নিষাদ – ৯

সিন্ধুরার মনখারাপ।

সিন্ধুরা মনখারাপকে গুরুত্ব দেয় না।‌ ঝেড়ে ফেলে দেয়। আজ পারছে না। মনের ভিতর খচখচ করছে। মাকে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু আজ মায়ের খোঁচা এমন পর্যায়ে পৌঁছল নিজেকে সামলাতে পারল না। অথবা এমনও হতে পারে, মা হয়তো চাইছিল, মেয়ের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। সকালে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে অনেকক্ষণ এলোমেলো ঘুরেছে সিন্ধুরা। পার্টি অফিসের পাশে ঝুপড়িতে ভাত খেয়েছে। খানিকটা আনমনেই চলে এসেছে স্টেশনে। মন আরও খারাপ লাগছে। অপরাধী লাগছে নিজেকে।

কাল রাতে বাঁশরীদির সঙ্গে কথা হয়েছে সিন্ধুরার। আজ বা কালকের মধ্যে ওদের আন্দোলনের জায়গায় একটা ছোটখাটো হইচই বাধানো যাবে বলে আশা করছে সিন্ধুরা। অগ্নীশের পরিকল্পনা মতো আন্দোলনের জায়গায় তিনদিন যাতায়াত করেছে সিন্ধুরা। সতর্ক ছিল। যাতে কেউ উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে, সন্দেহ না করে। সকলের সঙ্গে না পারলেও বাঁশরী ছাড়াও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বসছে সে। গল্পগুজব করছে। সাধারণ গল্প। তাতে রাজনীতির নামগন্ধ ছিল না। ওখানে কয়েকজন অনশনও শুরু করেছে। একপাশে শতরঞ্চি বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। তবে সব মিলিয়ে লোকবল কম। এতটাই কম যে সুরুলপুরে এই ধর্নার কোনও প্রভাব পড়েনি। যাদের ওদিকে যাতায়াত নেই, তারা জানেও না কিছু। আবার পাশ দিয়ে গেলেও ফিরে তাকাচ্ছে না, গুরুত্ব দেওয়া তো দূরের কথা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সুরুলপুর পার্টি ইউনিটকে কিছু না জানিয়েই সেখানে যাতায়াত করেছিল সিন্ধুরা। তারপরেও বিভাস সাহা একদিন সিন্ধুরাকে দেখতে পান। ওদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। সাধারণভাবে নিজের দলের ছাড়া অন্য কোনও দলের মিটিং, মিছিল, ধর্নার প্রতি কৌতূহল প্রকাশ করা এতদিন পার্টি নিয়মের বাইরে ছিল। এখন এ ধরনের নিয়ম কিছুটা শিথিল হয়েছে। তবে পুরনো নেতারা গোঁ ধরেই আছেন। মানুষকে তারা আজও দু’ভাগে ভাগ করে রেখেছেন। দলের আর দলের বাইরের। স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের দিকে তাকানোর কথা তাঁরা ভাবতে পারেন না। বিভাস সাহাও সেদিন পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই চোখ পড়ল পথের ধারের ছোট্ট প্যান্ডেলের ভিতর। আরে!‌ সিন্ধুরাও বসে আছে না? ঠিকই তো, সিন্ধুরা বসে রয়েছে। কয়েকজন মহিলা পুরুষের সঙ্গে মাথা নামিয়ে কথা বলছে। বিকেলে পার্টি অফিসে সিন্ধুরাকে চেপে ধরে তার বিভাসকাকা। তখন অগ্নীশও সেখানে ছিল। দলের সম্মেলন আসছে। কাগজপত্র তৈরি করছিল অগ্নীশ। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক নির্দেশিকা, পার্টির গঠনতন্ত্র, আশু কর্তব্য, শত্রু মিত্র চিহ্নিত করবার পদ্ধতি— এইসব। অনেক বছর সুরুলপুর ইউনিটে সেভাবে সম্মেলন হয়নি। এবারই একটু বড় করে আয়োজন হচ্ছে।

বিভাস সাহা বললেন, ‘সিন্ধুরা, তুমি ওখানে কী করছিলে?’

সিন্ধুরা‌ প্রথমে বুঝতে পারেনি। বলল, ‘কোথায়?’

বিভাস সাহা বললেন, ‘ওই যে ওখানে, কারা যেন সব রাস্তার ধারে বসে রয়েছে।’

সিন্ধুরা‌ বুঝতে পেরে সতর্ক হল। আড়চোখে একবার অগ্নীশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওরা ওদের চাকরিবাকরির কী সব দাবি নিয়ে ধর্না দিচ্ছে। আমার পরিচিত একটি মেয়েও রয়েছে। একসময়ে আমাদের প্রতিবেশী ছিল। ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে দেখেছেন বুঝি বিভাসকাকা?’

বিভাস সাহা অসন্তুষ্ট গলায় বলল, ‘ওখানে দেখা করতে যাওয়ার কী আছে? বাড়িতে যেতে পারতে, তার কাজের জায়গায় যেতে পারতে। ওদের ওখানে কেন যাবে?’

সিন্ধুরা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ওমা বাড়িতে যাব কী করে? মেয়েটি তো গত ন’দিন ধরে ওখানেই বসে রয়েছে। প্যান্ডেলের নীচে। শরীর-টরির খারাপ হল কিনা দেখতে গিয়েছিলাম।’

অগ্নীশ এবার কাজ করতে করতে বলল, ‘তাই নাকি!‌ ন’দিন হয়ে গেল? কই আমরা তো কিছু জানি না!‌’

কল্লোলবাবু বিরক্ত গলায় বললেন, ‘ন’দিন হোক আর ন’শো দিন হোক, আমাদের জানার কী আছে? ওখানে বসেছে ক’জন? কুড়ি-পঁচিশজনের বেশি তো নয়। ওই কুড়ি-পঁচিশজনের মুভমেন্ট নিয়ে সুরুলপুরের কারও মাথাব্যথা নেই। এখানকার লোকাল পত্রিকাগুলো পর্যন্ত চার লাইন লেখেনি। ওদের ডিমান্ড কে শুনবে বল দেখি? কোনও পলিটিক্যাল পার্টিও ওদের সঙ্গে নেই।‌’

অগ্নীশ বলল, ‘আমরা ওদের মুভমেন্টে খানিকটা মদত জোগাতে পারতাম না কল্লোলদা? একদিন গিয়ে যদি উপস্থিত হতাম?’

বিভাস সাহা বললেন, ‘তুমি কি পাগল হলে অগ্নীশ? ওসবে আমরা নাক গলাতে যাব কোন দুঃখে? ওরা কারা? আমাদের পার্টির নীতি আদর্শের সঙ্গে ওদের সম্পর্কটাই বা কী? তা ছাড়া.‌.‌.‌তা ছাড়া আমাদের সামনে এখন অনেক জরুরি কাজ। নিজেদের নতুনভাবে তৈরি করতে হবে। শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সামনের সম্মেলনগুলোতে সেসব বিষয়ে আলোচনার ঝড় উঠবে। সেসব দিকে মন না দিয়ে আবার এখন ওই কুড়ি-পঁচিশজনের মুভমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামাব? ওদের না আছে চাল, না আছে চুলো। নিজেদের চাকরিবাকরির পাওনাগন্ডা নিয়ে তো সবারই কিছু না কিছু অসন্তোষ থাকে। তা বলে একেবারে রাস্তার ধারে বসে যেতে হবে? আমরা একেবারেই মাথা ঘামাব না।’

‘না ঘামাব না,’ বলে অগ্নীশ আবার সম্মেলনের গঠনতন্ত্র লেখায় মন দিল।

সিন্ধুরা বলল, ‘মাথা ঘামিয়েও কোনও লাভ হবে না বিভাসকাকা। ওরা নিজেদের মধ্যে কোনও পলিটিক্যাল পার্টিকে ঢুকতে দিতে চায় না।’

কল্লোলবাবু একটু কড়া গলায় বললেন, ‘খুব ভাল। কিন্তু তুমি ও-পথ আর মাড়াবে না সিন্ধুরা। তোমাকে ওদের সঙ্গে দেখলে এখানকার মানুষের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। মনে রাখবে, কী করলে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল, মানুষের কাছে কী বার্তা যাচ্ছে। দুনিয়ার সব বড় নেতারাই একথা বলেছেন।’

সিন্ধুরা বলল, ‘শুধু ঘরে বসে ভাবলে কি চলবে? পথে তো নামতে হবে।’

কল্লোলবাবু সিন্ধুরার প্রশ্নে ভুরু কোঁচকালেন। কর্মীদের প্রশ্ন না শোনার যে অভ্যেস একসময় দলের নেতাদের মধ্যে ভয়ংকর চেহারা নিয়েছিল, তা আজও পুরোটা যায়নি। তারপরে নিজেকে সামলে কল্লোলবাবু বললেন, ‘পথে নামতে হবে ঠিকই, তবে সেটা ভাবনাচিন্তা করে। সিন্ধুরা, এখন আমাদের ক্রাইসিস পিরিয়ড চলছে। প্রতিটা স্টেপ হিসেব করে ফেলতে হবে। যতই হোক, তুমি এখন আমাদের ইউনিটের একজন সদস্য। তোমাকেও সতর্ক থাকতে হবে। যেখানে কনফিউশন হবে, আমাদের জিজ্ঞেস করবে। আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাবে না। আমরা এখন কোনওরকম গোলমালে যেতে চাই না।’

সিন্ধুরা তারপর থেকে আর ওই এলাকায় যায়নি। দরকারও হয়নি। বাঁশরীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখেছে। তাকে বুঝিয়েছে।

‘এইভাবে শুধু বসে থেকে কিছু করতে পারবে না বাঁশরীদি। সুরুলপুরের কেউ তোমাদের পাত্তাও দেবে না।’

বাঁশরী বলল, ‘দিচ্ছেও তো না। এখানকার লোকাল পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেলগুলোকে ফোন করলাম, কেউ তো এল না।’

সিন্ধুরা বলল, ‘আসবে কেন? এরকম নিরীহ, পান্তাভাতের মতো মুভমেন্টের খবর করতে কেউ কখনও আসে? তা ছাড়া যাদের উপর চাপ তৈরি করতে তোমরা রাস্তায় বসে আছ, তাদেরও তো কোনও টনক নড়ছে না। তোমাদের লিডারদের সঙ্গে কথা বলো।’

বাঁশরী বলল, ‘আমাদের কোনও লিডার নেই। কতদিন এভাবে চলবে বুঝতে পারছি না। সকলের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে। দু’-একজন করে উঠে পড়ছে। তবে আমরা যদি রণে ভঙ্গ দিই, দাবি আমাদের কোনওদিন মিটবে না। অবশ্য বসেও যে মিটছে, এমন নয়।’

সিন্ধুরা বলল, ‘এটাই তো সমস্যা। লিডার না থাকলে কখন কোনদিকে যেতে হবে বুঝতে পারা যায় না। আন্দোলন করলেই হল না, তাকে থামাতে, বাড়াতেও জানতে হয়। যাক, তোমরা কয়েকজনে নিজেদের মধ্যে কথা বল। বেশি লাগবে না, দু’-তিনজন হলেই চলবে। যদি রাজি থাক, আমি আলাদা করে তাদের সঙ্গে বসতে পারি। কথা দিচ্ছি, এটা একেবারেই ব্যক্তিগত স্তরে আলোচনা হবে, এর মধ্যে কোনও পার্টি পলিটিক্স থাকবে না। কেউ জানতেও পারবে না। এমন একটা পথ আমরা বার করব, যাতে সুরুলপুরের মানুষ নড়েচড়ে বসে।’

বাঁশরী একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘আমি খুব চেষ্টা করছি সিন্ধুরা।’

এই আলোচনাটাই কাল রাতে হয়েছে। হয়েছে সিন্ধুরার বাড়িতে। আগে থেকে ঠিক ছিল না। রাত এগারোটার সময় একটা টোটোয় চেপে বাঁশরী দু’জনকে নিয়ে হাজির হল। একজন মহিলা, একজন পুরুষ। সিন্ধুরা প্রথমটায় অবাকই হয়েছিল।

‘এত রাতে!‌’

বাঁশরী বলল, ‘লুকিয়ে এসেছি। ভেবে দেখলাম, তোমার বাড়িটাই সেফ।’

সিন্ধুরা খুশি হয়ে বলল, ‘খুব ভাল করেছ। এস, আমার ঘরে বসি।’

আজ সকালে এই মিটিং নিয়েই মায়ের সঙ্গে প্রথমে গোলমাল শুরু হয়। নয়নতারার শরীর আরও খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে একদিন সিন্ধুরা জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, সুরুলপুরে চিকিৎসা হওয়া মুশকিল। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি অসুখের ডায়াগনসিসও করতে পারছেন না। নিষাদকে ফোনে বলেছেও সিন্ধুরা। এই অবস্থা নিয়েই সংসারের কাজকর্ম করছে নয়নতারা। মেয়ের বারণ শুনছে না। আজও তাই। রান্নাঘরে ভাত চাপিয়ে এসে বলল, ‘কাল অত রাতে কারা এসেছিল সিন্ধু?’

সকালের দিকটায় কাজকর্মের জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চালায় সিন্ধুরা। স্কুলের কাজটা চলে যাওয়ার পর টানাটানি চলছে। একটা কোচিং ক্লাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু তাতে আর কত টাকাই বা হয়? চাকরির পরীক্ষাও দিচ্ছে। তবে পরীক্ষা দিয়েও কিছু হবে বলে মনে হয় না। সর্বত্রই গুটিকয়েক পোস্ট খালি, অ্যাপ্লিকেশন গাদাগাদা। লেখাপড়ায় এমন কোনও ভয়ংকর রেজ়াল্ট নেই যে, গুটিকয়েকের মধ্যে ঢুকে পড়বে। তাও চেষ্টা চালাচ্ছে। দাদা কিছু একটা পেলে খানিকটা সুরাহা হত। এখন বাড়িতে যে সামান্য টাকা পাঠায়, তা চোখেই দেখা যায় না। একটা কাজের সুযোগ হয়েও তো ফসকে গেল। তবে সংসারের টানাটানির কথা দাদাকে খুব একটা বলে না সিন্ধুরা। ও তো খুব চেষ্টা করছে। সুরুলপুরে চলে এলে ওর কলকাতায় থাকার খরচটা বাঁচত। প্রেসের কাজ আর ক’টা টিউশন থেকে উপার্জন তো ওই সামান্যটুকু। তাও দাদা খুব কষ্ট করে, কম খরচ করার চেষ্টা করে। কলকাতা শহরে এত কম খরচে থাকা-খাওয়া সহজ কথা নয়।

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সিন্ধুরা বলল, ‘আমার বন্ধুরা এসেছিল।’

নয়নতারা বলল, ‘অত রাতে বন্ধু!‌’

সিন্ধুরা এবার হালকা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কেন রাতে বন্ধু আসতে নেই?’

নয়নতারা বলল, ‘আমাকে কি তুই বোকা‌ ভাবিস? তোর বাবা যেমন ভাবত?’

সিন্ধুরা বলল, ‘মা, তুমি কি এই সাতসকালে ঝগড়া করতে চাও?’

নয়নতারা বলে, ‘আমি ‌চাইলেই বা কী এসে যায় তোদের? আমার কোন কথাটার গুরুত্ব তোরা দিস? তোর বাবাও দেয়নি। আমার ঝগড়াকেও পাত্তা দেয়নি, ভালবাসাকেও নয়।‌’

সিন্ধুরা বলল, ‘হঠাৎ তোমার কী হল?’

‘হঠাৎ হয়নি। অনেকদিন ধরে হচ্ছে, অনেক বছর ধরে। তোর বাবাও এভাবে বাড়িতে মিটিং করত। আমি রাগারাগি করে বন্ধ করেছিলাম। বাড়িটা পার্টি অফিস নয়। তুই আবার শুরু করেছিস।’

সিন্ধুরা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে আর করব না। এবার চুপ কর।’

নয়নতারা চুপ করল না। গজগজ করতে থাকে। স্বামী, পুত্র-কন্যাকে নিয়ে হাজার অভিযোগ। সিন্ধুরা ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের কাজে মন দিতে চেষ্টা করে। সাইবার কাফে থেকে অনলাইনে দুটো সিভি পাঠাতে হবে। দুটোই বাইরের কোম্পানি। একটা বেঙ্গালুরু, একটা গুরগাঁও। গুরগাঁওয়ের কোম্পানিতে কঙ্কণার জোরাজুরিতে সিভি মেল করছে। কঙ্কণা তার সঙ্গে কলেজে পড়ত। এখন গুরগাঁওতে সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করে। কনটেন্ট রাইটারের কাজ। ক’দিন আগে ফোন করেছিল।

‘চলে আয় সিনু। ওখানে না পচে চলে আয়। এখানে কাজ পেয়ে যাবি।’

কলেজের কোনও কোনও বান্ধবী তাকে সিনু ডাকত। কঙ্কণা তাদের একজন।‌

সিন্ধুরা বলল, ‘তোদের ওসব কাজ আমি পারব না।’

‌কঙ্কণা বলল, ‘একশোবার পারবি। আরে বাবা, সফটওয়্যারে বাংলা কাজও হয়। আমিই তো সেরকম একটা কোম্পানিতে কাজ করি। এখানে এসে আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকবি। তুই রান্না করবি, আমি খাব। আমার শালা রান্নাটা একদম আসে না। যাই করি, টেস্ট হয় না। তুই চিন্তা করিস না, বাংলাতেই একটা কাজ পেয়ে যাবি।’

সিন্ধুরা বলল, ‘বাংলা, ইংরেজি বড় কথা নয়। তোদের ওই কর্পোরেট কালচারেই মানিয়ে নিতে পারব না। অভ্যেস নেই যে।’

কঙ্কণা বলল, ‘আমারও কি অভ্যেস ছিল? অভ্যেস হয়ে যাবে। এই উইকে আমার মেলে একটা অ্যাপ্লিকেশন পাঠা।’

গুরগাঁওতে তো পাঠাচ্ছেই, বেঙ্গালুরুর কোম্পানিতেও সিভি পাঠাচ্ছে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে। এটাও একটা সফটওয়্যার কোম্পানি। ওরা শিক্ষা বিষয়ক নানা ধরনের অ্যাপ তৈরি করে। পড়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন লোক খুঁজছে। সিভি পাঠালেও সিন্ধুরা জানে, দুটোর একটা কাজ পেলেও তার যাওয়া হবে না। সুরুলপুর ছেড়ে, মাকে ছেড়ে, সবচেয়ে বড় কথা, রাজনীতি ছেড়ে তার কোথাও যাওয়া হবে না। সে পারবে না। সবাই সব পারে না। এখানেই তাকে একটা কাজ জোগাড় করতে হবে। যে করে হোক জোগাড় করতে হবে। বেসরকারি স্কুলের চাকরিটা গিয়েছে মাথা গরম করে। ম্যানেজমেন্টের এক কর্তার সঙ্গে ঝগড়া করে বসল। কর্তা ক্লাস এইটের এক ছাত্রীর পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলেছিল। মেয়েটির বাবা সুরুলপুরের একজন লোহা ব্যবসায়ী। ব্যবসার বিষয় কঠিন হলে কী হবে, মানুষটি বাইরের খোলসটি অমায়িক। নিজে অল্পবিস্তর কবিতার চর্চা করেন। স্কুলে অনুষ্ঠান হলে বড় অঙ্কের ডোনেশন দেন। এলাকার বিভিন্ন ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠন, এনজিওগুলোও তার কাছে নিয়মিত চাঁদা নেয়। রাজনৈতিক দলেরাও পিছিয়ে নেই। সেই লোকের মেয়ের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে সিন্ধুরার মাথা ঘামানোর কী ছিল? এ তো স্কুলের ব্যাপার। তাও ঘামিয়েছে। শুধু ঘামায়নি, ঝগড়াও করেছে। ফলে চাকরিটা চলে গেল।

সিন্ধুরাকে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরোতে দেখে নয়নতারা যেন আরও রেগে গেল।

‘বাবার মতো চলতে হলে বাইরে গিয়ে থাক। আমাকে জ্বালাতে আসবে না।’

সিন্ধুরা রাগতে গিয়েও চুপ করে থাকে। নয়নতারা বলে যায়।

‘দুটো ছেলেমেয়ে বড় হল, অথচ দুটো পয়সা রোজগারের মুরোদ হল না। একজন কলকাতায় গিয়ে কী করে কে জানে। শুনছি মেয়েদের সঙ্গে ফুর্তি করা শিখেছে। আর একজন কাজকর্ম শিকেয় তুলে গুন্ডাদের মতো হাতে ঝান্ডা ধরা শিখেছে। যেমন বাবা তেমন তার ছেলেমেয়ে।’

আর পারে না সিন্ধুরা। বলে, ‘আহ‌্ মা, চুপ করবে! তোমার শরীর খারাপ, কেন উত্তেজিত হচ্ছ? শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ো।’

নয়নতারা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ‘ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাবে, আর বলতে পারব না?’

সিন্ধুরা শান্তভাবেই বলে, ‘কেউ উচ্ছন্নে যাইনি মা। তোমাকে ‌যারা খবর দিয়েছে, ভুল দিয়েছে। একটি মেয়ের সঙ্গে দাদার ভালবাসার সম্পর্ক হয়েছিল। তাকে মেয়েদের সঙ্গে ফুর্তি করা বলে না। আমিও গুন্ডা হইনি। রাজনীতি মানেই গুন্ডাগিরি নয়।’

নয়নতারা বলল, ‘থাক, কাকে কী বলে আমাকে আর শিক্ষা দিতে হবে না। শুধু বড় বড় লেকচার। দেশে কাজকর্ম কিছু নেই, সবাই নাকি বেকার হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে। একটা ভাল ছেলেমেয়ে বসে রয়েছে? এই তো সুলগ্নার মেয়ে ব্যাঙ্কে চাকরি পেল, তপনদার ছেলে আমেরিকা গেল রিসার্চ করতে। মোটা স্কলারশিপ পাবে। মেজদির ছেলে আমদাবাদে গাড়ির কোম্পানিতে ম্যানেজার হয়েছে। মন দিয়ে লেখাপড়া যারা করেছে, তারাই কিছু না কিছু করছে। যত্তসব বাজে কথা।’

সিন্ধুরা বলল, ‘অবশ্যই বাজে কথা নয় মা। তুমি যাদের কথা বলছ তারা হাতেগোনা, মাত্র কয়েকজন।’

নয়নতারা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তোমাকে আর তোমার দাদাকে হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে থাকতে কে বারণ করেছিল? তোমাদের বাবা?’

সিন্ধুরা আর রাগ সামলাতে পারল না। বলল, ‘তুমি সব কথায় বাবাকে টানছ কেন? বাবা বড়সড়, ঝলমলে চাকরি করতে চায়নি, জীবনকে সে তার মতো দেখেছে। সেটা তার ব্যাপার। সততা, ভালমানুষি তো দাদা বাবার থেকেই পেয়েছে। শুধু টাকা রোজগারই একটা মানুষের পরিচয় হবে ভাবছ কেন? আর যদি আমার কথা বল, বলব, বাবার কাছ থেকে আমি অনেক বড় জিনিস পেয়েছি। শুধু নিজেকে নয়, চারপাশের জগতটা নিয়ে ভাবার ক্ষমতা পেয়েছি। এর জন্য আমি গর্বিত। সবাই কেরিয়ারের জন্য বেঁচে থাকে, এমন ভাবার কোনও কারণ আছে?’

নয়নতারা‌ বলল, ‘না, আমার কোনও কিছু ভাবারই কারণ নেই। তোমাদের বাবা যা খুশি করে বেড়াত, তোমরাও তাই করছ। তোমাদের আমার কিছু বলার কারণ থাকবে কোথা থেকে? শরীরে শাশ্বত সেনগুপ্তর রক্ত বইছে না! তার খারাপ গুণ সবই পেয়েছ।’

এবার মাথায় আগুন ধরে যায় সিন্ধুরার। সে স্নানের জন্য বাথরুমের দিকে এগোচ্ছিল। থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে সামলে, চাপা গলায় বলে, ‘মা, আমাদের তুমি যত খুশি বল, কিন্তু বাবার নামে এই অকারণ দোষারোপ বন্ধ কর। তোমার দুঃখ, কষ্ট, সমস্যা আমি বুঝতে পারছি। দাদাও পারছে। কী করবে? সব তো মনের মতো হয় না। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছে না সে। এটা তার দোষ নয়। মামা, কাকা, দাদাকে ধরতে না পারাটা দোষের নয়।’

নয়নতারা যেন ক্ষেপে উঠল। বলল, ‘একশোবার বলব, হাজারবার বলব। আমার এই দুর্দশার জন্য তোর বাবা দায়ী। সে যদি সংসারের কথা একটু বুঝত, এই কষ্টে আমি পড়তাম না। তোরা যতই মাথায় তুলে নাচিস না কেন, সে একটা খারাপ মানুষ ছিল, স্বার্থপর মানুষ ছিল। আর তোকেও বলে দিলাম সিন্ধু, কোনও বেয়াদপি আমি সহ্য করব না। বাড়িতে থাকতে গেলে আমার কথামতো চলতে হবে। মনে রাখবি বাবার পেনশন আমার নামে আসে। সেই টাকায় খাবি আর নিজের মতো চলবি, তা হবে না।’

সিন্ধুরা আর পারল না। দাঁতে দাঁত চেপে, হিসহিসিয়ে বলল, ‘মা, তুমি আমার উপর চোখ রাঙাও কোন অধিকারে? তুমি তো আমার জন্মটাই চাওনি। আমি পেটে আসার পর তুমি অ্যাবর্ট করাতে চেয়েছিলে। চেয়েছিলে ভ্রূণেই শেষ হোক। বাবাকে জোর করে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিলে। ডাক্তার বলেছিল, ফিটাসের বয়স চারমাস পেরিয়ে গিয়েছে। এরপর গর্ভপাত করলে তোমার শরীরের জন্য ঝুঁকির হয়ে যাবে। তুমি তারপরেও জোর করেছিলে। বাবা বন্ডে সই করতে রাজি হয়নি। তুমি কান্নাকাটি করেছিলে, তারপরেও বাবা রাজি হয়নি। বলেছিল, একসঙ্গে দুটো খুন করতে পারব না। বাবা যদি রাজি হত, আজ আমি কোথায় মা? আমি তোমার অবাঞ্ছিত সন্তান।’

নয়নতারা পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ের কথা শুনল। বলল, ‘একথা তোকে কে বলেছে? তোর বাবা?’

সিন্ধুরা ঠোঁটের কোনায় মলিন হেসে বলল, ‘কে বলল জেনে তোমার লাভ কী? মিথ্যে কিনা বল।’

নয়নতারা চুপ করে থাকে। সিন্ধুরা বলল, ‘কেন তুমি এই সন্তান চাওনি, তাও আমি জানি। আমার জন্মের ব্যাপারে তোমার দ্বিধা ছিল, সংশয় ছিল।’

‌নয়নতারা কাঁপা গলায় বলে, ‘কীসের দ্বিধা? তুই মিথ্যে কথা বলছিস।’

‘মা, এই কথাটা আর আমাকে বলিও না।’

‌‌নয়নতারা ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘আসলে তোর বলার কিছু নেই। তোর বাবা তোকে মিথ্যে বলে গিয়েছে। যাতে আমার উপর তোর মন বিষিয়ে যায়।’

সিন্ধুরা খানিকটা দম নিয়ে বলল, ‘বাবা আমাকে কিছু বলেনি। বলার মতো মানুষ সে ছিল না তুমি জান। তাও নিজেকে আড়াল করতে, ঢাকতে বাবার ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছ। তাকে অকারণে গালমন্দ করছ। এটা পাপ না পুণ্য, সে কথা আমি বলছি না। ভালবাসায় পাপ-পুণ্যের বিচার হয় না।’

নয়নতারা চেয়ারের উপর বসে পড়ে বলল, ‘তুই বাজে কথা বলছিস সিন্ধু।’

সিন্ধুরা একটু চুপ করে থেকে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তোমার সংশয় ছিল, তুমি ভয় পেয়েছিলে। ভেবেছিলে, দ্বিতীয় যে সন্তানটি তোমার গর্ভে এসেছে সে শাশ্বত সেনগুপ্তর সন্তান নাও হতে পারে। তাকে এই পৃথিবীতে আনা ঠিক হবে না। আমার জন্মের কিছু পরে সেই সংশয় কাটে।’

নয়নতারা ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘এসব তুই কী বলছিস!‌’

সিন্ধুরা শান্তভাবে বলল, ‘আমি বলতে চাইনি মা, তুমি জোর করে বলালে। আমার বাবার মতো একজন চমৎকার মানুষের বিরুদ্ধে তোমার অবিরত গালমন্দ আমাকে বলতে বাধ্য করাল। অথচ বাবা তোমার অন্য পুরুষকে ভালবাসার ঘটনা সব জেনেও তোমাকে কিছু বলেনি, কোনও রাগারাগি অশান্তি করেনি। বরং শান্তভাবে তোমাকে বুঝিয়েছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নয়নতারা মাথা নামিয়ে মুখ ঢাকল। সিন্ধুরা বলল, ‘বাবা মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে এই ঘটনা আমি জানতে পারি। কীভাবে জানতে পারি, যদি চাও বলতে পারি। বাবার ডায়েরি থেকে। সেখানে বাবা কী লিখেছে জান? লিখেছে, ‘নয়ন কেন এত চিন্তা করছে? সে যদি কারও প্রেমে পড়ে, অপরাধ তো কিছু করেনি। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে এমন কোনও নিয়ম আছে নাকি যে আর কাউকে কোনওদিন ভালবাসা যাবে না? কেউ কি কারও মালিক? জমিদার? যদি এমন নিয়ম থাকেও, সেই সামন্ততান্ত্রিক নিয়ম আমি মানি না। নয়ন তো আমার প্রতি কোনও কর্তব্যে অবহেলা করে না। ও কেন এত উদ্বিগ্ন?’ একটু থেমে সিন্ধুরা বলল, ‘মা, আমি ওই ডায়েরি নষ্ট করে ফেলেছি। আর আমার এখন কী মনে হচ্ছে জান? মনে হচ্ছে, কোনও একদিন বাবার রাতে বাড়িতে করা মিটিং থেকেই এই ঘটনার সূত্রপাত। সেখানে তোমার কাউকে দেখে পছন্দ হয়েছিল। পরিচয় হয়েছিল। তুমি অপরাধবোধে ভোগ, তাই কাল আমার কাছে লোক আসায় এভাবে রিঅ্যাক্ট করলে। বাবাকে তুমি ভুল বোঝ। এটা তোমার জন্য কষ্টের। আমার জন্য তো বটেই।’

খানিকটা এলোমেলোভাবেই স্টেশনে চলে এসেছে সিন্ধুরা। অস্থির মনে সে ফোন করল অগ্নীশকে। কেন জানি, আজ তার মনে হচ্ছে, এই মানুষটার সঙ্গে কথা বললে মন খানিকটা শান্ত হবে। এ ছাড়া বাঁশরীদির বিষয়টাও রিপোর্ট করার আছে। এসব কথা ফোনে বলার চেয়ে মুখে বলাই ভাল। সিন্ধুরার ফোন আগ্রহ নিয়ে ধরেছে অগ্নীশ। তার জ্বর হয়েছে। বাড়িতেই রয়েছে। সিন্ধুরা যেতে চায় শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হল। একা বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকতে নাকি তার অসহ্য লাগছে।

দহলার ট্রেন এলে সিন্ধুরা উঠে পড়ল।

অগ্নীশের জ্বর বেশি নয়। গায়ে নস্যি রঙের একটা হালকা চাদর দিয়েছে। মুখে দু’দিনের না-কাটা দাড়ি। তাকে আজ আরও বন্য দেখাচ্ছে। সিন্ধুরার মনে হল, এই মানুষটার কাছে তার অন্যায় স্বীকার করা উচিত। ‌অগ্নীশদা তার রাজনীতির শিক্ষক, সেই অর্থে জীবনের শিক্ষকও বটে। সে কিছু বলার আগে অগ্নীশ কথা বলল।

‘কী হয়েছে? মুখ শুকনো কেন?’

সিন্ধুরা বলল, ‘মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।’

অগ্নীশ অল্প হেসে বলল, ‘মায়ের সঙ্গে ঝগড়া তো ভাল। হেলদি।’

‌সিন্ধুরা বসেছে মুখোমুখি। মুখ নামিয়ে বলল, ‘বিষয়টা বিশ্রী।’

‌অগ্নীশ গায়ের চাদর আরও একটু ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘দ্বন্দ্বে সব মলিনতা দূর হয়ে যায়। যেখানে মতের পার্থক্য নেই, সে তো বদ্ধ জলাশয়ের মতো। তাতে কচুরিপানা জন্মায়।’

সিন্ধুরা মুখ তুলে বলল, ‘আপনি বুঝবেন না ‌অগ্নীশদা। এই ঝগড়াটা নোংরা কাদা ছোড়ার মতো.‌.‌.‌আমার খুব খারাপ লাগছে। মায়ের শরীরটাও ভাল নেই.‌.‌.‌কেন যে ওভাবে বলতে গেলাম.‌.‌.‌আসলে অনেক দিনের চাপা অভিমান.‌.‌.‌’

অগ্নীশ আবার হেসে বলল, ‘ভালই হয়েছে। সব বলে ফেলে এখন মন সাফ।’

সিন্ধুরা যা কখনও করে না, আজ তাই করে ফেলল। সে মুখ নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। অগ্নীশ একটুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। যেন কিছুই হয়নি, এমন একটা ভঙ্গিতে ঘরের কোনায় রাখা ইলেকট্রিক কেটলে চায়ের জল বসাল। বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে নাড়াচাড়া করে একটা বই টেনে বার করল। পাতা উলটে নিচু স্বরে আবৃত্তি শুরু করল—

‘বাতাস পিঠে চাবুক হানে/আকাশ আনে বজ্র/শান্তি কবে ফুঁকছে শিঙে—/বেজায় ঢিমে কান তো.‌.‌.‌’

সিন্ধুরার কান্নার দিকে মনোযোগ দিল না কোনও। যেন সে চাইল, কাঁদুক মেয়েটা। কেঁদে হালকা হোক।

চা বানিয়ে দুটো আলাদা কাপে ঢালল অগ্নীশ। সিন্ধুরার কাছে এসে একটা কাপ এগিয়ে নরম গলায় বলল, ‘নাও।’

সিন্ধুরা কান্না থামিয়ে লজ্জা পেল খুব। এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে অন্য হাতে তাড়াতাড়ি চায়ের কাপ ধরে নিয়ে বলল, ‘ইস্‌ কী কাণ্ড করলাম বলুন তো। ছি ছি।’

অগ্নীশ উলটো দিকে গুছিয়ে বসে বলল, ‘কাণ্ডের কী হয়েছে? মন খারাপ বলে কেঁদেছ, মন ভাল থাকলে হাসবে। এই নিয়ে এত ভাবার কী হয়েছে? এইসব অনুভূতিগুলো আছে বলেই মানুষ বড় কাজ করে। তবে আমি একটা জিনিস দেখে ফেললাম।’

কথাটা বলে মুচকি হাসল অগ্নীশ। সিন্ধুরা চোখ তুলে লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, ‘কী?’

অগ্নীশ বলল, ‘ব্যাকগ্রাউন্ডে কেউ কাঁদলে আমি খুব ভাল চা বানাতে পারি।’

সিন্ধুরা জোরে হেসে ফেলল। অগ্নীশও সেই হাসিতে যোগ দিল। অনেকটা হালকা লাগছে সিন্ধুরার। অগ্নীশকে সে বাঁশরীদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে বলল। অগ্নীশ সব শুনে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, ‘ভেরি গুড। কখন হবে?’

সিন্ধুরা নিচু গলায় বলল, ‘আজ বা কাল। একটা সুযোগের অপেক্ষা করছে।’

‘আমাদের কথা কেউ জানতে পারবে না তো?’

সিন্ধুরা বলল, ‘একেবারেই নয়। ‌আমি তো ধারেকাছে থাকব না।’

অগ্নীশ গাঢ় স্বরে বলল, ‘প্রথম অ্যাসাইনমেন্টই তুমি এত নিখুঁতভাবে করলে সিন্ধুরা, আমি কল্পনাও করতে পারছি না। আমি খুব খুশি।’

অগ্নীশের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, সিন্ধুরার কেমন ঘোরের মতো হল। অগ্নীশদার বাড়িতে এই প্রথম‌ সে একা এসেছে। এর আগে সব সময়েই কেউ না কেউ থেকেছে।

‘আগে কাজটা হোক।’

অগ্নীশ বলল, ‘কাজটা হওয়া না হওয়া তোমার দায়িত্ব নয়। তুমি তোমার কাজ করেছ। গেরিলা কায়দায় এরকম ছোটখাটো গোলমাল তৈরি করতে হবে আমাদের। সুরুলপুরের পার্টির নেতারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না। পুরোপুরি অশান্তি, অস্থিরতা তৈরি হলে আমরা এখানকার নেতৃত্ব বদলে চাপ দেব। বলব, কল্লোলবাবু, বিভাস সাহা পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। ওদের সরাতে হবে। এক সময়ে আমরা এখানকার ইউনিটের দখল নেব।’

সিন্ধুরা বলল, ‘তাতে লাভ?’

অগ্নীশের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, ‘লাভ অনেক সিন্ধুরা। অন্যদের অশান্তি, বিশৃঙ্খলা থেকে আমরা ফায়দা তুলব। পার্টি বাড়াব। অথচ গায়ে আঁচ লাগাব না। তা ছাড়া.‌.‌.‌তা ছাড়া আমি ইউনিটের দখল নেব।’

সিন্ধুরা এতটা বুঝতে পারল না। সে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি আজ চলি তাহলে? কিছু হলেই খবর দেব।‌’

অগ্নীশ বলল‌, ‘তোমার একটা প্রাইজ় আছে সিন্ধুরা।’

‘প্রাইজ়!‌’

অগ্নীশ হেসে বলল, ‘অবশ্যই। এত মাথা খাটিয়ে, এত সাহস করে কাজ করেছ, প্রাইজ় হবে না? যে স্কুল থেকে তোমার কাজ চলে গিয়েছিল তাদের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আমার যোগাযোগ র‌য়েছে। গোপন যোগাযোগ। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা তোমাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি।’

সিন্ধুরা উজ্জ্বল মুখে বলল, ‘সত্যি?’

অগ্নীশ হেসে বলল, ‘আমি কি মিথ্যে বলব? আমি তোমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। কেউ জানবে না।’

সিন্ধুরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি কীভাবে ধন্যবাদ জানাব জানি না। একটা কাজ আমার খুব দরকার।’

অগ্নীশ সিন্ধুরার কাছে সরে এসে বলল, ‘আমি জানি। জানি বলেই তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমি নিজেই কথা বলেছি।’ তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি সিন্ধুরা। তুমি ব্রাইট, সাহসী একটা মেয়ে। ‌আজ তোমার কান্না দেখে বুঝলাম, তোমার বাইরেটা যত কঠিন, ভিতরটা ততটাই নরম। আমাদের বয়সের অনেকটা ফারাক, একথা বলা হয়তো ঠিক নয়। তাও আজ বলে ফেললাম। কিছু মনে কোরো না।’

সিন্ধুরার কী হল সে নিজেও জানে না, সে অগ্নীশের হাত ধরে বলল, ‘এরকম করে বলবেন না, আমার আজ মনখারাপ।’

অগ্নীশ সিন্ধুরার ঠোঁটের উপর নিজের মুখ নামায়। উষ্ণ, কালো ঠোঁট। সিন্ধুরা শিউরে ওঠে। তেজি মেয়ের শরীর শিথিল হয়। পুরুষের শরীর এত সুন্দর!‌ এত রোমাঞ্চকর! সে অগ্নীশের কাঁধে হাত রেখে মুখ তুলে আত্মসমর্পণ করতে চায়। অগ্নীশ তাকে আলগোছে তুলে নেয়। গায়ের চাদর খসে যায় তার। সিন্ধুরা তার সারা শরীর দিয়ে অগ্নীশকে অনুভব করে। তাকে একরকম কোলে নিয়েই বেডরুমে ঢোকে অগ্নীশ। পরিপাটি করে পাতা বিছানায় শুইয়ে, পাকা হাতে দ্রুত সিন্ধুরার লাল টি-শার্ট, জিনসের প্যান্ট খুলতে থাকে। সিন্ধুরা হাত চেপে ধরে। সারা শরীরে চুমু খেতে খেতে সে হাত সরিয়ে দেয় অগ্নীশ। সিন্ধুরা আবার বাঁধ তৈরি করতে চায়। আবার সে ভেঙে যায়। নিজেকে ঢাকতে পারে না। আবরণ খোঁজে। কোথায় আবরণ‌? তর সইছে না অগ্নীশের। বহুদিনের তৃষ্ণার্ত সে। সিন্ধুরার মুখে, গলায়, ঘাড়ে নিজের নাক মুখ ঘষতে ঘষতে তার ব্রা, প্যান্টি টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে ফেলে। যেভাবে একসময়ে সে তার স্ত্রীকে নগ্ন করত।

‘তুমি সেক্স স্টার্ভড। এই সময়ে পাগল হয়ে যাও।’

‘কেন তোমার ভাল লাগে না?’

‘না, লাগে না। সেক্স একটা আর্ট। তোমার মধ্যে আর্জ আছে, আর্ট নেই। নিজে স্যাটিসফায়েড হতে চাও, আমাকে তৃপ্তি দাও না।’

‘নিকুচি করেছে তোমার আর্ট।’

শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে চেপে ধরত অগ্নীশ। আজ নিজেকে পোশাক থেকে মুক্ত করল সে। নগ্ন সিন্ধুরা অগ্নীশের জ্বর উত্তপ্ত শরীরের ভিতর ঢুকে যেতে যেতে ভাবে, মা কি এভাবেই বাবাকে আদর করত? নাকি প্রেমিককে? মায়ের কথা মনে করে সে ভয় পায়। ফিসফিস করে ওঠে।

‘কিছু হয়ে যাবে না তো অগ্নীশদা?’

অগ্নীশদা সিন্ধুরাকে চেপে ধরে, আশ্লেষ জড়ানো গলায় বলে, ‘সমাজব্যবস্থা বদলাতে হলে এত চিন্তা করলে চলবে না সিন্ধুরা। তুমি জান না তোমার তামাটে শরীর আমাকে কতটা.‌.‌.‌’

সিন্ধুরা ছটফট করতে করতে বলে, ‘আমি তো কিছু জানি না।’

‌অগ্নীশদা সিন্ধুরার স্তন থেকে মুখ নামাতে নামাতে বলে,

‘আমি জানি।’

অগ্নীশের নগ্ন গায়ের গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ সিন্ধুরাকে ঘোরের মধ্যে ডুবিয়ে নেয়। সে বুঝতে পারে, অপটু, অনভিজ্ঞ তাকে কিছু করতে হচ্ছে না, সব করে নিচ্ছে অগ্নীশদা। সব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *