3 of 3

নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে

সবকিছুর একটা সীমা আছে। আমাকে নিষিদ্ধ করার, মনে হয়, কোনো সীমা নেই। দেশ নিষিদ্ধ করে, রাজ্য নিষিদ্ধ করে, রাজনীতিক নিষিদ্ধ করে, প্রকাশক নিষিদ্ধ করে, সম্পাদক নিষিদ্ধ করে, বইমেলা নিষিদ্ধ করে, সাহিত্য উৎসব নিষিদ্ধ করে। চারদিকে নিষিদ্ধ আমি। অনেক কাল আমি একঘরে, অনেক কাল যুদ্ধ করছি বাক স্বাধীনতার জন্য। বারবার হেরে যাচ্ছি। যদিও বলি তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী, কিন্তু শেষ অবধি দেখি জয় তলোয়ারেরই হয়, কলমের নয়।

জয়পুর সাহিত্য উৎসব পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাহিত্য উৎসব। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ অংশ নেয় এই উৎসবে। ইউরোপ আমেরিকার অনেক নামিদামি লেখকও ভিড় করেন। বিশাল বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উৎসবে বিজ্ঞাপন দিয়ে ধন্য হয়, উৎসব উদ্বোধন করে সরকার ধন্য হয়। হারপারকলিন্স পেঙ্গুইন জমকালো পার্টি দিয়ে ধন্য হয়। এই উৎসবে আমাকে এ বছর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু আমার উপস্থিতি নিয়ে পাঁচটা অজ্ঞ, অসভ্য, অশিক্ষিত মৌলবাদী আপত্তি করার পর শুনেছি উৎসবের পরিচালকেরা বলেছেন ‘মাথা পেতে মেনে নিচ্ছি আপনাদের ডিমান্ড, প্রতিজ্ঞা করছি আমরা আর কখনও তসলিমাকে জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভেলে আমন্ত্রণ জানাবো না’। ব্যস আমি নিষিদ্ধ। পৃথিবীতে বোধহয় আর কাউকে এত সহজে নিষিদ্ধ করা যায় না, যত সহজে করা যায় আমাকে। সম্ভবত আমি একা বলেই করা যায়। আমাকে নিষিদ্ধ করলে কারও কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।

একবার যদি তুমি মৌলবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করো, তোমাকে বারবার মাথা নত করতে হবে। ২০১২ সালে রুশদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল জয়পুর লিট ফেস্ট। জয়পুরের মৌলবাদীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছিল রুশদির বিরুদ্ধে, বলেছিল জয়পুরে তারা ঢুকতেই দেবে না রুশদিকে। লিট ফেস্টের পরিচালকেরা মেনে নিয়েছিলেন মৌলবাদীদের দাবি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, রুশদির শারীরিক উপস্থিতির দরকার নেই। স্কাইপে তিনি কিছু বলবেন, লিট ফেস্টে অংশগ্রহণকারীরা মনিটরে তা দেখবে, কিন্তু তাতেও বাধা দিয়েছিল ওই অসভ্যগুলো। শেষ পর্যন্ত ওই প্রোগ্রামও বাদ দিতে হয়েছে।

আমাকে কখনও জয়পুর লিট ফেস্টে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ বছরই প্রথম আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যদিও প্রোগ্রাম লিস্টে  নিরাপত্তার কারণে আমার নাম উল্লেখ করা হয়নি, শুধু উল্লেখ করা হয়েছে আমার বইয়ের নাম একজাইল, নির্বাসন, আমি জানতাম আমার অনুষ্ঠান, বিকেলে, ৩.৪৫ এ। সেদিন সোমবার, সকালে ব্রেকফাস্ট স্কিপ করলাম, ভাবলাম গরম জলে স্নান করে, হোটেলেই লাঞ্চ করে নিয়ে পৌনে তিনটেয় বেরিয়ে যাবো, ফেস্টিভেলে যেতেই লাগে চল্লিশ মিনিট মতো। আগের রাতেই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমি যেন ঠিক আমার অনুষ্ঠানের দু মিনিট আগে ফেস্টিভেলে যাই, এবং অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার জিরো মিনিটের মাথায় ফেস্টিভেল থেকে বেরিয়ে যাই। আগের দিনেই আমাকে বের করার এক সুড়ঙ্গ পথ আবিষ্কার করেছিলেন ওঁরা। সেই সুড়ঙ্গ পথ দিয়েই আমাকে মঞ্চে উঠে যেতে হবে। এই তো কথা ছিল, কিন্তু দুপুর বারোটায় ফোন এল কর্মকর্তাদের, বললেন আমার ৩.৪৫-এর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে, আমি যদি আদৌ কোনও অনুষ্ঠান করতে চাই, তাহলে আমাকে এক্ষুনি ফেস্টিভেলে পৌঁছুতে হবে, সাড়ে বারোটায় আমাকে মঞ্চে উঠতে হবে, না পৌঁছুতে পারলে এই সম্ভাবনাও বাতিল করতে বাধ্য হবেন তাঁরা। ক্ষিধে পেট, চান না করে, শুধু শাড়িটা দ্রুত পরে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাক স্বাধীনতার মূল্য দিতেই বেরিয়ে গেলাম, মৌলবাদীদের অন্যায় দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতেই বেরিয়ে গেলাম। মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করার কোনও আকর্ষণ না থাকা সত্ত্বেও বেরিয়ে গেলাম।   তখনও আমার নিরাপত্তারক্ষীরা কেউ হোটেলে আসেননি, কিন্তু বেরিয়ে গেলাম। আমাকে শুধু একবার জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা যে মৌলবাদীরা নাকি আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। নিরাপত্তার কারণে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগেই আমাকে উপস্থিত থাকতে বলা হচ্ছে, অনুমান করি। আমার উপস্থিতিটা বাক স্বাধীনতার পক্ষে এক রকম প্রতীকী উপস্থিতি, এ বুঝেই আমি কর্মকর্তাদের উপদেশ মেনে নিই। ওঁরা যে লোক আর গাড়ি পাঠিয়েছিলেন তা নিয়েই দ্রুত ফেস্টিভেলে চলে যাই। সলিল ত্রিপাঠি আমার সঙ্গে কথা বললেন মঞ্চে। শুধু সময় বদলানো হয়নি, ডিউরেশনও বদলে গেছে, এক ঘণ্টার জায়গায় আধ ঘণ্টা কথোপকথন হলো। মঞ্চ ঘিরে ছিল প্রচুর পুলিশ, ছিল ফেস্টিভেলের কর্মকর্তা। মঞ্চের কথোপকথন শেষ হলে দ্রুত আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সোজা হোটেল। প্রায় চার দিন ছিলাম জয়পুরে, কিন্তু ফেস্টিভেলের কিছুই প্রায় উপভোগ করা হয়নি। হোটলেই বসে থাকতে হয়েছে। প্রথম দিন অবশ্য দিব্যি বিভিন্ন সেশনে উপস্থিত হয়ে আর সব দর্শকের মতো লেখকদের ভাষণ শুনছিলাম, এক সময় কর্মকর্তারা আমাকে সরিয়ে নিলেন, কোথায় কার সঙ্গে কার ঝগড়া লেগেছে, সে কারণে। ঝগড়াটা মোটেই আমাকে কেন্দ্র করে নয়, তারপরও। আমাকে পরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আমি যেন ফেস্টিভেলে ঘোরাঘুরি না করি, কোনও অনুষ্ঠানও না শুনি। কেন? জাস্ট ইন কেইস। আমার নিরাপত্তার জন্য, প্লাস ফেস্টিভেলের নিরাপত্তার জন্য। এত অবাঞ্ছিত কখনও অনুভব করিনি কোনও ফেস্টিভেলে। জীবনে তো অনেক সাহিত্য উৎসবেই অংশগ্রহণ করেছি।

রাতে জাঁকালো সব উৎসবের কথা শুনি, কিন্তু সেসবে যাওয়ার জন্যও আমাকে সংগঠকদের কেউ কিছু বলে না। এক রাতে আমি একা একাই চলে গেলাম ডিনারে, গিয়ে দেখি লাইভ মিউজিক, অঢেল খাবার দাবার, হাজারো লেখক এবং পাঠক আনন্দ করছে, না সেই আনন্দে আমি বুঝি আমি অনাহুত। সোমবার রাতে ছিল লেখকদের জন্য গালা ডিনার। না, সেদিনও আমাকে ডাকা হয়নি। সন্ধে বেলায় বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি আমার ফ্লাইট রাত বারোটায়। এয়ার লাইন্সের লোকেরা অবাক, এলেন কেন, এসেমেস পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বিকেলেই যে ফ্লাইট দেরিতে যাবে। কিন্তু সংগঠকরা যেহেতু টিকিট কিনেছিলেন, সংগঠকরা পেয়েছেন এসেমেস, আমি পাইনি। হয়তো ওঁরা চেয়েছিলেন অন্যান্য লেখকের সঙ্গে গালা ডিনারে বসার চেয়ে আমার এয়ারপোর্টেই বসে থাকা ভালো। জাস্ট ইন কেইস। ঝামেলাহীন পরব কাটাতে হলে ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ কাউকে কেউ আশেপাশে দেখতে চায় না।

পুরোটা লিট ফেস্টেই আমি অনুভব করেছি আমার উপস্থিতি কোথাও কাঙ্ক্ষিত নয়। আমি জানি নারী-বিদ্বেষীদের, মৌলবাদীদের, রক্ষণশীলদের অঞ্চলে আমার উপস্থিতি কাঙ্ক্ষিত নয়, টের পাই উদারপন্থীদের অঞ্চলেও আমি অস্পৃশ্য।

পরদিন সব খবরের কাগজে পড়ি, দশ বারোটা মৌলবাদী, যারা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোনওদিনই আমার বই পড়েনি, আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে। ওরা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি যত টাকা সাহায্য করেছি গুজরাতের রায়টে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিমদের জন্য, তত টাকার এক ভাগও ওরা সাহায্য করেনি।

২০১২ সালে মৌলবাদীদের দাবি মেনেছিলেন বলে ২০১৭ সালেও তাদের দাবি মানতে বাধ্য হলেন লিট ফেস্টের পাওয়ারফুল লোকেরা। ৫ জনের কাছে হেরে যায় ৫ লক্ষ। কেন, ৫ জন অতিকায় দানব? আর ৫ লক্ষ সবাই ভীরু কাপুরুষ? নাকি অন্য কিছু?

আমি জানি আমাকে নিষিদ্ধ করার মতো সহজ কিছু নেই। কারণ আমাকে নিষিদ্ধ করলে  ডানপন্থী হোক বামপন্থী হোক, চরমপন্থী হোক, নরমপন্থী হোক, পুরুষ হোক নারী হোক— কেউ প্রতিবাদ করে না। অনেক তো দেখা হলো এ জীবনে, মুখোশের আড়ালের মুখও অনেক দেখা হয়েছে।

যত আমার ভাবনা চিন্তার পরিসর বাড়ছে,  আমার শরীরী অবস্থানের জায়গা তত কমে যাচ্ছে। আমি যত বেশি মানুষের কথা ভাবছি, তত বেশি আমি একা হয়ে যাচ্ছি। যত আমি পৃথিবীকে নিজের গ্রাম বলে ভাবছি, তত আমি এক-ঘরে হয়ে যাচ্ছি। বাক স্বাধীনতার কথা মানুষ বলে বটে, খুব কম মানুষই এই স্বাধীনতাকে মানে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭

1 Comment
Collapse Comments
উজ্জ্বল শেখ September 18, 2019 at 11:32 pm

ফালতু ব্যক্তিত্ব কে কেউ মূল্য দিতে পারে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *