। তিনি বললেন, তোমার কষ্ট হইব জানি। বিদেশবিভূঁইয়ে কী কইরা আহার সংগ্রহ করবা সেটাই বড় চিন্তা। তবে কী জান, গঙ্গার পারে অনাহারে মরলেও শান্তি। তোমরা অন্তত এই শরীরটা গঙ্গার পারে দাহ করতে পারবা।

শচী বললেন, মাস্টারমশাই বলেছিলেন, ওদের দেশে জমি জায়গা কিছু রাইখা দিতে।

সুতরাং ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, তবে তোমার মত আছে দেখছি। চন্দ্রনাথের মতও তাই। দুশ্চিন্তা নিয়া বেশিদিন বাঁচা যায় না। হাজিসাহেবের বেটাদের খবর দ্যাও। জমি জায়গা বাড়ি-ঘর সব বিক্রি কইরা দিমু।

খুব স্থির গলায় এসব বলছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ। গলা এতটুকু কাঁপছিল না। গলা কাঁপলে ভিতরে ভিতরে তিনি যে কত দুর্বল হয়ে পড়ছেন ধরা পড়ে যাবেন। ধরা পড়ে গেলেই যেন তিনি আর ভূপেন্দ্রনাথ থাকবেন না। সোনার মতো বালক হয়ে যাবেন। তাঁর কথার তখন কেউ দাম দেবে না। তিনি নিজেকে খুব শক্ত করে রাখলেন।

এই বিক্রিবাট্টার খবর শুনে দীনবন্ধু ছুটে এল। মাইজাভাই, আপনারা চইলা যাইবেন হিন্দুস্থানে?

—আর কি করা!

—আমরা-অ তবে যামু।

—তুই যাইবি! ল তবে।

—এখানে থাকলে অভক্ষ্য ভক্ষণ করতে হইব। জাত-মান থাকব না।

ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, আমরা যাইতেছি নবদ্বীপ। শশীমাস্টার সব ব্যবস্থা করব। নবদ্বীপ যাইতে তর অমত নাই ত?

দীনবন্ধু এসেই হাঁকডাক করতে থাকল—আর অমত। এখন পালাতে পারলে বাঁচি। নরেন দাস শুনে ছুটে এল। সে বলল, আপনেরা চইলা গেলে আমরা থাকি কি কইরা?

মাঝিবাড়ি থেকে এল শ্রীশ চন্দ্র। প্রতাপচন্দের দুই ছেলে ছুটে এসে বলল, দেশ ছাইড়া গিয়া কি ভাল হইব?

দীনবন্ধু বলল, থাকতে গেলে হিন্দু হইয়া থাকন যাইব না। মুসলমান হইতে হইব। যদি তা পার থাক।

এ ভাবে প্রায় বার্তা রটি গেল গ্রামে-সবাই এসে খবর নিল। জলের দরে জমি বিক্রি করে দিচ্ছে ঠাকুরবাড়ির ভূপেন্দ্রনাথ। খবর পেয়ে যারা কিনবে তারা চলে এল। প্রতাপচন্দ্রের ছোট ছেলে এসে বলল, আপনে জমিজমা যারে খুশি বিক্রি করেন, বাড়িটা কইরেন না। যা দাম হয় আমরা কিনা রাখমু। শত হলেও বামুনের বাড়ি। বাড়িতে জাগ্রত বিগ্রহ—এ-বাড়ি মুসলমানরে বেইচেন না।

শচীর তাই ইচ্ছা। দাম কম হলেও এ-বাড়ি তিনি কখনও মুসলমানের কাছে বিক্রি করতে পারেন না। যেন বিক্রি করলেই যেখানে ঠাকুরঘর সেখানে মসজিদ উঠবে, যেখানে মাঘ-মণ্ডলের ব্রতকথা বলত ছোট ছোট বালিকারা সেখানে কোরবানী হবে—এইসব ভাবতেই তার চোখমুখে এক তীব্র আক্রোশ ফুটে উঠল। তিনি বললেন, তাই হবে। হলও তাই। প্রতাপচন্দ্র ওদের বাড়ি পুকুর এবং সেরা দশ বিঘা জমি হাজার পনের টাকায় কিনে নিল। কিছু টাকা সঙ্গে দেবে—বাকি হুণ্ডি করে পাঠাবে। বর্ডারে বড় কড়াকড়ি। এত টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতে দেবে না। ভূপেন্দ্রনাথ তাতেই রাজী হয়ে গেলেন।

সোনা দেখল এক সকালে কিছু মানুষজন এসে ঘরগুলির ওপর উঠে টিনের স্ক্রু খুলে দিচ্ছে। আর টিনগুলো রাখছে আলাদা করে। ওর বার বার মনে হয়েছে জ্যাঠামশাই শেষ পর্যন্ত তার মত পাল্টাবে। কিন্তু যখন দেখল টিনগুলি খুলে নেওয়া হচ্ছে, একটা ঘরে সব আসবাবপত্র নিয়ে আসা হয়েছে, কিছু কিছু বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে তখন সে নিজেও কেমন একা একা ঘুরে বেড়াতে লাগল বাড়িটার চারপাশে। অর্জুন গাছটা তাকে বার বার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঘর ভাঙা হচ্ছে বলেই গরিব কিছু মানুষজন সকাল থেকে বাড়ির চারপাশে ভিড় করে আছে। যা পারছে ফাঁক পেলে তুলে নিয়ে পালাচ্ছে। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারছে না। ঈশমদা ধরে আনছে ঘাড় ধরে। চোখে মানুষটা কম দেখে আজকাল, অথচ একটা সামান্য জিনিস কেউ না বলে নিয়ে গেলে ঠিক ধরে আনছে। এতসব যখন হচ্ছে, মা যখন বড় বড় বস্তার ভিতর তার সব প্রিয় জিনিস ভরে ফেলছে, যে কোনওদিন মুড়াপাড়া থেকে নৌকা চলে আসতে পারে বড় বড়, এবং সব সামগ্রী নিয়ে রওনা দিতে পারে—তখন সে সারাটা সকাল খেয়ে না খেয়ে সেই অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকল।

হাতে ওর একটা ধারালো ছুরি। সে প্রথম ঠিক ওর বুক সমান উঁচু জায়গায় গাছের কাণ্ডের ছালবাকল কেটে কেটে তুলে ফেলল। প্রথম ফোঁটা ফোঁটা কষ বের হচ্ছে। সাদা রঙের দুধের মতো কষ গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। বাবা, জ্যাঠামশাই পুকুরপাড়ে বসে আছেন। উত্তরের ঘর দক্ষিণের ঘর এক এক করে, ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কেউ দুটো জানালা কিনে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ একটা দরজা কিনতে এসেছে। আলাদা আলাদা দাম দিয়ে যাচ্ছে সবাই। কেবল মনজুর পুবের ঘরটা আস্ত কিনেছে। দরজা জানালা এবং টিন-কাঠের বেড়া এইসব সে একসঙ্গে কিনছে বলে খাবারদাবার এবং অন্যান্য তৈজসপত্র সে ঘরে তুলে রাখা হয়েছে। ওরা বাড়ি ছেড়ে দিলে কথা আছে মনজুর ঘরটা ভেঙে নিয়ে যাবে।

এক একটা টিন যখন খুলছে তখনই মনে হচ্ছে ভূপেন্দ্রনাথের এক একটা পাঁজর বুক থেকে কেউ তুলে নিচ্ছে। ওঁরা সেদিকে তাকাতে পারছেন না বলেই পুকুরপাড়ে এসে বসে আছেন। ঈশমই সব দেখাশোনা করছে। এবং দরদাম করে গুনে গুনে টাকা দিয়ে যাচ্ছে ভূপেন্দ্রনাথের হাতে। তিনি টাকা গুনে নিচ্ছেন না। গুনতে তার ভালো লাগছে না। গ্রামের কেউ কেউ চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। অন্যমনস্ক হবার জন্য তাদের সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর ছোটবেলার গল্প করছেন।

আর সোনা সেই সকাল থেকে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে কী যে করছে কেউ টের পাচ্ছে না। লালটু তাকে দু’বার খেতে ডেকেছে, সে খেতে আসেনি। সে নিবিষ্ট মনে কিছু করে যাচ্ছে।

ভূপেন্দ্রনাথও ব্যাপারটা লক্ষ করছেন। যখন বাড়িঘর বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বলে সবাই বিমর্ষ হয়ে আছে তখন সোনা অনবরত গাছের কাণ্ডে খুঁটে খুঁটে কী লিখে যাচ্ছে। শশীভূষণ খড়ম পায়ে বাইরে বের হয়ে এলেন। তিনি স্কুলে যাবেন আজ একবার। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। সেক্রেটারিকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে হবে। এখন আশ্বিন মাস বলে পূজার বন্ধ। জল চারপাশে। পাট কাটা হয়ে গেছে সব। আর কিছুদিন পরই যখন হেমন্তকাল আসবে সব জল নেমে যাবে মাঠ থেকে। মাঠে জল থাকতে থাকতে এদেশ থেকে রওনা হতে হবে। শশীভূষণ ডাকলেন, লালটু আছিস!

লালটু এলে বললেন, একটু তেল নিয়ে আয়। মাখি। আজ তিনি সবার সঙ্গে স্নান করলেন না। রান্না হতে দেরি হবে। তিনি স্কুল থেকে এসেই খাবেন। ঘাটে স্কুলের নৌকা লেগে রয়েছে। তিনি সোজা সেক্রেটারির কাছে গিয়ে চার্জ বুঝিয়ে আসবেন। শশীভূষণ মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছেন।

এ সংসারে শুধু একজন একেবারেই কোনও কথা বলতে পারছে না। সে সবার অলক্ষ্যে কাঁদছে। সে হচ্ছে বড়বৌ। এই দেশ ছেড়ে চলে গেলে মানুষটা যদি ফিরে আসেন তখন তিনি কোথায় যাবেন। এসে চিনতেই পারবেন না—এই বাড়ি তাঁর। ঘরবাড়ি কিছু নেই। শুধু কিছু পরিচিত গাছ। অর্জুন-গাছটা দেখলেই চিনতে পারবেন তিনি ঠিকমতো পথ চিনে উঠে এসেছেন। কিন্তু যখন দেখবেন ঘর বলতে কিছু নেই, পুবের ঘর বলতে শুধু মাটি আর একটা কামরাঙা গাছ তখন তিনি নিশ্চয়ই ভাববেন কোন জাদুবলে তিনি এসব দেখছেন। যেমন তিনি স্মৃতির ভিতর মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত জাদুবলে দেখতে পান শূন্য এক র‍্যামপার্ট এবং কিছু ইংরেজ সৈন্য কুচকাওয়াজ করছে মাঠে, তিনি তেমনি দেখতে পাবেন সেই পুবের ঘর, ঘরের দরজায় বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে বড়বৌ, বাড়িতে পিঠে-পায়েস হয়েছে। যত্ন করে বড়বৌ সব ভিন্ন ভিন্ন পাথরের থালায় রেখে দিয়েছে। দেখতে পাবেন তসরের জামা গায়ে দিয়ে দিচ্ছে বড়বৌ, ধুতি কুঁচি দিয়ে পরিয়ে দিচ্ছে এবং নাভির মতো কোমল অংশে হাত রাখতে রাখতে চোখ বুজে ফেলছেন। এসব দেখলেই তিনি এই বাড়ির চারাপাশে ঘুরে বেড়াবেন… কোথাও তাঁকে যে যেতে হবে সে কথা মনে থাকবে না। তখন এই মাঠে ঘাসে অথবা ফুলে মানুষটা বুঝি বন্দী হয়ে যাবেন!

সোনা তখনও লিখছিল। কী যে লিখছিল তখনও কেউ জানে না। সে বড়-বড় টান দিচ্ছে ছুরির ধারালো ডগা ধরে। তারপর খুঁটে খুঁটে তুলে ফেলছে কাঠ। সে গাছটায় ক্রমান্বয়ে সব গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাতের মতো কষ নেমে মাটি এবং ঘাস ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই ক্ষতস্থান ঝড়-বৃষ্টি অথবা কোনও মানুষ শত চেষ্টা করেও যেন মুছে না দিতে পারে। ওর হাত লাল হয়ে গেছে। জায়গায়-জায়াগয় হাত ওর সামান্য কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে হাত দিয়ে। সে কিছু ভ্রূক্ষেপ করছে না। গাছের মাথায় এক সেই নীলবর্ণ পাখি। মেজজ্যাঠামশাই সেই নীলবর্ণের পাখির সন্ধানে যাচ্ছেন সীমান্তের ওপারে। ওখানে গেলেই সব তিনি পেয়ে যাবেন। যা তিনি এদেশে হারিয়েছেন বর্ডার পার হয়ে গেলেই তিনি আবার বুঝি তা খুঁজে পাবেন। কিন্তু সোনার মনে কী যে এক অহেতুক ভয়। পাগল জ্যাঠামশাই ফিরে এলে তারা যে এখানে নেই জানবেন কী করে! জ্যাঠামশাই ফিরে এলে কী করে বুঝতে পারবেন ওরা হিন্দুস্থানে চলে গেছে। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। কারও কথা তিনি বুঝতেও পারেন না। একমাত্র সে জানে সে অথবা বড় জ্যেঠিমা কিছু বললে তিনি বুঝতে পারেন। সেজন্য সে সেই সকাল থেকে লিখে চলেছে। কপালে ঘাম। মুখে এসে সূর্যের তাপ লাগছে। মুখ লাল হয়ে গেছে। সে সেই এক নীল রঙের জামা গায়ে দিয়ে আছে। নীল রঙের জামা ওর খুব পছন্দ। আর এক নীলবর্ণ পাখি মাথার ওপর দেখছে, সোনা লিখছে, সুন্দর হস্তাক্ষরে, কত মায়ায় সে তার ভালোবাসার কথা লিখে যাচ্ছে। সে বড় বড় করে লিখে রাখছে। জ্যাঠামশাই উঠে এলে যখন দেখতে পাবেন বাড়ি বলতে কিছু নেই, সব খালি, শূন্য খাঁ খাঁ করছে উঠান, যেন কোনও প্লাবন এসে সব ধুয়ে-মুছে নিয়েছে তখন তিনি নিশ্চয় একবার এই অর্জুন গাছের নিচে এসে দাঁড়াবেন। দাঁড়ালেই দেখতে পাবেন—বড়-বড় হস্তাক্ষরে লেখা। সোনা লিখে রেখে গেছে—জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি, ইতি সোনা। নিরুদ্দিষ্ট জ্যাঠামশাইর জন্য সে অর্জুন গাছের কাণ্ডে তাদের ঠিকানা রেখে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *