নীচে নামো বাঁয়ে ঘোরো
রাজপুরোহিত এবং হুমকি
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নিবিষ্ট মনে একটা বই পড়ছিলেন। হঠাৎ বইটা বুজিয়ে টেবিলে রেখে বললেন, সভ্যতার সঙ্গে বর্বরতার সম্পর্ক যেন অচ্ছেদ্য। বর্বরতা ছাড়া সভ্যতা হয়তো টেকে না।
একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। দেখলাম, তার চুরুট থেকে আর সেই নীল ধোঁয়ার আঁকাবাঁকা রেখাটা নেই। তার মানে, চুরুটটা কখন নিভে গেছে। তাঁর সাদা দাড়িতে একটুকরো ছাই এখনও আটকে আছে। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি অভ্যাসমতো চোখ বুজে টাকে হাত বুলোচ্ছেন। বললাম, বর্বরতাকে কি সত্যিই সভ্যতার মধ্যে আবিষ্কার করলেন? নাকি ওই বইয়ে কথাটা ছাপানো আছে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, না জয়ন্ত! বইটা পড়তে পড়তে কথাটা আমার মাথায় এল।
কী বই ওটা?
কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দেয়ালঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। তারপর হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী!
তার প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণ ভেতর থেকে সাড়া দিল, যাচ্ছি বাবামশাই!
চারটে পাঁচ বেজে গেছে। কর্নেল দাড়ি থেকে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্ত মুখে বললেন। ষষ্ঠীর এই একটা অদ্ভুত স্বভাব। মিসেস অ্যারাথুনের বেড়ালটাকে দেখতে পেলেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। জানালার পাশে লাঠি হাতে ওঁত পেতে থাকে। নির্বোধ আর কাকে বলে? ও বুঝতেই পারে না অত মোটাসোটা একটা বেড়াল জানলার গ্রিল গলিয়ে ঘরে ঢুকবে কী করে?
কথা শেষ হওয়ার আগেই ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এই ড্রয়িং রুমে ঢুকেছিল। সে টেবিলে ট্রে রেখে গোমড়ামুখে বলল, আমি কি বেড়াল দেখছিলাম? অবেলায় খুব মেঘ করেছে। বিষ্টি হলেই কেলেঙ্কারি। রাস্তা একেবারে নদী হয়ে যাবে।
কথাটা বলে সে তেমনি গোমড়ামুখে চলে গেল। বললাম, আপনি একটু আগে সভ্যতা আর বর্বরতার কথা বলছিলেন। সভ্যতার প্রতীক এই কলকাতার রাস্তা এক পশলা বৃষ্টিতে সত্যিই নদী হয়ে যায়। বোঝা যাচ্ছে, ষষ্ঠীও সভ্যতার মধ্যে বর্বরতাকে আবিষ্কার করেছে। কারণ বৃষ্টির কলকাতাকে আর সভ্য বলেই মনে হয় না।
কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে কফিতে মন দিলেন। তার কয়েক মিনিট
অবশ্যি এভাবেই এসে পড়ে। তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরটা আবছা আঁধারে ভরে গিয়েছিল। ষষ্ঠী চুপচাপ এসে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন, হু। বর্বরতা তোমাকে সম্ভবত আজ রাতের মতো আটকে দিল। না-পারবে তোমার পত্রিকা অফিসে যেতে, না-পারবে সল্টলেকে বাড়ি ফিরতে। তবে হ্যাঁ–ডিনারে তুমি সভ্যতার স্বাদ পাবে। ষষ্ঠী তোমাকে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন খাওয়াবে।
আঁতকে উঠে বললাম, সর্বনাশ! অফিসে না ফিরলেই নয়। রিপন স্ট্রিটে পুলিস রেডের খবরটা খুব জরুরি। আমারই ভুল। কেন যে হঠাৎ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।
তুমিই বলছিলে রেড ধরে পুলিস কোনও চোরাই মাল পায়নি!
তা পায়নি। তবে এটাও তো একটা খবর।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালেন। পুলিসের নিছক রেড করাও কি একটা খবর? জয়ন্ত! আজকাল দেখছি খবরের কাগজের যা মতিগতি, ষষ্ঠীর হাতে মিসেস অ্যারাথুনের বেড়ালটা দেবাৎ আক্রান্ত হলেও সেটা একটা খবর হয়ে উঠবে। তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সুনাম এভাবে নষ্ট করা উচিত নয়।
এই সময় ডোরবেল বাজল। একটু পরে ষষ্ঠী এসে বলল, এক পুরুতঠাকুর এসেছেন বাবামশাই!
কর্নেল তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন, তুই কী করে জানলি পুতঠাকুর এসেছেন?
ষষ্ঠীচরণ হাসল। চেহারা দেখেই মানুষ চেনা যায়। পুরুতঠাকুর কি আমি কখনও দেখিনি?
খুব হয়েছে। নিয়ে আয়।
এরপর যিনি কর্নেলের এই জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন, তাঁকে দেখামাত্র বুঝলাম ষষ্ঠী চিনতে ভুল করেনি। আগন্তুক বয়সে প্রৌঢ়। তার গায়ে সাদা উত্তরীয় জড়ানো, পরনে খাটো ধুতি, কপালে লাল তিলক এবং খুঁটিয়ে ছাঁটা চুলের কেন্দ্রে গিট দিয়ে বাঁধা শিখাও আছে। পৈতে তো আছেই। নমস্কার করে কাঁচুমাচু মুখে তিনি বললেন, আমি কর্নেল সায়েবের সঙ্গে কিছু প্রাইভেট কথা বলতে চাই।
বলুন!
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বিনীতভাবে বললেন, কথাটা প্রাইভেট।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। আমাকে কেউ যা কিছু গোপন কথা বলুন, জয়ন্তর তা অজানা থাকবে না।
ভদ্রলোক আমাকে নমস্কার করে বললেন, আমার সৌভাগ্য! সত্যসেবক পত্রিকায় আপনার লেখার মাধ্যমেই কর্নেল সায়েবের পরিচয় পেয়েছি। আপনাদের কাগজের অফিস থেকে কর্নেল সায়েবের ঠিকানা জোগাড় করে সোজা এখানে চলে এলাম। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
কর্নেল বললেন, আপনি গাড়িতে এসেছেন দেখছি।
আজ্ঞে হ্যাঁ। পুরুতমশাইয়ের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। কাগজে যা পড়েছি, ঠিক তা-ই। আপনি সত্যিই
না। অন্তর্যামী নই। আপনি একটুও ভেজেননি। এই বাড়ির নীচে পোর্টিকো আছে। যাই হোক, যা বলার শিগগির বলুন। কারণ রাস্তায় জল জমে গেলে আপনার গাড়ি ফেঁসে যাবে।
পুরুতমশাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। চাপা গলায় বললেন, আপনি মোহনপুরের রাজবংশের কথা শুনে থাকবেন। দমদম এরিয়ায় ওঁদের একটা প্যালেস আছে। নামেই এখন মোহনপুর প্যালেস। জরাজীর্ণ খাঁ খাঁ অবস্থা। ওই বাড়িতে ওঁদের আরাধ্য দেবতা শ্রীবিষ্ণুর মন্দির আছে। সেই মন্দিরের সেবাইত আমি। আমার নাম নরহরি ভট্টাচার্য।
বেশ। কী ঘটেছে বলুন?
ভট্টাচার্যমশাই আরও চাপা গলায় বললেন, কথাটা কুমারবাহাদুরকে বলতে সাহস পাইনি। উনি বৃদ্ধ মানুষ। তার ওপর গত মাসে বাথরুমে পড়ে গিয়ে পক্ষাঘাত রোগে শয্যাশায়ী। ওঁর বউমা ছন্দা আমাকে বাবার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তাই তাকেই শুধু জানিয়েছি! কুমারবাহাদুরকে জানাতে নিষেধ করেছি। তো ছন্দা আমাকে পুলিসের কাছে যেতে বলেছিল। কিন্তু ভেবে দেখলাম
সংক্ষেপে বলুন। বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে।
মন্দিরের লোহার দরজা ব্রিটিশ আমলে সায়েব কোম্পানির তৈরি। ওতে একটা অদ্ভুত তালা আছে। সেই তালা কীভাবে খুলতে হয়। তা জানেন শুধু কুমারবাহাদুর আর আমি। তো সম্প্রতি কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি, শ্রীবিষ্ণুর বুকের কাছে একটা রেখা ফুটে উঠেছে। কিন্তু তার চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, নিরেট সোনার মূর্তির রঙ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। এত বছর ধরে আমি শ্রীবিষ্ণুর সেবা করছি। কিন্তু এমন তো কখনও দেখিনি! তাই মনে একটা খটকা লেগেছে।
আপনার খটকা কি এই যে, আসল মূর্তিটা কেউ হাতিয়ে নিয়ে অবিকল-একই চেহারার একটা নকল মূর্তি বসিয়ে রেখেছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। কুমারবাহাদুর জানতে পারলে সর্বনাশ হবে। আপনি যদি দয়া করে আসল মূর্তিটা উদ্ধার করে দেন, প্রাণে বেঁচে যাব।
কুমারবাহাদুরের ছেলে, মানে ছন্দাদেবীর স্বামী কী করেন?
মৃগেন্দ্র গত বছর ক্যান্সারে মারা গেছে। সে একটা কোম্পানিতে বড় পোস্টে চাকরি করত। তার মৃত্যুর পর ছন্দা শ্বশুরমশাইয়ের কাছেই আছে। একমাত্র সন্তান ছিল মৃগেন্দ্র।
যে গাড়িতে এসেছেন, সেটা কার?
মৃগেন্দ্রর গাড়ি। গাড়িটা ছন্দা স্বামীর স্মৃতি বলে বেচে দেয়নি। নিজেই ড্রাইভিং শিখেছে।
এবং আপনিও ড্রাইভিং শিখেছেন!
নরহরি ভট্টাচার্য আড়ষ্টভাবে একটু হেসে বললেন, আজ্ঞে, এ বয়সে ড্রাইভিং শেখা শক্ত। তবে বাধ্য হয়েই শিখতে হয়েছে। ছন্দা তো সবসময় শ্বশুরমশাইয়ের সেবাযত্ন নিয়ে ব্যস্ত। মাইনে দিয়ে ড্রাইভার পোষারও ক্ষমতা নেই। তাই ছন্দা আমাকে তাগিদ দিয়েছিল। কিন্তু আপনি দেখছি, সত্যিই
না। আপনার হাতে গাড়ির চাবি দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক, আর দেরি করবেন না। রাস্তায় জল জমে যাচ্ছে।
ভট্টাচার্যমশাই উঠে দাঁড়ালেন। আবার নমস্কার করে বললেন, ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। লোহার কপাট না ভাঙলে মন্দিরে চোর ঢোকা অসম্ভব। দয়া করে যদি একবার পায়ের ধূলো দেন, ভালো হয়। এই নিন। মোহনপুর প্যালেসের ঠিকানা আমি লিখে এনেছি।
ভাঁজ করা একটা কাগজ দিয়ে রাজবাড়ি পুরোহিত দ্রুত প্রস্থান করলেন। দেখলাম, কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতস কাচ বের করে ঠিকানাটা খুঁটিয়ে দেখছেন। একটা ঠিকানা পড়ার জন্য আতস কাচ কেন দরকার হল বুঝতে পারলাম না।
উঠে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে নীচের রাস্তার অবস্থা দেখে এলাম। বৃষ্টি সমানে ঝরছে। তবে এখনও রাস্তায় বেশি জল জমেনি। এখনই বেরিয়ে পড়তে পারলে অফিসে না ফিরে বরং ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস হয়ে সল্টলেকে ফিরতে পারতাম।
কর্নেল আতস কাচ এবং ঠিকানাটা ড্রয়ারে রেখে বললেন, তুমি কী চিন্তা করছ, তা বুঝতে পারছি জয়ন্ত! কিন্তু তুমি ইলিয়ট রোড থেকে যদি বা বেরুতে পারো, মল্লিকবাজারের সামনে জ্যামে আটকে যাবে। কারণ আমি দেখেছি, এই সময়টাতে ওখানে প্রতিদিন ট্রাফিক জ্যাম হয়। এদিকে বৃষ্টি পড়লেই সব গাড়ি যেন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এখন তুমি যদি শর্টকাটে যেতে চাও, তোমাকে ই এম বাইপাসে পৌঁছুতে দরগা রোড ধরতে হবে। সেখানে ততক্ষণে একহাঁটু জলে। তোমার পেট্রোল কার ফেঁসে যাবে। কাজেই চুপটি করে বসো।
অগত্যা চুপটি করেই বসে রইলাম। কর্নেল ষষ্ঠীকে ডেকে আরেক পেয়ালা কফির হুকুম দিয়ে সেই গাব্দা বইটা টেনে নিলেন। এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, বইটার নাম দি মিসটিরিয়াস বাটারফ্লাই।
আমার বৃদ্ধ বন্ধুর অবিশ্যি পাখি-প্রজাপতি-ক্যাক্টাস-অর্কিড এসব বিষয়ে প্রচণ্ড বাতিক আছে। কোথাও বাইরে গিয়ে বিরল প্রজাপতির খোঁজে দিনভর টো টো করে ঘোরেন। কিন্তু রহস্যময় প্রজাপতি ব্যাপারটা বুঝলাম না। কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল এবং চোখ নাচিয়ে ফ্রায়েড রাইস-চিকেনের আভাসও দিল। কর্নেলের দৃষ্টি বইটার পাতায়। বৃষ্টি কখনও জোরে কখনও আস্তে প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা শোনাচ্ছে।
কফি খেতে খেতে হঠাৎ মোহনপুর রাজবাড়ির বিষ্ণুমূর্তির কথা মনে পড়ে গেল। আজকাল দামি রত্নের মূর্তি বলেও নয়, যে-কোনও মূর্তি প্রাচীন হলেই বিদেশে চড়া দামে পাচার হয়ে যায়। তবে এই মূর্তিটা নাকি নিরেট সোনার। যদি কোনও চোর সেটা হাতিয়ে থাকে, সোনা বেচেই সে বড়লোক হয়ে যাবে।
কতক্ষণ পরে টেলিফোনের শব্দে আমার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল। কর্নেল বললেন, ফোনটা ধরো জয়ন্ত!
ফোন তুলে সাড়া দিতেই কেউ ধমক দিল, এই ব্যাটা বুড়ো ঘুঘু! মরণ ফাঁদ পাতা আছে। সাবধান!তার পরই লাইন কেটে গেল। ফোন রেখে কর্নেলের দিকে তাকালাম। আমার বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠেছিল। তখনও কাঁপুনি থামেনি।
কর্নেল মুখ তুলে একটু হেসে বললেন, কেউ হুমকি দিল তো? বাহ! খুব ভালো।…
.
হত্যাকাণ্ড এবং অদ্ভুত তালা
কর্নেল আমার মুখ দেখেই কীভাবে বুঝেছিলেন কেউ টেলিফোনে হুমকি দিল, তা জানি না। অবিশ্যি এমন হতেই পারে, আমার মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠেছিল। কিন্তু হুমকি দিলে সেটা কেন কর্নেলের কাছে খুব ভালো হয়। এইতে একটু অবাক হয়েছিলাম। উনি কি এমন হুমকির জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন?
প্রশ্নটা বার দুই তুলে কোনও জবাব পাইনি। তবে আমার কপাল গুণে বৃষ্টিটা সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ থেমে গিয়েছিল। রাত নটায় জানালায় উঁকি মেরে দেখেছিলাম রাস্তায় জল প্রায় নেমে গেছে। তাই কর্নেলকে তাগিদ দিয়ে সকাল-সকাল ডিনার খেয়ে সল্টলেকে ফিরে গিয়েছিলাম।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে কখনও রাত কাটাইনি এমন নয়। কিন্তু সমস্যা হল, সঙ্গে রাতের পোশাক না থাকলে ওই বিশালদেহী মানুষের রাতের পোশাক পরে শুতে হয়। সেটা আমার পক্ষে অস্বস্তিকর। তার পোশাকে আমার মতো আড়াইখানা লোক ঢুকে যেতে পারে। তা ছাড়াও ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা আমার অভ্যাস। এদিকে ষষ্ঠীচরণ সাতটা বাজলেই আমাকে বেড-টি খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সকালে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল! তখন সাড়ে সাতটা বাজে। বিরক্ত হয়ে টেলিফোন তুলে অভ্যাস মতো বললাম, রং নাম্বার!
রাইট নাম্বার ডার্লিং!
হেসে ফেললাম। প্লিজ কর্নেল! এই ডার্লিং বলাটা আপনি ছাড়ুন তো! লোকেরা এই নিয়ে
ডার্লিং! পুরনো বাংলা প্রবাদ আছে, কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। তোমার–মানে সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরির পৌষ মাসের খবর আছে।
কিন্তু সর্বনাশটা কার হল?
মোহনপুর রাজমন্দিরের সেবাইতমশাইয়ের।
তার মানে?
আজ ভোরে রাজমন্দিরের দরজার সামনে তার ডেডবডি পাওয়া গেছে। শিগগির চলে এস।বলেই কর্নেল মত বদলালেন। নাহ। আমাদের দমদম এরিয়ায় যেতে হবে। কাজেই তুমি বরং তৈরি হয়ে থাকো। আমি ট্যাক্সি করে তোমার কাছে যাচ্ছি। তারপর তোমাকে নিয়ে বেরুব।
কর্নেলের ফোনের লাইন কেটে গেল। কিন্তু তখনও আমি ফোন ধরে বসে আছি। এ তো ভারি অদ্ভুত ঘটনা! ভট্টাচার্যৰ্মশাইকে কাল বিকেলে বৃষ্টির সময় জলজ্যান্ত দেখেছি। আর উনি এখন ডেডবডি হয়ে গেলেন! সোনার বিষ্ণুমূর্তি হাতিয়েও চোর ওঁকে প্রাণে মারল কেন? উনি কর্নেলের কাছে এসেছিলেন, শুধু। এটাই কি তাকে হত্যার কারণ হতে পারে?
নাহ্। এক রহস্যভেদীর সঙ্গদোষে আমিও দেখছি রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। আমার দরকার একটা জমকালো প্রতিবেদন, আজকাল সংবাদপত্রে পরিভাষার যাকে বলে ইনভেস্টিগেটিভ স্টোরি।
বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গেলাম। তারপর ব্যাপারটা মাথা থেকে মুছে ফেললাম।
কর্নেল এলেন প্রায় সাড়ে আটটায়। বললেন, ই এম বাইপাসে দুর্ঘটনা লেগেই আছে। দুবার ট্যাক্সি বদল করতে হয়েছে। তুমি তৈরি তো?
তৈরি হয়েই ছিলাম। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, নরহরি ভট্টাচার্যের মার্ডার হওয়ার খবর কি আপনি পুলিসসূত্রে পেয়েছেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, না। ছন্দা রায়চৌধুরী আমাকে সাতটা নাগাদ ফোনে জানিয়েছেন।
তিনি আপনার ফোন নাম্বার কী ভাবে জানলেন?
গত রাতে ভটচাযমশাই ওঁকে আমার কাছে আসার কথা বলেছিলেন। আমার ঠিকানা-ফোন নাম্বারও তাকে দিয়েছিলেন। ভটচাযমশাই কাল তোমাদের পত্রিকা অফিস থেকেই আমার ঠিকানা যোগাড় করেন, তা তুমি শুনেছ।
কিন্তু ফোন নাম্বার?
কর্নেল হাসলেন। আমি নিজে চোখে দেখে এসেছি, তোমাদের নিউজ ব্যুরোর চিফ অমরেশবাবুর টেবিলে কাচের তলায় আমার নেমকার্ড রাখা আছে। কাজেই ফোন নাম্বারের ব্যাপারে কোনও রহস্য নেই।
ছন্দা আপনাকে ডিটেলস কিছু কি জানিয়েছেন?
এখন কোনও কথা নয়। গাড়ি ড্রাইভ করার সময় তুমি কথা বললে আমার ভয় হয়। বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। ই এম বাইপাস আর এই ভি আই রোড, দুটো রাস্তায় বিপজ্জনক। নাহ। আস্তে চলল। অত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।
গাড়ির গতি কমিয়ে বললাম, দমদম এলাকা আমার কাছে গোলকধাঁধা মনে হয়। আপনি মোহনপুর প্যালেসে কীভাবে পৌঁছুতে হবে জেনে নিয়েছেন তো?
ডার্লিং! মোহনপুর প্যালেসে আমি বছর পনের আগে বহুবার গেছি। কুমারবাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ আমার সুপরিচিত এবং বন্ধুস্থানীয় মানুষ। উনি আমার মতোই প্রকৃতিপ্রেমী।
বলেন কী!
হ্যাঁ। বিহারের মোহনপুরে ওঁর ঠাকুর্দার জমিদারি মহল ছিল। সেই বাড়িতেও একবার গিয়েছিলাম।
কিন্তু ভটচাযমশাইকে তো কাল আপনি এসব কথা কিছুই বললেন না?
নাহ। গাড়ি চালানোর সময় কথা নয়। আর শোনো। আমার মনে হচ্ছে, এই ধরনের রাস্তায় গাড়ি আস্তে চালানোই বিপজ্জনক। তোমার খুশিমতো ড্রাইভ করো!
আমার এই বৃদ্ধ বন্ধুর এ ধরনের খেয়ালের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। এই রকম মানুষকেই সম্ভবত আনপ্রেডিক্টেব ম্যান বলা হয়। ওঁর নির্দেশমতো গোলকধাঁধার ভেতর ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে যখন মোহনপুর প্যালেসে পৌঁছুলাম, তখন খুবই হতাশ হয়ে গেলাম। একটা এঁদো পুকুরের ধারে জরাজীর্ণ দোতলা বাড়ি। অবিশ্যি একটা ফটক আছে। ফটকে আটকানো মার্বেল ফলকটা পড়া যায় না। ফটক হাট করে খোলা। ভেতরটা জঙ্গল হয়ে আছে। সংকীর্ণ রাস্তায় কোন আমলে পাথরের ইট বসানো হয়েছিল। এখন খানাখন্দে হতশ্রী হয়ে গেছে। বাউন্ডারি ওয়াল মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাবধানে এগিয়ে পোর্টিকোর তলায় গাড়ি দাঁড় করালাম। পোর্টিকোর যা অবস্থা, ভয় হচ্ছিল যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়বে যেন। সামনে একটা অ্যাজবেস্টস চাপানো চালাঘরে একটা কালো অ্যামবাসাডার গাড়ি দেখে বুঝলাম, ওই গাড়ি চালিয়েই কাল বিকেলে ভটচাৰ্মশাই কর্নেলের বাড়ি গিয়েছিলেন। এবং ওটাই গাড়িটার গ্যারাজ ঘর।
সিঁড়ির মাথায় একটুকরো বারান্দা। সেখানে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়েছিলেন। পরনে ছাইরঙা সাধারণ তাঁতের শাড়ি। মহিলাদের বয়স আঁচ করার সাধ্য আমার নেই। তবে মনে হল, এঁর বয়স তিরিশের কাছাকাছি। মুখে তীক্ষ্ণ লাবণ্য এবং ব্যক্তিত্ব আছে। আমরা নামলে তিনি নমস্কার করে মৃদুস্বরে কর্নেলকে বললেন, আপনার অনেক গল্প আমি শ্বশুর মশাইয়ের কাছে শুনেছি। আপনাকে দেখে সাহস পেলাম। আসুন!
কর্নেল বললেন, পুলিশ কি বডি নিয়ে চলে গেছে?
একঘন্টা আগে। পুলিসের মতে ব্যক্তিগত শত্রুতা! কারণ ভটচাঙ্কাকুর সঙ্গে নাকি পাড়ার লোকেদের সদ্ভাব ছিল না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তবে কিছু লোক খানিকটা জমি জবরদখল করতে চেয়েছিল। উনি বিরোধী পক্ষের কিছু লোক নিয়ে তাদের বাধা দিয়েছিলেন।
কোনও ভিড় দেখলাম না কোথাও। কর্নেল সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বললেন। একটা খুনোখুনি হলে আজকাল লোকেরা জটলা করে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, যেন কিছুই ঘটেনি।
ছন্দা বললেন, গেটের কাছে জটলা হচ্ছিল। পুলিস বডি নিয়ে যাওয়ার পর জটলা ভেঙে গেল। আসলে খুনোখুনি আজকাল লোকের যেন গা সওয়া হয়ে গেছে।
হলঘরে সেকেলে কিছু আসবাব আর দেয়ালে পেন্টিং সাজানো আছে। সবই বিবর্ণ এবং জীর্ণ। হলঘরের একধারে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। কর্নেল বললেন, ভটচাযমশাইয়ের ফ্যামিলি কোথায় থাকে?
ওঁর কোনও ফ্যামিলি ছিল না। বিয়ে করেননি। আমাদের ফ্যামিলির মানুষ হিসেবেই ছিলেন। বাজার করা, রান্নাবান্না সবই উনি করতেন। আমাকে সংসারের কোনও কাজে হাত লাগাতে দিতেন না। তাই–ছন্দা অশ্রু সম্বরণ করে বললেন, কাজের লোক রাখতে দেননি। এমন কি আমার মেয়ে টিনিকেও উনি রোজ গাড়িতে করে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। আবার স্কুল থেকে নিয়েও আসতেন।
আমি আসছি এ কথা কি আপনার শ্বশুরমশাইকে বলেছেন?
সিঁড়িতে ছন্দা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, উনি অসুস্থ মানুষ। ওঁকে কিছু বলিনি এখনও। পুলিসকেও ওঁকে ডিসটার্ব করতে নিষেধ করেছিলাম।
উনি কি এখনও জানেন না ভটচাযমশাই খুন হয়েছেন?
ছন্দা আস্তে বললেন, না, ওঁর সারারাত ঘুম হয় না। শেষ রাতে ঘুমোন। বেলা এগারোটার আগে ঘুম ভাঙে না। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। ওঁকে খাওয়ানো যায়নি। কোনও ওষুধই উনি খান না। আসলে শ্বশুরমশাই খুব আত্মবিশ্বাসী মানুষ। উনি বলেন, ওঁর অসুখ মনের জোরেই সেরে যাবে।
কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, তা হলে কুমার বাহাদুর ঘুম থেকে না। জাগা অব্দি আমরা ওপরে যাচ্ছি না। বরং ততক্ষণ আমাদের মন্দিরে নিয়ে চলুন।
আগে অন্তত এক কাপ কফি
ধন্যবাদ। পরে হবে। আগে ঘটনাস্থল দেখা দরকার।
সিঁড়ি থেকে নেমে ছন্দা হলঘরের অন্যদিকে একটা দরজার তালা খুললেন। বললেন, এই দরজার ডুপ্লিকেট চাবি ভটচার্য কাকুর কাছে থাকত। উনি খুব ভোরে স্নান করে এই দরজা খুলে মন্দিরে পুজো করতে যেতেন।
একটা সংকীর্ণ করিডরের পর আবার একটা সিঁড়ি এবং নীচে একটুকরো উঠোনের প্রান্তে ছোট্ট একটা মন্দির দেখতে পেলাম। উঠোন ঘেরা উঁচু পাঁচিলটার অবস্থাও জরাজীর্ণ। মন্দিরের পাশে একটা দরজা দেখিয়ে ছন্দা বললেন, ওদিকে একটা পুকুর আছে। তবে বহুবছর ওই দরজাটা আমরা খুলি না। এই দেখুন! এখানে ভটচার্য্য কাকুর ডেডবডি পড়ে ছিল।
মন্দিরের সামনে একটুকরো খোলা বারান্দা। পুরোটাই মার্বেল পাথরে বাঁধানেনা। বারান্দার ওঠার জন্য মাত্র একটা ধাপ আছে। সেটা অবশ্য সিমেন্টের। কর্নেল বারান্দায় নীচে গিয়ে বললেন, বারান্দা কি ধোয়া হয়েছে?
পুলিস ধুয়ে দিতে বলে গেল। একটুখানি রক্ত ছিল। তাই ধুয়ে দিয়েছি।
বডি তো আপনিই দেখতে পেয়েছিলেন?
হ্যাঁ। তখন প্রায় ছটা বাজে। এখানে প্রচণ্ড মশা। তাই মশারি খাটাতে হয়। তার ওপর শেষ রাত থেকে লোডশেডিং ছিল। মশারি থেকে বেরিয়েছে, তখন কারেন্ট এল। তারপর জানালা দিয়ে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ভটচার্য কাকু উপুড় হয়ে মন্দিরের দরজার সামনে পড়ে আছেন। প্রথমে বুঝতে পারিনি কী হয়েছে। তক্ষুনি এখানে চলে এলাম। এসে দেখি, মাথার পেছনে চাপ-চাপ রক্ত। তখনও ওঁর পা দুটো নড়ছিল। তাই ওঁকে ধরে চিত করতে গেলাম। উনি অতিকষ্টে শুধু বললেন, বীরু! তারপর ওঁর শরীর স্থির হয়ে গেল।
কী বললেন? বীরু–
হ্যাঁ। বীরু। কিন্তু বীরু—
বলুন!
ছন্দা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার স্বামীর এক কলিগ ছিলেন। তাঁর নাম বীরেশ্বর সেন। আমার স্বামীর সঙ্গে এ বাড়িতে তিনি আসতেন। তাকে ও বীরু বলে ডাকত।
ছন্দা হঠাৎ চুপ করলে কর্নেল বললেন, আপনি বীরু কথাটা শুনেছিলেন তা হলে?
হ্যাঁ। কিন্তু বীরুবাবু তো আমেরিকায় থাকেন। মাস তিনেক আগে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ তিনি জানতেন না। জানার পর চিঠিটা লিখে পাঠিয়েছেন।
চিঠিটা আছে আপনার কাছে?
খুঁজে দেখতে হবে।
কর্নেল মন্দিরের বারান্দায় ওঠার ধাপের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ভটচাযমশাই বলছিলেন, মন্দিরের দরজা লোহার। ঠিক তা-ই দেখছি। আর লকটা–ভারি অদ্ভুত লক তো!
ছন্দা বললেন, হ্যাঁ। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। ওটা কীভাবে খোলা যায় তা জানতেন ভটচাকাকু, আর জানেন আমার শ্বশুরমশাই।
কর্নেল পকেট থেকে একটা নোট বই বের করে গোলাকার অদ্ভুত তালাটা আঁকতে ব্যস্ত হলেন।
লক্ষ্য করলাম, তালাটার মধ্যিখানে রোমান হরফে টি লেখা ছোট্ট বৃত্তটা একটা ন এবং সেই নক্টা উঁচু হয়ে আছে। তা ছাড়া তালাটা বসানো আছে লোহার দুটো কপাটের ঠিক মাঝখানে। দরজার আয়তন প্রায় ৬ ফুট লম্বা এবং প্রায় ৪ ফুট। চওড়া। তালাটা দরজা খুললে দু ভাগ হয়ে যায়।
লক্ষ্য করলাম, তালাটার মধ্যিখানে রোমান হরফে টি লেখা ছোট্ট বৃত্তটা একটা ন এবং সেই নক্টা উঁচু হয়ে আছে। তা ছাড়া তালাটা বসানো আছে লোহার দুটো কপাটের ঠিক মাঝখানে। দরজার আয়তন প্রায় ৬ ফুট লম্বা এবং প্রায় ৪ ফুট চওড়া। তালাটা দরজা খুললে দু ভাগ হয়ে যায়।
কর্নেল জুতো খুলে বারান্দায় উঠলেন। তারপর আতস কাচ বের করে কপাট পরীক্ষায় মন দিলেন। ছন্দা বললেন, মন্দিরের দরজাটা লোহার বলা হয় বটে, কিন্তু আমার ধারণা ওটা ইস্পাতের। কারণ ওতে কোথাও মরচে ধরতে দেখিনি।
কর্নেল নবটা কয়েকবার ঘুরিয়ে দেখে বললেন, সম্ভবত এতে কোনও সূক্ষ্ম ব্যালান্সের ব্যাপার আছে। নবটা খুবই মসৃণ। লেটারগুলো এক জায়গায় স্থির দেখাচ্ছে। কিন্তু নব ঘোরালেই ওগুলো যেন পিছলে যাচ্ছে একটার পর একটা। অসাধারণ কারিগরি কৌশলে এটা তৈরি করা হয়েছিল।
কর্নেল নেমে এসে জুতো পরলেন। তারপর হঠাৎ বারান্দার ধাপের নীচে বাঁদিকে ঝুঁকে পড়লেন। আঙুল দিয়ে কী একটা পরীক্ষা করে দেখে বললেন, আপনি কি কোনও ওয়াশিং পাউডার দিয়ে বারান্দা ধুয়েছেন?
ছন্দা বললেন, না তো! এমনি দু বালতি জল ছিটিয়ে ধুয়েছি।
হু। বডি কী অবস্থায় ছিল বলুন?
ছন্দা আঙুল দিয়ে দেখালেন। দরজার কাছে মাথা আর শরীরের বাকি অংশ লম্বালম্বি পড়ে ছিল। পা দুটো ছিল এই ধাপের ওপর।
কর্নেল নিজের আঙুল দেখতে দেখতে বললেন, একটু জল চাই।
ওই ট্যাপের জলে হাত ধুয়ে নিন। কিছু নোংরা লেগেছে কি? এখানে নোংরা। কিছু থাকার কথা নয়। রোজ ভটচাকাকু দুবেলা মন্দির আর উঠোন পরিষ্কার করতেন।
কর্নেল উঠোনের কোণে কয়েকটা ফুলগাছের পাশে একটা ট্যাপ খুলে রগড়ে হাত ধুলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, খুনি খুব ধূর্ত। বারান্দার ওই ধাপে গ্লিসারিন জাতীয় কোনও আঠালো পিচ্ছিল লিকুইড জিনিস ছড়িয়ে রেখেছিল।
ছন্দা চমকে উঠলেন।সে কী! কেন?
ভটচাযমশাই খালি পায়ে মন্দিরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাবেন। তখন তার মাথার পেছনে মোক্ষম আঘাতের সুযোগ পাওয়া যাবে। তিনি দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে কাজটা তত সহজ হত না, যতটা সহজ হয়েছে উনি পড়ে যাওয়ার ফলে। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। চলুন! এবার চা বা কফি কিছু খাওয়া যাক। আমি অবিশ্যি কফিরই ভক্ত।
ছন্দা করিডরে ঢুকে বললেন, শ্বশুরমশাইয়ের কাছে শুনেছি আপনি কফির ভক্ত। কিন্তু আমার অনুরোধ কর্নেলসায়েব! আমাকে আপনি তুমি বলে ডাকবেন।
ঠিক আছে। তো ছন্দা, তুমি কি কাল রাতে ভটচাযমশাইকে বলেছিলে যে আমি কুমার বাহাদুরের পরিচিত?
বলেছিলাম। শুনে উনি খুব অবাক হয়েছিলেন। ছন্দা হলঘরের সেই দরজায় তালা এঁটে দিয়ে এগিয়ে গেলেন। দোতলার বারান্দায় উঠে একটা ঘরের দরজা। দেখিয়ে আস্তে বললেন, এই ঘরে শ্বশুরমশাই থাকেন। পাশের ঘরে আমি আর, টিনি থাকি। আমার ঘর থেকে ওঁর ঘরে ঢোকা যায়।
ভটচাযমশাই কোন ঘরে থাকতেন?
ওই যে দেখছেন! শেষ দিকের ঘরে।
ছন্দা একটা ঘরের সামনে গিয়ে ডাকলেন, টিনি! টিনি!
কর্নেল বারান্দার রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে চারপাশটা দেখছিলেন। একটু হেসে বললেন, আপনার মেয়ে নীচে স্কিপিং করছে।
ছন্দা দেখে নিয়ে বললেন, দেখছ কাণ্ড? কখন হলঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। দরজা ভেজিয়ে রেখেছে বলে টের পাইনি। আপনারা ভেতরে এসে বসুন। কর্নেল বললেন, বাহ্! টিনি স্কিপিং করতে করতে মজার ছড়া বলছে তো।
ছড়াটা শুনতে পেলাম–
নীচে নামো বাঁয়ে ঘোরো।
তবেই তোমার পোয়া বারো।…
.
বিষ্ণুমূর্তি এবং দুই বাহাদুর
আমাদের বসিয়ে রেখে ছন্দা চলে গিয়েছিলেন। এই ঘরটা কিছুটা সাজানো গোছানো। দেয়ালে টাঙানো একটা ছবিতে ছন্দা এবং মৃগেন্দ্রকে দেখতে পেলাম। সম্ভবত বিয়ের পর তোলা ছবি। একটা জানালার পাশে টিনির লেখাপড়ার টেবিল এবং বইখাতা সাজানো। টেবিলে মৃগেন্দ্রের একটা বাঁধানো ছবি রাখা আছে। মৃগেন্দ্র সুদর্শন ছিলেন বলে মনে হল। অবশ্যি রাজবংশধরদের চেহারায় একটা উদ্ধত ধরনের লাবণ্য থাকে দেখেছি। কিংবা এটা আমার মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের চোখের ভুল!
কর্নেল মন্দিরের দিকের জানালায় গিয়ে বাইনোকুলারে কী দেখেছিলেন। একটু পরে সেখান থেকে সরে এসে চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন, মন্দিরের পেছনে পুকুরটা একসময় জলা ছিল। অনেকখানি ভরাট করে বাড়ি উঠেছে। বাকিটাও ভরাট করা হচ্ছে।
বললাম, মন্দিরের ওখানে পুকুরঘাটে নামার দরজা দেখে এলাম। কেউ ওদিক থেকে পাঁচিল ডিঙিয়ে এসে ফুলগাছের আড়ালে ওত পেতেছিল হয় তো। তারপর যেই ভট্টচামশাই আছাড় খেয়ে পড়ে গেছেন, অমনি সে
জল্পনা করে লাভ নেই জয়ন্ত! কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন। তবে হ্যাঁ। ছন্দা বলছিল ওই দরজাটা নাকি বহু বছর ভোলা হয়নি। তা ঠিক নয়। দরজায় সামনে আগাছার জঙ্গলটা লক্ষ্য করেছি। কিছু কিছু ঝোপ বেঁকে আছে। সেটা অবিশ্যি নানা কারণেই হতে পারে।
কর্নেল! আমি একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কাল ভটচাযমশাই প্রথমে আপনাকে বলছিলেন ওঁর খটকা লেগেছে। পরে বললেন, আসল মূর্তিটা উদ্ধার করে দিতে হবে। তার মানে উনি বুঝতে পেরেছিলেন এই বিষ্ণুমূর্তি নকল!
কর্নেল হাসলেন, ওঁর খটকাতে আমারও খটকা লেগেছিল। যাই হোক, এখন ওসব কথা থাক্।
ছন্দা পাশের ঘরের দরজার পর্দা তুলে ট্রেতে দু পেয়ালা কফি আর এক প্লেট পটাটো চিপস্ নিয়ে এলেন। আস্তে বললেন, শ্বশুরমশাই আজ সওয়া দশটাতেই জেগে গেছেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, কারা এসেছে? আমি ওঁকে বললাম, দুজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। একটু পরে ওঁদের নিয়ে আসছি। আপনারা কফি খান। আমি গেট বন্ধ করতে ভুলে গেছি। এখনই খাটালের গোরু-মোষ এসে ঢুকে পড়বে।
ছন্দা ব্যস্তভাবে চলে গেলেন। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, আমার মনে পড়ছে, কুমারবাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ বলতেন, এই বাড়িটা বেচে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবেন। শুধু ওঁদের গৃহদেবতার জন্য তার পারছেন না। গৃহদেবতাকে স্থানচ্যুত করা নাকি পাপ।
আপনি তো সব কিছুতেই নাক গলান! হাসতে হাসতে বললাম। এই অদ্ভুত মন্দিরের ব্যাপারটা আপনার অজানা থেকে গেছে। আশ্চর্য!
কর্নেল একটু পরে বললেন, সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে আমি ক্যাক্টাস্ নিয়েই আলোচনা করতে আসতাম। উনি একজন ক্যাক্টাস্ বিশেষজ্ঞ। এই মন্দির সম্পর্কে উনি বিশেষ কিছু বলেননি। তাই আমারও কৌতূহল জাগেনি। তাছাড়া সব অভিজাত বা বনেদি পরিবারেরই ঠাকুরবাড়ি থাকে। কাজেই তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ ছিল না।
কিছুক্ষণ পরে ছন্দা ফিরে এলেন। বললেন, এতদিন ভটচাকাকুই শ্বশুরমশাইকে বাথরুমে নিয়ে যেতেন। দেখতে রোগা মানুষ হলেও ওঁর হাতে জোর ছিল। দুহাতে শ্বশুরমশাইকে বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে তুলতে পারতেন। এমন সমস্যায় পড়া গেছে। টিনিকে দিয়ে জংবাহাদুরকে আবার ডাকতে পাঠালাম। মনে ক্ষোভ আছে। তাই আসছে না। আপনারা প্লিজ আর একটু অপেক্ষা করুন।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি বীরেশ্বরবাবুর চিঠিটা কি খুঁজে দেখেছ?
ওঃ! একেবারে ভুলে গেছি। আমার মাথার ঠিক নেই দেখছি।
দেখ। ততক্ষণ আমরা নীচে ঘুরে আসি। আর যদি আপত্তি না থাকে, হলঘর থেকে মন্দিরে ঢোকার চাবিটা দাও। আমি আরেকবার মন্দিরটা দেখতে চাই।
ছন্দা বলল, ওই দরজা ছাড়াও মন্দিরে যাওয়ার একটা পথ আছে। আসুন দেখাচ্ছি।
সে আমাদের বারান্দায় নিয়ে গেল। তারপর শেষ একটা লোহার ঘোরালো সিঁড়ি দেখাল। সিঁড়ির মরচে ধরা। ধাপগুলো কোনওক্রমে টিকে আছে। সে বলল, ভেঙে পড়বে না! তবে সাবধানে একে-একে নামতে হবে। আমি অনেক সময় শর্ট কাটে এদিক থেকেও ঠাকুরবাড়িতে যাই। টিনি তো রোজ যখন-তখন নেমে যায়। অবিশ্যি ওর ওজন আর একজন বয়স্ক মানুষের ওজন
কর্নেল হাসলেন। আমার ওজন সহ্য করবে কি না পরীক্ষা করা যাক।
আমার ভয় করছিল। কিন্তু কর্নেলের সামরিক জীবনের ট্রেনিং আবার কাজে লাগল। দিব্যি নেমে গেলেন। আমি একসময় কর্নেলের তাগিদে কিছুদিন মাউন্টেনিয়ারিঙে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। অনেক কসরত করে নেমে গেলাম। মন্দির প্রাঙ্গণের এক কোণে একটা ঝাপালো ছাতিম গাছ আছে। তাছাড়া সিঁড়িটা বাড়ির পশ্চিমদিকে এবং মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে কয়েক হাত দূরে বলে তখন চোখে পড়েনি।
এবার মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতে একটু দুর্ভোগ সইতে হল। ফুলগাছগুলো ঠেলে সরিয়ে গুঁড়ি মেরে ঢুকতে হল। বললাম, কর্নেল! খুনী এখানেও লুকিয়ে থাকতে পারত। তাই না?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, পারত। তবে তা হলে তাকে বাড়ির দোতলায় উঠতে হত।
কথাটা বলে উনি পুকুরঘাটের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজার সামনেটা আগাছার জঙ্গলে ঢেকে আছে সে-কথা আগেই বলেছি। কর্নেল সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছিলেন। হঠাৎ বললেন, আশ্চর্য তো!
কী আশ্চর্য?
কিছু ঝোপ বেঁকে গেছে। ওই ঝোপটার ডাল ভেঙে গেছে। টাটকা ভাঙা। অথচ
উত্তেজিতভাবে বললাম, খুনী ঝোপটার ওখানেই ওত পেতে ছিল।
থাকতে পারে। কিন্তু দরজাটা–আশ্চর্য! দরজার হুড়কো ঠিকভাবে বসানো নেই। কেউ নিশ্চয় খুলেছিল। কিন্তু এত শিগগির কপাটের ওপর মাকড়সা জাল বুনে ফেলল?
পোকামাকড় বিষয়ে তো আপনি বিশেষজ্ঞ। বিদেশি পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। আমি একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম, মাকড়সার জাল লম্বা করলে নাকি পাঁচশো মাইল হয়। এই জালটা লম্বা করে দেখবেন নাকি?
কর্নেল আমার রসিকতায় কান দিলেন না। ঝোপঝাড় ঠেলে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। তারপর সরে এসে বললেন, রাতে এই এলাকায় বৃষ্টি হয়েছিল। মাকড়সা জাল বুনেছে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু বৃষ্টির আগে কেউ ওই দরজাটা খুলেছিল। কেন খুলেছিল বোঝা যাচ্ছে না।
বললাম, কর্নেল! এ সবের চেয়ে বড় প্রশ্ন–আপনাকেই কোর্ট করে বলছি, এই খুনের মোটিভ। আপনিই বলেন, মোটিভ খুঁজে পেলেই খুনীকে খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, তোমার কী ধারণা বলো শুনি?
ভটচাযমশাই আপনার বাড়ি থেকে আসার পর হয় তো কে মূর্তিচোর তা জানতে পেরেছিলেন। তাই খুনী তার মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে।
জানতে পারলে ছন্দাকে তিনি নিশ্চয় বলতেন। তাছাড়া তিনি তখনই টেলিফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ছন্দাও যোগাযোগ করতে পারত।
ছন্দাকে আমার সন্দেহ হচ্ছে।
কেন?
বীরেশ্বর সেন নামে ওঁর স্বামীর এক কলিগ ওঁকে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটা উনি যেন আপনাকে দেখাতে অনিচ্ছুক। ভদ্রলোকের সঙ্গে ছন্দার–
কর্নেল চাপা গলায় বললেন, শাট আপ!
অবিশ্যি ওঁর মুখে কৌতুক ঝলমল করছিল। প্যান্ট-শার্ট থেকে ঝোপের আবর্জনা পরিষ্কার করে টুপি খুললেন কর্নেল। টুপি থেকে একটা পোকা তুলে ঝোপে ফেলে দিলেন। তারপর বললেন, জয়ন্ত! বীরেশ্বরবাবুর কথা আমরা ছন্দার কাছেই জেনেছি। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল, ভটচাযমশাইয়ের অন্তিম মুহূর্তের কথাটা। বীরু!
এই সময় টিনি ফুলগাছের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। মেয়েটির বয়স সাত-আট বছরের বেশি নয়। সে কর্নেলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বলল, তোমার মুখে সাদা দাড়ি কেন?
কর্নেল সহাস্যে বললেন, তুমি স্কিপিং করতে করতে ছড়া বলো কেন?
দাদু শিখিয়ে দিয়েছেন। বলো না তোমার মুখে সাদা দাড়ি কেন?
ছড়াটা আবার বলো। তা হলে বলব।
টিনি আওড়াল–
নীচে নামো বাঁয়ে ঘোরো।
তবেই তোমার পোয়াবারো।
কর্নেল ওর চিবুকে তর্জনী ছুঁইয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, আমার দাড়ি সাদা কেন, তা যদি তোমাকে বলে দিই, তাহলে তোমার দাদুর দাড়িও সাদা হয়ে যাবে।
দাদুর দাড়িই নেই।
কেন নেই?
দাদুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো না।
তোমার দাদু উঠেছেন?
হ্যাঁ। বাহাদুর এসে দাদুকে ওঠাল।
এই সময় দোতলার একটা জানালা থেকে ছন্দা ডাকলেন, টিনি! এখনও কী করছ? ওঁদের ডাকতে পাঠালাম না তোমাকে? সঙ্গে করে নিয়ে এস। নীচের দরজা খুলে দিয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠো না যেন।
টিনি বলল, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করলে দাদু রাগ করে। তোমরা এদিকে এস।
এবার আমরা সেই করিডর দিয়ে হলঘরে ঢুকলাম। হঠাৎ আমার মনে হল ছন্দা ওই বিপজ্জনক সিঁড়ি দিয়ে তখন আমাদের যেন নামতে বাধ্য করলেন। কেন?
টিনি হলঘরে গিয়েই দৌড়ে ওপরে চলে গেল। কর্নেলের কাছে চুপিচুপি প্রশ্নটা তুললাম। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, তুমি ছন্দা সম্পর্কে ক্রমশ বেশি সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ছ জয়ন্ত!
আপনার মতো লম্বাচওড়া ওয়েটি মানুষের ভারে সিঁড়িটা ভেঙে পড়ার চান্স ছিল কিন্তু!
এবার কর্নেলের মুখে হাসি ফুটল। সেটা অবিশ্যি ঠিক।
অত উঁচু থেকে পড়লে আপনার কী অবস্থা হত বুঝতে পারছেন?
হু। হাড়গোড় ভাঙা দ হয়ে যেতাম।
তাহলে?
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। বললেন, যাই হোক, ছড়াটার একটা মানে যেন বোঝা যাচ্ছে। দোতলা থেকে নীচে নেমে এসে বাঁয়ে ঘুরলেই ঠাকুরবাড়ির দরজা। আর ডাইনে ঘুরলে–হ্যাঁ, ওই ছবিটা। গৃহ-দেবতা বিষ্ণুমূর্তির ছবি। দেখতে পাচ্ছ?
আমরা হলঘরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। দেখলাম, দেয়ালে চওড়া ফ্রেমে বাঁধানো একটা বিষ্ণুমূর্তির ফোটো টাঙানো আছে। এই সময় হলঘরের সিঁড়িতে বেঁটে গোলগোল আর শক্তসমর্থ গড়নের প্রৌঢ় একটা লোককে দেখতে পেলাম। তার পরনে খাকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। সে থমকে দাঁড়িয়ে সেলাম দিয়ে বলল, কর্নিলসাব! আপ?
কর্নেল সহাস্যে বললেন, চিনতে পেরেছ জঙ্গবাহাদুর?
জি হাঁ কর্নিলসাব! আপ এত্তা বরষ বাদ এখানে আসলেন!
হ্যাঁ। প্রায় পনের বছর পরে। তা তুমি কেমন আছো বলো?
ভালো নেহি আছে কর্নিল সাব! আর এখানে আমার নোকরি নেহি আছে।
এসেই সে-খবর পেয়েছি।
জঙ্গবাহাদুর একটু হেসে চাপা গলায় বলল, ঠাকুরমশাই মার্ডার হইয়ে গেল। পুলিস আসল। আমাকে বহুরানি খবর ভেজেছিল। লেকিন আমি আসিনি। ঠাকুরমোশাই আচ্ছা আদমি ছিল না। উহি তো আমাকে নোকরি থেকে বরখাস্ত করিয়েছিল।
এই ঠাকুরমোশাই কতদিন ও বাড়িতে ছিলেন?
তিন বরষ হবে। আগের ঠাকুরমোশাই আচ্ছা আদমি ছিল। জদ্বাহাদুর ঘুরে ওপরটা দেখে নিয়ে বলল, বহুরানি খবর ভেজলেন দুসরাবার। কুমারসাবভি বললেন, ভুল হইয়ে গেছে। তুম্ ফির কাম করো।
হ্যাঁ। তুমি এ বাড়ির পুরনো লোক। তুমি কাজে বহাল হলে কুমারবাহাদুর আর বউরানির সুবিধা হবে।
জঙ্গবাহাদুর মুখে দুঃখের ছাপ ফুটিয়ে বলল, কুমারসাবের এত্তা বেমারি হইয়েছে, আমি জানতাম না কর্নিলসাব!
ওপর থেকে ছন্দা ডাকলেন, বাহাদুর! গল্প পরে হবে। ওঁদের আসতে বলো।
জঙ্গবাহাদুর আবার সেলাম ঠুকে নীচে কোথাও গেল। আমরা দোতলায় গিয়ে দেখি, ছন্দা দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, শ্বশুরমশাইকে আপনার আসার কথা বলেছি। ভেবেছিলাম ভটচাকাকুর দুঃসংবাদটা আপনার মুখ দিয়েই ওঁকে জানাব। কিন্তু জঙ্গবাহাদুর জানিয়ে ফেলল।
কর্নেল বললেন, ওঁর রিঅ্যাকশন কী?
শুনে গুম হয়ে গেলেন। কোনও কথা বললেন না। আপনারা আসুন।
ছন্দা আমাদের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা সেকেলে আসবাবে সাজানো। কয়েকটা আলমারি বইয়ে ভর্তি। সব জানালা বন্ধ। শুধু একটা জানালা খোলা আছে। জানালাটার পাশে একটা প্রকাণ্ড খাট। সেই খাটে কর্নেলের মতোই লম্বাচওড়া একজন বৃদ্ধ কয়েকটা বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। ঘরের ভেতর শুধু ওই উত্তরের জানালা দিয়েই যেটুকু আলো আসছে।
খাটের পাশে দুটো চেয়ার আর একটা গোল টেবিল সাজানো আছে। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালেন। হ্যালো কুমারবাহাদুর!
সত্যেন্দ্রনাথের ডান হাতটা একটু উঠেই পড়ে গেল। বাঁ হাত বাড়িয়ে কর্নেলের হাত চেপে ধরলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, আমার বড় দুঃসময়ে আপনাকে পেয়ে মনে ভরসা এল। আপনাকে কতদিন দেখিনি!
প্রায় পনের বছর।
হবে। বসুন কর্নেলসায়েব!
আলাপ করিয়ে দিই। আমার তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
সত্যেন্দ্রনাথ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বস বাবা! তুমি বলছি–কিছু মনে কোরো না!
আমরা বসলাম। কর্নেল বললেন, আপনার অসুখ শুনে দুঃখিত কুমারবাহাদুর!
আমাকে আর কুমারবাহাদুর বলবেন না প্লিজ! বউমা! কর্নেলসায়েব কিন্তু কফির ভক্ত।
ছন্দা কফি অলরেডি খাইয়েছে। আর কফি খাব না। আপনার এই অসুখ কবে হল?
গত মাসে হঠাৎ বাথরুমে পড়ে গেলাম। তারপর ডান হাত থেকে ডান পা অব্দি নিঃসাড়। সম্ভবত প্যারালেসিস। কিন্তু আপনি তো জানেন, জীবনে আমি ওষুধ খাইনি। আমি আমার পূজ্য দেবতা শ্রীবিষ্ণু আর নিজের ইচ্ছাশক্তিতে বিশ্বাসী। এ অসুখ শিগগির সেরে যাবে। এই তো আজই মনে হচ্ছে, অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছি।
ছন্দা বললেন, আপনারা কথা বলুন। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।
ছন্দা বেরিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল আস্তে বললেন, আপনার গৃহদেবতার মন্দিরে আজ ভোরে একটা মিসহ্যাপ হয়েছে।
সত্যেন্দ্রনাথ নির্বিকার মুখে বললেন, পাপের শাস্তি! নরহরি এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে একটার পর একটা–থাক্ ওসব কথা। আপনার খবর বলুন!
আমার খবর নতুন কিছু নেই। যথাপূর্বং। সেই পাখিপ্রজাতি অর্কিড ক্যাকটাস এবং মাঝে মাঝে রহস্যের গন্ধ পেলেই ছুটে বেড়ানো।
সত্যেন্দ্রনাথ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। নরহরি ব্যাটাচ্ছেলের মৃত্যুরহস্যের গন্ধ পেয়েই যদি এখানে এসে থাকেন, তাহলে আপনাকে অনুরোধ করব, এটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তাছাড়া এতে সত্যি বলতে কী কোনও রহস্যই নেই। পুলিস নরহরির খুনীকে ঠিকই ধরে ফেলবে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কাল বিকেলে নরহরিবাবু আমার কাছে গিয়েছিলেন।
আপনার কাছে? নরহরি গিয়েছিল?
হ্যাঁ। আপনার গৃহদেবতার আসল মূর্তি নাকি চুরি গেছে। আমাকে তা উদ্ধার করে দিতে হবে।
সত্যেন্দ্রনাথ প্রায় গর্জন করলেন, চোর! চোর! নিজেই চুরি করে বেচে দিয়ে সাধু সাজার জন্য আপনার কাছে গিয়েছিল!
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, উনি বলছিলেন, মন্দিরের তালা খোলার কৌশল শুধু উনি এবং আপনি জানেন। আর কেউ জানে না। এখন উনি আর বেঁচে নেই। তাই বিষ্ণুমূর্তি সত্যি চুরি গেছে কি না দেখা দরকার।
সত্যেন্দ্রনাথ ডাকলেন, বউমা!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছন্দা ঘরে ঢুকলেন। খাটের কাছে এসে বললেন, বলুন বাবা!
আজ তুমি ভোরে মন্দিরে প্রণাম করতে যাওনি?
ছন্দা মুখ নিচু করে বললেন, প্রণাম করেছি। তবে মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল। ভটচাঙ্কাকু উপুড় হয়ে পড়েছিলেন। মাথার পেছনে রক্ত। আপনাকে তো সব বললাম একটু আগে।
তা হলে মন্দিরের দরজা খোলা ছিল না?
না।
তুমি বাহাদুরকে ডাকো! আমাকে মন্দিরের দরজায় বসিয়ে রেখে আসবে। সে আমাকে রেখে ফিরে এলে তুমি হলঘরের দরজায় পাহারা দেবে। কেউ তালা খোলার কৌশল যেন না বুঝতে পারে। বুঝেছ?
হ্যাঁ বাবা!
যাও! বাহাদুরকে ডেকে আনো! বলে সত্যেন্দ্রনাথ কর্নেলের দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। সরি কর্নেলসায়েব! আপনার বাইনোকুলার দিয়ে তালা খোলার কৌশল দেখার সুযোগ কিন্তু আপনাকে দিচ্ছি না। আপনারা দুজনে হলঘরে বসে থাকবেন।
ছন্দা তখনই বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে। আমি হলঘরেই বসে থাকব। আমি শুধু জানতে চাই সত্যিই আসল মূর্তি আছে, নাকি নেই।
আপনি কি বলতে চাইছেন চোর আসল মূর্তি হাতিয়ে নকল মূর্তি রেখেছে?
হ্যাঁ। নরহরিবাবু সেই কথাই বলছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ আবার গর্জন করলেন, চোর! চোর! নরহরিই চুরি করেছে, তারপর টাকার বখরা নিয়ে স্যাঙাতদের সঙ্গে ঝামেলা বেঁধেছে। তখন তারা ওকে খুন করেছে। ওঃ! আমাদের পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠা করা গৃহদেবতা।
তিনি মুখ ঘুরিয়ে অশ্রু সম্বরণ করলেন। একটু পরে বাহাদুর এসে ওঁকে দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে ফেলল। অবাক হয়ে গেলাম! বাহাদুরের গায়ে দেখছি অসম্ভব জোর। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। হলঘরে নেমে সত্যেন্দ্রনাথ বললেন, বউমা! বাহাদুর ফিরে আসার পাঁচ মিনিট পরে আবার যেন আমাকে আনতে যায়। ওই পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। =
ছন্দা করিডরের দরজার তালা খুলে দিলেন। বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে ঢুকে গেল। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম, ছন্দাকে বলি, নরহরি ভট্টাচার্য কর্নেলকে মিথ্যা করে বলেছিলেন, উনি নাকি পঁয়ত্রিশ বছর এই মন্দিরের সেবাইত। কেন উনি মিথ্যা বলেছিলেন?
কিন্তু কর্নেল দেয়ালে টাঙানো বিষ্ণুমূর্তির ছবি দেখছেন এবং ছন্দা তার কাছে। গিয়ে চুপিচুপি কী যেন বলছেন। তাই কথাটা বলার সুযোগ পেলাম না।
বাহাদুর ফিরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। বাহাদুর! এবার তোমার কুমারসাহেবকে নিয়ে এস।
সত্যেন্দ্রনাথ বাহাদুরের কোলে চেপে এসে বাঁকা হেসে বললেন, নরহরি শুধু চোর নয়, মিথ্যুক। মূর্তি চুরি যায়নি। আসল মূর্তিই আছে। কর্নেলসায়েব! এবার আসুন! গল্প করা যাক। এই বাজে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। বরং এই মজাটা উপভোগ্য–এক বাহাদুর আর এক বাহাদুরকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই না?…
.
বীরেশ্বর এবং ঝুলির বেড়াল
কুমারবাহাদুরের কাছে বিদায় নিয়ে কর্নেল যখন বেরুলেন, তখন প্রায় সওয়া বারোটা বাজে। ছন্দা আমাদের সঙ্গে হলঘরের দরজা অব্দি এলেন। বললেন, শ্বশুরমশাই বলছেন আসল মূর্তিই আছে। অথচ ভটচাকাকু বলেছিলেন, বিষ্ণুমূর্তি বদলে গেছে। কিছু বুঝতে পারছি না।
কর্নেল বললেন, তুমি তো বিয়ের পর থেকে গৃহদেবতাকে প্রণাম করতে যাও! তুমি কি মূর্তির কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করোনি?
ছন্দা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, অত কিছু লক্ষ্য করিনি। আমি মন্দিরের বারান্দা থেকে প্রণাম করে চলে আসি। কারণ মন্দিরের তালা খোলা এবং বন্ধ করার সময় কারও ওখানে থাকা বারণ। তবে
তবে কী?
কিছুদিন আগে ভটচাকাকু বিষ্ণুমূর্তির রঙ বদল এবং বুকের কাছে রেখা ফুটে ওঠার কথা বলেছিলেন। তাই ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করেছিলাম। মন্দিরের ভেতর ইলেকট্রিক আলো জ্বালানোর নিয়ম নেই। ভোরে এবং সন্ধ্যায় দুবার পুজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো হয়। পরশু আর কাল ভোরে প্রণামের পর বুকের কাছে একটা সূক্ষ্ম রেখা চোখে পড়েছিল। রঙটাও একটু তামাটে দেখাচ্ছিল। অবিশ্যি আমার চোখের ভুলও হতে পারে।
জোর দিয়ে বলতে পারছ না তা হলে?
ছন্দা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললেন, রেখাটা হয়তো দেখেছিলাম।
তোমাদের হলঘরে শ্রীবিষ্ণুর যে ফোটো আছে, তাতে বুকের কাছে কোনও রেখা নেই।
ছন্দা চমকে উঠলেন। তারপর আস্তে বললেন, ভটচাকাকুকে মিথ্যাবাদী ভাবতে পারছি না।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, তুমি বীরেশ্বরবাবুর চিঠিটা খুঁজে পেলে ওঁর ঠিকানাটা ফোনে আমাকে জানিয়ে দিয়ো। আর একটা কথা। তোমার শ্বশুর মশাই বীরেশ্বরবাবুকে চেনেন। তার সুপারিশেই উনি ভটচাযমশাইকে সেবাইত নিযুক্ত করেছিলেন। তুমি জানতে এ কথা?
না তো। ছন্দা অবাক হয়ে গেলেন। টিনির বাবাও আমাকে কিছু বলেনি।
তোমার বিয়ে হয়েছে দশ বছর আগে। তোমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে তা তিনি এখন কোথায় আছেন, এসব কথা উনি বলতে চাইলেন না। তুমি এ বিষয়ে কিছু জানো?
ছন্দা আবার চমকে উঠলেন। তিনি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন।
তার নাম কী?
জয়রাম শর্মা বলেই তাঁকে জানতাম। রাত্রে তিনি মদ খেয়ে মাতলামি করতেন। শ্বশুরমশাই তাকে মারধর করেছিলেন। তারপর তিনি নিখোঁজ হন।
জয়রাম শর্মা তাহলে মন্দিরের তালা খোলার কৌশল জানতেন!
হ্যাঁ। জানতেন। না জানলে পুজো করবেন কী ভাবে?
কিন্তু তিনি নিখোঁজ হলে তোমার শ্বশুরমশাই কি তালার কোনও রদবদল করেছিলেন?
টিনির বাবার কাছে শুনেছি, তালার নাম্বার সিস্টেম বদলাতে জানেন। কাজেই উনি ছাড়া আর কে বদলাবেন?
ঠিক আছে চলি।
কর্নেলকে তাঁর বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ই এম বাইপাসের মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য গাড়ি দাঁড় করাতেই উনি হঠাৎ নেমে গেলেন এবং অবাক হয়ে দেখলাম, একটা খালি ট্যাক্সিও পেয়ে গেলেন। হয়তো তার সাদা দাড়ি দেখেই ট্যাক্সিচালকরা ওঁকে না করতে পারেন না। কিংবা উনি ট্যাক্সিচালকদের বশীভূত করার মন্ত্র-টন্ত্র জানেন। বরাবর এই ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় মনে হয়। অবিশ্যি মোহনপুর প্যালেসে ছোট্ট মেয়ে টিনি কর্নেলের সাদা দাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল!…
সেদিনই সন্ধ্যায় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে কর্নেলের টেলিফোন এল। জয়ন্ত! বাড়ি ফেরার পথে একবার দেখা করে যেও। ডিনার খাওয়া না-খাওয়া তোমার ইচ্ছা। তবে ইউ মে বি ইন্টারেস্টেড়!
উত্তেজিতভাবে বললাম, আবার কি কিছু ঘটেছে?
তেমন কিছু ঘটেনি। ফোনে হুমকি দেওয়াটা নতুন নয়।
তার মানে আজ আবার আপনাকে ফোনে কেউ হুমকি দিয়েছে!
হুমকির চেয়ে মজার কথা, ষষ্ঠী মিসেস অ্যারাথুনের বেড়ালটাকে খুব জব্দ করেছে।
হেসে ফেললাম। ওঃ কর্নেল! বেড়ালের ব্যাপারে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
বেড়ালকে অনেকেই অপছন্দ করে। কারণ এই খুদে চতুষ্পদ প্রাণীটি মাছ-মাংস-দুধের লোভ্র গোপনে হানা দেয়। কাজেই দুধের গ্লাস সাবাড় করতে এসে তা উল্টে গেলে মোহনপুর প্যালেসের একটা বেড়ালও জব্দ হতে পারে।
কর্নেল কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিলেন। পি পি শব্দ শুনতে পেলাম। কর্নেলের হেঁয়ালি করার অভ্যাস আছে। কিন্তু মোহনপুর প্যালেসের বেড়াল জব্দ হওয়াটা হেঁয়ালি হলেও অর্থবহ। চৌরঙ্গি এলাকার একটা হোটেলে ডাকাতির খবরটা লালবাজার পুলিস হেডকোয়ার্টার-সূত্রে টেলিফোনে জেনে নিয়েছিলাম। সেই খবর লেখা শেষ করেই বেরিয়ে পড়লাম। ইলিয়ট রোডে যখন পৌঁছুলাম, তখন প্রায় পৌনে আটটা বাজে।
তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি, ড্রয়িংরুমে যথারীতি চুরুট কামড়ে ধরে টেবিলে ঝুঁকে আছেন এবং একটা কাগজে কী সব লেখালিখি করছেন। আমাকে দেখে মুখ তুলে সহাস্যে বললেন, বেড়াল ইন্টারেস্টিং প্রাণী। তবে আগে কফি খাও। কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে। ষষ্ঠী! কফি নিয়ে আয় শিগগির!
সোফায় বসে বললাম, মোহনপুর প্যালেসে বেড়াল জব্দ হওয়ার ব্যাপারটা আগে বলুন!
বলছি। আগে কফি।
ষষ্ঠী কফি নিয়ে এল। সে একগাল হেসে বলল, আজ পাজি বেড়ালটার লেজ ধরে ফেলেছিলাম দাদাবাবু! কিন্তু হাত ফসকে পালিয়ে গেলে কী হবে? খুব জব্দ হয়েছে। আর ভুলেও উঁকি দিতে আসবে না।
সে বেরিয়ে গেলে কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, মিসেস অ্যারাথুনের বেড়াল আর মোহনপুর প্যালেসের বেড়ালের মধ্যে বুদ্ধির তফাত আছে। ওই বেড়ালটা অবিশ্যি লেজ ধরতে দেয়নি। কিন্তু বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে।
প্লিজ কর্নেল! হেঁয়ালি শোনার মুড নেই।
কর্নেল এবার একটু গম্ভীর হলেন। বিকেলে ছন্দা ফোন করেছিল। তার শ্বশুরমশাই সন্ধ্যার আগে এক গ্লাস দুধ খান। দুধটা সে খাটের পাশে টেবিলে রেখে এসেছিল। একটু পরে গিয়ে সে অবাক হয়ে দেখেছে, দুধের গ্লাস উল্টে মেঝেতে পড়ে আছে এবং তার শ্বশুরমশাই রাগে ফুঁসছেন। কোথা থেকে একটা বেড়াল এসে তার দুধের গ্লাস উল্টে ফেলেছে। তার ডান হাত অকেজো।.বাঁ হাতে খপ করে বেড়ালটা ধরে রাগের চোটে তিনি আছাড় মেরেছেন। আছাড় খেয়েই বেড়ালটা মারা পড়েছে।
আমার উৎসাহ মিইয়ে গেল। বললাম, এটা কী এমন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার! ওঁকে দেখেই তো মনে হচ্ছিল খুব রাগী আর গোঁয়ার মানুষ।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। রাগী আর গোঁয়ার মানুষ তো বটেই। কিন্তু না এইজন্য তোমাকে আসতে বলিনি। ছন্দা বলল, আজ সকালের ফ্লাইটে বীরেশ্বর সেন কলকাতা এসেছেন। তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছেন। ছন্দা তাঁরে নরহরি ভট্টাচার্য খুন হওয়ার কথা জানিয়েছে, আমার কথাও বলেছে, আমার ফোন নাম্বার দিয়েছে। বীরেশ্বরবাবু কিছুক্ষণ আগে আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে আমার কাছে আসছেন।
শোনামাত্র উৎসাহটা ফিরে এল। বললাম, হ্যাঁ। তাহলে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
কর্নেল হাসলেন। তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, মৃগেন্দ্র এবং বীরেশ্বর যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সেটা একটা অকশন কোম্পানি। নানা দেশে এই কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে। প্রাচীন অভিজাত ধনী পরিবারের মূল্যবান জিনিসপত্র বা ধনরত্ন কিনে নিলামে বিক্রি করেন ওঁরা। কুমারবাহাদুরের কাছে এই কোম্পানির নাম আজ তুমিও শুনেছিলে!
শুনেছিলাম মনে পড়ছে। কী যেমন নামটা
জয় ট্রেডার্স। নাম শুনে কিছু বোঝা যায় না। আমি আজ লাঞ্চের পর টেলিফোন গাইড দেখে ওঁদের টেলিফোন করেছিলাম। একটা পার্সোনাল কম্পিউটার কেনার ছল করতে হয়েছিল। তো ওঁরা জানিয়ে ছিলেন এখানে কম্পিউটার বিক্রি হয় না। ওটা একটা নিলামসংস্থা।
তাহলে রহস্য ঘনীভূত বলা চলে!
কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দিলেন। ঘনীভূত তো বটেই! বরফের মতো ঘনীভূত।
তার মানে?
জল জমে ঘন হলে বরফ বলা হয়। বরফে তাপ ওঠে। খুব ভাপ উঠছে।
ওঃ কর্নেল! আপনি রসিকতা করছেন।
কর্নেল কফি শেষ করার পর চুরুট ধরিয়ে বললেন, রসিকতা কী বলছ ডার্লিং! ফোনে আমাকে বুড়ো ঘুঘু বলে গাল দিল কেউ। তারপর বলল, সাবধান! ফাঁদ পাতা আছে। ওই যে কথায় বলে, ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি!
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ। বলুন মিঃ নন্দী!..মর্গের রিপোর্টে তা-ই বলেছে নাকি? ধন্যবাদ।…আঁ! বলেন কী?…তাহলে আপনাদের থিওরি কারেক্ট। হা–সাট্টাডন লোকটার ফোন নাম্বার দিতে অসুবিধে আছে?…এক মিনিট। বলে কর্নেল টেবিলে রাখা প্যাডের পাতা ওল্টালেন। কলম বাগিয়ে ধরলেন। বলুন মিঃ নন্দী!…অসংখ্য ধন্যবাদ। রাখছি।
ফোন রেখে কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। বললেন, তোমার কৌতূহল স্বাভাবিক। দমদম নর্থ রেঞ্জের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সুমন নন্দীকে তোমার অবিশ্যি চেনা উচিত।
নাম শুনেছি
। ওই এলাকার সব সাট্টাবাজের খবর ওঁর নখদর্পণে।
কর্নেলের কথার ওপর বললাম, নরহরি ভটচায সাট্টা খেলতেন নাকি?
কর্নেল জিভ কেটে বললেন, না, না! উনি সাট্টা খেলতেন না। ওই এলাকার এক সাট্টাডন হাজারিলাল আজ কথাপ্রসঙ্গে মিঃ নন্দীকে জানিয়েছে, সে মোহনপুর প্যালেস কেনার জন্য কুমারবাহাদুরের সঙ্গে অনেকদিন ধরে কথাবার্তা চালিয়ে আসছে। কুমারবাহাদুর বিক্রি করতে রাজি। কিন্তু হাজারিলালের কট্টর শত্রু জনৈক দুর্গাপ্রসাদ সিংহের সাহায্যে নাকি নরহরিবাবুই বাগড়া দিচ্ছিলেন। কুমারবাহাদুর এই দুর্গাদাসের কাছে বহু টাকা ধার করেছেন। এখন হাজারিলাল খুব খুশি। নরহরিবাবু মারা পড়েছেন। মোহনপুর প্যালেস গোপনে কিনে ফেলতে আর অসুবিধে নেই। দুর্গাদাসকে আর কে খবর দেবে যে, কুমারবাহাদুর বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন? যখন দুর্গাদাস সে খবর পাবে, তখন কুমারবাহাদুর তার দেনা শোধ করে দেবেন! হাজারিলালের যুক্তিটা হল এই।
পুলিস তাহলে হাজারিলালকে ধরছে না কেন? নরহরিবাবুকে খুন করার মোটিভ তো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কর্নেল হাসলেন। হাজারিলালকে ধরা শক্ত। তার মুরুব্বির জোর আছে, তাছাড়া সে নিজে বা তার লোক দিয়ে নরহরিবাবুকে খুন করেছে, তার প্রমাণ পুলিস পায়নি। শুধু অনুমানের ভিত্তিতে এসব লোককে ধরা যায় না।
মর্গের রিপোর্টের কথা বলছিলেন। ওতে কী বলা হয়েছে?
কোনও ভোঁতা আর শক্ত জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। মাথার পেছন দিকে একটা বিশেষ জায়গায় আঘাত করলে মৃত্যু অনিবার্য।
কর্নেল এবার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। আমি একটা বিদেশী পত্রিকা তুলে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। বীরেশ্বর সেনের প্রতীক্ষা করতে করতে যেন সারা জীবন কেটে যাবে।
বীরেশ্বর এলেন সওয়া আটটায়। বেশ স্বাস্থ্যবান এবং স্মার্ট ঝকমকে চেহারা। পঁয়তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়স। আলাপ-পরিচয়ের পর তিনি একটু গম্ভীর মুখে বললেন, আমি আপনার কাছে এসব ব্যাপারে আসতাম না কর্নেল সরকার! কিন্তু নরহরিকাকু মৃত্যুর সময় নাকি আমার ডাকনাম উচ্চারণ করেছিলেন। এটাই আশ্চর্য লেগেছে। ছন্দার মুখে একথা শোনার পর আমার মনে হল, আপনার সঙ্গে দেখা করা উচিত।
কর্নেল ষষ্ঠীকে ডেকে কফির হুকুম দিয়ে বললেন, আগের ঠাকুরমশাই জয়রাম শর্মা নিখোঁজ হওয়ার পর আপনার সুপারিশেই নাকি নরহরিবাবুকে সেবাইত করা হয়েছিল?
বীরেশ্বর একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, মৃগেন আমার কলিগ এবং বন্ধু ছিল। সে-ই আমাকে একজন বিশ্বস্ত সেবাইত যোগাড় করে দিতে বলেছিল। তো নরহরিবাবু আমার ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে গৃহদেবতার পুজোর জন্য আসতেন। ওঁর এটাই ছিল একমাত্র জীবিকা। অনেক বাড়িতে পুজো করে বেড়াতেন। কাজেই মৃগেনকে আমি ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। মৃগেন ওঁকে তার বাবার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। মৃগেনের বাবাকে আমি জ্যাঠামশাই বলি। উনি খুব বুদ্ধিমান এবং সতর্ক মানুষ। কথাবার্তা বলে সন্তুষ্ট হয়ে তবে উনি নরহরিবাবুকে কাজে বহাল করেছিলেন।
মোহনপুর প্যালেসে রাজমন্দিরে বিষ্ণুমূর্তি নিশ্চয় আপনি দেখেছেন?
ওঁদের নিয়মকানুন বড্ড কড়া। একবার মাত্র দেখেছিলাম। সে-ও সন্ধ্যাবেলায় বাইরে থেকে দেখা। প্রদীপ জ্বলছিল ভেতরে।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া হাত দিয়ে সরিয়ে আস্তে বললেন, ছ ইঞ্চি উঁচু মূর্তিটা নিরেট সোনার। ওজন প্রায় এক কিলোগ্রাম। চোখের তারায় দুটো পদ্মরাগ মণি বসানো আছে।
আমি অতকিছু লক্ষ্য করিনি। আমাদের গৃহদেবতা রাধাবল্লভ। অষ্টধাতুর বিগ্রহ।
মন্দিরের কপাট এবং তালা কি দেখেছেন।?
নাহ্। তবে মনে হয়েছিল, দরজার দুই পাশে কপাট দুটো ঢুকে গেছে। লিফটের দরজার মতো। আমি প্রণাম করেই মৃগেনের সঙ্গে চলে এসেছিলাম।
কোন পথে?
বীরেশ্বর তাকালেন। একটু পরে বললেন, কেন? হলঘর থেকে যে পথে। মন্দিরে যাওয়া যায়!
দোতলার পশ্চিমপ্রান্তে একটা লোহার সিঁড়ি দিয়ে নেমেও মন্দির যাওয়া যায়। ওটা দেখেছেন কি?
সিঁড়িটা দেখেছি। তবে পুরনো মরচে ধরা লোহার সিঁড়ি। আমি জানতাম না ওই সিঁড়ি দিয়ে মন্দিরে যাওয়া যায়। আপনার কাছেই প্রথম শুনছি।
আপনি কি আপনার কোম্পানির কাজেই আমেরিকায় ছিলেন?
হ্যাঁ। আমাকে নিউ ইয়র্ক ব্রাঞ্চে বদলি করা হয়েছিল। আবার কলকাতা হেড অফিসে ফিরে আসার অর্ডার গেল। তাই চলে এলাম।
ষষ্ঠীচরণ কফি আনল। বীরেশ্বর মার্কিনদের মতো শুধু লিকার ঢেলে নিলেন কাপে। কর্নেল বললেন, আপনাদের কোম্পানি জয় ট্রেডার্স নিলামে পুরনো দামী জিনিস বিক্রি করে।
বীরেশ্বরের চোখ দুটো জ্বলে উঠল হঠাৎ। গলার ভেতর বললেন, সো হোয়াট?
কর্নেল আস্তে বললেন, আমি আপনার সহযোগিতা চাই।
বাট হোয়াই আর ইউ-বীরেশ্বর থেমে গেলেন। একটু পরে বললেন, সরি! ইউ মে অ্যাস্ক মি এনি ড্যাম্ কোয়েশ্চেন ইউ লাইক।
অন্তিম মুহূর্তে নরহরিবাবুর বীরু বলার কি কোনও বিশেষ কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন?
বীরেশ্বর মাথা নেড়ে বললেন, মাথায় কিছু ঢুকছে না। আমাকে নরহরিবাবু বীরু বলে ডাকতেন তা ঠিক। কিন্তু কেন উনি মৃত্যুর আগে বীরু বলেছেন, এটা আমারও প্রশ্ন।
কুমারবাহাদুর পক্ষাঘাত রোগে শয্যাশায়ী। তিনি–
ছন্দা ফোনে আমাকে বলেছে। আমি দেখা করতে যাব।
তিনি আজ একটা বেড়ালকে কে আছড়ে মেরে ফেলেছেন।
বীরেশ্বর আবার চোকে গেলেন। হোয়াই আর ইউ প্রেয়িং জোক্স কর্নেল সরকার?
নো জোক মিঃ সেন! এ একটা ঘটনা! কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি নিশ্চয় বাংলা প্রবচনটা জানেন, বেড়ালের নটা প্রাণ। অথচ এক আছাড়েই একটা বেড়াল মরে গেল। তার অপরাধ, সে কুমারবাহাদুরের দুধের গ্লাস উল্টে দিয়েছিল।
আপনি দেখেছেন?
না। ছন্দা টেলিফোনে জানিয়েছে।
ছন্দার একটা বদ অভ্যাস আছে। খুব রঙ চড়িয়ে কথা বলে। আপনি গিয়ে হয়তো দেখবেন ব্যাপারটা অন্যভাবে ঘটেছে।
ছন্দাকে আপনি আমেরিকা থেকে একটা চিঠি লিখেছিলেন!
সো হোয়াট? বীরেশ্বর আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মৃগেনের ক্যান্সারে মৃত্যুর খবর ছন্দা দেয়নি। দৈবাৎ একজনের কাছে জানতে পেরে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লিখেছিলাম।
চিঠিটা ছন্দা খুঁজে পাচ্ছে না।
খুঁজে পাচ্ছে না তো আমি কী করতে পারি বলুন? চিঠিটা গোপনীয় ছিল না।
আচ্ছা মিঃ সেন, দুর্গাপ্রসাদ সিংহকে আপনি নিশ্চয় চেনেন?
বীরেশ্বর কর্নেলের দিকে তাকালেন। একটু পরে বললেন, চিনি না বললে মিথ্যা বলা হবে। মৃগেনের বাবার বন্ধু উনি। বিগ বিজনেসম্যান। ওঁর বাড়ি বিহারের মোহনপুরে। সেখানে মৃগেনের পূর্বপুরুষের জমিদারি এস্টেট ছিল। কাজেই তাকে মৃগেনদের ফ্যামিলিফ্রেন্ড বলা চলে। মৃগেনই ও-বাড়িতে একদিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আপনি কেন এসব প্রশ্ন করছেন জানতে পারি কি?
নরহরিবাবুর হত্যারহস্য ফাঁস করতে চাই আমি। ছন্দার কাছে তো শুনেছেন। এটা আমার একটা হবি।
আমিও চাই খুনী ধরা পড়ুক। নরহরিবাবু সৎ মানুষ ছিলেন। এমনও হতে পারে, অন্তিম মুহূর্তে তিনি আমাকে খবর দিতেই বলেছিলেন। কারণ আমিই তাঁকে সো-কল্ড রাজবাড়িতে কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলাম।
আপনি কি জানেন আগের সেবাইত জয়রাম শর্মা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান?
বীরেশ্বর মুখ নামিয়ে বললেন, পরে মৃগেন ও কথা বলেছিল। আগে জানলে আমি কখনও নরহরিবাবুকে ওদের বাড়িতে সেবাইতের কাজের জন্য সুপারিশ করতাম না। ওই সব তথাকথিত রাজপরিবারে ড্রাকুলার আস্তানা আছে।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, একটা প্রব্লেম হল, নরহরিবাবুর থাকার ঘর সার্চ করে পুলিস আপনার একটা চিঠি পেয়েছে। চিঠিতে আপনি তাকে দুর্গাপ্রসাদ সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন।
বীরেশ্বর চমকে উঠেছিলেন। একটু নার্ভাস হয়ে বললেন, মৃগেনদের বাড়ির একটা অংশ কারা জবরদখল করতে চেয়েছিল। নরহরিবাবু বাধা দেওয়ায় তারা তাকে হুমকি দিয়েছিল। তাই আমি দুর্গাপ্রসাদের সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করতে বলেছিলাম।
চিঠিতে এসব কথা নেই।
নেই মানে–খুব তাড়াহুড়ো করে চিঠিটা লিখেছিলাম।
এনিওয়ে! এতে বোঝা যাচ্ছে আপনাকে নরহরিবাবু চিঠি লিখতেন!
ওই একবার লিখেছিলেন। ছন্দার এটা জানা উচিত।
ছন্দা জানে না।
নিশ্চয় ছন্দা ভুলে গেছে। ওর এই একটা বদ অভ্যাস। আপনাকে অলরেডি তা বলেছি। বীরেশ্বর, ঘড়ি দেখে ফের বললেন, এই তুচ্ছ কারণে পুলিস আমাকে অ্যারেস্ট করে তো করুক। আই হ্যাভ গ্যাক্স টু ফেস এনি ড্যাম সিচুয়েশন। আচ্ছা! আমি উঠছি।
বলে উনি সটান উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সৌজন্যসূচক কোনও বিদায় সম্ভাষণও করলেন না।
বললাম, একটা বেড়াল মারা পড়লেও ঝুলির ভেতর থেকে অনেক বেড়াল বেরিয়ে এল দেখছি!
কর্নেল হাসলেন। আর একটা মজার বেড়াল তোমাকে দেখাই। বীরেশ্বর সেন আজ মর্নিংয়ের ফ্লাইটে আসেননি। এসেছেন গতকাল বিকেলের ফ্লাইটে। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে এ খবর জোগাড় করেছি।…
.
চিচিং ফাঁক এবং বীরু
রাত সাড়ে নটা বাজে। আমি বাড়ি ফেরার জন্য উঠব ভাবছি, কর্নেল বললেন, এবার সাট্টাডন হাজারিলালকে নাড়া দিয়ে দেখা যাক কিছু বেরোয় নাকি।
বলে টেলিফোনের রিসিভার তুলে তিনি ডায়াল করলেন। একটু পরে সাড়া পেয়ে বললেন, নমস্তে হাজারিলালজি! আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।…আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। …আপনার এই প্রাইভেট নাম্বার আমি কুমারবাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর কাছে পেয়েছি। …না, না! আমি রিয়েল এস্টেট বিজনেস করি। তো শুনলাম আপনি কুমারবাহাদুরকে ছ-লাখ টাকায়…তাহলে ভুল শুনেছি। ন লাখই হবে। …না। আপনি শুনুন! দুর্গাপ্রসাদ সিংহের কাছে শুনেছি, মোহনপুর প্যালেস তার কাছে নাকি বন্ধক দেওয়া। আছে…নেই? আপনি ঠিক জানেন?…। বুঝেছি। তো আজ বীরেশ্বর সেন নামে এক ভদ্রলোক…না। বীরেশ্বরবাবু শুধু মন্দিরের অংশটা কিনতে চান। …সে কী! তাহলে ভদ্রলোক আমাকে মিথ্যা করে..কিন্তু ওঁর উদ্দেশ্য কী? …আপনি আসতে চান তো আসুন! কাল সকাল নটা থেকে সাড়ে নটার মধ্যে..হ্যাঁ। ঠিকানা লিখে নিন।
কর্নেলের কথাবার্তা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। একটু আশঙ্কাও জাগল। একজন সাট্টাডনকে বাড়িতে আসতে বলছেন। তার ওপর এইসব মিথ্যা কথাবার্তা।
ঠিকানা বলে টেলিফোন রেখে কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। মুখে মিটিমিটি হাসি।
বললাম, এ এক সাংঘাতিক খেলা কর্নেল। ওই লোকটাই যে আপনাকে ফোনে হুমকি দিচ্ছে না আপনি কি জানেন?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, বীরেশ্বর সেনকে হাজারিলাল চেনে। কিন্তু সে বলল, বীরেশ্বর তার কট্টর শক্ত দুর্গাপ্রসাদের লোক। সে আমাকে বীরেশ্বর সম্পর্কে কিছু গোপন কথা জানাতে চায়। সেকথা টেলিফোনে নাকি বলা যাবে না। মুখোমুখি বলবে।
কিন্তু
নো কিন্তু! তুমি আরও ঝুলির বেড়াল দেখতে চাইলে কাল সকাল নটার আগেই চলে এস!…
উত্তেজনায় সে-রাতে ভাল ঘুম হল না। টেবিল ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। সাড়ে সাতটায় উঠে আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে বেরুলাম। কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেখি, তখনও উনি ছাদে তার বাগানের পরিচর্যা করছেন। বাগানে যত রাজ্যের অদ্ভুত-অদ্ভুত ক্যাকটাস, অর্কিড আর নানা রকম উদ্ভিদ। এককোণে প্রজাপতিদের জন্য ছোট্ট কাঁচঘর। ডিম থেকে তিনটি পর্যায়ে বিবর্তনের পর রঙবেরঙের প্রজাপতি জন্মায়। সে এক বিচিত্র জগৎ।
উঁকি মেরে দেখলাম বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ গার্ডেনিয়ের পোশাক পরে হাঁটু দুমড়ে একটা টাবের কাছে বসে আছেন। টবে একটা অষ্টাবক্র ক্যাক্টাস। এ সময় আমাকে দেখলেই ওঁর জ্ঞান বিতরণ শুরু হয়ে যাবে। তাই নেমে এসে ড্রয়িং রুমে বসলাম। ষষ্ঠীচরণ বলল, দাদাবাবুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেরেকফাস্টো হয়নি।
বললাম, না ষষ্ঠী! আমি বেরেকফাস্টো করেই বেরিয়েছি।
ষষ্ঠী হাসল, ব্রেকফাস্ট! বাবামশাই আমাকে ভেংচি কেটে বেরেকফাস্টো বলেন কিনা! তাই বাবামশাইকে ভেংচি কাটলাম।
বলেই সে দ্রুত পর্দা তুলে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিলেন। সিঁড়িটা এই ড্রয়িং রুমের শেষপ্রান্ত থেকে চিলেকোঠায় উঠে গেছে।
কর্নেল আমার দিকে না তাকিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে পর্দা তুলে ভেতরে গেলেন। মিনিট দশেক পরে সেজেগুজে ঝকঝকে চেহারায় বেরিয়ে এলেন। বললাম, আজ মর্নিং সম্ভাষণ করলেন না যে?
কর্নেল বললেন, তুমি যখন আমার শূন্যোদানে উঁকি দিচ্ছিলে, তখনই করেছি। তুমি শুনতে পাওনি!
আপনি আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে ছিলেন।
আমার পেছনেও চোখ আছে ডার্লিং!
অসম্ভব!
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, আমার কান-দুটোই পেছনের চোখ। তুমি জানো, যৌবনে গেরিলা যুদ্ধের তালিম নেওয়ার সময় আমার কান দুটো খুব প্রখর করতে হয়েছিল। কোনদিকে কী শব্দ হল, তা কিসের শব্দ এবং আমার কাছ থেকে তার দূরত্ব কত, এইসব শিখতে হত। যাইহোক, ষষ্ঠী ঠিকই বলছিল, তোমার বেরেকফাস্টো হয়নি। এখন সাড়ে আটটা বাজে। আমি রোজ নটায় ব্রেকফাস্ট করি। আজ এখনই সেরে নিতে হবে। কারণ নটার পর যে-কোনও সময় হাজারিলালের আবির্ভাব ঘটবে।…
হাজারিলাল এল পৌনে দশটায়। তাকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলাম। সাট্টাডন আজকাল একটা সাংঘাতিক কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের কয়েকজনকে আমার পেশার সুবাদে না দেখেছি এমন নয়। কিন্তু হাজারিলাল একে তো বয়সে তরুণ, তার ওপর রোগা টিঙটিঙে। পরনে যেমন-তেমন প্যান্ট-হাওয়াই শার্ট। মাথার চুলে সামান্য কেতা আছে। গায়ের রঙ কালো। চেহারায় অমায়িক হাবভাব। রাস্তাঘাটে ও ধরনের যুবক সর্বত্র দেখা যায়। ভিড় থেকে এদের আলাদা করে চেনা যায় না।
সে কর্নেলকে নমস্কার করে বিনীতভাবে বসল। কর্নেল আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। কিন্তু সে আমার দিকে মনোযোগ দিল না।
কর্নেল তাকে কফি খেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সে করফেঁড়ে বলল, আমি বাইরে কিছু খাই না।
তার কথায় এতটুকু অবাঙালি টোন নেই। কর্নেল বললেন, বলুন হাজারিলালজি! জয়ন্তের কাছে আমার কিছু লুকোনো থাকে না। তা ছাড়া আপনাকে কথা দিচ্ছি, খবরের কাগজে আপনার কোনও কথা ফাঁস করা হবে না।
হাজারিলাল বলল, দেখুন কর্নেল সরকার। আপনার পরিচয় আমি রাতেই পেয়ে গেছি। সব মহলে আমার চেনা-জানা লোক আছে। অন্য কেউ আমার সঙ্গে এভাবে জোক করলে আমি সহ্য করতাম না। কিন্তু আপনার মতো একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভের দরকার আছে বলেই
কর্নেল জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি ডিটেকটিভ নই। কথাটা আমার পছন্দ নয়। কারণ টিকটিকি কথাটা ডিটেকটিভের স্ল্যাং!
আমাকে আরও অবাক করে হাজারিলাল বলল, বাট আই নিড ইওর হেলপ কর্নেল সরকার!
বলুন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
হাজারিলাল একটু চুপ করে থাকার পর বলল, লোকে আমাকে সাট্টাডন বলে। ঠিক আছে। আমি সাট্টা-জুয়ার কারবারি। এ কারবার খারাপ না ভালো তা নিয়ে আমি ভাবি না। বেঁচে থাকতে হলে টাকা কামাতে হয়। যে যেভাবে পারে টাকা কামায়। তো দুর্গাপ্রসাদও কামায়। বাট ডু ইউ নো হাউ হি আর্নস্ এ লট অব মানি? সে দেশের ঠাকুরদেবতাকে ফরেনে স্মাগল করে। হাজারিলাল দু হাত কপালে রেখে ঠাকুরদেবতার উদ্দেশে প্রণাম করল। এবার বলুন কে বেশি পাপী? আমি, না দুর্গাপ্রসাদ?
বুঝলাম যে খুব ধর্মবিশ্বাসী। কর্নেল বললেন, দুর্গাপ্রসাদ বেশি পাপী।
হাজারিলাল বলল, আমি সাট্টা-জুয়ার কারবারি। প্রফিটের টাকায় আমি সোশ্যাল ওয়ার্ক করি। খেলার ক্লাব, মেডিক্যাল ইউনিট, মন্দির, আশ্রয় সব কিছুতে আমি টাকা দিই। লোকের হাউজিং প্রব্লেম আছে। তার জন্যই মোহনপুর প্যালস কিনে আমি মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং করতে চেয়েছি। একি আমার দোষ?
কখনই না।
তো মোহনপুর প্যালেসের মন্দিরে সোনার দেবতা আছেন। দুর্গাপ্রসাদ অনেক বছর থেকে সেই দেবতাকে চুরি করে ফরেনে স্মার্ করার চেষ্টায় আছে। তার সঙ্গে একটা কোম্পানির কন্ট্যাক্ট আছে।
জয় ট্রেডার্স?
হাজারিলাল তাকাল। দেন ইউ নো ইট!
হ্যাঁ। বীরেশ্বরবাবুর কথা বলুন।
বীরেশ্বর দুর্গাপ্রসাদের কনট্যাক্টম্যান। সে নরহরি ঠাকুরমশাইকে দিয়ে মোহনপুর প্যালেসের মন্দির থেকে দেবতা চুরির ধান্দায় ছিল। সেইজন্য আমি প্যালেসের জমি জবরদখলের জন্য পাড়ার কিছু লোককে লাগিয়েছিলাম। জবরদখল তারা সত্যি সত্যি করত না। ওটা আমার একটা ট্যাটিস। প্রেসার ক্রিয়েট করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ঝামেলা দেখে কুমারবাহাদুর আমাকে প্যালেস বিক্রি করে দেবেন। উনি বিক্রি করতেই তো চান। পারছেন না শুধু দুর্গাপ্রসাদের জন্য। সে তাকে লোভ দেখাচ্ছে, আরও বেশি দাম দিয়ে প্যালেস কেনার লোক সে যোগাড় করে দেবে।
দুর্গাপ্রসাদের কাছে কুমারবাহাদুরের নাকি অনেক টাকা দেনা আছে?
থাকতে পারে। হাজারিলাল এবার চাপা গলায় বলল, দেড় মাস আগে খবর পেলাম, মোহনপুর প্যালেসের দেবতা যে-কোনও দিন চুরি যাবে। তখন বাড়ি কেনার ছল নিয়ে কুমারবাহাদুরকে সাবধান করে দিলাম।
কী সূত্রে আপনি খবর পেলেন?
হাজারিলাল বাঁকা হাসল। তা বলব না। শুধু জেনে রাখুন সব জায়গায় আমার লোক আছে। জয় ট্রেডার্সেও আছে। বীরেশ্বর তখন আমেরিকায় ছিল। স্মার্ল্ড মাল কীভাবে সে সেখানকার কাস্টমস্ ডিপার্টমেন্টের চোখের আড়ালে ডেলিভারি নেবে তার ধান্দায় ছিল। কিন্তু মাল ঠিক সময়ে পৌঁছাল না। কুমারবাহাদুর অ্যালার্ট ছিলেন। তাই নরহরি ঠাকুরমশাই হয়তো দেবতা চুরির সুযোগ পায়নি।
বুঝলাম। কিন্তু ঠাকুরমশাই খুন হয়ে গেলেন!
আমার লোক তার গায়ে হাত দেয়নি। কিন্তু পুলিস আমার লোকদের হ্যারাস করছে।
কিন্তু নরহরি ভট্টাচার্য খুন হলেন কেন?
খুন করেছে দুর্গাপ্রসাদের লোক। প্রথমে আমার সন্দেহ ছিল, ঠাকুরমশাই অ্যাডভান্স কিছু টাকা নিয়েছিল। কিন্তু দেবতা চুরি করে দিতে পারছিল না। সেই জন্য হয়তো রাগে দুর্গাপ্রসাদ তাকে মেরে ফেলেছে। বাট আই নিড ইওর হেল্প।
বলুন।
হাজারিলাল একটু পরে বলল, কাল বিকেলে আমার লোক বীরেশ্বরকে দুর্গাপ্রসাদের বাড়ি ঢুকতে দেখেছে। তাই আমার অন্যরকম সন্দেহ হচ্ছে। দেবতা চুরি করে ঠাকুরমশাই হয়তো দুর্গাপ্রসাদের লোককে দিয়েছিল। আর বাকি টাকা যাতে না দিতে হয়, সেইজন্য ঠাকুরমশাইকে খুন করা হয়েছে। তাছাড়া ঠাকুরমশাইয়ের মুখ বন্ধ করারও দরকার হয়েছিল। এখন আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি, দেবতা সত্যি চুরি হয়েছে কি না ইনভেস্টিগেট করে দেখুন। আর যদি চুরি হয়ে থাকে, তা যাতে স্মার্ল্ড না হয় তার ব্যবস্থা করুন। আপনার সব খবর আমি পেয়ে গেছি কর্নেল সরকার! ইউ আর দি রাইট পার্সন টু ডু ইট। হা–পুলিস যেমন আমাকে বিশ্বাস করে না, তেমনি আমিও পুলিসকে বিশ্বাস করি না। আই নো দেম ওয়েল।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, দেবতা চুরি যায়নি। কুমারবাহাদুর কাল দুপুরে মন্দিরে গিয়ে দেখে এসেছেন। তখন আমি তার বাড়িতে ছিলাম।
হাজারিলাল গুম হয়ে বলল, মন্দিরের দরজা লোহার। ওতে একটা তালা আছে। আপনি কি দেখেছেন সেটা?
দেখেছি। তালাটা
হাত তুলে হাজারিলাল বলল, জানি। হাই টেকনলজির প্রসেসে তৈরি তালা। আমি বলি কী, আপনি কুমারবাহাদুরকে ইনসিস্ট করে থোক যেভাবে হোক, নিজের চোখে দেখুন দেবতা আছেন কি না।
কেন? কুমারবাহাদুর কি মিথ্যা বলেছেন আমাকে?
বলতেও পারেন।
কেন বলবেন?
বাড়ির দাম আমি ন-লাখ দিতে চেয়েছি। আর দেবতার দাম ধরা হয়েছে। তিরিশ লাখ। থার্টি নাইন লাখস্। ব্যস্। আর বেশি কিছু বলব না। বলে হাজারিলাল উঠে দাঁড়াল।
কর্নেলের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। কুমারবাহাদুর তাঁদের পূর্বপুরুষের গৃহদেবতা বেচতে চান এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না।
বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছা। আচ্ছা! আমি চলি। আপনি আমাকে টেলিফোনে শুধু কথাটা জানিয়ে দেবেন। আপনাকে আমি দশ হাজার টাকা দেব। নমস্তে!
হাজারিলাল নমস্কার করে চলে গেল। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। চুরুটেল নীল ধোঁয়ার একটা রেখা আঁকাবাঁকা হয়ে তাঁর টাক ছুঁয়ে ফ্যানের বাতাসে মিলিয়ে গেল।
হতবাক হয়ে বসেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে বললাম, তাহলে সব রহস্য ফাঁস হয়ে গেল।
কর্নেল চোখ না খুলেই বললেন, মোটেও হল না। আরও জট পাকিয়ে গেল।
আর জট কোথায়?
কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে ব্যস্ত হলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, ছন্দা! আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। তোমার শ্বশুরমশাই কি ঘুম থেকে উঠেছেন?..বাহ! ভালো খবর! এক বাহাদুরকে ফিরে পেয়ে আরেক বাহাদুর চাঙ্গা হতেই পারেন! তো বীরেশ্বর কি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন?…শোনো! আমি তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি। শ্বশুরমশাইকে কিছু জানিও না এখন। উনি বিরক্ত হতে পারেন। তুমি নীচে অপেক্ষা করবে। রাখছি।
টেলিফোন রেখে কর্নেল বললেন, বীরেশ্বর ছন্দাদের বাড়িতে যাননি। টেলিফোনে ওকে বলেছেন, এখন ব্যস্ত বলে যেতে পারছেন না। সময় পেলে যাবেন। যাই হোক, চলো! বেরিয়ে পড়া যাক। এক মিনিট! আমার কিটব্যাগ আর অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে আসি। এটা একটা অভিযান জয়ন্ত!…
আমরা সাড়ে এগারোটা নাগাদ মোহনপুর প্যালেসে পৌঁছুলাম। ছন্দা পোর্টিকোর নীচে অপেক্ষা করছিল। হলঘর থেকে বাহাদুর বেরিয়ে এসে সেলাম দিল। একগাল হেসে বলল, কুমারসাবকে আমি থোড়াগোড়া হাঁটাতে পারছি কর্নিলসাব! হাত-পা মালিশ করে দিচ্ছি। আমি একরকম মালিশ জানি। আমার বাবার কাছে শিখেছিলাম। আমাদের পাহাড়ি মুলুকের বুঢ়া আদমিরা সবাই জানে। কফি পাহাড়ে থেকে ফিরে গেলে এইরকম আচানক হাত-পায়ে খিচ ধরে যায়। এইটা পেরালিসিস না আছে কর্নিলসাব!
ছন্দা বললেন, বাহাদুর! গেট বন্ধ করে দিয়ে এসো।
বাহাদুর বলল, কুমারসাব আমাকে এক কামে ভেজলেন। গেট বন্ধ করে যাচ্ছি। লেকিন কিছু দরকার থাকে তো বলুন।
কিছু দরকার নেই। শ্বশুরমশাই তোমাকে কোথায় পাঠাচ্ছেন?
বাহাদুর গুম হয়ে বলল, মানা আছে বহুরানিদিদি! বলতে পারব না।
সে চলে গেলে ছন্দা বাঁকা মুখে বললেন, বুঝেছি। আবার হাজারিলালের ফাঁদে শ্বশুরমশাই পা দিতে যাচ্ছেন। আপনারা আসুন!
কর্নেল চাপা গলায় বললেন, একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এসেছি ছন্দা। তোমার একটু সহযোগিতা চাই!
বলুন!
তুমি মন্দিরে যাওয়ার দরজাটা খুলে দাও। আর ওপরে গিয়ে তোমার শ্বশুরমশাইয়ের হাত মালিশ করো। আমি লক্ষ্য করেছি, বিছানায় উনি শুলে ওঁর ডানদিকে উত্তরের জানালা দিয়ে নীচে মন্দিরটা চোখে পড়ে। তুমি জানালার ধারে বসে হাত মালিশ করবে।
ছন্দা অবাক হয়ে শুনছিল। বলল, কিন্তু উনি আমাকে হাত মালিশ করতে যদি না দেন?
তুমি ইনসিস্ট করবে। তাহলে আমার ধারণা, উনি আপত্তি করবেন না।
ছন্দা একটু ভেবে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। আজ থেকে টিনির স্কুলে ছুটি শুরু হয়েছে। বরং টিনিকেও ওঁর পা মালিশ করতে বলছি। টিনিকে উনি বাধা দেবেন না! সেই সুযোগে আমিও কাজে লেগে যাব।
ইউ আর ইনটেলিজেন্ট।
ছন্দা মন্দিরে যাওয়ার দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আমি তালা এঁটে দিচ্ছি। আপনারা লোহার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাবেন। কাল দেখলাম, সিঁড়িটা এখনও মজবুত আছে।
করিডরে মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! তুমি দেয়াল ঘেঁষে চুপিচুপি পশ্চিমের ফুলগাছগুলোর আড়ালে যাও। ওখানে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করো। ডাকাতি করতে যাচ্ছি দিন-দুপুরে। সাবধান!
চমকে উঠেছিলাম। কর্নেল! আপনি
ঠোঁটে আঙুল রেখে কর্নেল চোখে হেসে বললেন, বীরু!
তার মানে?
বীরু! ব্যস! আর কোনও কথা নয়।
ফুলগাছের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে অবাক হয়ে দেখলাম, কর্নেল দিব্যি মন্দিরের দরজা খুলে ফেললেন। দরজার কপাটদুটো নিঃশব্দে লিফটের কপাটের মতোই দুধারে ঢুকে গেল। কর্নেলও ঢুকে গেলেন এবং মিনিট দুই পরে বেরিয়ে এলেন। তারপর মন্দিরের দরজার কপাট টেনে বন্ধ করলেন। ফুলগাছের কাছে এসে চাপা গলায় বললেন, আগে তুমি উঠে যাও।
বললাম, আশ্চর্য! আপনি চিচিং ফাঁক মন্ত্র জানেন দেখছি!
কর্নেল হাসলেন। চিচিং ফাঁক বীরু…
.
নীচে নামো বাঁয়ে ঘোরো
সেই মরচে ধরা ঘোরালো লোহার সিঁড়ি দিয়ে আগে কর্নেল উঠে গেলেন। তারপর আমি সাবধানে উঠলাম। দোতলার বারান্দায় উঠে কর্নেল আস্তে কাসলেন। একটু পরে ছন্দা বেরিয়ে এলেন। তাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
কর্নেল বললেন, এবার তোমার শ্বশুরমশাইকে খবর দাও, আমি দেখা করতে চাই।
ছন্দা টিনির পড়ার ঘরে আমাদের বসিয়ে চাপা গলায় বললেন, আমি আপনাকে মন্দিরে ঢুকতে দেখলাম। আপনি কীভাবে লক খুললেন?
যথাসময়ে বলব। তুমি কুমারবাহাদুরকে খবর দাও!
ছন্দা ভেতরের একটা দরজার পর্দা সরিয়ে চলে গেলেন। বললাম, মন্দিরের ভেতরে বিষ্ণুমূর্তি দেখতে পেলেন তো?
কর্নেল বললেন, এখন কোনও কথা নয়। মুখ বুজে থাকবে কিন্তু!
মুখ বুজে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে টিনির সাড়া পাওয়া গেল। সে সেই ছড়াটা। সুর ধরে বলতে বলতে এ ঘরে ঢুকল। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে কর্নেলকে বলল, আবার তুমি এসেছ? তোমার দাড়ি সাদা কেন বলোনি। এখন বলবে?
কর্নেল তাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেন। সে ছিটকে সরে গেল। কর্নেল বললেন, তোমার দাদু কেন বেড়াল মেরেছেন আগে বলো। তা হলে বলব।
আমি দেখিনি।
আহা, বেড়ালটাকে তো দেখেছ?
বাহাদুর মরা বেড়ালটা কোথায় ফেলে দিয়েছে। বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করলে বলবে।
তুমি তা-ও দেখনি?
এই সময় ছন্দা এসে বললেন, আপনারা ভেতরে যান। আমি টিনিকে স্নান করাতে যাচ্ছি! টিনি! কাল স্নান করিসনি। আজ স্নান করবি আয়!
টিনি পালাতে যাচ্ছিল। ছন্দা তাকে ধরে ফেললেন। আমরা ভেতরের ঘরে ঢুকলাম। এ ঘরটা ফাঁকা। শুধু কিছু পুরনো আসবাব এক কোণে পড়ে আছে। কর্নেল ঘরটায় চোখ বুলিয়ে সামনের দরজার পর্দা তুলে বললেন, মর্নিং কুমারবাহাদুর। তারপর ঢুকে গেলেন। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম।
সত্যেন্দ্রনাথ তার বিছানায় পা ছড়িয়ে কালকের মতো বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। মুখটা খুব গম্ভীর মনে হল। বললেন, কর্নেলসায়েব! আমি বুঝতে পেরেছি কেন আপনি আবার এসেছেন। একজন ক্রিমিন্যাল শয়তানের জন্য আপনার কেন এত দয়া বুঝতে পারছি না।
কর্নেল খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। আমিও বসলাম। তারপর কর্নেল সহাস্যে বললেন, কুমার বাহাদুর! আপনি ভুল বুঝেছেন। আমার কয়েকটা ক্যাকটাসের গায়ে কতকগুলো রেড স্পট দেখা দিয়েছে। সেই ব্যাপারেই আমি কথা বলতে এসেছি। আমার মনে পড়ছে, আপনি একবার আমাকে কী একটা ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। প্লিজ যদি সেটা আবার লিখে দেন
আমার ডান হাত অচল। আমি বলছি, আপনি লিখে নিন।
কর্নেল পকেট থেকে নোট বই আর কলম বের করে কী একটা খটোমটো নাম লিখে নিলেন। তারপর বললেন, এটা কি যে কোন কেমিস্টের কাছে পাওয়া যায়? সেবার অনেক ঘোরাঘুরি করে তবে একটা ফার্মেসিতে পেয়েছিলাম।
এই পাড়াতেই পাবেন। কুণ্ডু ফার্মেসি-আপনার যাওয়ার পথেই পড়বে।
ছন্দা বলল, আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে অসুখটা নাকি প্যারালেসিস নয়।
সত্যেন্দ্রনাথ ডান হাত একটু তুলে মুঠো করে বললেন, ইচ্ছাশক্তি। বাহাদুর কাল থেকে ওদের দেশের প্রথায় মালিশ করে দিচ্ছে। একটু আগে বউমাও মালিশ করে দিচ্ছিল। আশা করি, এই সপ্তাহের শেষাশেষি চলাফেরা করতে পারব। আপনি কফি খাবেন তো?
ধন্যবাদ! অসময়ে আর বিরক্ত করব না আপনাকে। চলি।
বসলেন তো আর একটু বসুন। কথা আছে।
বলুন!
আমি ঠিক করেছি, একটু সুস্থ হলেই এই বাড়ি আর গৃহদেবতাসহ মন্দির বেঁচে দিয়ে মোহনপুরে আমাদের পুরনো বাড়িতে গিয়ে থাকব। মোহনপুরের বাড়িটা আপনার মনে পড়তে পারে। মেরামত করলে আরও দু-তিনশো বছর বাস করা যাবে।
কর্নেল হাসলেন। হাজারিলাল মোট উনচল্লিশ লাখ টাকা দিতে চেয়েছে। তাই না?
সত্যেন্দ্রনাথ নড়ে বসলেন। কে বলল আপনাকে? বউমা?
নাহ। ছন্দা জানে না।
তা হলে কে বলল?
আমার সোর্স বলা বারণ। দুঃখিত কুমারবাহাদুর! কর্নেল তার কাঁধের কিটব্যাগটা খুলে দুই ঊরুর ওপর রাখলেন। ফের বললেন, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, যে-বিষ্ণুমূর্তির জন্য হাজারিলাল আপনাকে তিরিশ লাখ টাকা দিতে চেয়েছে, তা সত্যিই মন্দিরে আছে তো?
সত্যেন্দ্রনাথের চোখ জ্বলে উঠল। কেন থাকবে না? কাল আপনারা যখন ছিলেন, তখন আমি দেখে এসেছি। তারপর সন্ধ্যায় আবার বাহাদুরের সাহায্যে মন্দিরে গিয়ে নিজেই পুজো করেছি। আজ ভোরেও–
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, সেটা আসল না নকল মূর্তি, তা লক্ষ্য করেছেন কি?
কালকের মতো আবার আপনি আসল-নকলের প্রশ্ন তুলছেন। কাল আপনাকে বলেছি, আসল মূর্তিই আছে। আপনার এই হেঁয়ালির উদ্দেশ্য কী।
কুমারবাহাদুর!.কাল আপনি মন্দিরে ঢুকে প্রদীপ জ্বেলেছিলেন কি?
না জ্বাললেও আমাদের গৃহদেবতাকে আমি চিনি। দুচোখে পদ্মরাগ মণি বসানো আছে। বাইরের আলোতেও তা ঝকমক করে ওঠে। তাছাড়া কাল সন্ধ্যায় এবং আজ ভোরে প্রদীপ জ্বেলেছিলাম।
হাজারিলাল বয়সে তরুণ হলেও দুর্ধর্ষ। ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা সাংঘাতিক দুবৃত্ত। পুলিসও ওকে সমীহ করে চলে। তাই বলছি, মূর্তি যদি নকল হয়, আপনার বিপদ ঘটতে পারে।
আমার মেজাজ নষ্ট করে দিচ্ছেন কর্নেলসায়েব! আপনি আমার পুরনো বন্ধু। অন্য কেউ হলে জোরে শ্বাস ছেড়ে সত্যেন্দ্রনাথ ফের বললেন, আমার ব্যাপারে প্লিজ আপনি নাক গলাবেন না।
কর্নেল হাসলেন। এ কথা ঠিক যে, নরহরিবাবুকে বিষ্ণুমূর্তি চুরি করানোর জন্যই আপনার ছেলের বন্ধু বীরেশ্বর সেন আপনার গৃহদেবতার সেবাইতপদে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু ধর্মভয়ে হোক বা আপনার ভয়েই হোক, উনি তা পারছিলেন না। আপনি যখন তা টের পেলেন, তখন সতর্ক হলেন। এবার বলুন, কীভাবে আপনি টের পেয়েছিলেন?
সত্যেন্দ্রনাথ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কর্নেলের কথা শুনছিলেন। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, আপনি সব জানেন তা হলে?
কিছু তথ্য থেকেই এটা আমার অনুমান মাত্র।
সত্যেন্দ্রনাথ একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, গতমাসে একদিন বিকেলে দোতলার বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ থামের পাশ দিয়ে দেখি, নীচের গেটে দুর্গাদাস নরহরির হাতে কী একটা গুঁজে দিয়ে চলে গেল। সেটা কোমরে ধুতির ভাঁজে খুঁজে নরহরি চলে এল। আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। সন্ধ্যায় ও মন্দিরে পুজো করতে ঢুকল। তখন আমি ওর থাকার ঘর সার্চ করলাম। মহাধূর্ত। বীরেশ্বরের এয়ারমেলে পাঠানো একটা চিঠি দেয়ালের একটা তাকে পঞ্জিকার তলায় রেখে দিয়েছে। চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে মাথায় আগুন ধরে গেল। কিন্তু ওকে আমি পারিবারিক প্রথা অনুসারে তালা খোলার সিস্টেম সরল বিশ্বাসে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। ওকে পুলিসের হাতে তুলে দিই বা তাড়িয়ে দিই, একই কথা। পুলিসের হাত থেকে একদিন ছাড়া পাবেই। তখন কী হবে?
এক মিনিট। তালার নাম্বারিং সিস্টেম চেঞ্জ করা যায় না?
নাহ। তবে আমি চেঞ্জ করতে জানি বলে রটিয়েছি। কেন তা বুঝতেই পারছেন!
হ্যাঁ। বাই দি বাই–জয়রাম শর্মা কি সত্যি নিখোঁজ হয়েছিলেন?
সত্যেন্দ্রনাথ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, আপনি সবই জানেন দেখছি! •
জেনেছি। জানার দরকার ছিল।
কার স্বার্থে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, নিজের স্বার্থে। আমার হবির কথা আপনার অজানা নয়।
প্লিজ কর্নেল সায়েব! আর এতে নাক গলাবেন না।
ঠিক আছে। গলাব না। কিন্তু আপনি টাকার লোভে হাজারিলালকে নকল বিষ্ণুমূর্তিসহ মন্দির বেচে দেবেন না। আপনার মঙ্গলের জন্য বলছি। মোহনপুরে গিয়েও হাজারিলালের হাত থেকে আপনি বাঁচবেন না। দুর্গাপ্রসাদ মোহনপুরের লোক। কিন্তু সে থাকে এখানে। আপনি ভেবেছেন, মোহনপুরে দুর্গাপ্রসাদের ঘাঁটি আছে। কিন্তু যতই ঘাঁটি থাক, অন্তত আপনার নাতনি টিনির কথা চিন্তা করুন। হাজারিলাল সব পারে।
সত্যেন্দ্রনাথ গলার ভেতর বললেন, কিন্তু হাজারিলালের মূল উদ্দেশ্য দেবতাসহ মন্দির কেনা। ওর প্রচণ্ড ধর্মবাতিক আছে। এদিকে দুর্গাপ্রসাদের কাছে আমার দু লক্ষ টাকার বেশি দেন।
দুর্গাপ্রসাদ বাড়ি কিনতে চাইলে তাকে বেচে দিন।
একই প্রব্লেম। হাজারিলাল রেগে যাবে। আমার হয়েছে উভয়সঙ্কট। দুর্গাপ্রসাদ যেমন দুবৃত্ত, হাজারিলালও তা-ই।
তাহলে কোনও থার্ড পার্টিকে বেচে দিয়ে কলকাতাতেই কোথাও ফ্ল্যাট কিনে চলে যান। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ ঘুরলেন। শুনলাম কাল আপনি এক আছাড়ে একটা বেড়াল মেরেছেন। বেড়ালের নাকি নটা প্রাণ! এক আছাড়ে বেড়াল মারা কম কথা নয়।
সত্যেন্দ্রনাথ বালকের মতো গর্জন করলেন, কী বলতে চান আপনি?
কর্নেল আস্তে বললেন, বলতে চাই, পূর্বপুরুষের জমিদারি রক্ত আপনার শরীরে আছে।
কথাটা বলেই কর্নেল দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণে দেরি করলাম না। মনে হচ্ছিল, পিঠে জমিদারি শ্বাসপ্রশ্বাসের গরম ঝাঁপটা এসে লাগছে।
ই এম বাইপাসের মোড়ে কর্নেল কালকের মতোই নেমে গেলেন। আমার মনে অনেক প্রশ্ন থেকে গেল। কিন্তু তখন কিছু করার ছিল না।…
সেদিন সন্ধ্যার পর সত্যসেবক পত্রিকার অফিস থেকে কর্নেলকে ফোন করলাম। ষষ্ঠীচরণ সাড়া দিয়ে বলল, বাবামশাই বেইরেছেন। বলে গেছেন, কখন ফিরবেন কিছু ঠিক নেই।
কর্নেলের সাড়া পেলাম টেলিফোনে পরদিন সকালে। মর্নিং ডার্লিং! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।
বললাম, মর্নি ওল্ড বস! মোটেও হয়নি। চিচিং ফাঁকের ব্যাপারটা
বীরু!
ওঃ কর্নেল!
চলে এস। এখানেই তোমার বেকেরফাস্টোর নেমন্তন্ন।
টেলিফোন রেখে ঝটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুতে পৌনে নটা বেজে গেল।
বৃদ্ধ রহস্যভেদী ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন। বললেন, আজ কেউ আসছে না। কাজেই নটায় ব্রেকফাস্ট করা যাবে। তারপর কফি।
বললাম, কাল সন্ধ্যায় ফোন করেছিলাম। কোথায় বেরিয়েছিলেন?
বিকেলে ছন্দা ফোন করেছিল। আমি চলে আসার পর কুমারবাহাদুর জঙ্গ বাহাদুরের কোলে চেপে মন্দিরে গিয়েছিলেন। তারপর কেলেঙ্কারি! কর্নেল তাঁর অট্টহাসিটি হাসলেন। মন্দিরে বিষ্ণুমূর্তি নেই। কুমারবাহাদুর হইচই বাধিয়েছেন। পুলিসকেও জানিয়েছেন। আমিই নাকি মূর্তি চুরি করেছি।
সে কী! তারপর?
ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, আমি যাচ্ছি। তারপর ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ নন্দীকে ফোন করলাম। প্রথমে গেলাম তার কাছে। যতটুকু বলা উচিত, তাকে বললাম। তারপর মোহনপুর প্যালেসের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ শুনি বোমাবাজি শুরু হয়েছে। ওই এরিয়ায় দুর্গাপ্রসাদ আর হাজারিলালের গ্যাং প্রায়ই মারপিট বোমাবাজি করে। লোকেদের গা সওয়া ঘটনা, পুলিসও যায়–তবে যথা সময়ে। কী আর করা যাবে? ফিরে আসছিলাম। পথে আমার আরে পুরনো বন্ধু রঘুবীর সিংহের সঙ্গে দেখা। দমদম ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। উনিও এক কর্নেল। রিটায়ার করে বাড়ি করেছেন ভি. আই. পি. রোডের ধারে। তার বাড়িতে আড্ডা দিয়ে–
ষষ্ঠী এ ঘরে ব্রেকফাস্টের ট্রে আনায় ওঁর কথায় বাধা পড়ল। ব্রেকফাস্টের সময় বললাম, এবার চিচিং ফাঁকের ব্যাপারটা বলুন।
কর্নেল বাঁ হাতে টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেই তার নকশাটা বের করে বললেন, এটা লক করা। তালাটার মাঝখানে বিন্দুগুলো জোড়ের চিহ্ন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তালাটা দুটো অর্ধবৃত্তে ভাগ হয়ে যায়।
বললাম, মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।
কর্নেল বললেন, টিনির ছড়াটা স্মরণ করো।
নীচে নামো বাঁয়ে ঘোরো।
তবেই তোমার পোয়াবারো।
কর্নেল ছড়াটা আওড়ে বললেন, টি হরফ থেকে নীচে নামলে এইচ। এবার দেখ, ওপরে এক হরফের কাছে তীরচিহ্ন আছে। নবটা ঘোরাতে হবে বাঁদিকে। এইচ থেকে বাঁয়ে ঘুরিয়ে এইচ-কে তীরচিহ্ন-আঁকা এক হরফের জায়গায় পৌঁছে দিলেই পোয়াবারো। তার মানে, কার্যসিদ্ধি। দরজা খুলে যাবে। এই সূত্রটার সঙ্গে নরহরি ভট্টাচার্যের অন্তিম মুহূর্তের কথাটা আমার মাথায় এসেছিল। উনি বীরু বলেছিলেন, নাকি হিরো বলেছিলেন? লক করো! নীচে নেমে অর্থাৎ এইচ হরফ ধেকে বাঁদিকে পড়লে হিরো শব্দটা পেয়ে যাচ্ছি। মধ্যিখানে নবের ওপর লেখা টি হরফ ইংরেজি টার্ন শব্দটার আভাস দিচ্ছে। টি মানে টার্ন অর্থাৎ ঘোরাও বা ঘোরো।
বাহ! বেশ কারিগরি কৌশল তো। আবার এই দেখুন, টি থেকে নেমে ডাইনে ঘুরে পড়লে THEREFORE দাঁড়াচ্ছে!
হ্যাঁ। ইচ্ছে করেই এই গোলকধাঁধা তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু নরহরিবাবু হিরো শব্দটা বলেছিলেন কেন?
মন্দিরের দরজার ভেতরদিকেও একই তালা আছে। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেও লর্ড হয়ে যাবে। তখন বেরুতে হবে নব ঘুরিয়ে তীরচিহ্ন থেকে হিরো সাজতে হবে। কর্নেল স্যান্ডউইচের শেষ টুকরো গিলে বললেন, তখন ছন্দাকে আসতে দেখে আততায়ী মন্দিরের ভেতর লুকিয়ে দরজা টেনে লন্ড করে দিয়েছিল। নরহরি ভট্টাচার্য চেয়েছিলেন, হিরো শুনে বুদ্ধিমতী ছন্দা যদি তালার দিকে তাকায়–সেটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। তুমি হিরো শব্দটা শোনার পর তালার দিকে তাকালেই শব্দটা দেখতে পাবে। তাই না?
ঠিক বলেছেন। এখন চোখে পড়ছে বটে।
ছন্দার হিরো শুনে লকের দিকে তাকানো উচিত ছিল। কারণ এত বছর ধরে সে তালাটা দেখছে। সে জানে, তালাটার নাম্বারিং সিস্টেম আছে। বিশেষভাবে ঘোরালেই খুলে যাবে। কিন্তু সে হিরো শুনতে বীরু শুনেছিল। কারণ বীরু তার স্বামীর বন্ধু। পরিচিত নাম।
তা হলে আততায়ী তখন মন্দিরের ভেতর ছিল বলছেন?
ছিল। নরহরিবাবু চেয়েছিলেন, ছন্দা আততায়ীকে দেখুক।
কে সেই আততায়ী?
কর্নেল বাঁহাতে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সলিউশনের শিশি বের করে বললেন। এটা তরল আঠার মতো পিছল। জলের মতো রঙ। কোনও শানবাঁধানো জায়গায় মাখিয়ে রাখলে চোখে পড়বে না। কিন্তু পা দিলেই তুমি আছাড় খাবে। আচমকা আছাড় খেলে সব বীরপুরুষই অসহায়! হা–এটা ক্যাকটাসের রোগের সেই ওষুধ।
চমকে উঠে বললাম, বলেন কী! তা হলে কুমারবাহাদুর
হ্যাঁ। কুমারবাহাদুরই খুনী। জরিদারি রক্ত। তাছাড়া বরাবর রাগী এবং গোঁয়ার মানুষ। এদিকে গৃহদেবতা শ্রীবিষ্ণুকে যে চুরি করতে চাইবে, সে-ই তার কোপানলে পড়বে। জয়রাম শর্মা নিখোঁজ হয়েছিলেন। তখন কুমারবাহাদুরের পক্ষে কাকেও নিখোঁজ করে ফেলার সামর্থ্য ছিল এখন অতটা নেই। সময়ও পাননি। ছন্দা দৌড়ে গিয়েছিল!
কিন্তু ওঁর ডান হাত এবং পায়ে
ওটা চালাকি। নরহরি ভট্টাচার্যকে মেরে ফেলার ফাঁদ।
কিন্তু নরহরিবাবুকে খতম করে উনি মন্দিরে আত্মগোপন করেছিলেন, সে-কথা আপনি কী ভাবে জানতে পারলেন?
ছন্দা কাল টেলিফোনে আমার কাছে স্বীকার করেছে, নরহরিবাবুর খুন হওয়ার খবর তার শ্বশুরমশাইকে দিতে এসে সে বিছানায় ওঁকে দেখতে পায়নি। কোনও সত্যিকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না।
তা হলে ছন্দা জানত কে খুনী?
তার সন্দেহ স্বাভাবিক। তখন নীচের হলঘরে মন্দিরে যাওয়ার দরজা ওদিক থেকে বন্ধ ছিল। কাজেই কুমারবাহাদুর লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। ছন্দা আমাদের ওই সিঁড়িটা দেখিয়ে এবং সেখান দিয়ে নামতে বলে আসলে একটা আভাস দিতে চেয়েছিল। তাছাড়া কাল টেলিফোনে তার শ্বশুরমশাইয়ের বেড়াল মারার ঘটনা বলেও সে জানাতে চেয়েছিল, কুমারবাহাদুরের হাত কত ক্ষিপ্রগতি এবং কত শক্তিশালী!
আপনি পুলিসকে জানাচ্ছেন না কেন?
যা প্রমাণ করতে পারব না, তা জানিয়ে কী লাভ? কুমারবাহাদুর এতটুকু সূত্র রাখেননি, যা দিয়ে ওঁকে খুনী প্রমাণ করা যাবে। হাতুড়ি বা লোহার রড জাতীয় কিছু ওঁর মার্ডার উইপন। সেটা উনি সম্ভবত মন্দিরের পেছনের পুকুরে ফেলে দিয়েছেন। তা উদ্ধার করা কঠিন। করলেও প্রমাণ করা যাবে না, উনিই ওটা ব্যবহার করেছিলেন।
কর্নেল ব্রেকফাস্ট শেষ করে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। ফের বললেন, নরহরিবাবুকে খতমের প্ল্যান রাত্রেই করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তোমাকে দেখিয়েছিলাম, মন্দিরের ঘাটের দরজায় সামনে ঝোপঝাড় দুমড়ে-মুচড়ে বাঁকা করা হয়েছে। কিছু ডালও ভাঙা হয়েছে। হুড়কো খুলে এমনভাবে রাখা আছে, তাতে মনে হবে খুনী ওই পথেই চলে গেছে। কিন্তু মাকড়সার জালের দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পেরেছিলাম, খুনী দরজা খুলে পালায়নি। ক্লিয়ার?
ক্লিয়ার। কিন্তু ফোনে আপনাকে হুমকি দিচ্ছিল কে?
কুমারবাহাদুর। বোঝা যাচ্ছে, নরহরিবাবু ফিরে গিয়ে ছন্দাকে আমার কথা চুপিচুপি জানিয়েছিলেন। কুমারবাহাদুর তো সত্যিই পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী নন। ওত পেতে তা শুনে থাকবেন। জয়ন্ত! এ অনুমান যুক্তিসিদ্ধ। কারণ দ্বিতীয় বার হুমকির ফোন আমি স্বকর্ণে শুনেছি। কুমারবাহাদুরের কণ্ঠস্বর আমার কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তবে তোমার চোখে পড়া উচিত ছিল, ছন্দার ঘরের টেলিফোনের একটা এক্সটেনশন লাইন কুমারবাহাদুরের ঘরেও ছিল। তিনি আড়ি পেতে আমার সঙ্গে ছন্দার বাক্যালাপ শুনতেন, এটা স্পষ্ট।
এইসময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। বলো ছন্দা! …হাওড়া স্টেশন থেকে? কী ব্যাপার? …ঠিক আছে। উইশ ইউ গুডলাক। …সেটাই ভালো, তোমাদের আর মোহনপুর প্যালেসে থাকার উচিত নয়। মোহনপুরেই…তো শোনো! আমি তোমার শ্বশুরমশাইকে নকল বিষ্ণুমূর্তিটা ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। ..দিতে হবে না? …উনি ফেরত চান না? ঠিক আছে। এগেন উইশ ইউ গুডলাক। ছাড়ছি।
টেলিফোন রেখে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, কুমারবাহাদুর তার বউমা আর নাতনিকে নিয়ে মোহনপুরে পাড়ি জমালেন। সঙ্গে আসল বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে যাচ্ছেন। বাহাদুর মোহনপুর প্যালেসের কেয়ারটেকার হয়ে রইল। অ্যামব্যাসাডর গাড়িটা ছন্দা অগত্যা দুর্গাপ্রসাদকে মাত্র তিরিশ হাজার টাকায় বেচে দিয়েছে। পরে বাড়িটা বেচে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে।
বুঝলাম। কিন্তু একজন খুনীকে আপনি ছেড়ে দিলেন, এটা ঠিক হল না।
ডার্লিং! আবার বলছি, এ একটা বিচিত্র কেস। খুনী কে, তা জানা সত্ত্বেও আমি প্রমাণ করতে পারব না। কী আর করা যাবে? তবে এ তো ঠিক, আমাদের দেশের অমূল্য সব মূর্তি যারা বিদেশে পাচার করছে, তাদের ক্ষমা করা যায় না। বিশেষ করে লোক নরহরিবাবু আমার সাহায্য নিতে কেন এসেছিলেন, তোমার তো বোঝা। উচিত। উনি আমার সাহায্যে আসল মূর্তিটা হাতাতে চেয়েছিলেন, তাই নয় কি? আমি আসল মূর্তি উদ্ধার করে দিলে তা উনি বীরেশ্বরকে দিতেন।
বৃদ্ধ রহস্যভেদী কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালেন। তারপর অভ্যাস মতো চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। চুরুটের নীল ধোঁয়ার একটা রেখা আঁকাবাঁকা হয়ে ওঁর টাক ছুঁয়ে ফ্যানের বাতাসে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে চুরুটের এক টুকরো ছাই ওঁর দাড়িতে যথারীতি খসে পড়ল। সাদা ঝকমকে দাড়িতে ছাইটুকু পড়ামাত্র বলে উঠলাম, সভ্যতার ওপর বর্বরতা!
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, কী?
হাসতে হাসলে বললাম, সেদিন বিকেলে আপনি বলছিলেন, সভ্যতার সঙ্গে বর্বরতার সম্পর্ক যেন অচ্ছেদ্য। বর্বরতা ছাড়া সভ্যতা হয়তো টেকে না।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার হাসলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ। বর্বরতা দিয়ে সভ্যতাকে রক্ষার প্রয়োজন মাঝে-মাঝে দেখা দেয়। একটা নরহত্যার বর্বরতার একটা সভ্যতার সম্পদকে রক্ষা করেছে।
আহা! আমি বলছি আপনার দাড়িতে ছাইয়ের টুকরো–
একই কথা। বলে বৃদ্ধ রহস্যভেদী আবার চোখ বুজে হেলান দিলেন।…