প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.২

১.২

ঢাক-ঢোলের বাজনা শোনা যাচ্ছে। ব্যাগপাইপ বাজাচ্ছে কেউ—মনে হয় কেউ দামামা বাজাচ্ছে। একদল লোক ঢাক-ঢোল বাজিয়ে গোপাট ধরে উঠে আসছে। শচীন্দ্রনাথ পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে সেই শব্দ শুনছিলেন। বুঝি ফেলু ফিরছে নারাণগঞ্জ থেকে। ফেলুর গলায় কালো তার বাঁধা। সে হা-ডু-ডু খেলে ফিরছে। কাপ-মেডেল কালো একটা কাপড়ে ঢাকা।

এবারেও ফেলু তবে গোপালদির বাবুদের বিপক্ষে খেলে এসেছে। মুখের উপর ফেলুর চাপদাড়ি আছে বলে আর কাঁধে সব সময় গামছা ফেলে রাখে বলে গেঞ্জির উপর বুকের ছাতিটা কাছিমের মতো, কত প্রশস্ত মাপা যায় না। কিন্তু কাছে এলে দলটা মনে হল—না, ফেলুর দল নয়, অন্য দল। তবে কি ফেলু এবারে হেরে এল! ওর দলবল ফিরছে না কেন? এই প্রথম তবে ফেলু হেরে গেছে। ফেলুর যৌবন চলে যাচ্ছে তবে। যখন ওর যৌবন ছিল—তখন এই তল্লাটে দুই আদমি ফেলু আর সাবু—দুই বড় খেলোয়াড়, হা-ডু-ডু খেলোয়াড়। তখন এই তল্লাটে বিশ্বাসপাড়া, নয়াপাড়া, এমন কি দশ-বিশ ক্রোশ দূরে অথবা গোপালদির মাঠ পার হয়ে সেই মেঘনার চরে ওদের খেলা দেখার জন্য কাতারে কাতারে লোক—ফেলু হ্যা-রে…রে…ডু…ডু বলে যখন দাগের উপর বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ত—যখন ফাইনাল খেলার দামামা বাজত, ব্যাগপাইপ বাজত, তখন ফেলুর মুখ দেখলে মনে হতো ফেলু বড় কুশলী খেলোয়াড়। তখন কত মেডেল গলায় ঝুলত তার।

কত কাপ এনে দিয়েছে সে তার দলের হয়ে! দিন নাই রাত নাই, ফেলু বিশ পঁচিশ ক্রোশ পথ হেঁটে খেলতে চলে গেছে। একবার বড় শহরে খেলতে গিয়েছিল, ফেরার পথে পালকিতে। জয় জয়ার ফেলুর। পালকির দুপাশে দু’মানুষের মাথায় দুই কাপ, ডে-লাইট জ্বালিয়ে দামামা বার্জিয়ে ওরা শহর থেকে গ্রামে ফিরেছিল। নাঙলবন্দের মাঠ এবং নদী পার হলে গ্রামের মানুষেরা বৌ-বিবিরা সেই যে দাঁড়িয়ে গেল দেখতে, তার আর শেষ নেই। ওরা ফেলুকে দেখছিল, দুই বড় কাপ দেখছিল, কালো তার গলায় দলের হা-ডু-ডু খেলোয়াড়দের দেখছিল—য্যান ঢাকার ঝুলনযাত্রা যায়। সেই ফেলু তবে এবারে হেরে গেছে! অন্য দলের মানুষেরা, জয় গোপালদির বাবুদের কি জয়…বলতে বলতে যাচ্ছে। শচীন্দ্রনাথের কেন জানি এ সময়ে ফেলুর মুখটা দেখতে ইচ্ছা হল। ফেলু হয়তো হেরে গিয়ে আগে বাড়ি চলে এসেছে। আর কিছু না পেয়ে হয়তো বিবি আন্নুকে ধরে পেটাচ্ছে।

চন্দ্রনাথ এ-সময় তাঁর জাতক দেখছেন। আঁতুড়ঘরে শশীবালা চন্দ্রনাথকে আর একটু ঝুঁকতে বললেন। ধনবৌ পান খেয়েছে। ঠোঁট লাল। এ-ক’দিন সিঁদুর দিতে নেই কপালে—কপাল সাদা। ঘরের ভিতরে ভিজা কাঠ জ্বলছে। কিছু শতচ্ছিন্ন নেকড়া। এক কোনায় আগুনটা গনগন করছিল। দু-হাতে ধনবৌ জাতককে সামনে তুলে ধরল, চন্দ্রনাথ ছেলে না দেখে ধনবৌর মুখ দেখলেন, কেমন সাদা হয়ে গেছে মুখটা—শালুক পাতার মতো রঙ মুখে। ধনবৌর চোখ, আবার মা হতে পেরেছে বলে জ্বলজ্বল করছিল। হাতের নোয়া, লালপেড়ে কাপড়, দুহাতে জাতককে তুলে ধরার ভঙ্গি, সবটুকু মিলে ফিসফিস করে বলার মতো—কেমন দ্যাখছ। কার মতো হইব! তোমার মতো, না আমার মতো?

তখন মণীন্দ্রনাথ একটা অশ্বত্থ গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। এই পথ দিয়ে হা-ডু-ডু খেলার দলটা চলে গেছে। তিনি কাপ মেডেল এবং মানুষের উল্লাস দেখার জন্য ওদের পিছনে পিছনে বের হয়ে পড়েছিলেন—এখন তারা নয়াপাড়ার মাঠে নেমে গেছে। তিনি তাদের সঙ্গে অতদূর গেলেন না। এই অশ্বত্থ গাছটার নিচে এলেই দূরের এক যেন দূর্গ দেখতে পান। দূর্গে হয়তো অশ্বারোহী কিছু যুবক এখন কদম দিচ্ছে। দূর্গের দরজা খুলে গেলে যেমন হাজার সেনা বের হয়ে মাঠে চত্বরে খেলা দেখায়—এখন যেন তেমনি গাছের উপরে হাজার গাঙশালিক মাথার উপর উড়ে-উড়ে খেলা দেখাচ্ছে! যারা নদী থেকে ফিরে আসেনি, যারা খুঁটে খুঁটে নদীর চরে অথবা বিলে পোকামাকড় খাচ্ছে, তারা এবারে ফিরে আসবে। ফিরে এলেই তিনি এই গাছের নিচে বসে আপন মনে এক মনোরম জগৎ বানিয়ে বসে থাকবেন।

গাছটার নিচে কিছু মটকিলার গাছ, কিছু বেতপাতার ঝোপ এবং বনকাশের জঙ্গল। কিছু ছাতার পাখি অনবরত ঝোপে-জঙ্গলে নেচে বেড়াচ্ছে। মণীন্দ্রনাথ গাছটাকে প্রদক্ষিণ করার মতো ঝোপ-জঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে থাকলেন। এত বড় গাছ। ঈশ্বরের মতো এই গাছ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে যেন। এবং তিনি ঈশ্বরকেই যেন প্রদক্ষিণ করছেন এমন একটা ভাব তাঁর চোখে মুখে। মুখ উঁচু করে গাছটা দেখছেন আর কি যেন বিড়বিড় করে বকছেন। তখন মুসলমান গ্রামের পুরুষেরা যেতে-যেতে আদাব দিল। বলল, কী মানুষ কী হইয়া গ্যাল! ওরা বলল, বাড়ি চলেন—দিয়া আসি। মণীন্দ্রনাথ ওদের কথায় বালকের মতো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন। তারপর ওরা যেই চলে গেল—সন্তর্পণে ঢুকে ঝোপের ভিতর বসে গেলেন। চুপচাপ ঝোপের ভিতরে বসে মটকিলার ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে থাকলেন। কতদিন যেন দাঁত মাজেননি, কতকাল সব ভুলে বসেছিলেন যেন—তিনি মুখে দুর্গন্ধ দূর করার নিমিত্ত দাঁত ঘষে ঘষে সাদা করে তুলছেন। আবেদালি উঠে আসছিল গ্রামে, সে দেখল ঝোপের ভিতর পাগল ঠাকুর। সে বলল, কর্তা বাড়ি যান। আসমানের অবস্থা ভাল না।

মনীন্দ্রনাথ ঝোপের ভিতর থেকে আবেদালির কথা শুনেও হাসলেন। মুসলমান. বিবিরা শালুক তুলে বাড়ি ফিরছিল। ওরা ঝোপের ভিতর খচখচ শব্দ শুনে উঁকি দিল। শিশুর মতো পাগল ঠাকুর ঝোপের ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে কি যেন অন্বেষণ করছেন। বিবিরা বলল, কর্তাগ, বাড়ি যান। মা-ঠাইরেন চিন্তা করব—আসমান বড় টান-টান ধরছে।

আবেদালি বাড়ি উঠে ভাবল–কর্তারে ধইরা নিয়া গ্যালে হয়। কিন্তু বুড়ো ঠাকুরুণ শশীবালার কথা মনে করে কেমন সঙ্কুচিত হয়ে গেল। যদি তিনি অসন্তুষ্ট হন, যদি বলেন, তুই ক্যান অরে ধইরা আনলি। আবার অরে সান করান লাগব, এই সব ভেবে উঠোনে আর দাঁড়াল না। সে চন্দদের নৌকায় কাজ করে। নদীতে নৌকা থাকে। ক’দিন পর বাড়ি ফিরছে—ক্লান্ত এবং অবসন্ন তবু কী এক কষ্টের কথা ভেবে আসমানের দিকে তাকিয়ে ওর ডর ধরে গেল। ঝড়-জল আসমান ফেটে নামলে মানুষটা ভিজে-ভিজে মরে যাবে। সে মাঠে নেমে গেল। এবং নদীর চরে ঈশমের ছই, সে ছইয়ের দিকে হাঁটতে থাকল। ঈশমকে খবরটা দিয়ে ঘরে ফিরবে।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আকাশের অবস্থা দেখে মাঠ থেকে মানুষেরা গ্রামে উঠে গেল। গরু-বাছুর নিয়ে গৃহস্থেরা ফিরে এল বাড়ি। ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে, শিলাবৃষ্টি হতে পারে, আকাশটা ক্রমে কালো হয়ে গেল। দুটো-একটা সাদা বক ইতস্তত উড়ে উড়ে নিরুদ্দেশে চলে যাচ্ছিল। খুব থমথমে ভাব। ডালপালা একটাও নড়ছে না। মুসলমান গ্রামে মোরগেরা ডাকতে থাকল। যত আকাশ কালো হচ্ছে, যত এই পৃথিবী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মণীন্দ্রনাথ তত উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। কি উল্লাস, কি উল্লাস! তিনি যেন ঘুরে-ফিরে নাচছিলেন। তিনি আকাশ দেখে, পাগলপারা আকাশ দেখে যেমন খুশি হলে তালি বাজান, ভুবনময় তালি বাজে—তিনি নেচে-নেচে তালি বাজাতে থাকলেন! টুপটাপ বৃষ্টি, গাছপাতা ভিজে যাচ্ছে। গরমে মাথা শক্ত হয়ে যাচ্ছে—এই টুপটাপ বৃষ্টি, আকাশের ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব ওঁকে সামান্য সহজ করে তুলছিল। কিন্তু এক্ষুনি শচী আসতে পারে, চন্দ্রনাথ আসতে পারে। ওরা এসে তাঁকে জোর করে নিয়ে যেতে পারে। ঈশ্বরের মতো গাছটার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারে ভাবতেই তিনি কাপড়ের আঁচলে গাছের ডালে নানা রকমের গিঁট দিতে থাকলেন। ঝড়ে ওঁকে ঠেলতে পারবে না, গ্রামের মানুষেরা ধরে নিয়ে যেতে পারবে না। তিনি কাপড়টা গোটা খুলে গাছের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেললেন।

টোডারবাগ থেকে নেমে আবেদালি সড়ক ধরে হাঁটতে থাকল। বাড়ির কাজ ফেলে, নামাজ ফেলে সে ঈশমের জন্য নদীর চরে নেমে যাচ্ছে। ছইয়ের নিচে কোনও লণ্ঠন জ্বলতে দেখল না। সে আলে দাঁড়িয়ে ডাকল, অ ঈশম চাচা, আছেন নাকি? বৃষ্টি পড়ায় আবেদালির শরীর ভিজে গেছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য শীত করছে। সুতরাং সে বেশিক্ষণ আপেক্ষা করতে পারল না। সে নিজের গাঁয়ে ফিরে ঘরে ওঠার মুখে ডাকল, জব্বরের মা, আমি আইছি দরজা খোল। অথচ কোনও সাড়া না পেয়ে সে কেমন ক্ষেপে গেল। সে চিৎকার করে ডাকল, তরা মইরা আছস নাকি!

বৃষ্টির শব্দের জন্যই হোক অথবা অন্য কোনও কারণে—জব্বর দরজা খুলতে দেরি করছে। আবেদালি বার বার ঝাঁপের দরজায় ধাক্কা মারতে থাকল। জব্বর দরজা খুললে সে কেমন পাগলের মতো চিৎকার করে বলল, তর মায় কই রে?

—মায় গ্যাছে সামুগ বাড়ি।

—ক্যান্ গ্যাল। আবেদালি তফন দিয়ে শরীর মুখ মুছল।

—সামুগ বাড়িতে জাল্‌সা আছে।

আবেদালি তিন-চারদিন পর বাড়ি ফিরেছে। সুতরাং গ্রামের কোথায় কি হচ্ছে জানার কথা নয়। আবেদালি চন্দদের বড় নৌকা নিয়ে নারাণগঞ্জে সওদা করতে গিয়েছিল। দন্দির বাজারে চন্দদের মুদির দোকান! আবেদালি চন্দদের বড় নৌকার মাঝি। ঘরে ফিরে সে কেমন শান্তি পাচ্ছিল না। ওর মনটা কেবল খচখচ করছে। এখনও হয়তো বড়কর্তা ঝোপে বসে আছেন। বাড়ির মানুষেরা বড়কর্তার জন্য ভাবছে। হয়তো কেউ কেউ খুঁজতে বের হয়ে গেছে। সে এবার ছেলের দিকে তাকাল–বলল, জব্বর, একটা কাম করবি বা’জান।

জব্বর কেমন ঝাঁঝের গলায় বলল, কারণ এখন কত কথা এই বয়স্ক মানুষটা তাকে বলতে পারে, যাও মাঠের খেড় তুইলা আন। পানিতে ভিজা গেলে গরুতে খাইব না!—কী করতে কন!

প্রথম ভাবল বিবির কথা বলবে। সে এসেছে—কোথায় বিবি এসে তাকে এখন খানাপিনার অথবা মর্জি মোতাবেক কিছু কথাবার্তা—তা না জাল্‌সায় পরাণ খুইলা দিছে। সে বিরক্ত হয়ে বলল, তর মায়েরে ডাক দিনি।

—মায় কি অখন আইব?

—আইব না ক্যান রে। তিনদিন ধইরা লগি বাইছি—এই জানডার লাগি তগ মায়া-মমতা নাই রে!

—আর বেশিদিন কষ্ট করতে হইব না বা’জান

এমন কথায় আবেদালি কি যেন টের পেয়ে বলল, হ, চুপ কর।

জব্বর চুপ করে ছেঁড়া মাদুরটার এক পাশে বসে থাকল। সহসা বলল, হুঁকা খাইবেন বা’জান? আবেদালি বুঝল, জব্বরও এসময় একটু হুঁকা খেতে চায়। মনটাতে খোশ-মোজাজ এনে দেবার জন্য বলল, সাজা।

জব্বর হুঁকা সাজাল। বাপকে দিল। তারপর নিজেও দু’টান দিয়ে বলল, আপনে নামাজ পড়েন, আমি ভাতটা বাড়তাছি।

—নামাজ পড়মু না! আবেদালি এবার উঠল। বৃষ্টির জলে বদনা ভরল। এবং হাতে মুখে জল দিল। বাইরে জোর বর্ষণ হচ্ছে। মাঝে মাঝে আকাশটা চিরে যাচ্ছে। যেন কে মাঝে মাঝে আসমানের গায়ে স্বর্ণলতা ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে-ফালা ফালা আকাশে গর্জন উঠছিল—আবেদালির ঘরটা যেন পড়ে যাবে। শণের চাল পচে গেছে। টুই দিয়ে জল গড়িয়ে নামছে। পাটকাঠির বেড়া পচে গেছে। বাঁশের উপর ছেঁড়া পাটি এবং কাঁথা বালিশ, নিচে ছেঁড়া চাটাই। আবেদালি ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর খেতে বসল। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া দিচ্ছে, মাদার গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ল। আবেদালি ডাকল, অ, জব্বর! জব্বর! খুব ধীরে এবং সে সোহাগের গলায় ডাকল।

—কিছু কন আমারে?

—একটা কাম করতে পারবি?

—কী কাম?

—তুই একবার বা জান ঠাকুরবাড়িতে গিয়া ক’দিনি, বড়কর্তা গোরস্থানের বটগাছটার নিচে বইসা আছে। বা’জানরে, বড় কষ্ট বড়কর্তার—যা, একবার গিয়া কর্তার বাড়িতে খবর দে।

—আমি পারমু না বাজান। আমারে অন্য কামের কথা কন!

আবেদালি এবার খাবার ফেলে উঠে পড়ল। সে জব্বরের মুখের সামনে গিয়ে খেঁকিয়ে উঠল—যেন সে জব্বরকে মেরেই ফেলবে—পা’টা পিঠের কাছে নিয়ে কি ভেবে সরিয়ে আনল। বলল হালার পো হালা, তুমি আমার বাপজান। তোমার কথায় আমি চলুম!

জব্বর তেমনি মাথা নিচু করে বসে থাকল।—আমারে অন্য কামের কথা কন। সে যেন কি স্থির করে রেখেছে মনে-মনে। সুখে এবং স্বচ্ছন্দে দিন যায় না–বাপ তার কত দিন পরে ঘরে ফিরে এসেছে। এসে কোথায় মিষ্টি কথা বলবে—তা না কেবল খ্যাক খ্যাক করছে খাটাশের মতো। সে ভিতরে-ভিতরে এতক্ষণ যা প্রকাশ করতে চাইছিল না, বাপের মর্জি দেখে, এই নিষ্ঠুর চেহারা দেখে মরিয়া হয়ে উঠল—যেন বাপ ফের বললে সে মুখের উপরে বলেই দেবে।

—কি যাবি না!

—না। আমারে অন্য কামের কথা কন।

—তা হইলে আমার কথা থাকব না!

—না।

—ক্যান, কী হইছে! আবেদালি এবার স্বর নামাল।

—আমি লীগে নাম লেখাইছি।

—ত হইছে ডা কি! হইছে ডা কী ক? নাম লেখাইয়া বা’জানের কোরান-শরিফ শুদ্ধ কইরা দিছ!

—কী হইব আবার। হিন্দুরা আমাগ দ্যাখলে ছ্যাপ ফালায়, আমরা-অ ছ্যাপ ফ্যালামু।

—জাল্‌সাতে বুঝি এডাই হইতাছে!

জব্বর এবার চুপ করে থাকল।

বাপ্ বেটা এবার দু’জনেই চুপ। আবেদালি ফের খেতে বসে গেল। মাথা নিচু করে খেতে বসে গেল। ঝালে—কি ছেলের কথায়, চোখ ছলছল করছে বোঝা যাচ্ছে না। সে নিজের এই দুঃখটুকু সামলাবার জন্য জল খেতে থাকল। তারপর খুব ধীরে ধীরে যেন অনেক দূর থেকে বলার মতো বলল, বড়কর্তা পানিতে ভিজতাছে, তুই না গেলে আমি যামু। আবেদালি বদনার নল মুখে পুরে দিল এবং হাঁসের মতো কোৎ করে জলটা যেন গিলে ফেলল। তারপর বাকি জলটা মুখে রেখে অনেকক্ষণ কুলকুচা করল। দাঁতের ফাঁকে যা কিছু ভোজ্য দ্রব্য—যেখানে যেমন যে-ভাবে দাঁতের ফাঁকে লেগে আছে—সে জিভ দিয়ে দাঁতের ফাক থেকে বাকি খাদ্যবস্তুর স্বাদ নিতে নিতে কেমন নিষ্ঠুর চোখে ফের জব্বরের দিকে তাকাল। বলল, তুমি আমার ভাত পাইবা না, কাইল থাইকা তোমার ভাত বন্ধ। আবেদালি মরিয়া হয়ে উঠল। পুত্রের এমন সম্মান-অসম্মানবোধ ওর ভাল লাগল না। তিন দিনের পরিশ্রম এবং এ-সময়ে ঘরে বিবির অনুপস্থিতি ওকে পাগল করে দিল। একবার ইচ্ছা হল ঘরের কোণ থেকে সড়কিটা নিয়ে পেটে খোঁচা মারে—কিন্তু কি ভেবে সে বলল, আল্লা, দ্যাশে এটা কী শুরু হইল!

আবেদালির কাঁচা-পাকা দাড়ি বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কুপির আলোতে আবেদালির মুখ ভয়ানক উদ্বিগ্ন। ঢাকায় রায়ট লেগেছে—এসব কথা কেন জানি বার বার মনে পড়ছে। হিন্দু-মুসলমান উভয়ই জবাই হচ্ছে। সব কচুকাটা। মুসলমান জবাই হলেই সে কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়ে—কিন্তু বড়কর্তা ধনকর্তার এবং পাশের গ্রামের অন্যান্য অনেক হিন্দুর উদারতা, পুরুষানুক্রমে আত্মীয় সম্পর্ক সব দুঃখ, উত্তেজনা মুছে দেয়। দরজার ভিতর থেকেই হাত বাড়াল আবেদালি। একটা মাথলা মাথায় টেনে অন্ধকার পথে নেমে গেল।

.

শচী হাঁটছিলেন। আগে ঈশম যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে, সংসারে নানা রকমের দুঃখ জেগে থাকে—এই যে বড়কর্তা বিকেল থেকে নিরুদ্দেশে চলে গেল—কই গেল—ঝড়ে জলে এখন কোথায় আছে—এসব বলছিলেন। শত্রুর য্যান এমন না হয়! অশান্তি, অশান্তি! মারা গ্যালে-অ ভাবতাম, গ্যাছে। কতকাল এই দেখতে হবে ঈশ্বর জানে!

শচী এই ঝড়-বৃষ্টিতে এবং শীতের হাওয়ায় কাঁপতে থাকলেন। ঈশমও শীতে কাঁপছে। ঝড়জলের ভিতর দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছিলেন। ওরা অনেকগুলি জমি অতিক্রম করে মুসলমান পাড়ার ভিতর ঢুকতেই দেখলেন, ইমতালির বড় ছেলে মনজুর বারান্দায় বসে আছে। সামনে কোরাণশরিফ—উপরে দড়ি দিয়ে বাঁধা লণ্ঠন। ঝড়জল কমে গেছে। সে যেমন সাঁজ হলে রোজ পড়তে বসে তেমনি পড়তে বসার সময় দেখেছে—ঝড়জলে গ্রাম ভেসে যাচ্ছে। সে গরুগুলি গোয়ালে তুলে, হাঁসগুলি খোঁয়াড়ে রেখে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে বসেছিল। ঝড়জল থামতেই দরজা জানালা খুলে দিয়েছে। আকাশ তেমন গর্জন করছে না। সুতরাং সে পা দুটো ভাঁজ করে অনেকটা নামাজ পড়ার ভঙ্গিতে বসার সময় দেখল লাউমাচানে আলো এসে পড়ছে! তারপর আলোটা বাড়ির দিকে উঠে এলে দেখল—ঠাকুরবাড়ির ছোটকর্তা—শচী ঠাকুর। সঙ্গে ঈশম। ওরা এত রাতে—এ-পাড়ায়! সে তাড়াতাড়ি নেমে গেল। বলল, কর্তা এই ম্যাঘলা দিনে বাইরে বাইর হইছেন!

—বড়দারে দ্যাখছস এদিকে?

—না-গ কর্তা তাইনত আইজ ইদিকে আসে নাই।

মনজুর হ্যারিকেনটা হাতে নিল। বলল, আপনে বসেন! আমরা পাড়াটা খুঁইজা দ্যাখতাছি।

শচী বললেন, তুই আবার এই বৃষ্টিতে যাবি কি করতে। সকলে কষ্ট কইরা লাভ নাই। বলে হাঁটতে থাকলেন। মনজুর কোনও কথা বলল না। শুধু সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকল। এ-সময়ে গ্রামে কিছু কুকুর ডেকে উঠল। ফেলুর বাড়িটা বাঁশঝাড়ের নিচে অন্ধকারে ডুবে আছে। শচীর ইচ্ছা হল বলতে, ফেলু কি হাইরা গ্যাছে। ফেলুর বাড়িতে এত অন্ধকার! কুপি জ্বালাইয়া অর বিবিটা ত নলিতে সূতা ভরে! আইজ সাড়াশব্দ পাই না ক্যান। কিন্তু বলতে পারলেন না। কুল গাছে ফুলের গন্ধ। বৃষ্টি এবং ঝড়ের জন্য কিছু ফুল মাটিতে পড়ে আছে। শচী এসব মাড়িয়ে সহসা দেখতে পেলেন বড় একটা ডে-লাইট জ্বলছে সামুদের বাড়ি। বড় টিন-কাঠের ঘর, চওড়া বারান্দা, মূলি বাঁশের বেড়া, এবং ঠিক দরজার মুখে বাঁশে আলোটা ঝুলছে। সামনে সামিয়ানা টাঙানো ছিল, খুলে ফেলা হয়েছে। ঝড়জল একেবারে থেমে গেলে ফের সামিয়ানা টাঙানো হবে। এখন লোকগুলি ঘরে বারান্দায় এবং বৈঠকখানায় গিজগিজ করছে। অন্ধকারে গ্রামে সহসা এই আলো শচীকে বিস্মিত করল।

মনজুর যেন টের পেয়ে গেছে। কর্তার মনে সংশয়। কর্তা কি যেন ভাবছেন। সে বলল, খুলেই বলল, জাল্‌সা কর্তা। শুনছি ইখানে সামসুদ্দিন লীগের একটা অফিস খুলব। ঢাকা থাইকা আইসা সামু আমাগ লীগের পাণ্ডা হইয়া গ্যাল।

শচী কোনও উত্তর করলেন না। সামুর এই ব্যাপারটা শচীর ভাল লাগল না।

মনজুর বলল, সামুরে ডাকি কর্তা। আপনে আইছেন।

শচী বললেন, না দরকার নাই। ব্যস্ত আছে, ডাইকা ব্যতিব্যস্ত কইরা লাভ নাই।

তবু খবর দিল মনজুর। ছোটকর্তা তোমার বাড়ির পাশ দিয়া যাচ্ছে তুমি বসে বসে জাল্‌সা করছ, একবার যাও। কর্তারে কও বইতে, পান-তামুক খাইতে।

খবর পেয়ে সামসুদ্দিন তাড়াতাড়ি বের হয়ে এল। বলল, আদাব কর্তা।

—ক্যামন আছ সামু?

—ভাল নাই কর্তা। ধনকর্তার নাকি পোলা হইছে?

—হ!

—তবে মিষ্টি খাওয়ান লাগব। যামু একদিন।

শচী এতক্ষণ যা বলবেন না ভাবছিলেন, অন্য কথা বলবেন ভাবছিলেন, কিন্তু মনের ভিতর কি রকম গোলমাল শুরু করে দিল। বললেন, চ্যালা-ফ্যালা যোগাড় হইছে। খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাটা বললেন শচী।—হঠাৎ পাণ্ডা সাজলা। আগে না আজাদের খুব ভক্ত আছিলা।

সামসুদ্দিন খুব বিব্রত বোধ করল। সে অন্য কথায় চলে আসতে চাইল। বলল কর্তা, বইসা যান।

মনজুর বলল, বড় কর্তারে খুঁজতে বাইর হইছে।

এবার সামসুদ্দিন শচীর সঙ্গে হাঁটতে থাকল। যেন একটা কী নৈতিক দায়িত্ব আছে এইসব মানুষের ভিতর। সংসারে এ যে এক মানুষ, অমন মানুষ হয় না—পাগল হয়ে যাচ্ছে। সব ফেলে—যা কিছু প্রিয়, যা কিছু সুখের—সব ফেলে মানুষটা কেবল নিরুদ্দেশে চলে যেতে চাইছে। সবাই সুতরাং চুপচাপ হাঁটছে। ঘরগুলি পরস্পর এত বেশি সংলগ্ন যে শচীকে প্রায় সময়ই নুয়ে পথ পার হতে হচ্ছিল, একটু সোজা হয়ে দাঁড়ালেই ঘরের সনচা এসে মাথায় ঠেকছে। এই বাড়িঘরের যেন কোনও নির্দিষ্ট সীমানা নেই—একটা বাড়ির সঙ্গে আর একটা বাড়ি লেগে আছে—কার কোন ঘর, কে কোন বাড়ির মালিক মাঝে-মাঝে শচীর পক্ষে নির্দিষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ বাড়িটা আবেদালির। বাড়ির উঠোনে আর একটা ঘর উঠছে। শচী ভাবলেন, আবেদালির দিদি জোটন নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে। ঘরটা দেখলেই তিনি টের করতে পারেন। টের করতে পারেন কিছুদিন আগে জোটন বিবি ছিল, এখন বেওয়া হয়েছে। জোটনের সব সমেত তিনবার নিকাহ্। শচী হিসাব করে দেখলেন—এবারটা নিয়ে চারবার হবে। তালাক অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর জোটন প্রতিবার আবেদালির কাছে চলে আসে। আবেদালি তখন লতা এবং খড়ের সাহায্যে উত্তর দুয়ারি ছোট্ট খুপরি ঘরটা তুলে দেয়—এই পর্যন্ত আবেদালির সঙ্গে জোটনের সম্পর্ক। তারপর কিছুদিন ধরে জোটনের জীবনসংগ্রাম। ধান ভেনে দেওয়া, চিঁড়া কুটে দেওয়া পাড়াপ্রতিবেশীদের এবং যখন বর্ষাকাল শেষ হয়, যখন হিন্দু গৃহস্থের পূজা-পার্বণ শেষ তখন জোটন অনেক দুঃখী ইমানদারের সঙ্গে ভাতের হাঁড়িটা ধুয়ে-পাকলে জলে নেমে পড়ে। এবং সব পাট খেত চষে বেড়াতে থাকে শালুকের জন্য। শালুক শেষ হলে আবেদালির কাছে নালিশ— দ্যাশে কি পুরুষমানুষ নাইরে আবেদালি। সেই জোটন উঠানের উপর আলো দেখে মুখ বার করল। দেখল, শচীকর্তা হাঁইটা যান উঠানের উপর দিয়া। সে একবার ডাকবে ভাবল, কিন্তু বড় মানুষকে ডাকতে সাহস পেল না।

শচী নেমে যাচ্ছিলেন, তখন আবেদালির দরজা খুলে গেল। ওরা পা টিপে-টিপে হাঁটছিল। জব্বর দরজা খুলতেই শচী দাঁড়ালেন। সব মাতব্বরদের দেখে জব্বর কিঞ্চিৎ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। প্ৰথমে কী বলবে ভেবে পেল না। পরে সামুকে দেখে যেন সাহস পেল। বলল, বা’জী আপনেগ বাড়ি গেছে কর্তা

—ক্যান রে?

—বড়কর্তার খবর দিতে। বড়কর্তা গোরস্থানে বইসা আছে।

ওরা আর দেরি করল না। তাড়াতাড়ি উঠান থেকে নেমে সড়কের উদ্দেশে হাঁটতে থাকল। জব্বর সকলকে দেখে ঘরে আর থাকতে পারল না। সে-ও ওদের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকল। বৃষ্টি ধরে এসেছে। ঝ’ড়ো হাওয়া আর বইছে না। গাছের মাথায়, ঝোপে-জঙ্গলে আবার তেমনি জোনাকি জ্বলতে শুরু করেছে। রাতের অন্ধকারে এই পাঁচটি প্রাণী মাঠে নেমে সেই গোরস্থানের বট গাছটার দিকে চোখ তুলে তাকাল।

ঈশম যেন সকলের আগে পৌঁছাতে চায়। সে বলল, কর্তা, পা চালাইয়া হাঁটেন।

অঘ্রাণের প্রথম শীত বলেই জোনাকির এই অল্প-অল্প আলো, প্রথম শীত বলেই কোড়া পাখি এত রাতেও ডাকছে না, ঘাস মাটি, বৃষ্টিতে ভিজে সব জল শুষে নিয়েছে। শক্ত মাটি। সড়কে কোথাও পথ পিচ্ছিল নয়—বরং শান্ত স্নিগ্ধ এক ভাব। অনেকদিন পর বৃষ্টি হওয়ায় ধানের পক্ষে ভালো হবে – সুদিন আসবে, দুর্দিন থাকবে না। ঈশম বড় বড় পা ফেলে হাঁটছে। কেউ কোনও কথা বলছিল না, যেন শচী ওদের সব দুষ্টুবুদ্ধি ধরতে পেরেছেন—যেন পুরুষানুক্রমিক আত্মীয়বোধটুকুতে দুঃখ ও বেদনা সঞ্চারিত হচ্ছে।

সামসুদ্দিন মনে মনে কেমন এক অপরাধবোধে পীড়িত—যার জন্য সে প্রায় চুপচাপ হাঁটছিল।

লণ্ঠন তুলে বটগাছটার নিচে খুঁজতেই দেখল, বড়কর্তা ফাঁসির মতো ঝুলে আছেন। ফাঁসটা গলায় নয় কোমরে। ধনুকের মতো বেঁকে আছেন। অথবা সার্কাসের তাঁবুতে খেলোয়াড় যেমন খেলা দেখায় তেমনি তিনি পিককের খেলা দেখাতে চাইছেন। ঝড়, শিলা-বৃষ্টি শরীরের উপর কিন্তু ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে। শরীরের ভিতর কোথাও এক যন্ত্রণা, ভালোবাসার যন্ত্রণা অথবা স্বপ্নের ভিতর এক মঞ্জিল আছে, মঞ্জিলে জাদুর পাখি আছে—সেই পাখি তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন তিনি তার সন্ধানে আছেন। মনে হয় পাখি উড়ে গেছে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, সওদাগরের দেশ পেরিয়ে কোথায় জলপরীদের দেশ আছে, পাখি এখন সেখানে দুঃখী রাজপুত্রের মাথায় বসে কাঁদছে। তখনই ভিতরে বড়কর্তার কী যেন কষ্ট হয়—নিজের হাত নিজে কামড়াতে থাকেন। ওরা দেখল মানুষটা হাত কামড়ে ফালা ফালা করে দিয়েছেন। এবং জঙ্গলের উপর ঝুলে আছেন।

ঈশম মটকিলার জঙ্গলে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল। সে এ-গাছ ও-গাছ করে বড়কর্তাকে জঙ্গলের ভিতর থেকে মুক্ত করল। ঠাণ্ডায় বড়কর্তার চোখ-মুখ কাতর। অথবা যেন তিনি নিশিদিন জলের নিচে ডুবে ছিলেন—জল থেকে কারা তাঁকে তুলে এনে ঝোপে-জঙ্গলে ফেলে গেছে। হাত-পা সাদা ফ্যাকাশে। ঈশম জঙ্গল থেকে বের করে কাপড়টা ভালো করে পরিয়ে দিল। বড়কর্তা নিজের কব্জি থেকে নিজের মাংস তুলে নিয়েছেন। হাত মুখ রক্তাক্ত, বড়কর্তার শরীর মুখ এ-মুহূর্তে বীভৎস দেখাচ্ছে। চাপ-চাপ রক্তের দাগ। গাছের ডালে-ডালে পাখিদের আর্তনাদ-নির্জন মাঠে সকলকে সহসা বড় ক্লান্ত করছে যেন।

শচী লণ্ঠন তুলে মুখ এবং কব্জি দেখতেই বড়কর্তা হেসে দিলেন। শিশুর মতো সরল হাসি। শচী তাকাতে পারছেন না। তাড়াতাড়ি এখন বাড়ি নিয়ে যেতে হয়। দূর্বা ঘাস তুলে শচী ক্ষতস্থানে রস ঢেলে দিলেন। জ্বালা এবং যন্ত্রণায় মুখটা কুঁচকে যাচ্ছে। তিনি কিছু বলছেন না। চিৎকার করছেন না। সবার সঙ্গে এখন আউলের মতো হেলে-দুলে হাঁটছেন শুধু।

সামসুদ্দিন হাঁটতে হাঁটতে বলল, কর্তারে লইয়া কাশী, গয়া, মথুরা ঘুইরা আইলেন—কেউ কিছু

করতে পারল না! ভাল করতে পারল না!

মনজুর বলল, কইলকাতায় লইয়া গেলেন—বড় ডাক্তার দেখাইলেন, কেউ কিছু করতে পারল না?

শচীর গলাতে অন্ধকারেও হতাশা ফুটে উঠতে থাকল! বললেন, কেউ কিছু করতে পারল না! দশ-বারো বছর ধইরা কত দেশ-বিদেশ করলাম!

মনজুর বলল, হাসান পীরের দরগায় সিন্নি দিলাম—না, কিছু হইল না।

শচী আর কথা বলছেন না। সকলেই এ দুঃখে যেন কাতর। যেন এই দুঃখ পাশাপাশি সব গ্রামকে বিপর্যস্ত করছে। বড়কর্তাকে নিয়ে একদা এই সব পাশাপাশি গ্রামের কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা। কত দিন থেকে বড়কর্তার অবিস্মরণীয় মেধাশক্তির পরিচয় পেয়ে এ-অঞ্চলের মানুষেরা গৌরব বোধে আচ্ছন্ন। আমাদের অঞ্চলেও একজন আছেন, আমরা একজনকে সবার সামনে রাজকীয় সম্মানে হাজির করতে পারি। সবার প্রীতি এবং স্নেহ যেন এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে অতি আদরে মনের ভিতরে সংগোপনে লালন করছে—সেই মানুষ দিন-দিন কী হয়ে যাচ্ছেন!

মনজুর এ-সময়ে শচীকে প্রশ্ন করল, আইচ্ছা কর্তা, বা’জী আমারে কয়, বুড়াকর্তা নাকি জীবনে মিছা কথা কয় নাই!

শচী বললেন, শুনছি, লোকে তাই কয়।

—তবে এত বড় একটা তাজা শোক পাইল ক্যান?

শচী উত্তর করতে পারলেন না। আকাশে যে মেঘ ছিল বাতাসে কেটে যাচ্ছে। ওরা গোপাট ধরে পুকুরপাড়ে উঠে এল না, ওরা নরেন দাসের গয়া গাছটার নিচ দিয়ে পথ সংক্ষিপ্ত করল। নরেন দাসের উঠোনে উঠে দেখল, কোনও আলো জ্বলছে না। নরেন দাসের তাঁতঘরেও কোনও শব্দ নেই। এত তাড়াতাড়ি সকলে শুয়ে পড়েছে! সামসুদ্দিন ভাবল নরেন দাসের বোনটা বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে—সুতরাং শোক এ-বাড়ির আনাচে-কানাচে ছমছম করছে। সে একদিন দূর থেকে মালতীকে দেখেছে। বিধবা হবার পর থেকে মালতী ব্লাউজ পরে না। মালতীর কোনও সন্তান নেই। যে সালে বিলের জলে কুমীর আটকা পড়ল সে সালেই মালতীর বিয়ে হল। নরেন দাস বিয়েতে খরচ-পত্তর করেছিল। সুতরাং পাঁচ সাত বছর হবে মালতী এই গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছিল। ফুটফুটে রাজপুত্রের মতো বর। ছোটোখাটো মানুষের চোখ দুটো ইচ্ছে করলে সামু এখন মনে করতে পারে। নরেন দাস নসিন্দি থেকে চারটে ডে-লাইট এনে ঘরে-বাইরে সকল স্থানে আলো জ্বেলে, আলোময় করে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিল বরের হাত ধরে, মালতীর মা নাই, বাপ নাই, তুমি ওর সব। নরেন দাস অনেকক্ষণ চৌকিতে পড়ে কেঁদেছিল। সকলে চলে গেল, বাড়ি ফাঁকা ঠেকল। তবু নরেন দাস দু’দিন তক্তপোশ থেকে উঠল না। ছোট বোনটা এ-বাড়ির যেন প্রজাপতির মতো ছিল। শুধু সারা দিন উড়ত, উড়ত। গাছের ছায়ায়, পুকুরের পাড়ে পাড়ে লটকন গাছের ডালে-ডালে মেয়েটা যেন নীলকণ্ঠ পাখি খুঁজে বেড়াত। সামু, রঞ্জিত ছিল বড় কাছের মানুষ তখন। ওরা কত দিন চুকৈর আনতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। মালতী বিধবা হয়ে ফিরলে সে আর কথা বলতে পারেনি। কারণ ঢাকার রায়টে স্বামী তার কাটা গেছে।

বাড়িতে ঢুকে শচী ডাকলেন মা জল দ্যাও।

কাকার গলা পেয়ে লালটু বৈঠকখানা থেকে বের হয়ে এল। চন্দ্রনাথ বের হয়ে এলেন। শশীবালা স্বামীর পায়ের কাছে বসেছিলেন এতক্ষণ, উঠোনে শচীর গলা পেয়েই নেমে এলেন। মহেন্দ্রনাথ ছেলের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। আজকাল মণির নূতন উপসর্গ হয়েছে। কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া। এতদিন সে বৈঠকখানায় শুধু বসে থাকত অথবা পুকুর পাড়ে পায়চারি করতে করতে গাছপালা পাখির সঙ্গে কী যেন বিড়বিড় করে বকত। ছেলে ফিরেছে শুনেই কম্বলটা হাতড়ে মুখের উপর টেনে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। ভিতরে যে উৎকণ্ঠা ছিল সেটা কেটে গেছে।

শশীবালা উঠোনে নেমে অনেক লোক দেখতে পেয়ে বললেন, তরা!

—আমি সামু ঠাইরেন।

—আমি মনজুর, ঠাইরেন।

বড় বৌ জানালা দিয়ে সব দেখছে। স্বামীর দীর্ঘ চেহারা এবং বলিষ্ঠ মুখ আর কি যেন তার ভিতরে এক আত্মপ্রত্যয়ের ছবি—সে ছবি মাঝে মাঝে হাওয়ায় দুলতে থাকলে—বড় বৌ হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে—ঈশ্বর আমার এই মানুষকে তুমি দেখে রেখো, উঠোনে মানুষজন বলে সে নেমে আসতে পারল না।

শশীবালা সকলকে বসতে বলে ঘরে ঢুকে গেলেন। সামান্য জল, তুলসীপাতা এবং চরণামৃত এনে শচী আর মণির শরীরে ছিটিয়ে দিলেন। জল আনালেন এক বালতি। চন্দ্রনাথ পাট ভাঙা কাপড় বের করে আনলেন। ক্ষতস্থানে গাঁদা পাতার রস দিয়ে হাতটা বেঁধে দিলেন।

সামসুদ্দিন বলল, ঠাইরেন, আমরা যাই।

—যাও। রাইত অনেক হইছে। সাবধানে যাইও। তারপর কি ভেবে শশীবালা উঠোনের মাঝখানে এসে বললেন, সামু, চাইর পাঁচদিন ধইরা তর মায়রে দ্যাখি না!

—ম্যার কমরে ব্যাদনা হইছে। উঠতে পারতাছে না। বাতের ব্যাদনা মনে হয়।

—খাড়। বলে তিনি ঘরে ঢুকে একটা পুরনো শিশি বের করে আনলেন। বললেন, শিশিডা নিয়া যা সামু। কমরে ত্যাল মালিশ করতে কবি

ওরা চলে গেল। ঈশম লণ্ঠন হাতে তরমুজ খেতে নেমে গেল। সোনালী বালির নদীর চরে তরমুজ খেতে ছইয়ের ভিতর সারা রাত সে বসে থাকবে। খরগোশ অথবা ইঁদুর কচি তরমুজের লতা কেটে দেয়। রাতে সে বসে টিনের ভিতর ডংকা বাজাবে। অনেক দূর থেকে কেউ প্রহরে জেগে গেলে সেই ডংকা শুনতে পায়, শুনতে পেলেই ধরতে পারে ঈশম, ঠাকুরবাড়ির বান্দা লোক, ঈশম এখন তরমুজ খেতে ডংকা বাজাচ্ছে। ডংকা বাজিয়ে ইঁদুর বাদুড় সব তাড়িয়ে দিচ্ছে।

ছোটকর্তা শচীন্দ্রনাথ নিজের ঘরে বসে তখন দৈনন্দিন হিসাব লিখছেন। বড়কর্তাকে হাতমুখ পরিষ্কার করে রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ডাল দিলে ডাল খেলেন, ভাত দিলে শুধু ভাত, মাছ অথবা মাংস খাওয়ার সময় হাড়গুলি গিলে ফেললেন। কেমন বড় বড় চোখে তিনি রান্নাঘরটা দেখতে থাকলেন। তখন শশীবালা বললেন, মণিরে আর কষ্ট দিও না। তরকারী ভাতের লগে মাইখা খাও।

মার এমন কথায় মণীন্দ্রনাথ কীটসের একটি প্রেমের কবিতা পূর্বাপর ঠিক রেখে গভীর এবং ঘন গলায় আবৃত্তি করে শোনালেন। মা অথবা চন্দ্রনাথ কেউ তার একবর্ণ বুঝল না। বলতে বলতে তিনি বড়বৌর দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকলেন। যেন নিদারুণ কোন যন্ত্রণার কথা তিনি বার বার এইসব কবিতার ভিতর পুনরাবৃত্তি করতে চাইছেন। যেন এই পৃথিবী নিরন্তর অসহিষ্ণুতায় ভুগছে। মণীন্দ্রনাথ এ সময়ে নিজের কপালে এবং মাথায় হাত বোলাতে থাকলেন, মাগো, তোমরা আমাকে আদর করো, এমন ভাব মণীন্দ্রনাথের চোখে মুখে। তাঁর অপলক দৃষ্টি যেন বলছে—আমার বড় কষ্ট বড় যন্ত্রণা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *