৮
টেবিলে কাচের গ্লাসে জল। জল বেশি ঠান্ডা হওয়ায় গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলকণা জমেছে। পাশেই ফিনফিনে কাপে গরম চা। সেখান থেকে অল্প ধোঁয়া উড়ছে। ঠান্ডা-গরমের এই পাশাপাশি অবস্থান নিষাদের চোখ এড়াল না। অনেকটা যেন টেবিলের উলটোদিকে বসে থাকা মানুষটার মতো। আগের দিন যে আচরণ তার কাছ থেকে পেয়েছে, আজ তার একেবারে উলটো! কে বলবে লোকটা সেই আগের অপূর্ব রায়।
অপূর্ব রায় নরম গলায় বলল, ‘বসে আছ কেন নিষাদ? চা খাও। নাকি তুমি চা খাও না?’
নিষাদ হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ টানল। সে চা খায়, তবে অল্প। কোনও নেশা নেই।
আজ অপূর্ব রায়ের সাজ অন্যরকম। সেদিন কোট প্যান্টে ফর্মাল লাগছিল। আজ কালো টি-শার্টে ক্যাজ়ুয়াল। গালে একদিনের না কাটা দাড়ি হালকা সবুজ আভা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, রং লাগিয়েছে। যাই করুক, সুদর্শন এই যুবককে দেখাচ্ছে সিনেমার হিরোদের মতো। নিষাদের মনে হল, ঐশানীদি রূপ দেখে এই লোকের প্রেমে পড়েছিল? মনে হয় না। রূপে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো মেয়ে ঐশানী চ্যাটার্জি নয়। অপূর্ব রায়ের নিশ্চয়ই গুণও রয়েছে। সে তো রয়েছেই। গুণ ছাড়া এত বড় একটা ব্যবসা কেউ দাঁড় করাতে পারে!
নিষাদ চা মুখে দিল। দামী চা। এত বড় অফিসে চা দামী হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথবা এমনও হতে পারে, খুব কিছু দাম নয়, গলির মোড়ে শিবুদার দোকানের তিনবার ফোটানো চায়ে অভ্যস্ত মুখে এই চা বেশি ভাল লাগছে।
‘তুমি ঐশানীর বাড়ি গিয়েছিলে?’
একটু চমকে উঠল নিষাদ। খবরটা জানল কী করে? ঐশানীদি বলেছে? তাই হবে। এই খবর আর কারও জানার কথা নয়। কথা হবেই বা কীভাবে? কলকাতায় তো নিষাদের কোনও বন্ধু নেই। নিজের কথা বলার মতো পরিচিতও তেমন কেউ নেই। মেঘপর্ণা আর পলাশ ছাড়া কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা হয় না। এখন তো মেঘপর্ণার সঙ্গে যোগাযোগও নেই। যখন ছিল, তখনও যে নিষাদ বেশি নিজের কথা বলতে পেরেছে, এমন নয়। মেঘপর্ণারও এই নিয়ে অভিযোগ ছিল। ‘আমিই শুধু বকে যাই। তুমি কিছু বল না কেন?’
নিষাদ বলত, ‘কই, বলি তো!’
‘তুমি তোমার কথা বলতে চাও না কেন নিষাদ?’
নিষাদ বলত, ‘কী বলব? আমার বলার মতো কী কথা রয়েছে?’
মেঘপর্ণা বিরক্ত হয়ে বলত, ‘যা আছে তাই বলবে। বাবা-মায়ের কথা, বোনের কথা, তোমার ছোটবেলার কথা।’
নিষাদ বলত, ‘যেটুকু বলেছি তার বেশি কিছু নেই। আমার ছোটবেলা, বড়বেলা দুটোই খুব সাধারণ মেঘ। গল্প করার মতো নয়। সবার জীবন কি আর গল্প করার মতো হয়?’
মেঘপর্ণার একথা পছন্দ হত না। বুঝতেও পারত না। বলত, ‘সাধারণ বলে সবসময় গোমড়া মুখে থাকবে?’
নিষাদ শুকনো হেসে বলত, ‘কী করব বল? আমি যে একজন গোমড়ামুখো মানুষ।’
মেঘপর্ণা বলত, ‘এমন কম কথা বলা মানুষ নিয়ে যে কীভাবে সংসার করব, কে জানে বাপু।’
মেঘপর্ণার পালা চুকেছে। নিজের কথা তো আর কারও সঙ্গেই হয় না, এমনি গল্পগুজবই বা হয় কোথায়? প্রেসের মালিক বলাইবাবু, মেসের ম্যানেজার কার্তিক দাঁ-ই যা একটু আধটু কথা বলে। বাড়ির কথা জানতে চায়। হুঁ-হাঁ করে জবাব দিয়ে এড়িয়ে যায় নিষাদ। কথা বলতে কোনওদিনই খুব একটা ভাল লাগে না তার।
নিষাদ আর একবার কাপে চুমুক দিল। অপূর্ব রায় বলল, ‘কী হল, বললে না? তুমি ঐশানীর বাড়ি গিয়েছিলে?’
নিষাদ এবার বলল, ‘হ্যাঁ। উনি আমাকে ডেকেছিলেন।’
অপূর্ব রায় সহজভাবে বলল, ‘তাহলে সেদিনই প্রথম ওর বাড়িতে গেলে? আগে তো কোনওদিন যাওনি।’
নিষাদ বলল, ‘হ্যাঁ।’
“বাড়ি চিনতে অসুবিধে হল?”
এ আবার কেমন প্রশ্ন? বাড়ি চিনতে অসুবিধে হবে কেন! একটু থমকে নিষাদ বলল, ‘ঐশানীদি ট্যাক্সিচালককে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।’
অপূর্ব রায় হালকা হেসে সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘বাহ্, সিনসিয়ার মেয়ে। একবারে ট্যাক্সিতে তুলে, বাড়ি বুঝিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখন ট্যাক্সির ভাড়া কেমন হয়েছে? কলকাতায় বহুদিন ট্যাক্সি চড়িনি।’
নিষাদ আবার থমকে গেল। এই লোক কী বলতে চাইছে? বেকার ছেলে ট্যাক্সি চড়ার পয়সা পেল কোথা থেকে? এই কথার তো ওই একটাই উদ্দেশ্য হয়। প্রশ্নটা আসার আগেই সে জবাব দিল।
‘ঐশানীদি ভাড়া দিয়েছে।’
অপূর্ব উজ্জ্বল মুখে বলে, ‘আমি এরকমই কিছু একটা ভাবছিলাম। তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তেমন যোগাযোগ না থাকলেও তোমার ঐশানীদি তোমাকে খুব বেশি ভালবাসে। আবার এমনও হতে পারে, পুরনো ভালবাসা, নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।’
নিষাদ বলল, ‘আপনি কী বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
অপূর্ব রায় চেয়ারে হেলান দিয়ে হেসে বলল, ‘সিরিয়াস কিছু বলিনি। নাকি বলে ফেললাম? যাক, বাদ দাও ওকথা। তুমি ট্যাক্সি করে গিয়ে এমন কী কথা বলে এলে নিষাদবাবু যে তোমার ঐশানীদি আমাকে ফোন করে বিরাট বকাবকি করল! আমি তো অবাক, ব্যাপার কী! বকুনি থামাতে বললাম, আরে! করেছিটা কী? বকছ কেন? তখন ঘটনাটা বলল।’
আজ বেলা এগারোটায় নিষাদের মোবাইলে ফোন আসে। নিষাদ তখন প্রেসে। অচেনা নম্বর দেখে ফোন সরিয়ে রেখেছিল। আজকাল ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না। একবার তো গোটা দিনই বন্ধ করে রেখেছিল। পরদিন ফোনে পেয়ে সিন্ধুরা খুব রাগারাগি করল।
‘তুই কি খেপে গিয়েছিস দাদা? পাগলামি করছিস? ফোন বন্ধ করে রেখেছিস কোন আক্কেলে? আমি খুব চিন্তায় পড়েছিলাম। মাকে কিছু বলতেও পারছি না। বললাম, দাদার ফোন খারাপ, সারাতে দিয়েছে। তাই লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। আজও যদি ফোন না পেতাম, আমি রাতে কলকাতার গাড়ি ধরতাম। আমার কথা বাদ দে, মায়ের যদি শরীর খারাপ হত?’
নিষাদ বুঝতে পারল, কাজটা খুব ভুল হয়েছে। নিজের মনখারাপ বলে এই বয়সে ছেলেমানুষি করা যায় না। সত্যি তো মায়ের যদি শরীর খারাপ হত? শুধু মায়ের কেন, সিন্ধুরারও তো কিছু হতে পারে। অল্পবয়সি একটা মেয়ে মায়ের সঙ্গে একা থাকে, তার উপর আবার পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছে। কাজটা খুব স্বার্থপরতার হয়েছে। একেই তো বাড়ির কোনও দায়িত্ব পালন করতে পারে না। না পারে মা-বোনকে দেখাশোনা করতে, না পারে ঠিকমতো টাকা পাঠাতে। সেই জন্য মায়ের মুখোমুখি হতেও লজ্জা করে। তার উপর নিজের সুখ-দুঃখের কথা ভেবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ছিঃ ছিঃ।
‘সরি, সিন্ধু।’
সিন্ধুরা গলা নরম করে বলল, ‘এত ভাবছিস কেন দাদা? মাঝেমধ্যে জীবনে ব্যাড প্যাচ আসে। খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে সবাইকে যেতে হয়। ঠিক হয়ে যায় সব। মেঘপর্ণাদি তোর থেকে সরে গিয়ে ভালই করেছে, বিয়েটা হলে নিজে তো বিপদে পড়তিস, তাকেও বিপদে জড়িয়ে ফেলতিস।’
নিষাদ চুপ করে থাকে। কথাটা সে জানে। আজ জানে না, বিয়ের পরিকল্পনা যখন হয় তখন থেকেই জানত। মেঘপর্ণার জন্যই বিয়েতে রাজি হয়েছিল সে। যেভাবে ওর বিয়ের জন্য বাড়িতে উঠে পড়ে লাগে, মেঘপর্ণা ঘাবড়ে যায়। নিষাদের কাছে কান্নাকাটি করে। নিষাদ বলেছিল, ‘তুমি বাড়িতে আমার কথা বলে দাও। এত ভয় পাচ্ছ কেন? এটা কি সেই প্রাচীন যুগ যে বাড়ির মেয়েকে ধরেবেঁধে বিয়ে দেবে? এখন আমাদের সুরুলপুরেই এসব চলে না তো কলকাতায় কী হবে?’
মেঘপর্ণা বলেছিল, ‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আমার বাড়ি প্রাচীন যুগের চেয়েও পিছিয়ে। তোমাকে তো বাবা-মায়ের কথা বলেছি। কলেজের পর আর পড়তেই দিল না। বেশি ডিগ্রি হলে নাকি ভাল পাত্র পেতে সমস্যা হয়। কেউ একথা বিশ্বাস করবে? অথচ কলকাতায় এরকম কত বাবা-মা রয়েছে! আমরা আধুনিকতার বড়াই করি, মনে মনে প্রাচীন, ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকি।’
নিষাদ বলেছিল, ‘আমি কি তোমার বাড়িতে গিয়ে কথা বলব?’
মেঘপর্ণা বলল, ‘কী বলবে?’
নিষাদ আমতা-আমতা করে বলে, ‘অপেক্ষা করার কথা। বলব, আগে আমি একটু দাঁড়াই, তারপর...’
মেঘপর্ণা বলেছিল, ‘সেদিনই হাতের কাছে যে পাত্র পাবে তাকে ধরে এনে বাবা আমাকে পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে। যদি বা কয়েক মাস, সময় পেতাম, প্রেমের কথা শুনলে কয়েক ঘণ্টাও পাব না।’
নিষাদ বলল, ‘তাহলে কী হবে?’
মেঘপর্ণা ফুঁপিয়ে উঠে বলেছিল, ‘তাহলে কী হবে আমি জানি না। তুমি ঠিক কর কী হবে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’
গোপনে বিয়ের সিদ্ধান্ত মেঘপর্ণাই নিয়েছিল। ওর বন্ধু উষ্ণি পরামর্শ দেয়। খানিকটা ঘোরের মধ্যেই নিষাদ তাতে সায়ও দিয়ে বসে। মেঘপর্ণা যে ঠিক বলছে না, বিপদের কথা বলছে, তখন মাথায় ছিল না। পরে মেঘপর্ণা সেই বিপদ বুঝতে পেরেছে। আবার এমনও হতে পারে, কেউ বুঝিয়েছে হয়তো। যেটাই হোক, যা ঘটেছে, দু’জনের জন্যই নিশ্চয়ই ভাল।
নিষাদ বোনকে বলল, ‘চিন্তা করিস না সিন্ধু, আমি সুরুলপুর যাব। ক’দিনের মধ্যেই যাব।’
‘একটা গুড নিউজ় আছে দাদা। বাবার অফিস থেকে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, বেশ খানিকটা টাকা পাওয়া যাবে। এরিয়ার না কী একটা বকেয়া টাকার হিসেব হয়েছে।’
নিষাদ বলল, ‘ভাল হয়েছে। মায়ের ট্রিটমেন্টের জন্য লাগবে।’
একটু চুপ করে থেকে সিন্ধুরা বলল, ‘মায়ের শরীরটা আরও খারাপ হয়েছে। একবার কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে পারলে ভাল হত। আমি এখানে কয়েকবার দেখালাম। লাভ হল না কিছু। অবশ্য জানিসই তো আমার কোনও কথা মা শুনতে চায় না। যেটা বারণ করি তাই করে। রান্নাঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা, অকারণে জল ঘেঁটে কাপড় কাচা, আমি আর বলিও না। কত বলব? তুই এসে যদি রাজি করাতে পারিস দেখ।’
নিষাদ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি যাচ্ছি সিন্ধু। এখানকার সব গুটিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। আর ভাল লাগছে না। ওখানে গিয়ে ছোটখাটো কাজকর্ম যা পাব, তাই করব।’
সিন্ধুরা খুশি হয়ে বলল, ‘তাই ভাল, চলে আয়। একসঙ্গে থাকব।’
ফোন একবার সরিয়ে রাখলেও বারবার অচেনা নম্বরটা থেকে ফোন আসতে থাকে। হাতের কাজ সরিয়ে ফোন কানে নেয় নিষাদ। মেয়ের গলা।
‘গুড মর্নিং নিষাদবাবু, আমি তৃষা বলছি।’
নিষাদ বুঝতে পারে না। তৃষা! সে কে? মেয়েটা এমন ভাবে নিজের নাম বলল, যেন অনেকদিনের পরিচিত।
‘আশা করি ভাল আছেন।’
গলায় সৌজন্য, অতিরিক্ত ভদ্রতা। নিষাদ বলল, ‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।’
মেয়েটি যেন অবাক হল। বলল, ‘আমি তৃষা। রয় ডিস্ট্রিবিউটার থেকে বলছি। অপূর্ব স্যারের কাছে আপনি এসেছিলেন...আমি ফ্রন্ট অফিসে বসি, রিসেপশনে...সেদিন অত কথা হল, মনে নেই আপনার?’
এবার অবাক হওয়ার পালা নিষাদের। সেই মেয়ে! যে মাত্র ক’দিন আগে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বার করে দিয়েছিল? মেয়েটি এমন নরম গলায় কথা বলছে কেন?
‘স্যার আপনার টেলিফোন নম্বরটা দিলেন।’
নিষাদ বলল, ‘কী হয়েছে বলুন?’
‘অপূর্ব স্যার আপনাকে আজই একবার দেখা করতে বলছেন।’
নিষাদের মনে হল ভুল শুনছে। সে অবাক হয়ে বলল, ‘আমাকে! আমাকে দেখা করতে বলেছেন?’
ওপাশ থেকে তৃষা নামের মেয়েটি আরও বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনাকে নিষাদবাবু। স্যার বলেছেন, লাঞ্চের পর যে কোনও সময়ে যদি একবার আসেন, ভাল হয়। আসলে উনি নেক্সট উইকে একটু দেশের বাইরে যাচ্ছেন। ইউকে। সাত-আটদিনের টুর। তাই চাইছিলেন আজই...’
কথা শেষ করে মেয়েটি মনে হয় আরও একবার হাসল। তৃষা মেয়েটি তো আশ্চর্য! একই লোককে কখনও ধমক শোনায়, কখনও শোনায় হাসি! এরকমভাবেই ওদের ট্রেনিং দেওয়া? আজ নিশ্চয়ই ওকে হাসি শোনাতে বলা হয়েছে। নিষাদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। অপূর্ব রায় কেন ডাকছে? যে কারণেই ডাকুক, যাওয়াটা কি উচিত হবে? ঐশানীদিকে একবার জিজ্ঞেস করা দরকার। নিষাদের আর ওই লোকের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না।
মেয়েটি এবার দুম করে গলা নামিয়ে বলল, ‘আপনি যদি আজ না আসেন, আমার খুব সমস্যা হবে নিষাদবাবু।’
নিষাদ অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার সমস্যা হবে! কেন?’
মেয়েটি গলা কাঁচুমাচু করে বলল, ‘স্যার ভাববেন, আগের দিন আমি নিশ্চয়ই এমন কোনও খারাপ ব্যবহার করেছি যাতে আপনি রাগ করেছেন। তাই আপনি এলেন না। আজ অফিসে এসেই আমাকে ডেকে সেদিনের কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, আমি তো কিছু বলিনি। শুধু বলেছি, স্যার আজ ব্যস্ত। আপনিই বলুন তাই বলেছি কিনা?’
মেয়েটি এত তড়বড় করে কথা বলছে যে নিষাদ কিছু ভাবার সময় পেল না। অস্ফুটে বলল, ‘তাই হবে।’
‘প্লিজ় নিষাদবাবু, আমি যদি সেদিন খারাপ কিছু বলে থাকি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আজ একবার আসুন। নইলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে।’
নিষাদ আর পারল না। বলল, ‘কী বলছেন এসব কথা! আমাকে আপনি কী বলেছেন না বলেছেন, তার জন্য আপনার চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে যাবে কেন?’
মেয়েটি যেন এবার টেলিফোনের ওপাশে ভেঙে পড়ল। প্রায় কেঁদে ফেলা গলায় বলল, ‘আপনি কে জানি না নিষাদবাবু, তবে এটুকু জানি, স্যার আপনাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যদি আমার কোনও আচরণে আপনি দুঃখ পান, আমাকে ক্ষমা করে দিন। চাকরিতে গোলমাল হলে খুব বিপদে পড়ব। আজকাল কোনও কাজ পাওয়া খুব মুশকিল। আপনি তো সব জানেনই স্যার।’
মেয়েটি এবার তাকেও স্যার বলতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই গুরুতর সমস্যা হয়েছে। সমস্যা না হলে একজন বেকার, কর্মপ্রার্থীকে বড় অফিসের কোনও কর্মচারী স্যার সম্বোধন করে? আর কথা বাড়াতে না দিয়ে নিষাদ বলল, ‘ঠিক আছে আমি যাব। বিকেলে যাব। তার আগে পারব না।’
তারপরেও মেয়েটি কিছু বলতে থাকে, নিষাদ না শুনে ফোন কেটে দেয়। থম মেরে বসে থাকে একটুক্ষণ। এ আবার কী অদ্ভুত ঘটনা? দু’দিন আগে তাড়িয়ে দিয়ে আবার খাতির করে ডেকে নেওয়া! ঐশানী চ্যাটার্জির নম্বর টেপে নিষাদ। ফোন বেজে যায়। দু’বার বেজে যাওয়ার পর মেসেজ পাঠায়।
‘অপূর্ব রায় ডেকেছেন। কী করব?’
কোনও জবাব আসে না। নিষাদ আবার নম্বর টেপে। এবারও ফোন বেজে যায়। নিশ্চয়ই ফোন সাইলেন্ট।
নিষাদ প্রেসে আসেনি গত দু’দিন। ইচ্ছে করেনি। সারাদিন পথে ঘুরে বেরিয়েছে এলোমেলো। খিদে পেলে হয় খায়নি, নয় ফুটপাতের হোটেলে দুটো ডাল-ভাত মুখে দিয়েছে। দুপুরে পার্কে গিয়ে শুয়ে থেকেছে। একদিন সস্তার টিকিট কেটে সিনেমা হলে ঢুকে ঘুমিয়েছে। বলাইবাবু বারবার ফোন করেও পাননি। তিনদিনের মাথায় হন্তদন্ত হয়ে মেসে গিয়ে হাজির হলেন। তখন সকাল সাড়ে আটটা। সদর দরজা টপকালে উঠোনে এক বোর্ডার উবু হয়ে বসেছিল। মুখে নিমডাল। মন দিয়ে দাঁতন করছে। নিষাদের ঘর কোথায় জিজ্ঞেস করলে আঙুল তুলে তিনতলা দেখিয়ে দিল। বলাইবাবু হড়বড়িয়ে ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে সেই ঘরে যান, তক্তপোষের উপর চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা মানুষটিকে ধরে নাড়া দিতে থাকেন।
‘তোমার ব্যাপারটা কী! অ্যাঁ? বলি ব্যাপারটা কী? প্রেসের দিকে পা বাড়াচ্ছ না যে বড়? এদিকে একগাদা কাজ জমেছে। কঠিন কাজ সব। আর কাউকে ভরসা করে ছাড়তেও পারছি না। আরে বাপু, বলেছি তো, একটা মাস পরে কাজ পিছু টাকা বাড়িয়ে দেব। ওঠ দেখি...কাজকম্ম কিছু নেই, শুধু পড়ে পড়ে ঘুম...চল আমার সঙ্গে যাবে।’
এবার চিৎ হয়ে মুখের উপর থেকে চাদর সরায় ব্রজ। ঘুমভাঙা লাল চোখে হুংকার দিয়ে বলে, ‘কৌন হ্যায় আপ? কেয়া মাঙতা?’
আঁতকে ওঠেন বলাইবাবু। তক্তপোষের কাছ থেকে সরে ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘এ কী আপনি! আপনি নিষাদ নন?’
ব্রজ এবার খানিকটা উঠে বসে বলেছিল, ‘মুঝে নিষাদ মালুম হোতা হ্যায়? নিকলো, আভি নিকলো।’
বলাইবাবু ধমক খেয়ে মুখ কালো করে একতলায় নেমে আসেন। দেখা হয় ম্যানেজারের সঙ্গে। ঘটনা শুনে কার্তিক দাঁ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘খুব ভুল করেছেন মশাই। ব্রজ মানুষ ভাল, কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙালে ক্ষেপে যায়। সারারাত ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিনা। হাতটাত চালিয়ে দেয়নি এই যথেষ্ট।’
বলাইবাবু রেগে গিয়ে জানতে চান, ‘তাহলে ওই ঘর নিষাদ নামের ছেলেটির নয়? আপনার বোর্ডার আমাকে ভুল দেখাল?’
কার্তিক দাঁ বলেন, ‘না না, ভুল কিছু দেখায়নি, ঘর নিষাদেরই। তবে সেটা রাতের শিফটে। ভাগাভাগির ঘর কিনা।’
বলাইবাবু অবাক হয়ে বলেন, ‘ভাগাভাগির ঘর মানে!’
কার্তিক দাঁ বললেন, ‘বেকার ছেলে। রোজগারপাতি কিছু নেই, একা ঘরের ভাড়া দেবে কোথা থেকে? তাই দিনে রাতে ভাগ করে ঢুকিয়ে দিয়েছি। ব্রজরও সুবিধে হল। তা ছাড়া সেই সময় মেসে সিটও ছিল না।’
বলাইবাবু গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন আছে?’
কার্তিক দাঁ বললেন, ‘দোতলার পিছন থেকে একটা হবে-হবে করছে। লাইন অনেক। চা খাবেন?’
বলাইবাবু এবার যেন ব্রজর ধমকের প্রতিশোধ নিলেন। কঠিন গলায় বললেন, ‘না, চা খাব না। ওসব লাইন টাইন বুঝি না, যে ঘরটা খালি হবে সেটা নিষাদের জন্য রেখে দেবেন। যত ভাড়াই লাগুক সে দেবে। আর তাকে বলে দেবেন, এলেই যেন প্রেসে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে।’
কার্তিক দাঁ বললেন, ‘তা তো বলব, কিন্তু ছেলেটা কেমন যেন, চুপচাপ ভালমানুষ গোছের। এত ভালমানুষ আবার এ যুগের জন্য অচল। ক’দিন হল আরও যেন থম মেরে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করলে বলে, কিছু না। একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলাম। আমার শ্যালকের বিজ়নেস। গেঞ্জি জাঙ্গিয়া বানায়। সেলসের কাজ, ভাল কমিশন। মালে একট আধটু গোলমাল থাকবে, দোকানে ভুজুংভাজুং দিলে ধরতে পারবে না। তো ওই ছেলে বলল, লোক ঠকাতে পারবে না। আরে বাপু তোকে দুনিয়াসুদ্ধ সবাই ঠকিয়ে ফাঁক করে দিচ্ছে, আর তুই ঠকাতে পারবি না?’
বলাইবাবু কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘তা অত ভালমানুষ যখন, আপনি একটা ঘর দিতে পারলেন না? যাক, এখন আমি যা বললাম তাই করবেন।’
নিষাদ আজ প্রেসে এসেছে। সত্যি অনেকগুলো কাজ জমা হয়েছে। তার মধ্যে একটা কাজ খুবই জটিল। কোনও এক ব্যায়ামাগারের শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে পত্রিকা বার হচ্ছে। সেখানে এক ব্যায়ামবীর সব ছেড়ে কৌটিল্যকে নিয়ে খটমট প্রবন্ধ লিখে বসেছেন। চাণক্যের নানা ধরনের নীতিকথা। সংস্কৃত শ্লোক সব। সঙ্গে বাংলায় টীকা।
‘তদ্বিপরিতো বুধঃ। অসৎ মানুষেরা যেকাজে অভ্যস্ত, জ্ঞানী মানুষেরা কখনই সেসব কাজ করবেন না। অসৎ, লোভী মানুষ উপকারীর অপকার করার জন্য সদা ব্যস্ত। জ্ঞানী, সৎ মানুষ কিন্তু চান সকলের মঙ্গল।
নপাপা কর্ম্মণাং সংক্রোশ ভয়ম্। যারা পাপ করে, অসৎ কাজ করে তারা। তাদের নিন্দামন্দর ভয় থাকে না। পাপের শাস্তিকেও ভয় পায় না। একমাত্র রাজশক্তিই তাকে শাস্তি দিতে পারে।’
এই জটিল লেখাপত্র পেয়ে বলাইবাবুর মাথায় হাত পড়েছে। গজগজ করেই চলেছেন।
‘আরে, তুমি ব্যায়ামবিশারদ, তুমি ডন বৈঠক, মুগুর, কুস্তি নিয়ে লেখ, এসব কঠিন সংস্কৃত লেখার কী হয়েছে? এ তো বিরাট জ্বালাতন।’
এদিকে টাকার কাজ ফিরিয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। এর সঙ্গে এক কোম্পানির গাদাখানেক অ্যানুয়াল রিপোর্টের বাংলা করতে দিয়েছে। হিসেবপত্রের কঠিন পরিভাষা। অনুবাদে সমস্যা অনেক। ক্রেডিট-ডেবিট, শেয়ার ক্যাপিটাল, কারেন্ট লায়াবিলিটিস। বাপরে! এসবের তর্জমা কি সহজ কথা? এই কারণেই নিষাদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন বলাইবাবু। আজ নিষাদ প্রেসে আসার পরে কাছে গিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, ‘তোমার মেসে গিয়েছিলাম। ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’
নিষাদ বলল, ‘জানি। সরি, দু’দিন আসতে পারিনি।’
বলাইবাবু নিচু গলায় বললেন, ‘নিষাদ, আমি ঠিক করেছি কাজ পিছু টাকাটা তোমার ডবল করে দেব। তাতে মেসের ঘরের ভাড়া হয়ে যাবে না?’
নিষাদ মাথা নামিয়ে বলে, ‘ধন্যবাদ বলাইবাবু। তবে ঘর আমার লাগবে না। আমি আর কলকাতায় থাকব না।’
প্রেস থেকে বেরিয়ে রয় ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসে পৌঁছতে নিষাদের বিকেল হয়ে গেল। রিসেপশনে বসা তৃষা একমুখ হাসি নিয়ে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়।
‘উফ্ আপনি এসেছেন! না এলে যে কী বিপদে পড়তাম!’
কথা শেষ করেই তৃষা বসের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে যায়। বেরিয়ে আসে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। বলে, ‘আসুন স্যার ডাকছেন।’
নিষাদের পোশাক আজ একেবারেই এলোমেলো। জামা-প্যান্ট কোনওটাই ইস্তিরি করা নেই। চুলও আঁচড়ানো হয়নি। সারাদিন কাজ করার জন্য চোখেমুখেও ক্লান্তির ছাপ। অপূর্ব রায়ের ঘরে ঢোকার মুহূর্তে তৃষা ফিসফিস করে বলল, ‘আমার কথাটা মনে রাখবেন স্যার। আমি কিন্তু খারাপ কথা কিছু বলিনি। স্যার, জিজ্ঞেস করলে বলবেন কিন্তু।’
ঘরে ঢুকে বসতেই অপূর্ব রায় ইন্টারকমে জল আর চায়ের কথা বলে দিল। জল, চা আসার পর কথা শুরু হয়েছে।
অপূর্ব রায় এবার বলল, ‘ঐশানীকে কী বললে?’ প্রশ্নটা করেই নিজেকে সামলে নিল অপূর্ব। বলল, ‘আমি কিন্তু জেরা করছি না নিষাদ। তোমার বলতে ইচ্ছে করলে বলবে। আসলে বকুনি খেয়েছি তো, তাই জানার কৌতূহল হচ্ছে।’
প্রশ্ন পছন্দ নয় নিষাদের। মুখ শক্ত করে বলল, ‘যা ঘটেছে তাই বলেছি। কাজটা দেবেন বলে ডেকেছিলেন। এমনকী সেদিন অফিসে জয়েন করতেও বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা করেননি। ঐশানীদির জন্যই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ। ওকে তো জানাতেই হবে।’
অপূর্ব রায় বলল, ‘যাক বাবা, বাঁচা গেল। খারাপ ব্যবহারের কোনও অভিযোগ নেই তাহলে। আমার রিসেপশনে যে মেয়েটি বসে, তৃষা, সে কোনও হার্শ কথা বলেছে নাকি? তাকে তো ডেকে বকুনি দিয়েছি।’
নিষাদ বলল, ‘না। এসব কোনও কথা তো আমি ঐশানীদিকে বলিনি।’
‘ওকে বলনি, তবে আমাকে কমপ্লেন করতে পার।’
নিষাদ বলল, ‘এরকম কিছু ঘটেনি। আপনি কি আমাকে এই কারণে ডেকেছেন?’
নিষাদের গলা আজ অন্যরকম। আগেরদিনের মতো আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গি নেই। বরং হালকা তেজ রয়েছে। অপূর্ব রায় খেয়াল করল। চেয়ারে হেলান দিয়ে সে নরম গলায় বলল, ‘না, শুধু এর জন্য ডাকিনি নিষাদ, আরও দুটো কারণ রয়েছে।’
নিষাদ বলল, ‘বলুন।’
অপূর্ব রায় ইন্টারকম তুলল।
‘তৃষা, কোনওরকম ফোন আমাকে দেবে না। কেউ এলে বসতে বলবে।’
ইন্টারকম নামিয়ে এবার নিষাদের চোখের দিকে সরাসরি তাকাল অপূর্ব। বলল, ‘সেদিন তোমাকে ডেকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু কাজটা যে আমি করব সেটা আগে থেকেই আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল। যেদিন ঐশানী তোমার জন্য আমাকে ফোন করে সেদিনই আমি বুঝতে পারি, সে তোমাকে কতটা পছন্দ করে। আমাদের ব্রেকআপের পর তিনটে বছর সে আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি। টেলিফোন নম্বর পর্যন্ত বদলে ফেলে। কলকাতায় চাকরির বদলি নেয়। নতুন ফ্ল্যাটও কেনে, যার ঠিকানা আমার জানা নেই। আমাদের সম্পর্কটা বিয়ের মুখে নিয়ে গিয়ে ভেঙে দেয় ঐশানী। দু’দিন পর আমাদের রেজিস্ট্রির তারিখ ছিল। ঐশানী হঠাৎই একটা মেসেজ পাঠায়, এই বিয়ে হবে না। মনে হয় আমার সম্পর্কে কোনও গসিপ শুনেছিল।’
চমকে ওঠে নিষাদ। কার গল্প বলছে লোকটা!
অপূর্ব রায় বলতে থাকে, ‘সেই ঐশানী যখন ফোন করে আমার কাছে একজনের জন্য হেল্প চায়, আমি বুঝি, ছেলেটি তার পছন্দের। অন্য কেউ হাজার রিকোয়েস্ট করলেও ঐশানী এই কাজ করত না। তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, শুধু পছন্দ নয়, ঐশানী নিষাদ নামের যুবকটিকে ভালবাসে। একটু আধটু ভালবাসা নয়, জবরদস্ত ভালবাসা। ঠিক কিনা?’
নিষাদ চুপ করে রইল। কী বলবে সে? এই ভালবাসার কথা সেদিন ঐশানীদিও বলেছে।
অপূর্ব রায় মিটিমিটি হেসে বলল, ‘কী নিষাদবাবু, চুপ করে কেন? বল, কথাটা কি মিথ্যে বলছি?’
নিষাদ এবার নিচু গলায় বলল, ‘আপনি এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?’
অপূর্ব এই প্রশ্ন গ্রাহ্য না করে বলল, ‘থাক, আমি কিছু জানার জন্য জোর করছি না। আমি শুধু জানাতে চাই। তোমাকে ঐশানী কতটা ভালবাসে জানার জন্য আমি একটা ছোট কাজ করলাম। রাগ কোরো না নিষাদ, এ ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় ছিল না। তোমাকে আমি চাকরি দেওয়ার জন্য ডেকেও চাকরিটা দিলাম না। দেখাই করলাম না। জানতাম, তুমি ঐশানীকে এই ঘটনা জানাবে। আমি তার রিঅ্যাকশনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেই রিঅ্যাকশন আমি পেয়ে গিয়েছি। সে আমাকে আবার ফোন করে। যে ফোনের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম।’
নিষাদ শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা সরিয়ে রাখল। লোকটা কি সত্যি বলছে? ঐশানীদি ওকে কী বলেছে? শুধুই বকাবকি করেছে? নাকি আবার ডাকতে বলেছে? অপূর্ব রায় নিষাদকে এই বিষয়ে কিছু না বললেও এই দুটোর কোনওটাই ঠিক নয়। ঐশানী সেদিন ফোন করে খুব ঠান্ডাভাবে কথা বলেছিল।
‘ছেলেটার সঙ্গে এমন ব্যবহার করলে কেন?’
অপূর্ব রায় বলল, ‘কোন ছেলেটা?’
ঐশানী বলে, ‘বাজে কথা বলছ কেন? তুমি জান আমি কার কথা বলছি। নিষাদকে ডেকে পাঠিয়ে অপমান করলে কেন? যদি কাজ না দাও, সোজা বলে দিলে অসুবিধে কী ছিল? আমি কি তোমাকে জোর করতে যেতাম? আমাদের অতীতের সম্পর্ক সরিয়ে রেখেই তো আমি এই রিকোয়েস্ট করেছিলাম। একজনকে কেন, দশজনকে চাকরি দেওয়ার মতো ক্ষমতা তোমার হয়েছে বলেই তোমাকে আমি ফোন করি। সেদিনও তো তুমি বললে, পাঠিয়ে দাও, আমি একটা ব্যবস্থা করে দেব। বলনি?’
ঐশানী থামলে অপূর্ব সামান্য হেসে বলে, ‘একটা কেন, দশটা চাকরি দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার এখন হয়েছে— আমার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও তুমি যে এই খবরটা রাখ জেনে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি ঐশানী।’
ঐশানী বলল, ‘আমাদের পুরনো অফিসের অনেকেই জানে।’
অপূর্ব রায় গদগদ গলায় বলল, ‘ইট’স মাই প্লেজ়ার।’
ঐশানী বলল, ‘বাজে কথা ছাড়। নিষাদের সঙ্গে তোমার এই আচরণ আসলে আমাকে অপমান করা, এটা তুমি নিশ্চয়ই ভাল করেই জান। জেনেবুঝেই করেছ। তাই তো?’
অপূর্ব কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলায়। বলল, ‘আমাদের পরস্পরকে অপমান করার পালা শেষ ঐশানী। এরকম একটা সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে কেন আবার সেসব তিক্ত দিন ফিরিয়ে আনব! সেদিন আমি হঠাৎই আর্জেন্ট মিটিংয়ে আটকে গিয়েছিলাম। চেন্নাইতে আমরা ক্লিয়ারিংসের একটা নতুন ডিভিশন খুলতে চলেছি। আমি সেদিন ছেলেটিকে বলে পাঠিয়েছিলাম, দু’-একদিনের মধ্যে তাকে আমি ডেকে নিচ্ছি। মোস্ট প্রবাবলি আমাদের রিসেপশনিস্ট মেয়েটি তাকে ঠিকমতো কমিউনিকেট করতে পারেনি।’
ঐশানী নিচু অথচ কড়া গলায় বলল, ‘অপূর্ব, নিজেকে চিনিও না। এটা তোমার প্রতিশোধ। খুব নিম্নমানের প্রতিশোধ। আমার বোঝা উচিত ছিল, তুমি বদলাওনি।’
অপূর্ব রায় একটু থমকে থেকে শান্ত গলায় বলে, ‘তুমি যতই চেষ্টা কর ঐশানী, আর আমি উত্তেজিত হব না। এতদিন পরে যে তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, সেটাই আমার কাছে বিরাট পাওনা। আমরা কি এটা মেনটেন করতে পারি না?’
ঐশানী বলে, ‘এতদিন পর কেন এসব কথা তুলছ? একটা নিডি ছেলের চাকরি করে দিতে রিকোয়েস্ট করেছি বলে? ইজ়ন’ট ইট টু কস্টলি?’
অপূর্ব চাপা গলায় বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই ঐশি। আই ওয়ান্ট টু মিট ইউ। মুখোমুখি কথা বলব। আমি তোমাকে অফিসে ডাকছি না। বাড়িতে তো নয়ই, আজও আমি ব্যাচেলর। হিমি নামের যে মেয়েটির জন্য তুমি আমাকে সন্দেহ করে চলে যাও, তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। সে এক বছর লিভ-ইন করে ইতালিতে চলে গিয়েছে। তুমি যেমন আমার খবর রাখ, আমিও তোমার খবর রাখি ঐশি। আমি জানি, এখনও তুমি বিয়ে করেনি। তাহলে কীসের অসুবিধে?’
ঐশানী ফোন কেটে দেয়। এরপরেই নিষাদকে খবর দিয়ে ডেকে এনেছে অপূর্ব রায়। জলের গ্লাসে আলতো চুমুক দিয়ে কেটে কেটে বলল, ‘এবার সরাসরি কাজের কথায় আসি। চাকরি তুমি পাবে নিষাদ। যেমন বলেছি তেমনভাবেই পাবে। ক’দিন পর তোমাকে প্রোমোশন দিয়ে আমি চেন্নাইতে পাঠাব। তুমি সেদিন বলেছিলে, তোমার বোনের কাজ চলে গিয়েছে। স্কুলে পড়াত। বলেছিলে না?’
নিষাদ হতভম্ব হয়ে ঘাড় নাড়ে। লোকটা কী বলতে চাইছে?
‘শুধু তোমার চাকরি নয় নিষাদ, আমি তোমার বোনকেও কাজ দেব। সে এখানে কাজ করবে। তোমরা তো দু’জনেই লেখাপড়া করেছ, কাজ শিখে নিতে বেশি সময় লাগবে না। আমার প্রস্তাব কি তোমার পছন্দ হয়েছে?’
কথা থামিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে অল্প হাসে অপূর্ব রায়।
‘চুপ করে আছ কেন? কিছু বল। এখানেই শেষ হয়নি, নিষাদবাবু। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাতে চাইলে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এস। তোমাদের দু’ভাইবোনকে অফিস থেকে ফ্যামিলি মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে লোন দেব। তোমরা ইনস্টলমেন্টে সেই লোন শোধ দেবে। পারবে না?’
নিষাদের মনে হচ্ছে শরীর কাঁপছে। লোকটা এসব কী বলছে? সত্যি এত কিছু করবে? নাকি নতুন কোনও অপমানের পরিকল্পনা?
আজ অনেকক্ষণ বাদে স্যার সম্বোধন করল নিষাদ। অস্ফুটে বলল, ‘স্যার, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
অপূর্ব রায় হাত তুলে শান্তভাবে বলল, ‘তোমাকে কিছু বুঝতে হবে না নিষাদ। তোমার কাজটা তো আমি আগে থেকেই ডিসাইড করে রেখেছিলাম। মাঝখানে একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে মাত্র। যাক, সেই চ্যাপ্টার আমি ক্লোজ় করে দিতে চাই। তোমার বোনের কাজের প্রস্তাবটা নতুন। বলতে পারো রয় ডিস্ট্রিবিউটরের পক্ষ থেকে কমপেনসেশন। তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দিয়ে যে হ্যারাসমেন্ট করা হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ। তোমার ঐশানীদি যেন বোঝে, আমি ভেবেচিন্তে কিছু করিনি। ওর ভালবাসার মানুষটির ভালই চেয়েছি আমি। তা ছাড়া তোমার বোন স্কুল টিচার ছিল, নিশ্চয়ই তাকে এখানে যুক্ত করাটা আমাদের পক্ষে ভালই হবে। অবশ্য সে যদি রাজি হয়। আর তোমার মায়ের চিকিৎসার টাকা দেওয়াটা তো কোম্পানির নর্মাল নিয়ম। আমরা তো তোমাদের এমনি টাকা দিচ্ছি না, লোন হিসেবে দিচ্ছি।’
নিষাদ বলল, ‘আমি এখনও বিষয়টা ভাবতে পারছি না স্যার।’
অপূর্ব রায় হেসে বলল, ‘তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। বোনের সঙ্গে কথা বল। কী নাম তার?’
‘সিন্ধুরা। সিন্ধুরা সেনগুপ্ত।’
অপূর্ব রায় ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী বললে! কী সিন্ধু?’
নিষাদ বলল, ‘সিন্ধুরা। এটা একটা রাগের নাম স্যার।’
অপূর্ব রায় চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, ‘চমৎকার। নিষাদ, সিন্ধুরা...তোমাদের ভাইবোনের নামদুটো চমৎকার আর আনকমন। কে দিয়েছেন? বাবা? তিনি তো রাজনীতি করতেন। সুরুলপুরে এখনও তাঁকে অনেকে চেনে। মিটিং মিছিল, বন্ধ করতেন। বাট হি ওয়জ় অ্যান অনেস্ট পার্সন। সবাই এককথায় বলে।’
এবার নিষাদের অবাক হওয়ার পালা। বলল, ‘আপনি খোঁজ নিয়েছেন?’
অপূর্ব রায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ওই আর কী...ঐশানী ঠিক লোককে আমার কাছে পাঠিয়েছে আমি জানি, তারপরেও একটু রিকনফার্ম করে নিলাম। করতে গিয়ে দেখলাম, শুধু সে যাকে পাঠিয়েছে সে ভাল নয়, তার পরিবারটিও ভাল। সেই জন্য তোমার বোনকেও নিতে চাইছি। শুনেছি, সে একটু একটু করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতির মধ্যে আজকাল না থাকাই ভাল।’
নিষাদ বুঝতে পারছে, তার সামনে বসা মানুষটা তাকে ধীরে ধীরে জড়িয়ে ফেলছে। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি ভাল নই, আমার বাবা একজন ভালমানুষ ছিলেন।’
‘অবশ্যই ভালমানুষ ছিলেন। সেই জন্য পলিটিক্স করেও গাদাখানেক ঋণের বোঝা রেখে মারা গিয়েছেন। তিনি যে সময়ে এবং যাদের হয়ে রাজনীতি করেছেন, তাদের অনেকেই তিনতলা বাড়ি করে ফেলেছে, গাড়ি করে ফেলেছে। সন্তানদের জন্য ব্যাঙ্কে অনেক টাকা রেখে গিয়েছে। আমার খবর বলছে, তোমার বাবা এসব কিছুই করেননি।’
নিষাদ বলল, ‘আমার বাবা কখনও কারও কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেননি।’
অপূর্ব রায় বলল, ‘ক্ষমতাবানদের সঙ্গে রাজনীতি করলে টাকা চাইতে হয় না, বাড়ি বয়ে ইট বালি সিমেন্ট ফ্রিতে দিয়ে যায়। শাশ্বত সেনগুপ্ত নেননি বলেই তার সুরুলপুরের বাড়িটা আজও ইনকমপ্লিট। ইট বেরিয়ে রয়েছে।’
নিষাদ বলল, ‘আপনি এতসব জেনেছেন!’
অপূর্ব রায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘কেন? ভুল জেনেছি? আরে, আমার একসময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু কেন একজনকে এত বেশি পছন্দ করে, ভালবাসে জানতে হবে না? যাক, এ তো গেল তোমাকে আজ ডাকার প্রথম কারণ। এবার দ্বিতীয়টা বলি?’
নিষাদ বলল, ‘বলুন।’
অপূর্ব একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘কোনওরকম ভণিতা না করে সরাসরি বলি। আমার এবং তোমার ঐশানীদির সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পিছনের কারণ স্পষ্ট নয়। হয়তো কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল। আমি চাই এই ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাক। যা ঘটেছে বা যা ঘটেনি সবটাই আবার মুছে ফেলে চার বছর আগের সম্পর্কে ফিরে যাই।’
নিষাদ অস্বস্তির মধ্যে থেকে বলল, ‘আপনাদের এই ব্যক্তিগত কথা আমাকে বলছেন কেন?’
অপূর্ব নিষাদের চোখের দিকে তাকিয়ে একটু কঠিন গলায় বলল, ‘কারণ তুমি এই ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে রয়েছ। তুমি ব্যক্তিগতভাবে ঐশানীর কাছের লোক। তুমিই একমাত্র পারবে ওকে বোঝাতে, ওর সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিতে। যদি তাতেও ও রাজি না হয়, একদিন আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাবে। আগে থেকে কিছু বলার দরকার নেই। ও শুধু জানবে, নিষাদ এসেছে। বাকিটা আমি বুঝে নেব। আমার বিশ্বাস, আমি পারব।’
কথাটা বলে অপূর্ব রায় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। নিষাদের ডানহাতটা ছিল টেবিলের উপর। সেটা ধরে নরম গলায় বলল, ‘আমাকে এইটুকু করে দাও নিষাদ। আমাকে ঐশানীর কাছে পৌঁছে দাও।’
নিষাদের মনে হল সে একটা জালের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে।
‘আপনি ভুল বুঝছেন স্যার। ঐশানীদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক এরকম নয়।’
অপূর্ব রায় জোর গলায় বলল, ‘আমি ঠিক বুঝেছি। তুমিই পারবে। ঐশানীকে বল, অতীতে যদি কিছু ভুল করে থাকি, আমি তার জন্য...তার জন্য সর্বক্ষণ রিগ্রেট করছি। যদি কিছু না বলতে পার, তাতেও কোনও সমস্যা নেই, একবার আমাকে মিট করিয়ে দাও। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের সম্পর্কের মধ্যে আমি কখনও নাক গলাব না। তুমি দু’দিন সময় নাও। আমি তোমার টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করে থাকব। তোমার জয়েনিং লেটার তৈরি করা থাকবে।’
নিষাদ চুপ করে রইল। কী আশ্চর্য এই দুনিয়া! একটা সামান্য কাজের জন্য এক সময়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে, কেউ ফিরেও তাকায়নি। আজও তাকায় না। আর এই মুহূর্তে এত বড় একটা অফিসের বস তার হাত চেপে ধরেছে! শুধু তাকে চাকরি নয়, তার গোটা পরিবারেরই দায়িত্ব নিতে চায়। প্রতিদানে খুব বেশি কিছু যে চাইছে, তা তো নয়। একবার দেখা করিয়ে দেওয়া। ঐশানী যদি তার সঙ্গে অপূর্ব রায়ের দেখা করিয়ে দিতে পারে, তারই বা অপূর্ব রায়কে ঐশানীদির সামনে নিয়ে যাওয়া অন্যায় হবে কেন?
নিষাদ ঘর থেকে বেরোতেই তৃষা মেয়েটি নিজের চেয়ার থেকে ঝপাং করে উঠে দাঁড়াল। যেন নিষাদ তার বস। নিচু গলায় বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।’
নিষাদ অবাক হয়। মানুষ কত বদলে যেতে পারে! মেঘপর্ণা, অপূর্ব রায়, এমনকী তৃষা নামের এই প্রায় অচেনা মেয়েটি কেমন সহজে বদলে গেল! সে কি কখনও বদলাতে পারবে? কে জানে, হয়তো পারবে। না পারলে যে দুনিয়ায় টিকতেই পারবে না।
অফিসের বাইরে এসে সন্ধে নামা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নিষাদের মনে হয়, সে একা। খুব একা।