প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.৫

১.৫

তখন বিকেলবেলা। বর্ষার জল মাঠে থইথই করছে। জোটন গোপাট ধরে জল ভাঙতে থাকল। সে সাঁতার কেটে পাশের গ্রামে উঠে যাবে। সে জলজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ঝোপ-জঙ্গল অতিক্রম করে কেবল সাঁতার কাটছে। সে সাঁতার কেটে ঠাকুরবাড়ির সুপারি বাগানে উঠে দেখল একটাও সুপারি পড়ে নেই। ঘাটে একটা তেমাল্লা নৌকা বাঁধা। ছই-এর নিচে দুই মাঝি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। জলে সে সারাক্ষণ সাঁতার কেটেছে। শাড়ি ভিজে গেছে। জবাফুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে শাড়িটাকে খুলে চিপে ফেলল। তারপর ফের প্যাঁচ দিয়ে পড়তেই মনে হল—কোথায় যেন কারা চিঁড়া কুটছে। তালের বড়া ভাজছে। সে নাক টেনে গন্ধ নিল। চিঁড়া কোটার শব্দ ভেসে আসছিল। মামাদের এখন ভাদ্রমাস। ভিটা জমিতে আউশ ধান, আউশ ধানের চিঁড়া—সে ভাবল, চিঁড়া কুটে দিলে ওর নসিবটা খুলে যাবে।

সে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। দেখল মাইজা কর্তা পশ্চিমের ঘরে তক্তপোশে একটা মোটা পুঁথি পড়ছেন। জোটন মাইজা কর্তাকে দেখেই দরজার সামনে দাঁড়াল। কে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তুলতেই দেখলেন আবেদালির দিদি জোটন। জোটনের শরীরটা একটু রু দেখাচ্ছে। চুল জোটনের নেই বললেই হয় এবং শণের মতো। মুখে কোনও কমনীয়তা নেই। ওর শরীরের গঠনটা কেমন যেন ভেঙে যাচ্ছে। গালে মেচেতা সুতরাং মুখটি কুৎসিত দেখাচ্ছিল। ভূপেন্দ্রনাথ বলল, কিরে জুটি, তুই।

—হ কর্তা, আমি। আবার ফিরা আইছি।

—আবার তরে তালাক দিল?

—হ। কিন্তু নিব্বৈংশায় না দিল পোলা, না দিল এক ফালি ত্যানা!

—পোলা না দিছে ভাল করছে—পোলা আইনা খাওয়াইবি কি?

জোটন সেটা ভাল বোঝে বলে অন্য কথা আর বলল না। মাইজা কর্তা আবার বড় পুঁথিতে মন দিয়েছেন। চশমার ভিতর কর্তার সহৃদয় মুখ দেখে বলতে ইচ্ছে হল, মাইজাকর্তা, আমারে পুরান-দুরান যা হয় একখানা ঠিক কইরা দ্যান। কিন্তু বলতে পারল না। যেন বললে শোনাত—সেই ফকিরসাব এসেছিলেন, কষ্টের যা কিছু সঞ্চয় ছিল, মোটা ভাত একটু শুকনো মাছের বাটা দিয়ে মানুষটা সবক’টা ভাত খেয়ে সেই যে চলে গেলেন আর এলেন না। যেন জোটন এই দরজায় দাঁড়িয়ে মনে করতে পারে—ফকিরসাব হুঁকো খাচ্ছিলেন, সব পোঁটলা-পুঁটলি যত্ন করে বাঁধা। যেন তিনি উঠবেন, হুঁকো খাওয়াটা বাকি। জোটন ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারেনি। সে বলেছিল-ফকিরসাব, আমারে লইয়া যাইবেন না? ফকিরসাব ঝোলাঝুলি কাঁধে নিতে নিতে বলেছিলেন—আইজ না। অন্যদিন হইব। কোরবান শেখের সিন্নিতে যামু। কবে ফিরমু ঠিক নাই। সেই যে বলে চলে গেলেন আর এলেন না মানুষটা। আর আসবেন কিনা ঠিক নেই। তাকে একটা মানুষ ঠিক করে দেবার জন্য সে যেন দোরে দোরে ঘুরছে।

আমারে একটা পুরান-দুরান যা হয় ঠিক কইরা দ্যান—বলতে সাহস পেল না। তিনবার তালাক এই শরীরকে যেন দুর্গন্ধময় করে রেখেছে—মাইজা কর্তা বললেন, কিছু কবি?

—কি কমুগ কর্তা। আমার চলে কি কইরা!

—আবার তর পাগলামি আরম্ভ হইছে। এইটা ঠিক না। মাইজা কর্তা বুঝতে পারছিলেন, পুরান-দুরান মানুষ ঠিক করে দেবার কথাটা সে বলতে এসেছে। জোটন কর্তার মুখে এমন কথা শুনে আর দাঁড়াল না। আতাবেড়ার পাশ দিয়ে ভিতর বাড়িতে ঢুকে গেল।

ধনমামি বড়মামি দাঁড়িয়ে আছেন। হারান পালের বৌ চিঁড়া কুটে দিচ্ছে। মালতী সঙ্গে আছে। জোটন বলল, দ্যান, আমি চিঁড়া কুটি

জোটন অতি অল্প সময়ে চিঁড়া কুটে খোলায় ছড়িয়ে দেখাল। সে যে ভাল চিঁড়া কুটতে পারে, চিঁড়াগুলি ওর বেশ বড় বড় হয়—খোলায় ছড়িয়ে যেন সকলকে দেখাতে চাইল। জোটন ওর চিঁড়াগুলি অন্য একটা বেতের ঢাকিতে রাখল। শশীবালা এই চিঁড়া দেখলে খুশি হবেন। যাবার সময় এক খোলা চিঁড়া ওর আঁচলে ঢেলে দেবেন।

ধনবৌ বলল, তর নাকি আবার বিয়া বসনের শখ হইছে?

—অঃ আল্লা, এডা এতদিনে জানলেন। কিন্তু পাইতাছি কই।

—তর ক্ষমতা আছে জুটি!

—কি যে কন আপনারা। শরমের কথা আর কইয়েন না। এডা গতরের কথা। আপনের-অ আছে আমার-অ আছে। আপনে সুখ পান কথা কন না, কর্তা আসে যায়। আমার মানুষ নাই, মানুষ আসে না যায় না। সুখ পাই না, কথা কই। এইসব বলে জোটন চিঁড়া কুটতে থাকল ফের, ওর মুখে একরকমের শব্দ; শব্দটা কোড়াপাখির ডাকের মতো। ভাদ্র মাস বলেই এত গরম এবং তালের পিঠা হচ্ছে বাড়ি বাড়ি—তার গন্ধ গ্রামময়। মাঠময়। হারান চন্দের বৌ ধান খোলাতে ভাজছে, শুকনো কাঠ গুঁজে দিচ্ছেন শশীবালা। সকলেই কোন-না-কোন কাজে ব্যস্ত। জোটন একটু জল চাইল। বড়বৌ জল আনতে গেছে কুয়াতে। আর এ সময় জাম গাছে একটা ইষ্টিকুটুম পাখি ডাকল। কাহাইলের দুধারে বস্তা পাতার সময় সে চোখ তুলে দেখল—গাছে পাখিটা ডাকছে। সে বলল, ধনমামি, গাছে ইষ্টিকুটুম পাখি। মেমান আসব।

রান্নাঘরে পবন কর্তার বৌ, তার ছেলেপুলে, সবাই বেড়াতে এসেছে। শশীবালা এই বর্ষাকালটা সব নাইয়রীদের জন্য যেন প্রতীক্ষায় বসে থাকেন। সারা বর্ষাকাল কুটুম আর কুটুম। ধনবৌ তখন নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। বড়বৌকে সারাদিন হেঁশেলে পড়ে থাকতে হয়। মুখ ফসকে ধনবৌ বলে ফেলেছিল আর কি—আর কুটুম না। কিন্তু ঘরে পবন কর্তার বৌ। সে বলতে পারল না, পাখিটারে উড়াইয়া দে জুটি। সারা বর্ষাকাল কুটুম আর কুটুম। দিন-রাইত নাই, আইতাছে যাইতাছে। অথচ বুড়ো ঠাকরুণ শশীবালার বড় শখ কুটুমে। কোন্ কুটুম কি খেতে পছন্দ করে—শশীবালার সব মুখস্থ

এ-সময়ে মেঘনা-পদ্মাতে ইলিশের ঝাঁক উঠতে থাকবে। জোটন জানত, এসময় ঠাকরুণ কুটুমের জন্য ভাল-মন্দ খাবার অথবা নাইয়রীরা ঘুরে বেড়াবে ঘরময়, উঠোনময় শিশুদের কোলাহল, ঘাটে ঘাটে নৌকা বাঁধা—এইসব দৃশ্য, আর জোটন তখন দেখল হারান পাল নৌকা থেকে এক গণ্ডা ইলিশ নামাচ্ছে। বড় বড় ইলিশ-রূপোর মতো উজ্জ্বল রঙ অবেলার রোদে চিকচিক করছিল। জোটন ইলিশমাছগুলি দেখে চোখ নামাতে পারছে না।

ওর ইলিশমাছগুলির দিকে তাকিয়ে থাকা–খুব করুণ অথবা রহস্যময় মনে হয়—যেন কতদিন এইসব মাছের স্বাদ ভুলে গেছে জোটন। শশীবালা এসব লক্ষ্য করে বললেন, রাইতে খাইয়া যাইস জুটি। জুটির চোখদুটো কেমন সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, ঠাইনদি, মাছগুলির প্যাটে ডিম হইব মনে হয়।

—তরে ডিম ভাজা দিতে কমু।

সে আর কি বলবে ভেবে পেল না। একমনে আবার চিঁড়া কুটতে থাকল। সেই কোড়াপাখির ডাকটা ওর ভিতর থেকে এখনও উঠছে। ওর পরনের শতচ্ছিন্ন শাড়িটা এতক্ষণে শুকিয়ে উঠেছে। বড়বৌ জোটনকে এক খোলা চিঁড়া দিল খেতে, সে খেল না। আঁচলে পোঁটলা বেঁধে নিল। পলটু এনে ক’টা কাঁচা সুপারি দিল। আঁচলে তা বেঁধে নিল। রাত হয়ে যাচ্ছিল অনেক। সে কলাপাতা ধুয়ে বসে থাকল—রান্না হলেই সে খেতে পাবে।

জোটন খেতে বসে পেট ভরে খেল। চেটেপুটে খেল। বড় যত্নের সঙ্গে ভাত ক’টি খেল। বেগুনের সঙ্গে ইলিশমাছের স্বাদ এবং আউশ ধানের মোটা ভাত জোটনকে এই পরিবারের সহৃদয়তা সম্বন্ধে অভিভূত করছে। বুড়ো ঠাকরুণ, ধনবৌর উদারতা যেন এই পরিবারের পাগল ঠাকুরের মতো। এই ভোজনের সঙ্গে রাতের জ্যোৎস্না এবং এক পাগল মানুষের অস্তিত্ব, বুড়ো কর্তার সাত্ত্বিক ধারণা, ভূপেন্দ্রনাথের সততা, সব মিলে জোটনকে সুখ দিচ্ছে। আর কতকালের মেমান যেন এইসব পরিবার। সে বড়বৌকে ডেকে বলল, মামি গ, অনেকদিন পরে দুইডা প্যাট ভইরা ভাত খাইলাম। এ খাওয়নের কথা ভুলতে পারি না।

বড়বৌ ওর দুঃখের কথা শুনে বলল, তুই যে বললি, কোন্ দরগার এক ফকিরসাব তোকে নিকা করতে চায়?

—কি যে কন মামি! খোয়াব ত কত দ্যাখলাম গ মামি। কিন্তু আল্লার মর্জি না হইলে আপনে আমি কি করমু!

—কেন, আবেদালি যে বলে গেল ফকিরসাব এসেছিল।

—আইছিল। প্যাট ভইরা ভাত গিলছিল। গিল্যা আমারে কয় কি, আপনে থাকেন, আমি কোরবান শেখের সিন্নিতে যামু। ফিরনের সময় আপনারে লইয়া ফিরমু। এই বইলা নিব্বৈংশায় আইজ-অ গ্যাছে কাইল-অ গ্যাছে মামি।

—যখন বলে গেছে তখন ঠিকই আসবে।

জোটন আর কোনও কথা বলল না। সে কলাপাতায় সব এঁটোকাঁটা তুলে জামগাছের অন্ধকার অতিক্রম করে বড়ঘরের পিছনে এসে দাঁড়াল। গন্ধ পাদালের ঝোপ ছাড়িয়ে সে তার এঁটোকাঁটা নিক্ষেপ করল। জ্যোৎস্না রাত বলে এই ঝোপ-জঙ্গল, দূরের মাঠ, সবুজ ধানখেতের অস্পষ্ট ছবি তার ভালো লাগে। সে হিসাব করে বুঝল প্রায় দু’সাল হবে গতর আল্লার মাশুল তুলছে না। বিশেষ করে এই রাত এবং ঝোপ-জঙ্গলের ইতস্তত অন্ধকারের ছবি অথবা আকণ্ঠ ভোজনে এক তীক্ষ্ণ ইচ্ছা জোটনকে কেমন কাতর করছে। ফকিরসাবকে এ-সময়ে বড় বেশি মনে পড়ছিল।

সে বড় মামির কাছ থেকে একটা পান চেয়ে নিল। কাঁচা সুপারি একটা আস্ত চিবোতে চিবোতে বাগানের ভিতর ঢুকে গেল। এক মন্ত্রবৎ ইচ্ছাশক্তি এই বাগানের ভিতর ওকে কিছুক্ষণ রেখে দিল—যদি একটা পাকা সুপারি, গাছ থেকে টুপ—এই শব্দ ঘাসের ভিতর, সে কান খাড়া করে রাখল—কোথায় টুপ এই শব্দ জেগে উঠবে—কখন বাদুড়েরা উড়ে আসবে। কিন্তু একটা বাদুড় উড়ে এল না। টুপ্ শব্দ হল না। শুধু কাঁচা সুপারির রসে মাথাটা কেমন ভারী ভারী, নেশার মতো মনে হল। সে এখন জলে নেমে যাবে। সাঁতার কেটে গ্রামে উঠে যেতে হবে। জ্যোৎস্না রাত। জলে সাদা জ্যোৎস্না এবং জোটন জলে নেমে যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে সে শাড়ি হাঁটুর উপর তুলে ফেলল। যত জলে নেমে যেতে লাগল, তত সে শাড়ি ক্রমে উপরে তুলে তুলে এক সময় কোমরের কাছে নিয়ে এল। না, জল কেবল বাড়ছে। সে শাড়ি খুলে মাথার উপর তুলে একটা গোসাপের মতো জলে ভেসে পড়ল। এক কাপড় জোটনের। ভিজা কাপড়ে রাত্রিবাস বড় কষ্টের।

ঝোপ-জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে জোটন দেখল নরেন দাসের বারান্দায় একটা কুপি জ্বলছে। পুবের ঘরে কোনও তাঁতের শব্দ হচ্ছে না। অমূল্য ওদের তাঁত চালায়। অমূল্য বাড়ি গেলে তাঁত বন্ধ থাকে। তাছাড়া সূতা পাওয়া যাচ্ছে না বাজারে। তার জন্যও নরেন দাস রাতে তাঁত বন্ধ করে রাখতে পারে। এখন আর জোটন নলী ভরতে পারছে না। জোটন অনেক কষ্টে একটা চরকা কিনে যখন বেশ দু’পয়সা কামাচ্ছিল, যখন ভাবল হিন্দু বাড়ির বৌদের মতো ছোট একটা কাঁসার থালা কিনে বড়লোক হবে এবং যখন সুতার মোড়া দু’পয়সা থেকে চার পয়সা হয়ে গেল এবং একজন ফকিরকে পোষার ক্ষমতা হচ্ছে তখন কিনা—বাজারে সূতা পাওয়া যাচ্ছে না।

জোটন জল কাটছিল। দু’হাতে ব্যাঙের মতো জলের ওপর ভেসে ভেসে যাচ্ছে। হাত-পা জলের ভিতর ফুটকরি তুলছে। এই গরমে জলের ঠাণ্ডাটুকু, আকাশের স্বাচ্ছন্দ্যটুকু এবং পুব দিকের বড় চান্দের হাসি জোটনের ভিতর কতদিন পর মাশুল তুলতে বলছে। আকণ্ঠ খেয়ে শরীরে এখন কত রকমের শখ জাগছে। দূরের মাঠে একটা আলোর ফুলকি। সামনে সব পাটের জমি। পাট কাটা হয়ে গেছে—জল স্বচ্ছ। হাওয়ায় জল থইথই করছে চারদিকে। স্বচ্ছ জলে জোটন শরীরের উত্তাপ ঢালছিল—য্যান কতকাল গাজীর গীতের বায়নদারের মতো সূর্যের উত্তাপ না পেয়ে অবসন্ন। সে এসময় একমুখ জল নিয়ে আকাশমুখো ছুঁড়ে দিল। বলল আল্লা, তর দুনিয়ায় আমার কি কামডা থাকল ক’দিনি!

আকাশে জ্যোৎস্না। জলে শাপলা-শালুক রয়েছে আর মাঠ শেষে আম-জামের ছায়া প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করছে। শাপলাফুলের মতো সে জল থেকে মুখটা তুলে দুটো মান্দার গাছ অতিক্রম করতেই দেখল, গোপাটের বটগাছটার নিচে একটা হারিকেন এবং নৌকার ছায়া। একটা মানুষেরও যেন। সে তাড়াতাড়ি জলের ভিতর হারিয়ে যাবার জন্য ঘাসের বনে শরীর আড়াল করে দিল। কিন্তু পালাবর সময় জলে শব্দ বুঝি একটা মাছ পালাচ্ছে। অথবা বঁড়শীতে, বোয়ালের বঁড়শীতে বড় বোয়াল মাছ আটকে গেছে। মানুষটা নৌকা নিয়ে মাছের খোঁজে এসে দেখল কে এক মানুষের মতো ঝোপে-জঙ্গলে জলের ভিতর ভেসে যাচ্ছে। জোটন তাড়াতাড়ি গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে শ্যাওলার জঙ্গলে শরীর লুকোতে চাইল—কিন্তু পারল না। ওর মুখের ওপর লণ্ঠন তুলে মনজুর বলছে, জোটন তুই।

জোটন শরমে চোখ বুজে ফেলল। চোখ বুজেই বলল, হ আমি!

—কই গ্যাছিলি?

—গ্যাছিলাম ঠাকুরবাড়ি। পথ ছাড়, যাই।

মনজুর জলের ভিতর ওর অবস্থা বুঝে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সে মুখ ফেরাল না। অথচ বলল আমি ভাবলাম বুঝি বড় একটা মাছ বঁড়শীতে ধরা পড়ছে।

—আর কিছু ভাবস নাই।

—আর কি ভাবমু। বলে সে নৌকাটার উপর বসল।

—ক্যান, অন্য কিছু ভাবন যায় না। তুই ইদিকে ক্যান। বলে জোটন চোখ খুলল। কথাবার্তায় যেন সব সঙ্কোচ কেটে গেছে। দেখল, মনজুর খালি গায়ে। পরনে অত্যন্ত মিহি গামছা। তাও জলে ভিজে খানিকটা উপরে উঠে গেছে। মনজুর কিছুতেই জোটনের দিকে তাকাচ্ছে না। জোটনের ভারি হাসি পেল। তর ত ম্যালা পয়সা। একটা বড় গামছা কিনতে পারস না?

মনজুর বলল, তুই যা দিনি।

—যামুনা ত, কি করবি। জোটনের ভিতর ইচ্ছাটা বড় চাড়া দিচ্ছে!

—কি আবার করমু। সে তার এই পরিস্থিতির জন্য অজুহাত দেখাল। বলল, হাইজাদি গ্যাছিলাম। ওষুধ আনতে। ফিরতে রাইত হইয়া গ্যাল। গোপাটে আইছি বঁড়শীতে মাছ লাগছে কিনা দ্যাখতে। আইয়া দ্যাখি তর এই কাণ্ড। জ্যোৎস্না রাইতে জায়গাটারে আনধাইর কইরা আছস। তর লগে দ্যাখা হইব জানলে তফন পইরা আইতাম

মনজুর জোটনের সমবয়সী। শৈশবের কিছু ঘটনা উভয়ে এ-সময়ে স্মরণ করতে পারল। একদা শৈশবে এইসব পাটখেতের আলে-আলে ওরা ঘুরে বেড়িয়েছে। জোটন সেইসব স্মৃতির কথা স্মরণ করতে চাইল অথচ সঙ্কোচবোধে কিছু বলতে পারছে না। দু’সালের অধিক এই শরীর জ্বলে-জ্বলে খাঁক্। জোটন কাতর গলায় বলল, পথ দে। যাই।

—তরে ধইরা রাখছি আমি!

জোটন এই জল দেখে, রাতের জ্যোৎস্না দেখে এবং আকণ্ঠ ভোজনে কি যে তৃপ্তি শরীরে—জোটন কিছুতেই নৌকা অতিক্রম করে সাঁতার কাটতে পারল না। শরীর ওর ক্রমে কেমন জলের ওপরে ভেসে উঠছিল। জলের ওপর ব্যাঙের মতো যেন একটা সোনালী ব্যাঙ জোনাকি খাবার জন্য জলে ভেসে হাঁ করে আছে। মনজুর কোনও কথা বলছে না দেখে সে-ই বলল, আসমানের চান্দের লাখান তর মুখখান। কিন্তু দেইখা ত এহনে ত মনে হয় অমাবস্যার আনধাইর রাইত। য্যান ডরে শুকাইয়া গ্যাছে।

—শুকাইয়া গ্যাছে! তরে কইছে।

মনজুর ওর রুগ্ন বিবির মুখটা স্মরণে এনে কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে পড়ল। দীর্ঘদিন বিবির রুগ্ন শরীর ওর গরম কজের ভিতর জল ছিটাতে পারেনি। শুধু মনজুর জ্বলছে, জ্বলছে। একটা, সাদির যে শখ ছিল না—তা নয়, তবু মনজুর বিবিকে যথার্থই ভালোবাসে। মনজুর অনেক কষ্টে যেন বলল, পারবি আনধাইর রাইত আলো করতে। এবং মনজুর মুখ ফেরাতেই আবার শরীরটাকে জলের ভিতর জোটন ডুবিয়ে দিল। সামনে পিছনে জলজ ঘাস। বেশ আব্রু সৃষ্টি করেছে। জোটন এই জলজ ঘাসের ভিতর মনজুরকে নিয়ে ডুব দিতে চাইল। আর মনজুর সহ্য করতে না পেরে দু’হাতে যেন একটা মরা মাছ নৌকায় তুলে আনছে—টানতে-টানতে নৌকার পাটাতনে তুলে ফেলল।

কিছুক্ষণ পরে পাটখেতের ফাঁক দিয়ে কেমন একটা কান্নার শব্দ গ্রাম থেকে ভেসে আসতে থাকল। জোটন শুনতে পাচ্ছে, মনজুর শুনতে পাচ্ছে। নৌকোর ওপর কিছু পোকা উড়ছিল। ধানের জমিতে চাঁদের আলো বড় মায়াময়। সুখ অথবা আনন্দ এই পাটাতনে এখন গড়াগাড়ি খাচ্ছে। সব দুঃখ ভেসে যাচ্ছিল জলে, সব উত্তাপ চাঁদের আলোর মতো গলে-গলে পড়ছে। ইচ্ছার সংসারে মনজুর পুতুল সেজে বিবির মরা মুখ দেখতে দেখতে বলল, ক্যাডা ক্যান্দে ল।

—মনে হয় তগ বাড়ি থাইক্যা আইতাছে।

—তবে বিবিডা বুঝি গ্যাল।

জোটন দেখল পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগীর মতো মনজুরের মুখ। সব উত্তাপ এখানে ঢেলে দিয়ে মনজুর হাউহাউ করে কাঁদছে আর নৌকাটা বাইছে।

.

কুকুরটাকে ফেলে দিয়ে গেছে কারা। জলের ভিতর ফেলে দিয়ে নৌকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। কুকুরটা আপ্রাণ বাঁচার জন্য জলে সাঁতার কাটছে। কোনওরকমে নাকটা জাগিয়ে রেখেছে জলে। তারপর মনে হল টানমতো জায়গা। কুকুরটা সামান্য উঠে দাঁড়াল। না, দূরে কোনও গ্রাম দেখা যাচ্ছে না। হতাশায় চোখ-মুখ কাতর। শেষ বর্ষা এখন। জল, ধানখেত থেকে পাটখেত থেকে নেমে যাচ্ছে।

পাগল ঠাকুর তখন নৌকাটাকে আলে আলে টেনে নিচ্ছিলেন। সোনা পাটাতনে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। ধানগাছ হেলে পড়ছে। শ্রাবণ-ভাদ্রের সেই স্বচ্ছ ভাবটুকু আর নেই। জল ঘোলা। জলে পচা গন্ধ উঠছে। দু’ধারে কাদা জল, শামুক পচা দুর্গন্ধময় জলজ ঘাস। নৌকাটাকে কবিরাজের জমিতে ঢুকিয়ে দিতেই মনে হল একটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে কাতর চেহারা। কুকুরটা পাগল ঠাকুরকে দেখে বলল, ঘেউ।

পাগল ঠাকুর দাঁড়ালেন। তারপর পুরানো কায়দায় হাত কচলে বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা।

কুকুরটা ফের বলল, ঘেউ।

পাগল ঠাকুর বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা।

জল কম বলেই আলের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে কুকুরটা। একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়ার জায়গা করে দিয়েছে। কুকুরের এই ভদ্রতাটুকু পাগল ঠাকুরের ভাল লাগল। তিনি আর তাকে মন্দ কথা বললেন না। তিনি পাশ কাটিয়ে নৌকা টেনে নেবার সময়ই কি মনে হতে পেছনে তাকালেন—কুকুরটা অবোধ বালকের মতো তাকিয়ে আছে। তিনি এবার আদর করার ভঙ্গিতে মুখে এক ধরনের শব্দ করতেই, জলের ভিতর ছপছপ শব্দ তুলে কুকুরটা পাশে এসে দাঁড়াল। পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ কুকুরটার মুখে চুমু খেলেন এবং নৌকায় তুলে বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা।

কুকুরটা পাটাতনের এক পাশে দাঁড়াল। গা ঝাড়ল। তারপর লম্বা হয়ে আড়মোড়া ভাঙল এবং জিভটা বের করে রাখল কিছুক্ষণের জন্য। পাগল ঠাকুর এবং সোনাকে দেখতে দেখতে হাঁপাচ্ছে। কুকুরটা লেজ নাড়ছে অনবরত। মণীন্দ্রনাথ তখন লগি মারছেন।

মণীন্দ্রনাথ শালুকের ফল তুলে খেলেন। ফল ভেঙে সোনাকে খেতে দিলেন। সোনা শক্ত জিনিস এখনও খেতে পারে না। সে খেতে গিয়ে বিষম খেল। ওর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। তিনি ওকে কোলে নিয়ে একটু আদর করলেন।

দুটো জমি পার হলে হাসান পীরের দরগা। শীতের শেষে তিনি এখানে ঘুরে গেছেন। তখন পীরের মেলা ছিল, সিন্নি ছিল। গ্রাম পার হয়ে মানুষেরা এসেছিল এবং মোমবাতি জ্বেলে সওদা করে ঘরে ফিরেছিল। এখন কোনও মানুষের সাড়াশব্দ নেই। শুধু ভাঙা-মসজিদ এবং পীরসাহেবের কবরের পাঁচিলে কয়েকটা কাক অনবরত উড়ছে, সোনার কিছুতেই কান্না থামছে না। তিনি এক হাতে সোনাকে বুকে নিয়ে অন্য হাতে লগি বাইতে থাকলেন। হাসান পীরের নির্জন দরগাতে নৌকা ভিড়িয়ে এক সময় ভিতরে উঠে গেলেন।

কাকগুলি পাঁচিলের উপর চিৎকার করছে। পীরসাহেবের কবরের পাশে পলাশ গাছটা এখনও তেমনি আছে। পাগল মানুষটাকে দেখে কাকগুলি পলাশ গাছটার উপর এসে বসল। ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দূরের মাইনর স্কুলটা দেখা যাচ্ছে। মণীন্দ্রনাথ হেঁটে-হেঁটে একদা এই বিদ্যালয়ে বিদ্যাভাস করতে আসতেন।

ভিটেমাটির মতো এই জমিটা উঁচু। কয়েকটা আমগাছ কিছু পাখপাখালি, বেতঝোপ, কাঁকড়া, সাপ এবং মোত্রাঘাসের জঙ্গল নিয়ে পীর সাহেব কবরের নিচে ঘুমোচ্ছেন। বন্যায় জল পীরসাহেবকে ছুঁতে পারে না। তখন অদূরের নদী-নালার কচ্ছপেরা পর্যন্ত নরম মাটির খোঁজে পীরসাহেবের কাছে চলে আসে। ডিম পাড়ার জন্য আশ্রয় চায়, ডিমে তা দেবার জন্য আশ্রয় চায়। অঘ্রাণ মাস, বেলা পড়তে দেরি নেই। সোনা তখনও কাঁদছিল। কুকুরটা ওদের পায়ে পায়ে হাঁটছে। কবরখানায় দুটো একটা পাতা ঝরে পড়ল। হেমন্তের শীত ভাবটা সকল ঘাস পাখি এবং পীরসাহেবের পাঁচিলের গায়ে জড়িয়ে আছে। পাঁচিলের নিচে কতরকমের গর্ত। কবরের বেদী থেকে ভাঙা কাঁচ আলগা হয়ে গেছে।

মণীন্দ্রনাথ সোনাকে কোলে নিয়ে এই পাঁচিলের চারিদিকে ঘুরতে থাকলেন। কাকগুলি নির্জন নিঃসঙ্গ দরগায় সহসা মানুষ দেখে কেমন ক্ষেপে গেল। ওরা মণীন্দ্রনাথের মাথার উপর ঘুরে-ঘুরে উড়তে থাকল। কতদিন অথবা দীর্ঘ সময় বাদে মণীন্দ্রনাথ পীরসাহেবের দরগাতে এসেছেন, কতদিন অথবা দীর্ঘ সময় বাদে মণীন্দ্রনাথ পীরসাহেবকে গলায় দড়ি দিয়ে মরার কারণটা জিজ্ঞাসা করতে চাইলেন।

সোনা এখন আর কাঁদছে না। পাগল ঠাকুর সোনাকে ঘাসের উপর শুইয়ে দিলেন। কুকুরটা এতক্ষণ পায়ে-পায়ে ঘুরছিল। মণীন্দ্রনাথ সোনাকে রেখে একটু হেঁটে গেলেন সামনে। কুকুরটা সোনার পাশে বসে থাকল। একটুকু নড়ল না। ঘাসের ওপর শুয়ে সোনা হাত-পা ছড়িয়ে এখন খেলছে। মণীন্দ্রনাথ যেন কোথায় যাচ্ছেন। তিনি পাঁচিলের দরজা টপকে ভিতরে ঢুকে গেলেন এবং বললেন, গ্যাৎচোরে শালা। যেন বলতে চাইলেন, পীরসাহেব, তোমার দরগাতে মেলা বসেছে, তুমি হিন্দু-মুসলমান সকল মানুষের পীর, তুমি গলায় দড়ি দিলে কেন, বলে বেদীটার পাশে এসে দাঁড়ালেন এবং একটা শুকনো ডাল এ সময় অন্য পাশে ভেঙে পড়ায় তিনি দেখলেন, ছাতিম গাছের মগডালে কিছু শকুন বাসা বেঁধেছে।

পাগল মানুষ বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। বলার ইচ্ছা যেন, পীরসাহেব ভিতরে আছেন? তিনি বেদীটার পাশে বসলেন এবং কান পাতলেন মাটিতে—পীর সাহেবের মুখটা মনে করতে পারছেন, বুড়ো অথর্ব তখন পীরসাহেব। মণীন্দ্রনাথ দূরের বিদ্যালয় থেকে পাঠ নিয়ে ফেরার পথে এই দরগাতে এসে পীরসাহেবের দাড়ি-গোঁফবিহীন মুখটা দেখতেন। এবং সেই পীরসাহেব একদিন কেন যে রাত্রে গলায় দড়ি দিয়ে ছাতিম গাছটায় ঝুলে থাকলেন! হায়! ঈশ্বর জানেন, এমন মানুষ হয় না এবং কথিত ছিল পীরসাহেবের আহারের প্রয়োজন হতো না। পীরসাহেবের হুঁকো-কল্কে কোমরে বাঁধা থাকত। তিনি এই দরগার চারপাশে ঘুরতেন শুধু এবং রাতের অন্ধকারে যখন দূরে দূরে শুধু ইতস্তত গয়না নৌকার আলো, দূরে দূরে সব গ্রাম গভীর মায়ায় আচ্ছন্ন তখন তিনি শাক-পাতা অথবা পুরানো ছাতিম গাছের ডাল বেয়ে উঠে শকুনের ডিম অন্বেষণ করতেন, কচ্ছপেরা এই দরগাতে অথবা খালের ধারে হেমন্তের শেষে, শীতের প্রথমে ডিম পেড়ে রেখে যেত—তাও অন্বেষণ করে ঘরে তুলে রাখতেন।

এখন আর সেসব শাক-পাতার গাছ এই দরগাতে নেই। হেজে মজে গেছে। বর্ষাকাল গেছে বলেই দরগার চারধারে নানারকমের আগাছার জঙ্গল—কিছু ঘাসের চিহ্ন। নরম ঘাসে সোনা ঘুমোচ্ছে—এই সময় সোনার কথা মনে হওয়ায় তিনি পাঁচিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। যখন দেখলেন সোনা ঘাসের ওপর শুয়ে ঘুমোচ্ছে, কুকুরটা পাহারায় আছে, তখন তিনি ফিরে এলেন। পাঁচিলটার ভিতরের দিকে প্রচুর জায়গা। বড় বড় গর্ত, কবর থেকে যেন ঢাকনা খুলে কারা মানুষ তুলে নিয়ে গেছে। বড় বড় শান পড়ে আছে। শান দিয়ে ঢেকে দিলেই একটা মানুষ গায়েব। কেউ জানবে না শানের নিচে একটা মানুষ আটকা পড়েছে। প্রচুর জায়গা দেখে, ঘর করে এখন কেমন এই দরগায় বসবাসের ইচ্ছা মণীন্দ্রনাথের। মেলার সময় যেখানে মোমবাতি জ্বেলে দেওয়া হয়, পীরসাহবের নামে সিন্নি চড়ানো হয়, সেই জায়গাটুকু শুধু পরিষ্কার। সেই জায়গাটুকুতে দূর্বাঘাস এবং সেই জায়গাটুকুতেই একটা কুঁড়েঘর ছিল, ভাঙা হাঁড়ি কলসি ছিল, কিছু দ্রব্যগুণ ছিল পীরসাহেবের—যার দৌলতে হাসান চোর ফকির হল এবং এক সময় পীর বনে গেল। মালা, তাবিজ নানারকমের হাড় সংগ্রহের বাতিক ছিল হাসানের। গোর দেবার সময় সবই ওর কবরে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন লম্বা বেদীর ওপর শকুনেরা শুধু হাগছেই। কাক এবং অন্য পাখপাখালি—যেমন শালিকের কথাই ধরা যাক, বড় বেশি ভিড় করছে এই দরগাতে। আর এই হাসান পীরই বলেছিলেন, তর যা চক্ষু মণি, চক্ষুতে কয় তুই পাগল বইনা যাবি।

—কী যে কন পীরসাহেব!

—আমি ঠিক কথাই কই ঠাকুর। তর সব লিখাপড়া মিছা। পীর-পয়গম্বর হইতে হইলে তর মত চক্ষু লাগে, তর শরীর মুখ লাগে। তর মত চক্ষু না থাকলে পাগল হওন যায় না, পাগল করন যায় না। আর ফোর্ট উইলিয়ামের র‍্যামপাটে বসে পলিন বলত, তোমার চোখ বড় গভীর বড় বিষণ্ণ মণি। ইত্তর আইজ আর গ্লুমি। অথবা বোটানিক্যালের পুরানো বটের ছায়ায় পলিন ববকাটা চুলে বিলি কেটে মিহি ইংরাজিতে উচ্চারণ করত, এস, আমরা দু’জনে একসঙ্গে বসে কীসের কবিতা আবৃত্তি করি। দেয়রস নান আই গ্রীভ টু লিভ বিহাইণ্ড বাট ওনলি, দি’। তখন দূরের নারকেল গাছ অথবা গঙ্গাবক্ষে জাহাজের বাঁশি এবং সমুদ্র থেকে আগত সব পাখিদের পাখার শব্দ উভয়কে অন্যমনস্ক করত। ওরা তখন পরস্পর নিবিষ্টভাবে পরস্পরকে দেখত। কবিতা উচ্চারণের পর পাখির পালকের মতো উভয়ে হালকা এক বিষণ্নতায় ডুবে থেকে কথা বলত না।

পলিন বলত, চলো এইসব জাহাজে উঠে আমরা অন্য কোনও সমুদ্রে চলে যাই। মণীন্দ্রনাথ এই দরগায় বসে সেই সব স্মৃতিতে এখন কাতর হচ্ছিলেন। তাঁর ইচ্ছার ঘরে পলিন…১৯২৫-২৬ সাল, পলিন তখন তরুণী, প্রথম মহাযুদ্ধে পলিনের দাদার মৃত্যু এবং সেই পরিবারে কোনও রাতের আঁধারে মোমবাতির সামনে যীশুখ্রিস্টের ছবি, হাঁটু গেড়ে পলিনের বসে থাকা—কি সব স্মৃতি যেন বার বার মাথার ভিতর ভেসে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়। মণীন্দ্রনাথ কিছু মনে করতে পারেন না। তাঁর এখন কেবল ভালোমানুষের মতো কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, ইচ্ছা হচ্ছিল এই দরগার মালিক হাসান পীরকে বলতে, আবার সেখানে ফিরে-যেতে পারি না পীরসাহেব? অথচ কথা বলার সময় সেই এক উচ্চারণ। আর এ-সময় পাখিরা উড়তে থাকল। হেমন্তের রোদ নেমে গেছে। বর্ষার জল এখন জলাজমিতে হাঁটু জলে এসে থেমেছে। ছোট ছোট চাঁদা মাছ, বৈচা মাছ ধানের গুঁড়িতে লেজ নেড়ে শ্যাওলা খাচ্ছে! শীতের এই আমেজ সকল প্রাণী-জীবনে শুভ এক বার্তা বয়ে আনছে। তবু অনেক মোত্রাঘাস পেরিয়ে, অনেক বন-জঙ্গল পেরিয়ে, নদী-নালা অতিক্রম করে শুধু সেই ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গ, তার সবুজ মাঠ এবং গম্বুজের মাথায় জালালি কবুতর উড়ছে—মণীন্দ্রনাথ দরগার বেদীতে বসে এখন কেবল দুর্গের মাথায় সূর্য দেখছেন। যেন পলিন সেই সূর্যের আলো এই অবেলায় দরগার মাঠে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

সোনা বসে নেই, অথবা হামাগুড়ি দিয়ে সোনা এগিয়েও যাচ্ছে না। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কুকুরটা বসে রয়েছে। নড়ছে না। তবুও যেন কেমন ঘুম পাচ্ছে। কুকুরটা চোখ বুজেছিল। মণীন্দ্রনাথ আরও দেখলেন হেমন্তের রোদ খুব সরু হয়ে পাঁচিলের গায়ে লেগে আছে। সোনার জলের মতো এই রেখা চিকচিক করছে। মণীন্দ্রনাথ পলাশের ডাল ফাঁক করে আকাশের ভিতর মাথা গুঁজে দিলেন এবং সেই আলোর জল যেখান থেকে ঝরে পড়ছে, তাকে দুহাতে ধরতে চাইলেন। বড় উষ্ণ মনে হচ্ছে সেই আঁধারকে। সুতরাং লাফ দিয়ে পাঁচিল টপকালেন। তারপর দু’হাত ওপরে তুলে সেই আলোর ঘর সূর্যকে ধরার জন্য ছুটতে থাকলেন। অথচ যত এগোচ্ছেন সূর্য তত ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। ঘাস জঙ্গল পার হলেই দরগার জমি শেষ। তিনি ক্রমশ মাঠে নেমে যেতে থাকলেন, মাঠে হাঁটুজল, জল ভেঙে এগুতে থাকলেন—যেন ঐ সূর্য পালিয়ে যাচ্ছে যে রথে, তিনি সেই রথে এখন উঠে যাবেন এবং অশ্বের বল্গা ধারণ করবেন। তারপর সূর্যকে নিয়ে সেই নিরুদ্দেশে, যেখানে পলিন এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। আর তা যদি না হয় এই সূর্যকে এনে অশ্বত্থের ডালে ঝুলিয়ে দেবেন। এই ধরিত্রীর সব লাঞ্ছনা দূর করতে, অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে সূর্যকে ধরে আনবেন। অর্থাৎ তিনি যেন ধরিত্রীকে সব কলুষ-কালিমা থেকে রক্ষা করার জন্য অথবা এক প্রিয় নিদর্শন রাখার জন্য পাগলের মতো ধানখেত, শীতল জল এবং খাল-বিল সাঁতরে যখন ট্যাবার পুকুরপাড়ে উঠলেন তখন দেখলেন সূর্য পলাতকের মতো গাছগাছালির অন্য প্রান্তে নেমে গেছে। তিনি সূর্যকে ওপারে বিলের জলে অদৃশ্য হতে দেখে ভেঙে পড়লেন। পরাজিত সৈনিকের মতো একটা গাছে হেলান দিয়ে যেন বন্দুকের নল হাতে রেখেছেন এমন ভাবের এক ভঙ্গি টেনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। চারপাশে রাতের সব কীটপতঙ্গের আওয়াজ আর তার সঙ্গে অতিদূর থেকে আগত এক শিশুকান্না। তাঁর মাথার ভিতর ফের যন্ত্রণা হতে থাকল। পিছনে যেন কি ফেলে এসেছেন, একেবারেই মনে করতে পারছেন না। এতদূর থেকে কান্না সেই শিশুর, মনে হয় মাঠময় হাজার শিশু উচ্চরোলে কাঁদছে। তাঁর কিছুই মনে পড়ছে না। কর্দমাক্ত পথে তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। পথটা তাঁর খুবই চেনা। চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে, অথচ দূর থেকে আগত শিশুকান্নার জন্য ব্যথিত হচ্ছিলেন। সোনা যে একা বসে বারান্দায় খেলছিল, পাগল-জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা কথা বলছিল এবং তিনি যে তাকে আদর করে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হয়েছেন, সকলের অলক্ষ্যে নৌকা নিয়ে-সোনা দ্যাখো, কত জমিন মাঠ, এই মাঠ এবং জমির ভিতর তুমি বড় হবে, এই তোমার জন্মভূমি, মায়ের চেয়ে বড়, ঈশ্বরের চেয়ে সত্য এই ঘাস ফুল মাটি–অথচ এখন কিছুতেই সেসব তিনি মনে করতে পারছেন না—কখন ঘর থেকে বের হয়েছেন, কে, কে তাঁর সঙ্গে ছিল।

কুকুর, সোনা এবং কোষা নৌকাটা দরগার মাটিতে পড়ে থাকল। দরগার মাটিতে হাসান পীরের স্পর্শ ওদের জন্য থাকুক। ছাতিমের ডালে শকুনের আর্তনাদ—এইসব নির্জন নিঃসঙ্গ গ্রামকে ভয় দেখাচ্ছে। আর মণীন্দ্রনাথ ঘরে ফিরেই দেখলেন—সব মানুষ ছোটাছুটি করছে। প্রতিবেশীরা এসে জড়ো হয়েছে। সোনা কি করে নিখোঁজ হয়ে গেছে সংসার থেকে। ধনবৌ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, পাগল মানুষ বাড়ি একা ফিরেছেন, কোষা নৌকা আনেননি। ধনবৌ, বড়বৌ সকলেই কাঁদছিল। অন্ধ মানুষ মহেন্দ্ৰনাথ উঠোনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মণীন্দ্রনাথ বুঝলেন—বাড়ি থেকে সোনা হারিয়ে গেছে। ওরা সকলে মিলে সোনাকে অন্বেষণ করছে। এবার মণীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে সব মনে করতে পারলেন, ধীরে ধীরে সকলের অলক্ষ্যে জলে নেমে গেলেন। হাঁটুজল ভেঙে যত এগুতে থাকলেন, তত কুকুরের আর্তনাদ স্পষ্ট হতে থাকল। তত তিনি বলতে চাইলেন যেন—হাসান পীর, তুই আছিস, তোর দরগা আছে, আমার সোনা তোর কাছে গচ্ছিত আছে। তিনি অন্ধকার পথে ছুটে চললেন। তিনি জল-কাদা ভেঙে ছুটলেন। তিনি ঘেমে যাচ্ছেন। কাদা জলে মুখ-শরীর ভরে যাচ্ছে। তিনি শুধু এখন কুকুরের ডাক অনুসরণ করে হেঁটে যাচ্ছেন। হাতে কোনও লণ্ঠন নেই—কোনও পরিচিত শব্দ পাচ্ছেন না। থেকে থেকে দূরে শেয়ালের আর্তনাদ। একটা কুকুর কী করে পারবে এত শেয়ালের সঙ্গে। সোনা, সোনারে। কেমন ভালোমানুষের মতো মুহূর্তে আবেগ ভরে ডেকে ফেললেন। আমি তোকে জঙ্গলে ফেলে এসেছি। আর কিছু বলতে পারলেন না। আলো ছিল না, তবু নক্ষত্রের আলোতে তিনি পথ চিনে নিতে পারছেন। অবশেষে তিনি আরও কাছে গিয়ে বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। তিনি জোরে জোরে একই উচ্চারণে ডাকলেন অথচ কুকুরটা কাছে আসছে না। পাঁচিলের কোন এক গহ্বর থেকে কুকুরটা যেন ডাকছে। তিনি ভিতরে ঢুকে দেখলেন, সোনা হামাগুড়ি দিচ্ছে আর কাঁদছে। কুকুরটা পাশে পাশে থাকছে। অনবরত কান্নায় ভেঙে আসছে গলা। শুধু গলাতে এখন একটা হিক্কার শব্দ। পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি সোনাকে বুকে তুলে নিলেন এবং আদর করতে থাকলেন। সোনার হাত মুখ স্পর্শ করে, অক্ষত সোনার শরীরের জন্য এক অপার আনন্দ—ধনবৌর মুখ, ব্যথিত সংসার আর কুকুরটাকে কাছে টেনে এক নতুন সংসার-বার বার তিনি কৃতজ্ঞতায় কুকুরটাকে চুম খেয়ে কেমন পাগলের মতো ছুটে গিয়ে কোষা নৌকাটাতে উঠতেই শুনলেন, একদল ধূর্ত শেয়াল পাঁচিলের পাশে হুক্কাহুয়া করছে। তিনি আকাশ এবং দরগার ভাঙা কাচের স্বচ্ছ ভাবকে মথিত করে হেসে উঠলেন। কুকুরকে বললেন, আকাশ দ্যাখো, সোনাকে বললেন, নক্ষত্র দ্যাখো—ঘাস ফড়িং-ফুল-পাখি দ্যাখো, জন্মভূমি দ্যাখো। তারপর নিজে দেখলেন আকাশের গায়ে লেখা রয়েছে—সোনার মুখ, পলিনের চোখ। কুকুরটা পাটাতনে দাঁড়িয়ে নীরবে লেজ নাড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *