নীরার অসুখ

নীরার অসুখ

ডালহৌসি স্কোয়ারে ট্রাম থেকে নেমে সবেমাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছি, হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কীসের যেন একটা শোরগোল শুনতে পাচ্ছিলাম। তাকিয়ে দেখলাম দূরাগত একটা মিছিল। এ পাড়া থেকে কি একশো চুয়াল্লিশ ধারা উঠে গেছে? সারাবছরই তো থাকে। উঠে যায়নি। অবিলম্বে পুলিশ এসে মিছিলের গতি রোধ করল। উত্তেজনা ও গোলমাল বাড়ল। তারপরই হুড়োহুড়ি। লোকজন ছুটোছুটি করছে চারদিকে। ঠিক যেন ভিড়ের মধ্যে একটা পাগলা ষাঁড়কে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ধাবমান লোকগুলির কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই।

আমি গড্ডলিকা প্রবাহে গা না মিশিয়ে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গাড়ি-বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। কলেজজীবন থেকেই পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার-গ্যাস চালানো এত বেশিবার দেখেছি যে এইসব গোলমালের চরিত্র বুঝতে আমার ভুল হয় না। লাঠি টিয়ার-গ্যাসের অবস্থায় এখনো আসেনি।

লোকজনের ছুটোছুটি ক্রমশ বাড়ছিল। তার ফলে লেগে গেল একটা বিশ্রী ট্রাফিক জ্যাম। কতক্ষণে এর জট ছাড়বে কে জানে। এর ওপর আবার আকস্মিকভাবে আরম্ভ হয়ে গেল বৃষ্টি। রীতিমতন জোরে।

বৃষ্টি আসার ফলে লোকজনের ছুটোছুটি, মিছিল ও পুলিশের তাণ্ডব সবই অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেল। বর্ষার তেজি বৃষ্টি অন্য কিছু সহ্য করে না। কয়েক মিনিট পরে আর সব কিছুই শান্ত, শুধু বৃষ্টিরই প্রবল প্রতাপ দেখা গেল।

আমি তখন আমার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম! যতদূর সম্ভব অন্যান্য গাড়ি-বারান্দাগুলোর তলা দিয়ে যাওয়া যায়। পুরোটা রাস্তায় সেরকম সুযোগ নেই, বেশ ভিজতে হল আমাকে। বুক পকেটটা শুধু চেপে রইলাম সিগারেট দেশলাই আর সামান্য যা টাকাপয়সা আছে তা যেন না ভেজে।

বেশিদূর নয়, আমার যাবার কথা রাজভবনের পশ্চিমদিকের গেটের সামনে। নীরা ওখানে আসবে, ঠিক সাড়ে চারটের সময়। আমার মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে।

সিংহমূর্তির কাছেই একটা গাছতলায় দাঁড়ালাম। নীরা এখনো আসেনি। নীরা কোনোদিন দেরি করে না।

কিন্তু সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বিরাট গাড়ির লাইন পড়েছে। ট্রাফিক জ্যাম ছড়িয়ে পড়েছে এদিকেও। এর মধ্যে নীরা আসবে কী করে? ট্রাম বাস সব অচল। নীরা যদি ট্যাক্সি নিয়েও থাকে, তবু এই জ্যাম ভেদ করে ট্যাক্সি আসতে পারবে না। ওরা আসতেও চায় না।

ভীষণ রাগ হল আমার। ঠিক এই সময়ে কি ট্রাফিক জ্যাম না হলে চলছিল না? এদিকে বৃষ্টির বিরাম নেই।

বৃষ্টির সময় গাছতলায় আশ্রয় নেওয়া খুব সুবিধের ব্যাপার নয়। প্রথম প্রথম জলের হাত থেকে বাঁচা যায়। তারপর গাছ নিজেই মাথা ঝাঁকিয়ে জল ঝাড়তে থাকে।

আর একটা সিগারেট ধরাবার জন্য পকেট থেকে সিগারেট দেশলাই বার করলাম। সিগারেট ভেজেনি বটে কিন্তু দেশলাইটা নেতিয়ে গেছে। কয়েকটা কাঠি নিয়ে জ্বালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম বার বার। ছাল-চামড়া শুধু উঠে আসে!

আমার পাশে আরও কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজনের মাথায় ছাতা। তবু তিনি আশ্রয় নিয়েছেন গাছের নীচে। তাঁর মুখে জ্বলন্ত সিগারেট।

খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলুম, আপনার কাছে দেশলাই আছে?

লোকটি আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। নিজের মুখ থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।

হয় ওঁর কাছে দেশলাই নেই অথবা উনি কাঠি খরচ করতে চান না।

সাবধানে ওঁর সিগারেটটা ধরে আমি আমারটা জ্বালিয়ে নিলাম। তারপর ওঁরটা ফেরত দেবার জন্য হাত বাড়িয়ে আমি বললাম, ধন্যবাদ।

আমার ধন্যবাদের উত্তরে উনি বললেন, ফেলে দিন।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওঁর সিগারেটটা মাত্র আধখানা পুড়েছে, উনি ফেরত নিতে চাইছেন না কেন? আমরা তো আরও অনেক দূর পর্যন্ত টানি।

আমি আবার বললাম, এই নিন।

উনি একইরকম গলায় বললেন, দরকার নেই ফেলে দিন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। আমার মুখখানা অপমানে কালি হয়ে গেল। এর মানে কি? আমি কি অচ্ছুৎ? আমার ছোঁয়া সিগারেট উনি স্পর্শ করবেন না? তাহলে দিতে গেলেন কেন? আমি তো সিগারেটের আগুন চাইনি। আর যদি ফেলতেই হয়, আমার কাছ থেকে নিয়েও তো নিজে ফেলতে পারতেন।

অথচ এই নিয়ে তর্ক করাও যায় না। অভদ্র লোকদের এই একটা সুবিধে, ভদ্রলোকেরা তাদের চ্যালেঞ্জ করে না। তারা নিজেরাই সহ্য করে যান। আমি মনে মনে গজরাতে লাগলুম।

পাঁচটা বেজে গেল, নীরা এখনও এল না। ট্রাফিক জ্যামের জট ছেড়ে গেছে, বৃষ্টির তেজ একটু কম। নীরা তো কোনোদিন এত দেরি করে না।

সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। আর কোনো সন্দেহ নেই যে নীরা আজ আর আসতে পারবে না। নিশ্চয়ই আকস্মিক কোনো অনিবার্য কারণে আটকে গেছে। আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।

বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি গাছতলা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। আর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু আমি কারুর কাছে দেশলাই চাইব না।

সবে মাত্র পা বাড়িয়েছি, এই সময় পটাং করে আমার একটা চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। চামড়ার চটি জলে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছিল।

এখন এই ছেঁড়া-চটি নিয়ে আমি কী করি। রাজভবনের সামনে মুচি খুঁজে পাওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার। অথচ ছেঁড়া-চটি ঘষটে ঘষটে হাঁটাও একটা অসম্ভব ব্যাপার। চটি-জোড়া পুরোনো, ফেলে দিলেও ক্ষতি নেই—কিন্তু খালি পায়ে হাঁটার মতন মনের জোর নেই।

অগত্যা সেই চটি টেনে টেনেই হাঁটতে লাগলুম। অত্যন্ত বিশ্রী লাগছে। চটি ছিঁড়ে গেলে মানুষের সমস্ত ব্যক্তিত্ব চলে যায়।

খানিকটা এগোতেই কার্জনপার্কের মোড়ের কাছে দড়াম করে জোর একটা শব্দ হল। চোখ তুলে সেদিকে তাকালাম। না তাকালেই ভালো হত। একটা লরি ধাক্কা মেরেছে একটা টেম্পোকে। টেম্পো থেকে একটা লোক ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। গল-গল করে রক্ত বেরুচ্ছে।

এতকাল কলকাতায় আছি, কিন্তু আমি নিজের চোখে কখনও কোনো দুর্ঘটনা দেখিনি। আজই প্রথম। আজ বিকেল থেকে পর পর একটার পর একটা খারাপ ঘটনা ঘটছে কেন? পৃথিবীর যন্ত্রপাতিতে কি কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে? হঠাৎ আমার মনে হল, নীরার নিশ্চয়ই কোনো অসুখ হয়েছে। সেই জন্যই আসতে পারেনি। কালকেও নীরাকে পরিপূর্ণ সুস্থ দেখেছি, আজ তার অসুখ হবার কোনো কারণই নেই। তবু আমার ওই কথাই মনে হল—সেইজন্যই আজ আমি একটার পর একটা কু-চিহ্ন দেখছি। এইসব ঘটনার সঙ্গে নীরার অসুখের নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে। এই জগৎ তো মায়ার প্রতিবাস, আমার মনের অবস্থা অনুযায়ীই সব কিছু ঘটে থাকে।

নীরার অসুখ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার এক্ষুনি জানা দরকার। ওদের বাড়িতে সাধারণত আমি টেলিফোন করি না, আজ করতে হবে।

কোথায় টেলিফোন? ট্রাম গুমটিতে। ছেঁড়া-চটি পায়ে দিয়েই ছুটলাম সেই দিকে। তিন-চারজন আগে থেকেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে। মেয়েরা টেলিফোন করতে অনেক সময় লাগায়। আমার ইচ্ছে হল, এদের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করে বলি, আমাকে একটু আগে সুযোগ দিন, পৃথিবীর সমস্ত কাজের চেয়েও আমার কাজটা বেশি জরুরি।

কিন্তু এ কথা মুখে বলা যায় না। নীরস মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম সবার পেছনে। মেয়েটি যথারীতি বহুক্ষণ সময় লাগাল। ও যেন কার সঙ্গে ঝগড়া করছে। তাতো করবেই। আজ এই মুহূর্তে, পৃথিবীতে কেউ সুখে নেই।

প্রায় আধঘন্টা বাদে আমার সুযোগ এল। ঠিকঠাক খুচরো পয়সা পকেটে আছে আগেই দেখে নিয়েছিলাম। কানেকশান হবার পর এনগেজড টোন পেলাম। তবু ফোন ছাড়লাম না। পর পর তিনবার চেষ্টা করলাম। একই অবস্থা। তখন টেলিফোন অফিসে লাইন ধরে জিজ্ঞেস করলাম, এই নাম্বারটার কী অবস্থা দেখুন তো। দূরভাষিণী জানালেন, ওই নাম্বার এখন আউট অব অর্ডার হয়ে আছে।

খুব একটা আশ্চর্য হবার মতন ব্যাপার কিছু নয়। আজ বিকেল থেকে পর পর যা ঘটছে, তার সঙ্গে বেশ মিল আছে।

এরপর আমি একটা কাজই করতে পারি। পা ঘষটে ঘষটে চলে এলাম ধর্মতলার মোড়ে। সন্ধের পর কলকাতার রাস্তায় মুচি পাওয়া অসম্ভব—ঈশ্বর এরকম নিয়ম করেছেন। সুতরাং, আমি আমার পুরনো চটি-জোড়া ফেলে দিয়ে ফুটপাথ থেকে একজোড়া রবারের চটি কিনে নিলাম। তারপর মিনিবাস ধরে দ্রুত নীরার বাড়িতে।

দরজা খুলল চাকর। কোনো দ্বিধা না করে জিজ্ঞেস করলাম, দিদিমণি আছে?

অন্য দিন হলে নীরার বাবার সঙ্গে প্রথমে কথা বলতাম, একটা কোনো জরুরি প্রসঙ্গ বানিয়ে নিতে হত। আজ আর ওরকম অছিলা খোঁজার কোনো মানে হয় না।

চাকরটি বলল, দিদিমণি ওপরে শুয়ে আছেন।

অসুখ করেছে?

না এমনিই শুয়ে আছেন।

খবর দাও, বলো, সুনীলবাবু দেখা করতে এসেছেন। চাকরটি ওপরে চলে গেল। আমি বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগলাম। বসতেও ইচ্ছে করল না। টেবিলে অনেক পত্র-পত্রিকা পড়ে আছে, ছুঁয়েও দেখলাম না।

চাকর একটু পরে এসে বললো, দিদিমণির জ্বর হয়েছে।

আমার প্রচণ্ড চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, আমি আগেই বলেছিলাম না?

খুব শান্তভাবে বললাম, আমি একবার ওপরে যাব। দিদিমণির বাবা কিংবা মাকে একটু বলে এসো আমার কথা।

বলেছি, আপনি আসুন।

চাকরটির আগে আগেই আমি সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে এলাম। নীরার ঘর আমি চিনি। তিনতলায় সিঁড়ির পাশেই।

নীরা শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, গায়ে একটা পাতলা নীল চাদর, চোখ বোজা। ওর মা শিয়রের কাছে বসে কপালে জলপটি দিচ্ছেন।

নীরার মা আমাকে দেখে সামান্য একটু অবাক হলেন, কথায় তা প্রকাশ করলেন না অবশ্য। বললেন, ওই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসো।

আমাকে বলতেই হল যে নীরার বিশেষ বন্ধু স্নিগ্ধা, যে আমার মাসতুতো বোন, সে নীরাকে একটা খবর দিতে বলেছিল, আমি এ পাড়ায় এসেছিলাম অন্য কাজে, এসে শুনলাম, নীরার অসুখ।

ওর মা বললেন, দ্যাখো দেখি, হঠাৎ কী রকম জ্বর। দুপুরেও ভালো ছিল।

কী হয়েছে?

বুঝতে পারছি না তো। টেম্পারেচার একশো ডিগ্রি।

ডাক্তার এসেছিলেন?

রথীনকে তো খবর পাঠিয়েছি। ন-টার সময় আসবে বলেছে। টেলিফোনটা আবার আজকে খারাপ। ওর বাবাও এখনও অফিস থেকে ফেরেননি।

কথাবার্তা শুনে নীরা চোখ মেলে একবার তাকাল। ঘোলাটে দৃষ্টি। আমাকে চিনতে পারল কি না কে জানে।

আমি চেয়ারে বসে নীরার মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো ওষুধ-টোষুধ আনতে হবে? আমি এনে দিতে পারি?

না। রথীন এসে দেখুক।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম , উনি কি একবারও ঘর ছেড়ে উঠে যাবেন না?

আজকালকার মায়েরা তেমন অবুঝ নন। একটু বাদেই উনি বললেন, তুমি একটু বসো। আমি একটু গরম দুধ নিয়ে আসি, যদি খায়।

উনি ঘর থেকে চলে যাওয়া মাত্রই আমি উঠে গিয়ে দরজার কাছে উঁকি মেরে দেখলাম, উনি একতলার রান্নাঘরেই যাচ্ছেন কিনা। উনি তাই-ই গেলেন। তাহলে ফিরতে অন্তত দু-মিনিট তো লাগবেই।

নীরার শিয়রের কাছে এসে আমি ওর কপালে হাত দিলাম। কপালটা যেন পুড়ে যাচ্ছে একেবারে।

নীরা চোখ মেলে তাকাল আবার। তারপর অস্পষ্ট গলায় বলল, আমি আজ যেতে পারিনি।

ও কথা এখন থাক। তোমার কষ্ট হচ্ছে?

আমার মন খারাপ লাগছে খুব।

ছিঃ এখন মন খারাপ করে না। হঠাৎ অসুখ বাধালে কী করে?

আমার তো অসুখ হয়নি, আমার মন খারাপ।

লক্ষ্মীটি এখন মন খারাপ করো না।

নীরা আমার হাতটা টেনে নিজের চোখের ওপর রাখল। আমি ভালো লাগায় বিভোর হয়ে গেলাম। আবার ভয়ও করতে লাগল। ওর মা এক্ষুনি এসে পড়বেন না তো?

নীরা বলল, তুমি যেও না।

আমি হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে এসে বসলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর মা এসে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। উত্তেজনায় আমি কাঁপছি।

ডাক্তার না-আসা পর্যন্ত আমি বসেই রইলাম সেই ঘরে। এর আগেই নীরার বাবা এলেন, দু-চারটে কথা বললেন আমার সঙ্গে। আমি জানি, ওঁরা তো আমাকে জোর করে চলে যেতে বলবেন না।

ডাক্তার এল সাড়ে ন-টায়। ওদের কিরকম আত্মীয়। নীরার সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলেন। নীরার জ্বর তখনও একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে মনে হয়।

ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, তোর হঠাৎ কী হল?

নীরা বলল, আমার কিছু ভালো লাগছে না।

কোথায় ব্যথা?

নীরার সেই একই উত্তর, আমার কিছু ভালো লাগছে না।

ওরা কেউ জানে না, শুধু আমি জানি, নীরা কখনও অসুখের কথা আলোচনা করতে ভালোবাসে না। কোনোদিন ও শরীরের কোনো ব্যাপার নিয়েই অভিযোগ করেনি। কিংবা আমার সামনে করে না।

ডাক্তার নীরার বুক-পিঠ পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, জ্বর তো একশো পাঁচের কম নয় মনে হচ্ছে। কোনো রকম ভাইরাস ইনফেকশান মনে হচ্ছে। রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। আজ তো হবে না! কাল সকালেই পাঠিয়ে দেব।

তার পরদিন থেকে কলকাতা শহরে কি তুলকালাম কাণ্ড। আগের দিনের ঘটনার জেরে ছাত্র ধর্মঘট। পুলিশের সঙ্গে আবার মারামারি। ট্রাম বাস পুড়ল। কলকাতা শহরটা বিকল হয়ে গেল।

আমি বিকেলে দৌড়তে দৌড়তে গেলাম নীরার কাছে। নীরার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। কোনো কথা বলতে পারছে না, প্রায় অজ্ঞানের মতন অবস্থা। এদিকে রক্ত পরীক্ষার কোনো ফলাফল তখনও আসেনি।

বিষণ্ণ মনে বেরিয়ে এলাম নীরাদের বাড়ি থেকে। রাস্তাঘাট ফাঁকা থমথমে। যে কয়েকজন লোককে দেখা গেল, সকলের মুখ থমথমে। মাঝে মাঝে হিংস্র চেহারায় পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে।

আমি তো জানি, কলকাতার এই অবস্থা তো শুধু নীরার জন্যই। নীরার অসুখ ঠিক না করলে এই শহর রসাতলে যাবে।

পরদিনও নীরার ঠিক সেই একই রকম অবস্থা। ডাক্তাররা কিছু বলতে পারছেন না। আমি তীব্রভাবে মনে মনে বলতে লাগলুম, আপনারা করছেন কী? আপনারা কি কলকাতা শহরটাকে ভালোবাসেন না? ওকে সারিয়ে না তুললে যে এই শহরটা ধবংস হয়ে যাবে। হঠাৎ ভূমিকম্পে সবকিছু ভেঙে পড়তেও পারে!

সেদিন কলকাতার সাত জায়গায় ট্রামে বাসে আগুন লেগেছে, পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে অনেক জায়গায়। আমি একটু ফাঁকা ঘর পেয়ে অচেতন নীরার কপালে হাত দিয়ে বললাম, নীরা, ভালো হয়ে ওঠ। তোমাকে ভালো হয়ে উঠতেই হবে। তুমি এতগুলো মানুষের কথা ভাব।

পরদিন কলকাতায় কারফিউ জারি হবে কিনা এরকম জল্পনাকল্পনা চলছিল, কেউ কেউ বলছে, আর্মিকে ডেকে আনা হবে। কিন্তু সেদিনই রক্ত পরীক্ষার ফল পাওয়া গেল, জানা গেল ভাইরাস। ঠিক ইনজেকশন দেবার পরই নীরার জ্ঞান ফিরে এল।

এক ঘন্টা বাদে ওর মুখের রংটা দেখাল অনেক স্বাভাবিক।

আমি জিজ্ঞেস করলাম নীরা, এখন কেমন আছ?

নীরা সামান্য হেসে বলল, আমার মন ভালো হয়ে গেছে।

সেদিন বাইরে এসে দেখলাম, চমৎকার ফুরফুরে হাওয়া বইছে। রাস্তায় অনেক বেশি লোকজন। কয়েকজন পুলিশের মুখেও হাসি।

পরদিন সকাল থেকে কলকাতা একেবারে স্বাভাবিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *