নিষাদ

নিষাদ

“You begin, by killing a cat and you end by killing a man.”

ছেলেটা মরবে ; লাইনে কাটা পড়েই মরবে একদিন। হয়ত আজ…কিংবা কাল…।

নাম ওর জলকু। বছর বারো বুঝি বয়েস। এখানকার দেহাতি ছেলেদের মতনই দেখতে। গাঢ় কালো রঙ। নরম সিমেন্টে কালি-মেশান কালচে রঙের একটি ছাঁচ যেন। এখন কাঁচা, হাত দিলেই দাগ পড়ে যাবে— এমনই নরম কাদাটে কোমল ভাব সারা গায়। মুখটা গোল, ফোলা ফোলা গাল, চিবুকের ডৌলটুকু এখনও ফোটেনি, কারিগরের হাত পড়েনি বোধহয়। নাকটি মোটা, ৰসা। পুরু মোটা মোটা ঠোঁট। জোড়া ঘন ভুরুর তলায় বড় বড় দুই চোখ। কেমন একটা উথলে ওঠার ভাব। কালো শান্ত চোখের তারা আর সাদাটে জমিটা যেন জলে-জলে ভেসে উঠেছে। জলকুর কপাল আছে কি নেই বোঝা যায় না চট করে। মাথা ভর্তি একরাশ চুলে কপাল, ঘাড়, কানের অর্ধেকটা ঢাকা পড়ে থাকে।

ছেলেটা একেবারে জংলী। এখানে থেকে থেকে এদের মতনই হয়ে গেছে। গায়ে জমা দেয় না, পায়ে জুতো নেই। আদুল গায়ে নোংরা একটা ইজের পরে সারাদিন ওই রেললাইনের কাছে।

ছেলেটা মরবে ; লাইনে কাটা পড়েই মরবে একদিন হয়ত আজ…কিংবা কাল ।

এই এক নতুন খেলা শুরু হয়েছে তার। আগে ছিল না।

কিছুদিন দেখতাম টিলার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে থাকত। চারপাশে তাকাত। শেষে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। কী যেন খোঁজবার চেষ্টা করত, দেখত। ঠিক জানি না কেন, হয়ত টিলার ওপর কিছু খুঁজে না পেয়ে, কিংবা হয়ত খুঁজে পেয়েই টিলার ও-পাশটায় নেমে যেতে লাগল। ও-পাশেই রেললাইন। লাইনের পর আবার টিলা। এখানটায় এইরকম। দু-পাশে, প্রায় বালিয়াড়ির মতন দুই টিলা, মাঝ দিয়ে পথ কেটে চলে গেছে রেললাইন। পুব এবং পশ্চিমে বেশি দূর ছড়িয়ে পড়েনি টিলার ঢল । শ’ দেড়েক গজ বড় জোর। তারপর মাঠ আর মাঠ, অস্পষ্ট জঙ্গল। পুবে একটা ছোটখাটো নদীর পুল। পুলের এ-পার থেকে রেললাইনটা ধনুকের মতন বেঁকে এসে টিলার কাছাকাছি সোজা হয়ে গেছে।

জলকু টিলা থেকে নেমে রেললাইনে চলে যেতে শুরু করেছিল আজকাল । আর নতুন যে-খেলা খেলতে শুরু করেছিল তা বাস্তবিক নতুন নয়, কিন্তু দিনে দিনে কেমন এক ভয়ংকর খেলা হয়ে উঠেছিল।

ছেলেবেলায় কে না এই খেলা খেলেছে। রেললাইন থেকে পাথর কুড়িয়ে আমরাও লাইন তাক করে পাথর ছুঁড়েছি। দেখেছি, টিপটা কি রকম ; হাতের জোর কতটা, লাইনের গায়ে পাথরের চোট লেগে ফুলকি জ্বলে কিনা, শব্দটা কেমন হয় ।

আমাদের এ খেলা ছিল কদাচিতের, সামান্য সময়ের। কিন্তু জলকুর কাছে খেলাটা রোজকার হয়ে উঠল । আজকাল প্রতিদিন সে এই খেলা খেলছে, প্রতিদিনই। আর এই খেলায় তার ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বৈশাখের প্রচণ্ড রোদ্দুরে, তাপে, লু-য়ে-জলকু পাথর ছুঁড়ছে, রেললাইনে তাক করে করে। আর প্রায় রোজই ওকে ধরে আনতে হয়। আমায়।

আমি ছাড়া জলকুকে ধরে আনার কেউ নেই। ওর বাবা পঙ্গু। ঘরে আছেন কি নেই বোঝা যায় না। এক এক সময় খেপে গিয়ে যখন চেঁচাতে শুরু করেন, গালিগালাজ ছোটান— তখন বোঝা যায় আমার পাশে ও-বাড়ির কোনো ঘরে একজন পুরুষমানুষ আছেন। নয়ত জলকুদের বাড়িতে শোনার মতন গলা আর নেই। জলকুর মাকে আমি কমই দেখেছি। চেহারা মুখ কিছুই ভাল করে দেখতে পাইনি, ধারণাও করতে পারি না সেই অবয়ব। অত্যন্ত ঝাপসাভাবে যেটুকু আকার তৈরি করতে পেরেছি, তাতে মনে হয়— জলকুর মা রোগা, রুগ্ন, কালো, অত্যন্ত লাজুক বা গোঁড়া গ্রাম্য। মুমূর্ষ পশুর মতন পড়ে পড়ে ধুঁকছে । রান্নাঘর আর উনুন, মসলা বাটা, ঘর ঝাঁট, কুয়োতলায় বসে বাসন মাজা— সংসারের এই শ’খানেক অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে জলকুর মা-র ভোর শুরু হয় এবং স্বামীর অসাড় দুর্গন্ধ শরীরে মালিশ মাখাতে মাখাতে মাঝরাতের বেহুঁশ ঘুমে ঢুলে পড়ে দিনটা তার ফুরিয়ে যায়।

জলকুর বাবা কী রোগে পঙ্গু হয়েছেন আমি জানি না। শুনেছি, বছর দুই ধরে ভদ্রলোকের এই অবস্থা। ডান পাশটা পড়ে গেছে একেবারে, শুকিয়ে চিমসে গেছে। অনাচারে কি ? হতে পারে। অত্যাচারে কি ? অসম্ভব নয়। কোনো সাঙ্ঘাতিক আঘাতের পরিণাম যদি হয়— হবেও বা। আমি জানি না। জলকুর বাবার সঙ্গে আমার দু একবার যা সাক্ষাৎ তাতে আমরা দুজনেই স্বল্পভাষী হয়েছি। ভদ্রলোকের সেই দুর্লভ গুণ আছে, দুর্ভাগ্যের কথা ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে বলতে চান না। আমার সহানুভূতি পাবার আশা উনি করেননি, ইতিবৃত্তও শোনেননি পঙ্গুতার। শুধুমাত্র বর্তমানের অবস্থাটা দু’এক কথায় বলেছিলেন।

সমবেদনা জানাবার ভদ্রতা আমার জানা ছিল না। আমি বেদনা পেয়েছিলাম নিশ্চয়। কিন্তু ভদ্রলোকের চেহারা, মুখ, বিছানা, ঘর, ঘরের আবহাওয়া আমায় এত বেশি অস্বস্তি দিচ্ছিল যে, আমি যতটুকু সম্ভব কম কথা বলে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম। কাজেই আমরা কথা বলেছি অল্প। নিছক কাজের কথা ছাড়া অন্য কথায় যাইনি। কাজের কথাও অবশ্য সামান্য— ঘরের ভাগ-বাঁটরা, ভাড়া, ভাড়ার তারিখ—এমনি খুঁটিনাটি।

জলকুদের একতলা ছোট টালিছাওয়া বাড়ির পশ্চিমটা আমার, ভাড়া পাওয়া। পুবটা তাদের। আমার এলাকায় একটি মাঝারি, অন্যটি ছোট ঘর ; সামনে পিছনে সামান্য বারান্দা, খাপরা-ছাওয়া একফালি রান্নাঘর ।

একই বাড়ির আধাআধি ভাগ-বাঁটরার মধ্যে দেওয়াল মাটি ছাদের সংযোগ ছাড়া বাকি যেটুকু সংযোগ তা ছিল জলকুকে নিয়ে এবং জলকুর পিসিকে যদি ধরা যায় তবে তাকে নিয়েও। তবে সে তো সামান্য, অতি সামান্য ।

জলকুর পিসির পুরো নাম বোধহয় তরুলতা। তরু বলেই ডাকতে শুনতাম। ঢেঙা রোগাটে গড়ন। মুখের ছাঁদটি লম্বা ধরনের। গায়ের রঙ মাজা কালো। সাপের মতন লম্বা বেণীটি ঘাড় থেকে খসে পিঠের ওপর দুলত। মিলের শাড়ি, সস্তা কাপড়ের জামা। তরুর বয়েস কুড়ি ছাড়িয়েছিল অনেকদিন। বিয়ে হয়নি। একটি দুটি বসন্তের না মেলানো দাগের সঙ্গে হতাশা এবং কাতরতা মাখানো সেই মুখ কেমন যেন রিক্ত শূন্য অবোধ দেখাত।

আমার আর তরুর মধ্যে মেলামেশা গল্পগুজব ছিল না। দেখা হলে চোখাচোখি হত, জলকুর খোঁজ করতে এসে বড় জোর শুধোত, জলকুকে দেখেছেন নাকি ? বা আমি যখন রাত্রে গ্রামোফোন বাজাতাম— ওদের তরফের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও শুনত, পরের দিন দেখা হলে বলত, ওই গানটা আজ আর একবার দেবেন ? বড্ড ভাল গান। …কখনও কখনও ডাকে-আসা আমার বাংলা মাসিক পত্রিকা দুটো চেয়ে নিয়ে যেত, গল্প পড়তে।

গল্প করতে, গান শুনতে তরু এলে আমি বোধহয় অখুশি হতাম না।

পরে সে-কথা বুঝেছি। আর যখন কথাটা স্পষ্ট করে বুঝছি, তখন থেকে জলকু তার সর্বনেশে নতুন খেলা শুরু করল।

জলকু অনেকক্ষণ পর্যন্ত উধাও। বাড়িতে নেই, সামনের আগাছাভরা বাগানটায় নেই, কুয়োতলায়, মাঠে— কোথাও না। …তরু বাইরে এসে খুঁজছে, ডাকছে, জলকু-জলকু। বাড়ির মধ্যে বসে সে-ডাক আমি স্পষ্টই শুনতে পাই। প্রথমটায় গরজ দেখাতে ইচ্ছে করে না ; ভালোও লাগে না উঠতে।

ডাক যখন বাড়তে বাড়তে ঘুরে ফিরে আমার বারান্দার কাছে এসে পৌঁছয়, উঠতে হয় আমায়। আমি জানি জলকু কোথায় আছে।

সমস্ত ব্যাপারটাই যেন ছককাটা। জলকুর পিসি খুঁজবে, ডাকবে, আমি প্রথমে গা করব না, পরে সরু ব্যাকুল গলার ডাক অনুনয়ের মতন আমার বারান্দায় এসে থামৰে, আমি উঠব। বিরক্ত, অপ্রসন্ন। মাথার ওপর বৈশাখের খর রোদ, অসহ্য গরম, আগুনে হাওয়া, আস্তে আস্তে আমি হাঁটব। বাড়ির পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে টিলার কাছে এসে দাঁড়াব, উপরে উঠব, সতর্ক পায়ে, মুখে তপ্ত বাতাসের ঝাপটা লাগবে, কটকটে রোদের ঝাঁঝে তাকাতে পারব না ভাল করে, তবু টিলার ওপর উঠলেই দেখতে পাব, নিচে রেললাইনের স্লিপারের ওপর দাঁড়িয়ে জলকু পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়ছে। আদুল গা, ঢলঢলে ইজের, একরাশ চুলে মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা এবং অব্যর্থ নিশানায় জলকু রেললাইনের লোহার ধারালো হিংস্র উজ্জ্বলতাকে বার বার আঘাত করছে। ধাতব, বেসুরো একটা আওয়াজ উঠছে, ঠং ঠং ঠং।

“জলকু। এই জলকু।” কাছে গিয়ে জোর এক ধমক দেবো। জলকুর একটা হাত জোরে চেপে ধরব। ডান হাত। জলকু প্রথমে হাত ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করবে। শেষে চোখ তুলে তাকাবে। সে জানে আমায় দেখতে পাবে। মুখে কোথাও তার বিস্ময়ের এতটুকু ছায়া পড়বে না। আমি জানি, ঘোর-ভাঙা দুটি গভীর অবসন্ন লালচে চোখ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাব না। তপ্ত, ঘর্মাক্ত, অথচ নরম পিচ্ছিল একটা হাত আমার মুঠোয় শক্তভাবে ধরা থাকবে।

“বাড়ি চলল।” গলাটা আমার রুক্ষ বিরক্ত কঠিন, “তোমায় রোজ বলি এ-ভাবে একা লাইনে এসে দাঁড়িয়ে না—সব সময় গাড়ি আসছে যাচ্ছে— কোন্‌দিন কাটা পড়বে লাইনে।”

জলকু কথা বলে না। আরও ঘামে, মুখ মাথা আরও গোঁজ করে আমার হাতের টানে-টানে টিলার ওপর উঠতে থাকে।

মাথার ওপর আকাশ জ্বলছে, পাথর আর কাঁকরে-বালি ঝকঝক করছে, গরম হাওয়া ঝাপ্টা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে, দূরের পুলের কাছ থেকে রেললাইনের ধনুকের মতন বাঁকটা বিরাট এক শানানো তলোয়ারের মতন জ্বলছে।

“তুমি এ-ভাবে আর এসো না জলকু। কখনও না।” টিলার ওপরে উঠে এসে আমি বলি। হাতটা ছেড়ে দি ওর। কয়েক পা দূরেই আমাদের বাড়ির পাঁচিল।

জলকূ কথা বলে না। আমি জানি, জলকু আমার নিষেধ শুনবে না। ও আবার আসবে। হয়ত আজই দুপুরে কোনো ফাঁকে ছাড়া পেয়ে।

কি সর্বনেশে খেলায় পেয়েছে ওকে। ছেলেটা মরবে ; লাইনে কাটা পড়েই মরবে একদিন। হয়ত আজ…কিংবা কাল…।

সে-দিন একটা লোক জুটেছিল। আমার এলাকার বাগানটুকু নিয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত খেটেছি। বাখারির ভাঙা বেড়াটা ভেঙেই ফেললাম একেবারে। আর দরকার নেই। কিছু আগাছা জন্মেছিল, রোদের তাতে পুড়ে পুড়ে খড় হচ্ছিল, সে-সব পরিস্কার করা হল। বেলফুলের কেয়ারি, জুঁই গাছের তলা, টিপ-হলুদের ছোট ঝোপের মাটি খুঁড়তে আর বারান্দার টবের ফুল-গাছ ক’টাকে পরিচর্যা করতে করতে বেলা অনেক হল। স্নান করতে যাব, এমন সময় জলকুর পিসির গলা, “জলকু—জলকু”।

ডাকটা পাঁচিলের শেষ পর্যন্ত চলে গেল, ওপাশে কদমগাছের তলা দিয়ে বেড় খেয়ে পেয়ারা ঝোপ, বাতাবি লেবু, আমগাছের ছায়া ঘুরে আমার বারান্দার কাছে এসে থামল।

“পালিয়েছে ?” আমি বললাম, বিরক্ত গলায়।

“ক—খন ; আসুক আজ হারামজাদা— গায়ের ছাল তুলব। দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেও নিস্তার নেই।” তবু রাগে গর গর করছিল ।

“বেঁধে রাখাই উচিত। রোজ রোজ এভাবে রেললাইনে পালিয়ে যায়। একটা বিপদ ঘটতে কতক্ষণ— ওইটুকু তো ছেলে।”

“মরবে ; মরবে একদিন হতভাগা। মরুক, আমারও হাড় জুড়োয় ।” তরু আজ অসম্ভব চটেছে। কথার ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল।

চটিটা পায়ে গলাতে গলাতে আমি বললাম, “আর কিছু না, এখান থেকে দেখাও যায় না, লোক নেই জন নেই, ফাঁকা রেললাইন— ভয় হয়।”

আমার অগোছালো কথা, তরুর তিক্তবিরক্ত ভাব, সব মিলেমিশে জলকুর একটি ভবিষ্যৎ পরিণতি যেন দুজনের চোখেই লহমার জন্যে ভেসে এলো। অল্প একটু নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা। তারপর আমি নেমে গেলাম বারান্দা দিয়ে।

বৈশাখের বুঝি শেষ সপ্তাহ চলছে। অসহ্য গরম। মাথার ওপর চোখ তোলা যায় না। গলা তামার মতন প্রতপ্ত আকাশ বেয়ে আগুন ঝরে পড়ছে। খাঁ খাঁ করছে চারপাশ। তেঁতুল কি কাঁঠালের ঝোপ-ঝাড়গুলো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঠে। একটি কাক কি চড়ুইও ডাকছে না। টিলাটা যেন পুড়ছে, পাথরগুলো রোদ আর তাতকে দ্বিগুণ করে ছুঁড়ে দিচ্ছে চোখে, গায়ে।

আমার চোখ জ্বালা করছিল, নিশ্বাস অসহ্য গরম, কানের পাশ দিয়ে লু-য়ের হলকা বয়ে যাচ্ছে।

জলকু একটার পর একটা পাথর কুড়োচ্ছে রেললাইন থেকে আর ছুঁড়ছে, ছুঁড়ে মারছে রেললাইনে। ছেলেটা যেন পাগল হয়ে গিয়েছে আজ। কিসের এক অদম্য আক্রোশ তাকে জ্ঞানহারা করেছে। আদুল গা, ছোট একটু ইজের, উদোম পা, স্লিপারের ওপর দাঁড়িয়ে ধারালো শক্ত পাথর তুলে নিচ্ছে মুঠোয় আর পলকের মধ্যে হাতটা অসম্ভব কঠিন, হিংস্র, উন্মত্ত ভঙ্গিতে ওপরে তুলতে না তুলতেই পাশ কাটিয়ে প্রাণপণে ছুঁড়ে মারছে। ইস্পাতের মসৃণ চকচকে একটা সাপ যেন এই অর্থহীন ছেলেখেলার আঘাত সয়ে যাচ্ছে ; গ্রাহ্য নেই।

আমার হঠাৎ মনে হল আজ, জলকু যেন অন্য কিছুকে তার ওই অন্ধ উন্মত্ত আক্রোশে ক্ষতবিক্ষত করে মারতে চাইছে। কিন্তু কাকে ?

কাকে ?

কোন্ অদ্ভুত কৌতূহলে জানি না— আমি চারপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। সমস্ত জায়গাটা নির্জন, ছায়াহীন। ঘা খাওয়া লোহার বেসুরো ভাঙা ভারি শব্দ শুধু। মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে বয়ে আসা লু-য়ের ঝড় বইছে, থেকে থেকে। অতি দ্রুত বাতাস কেটে এগিয়ে যাওয়ার সেই সোঁ সোঁ গর্জন, এই আছে, এই নেই। পুলের কাছে রেললাইনের পুরো বাঁকটা চোখে পড়ে না। বাঁক যেখানে শেষ হয়ে সোজা হয়ে মিশে যাচ্ছে সে-টুকু চোখে পড়ে। ধারালো ফলার মতন দেখাচ্ছে অংশটা।

অতি কষ্টে একবার মাথার ওপর চোখ তোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। সমস্ত আকাশটাই যেন জলন্ত সূর্য, অন্তরে ঝলসানিতে গনগনে আঁচের মত রঙ ধরেছে শূন্যে। টিলার পাথরে শরীরটা পড়ছে, কাঁকরের স্তূপ ধকধক করে জ্বলছে, রেললাইনের পাথর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত উজ্জ্বল, অসহ্য উজ্বল। আমার গাল মুখ পুড়ে যাচ্ছিল, চোখ জ্বালা করছিল ভীষণভাবে, গলার কাছে বুকের তলায় দরদর করে ঘাম ঝরছিল। আর চোখে মুখে নাকে ঠিকরে এসে লাগছিল সেই জ্বলন্ত দুঃসহ তাপ। অনুভব করতে পারছিলাম— টিলা, পাথর, লাইন, মাঠ, লোহা, স্লিপার সবই— সমস্ত কিছু এক ভয়ঙ্কর দহনের ঝলসানিতে জ্বলছে। অবোধ্য আকারহীন এবং নির্মম কোনো হিংস্রতা তার বিরাট করতল আস্তে আস্তে গুটিয়ে মুঠো করে নিচ্ছে।

আচমকা মনে হল, জলকু এই সর্বগ্রাসী বীভৎস অবয়বহীন হিংস্রতাকে তার অতি পরিমিত অর্থহীন সামর্থ্য দিয়ে আঘাত করছে, নিস্ফল আক্রোশে ।

আমার মাথার শিরায় রক্তের প্রবাহ হঠাৎ যেন জমে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ভীত এক অনুভূতি হল আমার। মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস-প্রশ্বাস হারালাম, চোখ অন্ধকারে ঠিকরে পড়ল, অসহ্য এক ব্যথা ঘাড়ের কাছে ছুরির ফলার মতন বিঁধে গেল।

“জলকু— এই জলকু।” জ্ঞান ফিরে পেয়ে জলকুর হাত চেপে ধরলাম।

টিলার ওপর দিয়ে যখন উঠে আসছি, জলকুৱা হাত আমার হাতে, মনে হল, নিচের ইস্পাতের দু’টি উজ্জ্বল হিংস্র অজগর যেন তার অফুরন্ত ওষ্ঠে হাসির আভা খেলিয়ে ঝকঝক করছে। বিদ্রূপে।

একটা গাড়ি আসছিল। পুলের কাছ থেকে ইঞ্জিনের সিটি বাজছে, বিরতিহীন কর্কশ তীক্ষ্ণ ধ্বনি— বাতাস থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই তীক্ষ্ণতা আমার কানে এসে লাগছিল ।

আর একটু হলেই জলকু আজ লাইনে কাটা পড়ে মরত। যা বেহুঁশ বেঘোর পাগল হয়েছিল আজ।

ছেলেটাকে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে আমি আজ বাঁচিয়েছি। আমি মনের তলায় তৃপ্তি এবং মমতার স্বাদ-মাখানো এক সুখ পাচ্ছিলাম।

“জলকু, আমি না এলে আজ তুমি একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড করতে। আর কখনও এ-ভাবে এসো না। বুঝলে ?”

জলকু তাকাল না, কথা বলল না, মাথাও নাড়ল না। …কেন জানি না, হঠাৎ ভীষণ একটা বিরক্তি এলো ছেলেটার ওপর। হাত ছেড়ে দিলাম।

ছেলেটা মরবে, লাইনে কাটা পড়েই মরবে একদিন। হয়ত আজ…কিম্বা কাল।।

মাঝে জলকুর অসুখের মতন হল। একদিন বিকেলে জ্বর এল। দেখতে দেখতে হু হু করে জ্বর বাড়ল। পাঁচ পর্যন্ত উঠে থামল তখনকার মতন। ছেলেটা জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান, চোখ চাইতে পারছে না। সারাটা মুখ ঝলসে যাচ্ছে। এখানে কাছাকাছি কোথাও ডাক্তার-বদ্যি নেই। আমার মনে হল, তাত-জ্বর। জলপটি দিতে বললাম তরুকে, সেই সঙ্গে আমার হঠাৎ-প্রয়োজনের হোমিওপ্যাথি বাক্স থেকে তখনকার মতন একটা ওষুধ।

পরের দিনও জ্বর থাকল। ডাক্তার এলো না বাড়িতে। জলকুর বাবা জলকুর মাকে গালাগালি দিচ্ছিল, শুনেছি। ডাক্তার না ডাকার জন্যে নয়, অন্য কোনো প্রাসঙ্গিক কারণে বোধহয়। জলকুর মা যথারীতি উনুন আর বাসন আর কাপড়কাচা নিয়ে ব্যস্ত থাকল, তরুই যা বার দুই আমার কাছে এলো ওষুধ চাইতে এটা ওটা বলতে। রাত্রে যেন জলকুর মাকে কাঁদতে শুনেছিলাম। সম্ভবত বারান্দায় এসে। অন্ধকারে বেচারি একটু আড়াল দিয়ে কাঁদছিল ।

জলকুর জ্বর ছাড়ল পরের দিন ভোরে । একেবারে ছেড়ে গেল। গা ঠাণ্ডা।

তরু এসে খবর দিল আমায়। নিজের ওষুধের মহিমায় নিজেই মুগ্ধ এবং অভিভূত হচ্ছিলাম। গর্ব বোধ হচ্ছিল। খুশি মনে তৃপ্ত মুখে তরুর দিকে চেয়ে থাকলাম।

তরু আঁচলের আগা দিয়ে আঙুলে পাক দিচ্ছিল আর খুলছিল। হঠাৎ বলল, “জ্বরের ঘোরে বার বারই জলকু তার মানিককে খুঁজেছে। বউদি বালিশ এগিয়ে দিয়েছে, জলকু তাই বুকের কাছে জাপটে ধরে…”

অসহ্য একটা রাগ মাথার মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠল। তরুকে শেষ করতে না দিয়েই বিশ্রী ইতর গলায় ধমকে উঠলাম, “তবে আর কি—তোমার বউদির কাছে যাও। ছেলের জ্বর তিনিই সারিয়েছেন।”

তরু চুপ। তার মুখে চোখে গলার স্বরে কি রকম এক অপরাধী ভাব ছিল, আমি মা সহ্য করতে পারছিলাম না।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তরু চলে গেল ধীরে ধীরে।

যাক। মনের ঝাঁঝ তখনও আমার পুরো মাত্রায় রয়েছে। প্রায় স্বগতোক্তির মতন বললাম, “বউদি বালিশ এগিয়ে দিয়েছে—? তবে আর কি, বালিশ বুকে জড়িয়েই তোমাদের ছেলে ভাই-পো সারুক।” বিদ্রূপটা আমারই কানে মধু বর্ষণ করল।

জলকুর মানিক ? সে তো, সে তো জলকুর সোহাগের একটা ছাগলছানা। মরেছে। পাপ চুকেছে। বড় জ্বালাতন করত। আমার বহু পরিশ্রমের ফল, টবের দু’টি ডালিয়াও একেবারে গোড়া পর্যন্ত চিবিয়ে খেয়েছিল। অকালের ফুল, বহু সাধ্যসাধনা করে পেয়েছিলাম।

গিয়েছিলাম সাত-সকালে সাইকেল ঠেলে, পাঁচ মাইলটাক পথ, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। জ্যৈষ্ঠের রোদে আর ফেরা গেল না সকালে। ফিরলাম বিকেলে। তখনও মাথার ওপর রোদ ছিল।

খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে কুয়োতলায় স্নান করতে নামলাম। ঠাণ্ডা গা-জুড়োনো জল। সমস্ত শরীর থেকে তাপ ধুয়ে যাচ্ছে, মাথাটা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে শীতলতায়, ঘর্মাক্ত ক্লান্ত অবসন্ন দেহের অতৃপ্তি ধুয়ে মুছে স্নিগ্ধতা জড়িয়ে ধরছে। আরাম অনুভব করতে পারছি। সাবানের ফেনায় গন্ধ উঠেছে খসের, মৃদু সুঘ্রাণ।

“জলকু—জলকু—।” তরুর গলা কানে গেল।

আমি স্নান করছি, কুয়োয় গা-মাথা জুড়োনো ঠাণ্ডা মিষ্টি জল, সাবানের ফেনায় চমৎকার গন্ধ, সামনে ছায়া নেমেছে, হালকা স্নান একটু রোদ, শালিক বসেছে কুয়োতলার পাড়ে।

“জলকু— জলকু।” ডাকটা বাড়ির সামনে পাঁচিলে পাঁচিলে ঘুরে বেড়ালো। কদম গাছের তলা দিয়ে করবী ঝোপের কাছে গিয়ে থামল। ঘুরে ফিরে বাতাবি লেবুর গাছের তলায় থমকে দাঁড়াল। আশপাশ ঘুরে কুয়াতলার কাছাকাছি কোথাও।

ছেলেটা আবার পালিয়েছে। স্নান শেষ হয়ে গেছে আমার। আমি জলকুর কথা ভাবতে ভাবতে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। এই সেদিন তাতজ্বরে মরতে মরতে বেঁচেছে। এখনও ও অসুস্থ। দুর্বল, রুগ্ন। এই অবস্থায় আবার পালিয়েছে ! শয়তান ছেলে একটা।

ঘরে এসে কাপড়-চোপড় ছাড়লাম। কি খেয়াল হল, ধোপ ভেঙে একটা পাজামা পরলাম। প্রায় আধ-কৌটো পাউডার ছড়ালাম গায় । কে জানে কেন, অত্যন্ত আরাম লাগছিল, ভাল লাগছিল। নেটের গেঞ্জিটা গায়ে দিলাম। চুল আঁচড়াচ্ছি— আয়নায় মুখ দেখে দেখে, বারান্দার কাছে তরুর গলা শোনা গেল, ভাইপোকে ডাকছে। আসলে ভাইপোর নাম ধরে আমাকেই ডাকা, আমাকেই অনুনয় করা।

মুখ মুছে, চটিটা পায়ে গলিয়ে বাইরে এলাম।

“পালিয়েছে ?”

“হাঁ, খানিকটা আগেও কাঁঠাল গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল। …আমি ভাবলাম…” তরু ব্যাকুল উদ্বিগ্ন চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল, “বিকেল শেষ হয়ে গেল…রোগা ছেলে…।”

“দেখছি।” বারান্দা থেকে নামলাম। কদমগাছের তলায় আসতেই কেমন এক লালচে আভা দেখলাম পাঁচিলের মাথায় চুপ করে পড়ে আছে। যেন ফিসফিস করে আমায় কিছু বলতে এসেছে। পশ্চিমের আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকালাম। সূর্যাস্তের লগ্ন শুরু হয়েছে। আকাশটা সিঁদুরের রঙে ধুয়ে গেছে, সূর্যটা লাল টকটকে…সূর্যটা ঘন লাল, টকটকে…।

হঠাৎ কিসের আকুল-করা ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসের একটা দমকা এসে ঠিক আমার হৃৎপিণ্ডে ঝাপটা দিল। ঝাপটা নয়, ছোবল। বুক থেকে পলকে সাপের কিলবিলকরা এক অনুভূতি মাথার স্নায়ুতে উঠে এলো। আমার হৃৎপিণ্ড, সম্ভবত জীবনের ধ্বনিটুকু, সময়মত বাজতে ভুলে গেছে। মাথা বুক হাত পা সব অসাড়। আমি সর্বপ্রকার অনুভূতি থেকে চ্যুত হলাম কয়েক মুহূর্তের মতন।

অল্পক্ষণ। হৃৎপিণ্ড এবার ভয়ঙ্কর জোরে শব্দ করতে শুরু করেছে। বরফের বিরাট একটা দেওয়ালে কে যেন আমার পিঠ ঘাড় ঠেসে ধরেছে। ঝিমঝিম করছিল মাথা ! দৃষ্টিটা টিলার ওপর থেকে আর নড়ছে না।

জলকু মারা গেছে, লাইনে কাটা পড়ে মারা গেছে আজ, অল্পক্ষণ আগেই। কানের পরদায় ইঞ্জিনের তীব্র হুইসল, মালগাড়ি চলে যাবার শব্দটুকু ভেসে এলো। আমি যখন স্নান করছিলাম একটা মালগাড়ি চলে গেছে। চাকার বিশ্রী জঘন্য সেই শব্দটা এখন আমার কানের পরদায় শুনছিলাম। চাকা চলছে…চলছে ; ইস্পাতের হিংস্রতা হাসছে। ছেলেটা মারা গেছে। কেন যেন আমার হঠাৎ আজ মনে হল। আকাশে টকটকে রক্তগোলা রঙ, সূর্যটা লাল, অসহ্য লালা আজ। ভয়ঙ্কর উজ্জ্বল।

আর আমার পা বাড়াবার মতন সাহস হচ্ছিল না। কাঠের মতন শক্ত হয়ে গেছে। সাড় নেই, আগ্রহ নেই, শুধুমাত্র এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের পীড়ন আমায় পিছু দিকে টেনে নিচ্ছে।

বিহ্বলতার এই উগ্রতা আমি দমন করবার চেষ্টা করলাম। কার্যকারণের স্বাভাবিক যুক্তি তৈরি করবার আপ্রাণ পরিশ্রম করছিলাম। জলকু কাটা পড়েছে এ-কথা আমি কেন ভাবছি ? কেন ?…সূর্য এই রকমই লাল থাকে, মেঘ এমনই ঘন রক্ত সদৃশ রঙ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যাস্তেবেলায়। হয়ত প্রত্যহই। আমি চোখ তুলে দেখি না বা দেখলেও তেমন করে দেখি না।

আমায় যেতে হবে। জলকুকে ধরে আনতে হবে। সে মারাত্মক খেলায় মেতে আছে। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে পা বাড়িয়েছে। জলকুর মা রুটি সেঁকছে জলকুর জন্যে। তরু কুয়াতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গামছা হাতে—অপেক্ষা করছে। জলকু ফিরে এলে হাত মুখ ধুইয়ে দেবে।

বুঝতে পারলাম আমি আস্তে আস্তে ভীত ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে হাঁটছি। টিলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ক্রমশই। কাঁকরের স্তূপ, ছোট ছোট আগাছার ঝোপের ওপর থেকে শেষ আলোটুকু মুছে গিয়ে ছায়া নেমেছে, মাথার ওপর দিয়ে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে। কোথা থেকে একটু হাওয়া বইতে শুরু করেছে এতক্ষণে ।

টিলায় ঠিক মতন পা দিতে পারছি না— পিছলে যাচ্ছে। আমার যেন একবিন্দু শক্তি নেই, হয় ঘুমে না হয় কতকাল অসুখে ভুগে আজ দুর্বল পায়ে পথ হাঁটতে নেমেছি।

বার বার বাধা। মন পিছু টানছে। জলকু সামনে টানছে। কে যেন কাছে ফিসফিস করে বলছে যেয়ো না—; পর মুহূর্তে চোখের ঝাপসায় জলকুর মা যেন রুটির থালা হাতে এগিয়ে আসছে, তরু ডাকছে…

জানি না কখন কেমন করে টিলার ওপর এসে দাঁড়িয়েছি। সূর্য সেই লহমায় কোন্ দূর দূরান্তে ডুব দিতে যাচ্ছে। যাবার আগে শেষ নিঃশ্বাসের মতন প্রাণের কোনও অদৃশ্য শক্তি থেকে সূর্যপিণ্ড তার শেষ আলোটুকু ঢেলে দিল। এই আলো অসহ্য গাঢ়, আশ্চর্য রকম লাল। আমি জীবনে কখনও এই রঙ দেখিনি, কখনও নয়। এত ঘন, জীবন্ত ভাষাময় হতে পারে রঙ আমি জানতাম না। এখন জানলাম। দেখলাম !

দেখলাম— টিলার তলায় অসাড় রেললাইন। এক ঝলক সেই আলো। হিংস্র ধারালো ইস্পাতের ওপর মুঠো-মাপের জায়গাটুকুতে আলোটা ছিল। আমার চোখের সাড়া পেয়ে আঙুল দিয়ে কী যেন দেখাল তারপর উড়ে গেল।

ছায়ার মধ্যে তালগোল পাকানো কালো জামা পরা জলকুর একটু চিহ্ন। পাথরের গায়ে গায়ে আর সব নিশ্চিহ্ন। স—ব।

কত রাত জানি না। ঘর অন্ধকার। ছোট লণ্ঠনটা নিবিয়ে দিয়েছি কখন। অল্প টিম-টিমে আলো— তাও সইতে পারছিলাম না। যতটুকুই হোক, আলো থাকলেই মনে হচ্ছিল, অন্য কিছু আছে এ-ঘরে। অপলক দুটি চোখ মেলে আমায় দেখছে। …বাতি নিবিয়ে ঘরভরা অন্ধকার সামনে নিয়ে বসে আছি। আমায় যেন কেউ না দেখে। নিজেকেও নিজে দেখতে চাই না।

কত রাত জানি না । চারিধারে অখণ্ড নিস্তব্ধতা। অন্ধকার। পাশের বাড়িতে একটি মুমূর্ষ গলার প্রায় শব্দহীন কান্নাটা শেষবারের মতন শুনেছি অনেকক্ষণ। এখন হয়ত মানুষটির গলা বুজে গেছে। আর শব্দ বেরুচ্ছে না। জলকুর পিসি হয়ত জলকুর বিছানা জাপটে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। জলকুর বাবা— ? জানি না।

আমি জেগে আছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার আমায় ভরে রেখেছে। মনে হচ্ছে এই লুকিয়ে থাকার খেলা আমি শুরু করেছি কতকাল আগে— আজ আর তার হিসেব পাওয়া অসম্ভব ; এই খেলা কতকাল খেলব তারও কোনো সীমা পাচ্ছি না। এই অন্ধকারের মতনই সব। আদি হারিয়ে গেছে ; অন্ত আছে বলে মনে হয় না ।

এত অস্থির চঞ্চল কাতর বিহ্বল আগে কখনও হইনি। কেন ? আজই বা আমার কি হল ? জলকুর কাটা পড়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোথায় ?

বুকের মধ্যে কী যে যন্ত্রণা আর কান্না ! কেমন এক মাথা-খোঁড়ার মতন হাহাকার। কিন্তু সব জমে শক্ত হয়ে রয়েছে। পাথরের মতন। একটুও গলবে না, একটুও না ।

অন্ধকার কখন একটু ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। বাইরে হয়ত মাঝরাতে চাঁদ উঠল । কোন্ তিথি আজ ?

বাইরে থেকে আমায় নিঃশব্দে কে যেন ডাকছে। আমি জানি কে। অনেকক্ষণ থেকেই ডাকছে। এ এক ভীষণ আকর্ষণ। প্রাণপণে বাধা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চাঁদ উঠছে বলে, আকর্ষণ আরও তীব্র হয়ে এসেছে। এমন কি হয় ! হয়ত।

কদমগাছের পাতা সরসর করে কাঁপছে, বাতাবি লেবুর তলায় কাঠবেড়ালি ছুটছে…জলকুর দড়ির দোলনা ছিঁড়ে গেছে কবে…তার মানিকের কাঁঠালপাতা জমে জমে রোদে শুকিয়ে খসখসে হয়ে উঠেছে। এখন বুঝি হাওয়া ছিল একটু, শুকনো কাঠালপাতা খস খস করে উড়ে গেল।

আমায় ধরে রাখতে পারল না ঘরের অন্ধকার। আমার বুক, মন, পা— প্রতিটি ইন্দ্রিয় যেন একবার শেষ চেষ্টা করে সেই অদ্ভুত যাদুকরী তীব্রতম আকর্ষণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করল।

বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চাঁদ ওঠে নি— উঠবে। পা বাড়াতে গিয়ে ফুলের টবে পা আটকাল। হাত বাড়িয়ে পথ ঠাওর করতে গিয়ে মনে হল, এটা সেই ফুলছেঁড়া, ডাল-চিবোনো ডালিয়ার গাছ। জলকুর মানিকের একটা বিরাট অপরাধের স্মৃতি। দু পা এগিয়ে বারান্দার নীচে মাঠে নামলাম। পাশের বাড়ি অসাড়। মনে হল শূন্য। হয় সবাই মরে গেছে, না হয় ছেড়ে চলে গেছে। পোড়া বাড়ির ভ্যাপসা গন্ধ যেন নাকে এসে লাগল। শ্যাওলা জমে জমে কালো দেওয়ালের অত্যন্ত আবছা একটু আভাস।

তরু কি চলে গেছে ? তরু জানত আমি ফুল ভালবাসি, তরু জানত আমি গান ভালবাসি, তরু জানত আমি তাকেও ভালবাসতে শুরু করেছিলাম— সবই জানত তরু। তার অজানা ছিল না কিছু। সেই যে একদিন এক ঘন মেঘলায় আঁধার হয়ে-আসা দুপুরে তরু অসাড় পায়ে আমার ঘরে এসেছিল, আমি ছিলাম…সে ছিল, ঝোড়ো ধুলোর ভয়ে জানলা বন্ধ ছিল…পাশাপাশি বসে…ঘর ভরা মেঘলার ঘনতা…। জলকু ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। তরু চমকে উঠল, আমি চমকে উঠলাম। জলকু তার মানিককে খুঁজছে। ঝড় উঠছে কিনা তাই। মানিকের সেই দ্বিতীয় অপরাধ।

চাঁদ উঠল। আমি টিলার ওপর উঠেছি। চরাচর নিস্তব্ধ। বাতাস বইছে। তাল তাল এবড়ো খেবড়ো ছায়া ছড়ানো এ-দিক ও-দিক। কোথাও হাল্‌কা, কোথাও নরম। চাঁদের অতি মিহি ঝাপসা আলো আমাকে ছায়াহীন করেছে।

জোনাকি জ্বলে না এখানে, ঝিল্লিরব হয়ত আছে…আমার কোনো হুঁশ নেই, মতিভ্রম হয়েছে হয়ত…বা কোনো কুহকের ডাকে চলে এসেছি।

টিলার উপর উঠে এসে দাঁড়ালাম। নিচে রেললাইন। কত যেন নিচু। চাঁদের মিহি, জলের মতো সাদা একটু আলো, রেললাইনের সাড়া নেই, পাথরের কুচিগুলো চুপ।

হঠাৎ মনে হল, আমি যেন কিছু একটা ধরে রেখেছিলাম এতক্ষণ। তার ভার ছিল হাতে। আচমকা মনে হল, সে-ভার আর নেই। ফেলে দিয়েছি। ছুঁড়েই দিয়েছি টিলার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, গড়িয়ে গড়িয়ে…পড়ল। শব্দ কি শুনলাম ? না, না। শব্দ নয়। তারপর চাঁদ একটু উজ্জ্বল হল, মুহূর্তের জন্যে…। এক মুঠো করুণ বিষণ্ণ আলো দুলে দুলে রেললাইনের একটু জমিতে কাঁপল । যেমন কাঁপা জলে আলো কাঁপে। জলকুর রক্ত বুঝি ওখানেই ছিল। কিংবা…মানিকের রক্ত বুঝি পাশেই ছিল, শুকিয়ে গিয়েছিল কবে। কবেই।

ক্ষীণ চাঁদ প্রকাণ্ড এক ভাসন্ত মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল।

কখন কদমতলার কাছে আবার ফিরে এসে দাঁড়িয়েছি। জলকুদের ঘর থেকে পোড়া বাড়ির গন্ধ ভেসে আসছে।

এখানে দাঁড়িয়ে আমি নিজের মন ও সত্তাকে ভাঙলাম। দু ভাগে। এক ভাগ আমি, অন্যটি জলকু। মানুষ যখন তার নাগালের কাছে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু হাতড়ে পায় না, অথচ তার কথা থাকে, তখন বোধহয় এইভাবে নিজেকে ভাঙে। জলকুর আদুল গা, কালো তুলতুলে চেহারাটি আমার চোখের সামনে ভাসছিল। আস্তে আস্তে তার মুখ স্পষ্ট হল। বড় বড় চোখ, বসা নাক, ঝুল জমে কালো হয়ে থাকার মতন চুলের গুচ্ছগুলি কপালে কানে চোখে ঝুলে ঝুলে পড়ছে।

মনে হল, জলকু পাথর ছুঁড়ছে। পরিচ্ছন্ন অথচ হৃদয়হীন এক ষড়যন্ত্র এবং অনেক সবল কঠিন নির্মমতার বিরুদ্ধে সে বোকার মতন তার ছোট পলকা হাতে শুধু পাথরই ছুঁড়ছে ব্যর্থ আক্রোশে ।

কত কথা বলার ছিল, বলা হল না। বলতে পারলাম না। শুধু বললুম, ‘জলকু, কে জানত গ্রামোফোনের দম দেওয়া অতটুকু হ্যান্ডেল ছুঁড়ে মারলে তোমার মানিক মরে যাবে। …একটুকুতেই কত কি যে মরে যায়! আশ্চর্য!’

জলকু হয়ত কথা শুনতে পেল না। নিজের কথা নিজের কানেই ফিরে এসে লাগল। আমি শুনলাম। তারপর স্বপ্নের মতন দেখছিলাম, সারা দুপুর বিকেল সন্ধে এবং প্রায় সারারাত পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা মানিককে আমি কেমন করে লুকিয়ে হেঁড়া এক টুকরো চটে জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছি টিলার ওপর।..

ছেলেটা মরেছে। লাইনে কাটা পড়েই মরেছে। আজ…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *