নিষাদ – ৭

‘কোথায় সখি লম্পট নাগর।।

দিবা নিশি কামশরে আমার দহিচে অন্তর গো।

‌যমুনার জল আনতে গেলে,

দেখা পেতাম কদম তলে,

প্রেম করিত কতই ছলে, সেই মনচোর।।’

গাইছে গঙ্গামণি। মেঝেতে মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসেছে। হাতে ছোট ঘুঙুর। সেটা দিয়ে নিজের হাঁটুতে ঠুকে তাল রাখছে।

গঙ্গামণির গলায় এক ধরনের মাদকতা র‌য়েছে। ধরা গলা। ইংরেজিতে একেই বোধহয় হাস্কি ‌ভয়েস বলে।‌ তালজ্ঞানও ভাল। তবে সবচেয়ে বড় কথা, তার গান বাছাই। এই পেশায় বেশি চলে চলতি হিন্দি সিনেমার গান। বয়স্ক খদ্দেররা পুরনো দিনের বাংলা শুনতে যায়। শরীরে হয় না বলে, মনে মনে ফুরিয়ে যাওয়া যৌবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। গঙ্গামণির মজা হল, তাকে গাইতে বললে সে অন্য ধরনের গান শোনাতে চায়। খদ্দের রাজি হলে ভাটিয়ালি, বাউল, ঝুমুর গায়। কোথা থেকে যে শিখেছে!‌ মেয়েমানুষের শরীরের টানে আসা পুরুষ বেশিরভাগ সময় এসব গানের অর্থ বোঝে না। তবে তালে মজে যায়। তার উপর গঙ্গামণির গলার আকর্ষণ তো রয়েছেই।

পলাশ গঙ্গার মতোই মেঝেতে বসেছে। খাটের গায়ে হেলান। চোখ আধবোজা। ডানহাতের আঙুল দিয়ে মেঝেতে টোকা দিচ্ছে। অন্য হাতে সিগারেট। সে এই ঘরে ঢুকেছে আধঘণ্টা হতে চলল। ঢুকেই বলেছে, আজ তার মন ভাল নেই। অতএব গানবাজনা চাই।

গঙ্গামণি আসল নাম নয়। এখানে এলে বেশিরভাগ মেয়ে নাম পালটায়। নিজের আসল পরিচয় গোপন করে, কেউ কেউ ভুলে যেতে চায় হয়তো। আবার খদ্দেরবিশেষে নাম বদলে বদলে যায়। কখনও সখনও ‘বাঁধা-বাবু’ শখ করে পছন্দমতো নাম রাখে। টাকার বিনিময়ে পাওয়া মেয়েমানুষের শরীরে শুধু নয়, তার পরিচয়েও হাত রাখার ইচ্ছে। মুখে বলে ‘সোহাগ’, আসলে নিজের ‘সম্পত্তি’ বানানোর চেষ্টা।

সময়‌ পালটাচ্ছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতিতে, অর্থনীতির নতুন নতুন মডেলে, পারস্পরিক সম্পর্কের সংকটে প্রতিদিন আধুনিক হচ্ছে পৃথিবী। উলটে পালটে যাচ্ছে পাপ-পুণ্যের সংজ্ঞা। মহাকাশে উড়ছে নিত্যনতুন স্যাটেলাইট, সমুদ্রের অতলে পাঠানো হচ্ছে জটিল শব্দতরঙ্গ। তথ্যের পর তথ্য উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে। পৃথিবীর রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। যখন মনে হচ্ছে, সব জানা হয়ে গিয়েছে, আর বুঝি জানার কিছু বাকি নেই, তখনই আবার নতুন করে তথ্য আবিষ্কৃত হচ্ছে। মানুষ প্রতিদিন আগের দিনের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। সে যেমন ভালবাসাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে শিখছে, শিখছে ভার্চুয়াল, মায়ার জগতে দুনিয়াকে বেঁধে ফেলতে, শিখছে যুদ্ধের ভয়ংকর সব কৌশল। তবে এত কিছুর পরেও নিজের আদিম প্রবৃত্তি থেকে বেরোতে পারে না মানুষ। রক্তের ভিতর, জিনের ভিতর সে ঘাপটি মেরে বসে আছে হাজার হাজার বছর ধরে।‌ যুদ্ধক্ষেত্রে, বেশ্যাপল্লিতে বোধহয় সেই প্রবৃত্তির সন্ধান মেলে। নামবদল তারই একটা অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

গঙ্গামণি খাবারদাবার, মদের বোতল আনাবে কিনা জানতে চেয়েছিল। পলাশ না বলে দিয়েছে। গাঁজাতেই সে খুশি। খরচ কম, নেশাও বেশি। গঙ্গামণি অবশ্য একটু আগে বলেছে, ‘বেশি ধোঁয়া খেওনি বাপু। জোর কমে যাবে।’ খিলখিল আওয়াজে হেসেওছে।‌

পলাশ ভুরু কুঁচকে বলে, ‘কীসের জোর‌?’

গঙ্গামণি উপরের ঠোঁট চেটে বলল, ‘কীসের জোর‌ বোঝ না? পুরুষমানুষের জোর।’

পলাশ হাত উলটে বলেছিল, ‘হুঁঃ, আমি আবার শালা পুরুষ নাকি? লেখাপড়া শিখেও দু’পয়সা রোজগারের মুরোদ নেই.‌.‌.‌মুখ থুবড়ে পড়ে যাই.‌.‌.‌পুরুষ হল আমার বাবা.‌.. এডুকেশন‌ ম্যাক্সিমাম ক্লাস ফোর.‌.‌. ‌অথচ টাকার উপর বসে আছে.‌.‌.‌ ‌একদিকে চাষবাস.‌.‌. শুনছি একটা কোল্ড স্টোরেজও নিয়েছে.‌.‌.‌ ‌সব একা হাতে সামলাচ্ছে। দুপুরে দু’থালা ভাত খায়। রাতে এক ডজন রুটি।’

‌গঙ্গামণি চোখ নাচিয়ে বলে, ‘সে যতই হোঁচট খেয়ে পড় বাপু, আজ টাকা নিয়ে ঢুকেছ তো? টাকা ছাড়া কিন্তু আমার কাছে অ্যালাও নেই। নো ধার-বাকিতে বিজিনেস। গানের জন্য আবার এক্সট্রা লাগে খেয়াল আছে তো? আমার তো আর যে সে গান নয়।’

পলাশ বলল, ‘কোনদিন তোমার কাছে টাকা ছাড়া এসেছি গঙ্গা? বিনিপয়সায় গান শুনেছি কবে? পকেট ফাঁকা থাকলে তো এদিকে পা-ই বাড়াই না। বাড়ালেই বা লাভ কী হত? পাছায় লাথ মেরে দূর করে দিতে। দিতে কিনা?’

গঙ্গামণি আশ্বস্ত হয়ে বলে, ‘তা তো দেবই। তবে কিনা সবাইকে কি আর সমান জোরে মারব? লোক বুঝে ঠিক হবে।‌ তবে যাই বল পলাশদা, তোমার সঙ্গে কিন্তু কনেসেশনে কাজ করি।‌ যাও আজ গান ফিরি।’

পলাশ ‌বলে, ‘বয়ে গিয়েছে তোমার ফ্রি নিতে। আজ পকেটে মালকড়ি আছে। একজনের কাছে তিন হাজার টাকা পাওনা ছিল, আড়াই দিয়েছে। আর দেবে না জানি। সব আজ তোমার এখানে ঢেলে যাব গঙ্গা।’

গঙ্গামণি চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘নেশা করে বলছ?’

পলাশ হেসে বলল, ‘আমার প্রেমে পড়ছ নাকি গঙ্গা?’

গ‌ঙ্গামণি আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘সমস্যা নেই, ফাইভ পার্সেন্ট এক্সট্রা দিলে পড়ব। ঘণ্টাখানেকের তো মামলা।’

পলাশ বলল, ‘থাক, এরপর বলবে প্রেমের জন্য জিএসটি চাই। দরকার নেই আমার প্রেমে। তবে তোমাকে আমার মনে ধরেছে। ধরেছে বলেই এখানে এসে তোমার ঘরে ঢুকি।’

গ‌ঙ্গামণি একগাল হেসে বলে, ‘আমার সৌভাগ্য। এত বড় একজন রাজপুত্তুরের আমায় মনে ধরেছে, এটা চাট্টিখানি কথা নয়।’

পলাশ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘ঠাট্টা কোরো না, আমাকে কনসেশন দেওয়ার কারণ কী?’

গ‌ঙ্গামণি ক’দিন পর ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশে পা দেবে। এই পেশায় ছাব্বিশ কম বয়স নয়, শরীরে ভাটা নামে, ব্যবসায় টান পড়ে। গঙ্গামণির পড়েনি। তার আঁটোসাঁটো চেহারা। গায়ের রং রোদে পোড়া বাদামি। লম্বায় আর পাঁচজন বাঙালির মেয়ের তুলনায় বেশি। চোখদুটো বড়, চওড়া কপাল। সব মিলিয়ে একধরনের রুক্ষ, ধারালো ভাব। পাউডার মেখে এই ভাব সে নষ্ট করে না। দৃষ্টিতে পুরুষমানুষের প্রতি যেমন তাচ্ছিল্য রাখে, তেমন তেজও রাখতে জানে। টেনে চুল বেঁধে, চোখে কাজল দিয়ে বসলে সেই তেজ যেন বেড়ে যায়। তাচ্ছিল্য আর তেজের মধ্যেও যে আকর্ষণ রয়েছে, সেকথা গঙ্গামণি জানে। এই পেশায় আসার পর সে জেনেছে, ব্যাটাছেলে বড় অদ্ভুত চিজ়। কখন সে কীসে মচকাবে, বলা যায় না। আর পাঁচটা মেয়ে যখন রংঢঙে মন দেয়, গঙ্গামণি তার তেজকে আরও শান দেয়। তাকে কাজে লাগায়। এমনভাবে পোশাক পরে যাতে চেহারায় নরমসরম নয়, কঠিন ভাব বেশি ফোটে। আচরণেও কখনও সখনও কড়া হয়। শরীরের খেলাতেও সে আলাদা। পুরুষকে প্রথমটায় দখল নিতে দেয়, তারপর নিয়ন্ত্রণ নেয় নিজে। কতক্ষণ খেলতে দেবে, কখন খেলা ফুরোবে সেই কায়দা সে রপ্ত করেছে। যে পুরুষ নিজেকে ছেড়ে, আত্মসমর্পণে খুশি হতে চায়, তারা একবার গঙ্গামণির ঘরে এলে চট করে অন্য কোথাও যেতে চায় না। তাই বয়স বাড়লেও কদর কমেনি। এখানে মেয়েদের কমবেশি সকলকেই গান জানতে হয়। বিছানায় যাওয়ার আগে অনেক সময় কাস্টমার গান শুনতে চায়। নেশা করতে করতে গান শুনবে। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি, গালমন্দ করে।

‘বাড়িতে বউ গাইলে ধরে ঝ্যাঁটা মারে, আমাদের কাছে এসে গানবাজনা উথলে পড়ে। আহা কত দরদ রে!‌’

‘যেন জমিদারের ব্যাটা এয়েছেন গো, খেমটা নাচের আসর বসিয়েছেন।’

‘আহা অমন করে বলিসনি। পুরুষমানুষের এই জমিদারি অভ্যেসের জন্য আমরা দুটো ‌পয়সা কামাতে পারি। দেখিস না, বিড়ালছানার মতো কেমন নেটিপেটি করে।’

‘তা কেন? শয়তানও আছে।’

বেশিরভাগ মেয়েরই গান গাইলে কখনও সখনও আলাদা করে পয়সা জোটে। তবে সবাই পায় না। গঙ্গামণি জানে তার গানে পুরুষমানুষের শরীরে ঝিম লাগে। সে পয়সা ছাড়া গায় না। আগেই চেয়ে নেয়। আজও পলাশকে দিতে হত। গঙ্গামণি ছাড় দিতে চায়।

পলাশ আবার বলল, ‘কনসেশন কীসের বললে না তো?’

গঙ্গামণি গানের জন্য তৈরি হয়ে বলল, ‘বেকার মানুষ বলে কথা। কত খরচা করবে?’

পলাশ নতুন করে সিগারেট ধরাল। এটাতেও তামাকের বদলে গাঁজাভরা। বলল, ‘তোমার ঘরে তো বেকার কম আসে না গঙ্গা। সবাইকে কি তুমি কনসেশন দাও?’

‘তা কেন? অল্প কদিনেই বুঝেছি, মানুষটা তুমি মন্দ নও। গুন্ডা-বদমাইশদের মতো জ্বালাতন করো না। খামচাখামচির বায়না নেই। বউ পালাল, প্রেমিকা পালাল বলে নাকে কাঁদতেও শুনিনি। পছন্দের কারণ কি কম? তো সেই পছন্দের নাগরকে একটু প্রশ্রয় তো দিতেই হয়,’ কথা শেষ করে হাসে গঙ্গা। বলে, ‘নাও, গান শোনো।’

‘কী শোনাবে?’

পলাশ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার যা খুশি।’

গঙ্গামণি বলে, ‘এটাও তোমার গুণ। নিজের মতো গাইতে দাও।’

পলাশ ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, ‘আমার এত গুণ, শুধু তুমিই বুঝতে পারলে গঙ্গা। যারা একটা-দুটো বুঝলেও আমার লাভ হত, তারা বুঝল না।’

গঙ্গামণি গান শুরু করল।

‘যমুনার জল আনতে গেলে,

দেখা পেতাম কদম তলে.‌.‌.‌’

গঙ্গামণির গলায় আজ যেন দরদ বেশি। বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল পলাশের। কারও সঙ্গে কি তার দেখা হওয়ার ছিল? কলেজে পড়ার সময় কত মেয়ের সঙ্গেই তো আলাপ হয়েছে। গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা সবই হয়েছে, কিন্তু প্রেম হয়নি। কাউকে দেখে মনেও হয়নি, ‘এ আমার নিজের মানুষ।’ শুধু এই ঘরে এলে সামান্য হলেও মনখারাপ হয়ে যায়। কে জানে গঙ্গামণি হয়তো প্রেম না হওয়ার বেদনাকে কোনওভাবে জাগিয়ে দেয়। কী ভাবে জাগায়? ভালবাসার ভানে? কে জানে। খুব একটা বড় কিছু করবে বলে কলকাতায় আসেনি পলাশ। বিরাট কোনও স্বপ্নও ছিল না। শুধু এইটুকু ভেবেছিল, পরিবারের মাঠঘাট-চাষবাসের জীবনযাপনে সে ঢুকবে না। কলকাতায় পড়া শেষ করে একটা ছিমছাম চাকরি পাবে। হল না। সাধারণ রেজ়াল্ট নিয়ে কলেজ শেষ হলে বাবা কলকাতায় থাকতে বারণ করেছিল।

‘ওখানে ভিড় খুব। তার মধ্যে থেকে নিজেকে আলাদা করা কঠিন। অনেক বুদ্ধি, অনেক শিক্ষা লাগে। দুটোর একটাও তোর নেই। আর নিজেকে যদি ভিড় থেকে আলাদা করতে না পারিস, কোথায় যে ছিটকে পড়বি, নিজেই বুঝতে পারবি না। যখন বুঝবি তখন আর ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা থাকবে না।’

‘বাবা, এত ছেলেমেয়ে তো কিছু না কিছু করছে, তাদের সবার কি খুব বুদ্ধি? দারুণ রেজ়াল্ট?’

‘তারা এক ধরনের শহুরে ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে। সাধারণ বা খারাপ রেজ়াল্টকে পুষিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। আমারও যেমন রয়েছে। একটা ফলনে মন্দা হল, আর একটা দিয়ে সামলাতে চেষ্টা করি। তুই যদি হাতেকলমে করার মতো কাজ শিখতিস, একটা কথা ছিল। তাও তো করিসনি। ফিরে আয়, সময় থাকতে থাকতে ফিরে আয়।’

পলাশ আবেগ সামলাতে সিগারেটে লম্বা টান দিল। মনে মনে নিজেকে বলল, ‘তুমি তো শালা ছিঁচকাঁদুনে ছেলে নও। বাপের জমিদারি ছেড়ে এসে এখানে ফুর্তিও তো কম করলে না। শহরের সবই দেখা হয়েছে। কলেজের ঝলমলে ছেলেমেয়ে থেকে শখের রাজনীতি, নেশাভাঙ থেকে বেশ্যাপাড়া— সবই চেখে দেখা হল, এখন কিছু হল না বলে নাকে কেঁদে লাভ কী বাছা?’

গঙ্গামণি গান শেষ করে বলল, ‘কী গো পলাশদা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

পলাশ চোখ খুলে বলল, ‘গঙ্গা, একটা কাজ করে দেবে?’

গঙ্গামণি বলল, ‘পারব কিনা জানি না, আগে শুনি।’

পলাশ সোজা হয়ে বসল।

‘তোমাদের কাছে তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষজনের আসা-যাওয়া আছে। তাই না?’

গঙ্গামণি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এ আবার কেমন কথা? এখানে কে আসে তোমায় বলব কেন!‌ ও তো আমাদের বিজনেস সিরিকেট। চোর ডাকতের নামও বলব না, মান্যিগণ্যিদের নামও বলব না।’

পলাশ বলল, ‘আরে বাবা, তোমার কাছে নাম জানতে কে চায়। শুধু বল আসে কিনা?’

গঙ্গামণির যেন পুরো সন্দেহ গেল না। বলল, ‘কেমন লোকের কথা বলছ?’

পলাশ বলল, ‘কেমন আবার? যাদের সমাজে ইনফ্লুয়েনশিয়াল বলে। ক্ষমতা রয়েছে। এই ধরো যেমন নেতা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, অফিসার।’

গঙ্গামণি এবার সহজ হয়ে বলল, ‘ও তাই বল। আমি ভাবলাম, পুলিশের মতো কারও খোঁজ করছ বুঝি।’ তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আজকাল অমন বড় লোকেরা আর এপাড়ায় আসে কই? সেসব ছিল সোনার দিন। ডাকাত আর দারোগা এক আসরে বসে খেমটা নাচ দেখত, গান শুনত। তারপর যে যার মেয়েমানুষ নিয়ে ঘরে ঢুকে দোর দিত। আমি অবশ্য নিজের চোখে দেখিনি। অন্যের মুখে শুনেছি। সেদিন আর নেই। এখন বড় মানুষরা এপাড়ায় আসে না। সবার পেরাইভেট ব্যবস্থা রয়েছে। ফেলাট, গেস্টহাউস, রিসটে যায়। সেসব মেয়েরাও আমাদের মতো নয়, অন্যরকম। কী বলে যেন? হাইফাই। সোসাইটি লেডি। তবে কী জানো, বেশ্যাপল্লি চিরকালই সবার উপর। তার একটা পেরেস্টিজ আছে। তুমি দামী লোকের খবর নিচ্ছ কেন বলো দেখি।’

‌পলাশ সরাসরি বলল, ‘আমার বন্ধুকে একটা কাজ জুটিয়ে দিতে হবে।’

‘কাজ!‌ কী কাজ?’

পলাশ বলল, ‘চাকরি। বেচারি বিরাট বিপদে পড়েছে। গোবেচারা, ভালমানুষ খুব। নাম নিষাদ। অদ্ভুত নাম না? বাইরে থেকে কলকাতায় এসে লেখাপড়া শিখে ফ্যাসাদে পড়েছে। ভেবেছিল, সরকারি অফিসে বা স্কুল মাস্টারির একটা কাজ পাবে। পরীক্ষায় খুব যে একটা ধেড়িয়েছিল এমন নয়, মোটামুটি রেজ়াল্টও করেছিল। কিন্তু চাকরি কোথায়? প্রাইভেটে পেতে গেলে ধরা-করা ছাড়া উপায় নেই। যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শিখেছে, তাতে কেউ ডেকে চাকরি দেবে না। মোটরবাইকে চেপে খাবার দেওয়ার কাজ ওর দ্বারা অসম্ভব। ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পড়ে ওইসব দরজা বন্ধ। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে যে ক্যাব বার করবে, সে মুরোদও নেই।’

গঙ্গামণি বলল, ‘এই অবস্থা তো অনেকেরই। তুমিই বা কোন রাজার হালে আছ বাপু? আমার ঘরে ঢুকলে আগে জিজ্ঞেস করি, পকেটে মালকড়ি আছে তো, থাকলে খিল তুলব, নইলে কেটে পড়।’

পলাশ বলল, ‘ঠিকই বলেছ, ‌আমার মতোই হাল নিষাদের। তাও আমি খানিকটা বলিয়ে কইয়ে, নিষাদ তাও পারে না। বাড়ির অবস্থাও ভাল নয়। গাধাটার ধরাধরি করার মতো লোক নেই। আমি যাকে পাচ্ছি বলছি। আমারও তো তেমন চেনাজানা নেই। দেখো না গঙ্গা, যদি কাউকে বলতে পারো। তোমাদের কথা ফেলবে না।’

গঙ্গামণি হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমার বন্ধুর হাল তো বেহাল দেখছি। কাজ খুঁজতে বাজারের মেয়েমানুষকে ধরতে হচ্ছে।’

পলাশ বলল, ‘তোমাদের ধরা অনেক ভাল, পার না পার বুজরুকি করো না। এই তো আজই একজন ওকে কাজে জয়েন করিয়ে দেবে বলে ধাপ্পা দিল। সেজেগুজে অফিসে গিয়েও হল না। ছেলেটার আবার আজ বিয়ে ছিল। সেটাও গেল ভেঙে। মেয়ে এলই না। ব্যাটার চাকরিটা যে হয়নি সে খবর নিশ্চয়ই পেয়ে গিয়েছে।‌’

গঙ্গামণি অবাক গলায় বলল, ‘আজ বিয়ে ছিল!‌ এ তো একেবারে সিনেমার গল্প গো।’

‌পলাশ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মাটির ভাঁড়ে টুকরোটা চেপে দেয়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘জীবনের অনেক কিছুই গল্পের মতো হয় গঙ্গা।‌ ঘটে যাওয়ার পরেও বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, সত্যি নয় মিথ্যে। এই যে আমি এই ঘরে বসে আছি, তোমার গান শুনছি, তোমার সঙ্গে বকবক করছি, এও কি সত্যি?’

গঙ্গামণি উঠে দাঁড়িয়েছে। পলাশ ঘরে ঢোকার পর অনেকটা সময় চলে গেল। একজন কাস্টমারকে নিয়ে এত সময় কাটালে চলবে কেন? এই ছেলে এলে সময়ের গোলমাল হয়ে যায়। মুখে পাইপয়সা বুঝে নেওয়ার কথা বললেও, পলাশ এলে গঙ্গা অন্য কাস্টমার নিয়ে বসায় ফাঁকি দিয়ে ফেলে। একজন তো ফিরে যাবেই, সেরকম হলেও দু’-তিনজনও চলে যায়। তবে পলাশ আসে আর ক’টা দিন? ন’মাসে-ছ’মাসে একবার। দু’বছর আগে এসে বলেছিল, ‘আপনার ঘরে ‌একটু বসা যাবে?’

‘আপনি’ সম্বোধনে গঙ্গামণি অবাক হয়নি। ভদ্রঘরের ছেলেরা প্রথম এপাড়ায় পা দিলে ‘আপনি’ করেই বলে। ধীরে ধীরে ‘ভদ্রলোক’-এর‌ স্বরূপ প্রকাশ পায়। ‘তুমি’ তো হবেই, ‘তুই’তেও নামে অনেকে।

‘শুধু বসা?’

পলাশ বলল, ‘আমার এক বন্ধুর মুখে শুনেছি, আপনি গান করেন।’

গঙ্গামণি পুরুষমানুষকে উত্তেজিত করার প্রাথমিক কাজটুকু করল। বাঁদিকের বুকের একপাশ থেকে আঁচল অল্প সরিয়ে বলল, ‘এই পাড়ায় সবাই করে।’

পলাশ বলল, ‘সবাই যে ধরনের গান করে, শুনেছি আপনি তেমন নন।’

আঁচল আরও সরিয়ে গঙ্গামণি চোখ অল্প নাচিয়ে বলে, ‘আমি কেমন?’

পলাশ সহজভাবে বলল, ‘অন্যদের চেয়ে আলাদা।’

গঙ্গামণির ভুরু কুঁচকে যায়। এই প্রশংসার কারণ কী? ছোকরার কোনও বদ মতলব আছে? নিশ্চয়ই আছে।‌ দুনিয়ার কোনও প্রশংসায় বিশ্বাস নেই। তবে ছেলেটি যে স্মার্ট সেটা কথাবার্তা, হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছে। তবে নতুন কাউকে ঘরে ঢোকানোর আগে আজকাল খুব সতর্ক থাকতে হয়। থানা থেকে বারবার এসে বলে গিয়েছে। এখন নাকি জঙ্গিরাও কাস্টমার সেজে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। চোর-ডাকাত আসাটা স্বাভাবিক। অপরাধ করার চাপ মুক্ত হতে তারা একবার এপাড়ায় ঘুরে যায়। একথা সবার জানা। যুগ যুগ ধরে চলছে। পুলিশ মাঝেমধ্যেই পাড়া ঘিরে চোর-ডাকাত ধরে নিয়ে যায়। খুনিও ধরা পড়েছে। খুন করে এসে শুয়ে পড়েছে। তা বলে কখনও এসব জঙ্গি-টঙ্গির কথা শোনা যেত না। কিন্তু পুলিশ সাবধান করলে কী হবে, কী করে এদের চেনা যায়, তা তো বলেনি। এই ছেলেকে আগে কখনও এ তল্লাটে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না গঙ্গামণি। পুলিশের লোক নয় তো? সেও এক ঝামেলা। খবর নিতে এসে বিনি পয়সায় ফুর্তি করে যায়।

গঙ্গামণি পলাশকে আর একটু নেড়েঘেঁটে দেখতে চাইল।

‘আমি যে আলাদা বুঝলেন কী করে? এখানে আর কাকে দেখেছেন‌? নিত্য আসেন?’

পলাশ বলল, ‘কাউকে দেখিনি। এপাড়ায় আজ প্রথম এসেছি। বন্ধুর কাছ থেকে আপনার গানের কথা শুনেছিলাম। আজ পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম, ঘুরে যাই।’

গঙ্গামণি স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কী গান?’

পলাশ সেই চোখে চোখ রেখে বলল, ‘পুরো মনে নেই, ভাদর ও আশ্বিন মাসে ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে.‌.‌.‌ এইটুকু মনে আছে। আপনি হয়তো তাকে চিনবেন। বন্ধুর নাম.‌.‌.‌’

‌গঙ্গামণির সন্দেহ দূর হল। ছেলেটা অদ্ভুত তো!‌ গান শুনে চলে এসেছে! গানের কথা মনেও রেখেছে। হাত তুলে বলল, ‘থাক, নাম বলতে হবে না। আমাদের ব্যবসায় পার্টির নাম বলতে নেই।’

পলাশ নিশ্চিন্ত হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘তাহলে ঘরে ঢুকি?’

গঙ্গামণির শাড়ির আঁচল তখন বুকের মাঝখানে। লাস্য হেসে বলল, ‘বাপু আমি তো কাঁচা বাঁশ নই, পাকা বাঁশ, এই মাসটাও ভাদর আশ্বিন নয়, তুমি বসবে কোথায়?’

পলাশ এক পা এগিয়ে এসে বলে, ‘সে জায়গা হয়ে যাবে।’

গঙ্গামণি চাপা গলায় বলল, ‘আমি কিন্তু ফিরির গায়িকা নই, কাউকে শুধু বসতে দিই না।’

পলাশ বলল, ‘টাকা নিয়ে এসেছি।’

গঙ্গামণি বলল, ‘শোয়া-বসা যাই করো, ‌ফুল পেমেন্ট দিতে হবে। গানের জন্য এক্সট্রা।’

পলাশ বলল, ‘তাই দেব।’

‌গঙ্গামণি দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছিল। গান শোনার পর সেদিন গঙ্গামণিই পলাশের হাত টেনে বুকের উপর রাখে। বহু বছর পর তার পুরুষের স্পর্শ ভাল লেগেছিল। তারপরেও আরও অনেকে এসেছিল। পলাশের স্পর্শ যেন বুকে লেগে ছিল।

পলাশ ফিসফিস করে বলেছিল, ‘আমি জানি না।’

গঙ্গামণি থুতনি ধরে বলে, ‘জামা-প্যান্ট খোল, আমি সব জানিয়ে দেব খোকাবাবু।’

পলাশকে নিজের দুর্বলতা বুঝতে দেয় না গঙ্গামণি। আর পাঁচজন কাস্টমারের মতোই পলাশের কাছ থেকে পয়সা বুঝে নেয়। দু’দিন টাকা ছাড়া এলে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। ‌একদিন তো অপমানই করে।

‘আমি তোমার প্রেমিকা নই পলাশদা। বিনি পয়সায় পাশে বসতে দেব না।’

অন্য কেউ হলে হয়তো আর এমুখো হত না। এপাড়ায় মেয়ের অভাব হবে না। বাউল, ঝুমুর না গাক, গঙ্গার চেয়ে গলা ভাল এমন মেয়ে অনেক রয়েছে। তবু পলাশ রাগ করেনি। বরং আরও আকর্ষণ বেড়েছে। গঙ্গামণি যতই লুকোক, তার দুর্বলতা অনুভব করেছে পলাশ। সে নিজেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। টাকাপয়সা জোগাড় করে আবার এসেছে।

আজ সময় বেশি হয়ে গেল। নিষাদের সত্যি-মিথ্যে নিয়ে দার্শনিক ধরনের ব্যাখ্যা শোনার পর গঙ্গামণি দ্রুত হাতে শাড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘ওমা! এসব‌ সত্যি নয়? সে আবার কেমন কথা ‌গো!‌ এই যে আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সে কি তবে মিথ্যে?’

পলাশ হেসে বলল, ‘হয়তো তাই। আজ যেটা সত্যি মনে হচ্ছে, কাল স্বপ্নের মতো লাগবে।’

ব্লাউজ় খুলে ফেলল গঙ্গা। অনেকে নিজে হাতে জামাকাপড় খুলতে চায়। পলাশ প্রথমদিনই বুঝিয়ে দিয়েছিল, এতে সে নেই। তাই গঙ্গাকেই তৈরি হয়ে আসতে হয়। ব্রা আর সায়া পরে পলাশের সামনে দাঁড়ায়। তার তেজের শরীরে ভারী স্তনদুটো যেন আরও তেজি। উন্মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করছে বাঁধনের ভিতর। ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা যেন আক্রমণ করতে চায়। সামনের পুরুষটিকে তুচ্ছ করে, পরাস্ত করে চিৎকার করে বলতে চায়, দয়া নয়, আমি নিজেই বাঁচার পথ চিনেছি। যদি পাপ কিছু থাকে সে আমার নয়, তোমার।

পলাশের গায়ের কাছে এসে ব্রায়ের হুক খুলে ফেলল গঙ্গামণি। ‌

‘গাঁজায় নেশা হয়ে গিয়েছে পলাশদা। কী যে সব বলছ!‌ তোমার কথার‌ মানে বুঝতে পারছি না। এই শরীর আমার মিথ্যে? তুমি যে আমায় ছুঁয়ে ছেনে দেখো, আদর দাও, কষ্ট দাও আমাকে, সব মিথ্যে?’

পলাশ গঙ্গামণিকে জাপটে ধরে বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, ‘অবশ্যই মিথ্যে.‌.‌.‌অবশ্যই মিথ্যে.‌.‌.‌‌’

গঙ্গামণি শরীরের বাকি আবরণটুকু সরিয়ে দিয়ে দু’হাতে পলাশের মাথার চুল চেপে ধরে। কোনও এক আশ্চর্য কারণে এই ছেলেটার নখের আঁচড়হীন উন্মাদনায় তার শরীর আদর খুঁজে পায়। শিউরে ওঠে। কতদিন পরে রতিক্রিয়ায় সুখ হচ্ছে, সে নিজেও মনে করতে পারে না।

পলাশ মুখ আরও গঙ্গামণির শরীরের গভীরে নিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘আমি চলে যাচ্ছি গঙ্গা.‌.‌.‌ ফিরে যাচ্ছি গাঁয়ে.‌.‌.‌ আর দেখা হবে না.‌.‌. আমি তোমাকে ভালবাসি গঙ্গা.‌.‌.‌ জানি, সে ভালবাসা সত্যি নয়, তাও ভালবাসি।’

গঙ্গামণি পলাশকে নিয়ে বিছানায় ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *