নীলকণ্ঠ

নীলকন্ঠ

মুর্শিদাবাদ জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এক প্রত্যন্ত গ্রাম জপুর। সেখানে কোল, ভিল, মুন্ডা, সাঁওতালদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে বাস করে অনেক গরীব হিন্দু। চাষবাসই তাদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায়। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগী পোষা হয়। তাদের দেখাশোনার কাজ, খাসি করানোর কাজে লাগানো হয় এই সব আদিবাসীদের। পুজোপার্বন আনন্দ উৎসবে সবাই একসাথে মিলেমিশে মজা করে। দুর্গাপূজো, শিবের আরাধনা, গাজন সবেতেই এদের অবাধ প্রবেশ। খুব সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবন এদের।

চৈত্রের এক সকাল। এবার বর্ষায় বৃষ্টি একেবারে হয়নি বললেই চলে। সুর্যের প্রচন্ড দাবদাহে চারদিক ফুটিফাটা হয়ে গেছে। দূরে কোথাও কোকিলের বিষন্ন কুহুতান শোনা যাচ্ছে, যেন সে বসন্তের অন্তিম লগ্ন ঘোষণা করছে। রঙ্গিলাকে আজ হাটে যেতে হবে। মা সুস্থ থাকলে তাকে যেতে হত না। কিন্তু আজ প্রায় চারপাঁচ দিন হল মায়ের খুব জ্বর। ডাক্তার দেখাবার পয়সাই নেই। আর থাকবেই বা কোথা থেকে? তার তো বাবাই নেই যে উপার্জন করে তাদের মা আর চার ভাইবোনকে কোনদিন অভুক্ত থাকতে দেয়নি। গত পৌষে তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তাদের ছেড়ে চলে গেছে। হাজার মাথা খুঁড়লেও আর তাকে পাওয়া যাবে না।

বাবার কথা মনে পড়তেই রঙ্গিলার মন খারাপ হয়ে গেল। তার বাবা মহুল ছিল গ্রামের সবার নয়নের মণি। কী তাদের সমাজ, কী হিন্দু প্রত্যেকেই তাদের দরকারে অদরকারে তাকে ডেকে পাঠাত। পাঁঠাকে খাসি বানানোর কাজে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। মা, ভাইবোন, পাড়ার লোকেদের সঙ্গে কেউ কখনও তাকে খারাপ ব্যবহার করতে দেখেনি। ওদের সমাজের প্রথামত মাঝে মধ্যে হাঁড়িয়া বা কাঁচিমদ খেলেও মুখ থেকে কখনও খারাপ কথা শোনা যেত না। বাড়ি ফিরেই খানিকটা জলঢালা ভাত যে কোন তরকারী দিয়ে খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ত। পরদিন আবার হাসিমুখে কাজে লেগে যেত।

দাওয়ায় বসে রঙ্গিলা একমনে ভাবতে লাগল তার বাবার কথা। পৌষ মাসে ওদের দেশে রান্নাপূজো হয়। সেদিন ছেলেরা সব মাঠে জড়ো হয়ে রান্না করে। ছাগল, মুরগী বলি দেয়।

তারপর পূজো শেষ হলে সব পরিবারের ছেলেরা আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেই রান্না করা ভাত, মাংস, হাঁড়িয়া খেয়ে বাড়ি ফেরে। বাড়ির বউদের সেখানে যাওয়া বারণ। কেন, তা রঙ্গিলা জানে না। মনে মনে ভাবে বিয়ে হয়ে গেলে সে আর এই আনন্দে যোগ দিতে পারবে না। তা এরকমই একটা দিনে যখন সবাই কাঁচিমদ গিলে নাচগান, আমোদ আহ্লাদে মত্ত, তখন কোথা থেকে একটা বাস্তুখরিস এসে সেখানে চুপচাপ শুয়েছিল। সাপটাকে দেখে বাচ্ছারা ভয় পাচ্ছিল বলে নির্মল কাকা সেটাকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলল। অন্য কেউ রাজী হল না। মহুল নেশার ঘোরে সাপটাকে জাপটে ধরল। তারপর মাথাটা চেপে ধরতেই সাপটা তার ডান হাতে পরপর দুবার ছোবল মারল। রঙ্গিলার বাবা ঐ অবস্থাতেই সাপটাকে আছড়ে মেরে ফেলল। কিন্তু বিষাক্ত সাপের ছোবলে তার ডান হাতটা অবশ হয়ে যেতে লাগল। ওঝা, গুনীন ডাকা হল। ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র সবই হল। কিন্তু ভোরের দিকে মহুল সেই যে ঝিমিয়ে পড়ল, আর উঠল না। রঙ্গিলার এখনো স্পষ্ট মনে আছে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল তার বাবাকে একবারের জন্য শেষ দেখা দেখতে। অনেকে বলাবলি করছিল যে তাকে সব্বাই এত ভালবাসে বলেই হিংসা করে কেউ তাকে এভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল। কোর্ট, কাছারি, পুলিশে যাবার কথাও অনেকে বলেছিল। কিন্তু মা-ই রাজী হয়নি। সে খালি নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করতে লাগল। তারপর অনেকে মিলে ধরাধরি করে তার আদরের বাবাকে নদীর ধারে পুঁতে দিল।

মায়ের ডাকে হঠাৎ রঙ্গিলার সম্বিত ফিরে এল। তাকে হাটে যেতে হবে। মায়ের হাতে যত্ন করে বড় হওয়া লাউ, কুমড়ো, পুঁইশাক, করলা, সিম, চুবড়ি করে মাথায় বয়ে নিয়ে যেতে হবে প্রায় দু’ক্রোশ দূরের হাটে। দশ বারো বছরের মেয়ের পক্ষে কাজটা কঠিন হলেও পারতেই হবে। না হলে, মায়ের ওষুধ, পথ্যি জোগাড় হবে কোথা থেকে? তাই, আর দেরী না করে রঙ্গিলা বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু অত জিনিস নিয়ে তাড়াতাড়ি চলা তার পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে যখন সে ক্রোশখানেক এসেছে তখন মাথার উপর সূর্যের প্রচন্ড তেজ। অসম্ভব তেষ্টা পেল রঙ্গিলার। শ্রান্ত, ক্লান্ত রঙ্গিলা একটা বটগাছের ছায়ায় দু’দন্ড জিরোবার জন্য বসল। গাছের শীতল ছায়ায় বসে মৃদুমন্দ বাতাসে তার শরীর মন জুড়িয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবতে লাগল, আহা! হাটটা যদি এখানেই বসত তাহলে কী ভালই না হত। তাকে আর কষ্ট করে অত দূরের হাটে যেতে হত না। কিন্তু ভগবান কী তার প্রতি এত সদয় হবেন? রঙ্গিলা অবাক হয়ে কাকে যেন বলতে শুনল, “তথাস্তু”।

কথাটা কে বলল দেখার জন্য চারদিকে তাকালো সে। হঠাৎ তার নজরে পড়ল গাছের উপর বসা এক নীলকন্ঠ পাখীর দিকে। পাখিটাই কী তবে “তথাস্তু” বলল, ভাবতে ভাবতেই সে দেখে তার চারপাশে প্রচুর লোক। তারা সব আনাজপাতি কিনে নিল, পয়সা নিয়ে ও বাড়ির দিকে রওনা দিলে। সারা রাস্তাটা সে সেই আশ্চর্য ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতে চলল। ফেরার পথে মায়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে সে বাড়ি ফিরল। তারপর স্নান করে ভাত খেয়ে সে শুয়ে পড়ল। সারাদিনের ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে সে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ শুনল নীলকন্ঠ পাখিটা যেন তাকে বলছে – “আমি নীলকন্ঠ মানে শিব। তুই যে গাছটার নীচে বসেছিলি সেখানেই আমার ঠাঁই। একসময় এখানে অনেক ভক্তের সমাগম হত। ভক্তি সহকারে তারা আমার পূজো করত। চারপাশে মেলা বসত। কিন্তু একবার ভূমিকম্পে আমার শরীরটা মাটির ভেতরে প্রবেশ করে। শুধু শিবলিঙ্গের মাথাটাই জেগে থাকে। তাই কেউ এখন আর এখানে এসে ভক্তিভরে মাথায় জল ঢালে না। প্রচন্ড রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে আমার মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। তুই যদি আমায় উদ্ধার করে এনে পূজো করিস তোর দুঃখ কষ্ট সব দূর হয়ে যাবে”। পরপর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখল রঙ্গিলা। তৃতীয় দিনের স্বপ্নে সে স্পষ্ট শুনল যে নীলকন্ঠ পাখিটা তাকে বলছে, “কিরে আমাকে ঘরে আনবি না। আমি যে বড় কষ্টে আছি। আমাকে উদ্ধার কর। তোদের উঠোনে তুলসী মঞ্চের পাশে আমায় আশ্রয় দে”।

স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল রঙ্গিলার। “ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয়” মনে মনে ভাবল সে। বিছানা ছেড়ে রঙ্গিলা তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে গিয়ে তার দেখা পরপর তিনদিনের স্বপ্নের কথা বলল। সব শুনে মা তো একেবারে তাজ্জব। সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার কয়েকজন উদ্যমী ছেলেকে সঙ্গে করে মেয়েকে নিয়ে সেই বট গাছটার কাছে এলেন। তারপর অতি সাবধানে সামান্য একটু মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে এল রঙ্গিলার স্বপ্নে দেখা শিব ঠাকুর। কি সুন্দর। কুচকুচে কালো কষ্টি পাথরের এক শিবলিঙ্গ। আর, কী আশ্চর্য! শিবলিঙ্গের মাথাটা ফেটে চৌচির। একটা পেতল না সোনা কে জানে কী দিয়ে তৈরী একটা সাপ শিবের মাথায় ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

রঙ্গিলা তো আনন্দে শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরল। তারপর সকলে মিলে ধরাধরি করে অতি সাবধানে শিবঠাকুরকে বাড়িতে নিয়ে এল। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে মহাসমারোহে শিবলিঙ্গকে তুলসী মন্ডপের পাশে বেদী তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করা হল। রঙ্গিলার বাড়িতে শিবঠাকুর আসার বার্তা মুখে মুখে গ্রামে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। অতি উৎসাহী দু’একজন ভক্ত শিবঠাকুরকে রোদের প্রচন্ড খরতাপ থেকে বাঁচাতে দামী চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিল। শিবদর্শনে এল দেশ দেশান্তরের মানুষজন। এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মেলাও বসল। তিনদিনের সেই মেলায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে নেচেগেয়ে আনন্দ করে রঙ্গিলাও মেতে উঠল। দু’বছর বাদে গ্রামের লোকেরাই উদ্যোগী হয়ে সেই বেদীতেই শিবমন্দির বানিয়ে দিলে। রঙ্গিলাদের এখন আর কোন কিছুর অভাব নেই।

কালের নিয়মে রঙ্গিলা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। পাশের গাঁয়ে স্বচ্ছল পরিবারে তার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকেই রঙ্গিলাকে ভালবাসে। কিন্তু রঙ্গিলা তার স্বপ্নে দেখা সেই নীলকন্ঠ পাখিটার কথা ভুলতে পারেনি। প্রত্যেক বছর চৈত্রসংক্রান্তির সময় শিবপুজো উপলক্ষে রঙ্গিলা বাপের বাড়ি এসে তিন চারদিন কাটিয়ে যায়। মজা, হাসি, আনন্দে কখন যে দিনগুলো কেটে যায় সে বুঝতেই পারে না। আত্মীয়, অনাত্মীয়ের ভিড়ে ওদের বাড়িটা গম্‌গম্‌ করে ওঠে। তারপর শ্বশুর ঘরে ফেরার পালা। বাপের ভিটে, শিবের মন্ডপ ছেড়ে যাবার সময় নীলকন্ঠ পাখির কথা মনে পড়ে। দুঃখে, বেদনায় তার দু’টি চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। পরের বার ঠিক এই সময় আবার আাসার আশা নিয়ে সে ফিরে যায় পাশের গ্রামে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *