নীপার বক

নীপার বক

একেবারে লন্ডভন্ড অবস্থা। যেন খন্ড প্রলয়। চারপাশে থই থই জল। রাস্তাঘাট নেই। সব মুছে গেছে। ঘোর অন্ধকার। মাথার ওপর ঝুলছে রান্নাঘরের ছাদের মতো কালো, নোংরা আকাশ। অসংখ্য গাড়ি অচল হয়ে পড়ে আছে। বৃষ্টি ভেজা গাড়ির চাল সৈনিকের মাথার হেলমেটের মতো চকচক করছে। কী অবস্থা। এখন দেখছি, সেকালের ডাকাতদের মতো এক জোড়া রণপা কিনতে হবে। রোরবার-রোববার, বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠে অভ্যাস করতে হবে। তা না হলে চাকরি-বাকরি আর করা যাবে না।

‘তা কতক্ষণ হবে মশাই আটকে বসে আছি। আমার ঘড়িটা আবার গত রবিবার মেচেদা লোকালে, সাঁতরাগাছির কাছে ছিনতাই হয়ে গেছে।’

ওপাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘তা দেড়ঘন্টা হল।’

‘দিস ইজ ক্যালকাটা। দিস ইজ ইওর ক্যালকাটা। এই দেড়ঘন্টায় প্লেনে দিল্লি চলে যাওয়া যায়। রাজীব নিশ্চয় এখন ডিনার খাচ্ছে!’

‘আর আমাদের মুখ্যমন্ত্রী? একবার দেখুন না মশাই উঁকি মেরে, জলের লেভেলটা। টনসিল টাচ না করলে নেমে পড়ি।’

‘তারপর?’

‘খপাত খপাত।’

‘শেষে গর্তে ঘপাত। অ্যাকসিডেন্ট ইনসিয়োরেন্স করা আছে?’

‘তা না হলে চুপচাপ বসে থাকুন। বসার জায়গা পেয়েছেন, ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল সকালে পেছন ফিরে বসবেন, অফিস পৌঁছে যাবেন। ঘন্টাখানেকের জন্যে বাড়ি ফিরে অশান্তি বাড়িয়ে লাভ কী। আজ তো আর মাস পয়লা নয় যে, এসো হে, এসো হে বলে, ভিজে ঢোল, কাদা-মাখা মালটিকে কোলে তুলে নেবে, আর জিজ্ঞেস করবে, হ্যাঁগা শুকনো আছে তো? ভেজেনি তো? তুমি ভিজে ব্লটিং মেরে যাও ক্ষতি নেই। মাইনের টাকাটা যেন শুকনো থাকে।’

পেছনের সিটে এই সব রম্য আলোচনা হচ্ছে। তার সামনের জোড়া আসনে এক জোড়া কপোতকপোতী। মাথায় মাথা ঠেকাঠেকি করে ভি হয়ে বসে আছে। তাদের কাছে এই জল, এই আটকে যাওয়া বাস যেন বিধাতার আশীর্বাদ। প্রেমিক-প্রেমিকাদের পেটে যে কত কথা জমে থাকে। শেষ আর হয় না। প্রেমালাপ আর ঝগড়া দুটোরই আদি অন্ত থাকে না। আজকাল আবার জনসমক্ষেই সব চলে। সেদিন দেখি রাজধানী এক্সপ্রেসের প্রবেশদ্বারে ঠোঁটে ঠোঁট লক করে একজোড়া পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। কে একজন বললেন, ‘এইটা কী এই সব করার জায়গা?’ সঙ্গেসঙ্গে উত্তর, ‘সিনেমায় চুম্বন, সেনসার আর কাটছে না।’

আর সামনের আসনে এক ভদ্রলোক নোটবুক বের করে হিসেব লিখছেন। বোধ হয় লোহার কারবারী। লোহা এখন সোনা। সে যুগে মানুষ সোনার সন্ধানে ছুটত, এ যুগের মানুষ ছুটছে পার্কের রেলিং খুলতে, ম্যানহোলের-ঢাকনা সরাতে। প্রস্তরযুগ, স্বর্ণযুগ সব যুগ শেষ হয়ে এখন পড়েছে লৌহ যুগ আর চুল্লুর যুগ। সিনেমার নায়ক গান ধরে, চুল্লু খাও, চুল্লু, চুল্লু খাও চুল্লু, আর ইয়ং অডিয়েন্স তাল মারে।

আমার বাঁ-পাশের ভদ্রলোক মিনিট পনেরো আগে তোফা নস্যি টেনে দিব্যি ঘুমোচ্ছিলেন, হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে চিৎকার ছাড়লেন, ‘হ্যাঁ গা ঘরের, জানলা বন্ধ করে এসেছিলে?’

ও মাথা থেকে নারীকন্ঠে ভেসে এল ‘না, কটা খুলে রেখে এসেছিলুম।’

ভদ্রলোক স্ত্রীর গলা নকল করে বললেন, ‘রেখে এসেছিলুম। বেশ করেছিলে। গিয়ে দেখবে সব কালিয়া হয়ে গেছে।’

ও মাথা হেঁকে উঠল, ‘কে জানত এমন বৃষ্টি নামবে। আমি কি জ্যোতিষী!’

ইনি সঙ্গেসঙ্গে ছক্কা মাড়লেন, ‘তুমি আমার নিয়তি।’

বাসের পেট থেকে অদৃশ্য কন্ঠ উৎসাহ দিল—‘চালিয়ে যান দাদা, জ্বালাময়ী জ্বালিয়ে দিন।’ ভদ্রলোক একটু দমে গেলেন। আবার এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, আপন মনে ‘যা: শালা মরগে যা। আমার কি। বিছানা পাওয়া হয়ে গেল। ধরবে যখন বাতে, তখন মুখের বাত বেরিয়ে যাবে।’

আবার বেশ তোড়জোড় করে ঘুমোবার তালে ছিলেন, ও মাথা থেকে নিয়তির কন্ঠ ভেসে এল, ‘ছাতাটা তুলেছিলে তো?’

ভদ্রলোক কেমন যেন চুপসে গেলেন, খোঁচা খাওয়া বেলুনের মতো। আমতা আমতা করে বললেন, ‘ছাতা?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ছাতা। জানি জানি, ওটা যখনই তোমার হাতে গেছে তখনই আমি জানি মায়ের ভোগে।’ মেয়েরা আজকাল মডার্ন ল্যাঙ্গোয়েজ শিখে গেছে।

ভদ্রলোক বললেন, ‘ওটা তা হলে সোনাদের বাড়িতেই পড়ে রইল।’

‘আজ্ঞে না, ওদের বাড়ি থেকে যখন বেরুলে তখন ছাতা তোমার হাতে। সে ছাতা এখন বেহালার ট্রামে চাপছে।’

আমি বললুম, ‘বেকায়দায় পড়ে গেছেন দাদা। এবার আপনি শুয়ে পড়ুন।’

ভদ্রলোকও কম যান না। ইনি হলেন সেই টাইপ। হারব বললেই হারেগা, খামচে খুমচে মারেগা।’ চিৎকার করে বললেন, ‘আমার ছাতা আমি বুঝব। পাখির খাঁচাটা কোথায় পড়ে রইল, বাইরের বারান্দায়!’

কলকাতার টেলিফোনের মতো, ওপাশ থেকে ‘নো রিপ্লাই’।

মধ্য বয়সী ভদ্রলোক ফোলাভোলা মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেমন দিলুম। একে বলে তুরুপের তাস।’

‘কে বেশি হারে?’

‘সে যদি বলেন, তা হলে আমিই বেশি হারি। আমি ঠিক পারি না মশাই। মহিলা ট্যাকল করা খুব কঠিন ব্যাপার, মোহনবাগানের মতো অবস্থা হয়। কাটিয়ে কাটিয়ে গোলের কাছে নিয়ে এলুম। সিওর গোল। মেরে দিলুম গোলপোস্টের বাইরে। অসংখ্য ছেঁদা মশাই। অসংখ্য ছেঁদা।’

‘আমার স্বভাবে। এত ছিদ্র নিয়ে জেতা যায়। অসম্ভব!’

ভদ্রলোক আর একবার নস্যি নিলেন সশব্দে। তারপর কোণের দিকে হেলে গিয়ে আবার এক রাউণ্ড ঘুমের আয়োজন করলেন।

ও মাথা থেকে ভেসে এল নারীকন্ঠ, ‘এবার নেমে পড়লে হয় না? সারা রাত বসে থাকবে না কি?’

আড় হয়ে বসে থাকা ভদ্রলোক চোখ না খুলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাঁতার জানা আচে কি?’

ওপাশে দুই মহিলাতে কথা হচ্ছে, একজন আর একজনকে বলছেন, ‘ভাই, আমাকে এই জল ঠেলে যেভাবেই হোক যেতে হবে। ছেলেটা এতক্ষণে মা, মা করে ঘুমিয়েই পড়ল হয়তো। সারাটা দিন ওই কাজের মেয়েটির কাছে থাকে। মারধোরও করে। এই চাকরি, সংসার এক সঙ্গে সামলানো যায়!’

‘ছেড়ে দে না।’

‘ওব্বাবা, চাকরির জোরেই বিয়ে। ছেড়ে দিলেই মারবে লাথি।’

না আর না, এবার উঠে পড়ি। যেমন করেই হোক বাড়ি তো ফিরতে হবে। সব পাখি ঘরে ফেরে। বাসের পাদানিতে ঘোলা নোঙরা জল ছলকাচ্ছে। পাশেই এক বিকল মটোরগাড়ি। পেছনের আসনে মোটাসোটা বদমেজাজী ভদ্রলোক, ক্রমান্বয়ে ঠোঁট নেড়ে চলেছেন। স্টিয়ারিং-এ অসহায় ড্রাইভার।

ধীরে ধীরে নিজেকে দুই গাড়ির মাঝখানের খালে নামালুম। হাঁটু জল। তলায় ভাঙাচোরা রাস্তা। জল-বেশ ঠাণ্ডা। স্পর্শে গা ঘিনঘিন করে উঠল। উপায় নেই। পড়েছি যবনের হাতে। চারপাশে শুধু অচল গাড়ি। সাদা, নীল, লাল, ঘেয়ো, তালিমারা, তাপ্পিমারা, মেহনতী স্টেটবাস। একটা ফুলসাজ-গাড়ীতে চন্দনচর্চিত বর। বড়োই উদ্বিগ্ন মুখচ্ছবি। লগ্ন বয়ে যায়। বরকর্তার ঠোঁটে সিগারেটের আগুন জ্বলছে নিভছে। উত্তেজনার টানাপোড়েন। গালে জলজল মতো কীসের ছিটে লাগল। ওপরে তাকালুম। ডবলডেকারের দোতলা থেকে থুতু বৃষ্টি হচ্ছে।

এ গাড়ি সে-গাড়ির মাঝখান দিয়ে নিজেকে রাস্তার বাঁ-পাশে এনে ফেললুম। ভয়াবহ অঞ্চল। জল হাঁটু ছাড়াল। তলায় হড়হড়ে কাদা। অদূরেই ফুটপাথের ধ্বংসাবশেষ। ভাঙা রেলিং। জনগণের ট্রাস্টিরা যতটা পেরেছে খুলে নিয়ে গেছে। সেলিং ন্যাশনাল প্রপার্টি একটা ভালো ব্যবসা। মূলধনের প্রয়োজন নেই। শুধু মেহনত। ফুটপাথের নিরাপত্তায় হাঁটার আশা ছেড়েই দিলুম। নিজের পশ্চাদ্দেশে বারকতক চাপড় মেরে বললুম, বলো বীর, বলো উন্নত মম শির। তারপর পড়ে যেতে যেতে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, ‘ভয়ে ভীত হোয়ো না। মানব।’ খোয়ার টিবিতে পা পড়েছিল। জলের তলায় রাস্তার ভূগোল পৌরপিতাও জানেন না আমি তো তাঁর নাবালক সন্তান। বলো, রাখে কেষ্ট মারে কে। বাঁ-পাশে একটা বড়ো ঢনঢনিয়া মার্কা বাড়ির তলায় মেহনতী মানুষের জটলায় কল্কে ফাটছে, ব্যোম শঙ্কর। কল্কে একমাত্র জিনিস, যার কৃপায় কাটফাটা রোদেও মানুষ গান ধরতে পারে—আহা, ‘এমান চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো।’

কলকাতার বন্দরে বড়ো বড়ো জাহাজ ভেড়াবার জন্যে পাইলট দরকার হয়। আমাকে এখন কোনো পাইলটে নিয়ে যাবেই। আমি তো আর কলম্বাস নই, যে ভাসতে ভাসতে আমেরিকা চলে যাব। অথৈ জলে গামলার মতো আমার টালমাটাল অবস্থা। বিশ-তিরিশ মিনিটের চেষ্টায় তিন চার কদম এগিয়েছি। একটা ঠং ঠং রিকশা পাকড়াবার চেষ্টা করলুম। পাত্তাই দিল না। দিলেও সামর্থ্যে হয় তো কুলোত না। কলকাতার রিকশা আর ট্যাকসি খদ্দের চেনে। মাতাল না হলে ওদের নেকনজরে পড়া অসম্ভব।

জয় মা বলে আরও দু-দশ পা এগোবার পর মনে হল, জলে স্রোতের টান ধরেছে। তার মানে সামনেই খোলা ম্যানহোল। কলকাতার পেটে যাবার সামান্যতম ইচ্ছে নেই। আলকাতরার মতো অন্ধকার। ছায়ামানবেরা নন্দী, ভৃঙ্গীর মতো ধূসর প্রেক্ষাপটে নাচছে। কলকাতার রসের গামলায় মানুষের লেডিকেনির টাপুরটুপুর অবস্থা।

একটি বেপরোয়া চরিত্র পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘অমন গাগরি ভরণে কে যায় ও চালে চললে রাত ভোর হয়ে যাবে মশাই। এ তো কিছুই নয়, সামনে—ফায়ার ব্রিগেড। সেখানে আপনার কপনি ডুবে যাবে।’ ভদ্রলোক গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেলেন প্রপেলার লাগানো বোটের মতো। তার সঙ্গেসঙ্গে যাও বা এধারে-ওধারে দু-চারটে আলো জ্বলছিল লোডশেডিং-এর ফুঁয়ে সব ধ্বংস হয়ে গেল। চারপাশ থেকে হো করে একটা শব্দ উঠল। নীচে ভরা চিত্তরঞ্জন নদী চার পাশে খাড়া খাড়া বাড়ি, মনে হল নরক থেকে ভয়ঙ্কর একটা সোরগোল উঠে, ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে গমগম করছে।

আমি অসহায়। কী ভেবে জানি না, তিনবার জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ বললুম, বেশ জোরে জোরে। সঙ্গেসঙ্গে একেবারে পেছন থেকে কে একজন জড়ানো গলায় বললেন, ‘কমরেড, বিপ্লব শুরু হল, না শেষ হল?’

একেবারে কাঁধের পাশে। নাকে ভক করে গন্ধ লাগল।

মালুদা হঠাৎ শাসনের গলায় বললেন, ‘হেডলাইট, ব্যাকলাইট ছাড়াই বেরিয়ে পড়েছ বাওয়া। তা থামলে কেন সোনার চাঁদ। পাম্পে গিয়ে আমার মতো পেট্রল নিয়ে এসো। ট্যাঙ্কে মাল নেই বাওয়া মুফতে মাইল মারবে? মামার বাড়ি! ভাগনে! এটা মামার বাড়ি!’

মাতাল আর দাঁতাল দুটোই ভীতিপ্রদ। অমার স্পিড সামান্য বাড়ল। মাতাল তবু সঙ্গ ছাড়ে না। প্রায় পাশে পাশে ঘাড়ে ঘাড়ে। মন্দ কি। সামনে সামনে চলুক না। গাড্ডায় পড়লে সাবধান হওয়া যাবে। ওব্বাবা জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক। আমি মন্থর হলে তিনি থেমে পড়েন। আবার হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে, ‘নাই বা ঘুমালে প্রিয় রজনী এখনও বাকি’।

ফায়ার ব্রিগেডের কাছাকাছি এসে গানের বাণী পালটে গেল, ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে পেণ্ডুলাম ভেজাবো না।’ কী মানে কে জানে! খপ করে আমার হাত চেপে ধরলেন, ‘কমরেড আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন জানি না, আমি বাড়ি যাবার চেষ্টা করছি।’

‘আমি তা হলে কোথায় যাচ্ছি। রসাতলে। আমি কে? বলতে পার আমি কে।’

‘আপনি অবতার।’

‘ধুস, আমি শ্যামার বর। তুমি কমরেড কার বর?

‘নীপার বর।’

‘তুমিও বর আমিও বর। মাইণ্ড ইট বরযাত্রী নই। তোমার পেট খালি?’

‘একেবারে খালি।’

‘ষ্টপ। ষ্টপ আর এক পা এগিয়ো না। ডুবে যাবে। পেটে মাল নেই, কী সাহস। সমুদ্র পার হবে?’

‘আমার বউমাকে বিধবা করবে। নিষ্ঠুর। তুমি কী নিষ্ঠুর।’

ভদ্রলোক হাপুস হাপুস করে কাঁদতে লাগলেন। পরনে দামী জামাপ্যান্ট। গায়ে বিলিতি সেন্টের গন্ধ। আর আমার দরকার নেই, খুব হয়েছে। জল প্রায় কৌপিন স্পর্শ করেছে। আমি মরীয়া হয়ে সামনে এগোচ্ছি। মেছোবাজারের খালি ফলের টুকরি দুলতে দুলতে ভাসছে। আকাশ আবার ঘোর হয়ে এসেছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা নামল বলে। লম্বা একটা বাঁশ উঁচু হয়ে আছে। ম্যানহোল সঙ্কেত। দূরে একটা বাড়ির সর্বাঙ্গে আলোর ঝালর ঝুলছে। তার মানে ও তল্লাটে লোডশেডিং হয়নি। বিয়ে বাড়ি। লোকজনের কালো কালো মাথা নড়ছে চড়ছে। গাড়ির গুঁতোগুঁতি। চিৎকার চেঁচামেচি। সিনেমা ভেঙেছে। ঠোঁটে ঠোঁটে হিন্দি গানের কলি। ওই অন্ধকারেই কে একজন সুরেলা গলার গেয়ে উঠল, গিলে লে গিলে লে, আরো, আরো গিলে লে; আর কী গিলবে বাবা, সারা কলকাতাটাই তো গিলে ফেলেছে। ডানপাশে পাতাল রেলের সাজসরঞ্জাম, যেন ময়দানবের কারখানা। হলদে শাড়ি পরা স্বাস্থ্যবতী একটি মেয়েকে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে এক কাপ্তেন বলছে, ‘ওর ভেতর জাপানি আছে। এপাশ থেকে ফুটো করতে করতে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। মেয়েটি অমনি বাওয়া ধরল, ‘আমি জাপানি দেখব। ও হুলোদা, আমি জাপানি দেখব।’

ছেলেটি বললে, ‘বাড়ি চল। তোর মা তা না হলে জাপানি দেখাবে।’

অন্ধকার সমুদ্র থেকে ভেসে এল মাতালের কন্ঠস্বর—‘নীপার বর, কোথায় পালালে বাওয়া। শ্বশুরবাড়ির পাড়া যে এসে গেল।’

মালের ট্যাঙ্ক আর প্যাটন ট্যাঙ্ক দুই অপ্রতিরোধ্য। মাতাল ঠিক চলে এসেছে। বাঁ-পাশে লাল আলোর এলাকা। এদিকে তেমন জল নেই। সব নেমে গেছে পাতাল রেলের গর্তে। অন্ধকারে বিশাল এক চেহারা যেন পাতাল ফুঁড়ে উঠল, ‘লাগবে না কী স্যার, তেরো থেকে তেত্রিশ।’ কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলুম। ফ্রক পরা তেরো চোদ্দো বছরের একটা মেয়ে ঘুপটি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা সিগারেটে পাকা টান লাগাচ্ছে। আগুন বড়ো হচ্ছে, ছোট হচ্ছে।

অন্ধকারে আবার আর্তনাদ—নীপার বর, কোথায় গেলে বাওয়া।’

পাড়ায় এসে ঢুকলুম। আলো আছে। ঢোকার মুখেই ছাইগাদা। বৃষ্টিতে ধোলাই হয়ে পরিচ্ছন্ন কয়লার সুন্দর কৃষ্ণ চাউনি। ঝড়ে আর জলে মোড়ের মাথায় কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার অলঙ্কার ছিন্নভিন্ন হয়ে ভিজে পথে চড়িয়ে আছে। একটু আগেই এ-পাড়ার কেউ হয়তো চিরবিদায় নিয়েছেন। সাদাফুলের পাপড়ি আর খই পড়ে আছে।

বিশু ময়রার দোকানে গরম রসগোল্লা রসে ফুটছে। বেঁচে অখন্ড অবস্থায় ফিরছে। পুরোটাই আমার কৃতিত্ব। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে পারতুম। গর্তে সমাধি হতে পারত। নিশাচরে নাঙ্গাবাবা করে দিতে পারত। প্রায় পুনর্জন্ম। হোক শেষ মাস। দশ টাকার গরম রসগোল্লা কিনে ফেললুম। আর এক খদ্দের বললেন—‘আজ আড়াই ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছে।’

বিশু বললে—‘আপনার বালতিতে ছেঁদা ছিল। ওই দেখুন আমার ছ-লিটার বালতি বাইরে বসানো আছে। ভরে উপচে পড়েছে।’

জলে ভিজে প্যান্ট ব্রিচেস। পা জলে চুপসে চামচিকে। হাতে গরম রসগোল্লা। একবার কড়া নাড়লুম। কেউ বললে না ‘যাই।’ উপন্যাসের বিরহিণী নায়িকার মতো কপালে সজল টিপ পরে, ঘরে প্রদীপ জ্বেলে, গবাক্ষে কেউ প্রতিক্ষায় নেই। জানালার যে অংশের জোড়, বার্ধক্যে ফাঁক হয়ে গেছে, সেই চিলতেতে জোরালো নীল আলোর নাচানাচি। টিভি-তে সাংঘাতিক কোনো বিজ্ঞাপন অনুষ্ঠান চলেছে। দুয়ারে নীপার বর কেঁপে মরছে।

আবার কড়া। ভেতর থেকে প্রলম্বিত প্রশ্ন—‘কে-এ-এ।’

আশ্চর্য! এখন আমি ছাড়া আর কে আসবে। আমি যে আসতে পারি, এ বোধটাই নেই। হায় সংসার! না, ধরেই নিয়েছে, গোরু যখন হোক গোয়ালে ফিরবেই। গম্ভীর গলায় বললুম, ‘আমি’।

ভেতর থেকে আদুরে এলানো উত্তর ‘যাই’ টিভিতে একগাদা ‘দামড়া’ ভাঁড়ামো করছে।

খুট করে দরজা খুলে গেল। বউ নয় শালী। কখন এসেছে কে জানে। ভেতর থেকে বোনের প্রশ্ন—‘কে রে? ও!’

আমি আমার বউয়ের পায়ের পাতা দেখতে পাচ্ছি। জোড়া হয়ে আছে। টিভির পর্দার আধখানা। সেই অর্ধাংশে এক দেহাতী মহিলা হাঁউহাঁউ করছে। নীপা আধ শোয়া হয়ে টিভি-দেখছিল। উঠে এল রাজহংসীর মতো। যেন ডিমে তা দিচ্ছিল। সোনার ডিমে।

‘কি গো এত দেরি হল?’

প্রশ্ন শুনে গা জ্বলে গেল। শালীকে সাক্ষী রেখে কড়া কথা চলবে না। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন—‘তোমাদের এদিকে বৃষ্টি হয়নি।’

‘একটু হয়েছে। অ, তাই বুঝি তুমি ভিজে গেছ?’

আমি ঢোকার জন্যে পা তুলেছি, নীপা হাঁ হাঁ করে উঠল—‘ঢুকো না, ঢুকো না। রাস্তার জল, রাস্তার জল।’ ওই এক পা তোলা অবস্থায়, আমি সেই বিখ্যাত হিন্দিগানের রূপান্তরিত কলি—‘তেরি দুয়ার খাড়া এক যোগী (যোগী নয় বক)’। নীপার বক।

আর সেই অবস্থাতেই দেখলাম—একটু আগেই মৌজ করে সব চিঁড়ে ভাজা খেয়েছে। খালি কফির কাপ। ফুলকাটা ডিশে লাল একটা ভাজা লঙ্কা। আর টি ভি গাইছে—ইয়ে হ্যায় জিন্দেগী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *