নিহিত পাতালছায়া

নিহিত পাতালছায়া (রচনা ১৯৬০-৬৬। প্রকাশ ১৯৬৭)

বিপুলা পৃথিবী

একদিন সে এসে পড়েছিল এই ভুল মানুষের অরণ্যে। হাতে তাদের গা ছুঁতে গিয়ে কর্কশ বক্কল লাগে বারেবারে।

আজ মনে হয় কেন সে গিয়েছিল। সে কি ভেবেছিল তার চিকন মোহ উদ্ভিন্ন করে দেবে অন্ধকারের শরীর? সে কি যেন মেঘলা জল কালো বনের মাথায়? প্রতিটি পাতা তার নন্দন বরণ করে নেবে সবুজ কৃতজ্ঞতায়? আঙুরের আভার মতো দৃষ্টি-ধুয়ে-দেওয়া প্রান্তবেলা?

আজ মনে হয় কেন সে ভেবেছিল। সেই অরণ্যের মধ্যে সেও এক তামসী বৃক্ষ যে নয়, এই কি তার জীবন?

জরাজটিল অরণ্যে তার ঠাঁই হলো না, ঠাঁই হলো না ভালোবাসার আকাশে। সে নেমে থাকল মধ্যপথের অজস্ব শূন্যের মাঝখানে। নিঃসীম নিঃসঙ্গ শূন্যে কেঁপে উঠল হৃদয়, ভয়ে জমজম করতে থাকল তার রাত্রির মতো হৃদয়।

আর এই রাত্রি দুলছে নিঃশব্দ বাদুড়ের মতো তাকে ঘিরে। চোখে পড়ে তারই নিরন্ত কালোয় অন্ধ অরণ্যের মূঢ় গর্জন, ‘তাকে ঢেকে দাও’ ‘তাকে ঢেকে দাও’ রব করতে-করতে ছিটকে বেড়ালো এধার থেকে ওধার, খসে-পড়া নক্ষত্র বেজে রইল বুকের মাঝখানে, ‘তাকে চোখ দাও’ ‘তাকে চোখ দাও’ বলতে-বলতে সীমানাহীন ভয়ে তার চোখ ঢাকল দু-হাতে।

আজ তুমি, যে-তুমি অপমান আর বর্জনের নিত্য পাওয়া নিয়ে তবুও মুঠোয় ধরেছ আমাকে, আমাকেই, আমাকে

সেই তুমি আমার অন্ধ দু-চোখ খুলে দাও, যেন সইতে পারি এই পৃথুলা পৃথিবী, এই বিপুলা পৃথিবী, বিপুলা পৃথিবী…

*

সত্তা

তুমি থেকো, তুমি সবার দৃশ্যগোচর থেকো–
 নইলে আমি এ যে কিছুই বুঝতে পারি না।
স্মরণ, বিস্মরণ- তার উর্ধ্বে প্রত্যেকে
দেখবে, তুমি মানবী না, স্বপ্নপরী না।

তবে কে ও? তবে কে ও? কোথায় চলেছে ও
অর্ধরাতে অন্ধকারে অবিশ্বাসিনী?
শব্দগুলি অন্ধকার, নীরব, নিঃশ্রেয়–
 এখনও না, আমি সীমার প্রান্তে আসিনি।

তুমি থামো তুমি থামো, নিশীথে বন্যতা,
মধ্যে জাহাজ জ্বলে হঠাৎ, তুমি থামো থামো;
দৃশ্যবিহীন অকূলতায় খোলে জলের জটা
গূঢ় পাতাল, মহাপাতাল, নমো নমো নম!

কিন্তু কেন? নিঃস্ব পদ্ম টানে প্রবল টানে
ভেসে কোথায় যেতে কোথায় ডাকে কে গো, কে গো–
 এ যদি হয় সত্তা তবে অস্তিত্বের মানে
থাকা, কেবল থাকা, তুমি বিশ্বগোচর থেকো।

*

মাতাল

আরো একটু মাতাল করে দাও।
নইলে এই বিশ্বসংসার
সহজে ও যে সইতে পারবে না!

এখনও যে ও যুবক আছে প্রভু!
এবার তবে প্রৌঢ় করে দাও–
নইলে এই বিশ্বসংসার
সহজে ওকে বইতে পারবে না।

*

অন্তিম

আমায় বেছে-বেছে বরণ করেছিল
 বিশ্ববিধাতার একটি দুরাশা।
এখন দেখছি তা কিছুই পূর্ণ না,
বয়স যদ্যপি মাত্র বিরাশি।

সফল কীর্তি তো আঙুলে গোনা যায়
বসতিনির্মাণ, বংশরক্ষা;
 তাছাড়া ছিল বটে অন্ধকার ঘটে
 সিঁদুরচিহ্নের মতন সখ্য।

কিন্তু সখাদের অস্থি ডাক দেয়
মস্ত সময়ের দাঁতের কৌটোয়–
 প্রবল বহমান দু-ধারে গর্জিত,
অন্ধ নির্বোধ, টান দে বৈঠী।

*

পাগল

‘এত কিসের গর্জে আকাশ
চিন্তা ভাবনা শরীরপাত?
বেঁচে থাকলেই বাঁচা সহজ,
মরলে মৃত্যু সুনির্ঘাত!’

ব’লে, একটু চোখ মটকে,
তাকান মত্ত মহাশয়–
 ‘ঈষৎ মাত্র গিলে নিলে
 যা সওয়াবেন তাহাই সয়।’

‘হাওড়া ব্রিজের চূড়োয় উঠুন,
 নীচে তাকান, উর্ধ্বে চান–
 দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’

*

বুড়িরা জটলা করে

বুড়িরা জটলা করে
আগুনের পাড়ায়
 দু-ধারে আঁধার জল
পাতাল নাড়ায়।

আবছায়া জাহাজ ঘিরে
মাতালের সাঁতার
কেউ-কেউ আলোক ভাবে
 কেউ-কেউ আঁধার।

রাত্রির কুণ্ডলীও
 কুয়াশায় কাঁপে
 বুড়িদের জটলা নড়ে
অতীতের ভাপে।

বুড়িরা জটলা করে
 বুড়িরা জটলা করে

*

পোকা

খেয়ে যা, খেয়ে যা, খা
 দেয়ালের মধ্য খুঁড়ে জল।
বাহিরে ভরসা ছিল এতকাল শাদা
কোথা হতে নীলাভ গরল–
 দেয়ালের মধ্য বুকে জল।

জালের জানালা খোলা, গগনে তাকা–
 টিপি-ঢিপি পাহাড়-চূড়ালি।
 যা, যা, নিজে যদি জুড়া তো জুড়ালি।
 নতুবা আকাশে দিয়ে ছাই
 দেয়ালে-দেয়ালে নড়ে পোকা।

যা, দেয়ালে-দেয়ালে ঘুরে যা–
খা, খা
খুঁড়ে-খুঁড়ে সবই অস্থায়ী
 খেয়ে যা, খেয়ে যা, খা।

*

প্রতিশ্রুতি

এখন আমি অনেকদিন তোমার মুখে তাকাব না,
 প্রতিশ্রুতি ছিল, তুমি রাখোনি কোনো কথা।
এখন ওরা অনেকদিন আমার মুখে তাকাবে না,
প্রতিশ্রুতি ছিল, আমি ভেঙেছি নীরবতা।

কেন? কারণ সেই যে-বুড়ি, সেই-যে তিনটে পাকা বুড়ি,
ঘরের সামনে অশথ ঘিরে ঘুরেছে সাতবার,
 বাঁধা মুঠি খোলা দুগাল ধুলোতে আর শাপশাপান্তে
 ছিটিয়ে দিয়ে গিয়েছে ঘর-বার।

বুকের ভিতর খরদীপালি জ্বালিয়ে বলে ‘তালি তালি’
 দু-হাতে তালি, ছ-হাতে তালি, শ-হাতে তালি বাজে
 এখন আমি আর কি নারী তোমার মুখে তাকাতে পারি?
কিংবা ওরা আমার মুখের গমক-গমক আঁচে?

কেবল দু-জন দু-ধার থেকে মধ্যে আগুন আড়াল রেখে
 খুলে দিয়েছি ছাইয়ের করতল,
গলিত দ্রব নীরবতা যদিও জানে শেষ পরিণাম–
 তুমিও জানো, আমিও জানি, সামান্য সম্বল।

*

কিউ

একটু এগোও একটু এগোও
 তখন থেকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি একটু এগোও
হে সর্পিণী, পিচ্ছিলতা একটু নড়ুক-চড়ুক!
মানুষ, মাছি, অন্ধকার    মানুষ, মাছি, অন্ধকার
হে সর্পিণী, পিচ্ছিলতা একটু নড়ুক-চড়ুক!

জলের সঙ্গে স্রোতের সামনে
 মুখের সঙ্গে আলোর সামনে
 মানুষ মাছি অন্ধকার একটু নড়ুক-চড়ুক।

একটু এগোও, বিসর্পিণী, একটু এগোও…

*

বাস্তু

আজকাল বনে কোনো মানুষ থাকে না
কলকাতায় থাকে।
 আমার মেয়েকে ওরা চুরি করে নিয়েছিল
 জবার পোশাকে!
 কিন্তু আমি দোষ দেব কাকে?

শুধু ওই যুবকের মুখখানি মনে পড়ে ম্লান,
 প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ও কেন গলির কানা বাঁকে
 এখনও প্রতীক্ষা করে তাকে।

সব আজ কলকাতায়, কিন্তু আমি দোষ দেব কাকে?

*

ভিড়

‘ছোটো হয়ে নেমে পড়ুন মশাই
‘সরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাই
‘চোখ নেই? চোখে দেখতে পান না?
‘সরু হয়ে যান, ছোটো হয়ে যান—’

আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর
 ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে, বাজারে, আড়ালে?

*

রাস্তা

‘রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন
 মশাই দেখছি ভীষণ শৌখিন—’

চশমা ধরে নেমে এলাম
 ঘুরতে ঘুরতে নেমে এলাম
ভুবনখানা টলে পড়ল ভুবনডিঙির পায়ে
ফিরে যাব, ফিরে যাব, ফিরব কী উপায়ে?

এক রাস্তা দুই রাস্তা তিন রাস্তা কেউ রাস্তা
 রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন।
 তিন রাস্তা চার রাস্তা সব রাস্তা সমান
রাস্তা করে নিন।
এক রাস্তা দুই রাস্তা
দুই রাস্তা এক রাস্তা
কেউ রাস্তা দেবে না, রাস্তা করে নিন।

*

অলস জল

পা-ডোবানো অলস জল, এখন আমায় মনে পড়ে?
 কোথায় চলে গিয়েছিলাম ঝুরি-নামানো সন্ধ্যাবেলা?

খুব মনে নেই আকাশ-বাতাস ঠিক কতটা বাংলাদেশের
 কতটা তার মিথ্যে ছিল বুকের ভিতর বানিয়ে-তোলা :

নীলনীলিমা ললাট এমন আজলকাজল অন্ধকারে
ঘনবিনুনি শূন্যতা তাও বৃক্ষ ইব চতুর্ধারে!

কিন্তু কোথায় গিয়েছিলাম? মাঝি, আমার বাংলাদেশের
ছলাৎছল শব্দ গেল অনেক দূরে মিলিয়ে, সেই

শব্দকুহক, নৌকাকাঙাল, খোলা আজান বাংলাদেশের
 কিছুই হাতে তুলে দাওনি, বিদায় করে দিয়েছ, সেই

স্মৃতি আমার শহর, আমার এলোমেলো হাতের খেলা,
 তোমায় আমি বুকের ভিতর নিইনি কেন রাত্রিবেলা?

*

ফুলবাজার

পদ্ম, তোর মনে পড়ে খালযমুনার এপার-ওপার
রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?

স্পষ্ট নৌকো, ছই ছিল না, ভাঙাবৈঠা গ্রাম-হারানো
বন্য মুঠোয় ডাগর সাহস, ফলফুলন্ত নির্জনতা

আড়ালবাঁকে কিশোরী চাল, ছিটকে সরে মুখের জ্যোতি
আমরা ভেবেছিলাম এরই নাম বুঝি-বা জন্মজীবন।

কিন্তু এখন তোর মুখে কী মৃণালবিহীন কাগজ-আভা
সেদিন যখন হেসেছিলি সত্যি মুখের ঢেউ ছিল না।

আমিই আমার নিজের হাতে রঙিন করে দিয়েছিলাম
 ছলছলানো মুখোশমালা, সেকথা তুই ভালোই জানিস–

তবু কি তোর ইচ্ছে করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে
 সবার হাতে ঘুরতে-ঘুরতে বিন্দু-বিন্দু জীবনযাপন?

*

পিঁপড়ে

পিঁপড়ে রে, তোর পাখা উঠুক
আমি যে আর সইতে পারি না!
সারিবন্দী সারিবন্দী সারিবন্দী মুখ
 আমি যে আর দেখতে পারি না।

আলমারিতে খাবার আছে, কিন্তু সে তো আমার জন্য রাখা,
 তুই কেন তা খাস? বিশ্রী বদভ্যাস।
আলমারি, প্লেট, বারান্দা, বই, উজাড় টেবিলঢাকা,
গভীর রাতের বিছানাটাও চাস?

পিঁপড়ে রে, তোর বাসা কোথায়? উড়িয়ে দিয়ে পাখা
সেইখানে যা, নয়,
 ঝাঁপ দে যমুনায়,
 নইলে মস্ত আগুন জ্বেলে চতুৰ্ধারে নাচ–
পাখা উঠুক পাখা উঠুক পাখা উঠুক তোর
পিঁপড়ে রে, আর সইতে পারি না।

*

সঙ্ঘ

এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়     থাকে শুধু পরিত্রাণহীন
ব্যক্তির আবর্তে ঘূর্ণিঘোর,     কার শির ছেঁড়ে সুদর্শন?
‘মিথ্যাচারী মিথ্যাভাষী, শঠ,  আমিই মহান, দেখ আমাকে’–
ছিন্ন হয়ে যায় শিশুপাল        এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়!
কিন্তু ব্যভিচার, রক্তধারা      লক্ষ-লক্ষ জীবন্ত বীজাণু
মুক্তি পায় চক্র ছুঁয়ে যায়–   ঘোরে চাকা দশক দশক।
 আরো শত নিষ্ঠুরতা বাকি,   সে কেবল স্থির প্রচালিত
শোকের দ্বেষের পরিপাকে     গড়ে তোলে অদ্বেষ অশোক!

*

মিলন

কখনো মনে হয় তুমি ধানখেতে ঢেউ, তারই সুগন্ধে গভীর তোমার উদাত্ত-অনুদাত্তে বাঁধা দেহ, প্রসারিত, হিল্লোলিত

আমি ডুবে যাই নিবিড়ে নিমগ্ন বৃষ্টিরেণুর মতো, শিউরে ওঠে সমস্ত পর্ণকণা
জীবনের রোমাঞ্চে, ধূপের ধোঁয়ার মতো মাটির শরীর জাগে কুণ্ডলিত কুয়াশায়

তারই কেন্দ্রে তুমি, তুমি প্রসারিত, হিল্লোলিত, প্রসারিত।

আজ মনে হয় কী ক্ষমাহীন রাতগুলি বেঁধেছিল আমায়। বাইরে তার সজল মেঘাবরণ, দেখে ভুললে, ভুলে কামনার দুই ঠোঁটে টেনে নিলে বুকের উপর বারে-বারে, ঘুলিয়ে উঠল অন্তরাত্মা

কিন্তু কাছে এসে দেখলে, হায়, এ কী ভগ্নকরুণ অবনত দয়িত আমার। এই কি সে দিব্যসজল মুখশ্রীর যৌবন যাকে আমি মগ্ন আকাশের অসংখ্য তারার মতো চুম্বনকণিকায় ভরে দিতে পারতুম, হায়

ব’লে উদবেল হলো করুণা তোমার দুই বুকে, যুগল নিশ্বাস প্রবাহিত হলো ধানখেতের উপর তোমারই সংহত শরীরের মতো, দূরে

আর তার নিপীড়ন দেহ ভরে আস্বাদ করে আস্তে-আস্তে উন্মোচিত হতে থাকে আমার সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত অন্ধকার!

*

জল

জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?
জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন
কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?

*

ইট

নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়!
ছিল, নেই- মাত্র এই; ইটের পাঁজায়
আগুন জ্বালায় রাত্রে দারুণ জ্বালায়
আর সব ধ্যান ধান নষ্ট হয়ে যায়।

*

বাড়ি

আমি একটি বাড়ি খুঁজছি বহুদিন–
 মনে-মনে।
আলোর তরল জলে ভেসে যাব কবে!

বাড়ি কি পেয়েছ তুমি?

বাড়ি তো পেয়েছি আমি বহুদিন–
 মনে-মনে,
বাড়ি চাই বাহির-ভুবনে।

*

ঘর : ১

তোমরা যদি কথা বলতে চাও–
 এসো আমার ঘরে, আমি ঘর পেয়েছি,
এসো,
আমার ঘরে উদ্যত বন্ধুতা।

তোমরা যদি ছায়া গুনতে চাও–
 এসো আমার ঘরে, আমার মুখের উপর আলো
পিছ-দুয়ারে ছায়া খরস্রোতা।

কিংবা যদি বাহিরই চাও, এসো এসো এসো
নীল পাথরে হাঁটি :

সেই মুহূর্তে নিভে গেল ঘরে সকল বাতি।

*

ঘর : ২

যে চায় তাকে আনিস
যে যায় তাকে আনিস
যে চায় তাকে আনিস ডেকে আনিস—
ঘরের কাছে আছে অনেক মানুষ।

যে যায় দূরে অনেক দূরে অনেক দূরে-দূরে
অনেক ঘুরে-ঘুরে
যে যায় তাকে আনিস ডেকে আনিস ঘরে আনিস
 ঘরের কাছে আছে ঘরের মানুষ!

দু-জন যেতে উজান পথে উজান যেতে-যেতে
ঘরের মুখে আগুন কেন জ্বালিস?

*

মধ্যরাত

আজ আর কেউ নেই, ঘুমন্ত ঘরের নীল জল,
 ঠান্ডা বারান্দার গায়ে মধ্যরাত দেবতার দীপে–
 হাতে খেলে যায় হাওয়া।

আজ চুপ করে ভাবো, এই রাত মৃদুজলঢেউ,
বড়ো একাকিনী গাছ, মাঝে-মাঝে কার কাছে যাব,
ঘুমায় ঘরের গায়ে ছায়াময় বাহিত প্রপাত,
 বুকে খেলে যায় হাওয়া।

দুইজনে পাশাপাশি, মাঝে কি পথিক নেই কোনো,
এখন বসন খোলো, দেবতা দেখুক দু-নয়নে,
শিশিরে পায়ের ধ্বনি সুদূর অধীর জলধি
শুধু বহে যায় হাওয়া।

আজ আর কেউ নেই, মাঝে-মাঝে কার কাছে যাব।

*

বৃষ্টি

আমার দুঃখের দিন তথাগত
আমার সুখের দিন ভাসমান।
এমন বৃষ্টির দিন পথে-পথে
আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।

আবার সুখের মাঠ জলভরা
আবার দুঃখের ধান ভরে যায়।
এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে
আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।

*

মুনিয়া

মুনিয়া সমস্ত দিন বাঁধা ছিল।

খুব বারোটায় উঠে চুপি চুপি খাঁচা খুলে
‘উড়ে যা’ ‘উড়ে যা’ বলে প্ররোচনা দিতে
আমার বুকের দিকে তুলে দিল ঠ্যাঙ–

জ্যোৎস্নায় মনে হলো বাঘিনীর থাবা।

*

রাঙামামিমার গৃহত্যাগ

ঘর, বাড়ি, আঙিনা
 সমস্ত সন্তর্পণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা
ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে–

ছড়ানো পালক, কেউ জানে না!

*

মধ্যদুপুর

এখন আরো অপরিচয়
এখন আরো ভালো,
যা-কিছু যায় দুপুরে যায় উড়ে।

যেমন ছিল বাঁধাদিনের চতুঃসীমায় বাঁধা,
 ঝিমায় ওরা ঝিমায়,
শহর, তার বুকের মধ্যে দীর্ঘ পুকুর, শোনে
দীর্ঘ পুকুর খোলা আকাশ হা-হা,
পুরোনো সব রুপোর বাসন ছড়ানো অঙ্গনে।

দুপুরে যায়, দুপুরে যায়, ঝিমত্ত তন্তুরে
নিভৃতে যায় খুঁড়ে–
কেবল যখন সুপুরিচয় চয়ন করতে এসে
ওরা হঠাৎ নিজের মুখে ভেসে
সামনে দেখে পুকুর–

আমার চতুর্দিকে শহর, চতুর্দিকে আলো,
আমি তখন মধ্যদুপুরবেলা।

*

হাজারদুয়ারি

একবার তাকাবে না? নিজের মুখের দিকে চোখ ভরে?
মাঝে-মাঝে ফিরে দেখা ভালো নয়?
তুমি হাত ধুতে পারো এত গঙ্গাজল জানে কোন্ দেশ!
 মাঝে-মাঝে ধুয়ে নেওয়া ভালো নয়?
 তাই আমি আমার দক্ষিণ হাত
 রেখেছি নিজের বুকে,
তুমি এসো, মাথা পাতো, যেন কত ঘর ঘুরে এলে
এখন লহরী নয়
যত চুপ তত দূর দুয়ারে দুয়ার খুলে যায়
দুয়ারে দুয়ার খুলে যায়
এই এক শুদ্ধতর।
হাজারদুয়ারি ভালোবাসা।

*

ছুটি

হয়তো এসেছিল। কিন্তু আমি দেখিনি।
এখন কি সে অনেক দূরে চলে গেছে?
যাব যাব। যাব।

সব তো ঠিক করাই আছে। এখন কেবল বিদায় নেওয়া,
 সবার দিকে চোখ,
 যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম।

কী নাম?
 আমার কোনো নাম তো নেই, নৌকো বাঁধা আছে দুটি,
 দূরে সবাই জাল ফেলেছে সমুদ্রে–

ছুটি, প্রভু, ছুটি!

*

ভাষা

এই তো, রাত্রি এল। বলল, এখন তোমার কথা বলো।

কিন্তু বলবে কোন্ ভাষায়? না, এই পুরোনো ক্ষয়ে-যাওয়া কথা তোমার ঠোঁটে ধোরো না– সেই তোমার ঠোঁটে, যাকে দেখেছিলুম মলিন মেঘের মতো ঝিমিয়ে থাকতে, কিংবা উথলে উঠতে ঝোড়ো রাতে পদ্মর মত্ত ভালোবাসায়, না- তোমার সেই ঠোঁটে তুলে নিয়ো না কত জন্মের এই ব্যবহৃত ভাষা, জীর্ণ, উচ্ছিষ্ট।

বলবে কোন্ ভাষায়? যে ভাষায় বাচাল প্রকৃতি চিৎকার করতে থাকে আমার চোখের সামনে, তার সব রং একত্রে এসে ঘুলিয়ে দেয় আমার আনন্দের স্বাদ, ‘সরে যাও’ ‘সরে যাও’ বলে দৌড়ে বেড়ায় আন্তরাত্মা, না, সেই দারুণ প্রকৃতির রহস্য তুমি তুলো না তোমার ঠোঁটে।

এই পৃথিবী না থাকলে থাকত শুধু অন্ধকার। কিছুই থাকত না এই সৌরলোক না থাকলে। কিন্তু কোথায় থাকত সেই না-থাকা, কোন পাত্রে? অন্তহীন এই নাস্তি যখন হা হা করে এগিয়ে আসে চোখের উপর, দুলে ওঠে রক্ত- তখন তুমি কথা বলো মহাশূন্যে অন্ধকারের ফুটে ওঠার মতন, সেই তোমার ভাষা হোক প্রথম আবির্ভাবের মতো শুচি, কুমারী– শষ্পের মতো গহন, গম্ভীর

এই তো, এই তো রাত্রি হলো। বলো, এখন তুমি কথা বলো।

*

সময়

তোমরা এসেছ তাই তোমাদের বলি
এখনও সময় হয়নি।
একবার এর মুখে একবার অন্য মুখে তাকাবার এইসব প্রহসন
আমার ভালো লাগে না।
যেখানে আমার কবর হবে আজ সেখানে জল দিতে ভুলে গিয়েছি
যেসব শামুক তোমরা রেখে গিয়েছিলে
তার মধ্যে গাঢ় শঙ্খ কোথাও ছিল না
 তোমরা এসেছ, তোমাদের বলি
গ্রহে-গ্রহে টানা আছে সময়বিহীন স্তব্ধ জাল
আমি চাই আরো কিছু নিজস্বতা অজ্ঞাত সময়।

*

ভিক্ষা

আর আমাদের এই কয় মুষ্টি ভিক্ষা দেবে প্রিয়।
 আমি জানি তুমিও একদিন হবে বিশ্বাসঘাতক
রক্ত নেবে ছল করে বসে আছো–
 সব জেনেশুনে তবু জানু পেতে দিই
 তোমার নিজের হাতে ভিক্ষা নিতে এত ভালো লাগে!

*

নাম

 কোনো জোর কোরো না আমায়।

শব্দগুলি খুলে যাক, খুলে-খুলে যায়
 যেমন-বা ভোর

জলস্রোত বহুদূরে টেনে নিয়ে যেমন পাথর
 জনহীন টলটল শব্দ করে

দিগন্তের ঘরে
আমাদের নাম মুছে যায় চুপচাপ। খুব ক্ষীণ

টুপটুপ খুলে পড়ে ঘাসের মাথায় নীল, আর কোনো দিন
কোনো জোর কোরো না আমাকে।

*

এমনি ভাষা

মনে কি ভাবে লাজুক, লজ্জাশীলা?
 এসব আমার অনেক হলো
এখন
 রাস্তা জুড়ে থমকে আছে ট্রামের সেতু
 দীর্ঘ, তবু অনিশ্চিত বৈদ্যুতিক।
কোথায় যাবে যাত্রীদল, যাত্রিণীদল, চকঝমকের যাত্রিণীদল?
এসো, আমার অল্প পায়ের সঙ্গে নামো।
 মনে কি ভাবো লাজুক? আমার এমনি ভাষা।

*

সহজ

আমিই সবার চেয়ে কম বুঝি, তাই
আচম্বিতে আমার বাঁ-পাশে এসে হেসে
 পিঠ ছুঁয়ে চলে যাও;
‘অত কি সহজ?’ বল তুমি।

তার পর আমার কী বাকি থাকে? অপরাধ
আমার দু-পাশে কেন কাশফুল হয়ে ভরে ওঠে?
 শরীরে শারদবেলা নত হয়ে নেমে আসে যেন-বা আমিই শস্যভূমি
অত যে সহজ নয় মাঝে-মাঝে তাও ভুলে যাই।

*

প্রতীক্ষা

কড়িকাঠ থেকে বুকের রক্ত পর্যন্ত ঝুলে-পড়া মাকড়সা
অনেকদিন পরে ঢুকতে গেলে জাল জড়িয়ে ধরে মাথায়,
বলে- এসো এসো, এই তো কত গ্রীষ্ম বর্ষা
 কত শীত হেমন্ত বসে আছি তোমার প্রতীক্ষায়, এসো–
 ব’লে ভিজে অন্ধকারে মনোহীনতার গন্ধে টেনে নিতে-নিতে
 শুষে নেয় আমার সমস্ত উদ্ভিদ, আমার অন্তরাত্মা।

*

প্রতিহিংসা

যুবতী কিছু জানে না, শুধু
প্রেমের কথা ব’লে
 দেহ আমার সাজিয়েছিল
প্রাচীন বল্কলে।

আমিও পরিবর্তে তার
রেখেছি সব কথা
শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি
আগুন, প্রবণতা।

*

গুল্ম, ঈথার

আমি যখন নিচু হয়ে পাথরকুচি কুড়াই
কয়েকটা জটিল গুল্মের ছায়া পড়ে আমার মুখে
আড়াআড়ি।

আর যখন শূন্যমুখে উলটোমুখে আকাশে তুলে দিই হাত
 মুখের কিনার ঘিরে ঢেউ দেয় জয়ন্ত ঈথার আভাময়
অদৃশ্যতা।

‘ও এমন একই সঙ্গে দু-রকম কেন?’–ওরা ভাবে।

*

দ্বা সুপর্ণা

‘কেমন করে পারো এমন স্বাভাবিক আর স্বাদু আহার
সব জায়গায় মানিয়ে যাও কিছুই তোমার নিজস্ব নয়
কেমন করে পারো?’

‘নষ্ট আমি কিছুই আমার নিজস্ব নয়; ডালে-ডালে
 পাতায়-পাতায় স্বাদু আহার বিষ অথবা বাঁচার আগুন
 ধরে ব্যাপক মাটি–
 দীর্ঘতর বট, এমন জটিলঝুরি সমকালীন
সব জায়গায় থাকি, আমার
 অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।’

*

চরিত্র

এক পাথরে বসে থাকার অনন্যতা হয়তো ভালো।
 তোমাকে সব দেখতে পায়, তুমিও সব দেখতে পাও
মুখের সঙ্গে মুখের ছায়া স্থির ছবিতে নিসর্গ, তা-ও
হয়তো ভালো। সত্যি ভালো?

নাকি পাথর থেকে পাথর টপকে চলার যখন-তখন?
 পাহাড়পায়ে প্রণত পথ
অল্প নীচে বুকের জমি ভরে যাবার উড়ন-নদী
স্বচ্ছ এবং নগ্ন তরল,

টপকে চলা, নিসর্গপট ওলটপালট মুখের আড়ে
নীলসবুজে লড়াই সারে
পিছনে চুল মেঘলা ওড়ে, নবীন শরীর চলচ্ছবি
পাথর থেকে পাথরে যায় ঐ যুবতী, জীবনসমান
সেই যাওয়া কি চরিত্র নয়?
 আরেক রকম চরিত্রবান।

*

যখন প্রহর শান্ত

যখন প্রহর শান্ত, মধ্যম, নিবিড় আভাসিনী
সমস্ত ব্যসন কাম উজ্জ্বলতা ঘুমিয়ে পড়েছে
 বাহির-দুয়ারে চাবি, আমি নতজানু একা
আমার নিজের কাছে ক্ষমা চাই, পরিত্রাণ, প্রতিটি শব্দের শাস্তি–
 বধির দিনের যাত্রী
কর্মে ছিল অধিকার, আমাকে কি সমর্পণ সাজে?

*

চাবি

জাল করেছে জাল করেছে ওরা আমার সই
 জাল করেছে—ব’লে যেমন ধরতে গেলাম চোর
 ঘুরিয়ে দিয়ে মুখ
দেখি, এ কী, এ তো আমিই, আমিই দুঃসাহসে
 জাল করেছি জাল করেছি, হা রে আমার সই
জাল করেছি আমি আমার সর্বনাশের চাবি।

*

আড়াল

আমি আড়াল চেয়েছিলাম চার কিনারে।
 কিন্তু প্রভু ভুল কোরো না
 রাত্ৰিসকাল
পথই আমার পথের আড়াল।

দু-হাত তোমায় বাড়িয়ে দিইনি সে কি কেবল আত্মাভিমান?
 যখন মুঠো খুলতে গেছি হাতের রেখায় দীনাতিদীন
কাল রজনীর নিষ্ফলতা চাবুক মারে।

এখনও ঠিক সময় তো নয়, শরীর আমার জন্মজামিন
পথিক জনস্রোতের টান
তার ভিতরে এমন উজান
আমি আড়াল চেয়েছিলাম পিছনদাঁড়ে।

*

দেহ

আসছিলুম সনাতনীর মাঠ পেরিয়ে।
বুকেও অল্প চাপ ছিল, সলতে জ্বলার তাপ ছিল,
মুখোমুখি হতেও পারে গ্রহের ফেরে।
 পাশে পাশে সতর্জন
 ‘দেহ কোথায়’ ‘দেহ কোথায় বলতে বলতে তাড়া করল
 নাগরজন!
এখন ওসব শুনতে পাই না, পকেটে এক ঝাপসা আয়না,
ভাঙা চিরুনি, চাদরমুড়ি, নৌকোচটি–
 আসছিলুম, আসছিলুম তোমার প্রতি।

*

জন্মদিন

ছিল দিন জন্মদিন তোমার উৎসবে কাল রাত
প্রখর কৌতুকে ছিল তরলবসনা নারীদল
 যাবার বেলায় ছটা পরিচ্ছিন্ন মাংস আর হাড়
‘বন্ধ করো দ্বার’ বলে খলখল নেমেছিল হাসি
 বাইরে যে পাখি ছিল মনেও পড়েনি তার নাম
আমি ফুল বুকে নিয়ে লজ্জাহীন ঘুমিয়ে পড়েছি
সুযোগের পাশাপাশি প্রতিহারী ছিল যে বেড়াল
 আমার একাকী পাখি খুন করে খেয়ে গেছে কাল।

*

নষ্ট

নষ্ট হয়ে যাবার পথে গিয়েছিলুম, প্রভু আমার!
তুমি আমার
নষ্ট হবার সমস্ত ঋণ
কোটর ভরে রেখেছিলে।

কিন্তু তোমার অমোঘ মুঠি ধরে বুকের মোরগঝুঁটি
সন্ধ্যাবেলা শুধু আমার
 মুখের রঙে
ঝরে পড়ার ঝরে পড়ার
ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু।

*

উদাসীনা

পা ছুঁয়ে যে প্রণাম করি সে কি কেবল দিনযাপনের নিশান?
আমি কেবল দেখতে চেয়েছিলাম
 নির্জীব পা সরিয়ে নাও কিনা।

দুঃখ এত ঝরাই, সে কি জানতে চেয়ে দেবদূতেরা কী চান?
আমি কেবল দেখতে চেয়েছিলাম
 তোমার মুখে সত্যিকারের ঘৃণা।

এখন আমি বুঝতে পারি আমায় নিয়ে কী চাও তুমি।
 দুপুরজ্বালার মধ্যখানে।
সূত্রপাতে অবসানে
 তুমি আমায় দেখতে চেয়েছিলে
 দু-হাত ধরেও থাকব উদাসীনা।

*

সুন্দর

লোকে তো কোথাও যাবে, তাই আসি, এমন কিছু নয়
নিহিত পাতালছায়া ভরে ছিল আকাশপরিধি।
কিছু তো দেখবে লোকে, তাই দেখি, ফসলের সীমা,
 বুকের গেরুয়া জল, দ্বাদশীতে সব গ্রাম মিলেমিশে যায়
জেগে ওঠে রাত।
 স্বভাবই তো পথ হারানো, তাই পথ হারিয়ে ফেলেছি।
তবে জানি, মনে পড়ে কে এনেছে ভুলিয়ে-ভুলিয়ে।
পাহাড়িয়া নিঃসাড়, কথকতা ছিল না কোথাও,
গোপনে নিজেই আমি মাছ ধরবার নাম করে
ডুবিয়ে দিয়েছি তাকে নিরিবিলি সাঁওতালি দিঘিতে।
ধনুক ছোঁড়েনি কেউ, বেঁচে গেছি, খুব বেঁচে গেছি,
নিখাত পাতালছায়া ভরে দেয় দিগন্তদখিনা।

লোকে তো জানে না কিছু। জানুক না, টেনে নিক পাপ,
ঝরে যায় নীল স্রোত, গাঢ় খাদে করুণার টান
যদি-বা নিজেরই ছায়া হঠাৎ জড়িয়ে ধরে বলে :
‘তুমি কি সুন্দর নও? বেঁচে আছো কেন পৃথিবীতে?’