নিষাদ
রাত্রির ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটি বটগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছিল ছেলেটি। তুমুল বরষায় চারিদিক থইথই, মধ্য শরতে এমন ঘনঘোর বরিষণ ধারা শেষ কবে নেমেছে এই বরেন্দ্রভূমিতে, সে কথা প্রবীণতম কৈবর্ত জালুকী বুড়োও বলতে পারেনি কাল। এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে মাটি, কাদা, ছোটো জলের ধারা, উপচে পড়া ছোটো ডোবা, গাছের ভাঙা পাতা আর ডাল, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মৃত পশুদের গলিত শব, সব মিলিয়ে স্থানটি নরকতুল্য হয়ে উঠেছে। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না ঠিক করে, এমন আকাশভাঙা বিপর্যয় নেমে এসেছে আজ এই চরাচরে।
ছেলেটির অবশ্য তাতে ভ্রূক্ষেপ ছিল না বিন্দুমাত্র। তার পোশাক বলতে কোমরে জড়ানো সামান্য এক টুকরো কাপড় পাহাড়ের মতন তার বিশাল দেহ, প্রশস্ত বক্ষ, শালপ্রাংশু দুই বাহু আর রাজবাড়ির স্তম্ভের মতন পুষ্ট ঊরুদ্বয়। সম্পূর্ণ কেশবিহীন মস্তক তার, প্রথম দর্শনে মনে হয় কোনো কুশলী স্থপতির বানানো প্রস্তরমূর্তি। কয়েকদিন আগে যখন সে আর তার ঘোর কৃষ্ণ খর্ব নাসা সঙ্গীরা অরণ্য থেকে নেমে এসেছিল এই এলাকায়, নেমে এসেছিল দিব্বোক আর রুদকের রাজধানী ডমরনগরের রাজপথে, সমস্ত নগরী সেদিন আতঙ্কে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছিল। বাব্বা, সমগ্র বরেন্দ্রভূমির সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটিও যে আকারে-প্রকারে এদের কাছে শিশু।
কারা এরা? এখানে কী করছে? এরা কি পাল সম্রাট রামপালের পাঠানো বিশেষ বাহিনী? এই ঘোর বিপদের লগ্নে কৈবর্ত সৈন্যদল কোথায়? কৌতূহলের আন্দোলন আছড়ে পড়েছিল রাজার আঙিনায়।
রাজা বলতে আর দিব্বোক নয়, এখন ডমরনগরের নায়ক পুণ্যশ্লোক দিব্বোকের ভ্রাতুষ্পুত্র, বরেন্দ্রসূর্য ভীম।
মহাকায় ভীম যখন সিংহাসন থেকে নেমে এসে এই ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন, মস্তক আঘ্রাণ করে দিলেন সহস্র আশিসচুম্বন, কালিন্দী নদীর প্রতিটি তরঙ্গ আর বারেন্দ্রীর গেরুয়া মৃত্তিকার প্রতিটি কণা যেন বিস্ময়ে প্রস্তরীভূত গেল। সেই বিস্ময় অবশ্য সহর্ষ উল্লাস আর আশ্চর্যচকিত আনন্দে বদলে যেতে দেরি হয়নি, যখন রাজা ভীম জনসাধারণ্যে ঘোষণা করলেন এই নিষাদপুত্র তাঁর আত্মজ, কুমার শব্বের মতো এর শরীরেও বইছে তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার!
দাবানলের মতো রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত অবধি ধেয়ে গেল সেই সংবাদ। কৌতূহলে ফেটে পড়ল সমগ্র বরেন্দ্রভূমি। মহারাজ ভীমের এক নিষাদপুত্ৰ যে আছে, এই সংবাদটাই রাজ্যবাসীর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। কই, আগে তো ঘুণাক্ষরেও রাজা কিছু বলেননি!
কানাকানি হতে হতে অবশ্য জানা গেল সবই।
.
বছর দশেক আগের কথা, সম্রাট মহীপাল তখন মহাপরাক্রমে গৌড়ের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। অশেষ ক্রূরকর্মা এই সম্রাট মহীপাল, যেমন নিষ্ঠুর, তেমনই অবিবেচক। নিতান্ত অলীক সন্দেহের বশে নিজের ভাই শূরপাল আর রামপালকে কারাদণ্ড দিতে সাম্রাজ্যের দিকে দিকে জ্বলে উঠল রোষবহ্নি, মহাপরাক্রান্ত সামন্তরা বিরূপভাব ধারণ করতে লাগলেন। মহাসান্ধিবিগ্রহিক পদ্মনাভ আর প্রধান অমাত্য বরাহস্বামী দুজনেই প্রখরবুদ্ধি কুশলী কূটনীতিক, কিন্তু এই অসন্তোষ সামলাতে তাঁদেরও যথেষ্ট বেগ পেতে হল।
.
কিন্তু না, মহাসামন্তরা নয়, পাল সাম্রাজ্যের মহাসর্বনাশ ধেয়ে এল সম্পূর্ণ অন্যদিক থেকে। দুই মহাবুদ্ধি অমাত্য ভুলে গেলেন পাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকা আর-একটি জ্বালামুখীর কথা, আর-এক জনজাতির মধ্যে ধূমায়িত ক্ষোভের কথা
ভুলে গেলেন এই বারেন্দ্রীর কৈবর্তদের কথা।
.
ফসল আর জমির অধিকার নিয়ে পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে, মাছ ধরা নিয়ে রাজানুকম্পাপুষ্ট বৌদ্ধদের সঙ্গে বরেন্দ্রভূমির কৈবর্তদের বিরোধ বহুদিনের। সম্রাট মহীপালের অবিবেকী অত্যাচার, নিপীড়ন আর জাতিঘৃণা আহুতি হিসেবে পেয়ে কৈবর্তদের সেই বহুদিনের জমানো ক্ষোভাগ্নি হয়ে উঠল বিদ্রোহের দাউদাউ লেলিহান শিখা, গ্রাস করতে চাইল সমগ্ৰ কৈবর্তভূমিকে।
সেই সময়ে বরেন্দ্রীর অহংকার দিব্বোকের ভাই রুদক এবং রুদকপুত্র ভীম অজ্ঞাতবাসে ঘুরছিলেন বিভিন্ন সামন্তপ্রদেশে। তাঁরা জানতেন পাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি এই অনন্তসামন্তচক্র। যদি এই সামন্তদের মধ্যে ভাঙন ধরানো যায়, যদি একটি অংশ যদি কৈবর্ত সাহায্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, তবে সেই খণ্ডসামন্তচক্র চালিত পালসৈন্যদের পরাস্ত করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। নৌসংগ্রামে কৈবর্তরা এমনিতেও অজেয়, তারা জন্মজালিক, তাদের জন্মনাড়িতে মিশে থাকে জলের আঁশটে গন্ধ। তাদের ভয় ছিল শুধু দুটি ক্ষেত্রে। প্রথমত অশ্বারোহী সৈন্যবল বলে তাদের কিছু নেই। আর দ্বিতীয়ত, জঙ্গল যুদ্ধে পালসৈন্য আর কৈবর্তসেনা তুল্যমূল্য। এইখানে তাদের দরকার ছিল জঙ্গলকে নিজের মতো চেনে এমন সহযোগী যোদ্ধৃবর্গ। তাদের হাতের কাছে ছিলও এমন এক জনজাতি যারা জঙ্গল যুদ্ধে প্রায় অজেয়, কিন্তু তারা মোটেও সম্মত হয়নি কৈবর্তদের সাহায্য করতে।
.
কোচ। তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। রাষ্ট্রবিপ্লব সবসময়ে সবার সহ্য হয় না।
এমনই এক অগ্নিগর্ভ সময় আসতে পারে তা আঁচ করতে পেরেই দিব্বোকের আদেশানুসারে রুদক আর ভীম ঘুরছিলেন পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সামন্ত রাজ্যে। এমনই এক সময় তৎকালীন মগধাধিপ সামন্ত রাজাটির সঙ্গে দেখা করে গৌড়ে ফেরার সময় তাঁরা পথ হারান মগধের নিম্নভাগের এক পাহাড়িয়া জঙ্গলের মধ্যে।
সেইদিন মনে পড়লে আজকের অকুতোভয়, সমরনিপুণ, নির্ভীকশ্রেষ্ঠ কৈবর্তরাজ ভীমের কপালে আজও স্বেদবারি লক্ষ করা যায়। সেই ঘন শ্বাপদসংকুল অরণ্যে নেহাত দৈবানুগ্রহে আর স্বীয় বলপ্রভাবে যাবতীয় প্রতিকূল পরিস্থিতি পরাস্ত করে বেঁচেছিলেন তাঁরা। দৈবাৎ এমন গহীন, মনুষ্য সংস্পর্শহীন অরণ্যে তাঁরা প্রবেশ করেন, যা তাঁদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাঁদের মনে হয়েছিল হয়তো বা এই অতি আদিম, অতি ভয়াল সেই অরণ্যে আজ অবধি কোনো মানুষের পা পড়েনি অদ্যাবধি। কিন্তু সেই ভুল অচিরেই ভেঙে যায়, যখন একদল আদিম, উলঙ্গ, হিংস্র নিষাদ অকস্মাৎ তাঁদের ঘিরে দাঁড়ায়। চলাফেরা তাদের ধূর্ত শৃগালের মতোই নিঃশব্দ, চোখে তাদের বিষধর ভুজঙ্গবৎ শীতল নিষ্ঠুরতা, শরীরের প্রতিটি পেশিতে মত্ত মাতঙ্গসম শক্তির আভাস। এবং তাদের ক্ষুধার্ত লোলুপ দৃষ্টি যে নিঃসংশয় ইঙ্গিত বয়ে আনে, তার একটিই মানে দাঁড়ায়।
এরা নরমাংসভোজী!
সেইদিনই যে দুজনে নিহত হতেন সে নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।, যদিও দুজনেই লড়াই করেছিলেন যথার্থ স্বাধীনচেতা কৈবর্তদের মতোই। বিশেষত যৌবনমদমত্ত ভীমের ওপর যেন ভর করেছিলেন ক্ষত্রিয়হন্তা পরশুরাম স্বয়ং। কিন্তু সংখ্যাধিক্যে প্রবল সেই নিষাদবাহিনীর লোলুপ শ্বাস ক্রমশই তাঁদের মৃত্যুর সুনিপুণ জালে জড়িয়ে ফেলেছিল খুব দ্রুত। আসন্ন মৃত্যুর সামনে দুজনেই প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছেন, এমন সময় একটা দীর্ঘ শিসের শব্দ শুনে হঠাৎ করেই সেই অসভ্য নরখাদক নিষাদের দল তাঁদের ছেড়ে দূরে সরে যায়, তাদের চোখে তখন সম্ভ্রমের দৃষ্টি।
আর তাদের মধ্যে সর্বংসহা নিয়তির মতন সেখানে এসে দাঁড়ান এক নারী। সম্পূর্ণ উলঙ্গ সেই
পূর্ণ যৌবনবতী আদিম রমণীটি যেন তাঁর সমগ্র দেহে জড়িয়ে এনেছেন মহাকালের গহ্বর থেকে বুনে আনা রাত্রির অনন্ত কৃষ্ণ আঁচল। শান্ত দু-চোখ দুটিতে শূন্যতার অসীম হাহাকার জড়িয়ে তিনি এসে দাঁড়ান সেই রণভূমির মধ্যে। তিনিই ইশারা করেন এই দুই অনুপ্রবেশকারীকে বেঁধে নিয়ে যেতে।
পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। আদিম মাতৃতান্ত্রিক নিষাদগোষ্ঠীর প্রধানা সেই নারী তাঁদের মুক্তি দিতে রাজি হন বটে, কিন্তু একটি অতি সাধারণ দাবির বিনিময়ে। রুদকপুত্র ভীমের কৌমার্য হরণ করবেন সেই উদ্ভিন্নযৌবনা নিষাদ রমণী। করবেন এক পক্ষকাল ধরে। প্রতিদিন। প্রতিনিশি।
রাজি হতে দুবার ভাবেননি রুদক। এই উগ্র নরখাদক নিষাদজাতির নৈশভোজ হওয়ার থেকে এদের একপক্ষকাল যাবৎ শ্বশুর হওয়াটাই বরং তাঁর কাছে অনেক বেশি গ্রহণীয় মনে হয়েছিল।
তারপর অনেক নারীসঙ্গ করেছেন ভীম। প্রাগজ্যোতিষ থেকে কলিঙ্গ, প্রয়াগ থেকে সমতট, বহুবিচিত্র নারীর কামার্ত বাঁধনে ধরা দিয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ ভীম। কিন্তু এখনও একান্ত অবসরে চোখ বুজলেই সেই ঘোরকৃষ্ণা নিষাদ রমণীর আদিম আরণ্যক স্বাধীন কামগন্ধ তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ষার কালিন্দীর মাতম জাগিয়ে তোলে। সেই সুবতুল স্তনদ্বয়, সেই ভারী নিতম্ব দুটি, সেই রহস্যঘন ঊরুসন্ধি, সেই শীৎকার, সেই নখরাঘাত, সেই আশ্লেষ, সেই সুদীর্ঘ নেশাতুর রমণক্লান্ত দিন কয়টি। এক অমাবস্যা তিথিতে রক্তচর্চিত প্রস্তর খণ্ডের সামনে গলায় বন্যপুষ্পের মালা ঝুলিয়ে, সমবেত নৃত্যগীতবাদ্যর মধ্যে মহুয়ার রসস্নাত মাদকাচ্ছন্ন রাত্রি দিয়ে সেই সুদীর্ঘ কামপক্ষের শুরু। চাঁদের কলাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে সেই বন্য দুহিতার অসংকোচ রমণতৃষ্ণা। সেই অখণ্ড নিবিড়তার মধ্যে কোথা থেকে যে এক চান্দ্রপক্ষ কেটে গেছে তা টেরই পাননি তিনি।
এই নিষাদপুত্র সেই স্বাধীনা নিষাদকন্যার সন্তান। না, এ ছেলে ভীমের ঔরসজাত নয়। কার ঔরসজাত সে কথা সেই মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠীর প্রধানা রমণীটি নিজেও জানেন না। শুধুমাত্র ভীমের পৌরুষতৃপ্ত সেই রমণী একদিন তাঁদের অরণ্যের প্রান্তবর্তী একটি প্রস্তরমূর্তির সামনে, গোপন নিষাদতন্ত্র অনুযায়ী এই নিষাদপুত্রকে ভীমের সন্তান হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেই থেকে এই নিষাদপুত্র নিজেকে কৈবর্তসন্তান ভীমের পুত্র বলেই পরিচয় দেয়।
একমাত্র মা-ই জানেন তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের পিতা কে!
সেই নিষাদপুত্র আজ তাদের জঙ্গলের ঘেরাটোপ ছেড়ে পিতৃস্বার্থে নেমে এসেছে বরেন্দ্রভূমিতে, এসেছ নিষাদজননীর আজ্ঞা শুনে। লোকমুখে সেই নিষাদরাজ্ঞী শুনেছেন এই বিপুল রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা, শুনেছেন স্বাধীনতার দাবিতে, ন্যায়ের দাবিতে কৈবর্তদের সর্বস্ব পণ রেখে এই প্রাণান্তক লড়াইয়ের খবর। তাই তিনি তাঁর গর্ভজাত বীরপুত্তলিটিকে পাঠিয়েছেন তাঁর ধর্মপিতার কাছে। তিনি আশা করেন প্রবল বিক্রম পিতা তাঁর প্রশস্ত বক্ষে বীর পুত্রকে ঠাঁই দেবেন অবশ্যই। এবং সেই পিতা তাঁর যোগ্য পুত্রকে শিখিয়ে দেবেন আধুনিকতম সমরকৌশল, পাঠ দেবেন সমকালীন রাজনীতির কূটাভাস।
আর যদি তাঁর পুত্র পরাস্ত হয় দৈবগতিকে? পরাস্ত হন তার পরাক্রান্ত পিতা?
ধুর, তাও সম্ভব নাকি? স্থানীয় ধর্মগুরুরা কি বিন্ধাদেবীর আশির্বাদী ফুল এনে দেননি ওর কেশবিহীন মস্তকে? অপদেবীর বিষাক্ত দৃষ্টিক্ষেপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে উৎসর্গ করা হয়নি কি বিজিত জাতির সমর্থ নারীদের মুণ্ড? তবে?
সেই আশাতেই এই মহারণে নিজের বীর সন্তানকে পাঠিয়েছেন সেই নিষাদনেত্রী।
সে একা আসেনি, এসেছে একশোজন বাছা বাছা নিষাদযোদ্ধা নিয়ে। তাদের এক-একজনের বিশাল শরীরে সহস্র হস্তীর বল, চোখে আদিম অরণ্যের শীতল নিষ্ঠুরতা। তারা কৈবর্তবাহিনীকে সেই তীক্ষ্ণতা দিয়েছে যার অভাবে এতদিন তারা বার বার পরাস্ত হচ্ছিল পাল সৈন্যবাহিনীর হাতে। সেই তীক্ষ্ণতার একটিই নাম, আরণ্যযুদ্ধনৈপুণ্য!
সেই প্রবল বর্ষাধারার মধ্যে অকম্পিত দীপশিখার মতো স্থির দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটি। তার প্রশস্ত নগ্ন বক্ষ জুড়ে নেমে যাচ্ছিল সেই অকাল বর্ষণের ধারাপ্রপাত। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় ছিল ধনুকের সটান ছিলার মতোই তীক্ষ্ণ ও তীব্র। এই ধারাপ্রপাতের ঘোরশব্দের মধ্যেও তার কানে ধরা পড়ছিল টুকরো টুকরো ক্ষীণ শব্দগুলি। সব ঠিক আছে। ওরা এসে পড়েছে কাছাকাছিই, ওর সঙ্গীসাথিরা।
নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেই একবার হেসে নিল সে, এমন ন্যাড়া মাথার জন্যেই তো মা ভালোবেসে ওকে ডাকে…
কী যেন ডাকে? মনে পড়ে না ছেলেটার। এই একটা ওর অসুবিধা, সবসময় সব কথা ওর মনে থাকে না। মাঝেমধ্যেই বেভুল হয়ে যায় ওর সবকিছু, ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে চারিদিকে। এমন সময় মা এসে ওর ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মিঠে গলায় ডাকে…
আহ, কী বলে যেন ডাকে?
মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নেয় ও। কিছুতেই মনে পড়ছে না। অথচ বাকি সব স্পষ্ট মনে আছে। এই যেমন এরা এই জঙ্গলে এখন কী করছে!
জঙ্গলের সীমানা শেষ হতেই কালিন্দী নদী, গৌড়বঙ্গে প্রবেশ করে যার নাম হয়ে যায় রায়মঙ্গল। সেই নদী আর জঙ্গলের মধ্যে শিবির ফেলেছেন কোটাটবীনাথ বীরগুণ এবং তৈলকম্পাধিপতি রুদ্রশিখর। মগধনরেশ ভীমযশের পর পাল সাম্রাজ্যের পক্ষাবলম্বী হয়ে সর্বাধিক সৈন্যসংস্থাপন করেছেন এই দুই সামন্তপ্রভু। এদের ওপর একটি ভয়াবহ আঘাত হানতে পারলেই পাল সৈন্যদের অনেকটা দুর্বল করা যাবে। একই সঙ্গে কৈবর্ত নৌসেনার জন্য উন্মুক্ত হবে কালিন্দী। সেই উদ্দেশ্যেই বাবা নামের লোকটা… না না না, বাবা নয়, মহারাজ ভীম আজ তাঁদের এই নিশাভিযানে পাঠিয়েছেন।
জঙ্গলের মধ্যে অবশ্য প্রহরার কমতি ছিল না। কমপক্ষে চল্লিশটি মৃতদেহ এখনও সেই গহীন অরণ্যের মধ্যে কোথাও পড়ে আছে। ভাবতেই লোলুপ একটা চিন্তা মুহূর্তের জন্যে আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে।
নাহ কাজ আগে। একটা হালকা শিসের শব্দ করে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায় সে, পিছনে পিছনে ঘাতকমূর্তি ধরে আরও একশোজন নিষাদ।
শিবিরের মধ্যে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন সম্রাট রামপাল। সামনে গম্ভীরভাবে বসেছিলেন প্রধান অমাত্য মথনদেব, প্রধান সেনাপতি বিশুদ্ধানন্দ, রামপালপুত্ৰ বিত্তপাল এবং মহাসান্ধিবিগ্রহিক সত্যব্ৰত।
“দুটি শিবির সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত?” উদগ্র বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন সম্রাট।
“হ্যাঁ প্ৰভু, কমপক্ষে অর্ধসহস্র সামন্তসৈন্য নিহত। দ্বিশতাধিক সৈন্য সেই ঘোর আক্রমণের সামনে দিশেহারা হয়ে উত্তাল কালিন্দীতে ঝাঁপ দেয়, তাদের কারওই কোনো খোঁজ নেই”, ধীর ও শুষ্ক স্বরে জানালেন সত্যব্রত।
“আশ্চর্য। অতি আশ্চর্য। কারা করল এসব? রুদ্রশিখর, বীরগুণ, দুজনেই আমাদের মহাশক্তিশালী সামন্তসহায়। যদি তাদেরই অমন বলশালী সৈন্যদলের এই ভয়াবহ পরিণতি হয়, তাহলে বাকি সামন্তশাসকরা কী ভাববেন? কী করে হল এসব? কারা করল?”
এইবার নড়েচড়ে বসলেন সত্যব্রত। পদাধিকারবলে তিনি গুপ্তচরবাহিনীর প্রধানও বটে। তাঁর কণ্ঠস্বরে সর্বদাই এক আবেগহীন নৈর্ব্যক্তিকতা খেলা করে। সেই নিরাবেগ নিষ্কম্প স্বরে তিনি কথা বলতে শুরু করলেন,
“যে দুজন সৈনিককে আমরা জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছি, তারা এক অদ্ভুত কাহিনি বলছে প্রভু। সেই ঘোর বর্ষারজনিতে সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেকে আকণ্ঠ পৈষ্টী, গৌড়ীয় প্রভৃতি পান করে অতি সত্বর নিদ্রাভিভূত হয়। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে অকস্মাৎ এদের ঘুম ভেঙে যায় এবং তখন তারা স্কন্ধাবারের প্রায় নিভন্ত প্রদীপের আলোয় দেখে যে জনা কয়েক উলঙ্গ এবং ভীষণদর্শন পুরুষ কৃপাণ আর প্রস্তরনির্মিত গদাহস্তে ঘোররবে সৈন্যনিধনে রত। যারাই বাধা দিতে গেছে, মুহূর্তমধ্যে নিহত হয়েছে। সেই রক্তস্নাত উলঙ্গ কালভৈরবসদৃশ পুরুষদের সামনে কেউই কোনো প্রতিরোধ করতে পারেনি। যেভাবে শৌখিন গুল্মলতা বন্য কুঠারাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়, নিদ্রিত সামন্তসৈন্যরা সেই রাতে সেইভাবেই নিহত হয়েছে।” বিস্মিত হলেন রামাবতীনাথ পালসম্রাট রামপাল, “কারা এরা? কোথা থেকে এল?”
“বলা দুষ্কর প্রভু। সামান্য আলো-আঁধারিতে এরা যা দেখেছে, সেই অনুযায়ী সেই ঘাতকদের দেহ অতি বিশালাকার, অদ্ভুত তাদের হননকৌশল, অসম্ভব দ্রুত তাদের চলন। দেখে মনে হয় নরকের মায়াবী দৈত্যরা যেন জীবন্ত বিভীষিকার রূপ ধরে পাতাল থেকে উঠে এসেছে। তারা মানুষ নয়, কালান্তক যমরাজ যেন স্বয়ং শিকারে বেরিয়েছিলেন তাঁর নারকীযূথ নিয়ে… অন্তত তাদের বিশালদেহী, কেশহীন নেতাকে দেখে তাইই মনে হচ্ছিল। কৃপাণের এক এক আঘাতে সে দুইটি মস্তক দেহ থেকে বিযুক্ত করার ক্ষমতা রাখে, এতই শক্তিধর সে।”
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন সম্রাট এবং বাকি অমাত্যরা, তাঁদের মুখে কথা জোগায় না।
শুধু তাই নয়, সৈনিক দুজন আরও একটি কথা বলেছে, যা এতই অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য যে…” এতটা বলেই চুপ করে গেলেন সত্যব্ৰত।
“কী হল, থেমে গেলেন কেন?” সামান্য অস্থিরতাই প্রকাশ পেল সম্রাটের গলায়।
“সম্রাট কি ভুলে যাচ্ছেন যে ওই সৈনিক দুটি তাদেরই স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণ মদ্যপাবস্থায় ছিল? কী দেখতে কী দেখেছে… তাদের কথায় এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই বলেই মনে হয়। আমার মতে সবই ওই নীচ কৈবর্তদের নোংরা খেলা… অমন ভীতিপ্রদ বর্ণনা আসলে দেবী আসবেশ্বরীর কৃপায় পরিলক্ষিত কল্পিত কাহিনি মাত্র। কালিঝুলি মেখে কাপুরুষের মতো রাতের অন্ধকারে এসে…” দাঁতে দাঁত ঘষেন প্রধান সেনাপতি বিশুদ্ধানন্দ, সম্পর্কে তিনি সম্রাটের আত্মীয়ও বটে। রাষ্ট্রকূট বংশের মানুষ তিনি, স্বভাবটা স্বতই সামান্য উগ্র
“পালাবার ঠিক আগের মুহূর্তে সেই স্কন্ধাবারের বাইরে তারা দেখে যে”, নির্বিকার স্বরে বলতে থাকেন রাজ্যের সান্ধিবিগ্রহিক সত্যব্রত, “কালিন্দীতীরে সেই অঘোর ভৈরবের দল…” বলে একবার ঢোঁক গিললেন, “মৃত সৈনিকদের দেহ নিয়ে ভোজনসভা বসিয়েছে!”
“কী বললেন? ভোজসভা? সৈনিকদের মৃতদেহ নিয়ে? এই কথাটার মানেটা কি অমাত্য সত্যব্রত? তারা কি কাঁচা নরমাংস ভক্ষণে ব্যস্ত ছিল?” সম্রাট রামপালের চোখে স্পষ্টতই অবিশ্বাস।
“হ্যাঁ প্রভু, আপনার অনুমান যথার্থ।”
শিউরে উঠলেন সম্রাট, চোখ বন্ধ করে তথাগতকে স্মরণ করলেন। বিত্তপাল এখনও কিশোর, তার মুখ দেখে মনে হল এখানেই বমন করে ফেলবে সে।
“এ কথা যে তাদের স্বকপোলকল্পিত নয় তার প্রমাণ কী?” ভ্রূকুটিকুটিল চোখে প্রশ্ন করলেন সেনাধ্যক্ষ বিশুদ্ধানন্দ। “কারণ পরদিন প্রভাতে আমরা সেইস্থানে বেশ কয়েকটি অর্ধভুক্ত নরদেহ পেয়েছি”, অসম্ভব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উত্তর দেন সত্যব্ৰত।
এরপর আর কারওই কিছু বলার থাকে না।
এর মধ্যেই শিবিরের আলোচনায় মাথা গলায় রাজপ্রতিহারী, সংকুচিত স্বরে জানায়, “আমি ক্ষমাপ্রার্থী মহারাজ, কিন্তু কজঙ্গল মণ্ডলাধীশ নরসিংহার্জুনের প্রধান সেনাধ্যক্ষ ভুজঙ্গদাস মহারাজের দর্শনাঙ্ক্ষায় বাইরে উপস্থিত। এই দণ্ডেই তিনি মহারাজকে কিছু সংবাদ দিতে চান।”
ভুজঙ্গদাসের ভগ্নদূতসম রূপ দেখে দুঃসংবাদ বলেই আশঙ্কা করেছিলেন সম্রাট রামপাল। কিন্তু তাই বলে এতটা আশা করেননি!
আজকের দ্বিপ্রহরে, প্রকাশ্য দিবালোকে নরসিংহার্জুনের স্কন্ধাবারে চকিত বন্য আক্রমণে দ্বিশতাধিক সৈন্য নিহত। সমস্ত শিবির ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্ট অবস্থায় বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। আক্রমণকারী বিশালদেহী বন্যদের দল লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে অজস্র অস্ত্রশস্ত্র এবং মূল্যবান মাণিক্যসমূহ। কোনোমতে প্ৰাণ হাতে করে পালিয়ে বেঁচেছেন সামন্তশ্রেষ্ঠ নরসিংহার্জন। তাঁর প্রিয়তমা নর্তকী অম্বালিকার শরীর পাওয়া গেছে স্কন্ধাবারের সংলগ্ন জঙ্গলে, অবশ্য শরীর বলা ভুল, অর্ধভুক্ত দেহাংশ বলাই ভালো। বাম স্তনের তিল এবং দক্ষিণ পদাঙ্গুলি পরিহিত অঙ্গুষ্ঠটি দেখে শরীরটি অম্বালিকার বলে চিহ্নিত করেন রাজা নরসিংহার্জুন স্বয়ং!
এক আতঙ্কজনক কালসন্ধ্যা যেন নেমে এল এই উজ্জ্বলিত শিবির মধ্যে। এই মুহূর্তে এই নৃশংস নরখাদকবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধী ব্যবস্থা না নেওয়া হলে শুধু কজঙ্গল কেন, বাকি যে যে সামন্তপ্রভুরা পালসম্রাট রামপালের ধ্বজতলে একত্র হয়েছেন বরেন্দ্রভূমি উদ্ধারকল্পে তাঁদের প্রত্যেকে যে বিরূপ হবেন, সে কথা বুঝতে সভায় উপস্থিত কারওই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হয়ওনি। মাথা নীচু করে সেই কথাই ভাবছিলেন রামপাল। বাকিরাও মূঢ়, মূক, ম্লান মুখে ভাবছিলেন এই সদ্যজাত ঘটনার গতিপ্রকৃতি।
সহসা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন মথনদেব। শুধুমাত্র প্রধান অমাত্যই নয়, সম্পর্কে তিনি সম্রাটের মাতুলও বটে। প্রগাঢ় কূটবুদ্ধিসম্পন্ন এই দক্ষিণী ব্রাহ্মণের ওপর অগাধ আস্থা সম্রাটের। সবাই তাঁর দিকে তাকাতে তিনি শান্ত ও গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করলেন,
“আমার মনে হয় এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। একটি প্রাচীন রহস্য বহুদিন ধরে আমাকে বিব্রত করে রেখেছে। জানি না কেন মনে হচ্ছে যে এই আধিভৌতিক ঘটনাবলির সঙ্গে তার যোগ থাকলেও থাকতে পারে।” এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন মথনদেব, চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন একবার। সমগ্র শিবিরে তখন তৃণপতনতুল্য স্তব্ধতা, প্রতিটি লোক উৎকর্ণ হয়ে শুনছেন তাঁর প্রতিটি শব্দ। আবার শুরু করলেন তিনি,
“আপনারা জানেন যে পূর্বতন মহারাজ যখন সম্পূর্ণ ভ্রান্তিবশে বর্তমান সম্রাটকে বন্দি করেন, তখন থেকে আমি গোপনে বিভিন্ন সামন্তশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলাম। বলতে বাধা নেই, বিশ্বাসঘাতক কুচক্রী দিব্যোকের সঙ্গেও তখন আমাদের গোপন যোগাযোগ ছিল এবং আমরা নিয়মিত আমাদের মধ্যে খবরের আদানপ্রদান করতাম। কারণ সেই সময়ে আমাদের শত্রু ছিলেন একই, সম্রাট মহীপাল। বস্তুত দিব্যোককে আমিই প্ররোচিত করি গৌড় আক্রমণ করতে, গূঢ়পুরুষদের দ্বারা তার কাছে পৌঁছে দিই পালবাহিনীর গোপন তথ্যসমূহ, চিহ্নিত করে দিই দুর্বল অংশগুলিকে।
যে ঘটনার কথা বলছি, তা আজ থেকে প্রায় দশবছর আগেকার। সেই সময়ে একবার আমারই ব্যবস্থাপনায় দিব্যোকভ্রাতা রুদক এবং তার কুলাঙ্গার সন্তান ভীম, তারা দুজনে মগধ যায় তৎকালীন মগধনরেশ দিব্যরক্ষিতের সঙ্গে দেখা করতে। খবরে প্রকাশ, দিব্যরক্ষিতের সঙ্গে দেখা করার পর থেকে গৌড়ে ফিরে আসতে তাদের যা সময় লাগার কথা, তার থেকে ঠিক একমাস সময় বেশি লাগে।
এই বিলম্বের কারণ আমি বহুবার তাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছি, কিন্তু প্রতিবারই তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এড়িয়ে গেছে। আমিও শেষে বিরক্তিবোধে তাদের এই বিষয়ে প্রশ্ন করা ত্যাগ করি, যদিও সংশয়ে অবশেষে, নিতান্ত দৈবাৎ আমি এই বিলম্বঘটিত কারণের কিছু সূত্র পাই।
সেই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর জগদ্দল মহাবিহারের গোপন . প্রকোষ্ঠে, বিহারাধ্যক্ষ ভন্তে স্থবিরপা-র নেতৃত্বে মহীপালবিরোধীদের এক সভা সংঘটিত হয়। সেই সভা ভঙ্গ হওয়ার পর আমি আর রুদক আকণ্ঠ মাীক পান করি। সেইদিন নেশার আবেশে সেই নীচ, ধূর্ত, কুটিলচেতা কৈবর্ত আমাকে জানায় সেইবার তাদের বিলম্বের প্রকৃত কারণ।”
ফের একবার থামলেন মথনদেব। বাতাসও বোধকরি উদগ্রীব হয়ে শুনছিল তাঁর কথা। বাকিদের তো কথাই নেই। প্রত্যেকে নিশ্বাস অবধি বন্ধ করে রেখেছেন, সমস্ত ইন্দ্ৰিয় দিয়ে যেন শোষণ করছেন মথনদেবের কাহিনি।
“পীঠি থেকে গৌড় ফেরার পথে, তারা নাকি নিতান্তই গ্রহবৈগুণ্যে কোনো আদিম নরমাংসাশী অসভ্য জনজাতি কর্তৃক বন্দি হয়। মত্ত রুদকের স্বীকৃতি অনুযায়ী, সদ্যযুবা ভীমকে সেই নরখাদী গোষ্ঠীর নেত্রীর হাতে পক্ষকালযাবৎ তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই ছাড়া পায় তারা। ব্যাস, এইটুকুর বাইরে বহু প্রশ্ন করেও আর কোনো উত্তর পাইনি আমি।”
“নেত্রীর হাতে তুলে দেওয়া? এর মানে কী? সেই কুলাঙ্গার যে নিহত হয়নি সে তো দেখাই যাচ্ছে। তাহলে তাকে একপক্ষকাল নিজের কাছে রেখে কীই বা করলেন করলেন সেই জংলি গোষ্ঠীনেত্রী?” বিস্মিত হয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললেন বিশুদ্ধানন্দ।
আড়চোখে একবার বিত্তপালের দিকে তাকালেন মথনদেব। তারপর সামান্য বিব্রত স্বরে বললেন, “খুব সম্ভবত পক্ষকালব্যপী অবাধ যৌনতা। মাতৃতান্ত্রিক আদিম শবর ও নিষাদদের মধ্যে এর প্রচলন আছে বইকি!”
কিশোর বিত্তপাল একবার ফিচিক করে হেসে ফেলেই গম্ভীর হয়ে যায়।
সমগ্র সভা স্তব্ধ হয়ে এই কাহিনি শুনছিল। সেই নৈঃশব্দের মাঝেই রাজপ্রতিহারী ফের প্রবেশ করে সভায়। খুবই ইতস্ততভাবে জানায় যে গুপ্তপুরুষবাহিনীর প্রধান অনঙ্গদেব এক্ষুনি অমাত্য সত্যব্রতর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
“কী ব্যাপারে? উনি কি জানেন না আমরা কী ধরনের গোপন আলোচনায় ব্যাপৃত?” সেনাপতি বিশুদ্ধানন্দের রুষ্ট স্বরে ঝলসে উঠল ঘোর বিরক্তি। সেই স্বর উপেক্ষা করে ধীর স্বরে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করলেন সত্যব্রত, “প্রভু, অনঙ্গদেবকে বিশেষ কাজে আমি গোপনে ডমরনগরে পাঠিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই সে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পেয়ে সবিশেষ উত্তেজিত, তাই অপেক্ষা না করে এখনই আমার কাছে এসেছেন। অনঙ্গদেবকে সভায় উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দিন প্ৰভু
মুহূর্ত কয়েকের প্রতীক্ষামাত্র, আরক্তমুখে প্রবেশ করলেন অনঙ্গদেব, তাঁর সমস্ত শরীরে ফেটে পড়ছে বিপুল উত্তেজনায়। মহারাজকে অভিবাদন করে এক নিশ্বাসে বলে উঠলেন তিনি, “গুরুতর সংবাদ এনেছি প্রভু। আমরা আজ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে।” এই বলে সংবাদের পেটিকা খুলে বসলেন সেই প্রবীণ ও সুদক্ষ রাজকর্মচারী।
*****
অনুচ্চ পাহাড়ের পাদদেশের জঙ্গলটির মধ্যে একাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল ছেলেটি, জঙ্গলেই সে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। শরতের মিঠে কিন্তু তীক্ষ্ণ রৌদ্রে চকচক করছিল তার সম্পূর্ণ কেশবিহীন মস্তক, নিকষ কৃষ্ণ নগ্নশরীরে পেশির ভাঁজে ভাঁজে জমে উঠছিল শিশিরের মতো স্বেদবিন্দু। একটা গাছের ডাল হাতে আনমনে এদিক-ওদিক দোলাতে দোলাতে হাঁটছিল সে। বোঝাই যায়, এই হাঁটার পেছনে লক্ষ্যে পৌঁছাবার কোনো তাড়া নেই, বরং উন্মনা স্বগত চিন্তার ভাবটি স্পষ্ট।
এই এলাকায় এখন কোনো লোক নেই, বা বলা ভালো কোনো সমর্থ শরীরের পুরুষ নেই। সবাই এখন ডমরনগর বা তার আশেপাশের অঞ্চলে। কারণ কাল থেকে যুদ্ধ শুরু, মহাযুদ্ধ।
বাবা নামের লোকটা তাকে বলেছেন যে সে খুব ভালো যুদ্ধ করেছে। শত্রুদের নাকি নাকের জলে চোখের জলে একাকার করে দিয়েছে। তাই খবর এসেছে যে শত্রুরা সব লোকজন নিয়ে কালকে নাকি বাবাকে আর ওকে মারতে আসছে, কাল তাই দুই দলে লড়াই হবে, খুব লড়াই।
লড়াইয়ের কথা ভাবতেই শরীরটা চনমন করে উঠল তার। লড়াই করতে সে খুব ভালোবাসে, রক্ত দেখলে তার শরীরে আনন্দের মাতম লাগে। শত্রুর মাথা বিদীর্ণ করার মধ্যে যা সুখ, তার তুল্য শুধু বিন্ধ্যা ঠাকুরানির কাছে উৎসর্গীকৃত মহাভোজের স্বাদ। তাই কালকের জন্যে ও আর ওর সঙ্গীসাথিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। বাবা নামের লোকটা বলেছে ওদের ওপরেই নাকি নির্ভর করছে ওর দেশের লোকের ভবিষ্যৎ।
‘ভবিষ্যৎ’ শব্দটা মনে আসতেই ন্যাড়া মাথাটা একবার চুলকে নেয় সে। তার পক্ষে শব্দটা এমনিতেও খুব ভারী। তাদের যেমন অতীতও নেই, তেমন ভবিষ্যৎ বলতেও তারা কিছু বোঝে না। এমনকি তাদের সমাজে বেশি শব্দেরও প্রচলন নেই। আহার নিদ্রা মৈথুন হত্যা, এই সহজচক্রে তাদের জীবন চলে। গোষ্ঠীর সকলে একত্রে বাস করে, একসঙ্গে ভোজন করে, একসঙ্গে শয়ন। এই সহজ সরল সমাজে কারও নাম রাখার প্রচলন নেই। এই, ওই, তুই, সে, এই বলে যখন কাজ চালিয়ে নিতে পারছে লোকে, তখন একটা নাম রাখার প্ৰয়োজন কী?
সেই নামহীন আদিম সমাজে জন্মেও তার একটা নাম আছে, যা তার এই লোকটা তাকে দিয়েছিল। এই লোকটা তাকে সত্যিই ভালোবাসে, তাই তার মা সেই নামটা গর্বভরে মনেও রেখেছে, মাঝে মাঝেই তাকে আদর করে সেই নামে ডাকে।
আহ, নামটা যেন কী? মনে আসি আসি করেও আসছে না। নিজের কেশহীন মাথাতেই কয়েকটা কঠোর মুষ্টাঘাত করে সে। নাম জিনিসটাই তাদের সমাজে বড়ো গোলমেলে জিনিস, তার ওপর এই নামের উচ্চারণটাও বড়ো ভজকট। মা বলেছে এই নামটাই তার সঙ্গে তার বাবার সমাজের যোগাযোগের একমাত্র উপায়।
তার সমাজ? কথাটা মনে হতেই একটা শিশংপা গাছের নীচে বসে পড়ে ছেলেটি। একটা কথা তার মাথায় আসছে কাল থেকেই… ভাবছে সেই কথাটাই সে…
কে তার সমাজ? কারা? এই যে তাদের আশেপাশের লোকজন, তারা যে তাদের মতো প্রায় উলঙ্গ নরমাংসভোজীদের অত্যন্ত ঘৃণা করে, সেইটা সে আর তার সঙ্গীরা বেশ বুঝতে পারে। শুধু ঘৃণা নয়, তার মধ্যে অনেকটা আতঙ্কও মিশে থাকে, সেটাও তার চোখ এড়ায়নি।
কাদের জন্যে মারছে সে? কাদের মারছে? কেন মারছে? যাদের মারছে তারা এমনিতেও তার কেউ নয়, তাদের সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। আর যাদের হয়ে মারছে, তারাও কেবলমাত্র নামেই তাদের আপন করে নিয়েছে, ব্যবহারে রেখেছে অচ্ছুত করে। তাদের দীর্ঘ দেহের ছায়াদর্শনমাত্র এই নগরের গে।কেরা আশঙ্কিত হয়ে পড়ে, মাঠেঘাটে খেলছে এমন শিশুদের ঘরে জোর করে ঢুকিয়ে দেয় এবং বাইরে থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে, বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অতিসতর্কভাবে ঘাড় নুইয়ে হেঁ হেঁ করতে থাকে। তাদের দেহভঙ্গিতে সচরাচর এমন সতর্কতা দেখা যায় হিংস্র বুনো কুকুর বা ধূর্ত বন্য শিয়ালের সামনে। এরাও তার কেউ নয়।
তাহলে এখানে তারা এসেছে কেন? যে শত্রুতায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই, যে আগুন তারা জ্বালায়নি, তাতে হবি আহুতি দেওয়ার দেওয়ার জন্যে তাদের কেন আসা?
কে জানে, তার মাথায় এতসব ঢোকে না। মা থাকলে হয়তো বুঝিয়ে দিত। মায়ের গায়ে যেমন শক্তি, বুকে তেমন সাহস, আর মাথায় তেমনই বুদ্ধি। মা থাকলে নিশ্চয় তার ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে সব বুঝিয়ে দিত ঠিকঠাক… আদর করে ডেকে বলত…
কী যেন বলত? আহা, নিজের নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না তার… কী যেন নাম তার… তার মা যেন কী নামে ডাকে তাকে…
“কী বলছেন কী সম্রাট? ভীম আর হিমালয়কে হত্যা করতে গেলে এই মহাস্ত্রটি ছাড়া আমাদের হাতে আর উপায় আছে নাকি? একে হিমালয়ের মতন বিশালদেহী, যুদ্ধবিশারদ, জিতক্লম রণহস্তী এতদঞ্চলে আর একটিও নেই। হিমালয়ারূঢ় ভীমকে দেখায় যেন ঐরাবতপৃষ্ঠে স্বয়ং পুরন্দর! তার একপাশ রক্ষা করে কুমার শর্বদেব, ধনুকচালনায় গাণ্ডিবধন্বা ফাল্গুনির সমতুল্য সে। আর-এক পাশ রক্ষা করে ভীমের পোষ্যপুত্র মহাবল চণ্ডক, তার বাহন সেই ভীষণ বন্য মহিষে আরূঢ় হয়ে দুই হাতে দুই বিশাল খড়া ধারণ করে সে রণভূমে ঘুরে বেড়ায় কালান্তক কৃতান্তের ন্যায়। এদের মতোই কোনো মহারথীদের জন্যেই এত যত্নসাধনে সেই সুদূর চিনদেশ থেকে আনা ব্রহ্মাস্ত্রটি রক্ষিত, আর তাকে প্রয়োগ করতে হবে ওই জংলি বর্বরটির ওপর? এই মহাস্ত্র একটি মাত্র ছাড়া আর নেই প্ৰভু, আপনাকে এই নির্দেশ আরও একটিবার পর্যালোচনা করতে অনুরোধ করছি”, কথাগুলো যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বললেও বিশুদ্ধানন্দের কণ্ঠস্বরের উষ্মা কিছুতেই গোপন করা গেল না।
কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আচার্য অতীশ যখন সুদূর তিব্বতে সদ্ধর্মের প্রচারে নিরত ছিলেন, তখন তিনি চৈনিক দেশ থেকে আহৃত এই মহাস্ত্র দেখে মোহিত হন। তিনিই বহু কষ্টে ও বহুমূল্যে একটি বিশালাকার অস্ত্র ক্রয় করেন এবং বিশ্বাসী কিছু ছাত্রের হাত দিয়ে তৎকালীন সম্রাট ন্যায়পালের কাছে পাঠান।
মহাস্ত্রটি দেখতে বড়োই অদ্ভুত। একটি অতি দীর্ঘ ও দৃঢ় বংশদণ্ডের মাথায় কাষ্ঠনির্মিত বেলনাকার একটি দুইহাত পরিমিত বস্তু দৃঢ়ভাবে বদ্ধ। অত্যন্ত ভারী সেই বেলনটি থেকে নেমে এসেছে নাতিদীর্ঘ রজ্জু। অস্ত্রটি প্রয়োগের উপায় হচ্ছে, যেদিকে শত্রু অবস্থিত, সেদিকে বেলনটির সূচাগ্রভাগটি নির্দেশ করে সেই রজ্জুতে অগ্নিসংযোগ করা।
তারপরেই নাকি বিশাল গর্জনে ঘোররবে সেই ব্রহ্মরাক্ষস ধেয়ে যায় শত্রুর প্রতি। তার জ্বালামুখ থেকে ক্রমশই উদ্গিরণ হতে থাকে কালভৈরবতুল্য ক্রোধবহ্নির। তারপর স্বর্গমর্ত্যপাতাল কম্পিত করে শত্রুর ওপর আছড়ে পড়ে সেই বজ্রতুল্য মারণাস্ত্রটি। যত বলশালী শত্রুই হোক না কেন, এই অব্যর্থ মৃত্যুর হাত থেকে কারও রেহাই নেই।
আর তাই কালকের নির্ণায়ক যুদ্ধে এর ওপর বড়ো বেশি আশা করে রেখেছিলেন বিশুদ্ধানন্দ। হিমালয়ারূঢ় ভীমকে একবার পতিত করতে পারলে কৈবর্তদের মনোবল ভেঙে যেতে বাধ্য। তদুপরি এই অমোঘাস্ত্রটির আরও কয়েকটি হুবহু নকল বানিয়ে রেখেছেন তিনি। একটি অস্ত্রের বিধ্বংসী মারণযজ্ঞ দেখেই ওরা ভীত হবেই, তারপর আরও এমন অস্ত্র দেখিয়ে ওদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাতে কতক্ষণ? এখন সম্রাট যদি আদেশ দেন সেই একটি মাত্র শত্ৰুঘাতী অস্ত্রকে কোনো এক জংলির ওপরে প্রয়োগ করতে, সেক্ষেত্রে সেনাপ্রধানের পক্ষে ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক।
“গুপ্তচর প্রধান অনঙ্গদেব সেদিন যা শোনালেন”, গম্ভীর স্বরে বললেন সম্রাট রামপাল, “তা যদি সত্যি হয়, তবে আকারে, প্রকারে, শক্তিতে আর নীতিহীন যুদ্ধের বীভৎসতায় ওই আরণ্যকদের সমকক্ষ কেউ নেই। ভীম অতি ধুরন্ধর পুরুষ, সে এইসব ভেবেই এই নিষাদবাহিনীকে আনিয়েছে। এদের এক এক জন দশজন সাধারণ সৈন্যের সমান। এমনিতেই এদের নিয়ে পালসৈন্য এবং সামন্তচক্রের সৈন্যদের মধ্যে বিচিত্র সব গুজব ছড়িয়েছে। এরা নাকি মায়াবী রাক্ষস, দশানন রাবণের বংশাবতংস, যমরাজের নিজস্ব বাহিনী ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের ওই বিশালদেহী কেশহীন নেতাটিকে এই অস্ত্র ছাড়া হত্যার উপায় নেই। তাতে আমাদের সেনাদের মনোবল বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে, তা ছাড়া সংখ্যাধিক্যের জোর তো আমাদের আছেই।”
“কিন্তু প্রভু, সেক্ষেত্রে ভীমকে পরাস্ত করার তবে কী উপায়? যতক্ষণ ভীম আছে রণক্ষেত্রে, কৈবর্তসেনা জানে যে তাদের রাজা আছে। তাদের রাজার ডাকে তারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করতে রাজি…”
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন বিশুদ্ধানন্দ, বাধ সাধল ঘরের কোণে বসে থাকা তরুণ সভাকবিটি, সামান্য মেয়েলি সুরে সে বলে উঠল, “বৃথাই তর্ক করছেন সেনাপতি। সম্রাট স্বয়ং ঈশ্বরতুল্য, তাঁর অবিদিত তো কিছুই নেই। নিঃশঙ্ক হয়ে প্রভু রামের আজ্ঞা পালন করুন আপনি। অধর্মের বিরুদ্ধে প্রভু শ্রীরাম যখন তাঁর ধনুর্বাণ তুলেছেন, জানবেন যে ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী।”
গনগনে চোখে সেদিকে তাকালেন বিশুদ্ধানন্দ। তাঁর বহুদিনের ইচ্ছে এই সখীভাবসম্পন্ন কবিবরের গণ্ডদেশে একটি বিশাল চপেটাঘাত করে এর কয়েকটি দন্ত উৎপাটিত করার। একে এই মেয়েলিপনা তাঁর বিন্দুমাত্র সহ্য হয় না, তারপর চাটুকারিতায় ছেলেটি প্রায় মহামহোপাধ্যায়! এর জীবনের একমাত্র সাধনা বোধহয় সম্রাটের পদলেহন করে জীবন ধন্য করা। অমাত্যরা আড়ালে হাসাহাসি করেন, একদিন দৈবাৎ যদি সম্রাটের পদাঙ্গুলিতে সামান্য বিষ মিশিয়ে দেওয়া যায়, এই অপোগণ্ডটি সেইদিনই ভবলীলা সাঙ্গ করবে নিশ্চিত। “আহ, তুমি আবার এ বিষয়ে কথা বলছ কেন?” প্রগাঢ় স্নেহমিশ্রিত স্বরে কবিবরকে মৃদু ধমক দেন সম্রাট, তারপর তাকান বিশুদ্ধানন্দের দিকে, “আপনার কি মনে হয়ে সেনাধ্যক্ষ, আমি এতই অর্বাচীন যে সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা না করেই আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি সেই মহাস্ত্র জংলিদের ওপর প্রয়োগ করতে?”
খুবই অপ্রস্তুত হন সেনাপ্রধান, নম্র স্বরে বলেন, “না প্রভু, ঠিক তা নয়…”
“ভীমের জন্যে আমরা একটি বিশেষ ব্যবস্থা করেছি সেনাপতি। তা জানাতেই আপনাকে আমরা ডেকেছিলাম।”
“অধীন খুবই উৎসুক সেই ব্যবস্থা জানতে, প্ৰভু।”
“গুপ্তচরপ্রধান অনঙ্গদেব বহুকষ্টে দঙ্গদাস নামের এক কৈবর্তকে অর্থদ্বারা বশীভূত করতে সমর্থ হন। এই দঙ্গদাস আবার কৈবর্ত সেনামুখ্যদের মধ্যে এক অতি বিশিষ্টজনের অঙ্গসংবাহক। তার মাধ্যমে অতি সুকৌশলে আমরা সেই সেনামুখ্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সমর্থ হই।”
বিশুদ্ধানন্দের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি শুনছেন না, প্রতিটি শব্দ তিনি শোষণ করছেন।
“অবশেষে প্রভূত আর্থিক উৎকোচ তথা অযুত ভূমিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে আমরা দলে টানতে পেরেছি সেনাপতি।”
এই সময়ে সেই চাটুকার কবিবর বাষ্পাকুল কণ্ঠে প্ৰায় ককিয়ে উঠলেন, “জানতাম, আমি জানতাম যে প্রভু শ্রীরামের অসাধ্য কিছু নেই। জয় শ্রীরামের জয়…”
সেইদিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিলেন না বিশুদ্ধানন্দ, চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কে সেই সেনামুখ্য প্রভু?”
“মহাবল চণ্ডক।”
কথাটা হৃদয়ঙ্গম করতে কিছু সময় নিলেন সেই প্রৌঢ় সেনাপ্রধান। তারপর বুঝলেন যে এই চালের মার নেই। এবং খুব সম্ভবত এ ছাড়া ভীমকে হারাবার অন্য কোনো পথ নেই। চণ্ডক সর্বদাই ভীমের পাশে থাকে। ভীমের ওপর এই মারণাস্ত্র প্রয়োগ করলে তাতে চণ্ডকেরও আহত হওয়ার সম্ভাবনা, সম্রাট তাই সেটা চাইছেন না। ভীম পরাস্ত হলেই কৈবর্তসেনা ছত্রভঙ্গ হতে বেশি সময় নেবে না। শুধু রয়ে যাবে একটি মাত্র অপ্রতিরোধ্য বিরুদ্ধশক্তি।
ভীমের নিষাদপুত্র। ভীমের নিষাদসৈন্যদল।
“যান সেনাপতি, নিশ্চিন্ত চিত্তে সৈন্যসমাবেশ করুন। কালকে অফলার যুদ্ধাঙ্গনে পাল সাম্রাজ্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। সংবাদটা যেন সূর্যাস্তের আলো থাকতে থাকতে পাই। ভীমকে জীবিত বন্দি করবেন, পারলে শর্বদেবকেও। আর হ্যাঁ, শুনুন, ভীমকে বন্দি করার পর একদল সৈন্যকে ডমরনগরের দিকে পাঠিয়ে দেবেন। আর তারপরেই কালবিলম্ব না করে এক ব্যক্তির মস্তকছেদন করে কর্তিত মস্তকটি আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। দেখবেন, যেন দেরি না হয়।”
“কার মস্তক প্রভু? ভীমের?”
“না, চণ্ডকের।”
এই বলে সেই তরুণ কবিবরের দিকে ফেরেন পাল সাম্রাজ্যের সার্বভৌম সম্রাট রামপাল। মিষ্ট হেসে বলেন, “তারপর সন্ধ্যাকর, তোমার রামচরিত কতদূর এগোল?”
যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে পুরো যুদ্ধটা দেখছিল তারা। তারা বলতে একশো একজন। নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো দাঁড়িয়ে ছিল তারা, সর্দারের ইঙ্গিতের অপেক্ষায়।
ছেলেটি তখন নৈর্ব্যক্তিকভাবে যুদ্ধ দেখছিল। এত মারামারি কাটাকাটি দেখতে দেখতে হাই উঠছিল তার একবার হাতের কৃপাণটিকে দেখে নিল, চমৎকার জিনিসই বানিয়েছে বাবা নামের লোকটার দেশের লোকজন। কেমন মুচুৎ করে মুণ্ডু কাটা যায়, তাদের মতো ধারালো পাথরের ছুরি দিয়ে কষ্ট করে কাটতে হয় না!
সকালে বাবা লোকটা তাকে ডেকেছিল, ডেকেছিল সেই নামে যেটা তার মা মনে রেখেছে। নামটা শুনে খুব ভালো লাগছিল তার, মায়ের কথা মনে পড়ে গেছিল কিনা! সে যাই হোক, লোকটা তাকে বলেছিল লোকটা যদি লাল রঙের কাপড় উড়িয়ে দেয়, তাহলে নেমে পড়তে। নইলে অপেক্ষা করতে।
তা অপেক্ষা করতে খারাপ লাগছিল না ছেলেটার। বাবা নামের লোকটা চড়েছে একটা হাতির ওপর। উরিব্বাবা, কী বড়ো সেই হাতিটা… বিন্ধ্যা ঠাকুরানির সামনে কম করে চারটে ভোজসভা হতে পারে ওর মাংসে। আর লড়তেও পারে বটে, যেমন হাতিটা, তেমন বাবাটা, দেখে খুব ভালো লাগছিল তার। এইজন্যেই মা বলেছে ওকে, যে ওর বাবাটাও খুব বীর।
কিন্তু ধীরে ধীরে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলাচ্ছিল। কমপক্ষে পঞ্চদশ সামন্তপ্রভুর সৈন্যবলে বলীয়ান পাল সৈন্যবাহিনী। তদুপরি তাদের হাতে অগণিত অশ্বারোহী সেনা, তারা মুহূর্তে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল কৈবর্তসেনাদের যাবতীয় প্রতিরোধ। পূর্বদিকে দণ্ডভুক্তিরাজ জয়সিংহ আর বাল-বলভীর অধিপতি বিক্রমরাজ অধিষ্ঠিত ছিলেন, পশ্চিমদিক রক্ষা করছিলেন কূজবটীসম্রাট শূরপাল এবং নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ। দক্ষিণপথ রোধ করে ছিলেন কৌশাম্বীনরেশ দ্বোরপবর্ধন ও সংকটগ্রামের রাজা চণ্ডার্জুন।
যদিও আক্রমণের আধিক্য ছিল উত্তর দিক থেকেই। পাল সেনাধিপতি বিশুদ্ধানন্দ, মগধরাজ ভীমযশ, ঢেক্করীরাজ প্রতাপসিংহ এবং উচ্ছলাধিপতি ভাস্করবর্মণ, এই চার অতিরথ মিলে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিলেন কৈবর্তসৈন্যদের।
দেখতে দেখতে রক্ত গরম হয়ে উঠছিল ছেলেটির। ইস্, বাবা নামের লোকটা এখনও লাল রঙের কাপড় ওড়াচ্ছে না কেন? তার দলের ছেলেরাও রক্ত দেখে অধীর হয়ে উঠেছে। নামতে চায়, তারা এক্ষুনি নামতে চায় রণভূমিতে।
ওই তো, ওই তো দেখা যায় লাল ধ্বজা …
সবে বিজয়ের গন্ধ পেতে শুরু করেছিল পালসৈন্যদল। যেমন রক্তের গন্ধ পেয়ে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে বন্য কুকুরের দল, তেমনই বিপুল উদ্যমে তারা সংহার করতে শুরু করেছিল দাঁতে দাঁত চিপে লড়ে যাওয়া কৈবর্তসেনাদের। মাত্র আর কয়েক দণ্ডের অপেক্ষা, তারপরেই ডমরনগর তাদের। যেভাবে সুগন্ধি পলান্নের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকের দল, লুব্ধ পালসৈন্য সেভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়বে কৈবর্তরাজধানীর ওপর, লুঠ হয়ে যাবে কৈবর্তদের সম্পদ, সোনাদানা আর ফসল। লুঠ হয়ে যাবে কৈবর্ত নারীরা, তাদের সম্মান তাদের ছিন্নবস্ত্রের মতোই লুটিয়ে পড়ে থাকবে ডমরনগরের রাজপথে।
লুঠ হয়ে যাবে বাংলার বুকে জ্বলে থাকা একমাত্ৰ স্পৰ্ধিত স্বাধীন দীপশিখাটি!
জয় আর বেশি দূরে নয়, এমন সময় সবিস্ময়ে পালসৈন্যরা দেখলো যে কুলু কুলু ধ্বনিসহ ঘোররবে তাদের সৈন্যসমুদ্রের মধ্যে দাবানলের গলিত আগুনের মতো নেমে এল উন্মুক্ত কৃপাণহস্তে বিশালদেহী, ভয়ংকররূপী কালান্তক নিষাদসৈন্যদল। পালসেনাদের মধ্যে এই অদ্ভুতকর্মা নিষাদযোদ্ধাদের নিয়ে বিচিত্র সব নারকীয় কাহিনি পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যেই। ফলে মুহূর্তের মধ্যে থমকে দাঁড়াল তারা, আর এই ভয়ানক অসম যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে যেত থাকল এই প্রথম বার।
ভীমের নিষাদপুত্রটি ভীমনাদে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে এসে প্রথমে যে যোদ্ধাকে পেল হাতের কাছে, বাম হাত দিয়ে তার কেশাকর্ষণ করে মুখ নামিয়ে আনল তার কণ্ঠনালী বরাবর। তারপর দাঁত দিয়ে তার গলার অর্ধেকটা কামড়ে তুলে নিয়ে থু থু করে ফেলে দিল একপাশে। তারপর এক বীভৎস রণহুংকারে কম্পিত করে তুলল আকাশবাতাস।
ব্যাস, এইটুকুরই প্রয়োজন ছিল। যেভাবে দুরন্ত বালক লাঠি দিয়ে সারমেয়শাবকদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়, সেভাবেই মাত্র এই একশোজন নিষাদযোদ্ধা পালসৈন্যদের তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল। যেন বাজপাখি নেমে এসেছে পায়রাদের মধ্যে, সেইভাবে পালাতে লাগল পালসৈন্যরা।
নতুন উদ্যমে কৈবর্তসেনা যুদ্ধ করে শুরু করে দিল। শর্বদেবের মধ্যে যেন ভর করে এলেন ক্ষত্রিয়হন্তা পরশুরাম স্বয়ং। বরেন্দ্রীসূর্য ভীমের ইঙ্গিতে তাঁর রণহস্তী হিমালয় ঘোর বৃংহণে রণভূমি প্রকম্পিত করে আবার রণপ্রমত্ত হয়ে উঠল। ঘোররবে জমে উঠল অফলার সেই যুদ্ধক্ষেত্র, চিরস্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠল কৈবর্তসৈন্য।
পাল সেনাধ্যক্ষ ও সামন্তচক্রাধিপতিদের সঙ্গে আশঙ্কিত হয়ে উঠলেন আরও একজন। বিপুল ঐশ্বর্যের হাতছানি যে মিথ্যে হয়ে যায়!
ছুটছিল হিমালয়, মেদিনী প্রকম্পিত করে। পাশে ছুটছিল একটি রণদুর্মদ বন্যমহিষও। অকস্মাৎ সেই মহিষের আরোহী বিপুলদেহী সেনানীটি তার ভল্পের অগ্রভাগ ঢুকিয়ে দিল হিমালয়ের চোখে। মুহূর্তে আর্তনাদ করে উঠল সেই সুশিক্ষিত গজরাজ। মাহুতের নির্দেশিত দিক ভুলে ছুটতে লাগল যেদিকে পালসৈন্য তার জন্যে পরিখা খুঁড়ে রেখেছে, সেই দিকে।
শর্বদেব ব্যাপারটা দেখলেন এবং অসহ্য ক্রোধে ধাবিত হলেন সেইদিকে। বিশ্বাসহন্তা এই চণ্ডককে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন বটে, কিন্তু তার আগে পিতাকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করা আশু কর্তব্য।
সমস্ত দৃশ্যটা কৌতুকমিশ্রিত নৈর্ব্যক্তিকতাসহ দেখলেন বিশুদ্ধানন্দ। তারপর বিশ্বস্ততম রথী শাঙ্গপাণিকে বললেন, “সময় উপস্থিত হে বীর, মহাস্ত্র প্রস্তুত করো।”
বংশদণ্ডনির্মিত অস্ত্রপীঠ প্রস্তুত ছিলই, শাঙ্গপাণির অনুচরেরা অতি কষ্টে সেই ব্রহ্মাস্ত্র সেখানে স্থাপন করে, পরিখার দিকে ধাবিত হিমালয়ের দিকে তার মুখ ফেরাতেই বাধা দিলেন বিশুদ্ধানন্দ, “উঁহু, ওদিকে না, ওইই দিকে।”
“কার দিকে অধিপতি? ওই কেশহীন নিষাদটির দিকে?”
“হ্যাঁ।”
শাঙ্গপাণি অবাক হলেন বটে, কিন্তু প্রশ্ন করা তাঁর ধাতে নেই। তিনি আদেশ পালন করেই অভ্যস্ত। তিনি তাই করলেন, যা বিশুদ্ধানন্দ বলেছেন।
“অতঃপর, প্রভু?”
“অগ্নিসংযোগ করো শাঙ্গপাণি।”
ঘোররবে যুদ্ধ করছিল ছেলেটি। রক্তের এই খেলা তার মধ্যে বিপুল আনন্দ জাগিয়ে তুলছিল। পলায়নপর, ভীত সৈন্যদের ধরে ধরে তাদের হত্যা করার মধ্যেও একটা অসম্ভব উল্লাস আছে, সেটা আর অস্বীকার করতে পারছিল না সে।
.
এমন সময় এক অজানা শোঁ শোঁ শব্দ :নে অবাক হয় সে আর ফিরে দাঁড়ায় শব্দের উৎসমুখটির দিকে। আর বিপুল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। অবাক হয়ে সে ভাবে, এ আবার কী? কই, তার মা অথবা বাবা নামের লোকটা এই নিয়ে কিছু তো বলে দেয়নি।
সে দেখে যে তার দিকে উল্কার বেগে ধাবমান এক অগ্নিপিণ্ড। তবে কোনো বিভ্রান্তি নয়, তাকে যা আচ্ছন্ন করে ফেলে তা হচ্ছে তার দিকেই ধাবিত সেই মৃত্যুপিণ্ডটির মোহিনী মায়া। আহা, এত রাজসিক, এত গরীয়ান, এত মহিমান্বিতও হতে পারে কারও মৃত্যু?
ফিরে দাঁড়ায় ছেলেটি, তার পাথুরে বুক নিয়ে ফিরে দাঁড়ায় তার অব্যর্থ মৃত্যুর সামনে।
খুব কাছে এসে পড়েছে দাবানলটা, আর এড়াবার উপায় নেই, এই কথাই ভাবে সে। যদিও তাতে তার কোনো খেদ ছিল না। শুধু ইচ্ছে ছিল তার মাকে একবার দেখার, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করার।
যে যুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই, সেখানে তাদের বিন্ধ্যাদেবীর বলি হতে পাঠানো কেন? যে আগুনের ওপর তাদের কোনো দাবি নেই, সেই আগুনে তাদের পতঙ্গের মতো পুড়তে পাঠানো কেন?
আগুনটা খুব কাছে এসে পড়েছে। তার একবার মনে হল একমাত্র মা-ই বোধহয় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত। তার মাথায় হাত বুলিয়ে নাম ধরে ডেকে বলত…
আহ্, কী নামে যেন তাকে ডাকতে তার মা? বাবা নামের লোকটা আজ আজ সকালে তাকে যেন কী নামে ডেকেছিলে? কিছুতেই মনে পড়ে না তার… কী যেন… কী যেন… কী যেন…
.
আগুনের গোলাটা তার চওড়া বুকে আছড়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে অলৌকিকভাবে তার মনে পড়ে যায় নামটা কোনো অপার্থিব স্বর যেন তার চৈতন্যের মধ্যে জাগিয়ে তোলে আজন্মের স্নেহস্মৃতি। চকিতের মধ্যে মনে পড়ে যায় মা কী নামে ডাকে তাকে… বাবা নামের লোকটা আজ সকালে তাকে কী নামে ডেকেছিল।
মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে তার মনে পড়ে যায় যে মা তাকে আদর করে ডাকত ঘোটু বলে। বাবার দেওয়া নামটাই ছোটো আর আদুরে করে নাম রেখেছিল মা, ঘোটু।
আর সেই বাবা নামের লোকটা কী নাম দিয়েছিল তার?
ঘটোৎকচ! কৈবর্তনৃপতি ভীম তাঁর নিষাদপুত্রের নাম রেখেছিলেন ঘটোৎকচ!
***