প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.১৭

১.১৭

সবার শেষে ঈশমও গ্রামে উঠে যাচ্ছে। উঠে যাবার পথে মনে হল, ঝোপের ভিতর এক প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড। প্রায় সাপে বাঘে ধস্তাধস্তি হচ্ছে যেন। বোধ হয় মড়ার গন্ধ পেয়ে হাসান পীরের দরগা থেকে শেয়াল উঠে এসেছে। গোসাপও হতে পারে। প্রায় কুমীরের মতো বড় বড় গোসাপ নদীর চরে সে কতদিন ঘুরতে দেখেছে। এখন এই ঝোপের ভিতর কামড়াকামড়ি করছে। ঈশম ভয়ে দ্রুত গ্রামের দিকে ছুটে গেল।

ভোরের স্বপ্ন, যেমন তাজা তেমনি মিষ্টি। আর বোধ হয় প্রথম স্বপ্ন দেখতে শিখল সে। স্বপ্ন দেখার পরই ঘুম ভেঙে গেল। সে শুনতে পেল বড় ঘরে ঠাকুরদা ঈশ্বরের স্তোত্র পাঠ করছেন। বড়: জ্যেঠিমা, ছোট কাকা এই শীতের ভোরে ঠাকুরদাকে উঠোনের ওপর এনে দাঁড় করিয়েছেন।

বৃদ্ধ দীর্ঘদিন পর বায়না ধরেছেন—তিনি আজ সূর্যোদয় দেখবেন। তিনি সেই কবে অন্ধ হয়ে গেছেন—দীর্ঘদিন ঘরের বার হননি, তিনি ঘরে বসেই প্রতিদিন ভোর রাতের দিকে ঈশ্বরের স্তোত্র পাঠ করেন—হে ঈশ্বর, তোমার করুণা ফুলে ফলে, ফসলের মাঠে, তুমি করুণাময়।

বৃদ্ধের কথা না রাখলে অনর্থ ঘটবে। সুতরাং ওরা বৃদ্ধের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। ঠিক কামরাঙা গাছটার নিচে দাঁড়ালে পুবের আকাশ স্পষ্ট। সূর্য উঠবে। পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। পাখিরা উড়ে যাচ্ছিল। মসজিদে আজান দিচ্ছে সামসুদ্দিন। মোরগেরা ডাকছে। বড়বৌ পূজার ফুল তুলতে চলে গেছে। বৃদ্ধ মানুষটি সূর্যোদয় দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। কতকাল যেন—কত দীর্ঘকাল যেন সূর্যোদয় দেখেননি, কতকাল তিনি যেন এমন পাখির কলবর শুনতে পাননি। কামরাঙা গাছটার নিচে তিনি সোনা, লালটু, পলটুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সূর্য উঠলেই বলতে হবে—সূর্যোদয় হচ্ছে। তিনি এই যে সূর্য, আলোর দেবতা, ঈশ্বরের অংশ, ঈশ্বর জনে জনে ফুলে ফুলে বিরাজমান—সর্বত্র তিনি, তিনি এক এবং বহু, তিনি সীমাসংখ্যার অতীত, মহাবিশ্বের তিনিই সব—তাঁর সেই আলোর দূতকে স্বাগত জানাবেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার সুর্যোদয়ের কথা তাঁকে আর বলতে হল না। তিনি নিজেই যেন টের পাচ্ছেন সূর্য আকাশে উঠে আসছে। কুয়াশার জল কামরাঙা গাছ থেকে টুপটাপ ঝরছিল। লাল নীল পাখির পালক উড়ছিল। ফ্লানেলের জামা গায়ে খড়ম পায়ে বৃদ্ধ মানুষটি সূর্য উঠতেই দু’হাত তুলে প্রণাম করলেন। মহাবিশ্বে আমরা সামান্য মানুষ। তুমি মানুষের জরাজীর্ণ জীবনকে আলোকিত কর। রোগ শোক সব হরণ করে নাও।

সূর্যোদয়ে এত রহস্য আছে সোনার জানা ছিল না। সেও ঠাকুরদার দেখাদেখি সূর্যকে প্রণাম করল এবং ঠাকুবদার সঙ্গে গলা মিলিয়ে সূর্যস্তব পাঠ করল।

শচীন্দ্রনাথের অন্য কিছু কাজ ছিল। মাঠে ঈশমকে নিয়ে নেমে যেতে হবে। গৌর সরকার সীমানা ভেঙে দিচ্ছে জমির। এসব দেখার জন্য, আর বোধ হয় ঘটনাটা মামলাবাজ গৌর সরকারকে একটু সমঝে দেবার জন্য তিনি দ্রুত মাঠে নেমে যাবেন স্থির করেছিলেন। উত্তেজনায় রাতে শচীন্দ্রনাথের ঘুম হয়নি, কারণ মাটির মতো ভালোবাসার সামগ্রী আর কি আছে!

সূর্য আকাশে উঠে গেছে। মনে হল বৃদ্ধের এখন আর কোনও অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। সূর্যের উত্তাপে শরীরের ভিতর প্রাণের আবেগ—সেই যৌবনের মতো অথবা শৈশবের মতো মনে হয়, তিনি এখন একা একা, কেউ কিছু বলে না দিলেও কোথায় কোনদিকে গেলে গোপাট পড়বে, কোনদিকে গেলে পুকুরপাড়ের প্রিয় অর্জুন গাছটা পড়বে এবং নদী আর কতদূর, কতটা মাঠ এগুতে পারলে সোনালী বালির নদীর চর, চরে এখন তরমুজের লতা কত বড়, কত সবুজ সব লতাপাতা তিনি চোখ বুজে বলে দিতে পারেন। তিনি যেন বলতে চাইলেন, শচি, তুমি মাঠে নাইমা যাইতে চাও–যাও, আমার জন্য তোমার কোন চিন্তার কারণ নাই। আমি একলা মানুষ। সংসারে এই তো হয়—স্ত্রী-পুত্র এত, তবু নিজেকে কেবল একা মনে হয়। তিনি শচীন্দ্রনাথকে শুধু বলেছিলেন, সে যেন মাঠে যাবার আগে তাঁর চাঁদির বাঁধানো লাঠিটা দিয়ে যায়। কতকাল আগে, তখন প্রৌঢ় মহেন্দ্রনাথের কি দাপট! তিনি চাঁদির বাঁধানো লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে গ্রাম মাঠ পার হয়ে চলে গেছেন। সেই মানুষ কতকাল ঘরের বার হননি। প্ৰায় অথব এখন তিনি। কিন্তু কথা আছে এ-সালে তিনি দেহরক্ষা করবেন। কুষ্ঠী ঠিকুজি এবং রাশিফল এমনই সব বলছে। শীতকালে বুড়ো মানুষের মৃত্যুভয় অসীম। কার্তিকের টান, বড় টান। কার্তিকের টান বানের জলের মতো। গ্রাম মাঠ সাফ করে বুড়ো মানুষদের নিয়ে যায়। ঠিক সেই সময়ে একদিন তাঁর সন্তান ভূপেন্দ্রনাথ বলেছিল, বাবা, এবারে চন্দ্রায়ণটা কইরা ফেলি।

তিনি পুত্রের ইচ্ছার কথা ধরতে পেরেছিলেন। বয়স হয়েছে। কার্তিকের টানে বড় কষ্ট পাচ্ছিলেন। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন এবং চন্দ্রায়ণ করালে পাপ খণ্ডন হবে। পাপ খণ্ডন হলেই এই সংসার থেকে মুক্তি। তখন বায়ুতে পঞ্চভূত হয়ে আত্মাটা মিশে যাবে। তিনি ভূপেন্দ্রনাথের কথায় রুষ্ট হয়েছিলেন।—আমার ত যাওয়নের সময় হয় নাই। হইলে টের পামু। তোমাগ ঘণ্টা বাজাইতে হইব না।

আর শীতের মাঝামাঝিতে মনে হল মহেন্দ্রনাথ আবার তাজা হয়ে যাচ্ছেন। এবং কানে যেন ভালো শুনতে পাচ্ছেন। শরীরের জড়তা ক্রমশ উবে যাচ্ছে। এখন তিনি বিছানাতে ওঠা বসা করতে পারেন। হাঁটা চলা করতে পারেন। আর মনে হল তিনি ফের শতবর্ষ বাঁচার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

তিনি এবার তাঁর তিন নাতিকে উদ্দেশ করে-বড় কচিকাঁচা বয়স ওদের, তাঁর সন্তানেরা সবই শেষ বয়সের, প্রথম দিকে কোনও সন্তানাদি হবে না বলেই ঠিক ছিল, তিন নাতিকে উদ্দেশ করে কিছু বলতে গিয়ে এমন সব ছবি মনে পড়ে গেল তাঁর। তিনি বললেন, আমার মাঠে নাইমা যাইতে ইচ্ছা হয়। তোমরা আমারে মাঠে নিয়া যাইবা?

এই কথায় তিন নাতিকে বড় উৎফুল্ল দেখাল। ওরা ঠাকুরদার এমন একটা অভিপ্রায় জেনে আনন্দে উৎফুল্ল। এখনও সূর্য উপরে উঠে আসেনি।

পলটুর হাত ধরে মহেন্দ্রনাথ গোপাটে যাচ্ছেন। লালটু আগে আগে হাঁটছে। সোনা পিছনে পিছনে হাঁটছে। ঠাকুরদার হাতে চাঁদি বাঁধানো লাঠি। লাঠির মুখটা সোনাব্যাঙের মাথা যেন। চোখ বোজা, কান খাড়া, কোনও-কোনও সময় মনে হয় শজারুর মুখের মতো লাঠির মাথাটা হাঁ করা। মহেন্দ্রনাথ লাঠিটা ডান হাতে ভালো করে ধরলেন। তিনি যেন এখন সব কিছু দেখতে পাচ্ছেন, সেই প্রৌঢ় বয়সের মতো। কোথাও একটা শ্বেতজবা ফুটে আছে। তিনি বললেন,দ্যাখ ত পলটু, মনে হয় গাছে একটা জবা ফুল ফুইটা আছে।

লালটু বলল, আছে।

লালটু পলটু সোনা অবাক। হ্যাঁ, গাছে মাত্র একটা শ্বেতজবা ফুটে আছে।

সোনা বলল, ঠাকুরদা স্থলপদ্ম গাছটায় ফুল হইছে।

—অসময়ে ফুল। বলে তিনি পুকুরপাড় ধরে নেমে যাবার সময় বললেন, তরা আমারে তেঁতুল গাছটার নিচে নিয়া আইলি!

ওরা ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধ মানুষকে যেমন সবাই ধরাধরি করে পথ পার করে দেয় তেমনি এই তিন নাবালক মহেন্দ্রনাথকে মাঠের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পুকুরপাড় ধরে হাঁটার সময় তিনি প্রায় এক-এক করে সব গাছের নাম বলে যাচ্ছিলেন। কখনও কদবেল গাছ অথবা কখনও জামরুল গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছেন, বলে দিতে পারছেন। যেতে যেতে সহসা তিনি থেমে পড়লেন। বললেন, জলে একটা বোয়াল মাছ ভাইসা আছে।

ওরা দেখল, হ্যাঁ, পুকুরের জলে বড় একটা বোয়াল মাছ ভেসে দাম খাচ্ছে। সোনা বলল, দ্যাখি আপনের চোখ দুইটা। বাবায় আইলে কইয়া দিমু, আপনে মিছা কথা কন। চক্ষে দ্যাখতে পান ঠিক। মহেন্দ্রনাথ সোনার কথা শুনে হাসলেন। তিনি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে মাছের গন্ধ পাচ্ছিলেন, এবার লাঠি ঠুকে ঠুকে জায়গাটাকে চেনার জন্য বললেন, তরা বড় জামগাছটার নিচে নিয়া আইছস্!

তিনজন ওরা এবার একসঙ্গে হেসে উঠল। বলল, ঠাকুরদা কইতে পারল না।

মহেন্দ্রনাথ আরও সামান্য সময় চিন্তা করলেন। কতদিন পর ঘর থেকে বের হয়েছেন, সূর্যোদয় দেখবেন বলে। আর নিজের এই বাসভূমি যা তিনি তিলেতিলে অর্জন করেছেন, যে ভালোবাসা তাঁকে এখনও ঈশ্বরের সংসারে ডুবে যেতে দেয় না, সেই জগৎ এত অপরিচিত হয়ে গেল! তিনি এমন ভুল বলে ফেললেন! প্রায় শতবর্ষের অভিজ্ঞতা এই মাটি এবং মানুষ সম্পর্কে—তিনি এই তিন নাবালকের কাছে কিছুতেই হার স্বীকার করতে চাইলেন না। তিনি স্মৃতির ভিতর ডুবে মণিমাণিক্য অনুসন্ধানের মতো কোথায় কোন গাছের পরে কি গাছ ছিল, কখন কোন গাছ ছিল, কখন কোন গাছ তিনি কেটে ফেলেছেন—সব মনে-মনে অনুসন্ধান করে বেড়ালেন। তেঁতুল গাছটার পর জামরুল গাছের পাতার গন্ধ আসছিল নাকে, তারপর মনে হল রোদ মাথায় মুখে—তবে বড় জামগাছটা হবে ঠিক। কিন্তু নাতিরা তাঁর যেভাবে হেসে উড়িয়ে দিল তাতে তিনি বড় মুষড়ে পড়েছেন। নাকে বড়-বড় শ্বাস টানলেন—যদি নিঃশ্বাসে কোনও অন্য কোন পরিচিত গন্ধ ভেসে আসে। যদি তাঁর জল মাটির জন্য ভালোবাসা তাঁকে ফের অন্তর্যামী করে তোলে।

এবার মহেন্দ্রনাথ বললেন, খেজুর গাছের নিচে আইছি।

নাবালক তিন নাতি আরও জোরে হেসে উঠল। ঠাকুরদাকে নিয়ে এবার তারা খেলায় মেতে গেল। ‘সেই যেন চোর-চোর খেলা। ঠাকুরদা অন্ধ। অন্ধ বলেই ওরা ধরে নিল ঠাকুরদার চোখ বাঁধা। ওরা ঠাকুরদার চারপাশে চোর-চোর খেলছিল অথবা চোর চোর বলে চিৎকার করছিল—ঠাকুরদা ওদের ছুঁতে পারছেন না। ওরা ঠাকুরদাকে নিয়ে শক্ত খেলায় মেতেছে। ওরা এবার ঠাকুরদাকে সামনের মাঠে নিয়ে যাবে এবং যেতে যেতে বলবে, আপনি কোথায়? ঠাকুরদা বলবেন, আমি খামার বাড়িতে। তারপর ওরা যতদূর হেঁটে যাবে, উত্তরে, দক্ষিণে যেদিকে চোখ যায়—ফের এক প্রশ্ন, আমরা কোথায়? তিনি যেন বলবেন, আমরা ভিটা জমির ওপর। খেলার মতো ঘটনাটা হয়ে গেল। এমন খেলা বুঝি হয় না। ওরা প্রশ্ন করছিল আর বিজ্ঞের মতো ঠাকুরদার দিকে তাকিয়ে উত্তরের প্রত্যাশা করছিল। সোনা কেবল হরিণ শিশুর মতো ঠাকুরদার চারপাশে লাফাচ্ছে। ঠাকুরদা ঠিক বলতে পারলেই আবার টেনে নিয়ে যাওয়া রথের মতো—ওরা এক পুরনো রথ যেন ভালোবাসার পথ ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

জরাজীর্ণ রথটি পথের ওপর অতিকায় এক বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়েছিল। হাতে লাঠি, গায়ে শাল, মাথায় লাল টুপি এবং হাতে শীতের দস্তানা। তিনি গরম মোজা পায়ে দিয়েছেন, পায়ে সাদা কেডস জুতো—তিনি হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন, তাঁর প্রিয় নাবালকেরা কোথায় তাঁকে টেনে নিয়ে এসেছে। তিনি একবার ভাবলেন ডেকে বলবেন, দ্যাখ বৌমারা, তোমার পোলারা আমারে কই লইয়া যইতাছে। কিন্তু বলতে পারলেন না। কেমন যেন পুকুরপাড়ে নেমে এসে তিনি মজা পেয়ে গেছেন। তিনি চুপচাপ লাঠিটা ঝোপে-জঙ্গলে ঠুকে ঠুকে এগুতে থাকলেন। এক সময় মনে হল লাঠিতে শক্ত একটা কিছু ঠেকছে। এতক্ষণে মনে হল তিনি বড় জামগাছটা কেটে একটা অর্জুন গাছ লাগিয়েছিলেন। ওঁর মুখ চোখ এবার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল—তোমরা আমারে অর্জুন গাছটার নিচে নিয়া আইছ।

ঠাকুরদা এবার ঠিক বলে ফেলেছেন। সোনা মনে মনে চাইছিল, ঠাকুরদা ঠিক-ঠিক বলে ফেলুক। কারণ তিনি যে ভাবে নিরালম্ব মানুষের মতো এই পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন এবং বড়দা মেজদা যে-ভাবে ঠাকুরদাকে হেনস্থা করছে—তাতে ওঁর কষ্টটা কেবল বাড়ছিল। যেই সঠিক বলে ফেলেছেন, যেই তিনি বুঝতে পেরেছেন ওঁকে অন্য পথে পুকুরের পাড়ে নিয়ে আসা হয়েছে এবং মুখে নাবালকের মতোই যখন আর গর্বের অন্ত নেই, তখন সোনা আনন্দে একটা লাফ না দিয়ে থাকতে পারল না; যেন উত্তরটা মহেন্দ্রনাথ দেয়নি, উত্তরটা সোনা দিয়েছে।

ওরা মহেন্দ্রনাথকে আরও টেনে নামাতে চাইলে তিনি বললেন, আমি আর যামু না। আমারে তোমরা ঝোপে-জঙ্গলে নিয়া যাইতে চাও! বান্দরের মতো নাচাইতে চাও! আমি নাচমু না। বলে তিনি অর্জুন গাছটার নিচে বসে পড়লেন। দুর্বাঘাস ছিল কিছু, রোদ এসে পড়েছে কখন। ঘাসে কোনও শিশিরবিন্দু ছিল না। বসে পড়ে তিনি চারধারে কি খুঁজতে থাকলেন।

সোনা বলল, কি খোঁজেন।

—আমারে।

সোনা বুঝতে পারল না কথাটা।

—আমারে খুঁজি। আমারে তোমরা এইখান রাইখা দিয়। তারপর তিনি কি ভেবে চুপ করে গেলেন। হয়তো তাঁর এই তিন নাতি ওঁর এই প্রিয় স্থানটুকুর খবর রাখে না। তিনি মাটির ওপর ফের ভালোবাসার হাত রাখলেন। সব ছেলেদেরই বলে রেখেছেন, তাঁর এই ভালোবাসার মাটিতে তাঁকে যেন দাহ করা হয়। তিনি নিজেই স্থানটি নির্বাচন করে রাখার সময় স্মারক হিসাবে অর্জুন গাছ লাগিয়েছেন।

সূর্যের আলো গাছের মাথায় পড়ায় বেশ উষ্ণ মনে হচ্ছিল চারিদিকটা। মাঠে মেলার গরু নেমে যাচ্ছে। কিছু গাছের ছায়া ইতস্তত পাড়ে-পাড়ে। বুড়ো মানুষ মহেন্দ্রনাথ পা ছড়িয়ে নাতিদের নিয়ে অর্জুন গাছের নিচে বসে রয়েছেন। দেখলে মনে হয় চোখ বুজে কিছু ভাবছেন। বোধ হয় স্মৃতিতে তাঁর একমাত্র পাগল ছেলের জন্য কষ্ট। তিনি পলটুর মাথায় হাত রেখে বললেন, পড়াশুনা কইর। বাবারে কষ্ট দিয় না।

মাঠে আবেদালির বিবির কবরটা দেখা যাচ্ছে। কবরের পাশে তিনটে জিয়ল গাছ পোঁতা। একটা মোরগ কবরটার ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে শীতের সূর্যকে দেখছে। আর এই জলালিকে নিয়ে পাগল ঠাকুর গত রাতে ফিরে এসেছেন। মণীন্দ্রনাথ, বড় ছেলে তাঁর, পাগল ছেলে, সে এখন কোথায় কে জানে!

পলটু কোনও উত্তর করল না। বাপ সম্পর্কে পলটুর একটা অসম্ভব রকমের অবজ্ঞা আছে। সে বাপের সঙ্গে কোথাও যায় না। বরং সোনার সঙ্গে ভাব বেশি। পলটু অন্য কথায় এল। সে বলল, চলেন, ঠাকুরদা, আমরা গোপাটে নাইমা যাই।

মহেন্দ্রনাথ পলটুর কথা শুনেও শুনলেন না। তিনি এখন অন্য কথা ভাবছিলেন। জালালি জলে ডুবে মরেছে। কবরে একটা মোরগ উত্তর-দক্ষিণ ঘুরছে। আর সূর্যের উত্তাপ সমানভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছিল। গতকাল পার্বণের দিন গেছে। পূজার শেষে বলির বাজনা যেন থামছে না। আর অঞ্চলের বয়সী মানুষটি এখন তাঁর প্রিয় মাটিটুকুর উপর বসে আছেন। এখানেই তিনি চিরকালের মতো মহানিদ্রায় মগ্ন হবেন। এখানেই তাঁর দেহ সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসবে—চোখের উপর তিনি দৃশ্যটা ঝুলতে দেখলেন। ছেলেরা চারপাশে ঘিরে থাকবে, গ্রামের পর গ্রাম থেকে লোক জড়ো হবে—অঞ্চলের মানুষেরা হরিসংকীর্তন করবে, চন্দনের কাঠ পুড়বে, ঘৃত-দধি দুগ্ধ ঢেলে দেওয়া হবে, তার ভিতরে তিনি যজ্ঞের হবির মতো জ্বলতে থাকবেন। এবং তাঁর পাগল ছেলে তখন অর্জুন গাছটায় হেলান দিয়ে জ্বলন্ত মানুষটাকে দেখতে দেখতে দু’হাত তুলে চিৎকার করে উঠবে। সহসা এই পাগুল পুত্রের মুখ তাঁকে কেমন বিষণ্ণ করে দিল। পাগল পুত্র চিতার আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন নালিশ–বাবা, আপনি আমার সর্বনাশ করেছেন। আপনি আমার সব ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছেন। আপনার ধর্মবোধ আমার জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি এক পাগল, আমার চিন্তাশক্তি নাই, আমার পাগল চিন্তার সমভাগী হতে কেউ চায় না—কেবল যেন মনে হয় মাথার ভিতর এক স্বপ্ন নিরালম্ব মানুষের মতো পাক খাচ্ছে, কেবল কে যেন সেই স্বপ্নের ভিতর চলে যেতে থাকে। আপনি সেই মানুষ, আত্মার কাছাকাছি আমার যে যুবতী ছিল, যুবতীর নাম পলিন, উঁচু লম্বা এবং নীল চোখ তার, তাকে আপনি দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। সমুদ্র আমি দেখিনি বাবা, কিন্তু বসন্তের আকাশ দেখেছি, আকাশের নিচে সোনালী বালির নদীর জল, জলে তার মুখ ভাসে। আকাশের কোনও বড় নক্ষত্র অন্ধকারে জলে প্রতিবিম্ব ফেললে মনে হয়, সেই মেয়ে কত দূরদেশ থেকে ডাকছে, মণি, যাবে না? উইলো ঝোপের পাশে বসে আমরা দুজনে সান্তাক্লজের গল্প করব। তুমি যাবে না? আর দেখছি শীতের মাঠে ঘাসে ঘাসে কত শিশিরবিন্দু। শিশিরবিন্দুর মতো সেই পবিত্র মুখ আপনি কেড়ে নিয়েছেন বাবা। নালিশ দিতে দিতে চিতার আগুনের দিকে তাকিয়ে বিদ্বান বুদ্ধিমান পাগল ছেলে হাউহাউ করে কাঁদছে।

মহেন্দ্রনাথ লাঠিটা এবার আরও জোরে চেপে ধরলেন। মনের ভিতর কতকাল থেকে অনুশোচনা। মৃত্যুর জন্য যত প্রস্তুত হচ্ছেন ততই পাগল ছেলের জন্য অনুশোচনা বাড়ছে। তত তিনি নিজেকে অসহায় ভাবছেন। তাঁর কেন জানি মনে হয়, আর দেরি করে লাভ নেই। তাড়াতাড়ি চন্দ্রায়ণটা করে ফেলতে হয়। দ্বাদশ ব্রাহ্মণভোজনের ব্যবস্থা করতে হয়। ব্রাহ্মণ খাইয়ে প্রায়শ্চিত্তটা সেরে ফেললেই—সংসার থেকে চিরদিনের জন্য নির্বাসনের দলিলটা মিলে যাবে। ঈশ্বরে সমর্পিত প্রাণ আর সাংসারিক দুঃখবোধে পীড়িত না হলেই যেন ভালো হয়। তিনি পলটুকে বললেন, আমারে ঘরে নিয়া যা। বলে তিনি পলটুর কাঁধে ঘরে ফেরার জন্য হাত রাখলেন।

বস্তুত তিনি নিজের সংসারে ফিরতে চাইলেন। ওরাই যেন তাঁকে তাঁর নির্দিষ্ট ঘরটিতে পৌঁছে দেবে। যে-ঘর থেকে একদা সূর্যোদয় দেখবেন বলে বের হয়েছিলেন, ঠিক সেই ঘরে। অন্ধকার ঘর, বায়ুশূন্য এবং মাঝে মাঝে ঝিল্লির ডাক শোনা যায়—কেম নিঃশব্দ এবং নির্জন, পাশে কেউ নেই। সব শূন্য। একটা শূন্যের মতো বায়ুশূন্য ঘরে ফের ফিরে যাওয়া। তিনি চোখ বুজলে তেমন একটা আলোহীন বায়ুহীন ঘরের দৃশ্য দেখতে পান।

কিন্তু দুষ্ট বালকদের মতলব বোঝা দায়। ওরা ওদের ঠাকুরদাকে নিয়ে বেশ রঙ্গ-তামাশা আরম্ভ করে দিল। ওরা ওদের প্রিয় ঠাকুরদাকে ধরে নিয়ে যেতে থাকল। গোপাট পার হয়ে অশ্বত্থ গাছের নিচটাতে এসে দাঁড়াল তারা। ওরা মহেন্দ্রনাথকে গাছতলায় ছেড়ে দিয়ে বলল, এবারে কন ত কোনখানে আইছেন?

বৃদ্ধ তাদের খুব অনুনয়-বিনয় করতে থাকলেন—কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন ওদের হাতে যখন পড়েছেন, তখন তাঁর হেনস্থার শেষ নেই। ওরা ওঁকে নিয়ে খেলায় মেতে গেছে। ওরা ওঁকে ঝোপে-জঙ্গলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। তিনি প্রায় করজোড়ে বললেন ওদের, সোনাভাই, ধনভাই, বড়ভাই, তোমরা বড় লক্ষ্মী পোলা। তোমরা আমারে ঘরে নিয়া যাও।

সোনা বলল, ঠাকুরদা, ডর নাই। টোডারবাগের বটগাছটার নিচে আইছি। লালটু বলল, আমরা আপনের লগে মাঠ পলান্তি খেলুম। বলেই ওরা মহেন্দ্রনাথকে গাছের নিচে ধীরে ধীরে বসিয়ে দিল। যেন মহেন্দ্রনাথ ওদের সমবয়সী বন্ধু। তারপর ওরা ছুটে ছুটে বেড়ালো—চিৎকার করে সবাইকে যেন বলতে চাইল—রাজা হুই গাছের নিচে বইসা আছে। রাজারে ছুঁইয়া দিলেই জিত! মহেন্দ্ৰনাথ এমন খেলায় ঘরের কথা ভুলে গেলেন। গাছের ডালে পাখি, পাখিরা সব কলরব করছে। কোথাও দূরে গরু-বাছুরের ডাক, অনেক দূরে কে যেন কাঠ কাটছে। আর অনেক দূর দিয়ে কে যেন হেঁটে চলে যায়। বুঝি সেই পাগল ছেলে। আর মনে হল তাঁর, চারপাশে প্রকৃতির কোলে সেই এক শৈশব ঘুরে ফিরে আসে। তিনি লাঠি কোলে রেখে বসে আছেন। স্থির। প্রায় বুদ্ধমূর্তির মতো চোখ বুজে তিনি বসে আছেন। দূরে সোনালী বালির নদীর জলে নৌকা ভাসে, পাল তোলা নৌকার খুঁটিতে নীল রঙের পাখি—তিনি বসে বসে সেই শৈশবকে যেন দেখতে পাচ্ছেন, শৈশব ঘুরে ফিরে চলে আসে, সেই এক নাও নদী ধরে যায়, পাশে সেই এক লাল নীল পাখি উড়ে উড়ে আসে। তাঁর চারপাশে শৈশব এখন খেলা করে বেড়াচ্ছে। তিনি পুরানো শৈশবের প্রতীক। ওরা এখন গান গাইছে মাঠে, লুকোচুরির গান। গ্রামের অন্য সব বালক বলিকা এই খেলায় ভিড়ে গেছে। সুভাষ, কিরণী, কালাপাহাড় এমনকি টোডারবাগ থেকে ছোট্ট ফতিমা পর্যন্ত নেমে এসেছে।

মহেন্দ্রনাথের চোখে এখন আর পাগলপুত্রের মুখ ভাসছে না। কারণ,সংসারে সুখ সব সময় থাকে না। সংসারে দুঃখও সব সময় ভাসে না। শুধু এক দূরের শৈশব বারবার এই প্রকৃতির কোলে ঘুরে ফিরে চলে আসে। তিনি মনে মনে নিজের সেই হরানো শৈশবকে ফিরে পাবার জন্য গুনগুন করে লুকোচুরি গান গাইতে থাকলেন। শৈশব বুঝি মাথার উপরের বটবৃক্ষ অত বড় ছিল না। তবু তিনি তাঁর শৈশবের সাঙ্গোপাঙ্গদের গাছের নিচে দেখতে পেলেন। ওর খেলা করে বেড়াচ্ছে। এবং তিনি যে গান গাইছিলেন, সেই গান সমস্বরে ওরা গেয়ে চলেছে। কিন্তু সময় বড় সামান্য। কত আর সময় হবে—তাঁর মনে হল সহসা, ওরা কেউ বেঁচে নেই, ওরা এই বটবৃক্ষের নিচে কী করে আর ফিরে আসবে। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। ভিতর থেকে কে যেন কেবল বলছে, তারা কেউ বেঁচে নেই, একা তুমি পুরী পাহারা দিচ্ছ। যেন এতদিনে ধরতে পারলেন এই গাছপালা পাখির ভিতর তিনি আর কেউ নন। তিনি পরিত্যক্ত মানুষ সবুজ বনে মৃত বৃক্ষের মতো তিনি জায়গা দখল করে আছেন। অথবা জীর্ণ মঠের মতো, মঠ থেকে সন্ন্যাসী পুণ্য করতে তীর্থে বের হয়ে গেছেন। তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। একা একা সবার অলক্ষ্যে তিনি নদীর দিকে পাগলের মতো নেমে যেতে থাকলেন।

সোনা-ই প্রথমে চিৎকার করে উঠল, ঠাকুরদা গাছতলাতে নাই।

ওরা সকলে এত মশগুল ছিল খেলাতে, ঝোপে-জঙ্গলে ওরা এত বেশি ছুটছিল যে, টেরই পায়নি কখন বুড়ো মানুষটা নদীর দিকে নেমে গেছেন। ওরা সবাই এবার গ্রামের দিকে চিৎকার করে বলতে বলতে উঠে আসছে—ঠাকুরদা হারাইয়া গেছে। গাছতলাতে নাই, কোনখানে নাই।

.

ঈশম চরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। চারদিকে তরমুজের লতা। হলুদ রঙের ফুল। বড় বড় লতার ফঁকে ফাঁকে উটপাখির ডিমের মতো তরমুজ। যেন এক অতিকায় উটপাখি এই বালির চরে ডিম পেড়ে রেখে গেছে। কালো কুচকুচে রঙ। এবার শীত যেতে-না-যেতেই তরমুজে ছেয়ে গেল। মেলায় এবার অনেক তরমুজ যাবে। ছোটঠাকুর ব্যাপারীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তিনি আল নিয়ে মামলা করবেন ভেবে বাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন। পথে ব্যাপারীর সঙ্গে দেখা। তিনি জমিতে চলে এলেন। এসে তাজ্জব বনে গেলেন। ঈশম ওকে একবারও বলেনি, ফলন এত ভালো হয়েছে। ক’দিনের ভিতর জমিটার চেহারা পাল্টে গেছে। মেলায় যাবে তরমুজ। কাল পরশু থেকে এই পথে অথবা চরের পাশ দিয়ে বড় বড় ঘোড়া উঠে যাবে। মেলায় ঘোড়দৌড় হবে। সোনালী বালির নদীতে পাল তুলে নৌকা যেতে আরম্ভ করেছে। এ মাসটাই নৌকা চলবে। তারপর জল কমে গেলে পারাপার করতে হাঁটু জল থাকে। ঈশম জমি থেকে এক দুই করে তরমুজ সংগ্রহ করছে।

ঈশম ছুটে যাচ্ছে। পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখছে। তারপর টোকা মারছে। ডাঁসা তরমুজ খেতে স্বাদের হয়। সে টোকা দিয়ে বুঝতে পারে কোন তরমুজ জমি থেকে তুলে নেবার সময় হয়েছে। এক-একটা তরমুজ বিশ-ত্রিশ সের ওজনের। সে একসঙ্গে দুটো তুলে আনতে পারছে না। এমন কি কোনও কোনও তরমুজ সে বুকের কাছে তুলে প্রায় যেন পাঁজাকোলে নিয়ে আসছে। সে ছইয়ের পাশে এক-দুই করে তরমুজ জড়ো করার সময়ই দেখল, এদিকে একটা মানুষ টলতে টলতে নেমে আসছে। কত লোকই আসে! সে ভলো করে লক্ষ করেনি। নিবিষ্ট মনে সে শুধু তরমুজ জড়ো করছে। তার যেন হাতে সময় নেই। সময় চলে যাচ্ছে। সে দূরে দেখল বাতাসে তরমুজের পাতা ফাঁক হয়ে যাচ্ছে, ফাঁক হয়ে গেলেই বড় একটা তরমুজের পিঠ সে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল। বাতাস আর নেই। কাছে গিয়ে দেখল বড় বড় পাতা তরমুজটাকে ঢেকে দিয়েছে। সে চারিদিকে চোখ মেলে খুঁজতে থাকল। পাতার ভিতর পড়ে থাকলে টের পাওয়া যায় না। তরমুজ ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়। সে আর একবার বাতাসের জন্য অপেক্ষা করল। বাতাস উঠলেই পাতার ফাঁকে তরমুজটা সে দেখে ফেলবে—এই ভেবে চোখ তুলতেই দেখল, মানুষটা দু’বার আছাড় খেয়েছে, দু’বার উঠে দাঁড়িয়েছে। টলছে। কে এই মানুষ! শীতের রোদে পাগলের মতো নদীর দিকে নেমে আসছে। সে ভালো করে লক্ষ করতেই বুঝল, আরে এ যে সেই মানুষ, সে ছুটতে থাকল। নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এত সাহস হল কী করে, চোখে দেখতে পায় না, তাজ্জব। মানুষটা লাঠি ঘুরিয়ে যেন তার যৌবনকাল, যেন বাতাসের সঙ্গে মানুষটা লড়ছে, লাঠি ঘোরাচ্ছে, দ্যাখো, আমি মহেন্দ্রনাথ এখনও কতদূর হেঁটে যেতে পারি, দ্যাখো, আমি মহেন্দ্ৰনাথ কতকাল এই মাটিতে বসবাস করছি, এখন কিনা আমার পোলারা কয় চন্দ্রায়ণ করেন বাবা। কি সাহস! মানুষটা লাঠি ঘুরিয়ে হাঁটতে গিয়ে বার বার মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছেন। আর একটু হলেই গড়িয়ে গিয়ে নদীর জলে পড়বেন। ঈশম ছুটতে ছুটতে গিয়ে ধরে ফেলল। তারপর পাঁজাকোলে তুলে নিতেই দেখল, হাত পা ছিঁড়ে গেছে। রক্ত পড়ছে। এমন কেন করছেন তিনি! এখন যেন ঠিক একটা পতুলের মতো মুখ—মানুষটার, সেই জবরদস্ত চেহারা নেই। একেবারে ছোট মানুষ হয়ে গেছেন। ছোট্ট শিশুর মতো কাঁদছেন।

—আপনের কি হইছে কর্তা! কোনদিকে যাইবেন ঠিক করছেন।

—আমারে তুই কই লইয়া যাইতাছস?

—বাড়ি যাইবেন।

–বাড়ি! বৃদ্ধ এবার চোখ বুজে ফেললেন। তিনি এটা কী করতে যাচ্ছিলেন! তিনি তাঁর বড় ছেলের মতো নিরুদ্দেশে হাঁটছিলেন কেন! মনের ভিতর কিসের এই অনুতাপ। নিজের ছেলেমানুষীর জন্য কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।-আমারে নামাইয়া দে।

—শরীর কি হইছে দ্যাখছেন?

—কি হইছে?

ঈশম ইচ্ছা করেই চুপ করে থাকল। শরীরে রক্ত নেই বোঝা যাচ্ছে। কোনও কোনও জায়গা কেটে গেছে অথচ রক্তপাত হচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি পুকুরপাড়ে উঠলেই সকলে ছুটে এল। সেই বৃদ্ধ মানুষ, আলখাল্লা পরা মানুষ, অঞ্চলের সর্বশেষ মানুষ পথ হারিয়ে ফেলেছিল। তিনি সকলকে অন্তত এমনই বললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *