নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা

নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্ৰা 

আকাশে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি উড়ছিল, সেগুলো তাড়াতাড়ি নেবে আসে। ব্যাটা ছেলেরা কাজ ভুলে আরাম ছেড়ে রাস্তায় বেরোয়, পর্দানশিন মেয়েরা দাঁড়ায় বেড়ার পেছনে পর্দার আড়ালে। ঔৎসুক্যের সীমা নাই যাদের তারা রাস্তার মোড়ে-চৌমাথায় জড়ো হয় এবং ন্যাংটা ছেলেরা বাঁদর-নাচ হবে মনে করে তারস্বরে চিৎকার করে দিগ্বিদিগশূন্য ছুটতে শুরু করে। 

সারা শহরে খবর পৌঁছে গেছে। 

খবরটা অতিশয় বিচিত্র। 

সেটি এই যে, বৃদ্ধ সদরউদ্দিন একটি অত্যাশ্চর্য অন্তিমখেয়াল পূর্ণ করতে পথে নেবেছে। খাড়া নাকে কড়া রোদ, গর্তে-ঢোকা চোখে ঘোলাটে অন্ধকার এবং লম্বা শীর্ণ হাড়সার পায়ে কাঠ-কাঠ ভাব, শহরের অলিগলি দিয়ে হেঁটে-হেঁটে সে বন্ধু-শত্রুর সন্ধান করে। মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে মানুষের যখন মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো কামনা থাকে না, যখন তার সমগ্র ইন্দ্রিয় অন্ত্র-তন্ত্র অধীরভাবে চায় যে জীবনের যবনিকা ঘটুক, যখন আশা-ভরসা মায়ামমতা ব্যথা বেদনা সবই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়, তখনই সদরউদ্দিন তার অন্তিমশয্যা ছেড়ে একটি অদ্ভুত মনস্কামনা পূর্ণ করতে বের হয়েছে। তার সময় নাই সে-কথা সে জানে। শয্যা ত্যাগ না করলে এতক্ষণে তার মৃত্যুও এসে যেত। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার মনস্কামনা পূর্ণ না করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত পাকে-প্রকারে দৃঢ়সঙ্কল্পের বলে সে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখবে। যে-মানুষ মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছেও উগ্রসূর্যের তলে পথে-পথে এমনভাবে হাঁটতে পারে, সে আর মৃত্যুর ক্রীতদাস নয়। এখন ফেরেশতা নয়, সে-ই সাব্যস্ত করবে তার প্রাণান্তের সময়। 

তার অন্তিম বাসনা বন্ধু-মিত্র-শত্রুর নিকট হতে মাফ চাওয়া। তাদের কাছে মাফ না নেওয়া পর্যন্ত সে মরবে না, লকলকে পায়ে অনিশ্চিত পদক্ষেপে যে-শহর ভ্রমণ শুরু করেছে সে-শহর ভ্রমণ হবে না। তার বাসনাটি পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত সে এ-দুনিয়া পরিত্যাগ করবে না। 

অবশেষে সদরউদ্দিন কে বন্ধু কে শত্রু তার বাছবিচার আর করে না। সে বিষয়ে কখন নিশ্চিত হতে পারে? তাছাড়া মৃত্যুর সম্মুখে সে-বাছবিচার নেহাতই অর্থহীন মনে হয়। সকলের কাছেই মাফ চায় সদরউদ্দিন। যার সঙ্গে সারাজীবনেও একটিবার কথার আদান-প্রদান করে নাই, তাকেও বাদ দেয় না। কে জানে কখন সে নিজেরই অজ্ঞাতে শুধু চোখের অবহেলায়ই কার হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। তবে কারো কাছে সে মাফ ভিক্ষা করে না, দাবিই করে। 

একগুঁয়ে-ভাবে হাতের লাঠি ঠুকে ঠুকে মরণাপন্ন বৃদ্ধ সদরউদ্দিন অগ্রসর হয়। মাঝে-মাঝে লাঠি ঘুরিয়ে সে তার পেছনে ছেলেদের দলটিকে যথাস্থানে রাখে। তারা তার পেছনে ফেউ ধরেছে আজরাইলকে দেখবে বলে। তাতে তার আপত্তি নাই। তবে যখন তারা তার কাপড় ধরে টানে বা হাত ধরতে চায়, তখন সে বিরক্তই বোধ করে। 

লাঠি দিয়ে সদরউদ্দিন তার মেয়েকেও দূরে রাখে। চুল আলু-থালু, মুখে উদ্‌ভ্রান্ত ভাব, মাথা ঘোমটাশূন্য—মেয়েটি তার পিছু ছাড়তে নারাজ। সে কেবল গোঙায়, বৃদ্ধ বাপকে ঘরে প্রত্যাবর্তন করবার জন্যে কাতরকণ্ঠে অনুরোধ করে। কিন্তু সদরউদ্দিন তার গোঙানিতে বা অনুরোধে কান দেয় না। সে জানে তার মেয়ের ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে না : কায়দামাফিক বিছানায় শুয়েই সে তার শেষনিশ্বাস ত্যাগ করবে। 

বৃদ্ধ সদরউদ্দিন এগিয়েই চলে। তাকে দেখে মনে হয়, তার কাম্যবস্তু না এ-জীবনের না সে-জীবনের। গলির পর গলি পেরিয়ে চলে সে, কাঠের পা-দুটি অব্যর্থভাবে সম্মুখদিকে নিক্ষিপ্ত হয়। সে-পা জীবনীশক্তিতে চলে বলে মনে হয় না। অত্যাশ্চর্যভাবে সোজা তার পিঠ, মাথা উন্নত—যন্ত্রচালিত পুতুলের মতোই সে এ-পথ সে-পথ অতিক্রম করে। 

থেকে-থেকে মেয়েটি নিজেকে যেন সামলাতে পারে না। তখন তার গোঙানি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। একবার বৃদ্ধ সদরউদ্দিন ঘুরে দাঁড়িয়ে অপ্রত্যাশিত শক্তির পরিচয় দিয়ে লাঠি ঝেঁকে মেয়েকে শাসন করে। অবশ্য লাঠিকে মেয়ের ভয় নাই। কেবল পুনর্বার তার বাপের অনমনীয় মনের পরিচয় পেয়ে সে এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। সদরউদ্দিন তার কানে খিল দেয়। 

যাদের কাছে সদরউদ্দিন মাফ চায়, তারা যে সন্তুষ্ট হয় তা নয়। কেউ গভীরভাবে লজ্জিত হয়, কেউ অপ্রস্তুত হয়, কেউ-কেউ আবার ভয়ও পায়। কিন্তু সন্তুষ্ট হয় না কেউ-ই। 

মাফ? কিসের জন্যে মাফ? 

উত্তর দিতে তারা দ্বিধা করে, কেউ-কেউ আবার বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলে যেন। যে-মানুষ জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে, যার সম্মুখে কেবল অনন্তকালের সীমাহীনতা, তার সামনে দাঁড়িয়ে, মুখে ভাষা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। 

তবে লোকেরা যখন উত্তর দিতে দ্বিধা করে তখন সদরউদ্দিনের মেয়ের ভয়ের সীমা থাকে না। ভীতত্রস্ত কণ্ঠে সে বারবার বলে, মাফ দিয়ে দেন, মাফ দিয়ে দেন। মরবার আগে একটি বুড়ো মানুষ মাফ চাইছে, তাকে মাফ করে দেন। 

কিন্তু কিসের জন্যে মাফ? 

কারো উত্তরের জন্যে অবশ্য সদরউদ্দিন অপেক্ষা করে না। তার সময় নাই। মৃত্যু এখন তার ক্রীতদাস হলেও তার সময় অফুরন্ত নয়। যারা উত্তর দিতে দ্বিধা করে বা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারা কিছু বলবার আগেই সে হাঁটতে শুরু করে। মেয়েটি তার পেছনে আবার ছুটে আসে। 

নীল আকাশে উগ্র রোদ; সেখানে একটি ঘুড়িও আর নাই বটে কিন্তু চিল ওড়ে। কড়া রোদে সদরউদ্দিনের নাক ঝলকায়। এবার তার পা-দুটি কেমন অনিশ্চিতভাবে বাঁয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। যেন যন্ত্রের তেজ কিছু কমে এসেছে। তবে সে পূর্ববৎ অগ্রসর হতে থাকে। তার মুখে অজাগতীয় ভাব। দৃষ্টি তার সম্মুখে নিবদ্ধ থাকলেও অন্য মানুষরা যা দেখে সে তা যেন দেখে না। হয়তো সে সত্যিই দেখে না। হয়তো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সে যে-সত্য দেখতে পায়, সে-সত্য সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। একই মুহূর্তে সমস্ত পৃথিবী, ঘরবাড়ি জীবনের ধারা—সবই যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে তা তাদের কল্পনাতীত। হয়তো সদরউদ্দিন একটি নিরাকার শূন্যতাই কেবল দেখে, যে-শূন্যতা চতুর্দিকে ঘিরে থাকলেও দেখার সময় আসার আগে কেউ তা দেখতে পায় না। 

এক সময়ে সদরউদ্দিনের মুখের কথা শুকিয়ে যায়। তাতে তার অবশ্য কোনো অসুবিধা হয় না। সারা শহরে সকলেই এখন জানে কেন সে মৃত্যুর ছায়া পেছনে নিয়ে নাকে সূর্যের ঝলক মেখে এমন অলিগলি ঘুরছে। যাদের কাছ থেকে মাফ চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে, তাদের সামনে কেবল থামলেই হয়। মনের কথা মুখ ফুটে না বললেও তারা জানে বৃদ্ধ কী চায় তাদের কাছে। একটু থেমে তারপর সে আবার হাঁটতে শুরু করে। 

.

তারপর লোকেদের মধ্যে পরিবর্তন আসে। 

শহরের মধ্যে দিয়ে একটা মুমূর্ষু মানুষের এমন বিস্ময়কর বিচিত্র যাত্রা উজ্জ্বল দিনেও অবশেষে মানুষের মনে একটা ভীতির সৃষ্টি করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার আকাশে হঠাৎ মেঘ আসার মতো আকস্মিকভাবে আসে সে-ভীতি। রাস্তায়, পাশে সারি সারি বাসা-বাড়িতে, দোকানপাটে, গাছে-বাগানে, পড়োজমিতে ক্রমশ একটা নিঃশব্দতা ঘনীভূত হয়ে ওঠে এবং সে-নিঃশব্দতার মধ্যে মানুষের মনের গভীরতম অঞ্চলে একটি নামহীন আশঙ্কা-ভীতির সৃষ্টি হয়। সে-শঙ্কা-ভীতি অসহনীয় হয়ে পড়লেই কোনো বাড়ির গহ্বরে একটি অদৃশ্য নারী তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে। তারপর রৌদ্র উজ্জ্বল আকাশও যেন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। 

সভয়ে মেয়েটি তার বাপের একটি হাত আঁকড়ে ধরে। 

বাবা, বাবা এবার ফিরে চল। তোমার কারো কাছে মাফ চাইতে হবে না। সবাই তোমাকে মাফ করে দিয়েছে। 

অবশ্য তার উন্মাদপ্রায় মেয়ের মিনতি বৃদ্ধের কানে পৌঁছায় না। পূর্ববৎ লাঠি ঠুকে অনিশ্চিতভাবে পা ফেলে সে অগ্রসর হয়। দেহ ঋজু, মাথা উঁচু। 

ভীতি-শঙ্কা ক্রমশ বাড়তে থাকে। মৃত্যুকে পিঠে নিয়ে কেন সে মানুষের বাড়িঘরে দুয়ারে-ভিটেতে অমঙ্গলের ছায়া ফেলে হাঁটছে? 

সূর্য আরো চড়ে, সামান্য হাওয়াটুকুও থেমে পড়ে। মনে হয়, নীল আকাশে চিলগুলোও আর নাই যেন। 

শহরের যে-সব স্থানে সদরউদ্দিন এখনো পৌঁছায় নাই, সেখানে লোকেরা অপেক্ষা করে বটে কিন্তু তাদের অন্তরে এখন অস্থিরতা। তারা আর অপেক্ষা করতে চায় না। যে-মুমূর্ষু বৃদ্ধলোকটি এখনো এসে পৌঁছায় নাই, তার পদশব্দের জন্যে কান খাড়া করে রাখলেও মনে তাদের সে-কৌতূহল আর নাই। কৌতূহলের স্থানে সে-ভীতিরই সঞ্চার হয়েছে যে-ভীতি মানুষকে পলায়নমুখো করে, তার মায়ামমতা দয়াদরদকে ধ্বংস করে, কখনো-কখনো তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরির মতো মারাত্মক হয়ে ওঠে। যে-বৃদ্ধ লোকটির ছায়া এখনো তাদের পথে পড়ে নি কিন্তু শীঘ্র পড়বে, সে-ছায়া মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দিনই আনে। সে-ছায়া শয়তানের ছায়া। সদরউদ্দিন পথে-পথে হাঁটছে এবং প্রতি বাড়িতে অকল্যাণ-অমঙ্গলের ছায়া ফেলছে। 

অবশ্য বৃদ্ধ সদরউদ্দিন সে-বিষয়ে সচেতন নয়। কেবল তার মেয়ে মুখে কাপড় দিয়ে থেকে-থেকে একটা অদম্য কান্নাকে সংযত করার চেষ্টা করে। 

একটা মোড় নিয়ে সদরউদ্দিন এবার একটি অতি সঙ্কীর্ণ গলিতে প্রবেশ করে। দ্বিতীয়বার একটি অদৃশ্য নারী ভূত-দেখা-ভয়ে তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে। সে ভূত দেখে না অবশ্য। সে মৃত্যুকে দেখে, সশরীরে, তারই দোরগোড়ায়। যে-মেয়েলোকটি বেড়ার ফাঁকে চোখ পেতে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে ছিল বৃদ্ধ সদরউদ্দিনকে দেখবে বলে, এবার সে ছুটে ভেতরে গিয়ে তার এক বছরের শিশুকে বুকে চেপে ধরে। চিৎকারটা অতি কাছে থেকে আসে বলেই মুহূর্তের জন্যে একটা বিরক্তির ভাব দেখা দেয় বৃদ্ধের মুখে। 

দু-কদম পরে একটি মানুষ ক্ষিপ্রগতিতে বেরিয়ে আসে! তার মুখে ভয়-ক্রোধের মিশ্রিত ভাব। তার ঠোট থরথর করে কাঁপে। 

এখানে থেমো না। যাও, যাও। 

সেখানে থামার কথা নয়, তাই সদরউদ্দিন পূর্ববৎ অগ্রসর হতে থাকে। তার চলার গতি না হয় শ্লথ, না হয় দ্রুত। আগের মতো ঘোলাটে চোখ দূরে কোথাও নিবদ্ধ। অনতিদূরে ময়লার স্তূপ থেকে লেজ নাড়িয়ে একটা লোম ছাড়া কুকুর ঘেউ করে ওঠে। 

বাবা বাবা! এবার ফিরে চল। নিদারুণ ভয়ে তার মেয়ে বুক-ফাটা স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। সে বোঝে, হাওয়া সত্যিই বদলে গেছে। সে জানে এবার লোকেরা তার মুমূর্ষু বৃদ্ধ বাপকে বদদোয়া দেবে। যে-মানুষ লোকদের কাছে ক্ষমা চাইতে বেরিয়েছে শেষ পর্যন্ত সে তাদের ঘৃণা-বদদোয়া নিয়েই ঘরে ফিরবে। 

সদরউদ্দিন লাঠি ঘুরিয়ে মেয়েটিকে হটিয়ে দেয়। 

.

সারা সকাল এ-গলি সে-গলি করে সর্পিল ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে চললেও সদরউদ্দিন একটি বিশেষ লক্ষ্যস্থানের দিকেই অগ্রসর হয়। সেখানে পৌঁছলেই তার এ-বিচিত্র যাত্রার শেষ হবে, তার মনস্কামনা সম্পূর্ণভাবে পরিতৃপ্ত হবে। 

লক্ষ্যস্থানটি আখলাক তরফদারের বাড়ি। জীবনে যদি কাউকে সে অবিচ্ছিন্নভাবে এবং সমগ্র সত্তা দিয়ে ঘৃণা করেছে এবং সে ঘৃণার দরুন তার ক্ষতি করেছে নানা প্রকারে, তবে সে-লোক ঐ আখলাক তরফদার। 

সে-ঘৃণার উৎপত্তি হয় বাল্যকালেই। নদীর ধারে তাদের নিদারুণ হস্তযুদ্ধের কথা, ঘনায়মান সন্ধ্যায় সর্ষের ক্ষেত থেকে ভেসে আসা ভারি গন্ধের কথা এতদিন পরেও সদরউদ্দিনের মনে আছে স্পষ্টভাবে। সে-সব যেন গতকালের ঘটনামাত্র। 

বাল্যকালের শত্রুতা নয়। সে-শত্রুতা থেকে-থেকে ক্রূর রূপ ধারণ করলেও তা একেবারে স্নেহ-মমতাবিবর্জিত নয়। তবু তাদের দুজনের মধ্যে তখন যে-শত্রুতার জন্ম হয়, তা বয়ঃক্রমে কেবল তীক্ষ্ণতর এবং সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। আজ আখলাক তরফদারের মাথায় টাক, পেটে থলথলে ভুঁড়ি এবং তার নিস্তেজ চোখে সারাজীবনের শ্রান্তি-দুর্বলতা। তবু সে-চোখ সদরউদ্দিনের ওপর পড়লে ক্রোধান্ধ পশুর মতো সে-চোখ কালো এবং স্থির হয়ে পড়ে। 

বৃদ্ধের গতি ঈষৎ দ্রুত হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, আখলাক তরফদারের কাছে তাকে পৌঁছতেই হবে। তার মাফ না পাওয়া পর্যন্ত সে মরতে পারে না। 

তার জবান যে শেষ হয়ে গেছে, সে-কথায় সে বিন্দুমাত্র ভাবিত হয় না। সে জানে একবার সে তার সামনে দাঁড়ালেই আখলাক বুঝবে কেন সে এসেছে। তারপর তাকে ক্ষমা করতে তার বিলম্ব হবে না, তাকে দেখে তার বাল্যবন্ধু এবং চিরশত্রুর চোখ এবার ক্রোধান্ধ পশুর চোখের মতো কালো এবং স্থির হয়ে উঠবে না। বরঞ্চ তাতে স্নেহ-মমতা এবং ক্ষমাই দেখা দেবে। 

অকস্মাৎ একটি অপরিসীম প্রত্যাশায় বৃদ্ধ সদরউদ্দিন কেমন উদ্বেলিত হয়ে পড়ে, তার শীর্ণ দেহে একটু কম্পন জাগে। 

তাদের আজীবন শত্রুতার কারণ কী? যে-মুমূর্ষু মৃত্যুকে ঠেকিয়ে বিছানা ছেড়ে শহরের এতখানি পথ অতিক্রম করে এসেছে সে-মানুষ এসব প্রশ্নের কোনোই যথাযথ উত্তর পায় না আজ। 

নানা স্মৃতি বিপুল বেগে এসে তার মন ভাসিয়ে দেয়। তার কানে আসে বনপথের গরুগাড়ির চাকার আওয়াজ, নাকে লাগে সন্ধ্যার শ্রান্ত গন্ধ। বাল্যকালে সদরউদ্দিন নেহাতই রোগাপটকা ছেলে ছিল। তবু তার মধ্যে ছিল অত্যাশ্চর্য শক্তি। একদিন পথের পাশে ফেলে আখলাককে সে ভীষণভাবে মেরেছিল। আখলাক একটি শব্দ করে নাই। তারপর হঠাৎ হ্যাঁচকা টান দিয়ে বালক সদরউদ্দিন তার আনকোরা নতুন শার্টটি ছিড়ে ফেলে। মাত্র দুদিন আগে ঈদের উপলক্ষে তার বাপ তাকে সেটি উপহার দিয়েছিল। সে-ছেঁড়া শার্টটির জন্যেই আখলাক হঠাৎ অসহায় শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করে। তাকে অমনভাবে কাঁদতে দেখে সদরউদ্দিনের একটু দুঃখ হয়েছিল কি? না। বরঞ্চ একটি গভীর তৃপ্তিতে সারা মন ভরে উঠেছিল। 

হয়তো ঘটনাটি আজ আখলাকের মনে নাই। সেটি বাল্যজীবনের একটি নগণ্য ঘটনা। তবু সদরউদ্দিনের কাছে সেটি আজ খুবই বড় মনে হয়। মৃত্যুর সামনে মানুষ যখন তার সমগ্র জীবন বিশ্লেষণ করে দেখে, তখন কোন কথাটা বড় কোন কথাটা ছোট তা হয়তো তার পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। হয়তো জীবনে কিছুই ছোট নয়। তাছাড়া এখন সদরউদ্দিন যদি বাল্যকালের ঘটনা স্মরণ করে তার অর্থ এই যে, মানুষের জীবনে বাল্যকাল এবং বার্ধক্যকালের মধ্যে সত্যিই কোনো তফাত নাই। মানুষের জীবনের কোনো সময় অন্য কোনো সময়ের চেয়ে বড় নয়, ছোটও নয়। 

আখলাকের সামনে উপস্থিত হবার জন্যে একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বৃদ্ধ সদরউদ্দিন অধীর হয়ে ওঠে। তার গতি দ্রুততর হয়। 

একটু পরে পথের সামনে মানুষের জটলা নজরে পড়ে। দৃষ্টিহীন দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে সদরউদ্দিন সর্বপ্রথমে মনে একটু ভীতি বোধ করে। তারা কি তার পথরুদ্ধ করে দাঁড়াবে নাকি? তার যে সময় নাই। 

ক্ষুদ্র জনতাটিকে এড়ানো সম্ভব হয় না। তাদের পাশে একটি মসজিদ। সে-মসজিদ হতে তারা বেরিয়ে এসেছে। সদরউদ্দিন তাদের নিকটবর্তী হলে সাদা কামিজ পরিহিত একটি সৌম্যমূর্তি প্রৌঢ় ব্যক্তি ধীরপদে তার দিকে এগিয়ে আসে। 

দাঁড়ান। প্রৌঢ় ব্যক্তিটি হুকুমের কণ্ঠেই বলে। 

সদরউদ্দিন তার কথা শুনতে পায় বলে মনে হয় না। সে লাঠি ঠুকে অগ্রসর হয়। 

দাঁড়ান, দাঁড়ান। সৌম্যমূর্তি প্রৌঢ় ব্যক্তিটি আবার বলে। তার কণ্ঠে এবার উষ্ণতার ভাব। বলি, খোদার কাছে মাফ চেয়েছেন? 

কামিজ পরিহিত লোকটির একজন সঙ্গী কেশে গলা সাফ করে। এতক্ষণ সে অস্ফুটকণ্ঠে দোয়াদরুদ পড়ছিল। সে বলে, 

খোদাই আপনাকে মাফ করবে। মানুষের কী শক্তি কাউকে মাফ করে? 

তাদের কথা সদরউদ্দিনের কর্ণগোচর হয় না যে তা নয়। ক্ষীণ বাষ্পের মতো অস্পষ্ট তাদের কথা তার কানে ভেসে এলেও সে তা শুনতে পায়, তার মর্মও সে বোঝে। তবে সে যে শোনে তার কোনো বাহ্যিক প্রমাণ দেয় না। মসজিদের লোকদের উপদেশ বৃদ্ধের কাছে অর্থহীনই মনে হয়। তার জীবনে তর্কের সময় শেষ হয়েছে। খোদার কাছে সে মাফ চাইবে বৈকি। কিন্তু সেটা আলাদা ব্যাপার। এখন সে মাফ চাইছে তাদের কাছে যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন এ-নশ্বর পৃথিবীতে সে বসবাস করেছে এবং যে-পৃথিবী এখন সে ছেড়ে যাচ্ছে। তার মনের কথা ওরা কী করে বুঝবে। 

সদরউদ্দিন কোনো দিকে না তাকিয়ে লাঠি ঠুকে এগিয়ে যায়, তার পদক্ষেপে কেমন দৃঢ়তা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জনতা তাকে পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সদরউদ্দিন একটু এগিয়ে যেতেই ক্ষুদ্র জনতাটির মধ্যে ক্রুদ্ধ গুঞ্জন জাগে। প্রথমে কামিজ পরিহিত লোকটি সদরউদ্দিনের স্পর্ধা দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বাক্শক্তি ফিরে পেলে সে-ও রাগতভাবে কিছু বলে ওঠে। অবশ্য তার কথা সদরউদ্দিনের কানে আর পৌঁছায় না। অর্থহীনভাবে সে একবার লাঠি ঘোরায়। বিরক্তিকর মাছির দল তাড়ায়। 

তবে মসজিদের লোকদের ক্রোধে সদরউদ্দিনের মেয়ে ভয়ে মুষড়ে পড়ে। সে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে কামিজ পরিহিত মানুষটির দীর্ঘ আস্তিন চেপে ধরে বারেবারে চিৎকার করে বলে, 

তাঁকে বদদোয়া দেবেন না, বদদোয়া দেবেন না। 

কামিজ পরিহিত মানুষটি ক্রুদ্ধভাবে আস্তিনটি ছাড়িয়ে নেয়। 

চতুর্দিকে অন্ধকার দেখে মেয়েটি এবার হু-হু করে কেঁদে ওঠে। সে-কান্নায় কারো হৃদয় গলে না; সে-কান্না তার বৃদ্ধ বাপের কানেও পৌঁছায় না। বিরক্তিকর মাছির দল পশ্চাতে ফেলে আসতে সক্ষম হয়েছে বলে বৃদ্ধ সদরউদ্দিনের মন এবার নিরুপদ্রবে আখলাকের দিকে ফেরে। 

বাল্যজীবনের কলহ-বিবাদ হাতাহাতি মারামারি পরে একটি মারাত্মক হিংসা-বিদ্বেষেই পরিণত হয়। সদরউদ্দিন এখন নিজের দোষটি পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। সারাজীবন সে একটি বিষাত্মক একনিষ্ঠতার সঙ্গেই আখলাকের সুখ শান্তি-ধ্বংস করেছে। কী করে তার আর্থিক-বৈষয়িক ক্ষতি করতে পারে, তারই ফন্দিফিকিরে থেকেছে সদাসর্বদা। কু-মতলব চরিতার্থ করার কোনো সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করে নাই। বারেবারে আখলাককে সে নির্দয়ভাবে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করেছে। এবং প্রথমে সে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেই তাকে আক্রমণ করেছে বলে হতবিহ্বল আখলাক পাল্টা জবাব দিতে পারে নাই। এ-বিষয়ে সন্দেহ নাই, যে, সদরউদ্দিনের জন্যেই সে জীবনে কখনো সুখ-শান্তি বা আর্থিক সচ্ছলতা উপভোগ করতে সক্ষম হয় নাই। অথচ সদরউদ্দিন না থাকলে হয়তো সে-সব উপভোগ করার পথে কোনো বাধা থাকত না। বাল্যকালে আখলাক অধ্যয়নশীল সুবোধ ছেলে ছিল। পয়সার অভাবে শিক্ষা তেমন না এগোলেও সচ্চরিত্রতা-সততা-সাধুতার জন্যে মানুষের মনে সে যে-বিশ্বাস-আস্থার সৃষ্টি করত, সে-মূলধনের সাহায্যেই সে হয়তো অর্থসম্পদ সুখশান্তি লাভ করতে পারত। কিন্তু সদরউদ্দিনের জন্যে তা সম্ভব হয় নাই। সদরউদ্দিনের চক্রান্তে সে যে-দীর্ঘ মকদ্দমায় লিপ্ত হয়, সে-মকদ্দমায় সে সর্বস্বান্ত হয়। সদরউদ্দিন তার বুকে যে সর্বনাশী আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়, সে আগুনে সে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়। আজ সে ভগ্ন-দুস্থ মানুষ। মুখের বাঁ দিকে তার পক্ষাঘাত; চোখে পরাজয়ের নিবিড় গ্লানি। সে আজ যে-ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, সে-ধ্বংসস্তূপের সৃষ্টিকর্তা সদরউদ্দিনই। 

তার কাছে মাফ না চেয়ে কী করে মরতে পারে সদরউদ্দিন? 

আচম্বিতে মেয়েটি এবার তার গন্থব্যস্থলের কথা বুঝতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে নিদারুণ ভয়ে সে শীতল হয়ে পড়ে। তারপর সে তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করে বলে, 

বাবা বাবা, আর নয়,—এবার ফিরে চল। 

মেয়ের আর্তনাদটি বৃদ্ধের কানে পৌঁছলে কেবল তার পদক্ষেপটা আরো দ্রুত হয়। তার গর্তে-ঢোকা চোখটা ধকধক করে ওঠে একটি বিচিত্র উদ্দীপনায়।

.

গন্তব্যস্থল আর বেশি দূরে নয়। খেলার মাঠটা, তারপর আখলাকের বাসস্থান। সামনে ক্ষুদ্র উঠানটা সযত্নে লেপাজোকা; তার পাশে একটু গাঁদা ফুলের বাগান। কিন্তু সদরউদ্দিন জানে সে-বাড়ির কাঠে ঘুণ এবং তার ছিদ্রবহুল ছাদে বর্ষার পানি আর ধরে না। এক সময় সদর-দরজায় সবুজ রং ছিল; সে-রং অনেকদিন হল বিবর্ণ হয়ে গেছে। জরাজীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু বাড়ির চতুর্দিকে নির্দয় সদরউদ্দিনের হাতের ছাপ। 

মাঠটা অতিক্রম করে সরদউদ্দিন হঠাৎ একটু থামে। লাঠিতে ভর করে দাঁড়ালেও তার দেহ তারপর অসংযতভাবে কাঁপতে শুরু করে। কেবল তার নিষ্পলক দৃষ্টি সম্মুখে স্থির হয়ে থাকে। সে-দৃষ্টি অদূরে বিবর্ণ দরজার পাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে-থাকা একটি লোকের ওপর নিবদ্ধ। লোকটির মাথার টাকে রোদের ঝলক, কিন্তু তার চোখ দেখা যায় না। 

তার দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটি অস্ফুটভাবে আর্তনাদ করে ওঠে। সে বলে, 

বাবা বাবা, আর যেয়ো না। শুনছ বাবা? আর যেয়ো না। 

সদরউদ্দিন ঝোড়ো গাছের মতো একটু হেলে-দুলে আবার চলতে শুরু করে। তার ক্ষণকালের দ্বিধা-সংশয় কেটেছে। তাকে এগোতেই হবে। আখলাকের কাছে মাফ চাইতেই হবে তাকে। মাফ চাওয়ার অধিকার তার আছে কি না সে জানে না। তবে সে এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে, দোজখের ভয়ে সে আখলাকের কাছে আসে নাই, বেহেশতে তার স্থান নিশ্চিত করবার জন্যেও সে তার কাছে মাফ চাইবে না। 

আরো অগ্রসর হলে সদরউদ্দিনের মনে হয় সে যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষটির চোখ দেখতে পায়। সে চোখে কি ঘৃণার ছায়া? মুহূর্তের জন্যে বৃদ্ধের বুক কেঁপে ওঠে। কিন্তু মুহূর্তের জন্যেই কেবল। সে জানে আখলাকের ঘৃণায় এখন সে বিচলিত হবে না। বরঞ্চ জীবনের শেষ মুহূর্তে তার চোখে সে ঘৃণাই দেখতে চায়; তার ঘৃণাভরা দৃষ্টির তলেই সে তার শেষনিশ্বাস ফেলতে চায়। সে-সময়ে আখলাকের ক্ষমাভরা চোখ তার সহ্য হবে না। তার কাছে সে মাফ চাইতে এসেছে বটে কিন্তু সে চায় না যে আখলাক তাকে মাফ করুক। 

ক্ষণকালের জন্যে একটি প্রশ্ন জাগে বৃদ্ধ সদরউদ্দিনের মনে। তবে কেন সে এসেছে আখলাকের কাছে? সে কি এ-কথা তাকে জানাতে এসেছে যে জীবনের শেষ মুহূর্তে তার মনে অনুতাপ-অনুশোচনা এসেছে? কিন্তু তার অনুতাপ-অনুশোচনা আখলাকের কাছে অর্থহীন মনে হবে। সদরউদ্দিনের দীর্ঘ শত্রুতার ফলে আখলাকের যে-জীবন অঙ্গার-প্রান্তরে পরিণত হয়েছে, সেখানে তার অনুতাপ-অনুশোচনায় এখন আর তৃণ গজাবে না, সজীবতা আসবে না 

সদরউদ্দিন তার প্রশ্নের উত্তর পায় না, উত্তর জানতেও চায় না। তর্কবিতর্কের সময় তার সত্যিই শেষ হয়েছে। অকস্মাৎ তার সমগ্র হৃদয়ে যে-পরম শান্তির ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছে, সে-ধারায় কোনো প্রশ্নই আর দাঁড়াতে পারে না। 

অবশেষে দুই চিরশত্রু মুখোমুখি হয়। মুমূর্ষু সদরউদ্দিনের গর্তে-ঢোকা চোখে তীক্ষ্ণ উজ্জ্বলতা; সে-চোখে পলক পড়ে না। মনে হয়, আখলাকের প্রতিক্রিয়াতেই একটি কথা নির্ধারিত হবে : তার জীবনের কোনো অর্থ ছিল কি ছিল না। 

আখলাকের মুখের পক্ষাঘাতগ্রস্ত ডান-দিকটা স্থির হয়ে থাকলেও শীঘ্র সুস্থ বাঁ-দিকটা একটি অদম্য চঞ্চলতায় অভিভূত হয়ে পড়ে। সে-অঞ্চলটি বেঁকে-কুঁচকে গিয়ে অসহায়ভাবে কাপতে শুরু করে অবশেষে যেন ভেঙেচুরে পড়ে। তার চোখে কি এবার ঘৃণাটি জাগবে—যে ঘৃণায় তার দৃষ্টি মারাত্মকভাবে কালো এবং স্থির হয়ে ওঠে? যে-সামান্য শ্বাসটুকু এখনো আছে, সে শ্বাসটিও রুদ্ধ করে সদরউদ্দিন নিস্পন্দভাবে তাকিয়ে থাকে আখলাকের দিকে। 

তারপর সহসা তার চিরশত্রু আখলাকের চোখে অশ্রুর আভাস দেখা দেয়। তার মুখের সুস্থ অংশটি স্থির হয়েই থাকে, কিন্তু তার নিস্তেজ চোখে ঝাপটা দিয়ে তিক্ত, নিঃস্ব অশ্রুর সঞ্চার হয়। হয়তো আজ সর্বপ্রথম স্বচ্ছদৃষ্টিতে সে দেখতে পায় তার অঙ্গার-প্রান্তরসম জীবনটি। ক্ষমা চাইতে এসে সদরউদ্দিন তাকে সে-কথা বুঝতেই সাহায্য করেছে। 

গভীর বিস্ময়ে আখলাকের অশ্রুভরা চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সদরউদ্দিন বিহ্বলভাবে এদিক-ওদিক তাকায়। সে যেন জানে না এখানে সে কী করছে, কীই-বা তার অন্তিম কাম্য, তার এ-বিচিত্র শেষযাত্রাটিরই-বা অর্থ কী 

পেছনে গভীর নীরবতার মধ্যে এবার তার নির্বোধ মেয়েটি নিঃশঙ্কচিত্তে তৃপ্ত নিশ্চিন্ত মানুষের অনাবিল কান্নায় ভেঙে পড়ে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *