নিষিদ্ধ প্রান্তর

নিষিদ্ধ প্রান্তর

…আপনি কিন্তু কোনো মুসলিম মেয়ের কথা লেখেননি!

…হ্যাঁ, লিখিনি। তবে—

…কেন লেখেননি? মুসলিম মেয়েরা আপনার মনে কোনো দাগ কাটেনি বুঝি? নাকি মনে করেন ওরা তুচ্ছ, এত সাধারণ, এত সরল আর বোকাহাবা যে ওদের নিয়ে কোনো সাহিত্যই সৃষ্টি হতে পারে না?

…না, না। তা কেন?

…বুঝেছি মশাই, বুঝেছি। ওদের কথা লিখলে এ পোড়া বাংলাদেশের কারও মনে কোনো দাগ কাটবে না, ভেবেছেন। ধরে নিয়েছেন ওরা মেয়ে হলেও ঠিক নায়িকা হবার মতো মেয়ে নয়।

…দেখুন, আপনি মিথ্যে বা আমার বাঙালি পাঠক—পাঠিকাদের বদনাম দিচ্ছেন। আসলে ব্যাপারটা কী জানেন? আজ অব্দি খুবই কম মুসলিম মেয়ের সঙ্গে মিশবার সুযোগ আমি পেয়েছি। আপনি তো ভালোই জানেন, ওঁরা সচরাচর পর্দানসীনা। আত্মীয় পুরুষের সাথে মেলামেশা করতে ওঁদের পারিবারিক এবং সামাজিক বাধা রয়েছে। আর—

…থামুন! একজন আধুনিক লেখক বলে আপনি নিজের বড়াই করেন অথচ আপনি অন্ধ। বর্তমান সময়ের অনেক বড়ো ঘটনা আপনার চোখ এড়িয়ে যায়। আজকাল অজস্র মুসলিম মেয়ে লেখাপড়া শিখছে, চাকরি করছে, বা বাইরে সমাজে নিঃসঙ্কোচে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা হিন্দু মেয়েদের মতোই সুযোগ পেলে ছেলেদের সঙ্গে প্রেম ভালোবাসার জালেও জড়িয়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি অন্তত একডজন মেয়ের নাম করতে পারি, যারা কেউ বাবা মার অমতে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছে, কেউ বাড়ি ছেড়ে গিয়ে স্বাধীনভাবে বাস করছে। দু’জনকে জানি, তারা খ্রিস্টান ও হিন্দুকে বিয়ে করেছে। আরও নজির চান?

….একটা কথা শুনুন। লেখক—মানে একজন সিরিয়াস সাহিত্যব্রতী লেখকের কথাই আমি বলছি, তিনি মোটামুটিভাবে তাঁর লেখার বিষয় খুঁজে নেন অতীত অভিজ্ঞতা থেকে। স্মৃতি তাঁর শিল্পের সহচর। আজ মুসলিম মেয়েরা হয়তো অনেক কিছু করছে। এটা কিন্তু আমি সমকালের ব্যাপার মনে করি। ভুল করবেন না—সাহিত্যের সমকাল আর সংবাদপত্র বা রাজনীতির সমকাল কিন্তু মোটেও এক নয়। কালের হিসেবে স্পষ্টত দুটো দু’দিকের ব্যাপার।

…বেশ, তাই যদি হয়—এবং তর্কের খাতিরে তাই—ই ধরে নিচ্ছি, সমকাল নিয়ে আপনি লিখতে নারাজ—কিন্তু বিগত কালে আপনার অভিজ্ঞতায় কি তেমনি কিছুই ঘটেনি? কোনো মুসলিম নায়িকা কি সত্যি আপনার চোখে পড়েনি? তার হাসিকান্না সুখদুঃখে ভরা জীবনের কোনো প্রান্তেও কি আপনি এমন আশ্চর্য কোনো উদ্যান দ্যাখেননি—যার একটি দুটি ফুল চয়ন করে শিল্পের সাজিতে রাখা যায়?

…আপনি আমায় ভাবিয়ে তুললেন সত্যি!

…বলুন, তেমন কোনো মেয়ের কথা আপনার মনে নেই?

…কী জানি!

…বলুন, চুপ করে থাকবেন না।

…কী বলবো?

…মুসলিম নায়িকার কথা। যার রূপ না থাক; হৃদয় ছিল। চোখধাঁধানো উজ্জ্বলতা না থাক, ছিল রহস্য। দুপুরের গনগনে রোদ্দুরের চেয়ে গোধুলির স্মিত পাণ্ডুরতা, অস্তোন্মুখ সূর্যের লালচে রঙটার চেয়ে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ ধূসরতা তো অনেক বেশি রহস্যময়। অনেক ভাবায়। অনেকখানি বিষণ্ণও করে। নাই বা হল উচ্ছল চটুল চঞ্চল আর চটপটে। কথায় কথায় চমক আর ফুলঝুরি ছড়ানোর ক্ষমতা নাইবা থাকল! হয়তো মৃদু একটু ছোঁয়াতেই লজ্জাবতী লতার মতো সংকুচিতা, হয়তো নম্রা বিনীতা কুণ্ঠিতা ব্রীড়াভারবনতা শান্তা ভীতা…

আঃ, চুপ করুন। আমায় ভাবতে দিন।

…মনে পড়েছে বুঝি তেমন কাকেও?

…আপনি হাসছেন। হাসবেন না। আর কী যেন বলছিলেন, নম্রা ভীতা শান্তা!

…বলছিলুম।

…কিন্তু না, না। নম্রা নয়, ভীতা নয়, শান্তা নয়। লজ্জা? যত লজ্জা—তা তার বুক থেকে মুখে পৌঁছতে জীবন কেটে গিয়েছিল। কুণ্ঠা? কুণ্ঠার সাধ্য ছিল না তার হাতের আঙুলকে বাগ মানায়। হ্যাঁ—আঙুলের কথাই বলছি। ওই অকুণ্ঠ আঙুল দিয়ে নিজের নবজাতককে সেই রাক্ষসী…

…রাক্ষসী নয়! আমি নায়িকার কথা বলেছিলুম—সে মানুষী।

…তাই হবে। সে মানুষী।

…তাহলে মনে পড়ে গেল?

…হ্যাঁ।

…কে ছিল সে? কেমন গম্ভীর আর বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন মনে হচ্ছে! আপনার এই চোখদুটোকে আমি চিনি। চশমার কাচের নীচে ওই তীব্র কাকুতিটা কিন্তু আমার অচেনা। সত্যি বলুন তো, আপনার চোখে কেন এ বিদ্যুতের ছটা আর অন্ধকার জমাট মেঘের চাপ এসে পড়ল এ মুহূর্তে? কে ছিল সে?

…আমায় যেতে দিন।

…পালাতে চান? অত সহজে আমি কাকেও রেহাই দিইনে মশাই।

…পথ ছাড়ুন। আমার পিছনে একটা অন্ধকারময় শূন্যতা যেন তাড়া করে আসছে।

…এ আপনার পাপবোধের ত্রাস।

…কিন্তু আমি তো কোনো পাপ করিনি।

…কোনো রাক্ষসী তার নবজাতককে হত্যা করেছিল, বলছিলেন!

…করেছিল, কিন্তু তাতে আমার তো দায়িত্ব ছিল না! সে পাপ আমায় স্পর্শ করবে কেন?

…না করলে এ পাপবোধজনিত ত্রাস কেন আপনার?

…জীবনের ওই রূপটাই আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের আয়েষার কথা মনে আছে আপনার? যে বন্দি হিন্দু রাজপুত্রকে দেখে বলেছিল, ‘এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর’!

…এ একটা প্রখ্যাত উক্তি।

…হ্যাঁ। আয়েষা আমায় ভাবায়। মুসলিম মেয়ে যখন কোনো হিন্দু ছেলেকে ভালোবেসে ফেলে, আমি সত্যি চমকে উঠি। এক অথৈ শূন্যতা আমায় চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমি যতবার চিৎকার করে ডাকি, ঈশ্বর তুমি কোথায়, সব ডাক শূন্যতায় লীন হয় নিঃশেষে। আমি আরও বলে উঠি: ঈশ্বর, তুমি কি সব মানুষকেই সৃষ্টি করনি? তোমার কি আরও সব প্রতিনিধি রয়েছে নানারকম মানুষ সৃষ্টির জন্যে?…কোনো সাড়া পাইনে। প্রচণ্ড অসহায়তা গ্রাস করে। মানুষকেই তখন ভয় পেয়ে যাই। ভয় পাই মানুষের এই জীবনটাকে।

…আপনার আয়েষার কথা বলুন শুনবো।

…থাক। কী হবে?

…বলছি তো, অত সহজে আমি কোনো লেখককে রেহাই দিইনে। আচ্ছা, একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে। আপনিই কি তাহলে ওই কাহিনির ওসমান খাঁ ছিলেন?

…পাগল! না, না। আমার মধ্যে অমন মহত্ত্ব কোথায়? তেমন সাহস আর সহিষ্ণুতা, ধৈর্য আর উদারতা কোথায় পাব আমি? আজও তো মানুষকে আমি ক্ষমা করতেই শিখলুম না!

…তাহলে কী ছিলেন আপনি? শুধু নির্লিপ্ত দ্রষ্টা?

…এবার হাসি পেল। আপনি নাছোড়বান্দা। বাংলা সাহিত্যের পাঠিকাদের আমি এজন্যেই বড় ভয় করি। আপনারা বড্ড বেশি খুঁটিয়ে জানতে চান। আপনারা পাতায় পাতায় চোখের জলের ফোঁটা না ফেলতে পারলে…

…ভণিতা রাখুন।

…তার আগে এক মিনিট চুপচাপ সিগ্রেট টানতে দিন লক্ষ্মী মেয়ের মতো। আর একটা কথা—কোনোসময়ই বাধা দেবেন না যেন। প্রশ্ন করবেন না। শুধু মনে রাখবেন, আমি যা বলছি—তা জীবনেরই কথা। আপনার জীবনে না ঘটুক বা কোনো মিল নাই থাক, এটা ঘটেছিল বা ঘটতে পারে। আসলে আমরা আটপৌরে সাদাসিদে মানুষেরা কতটুকুই বা খবর রাখি কোথায় কী ঘটেছে? জানবেন—খবরের কাগজই সব নয়। অন্যের কাছে শোনাটাও বাস্তবজীবনের একটুকু অংশ মাত্র! বিজ্ঞানী নিউটনের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে আছে তো? জ্ঞানসমুদ্রের বেলায় মাত্র কিছু নুড়ি কুড়োতেই একটা জীবন কেটে যায়। মানুষের জীবন এক অকূল দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। আমাদের কাছে শুধু ওই বেলাভূমির নুড়ির হিসেবই মেলে। আমরা লেখকরা নিছক নুড়ির ফেরিওয়ালা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *