৫
একেই ঘর ছোট, তার উপর বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া। চোখ জ্বালা না করে উপায় নেই। প্রথম প্রথম অসুবিধে হত সিন্ধুরার। প্রবাল হেসে বলেছিল, ‘অভ্যেস হয়ে যাবে। সবচেয়ে ভাল হয়, তুমি যদি নেশাটা ধরে নিতে পার সিন্ধুরা। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কাটাকাটি হয়ে যাবে।’
সিন্ধুরা রাগ দেখিয়ে বলেছিল, ‘দুনিয়াসুদ্ধ সবাই স্মোকিং বন্ধ করতে বলছে, আর তুমি উৎসাহ দিচ্ছ প্রবালদা!’
প্রবাল একটু থতমত খেয়ে যায়। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে নড়বড়ে যুক্তি দিয়ে বসে।
‘রাজনীতির মিটিংয়ে বিড়ি-সিগারেট লাগে। আজ নয়, প্রাচীনকাল থেকে লাগে। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে হয়। নইলে কাজ হয় না।’
সিন্ধুরা জোরের সঙ্গে বলল, ‘কখনওই নয়, কোনও কিছুতেই লাগে না। আগের ধারণা বদলে ফেলা উচিত। এত মানুষ স্মোক করতে এমনি বারণ করে না।’
এবার মুখ খুলল অগ্নীশ। অগ্নীশ পাল। এই ঘরে যারা আসা-যাওয়া করে তাদের ‘অগ্নীশদা’। চল্লিশ ছুঁতে না ছুঁতেই চুলের দু’পাশে রুপোলি রেখা উঁকি দিতে শুরু করেছে। চেহারায় পেটানো ভাব। দীর্ঘদিন মাঠেঘাটে ঘোরাঘুরি করায় গায়ের রং রোদে জলে পুড়ে তামাটে। মাথার চুল এলোমেলো। সবমিলিয়ে এক ধরনের বন্য ভাব। চশমার ওপাশে চোখদুটো ঝকঝকে। কম বয়সে বিয়ে করেছিল। মেয়েটি পার্টিতে একসঙ্গে কাজ করত। সেই মেয়ে হঠাৎ পার্টি অফিসে আসা-যাওয়া বন্ধ করল। প্রোগ্রামেও যেত না। অগ্নীশকে অন্যরা প্রশ্ন করলে সে নিস্পৃহভাবে বলত, ‘মনে হয়, শরীর খারাপ।’ সেই মেয়ে একদিন ডিভোর্স করে চলে গেল। ডিভোর্সের কারণ জানা যায়নি। মেয়েটি শুধু অগ্নীশকে ছেড়েই গেল না, দেশ ছেড়েই চলে গেল। এখন আমেরিকায়। মেয়াপ্পান নামে এক দক্ষিণ ভারতীয়কে বিয়ে করেছে। ভদ্রলোক বিজ্ঞানী। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পেপার লিখেছেন। অগ্নীশ স্ত্রীকে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকত। এখন একা থাকে।
অগ্নীশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ‘কথাটা ঠিক, কিন্তু কারা একথা বলে, সেটাও দেখতে হবে সিন্ধুরা। তারা সত্যি মানুষের ভাল চায় কিনা, বুঝতে হবে। আমরা ইন্ডিভিজুয়াল স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবি না, গোটা সমাজের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবি।’
সিন্ধুরা বলল, ‘ব্যক্তির স্বাস্থ্য যোগ করলে কি সমাজের স্বাস্থ্য তৈরি হয় না অগ্নীশদা?’
অগ্নীশ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তাহলে তো স্বার্থপরতাই মুক্তির পথ। যে যার নিজের ভালমন্দটুকু দেখলেই একটা আদর্শ সমাজ তৈরি হয়ে যেত, যে সমাজ শোষণহীন, যে সমাজে সবার অধিকার সমান। একা সুখে থাকা মানেই সবার সুখে থাকা হত। তাই কি হয়?’
সিন্ধুরা একটু হকচকিয়ে যায়। সামান্য বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া থেকে একেবারে শোষণহীন সমাজের প্রসঙ্গ চলে আসবে, বুঝতে পারেনি। বলল, ‘আমি এতটা বলতে চাইনি। বলছিলাম, রাজনীতি করলেই...’
অগ্নীশ কথা শেষ হওয়ার আগেই সিন্ধুরাকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘তুমি এমনভাবে বলছ যেন তোমাকে কেউ জোর করে বিড়ি-সিগারেট ধরতে বলেছে। প্রবালের কথা ভুল বুঝেছ। সে মজা করেছে মাত্র। চে গেভারা, লেনিন, হো চি মিন সিগার, পাইপ, চুরুট খেতেন, তার মানে এই নয় যে তাঁরা স্বাস্থ্য খারাপ হয়, এমন কিছুকে সাপোর্ট করেছেন। আসলে তাঁরা নিজেদের শরীর নিয়ে ভাবার সময় পাননি। অন্য মানুষকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে নিজের ক্ষতির দিকে তাকাননি।’
সিন্ধুরা অগ্নীশের কথার সঙ্গে পুরোটা একমত হল না। কিন্তু অগ্নীশদার সঙ্গে তর্ক করা যায় না। সে বয়সে বড়, পার্টির লিডারও বটে। শুধু এখানেই শেষ নয়, বয়সের তফাত বেশ খানিকটা হওয়া সত্ত্বেও সিন্ধুরা এই মানুষটার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করে। সেই আকর্ষণ ঠিক কেমন সে জানে না। কাউকে কখনও বলেনি। নিজেই অনুভব করে। অগ্নীশদার এলোমেলো চেহারা, মেধা, কথা বলার সম্মোহনী ক্ষমতা তাকে আচ্ছন্ন করে। যদিও সুরুলপুর পার্টি ইউনিট তাকে খুব বেশি উপরে উঠতে দেয়নি। পার্টির জেলা বা রাজ্যস্তরেও তার ঠাঁই হয়নি। এই নিয়ে অগ্নীশের মনে আবছা অভিমান রয়েছে। প্রকাশ করে না। এখন আবার পার্টির দুঃসময়। এই সময়ে কর্মী, নেতাদের মান-অভিমান নিয়ে কে ভাববে? তাকে নিয়ে ভাবে সিন্ধুরা। কর্মীদের সঙ্গে তার আচরণ কখনও কড়া, কখনও বন্ধুত্বের। তার উপর মানুষটার মিছিলের স্লোগান, পথসভার ভাষণ, কর্মী মিটিংয়ের যুক্তিতে সিন্ধুরা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এনার্জিতে চনমনে, ঝকঝকে অথচ শান্ত, স্থিতধী। সেই সঙ্গে দেখার মতো সাহস। বেশিরভাগ নেতাই যখন বসে গিয়েছে, নয় আড়ালে, অগ্নীশ পাল তখন বুক ফুলিয়ে চলে। সিন্ধুরার মনে হয়, এরকম একজন নেতাই প্রয়োজন। শুধু দলের নয়, তার নিজের জীবনের জন্যও প্রয়োজন। যে দিশা দেখাবে। তবে কাউকে একথা বলে না। কে কী মানে করবে তার ঠিক আছে?
সেদিন সিন্ধুরা বলেছিল, ‘সরি অগ্নীশদা। আমি কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য কিছু বলতে চাইনি।’
অগ্নীশও গলা নরম করে বলেছিল, ‘ঠিক আছে। সিন্ধুরা, আমি জানি, এই ছোট ঘরে নানা সমস্যা। কী করব বলো? তোমরা তো দেখেছ বাধ্য হয়ে তোমাদের এখানে আনতে হয়েছে। নিজেদের মানিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। গোটা সিস্টেমের সঙ্গেই তো আমাদের মানিয়ে নিতে হচ্ছে।’
সিন্ধুরা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না না, ঘর তো খুবই ভাল। বরং আমরা এসে আপনাকে সমস্যায় ফেলি।’
অগ্নীশের এই ঘরে পৌঁছতে সিন্ধুরাদের সুরুলপুর থেকে দুটো স্টেশন ট্রেনে আসতে হয়। জায়গাটার নাম দহলা। আধা মফস্সল, আধা শহর। গলি দিয়ে মিনিট সতেরো-আঠেরো হেঁটে গেলে একতলা বাড়ির দেড়খানা ঘর। বড় ঘরটা বেডরুম, বাকি আধখানা ঘর অগ্নীশের লেখাপড়া, বাইরের কেউ এলে বসার। সিন্ধুরাদের মিটিং এই ঘরেই হয়। এখন পর্যন্ত চারজনকে ডেকেছে অগ্নীশ। তার মধ্যে সুতনু আসা বন্ধ করে দিয়েছে। সিন্ধুরার সঙ্গে তার একদিন দেখা হয়েছিল।
‘তুই অগ্নীশদার ওখানে যাস না কেন?’
সুতনু মুখ শক্ত করে বলেছিল, ‘আর যাব না। আমি পার্টি ফ্র্যাকশনে নেই। দলের মধ্যে থেকে উপদল করতে পারব না।’
সিন্ধুরা অবাক হয়ে বলল, ‘ফ্র্যাকশন কোথায় পেলি? পার্টি ক্লাসকে তুই উপদল করা বলছিস! পার্টির নীতি-আদর্শ নিয়ে লেখাপড়া না করলে তো পার্টিটাও ঠিকমতো বোঝা যায় না।’
সুতনু ঠোঁটের ফাঁকে বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, ‘পার্টি ক্লাস! পার্টি ক্লাস করতে গিয়ে যিনি ক্লাস নেন সেই মাস্টারের কাছ থেকে পার্টির সমালোচনা শুনতে হয়?’
সিন্ধুরা বলেছিল, ‘সমালোচনা কেন বলছিস, আত্মসমালোচনা বল। আত্মসমালোচনা ছাড়া আমাদের মতো পার্টি এগোতে পারে না। আমাদের দল তো ফ্যাসিস্ট দল নয়।’
সুতনু মাঝপথে সিন্ধুরাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এত বড় বড় কথা শুনে আমার কাজ নেই। আমি যদি পার্টিতে থাকি মূর্খ হয়েই থাকব। ঘোটালা করার দরকার নেই। একেই পার্টির এই হাল, তার মধ্যে ঘোটালা।’
এরপর সিন্ধুরা কথা না বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
গত কয়েক বছর ধরেই উপর থেকে পার্টিতে নির্দেশ এসেছে, কর্মীদের ‘শিক্ষিত’ হতে হবে। বহু বছর শুধু ভোট নিয়েই ভাবনাচিন্তা হয়েছে, মিটিং, মিছিল হয়েছে, পার্টির নীতি আদর্শ নিয়ে লেখাপড়া কিছু হয়নি। সেই কারণে দলের বিপর্যয়ের সময় বহু মানুষ দল ছেড়ে সরে গিয়েছে। তারা দলের আদর্শ জানত না, ক্ষমতা জানত। সেই ভুল সংশোধন করতে হবে। এই দুঃসময়ে নতুন যে ক’জন পার্টিতে এসেছে তাদের ধরে রাখতে হলে চাই শিক্ষা। তাই পার্টি ক্লাস-এর ব্যবস্থা করতে হবে। মাসে একদিন-দু’দিন ছেলেমেয়েদের দলের নীতি, আদর্শ বোঝাতে হবে। পুরনো কোনও যোগ্য লোককে এই দায়িত্ব দিতে হবে। পার্টি-নির্ধারিত পত্রিকা, বই নিয়ে তিনি কাজ শুরু করবেন। সুরুলপুর পার্টি অগ্নীশকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকার পরে গত বছর সুরুলপুর পার্টি অফিস খুলেছে। এখনও সাইনবোর্ড, ঝান্ডা লাগানো হয়নি। বেশিক্ষণ খোলাও থাকে না। দিনেরবেলা লোকজন আসা-যাওয়া করলেও, সন্ধের পর তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পড়ানোর দায়িত্ব পাওয়ার পর অগ্নীশ বলেছিল, ‘এই পার্টি অফিসে বসে মিটিং হয়, লেখাপড়া হয় না। ক্লাস করতে গেলে আলাদা করে বসতে হবে। আমার বাড়িতেই একটা ব্যবস্থা করা যাবে। অবশ্য যদি কোনও অসুবিধে না হয়। দুটো তো মাত্র স্টেশন। সবারই তো মান্থলি রয়েছে। তোমরা রাজি থাকলে বল।’
সকলেই রাজি হয়েছিল। সুতনু রাজি হয়েছিল সবার আগে। সেই সবার আগে পালাল। অগ্নীশ তার কথা শুনে মুচকি হেসেছে।
‘খারাপ সময়ে মানুষ যখন পালায়, নানা অজুহাত তোলে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে হবে তো। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। ভুলে যাও।’
সুতনুর মতো ঘোটালা মনে না হলেও, এখানে যারা আসে তারা এতদিনে বুঝে গিয়েছে, অগ্নীশদার অনেক কথাই পার্টির মুখ্য নেতাদের মতো নয়। বলা ভাল, সুরুলপুরে বসে মানুষটা যেভাবে কথা বলে, দহলার বাড়িতে বসে পুরোটা একরকম কথা বলে না। পার্টির প্রতিষ্ঠা, পার্টির আদর্শ, পার্টির পুরনো নেতাদের আত্মত্যাগের কথা বলার পরই একটু-একটু করে নিজের ভাবনাচিন্তার কথা বলতে শুরু করেছে অগ্নীশ।
‘যেভাবে আমরা সুরুলপুরে চলছি, তাতে হবে না। কর্মসূচিতে বদল এনে দলকে শক্তিশালী করতে হবে। মানুষের ভিতর যে আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে, তাকে বাড়িয়ে দিতে হবে। মানুষ যেন বোঝে, হ্যাঁ, পার্টি এখনও বেঁচে রয়েছে।’
সিন্ধুরা বলল, ‘আমরা তো মিটিং, মিছিল করছি। পার্টি যেমন প্রোগ্রাম দিচ্ছে সবই করছি। এই তো সেদিন জেলাশাসককে ডেপুটেশন দেওয়া হল। আপনি ছিলেন।’
অগ্নীশ বলল, ‘ওসব তো শোকেসিং প্রোগ্রাম। সাজানো কর্মসূচি। খাতায় লেখা হবে, সুরুলপুর পার্টি ইউনিট তিনটি মিছিল, দুটি পথসভা, একটি দাবিসনদের কর্মসূচি যথাযথভাবে পালন করিয়াছে। জনসমাগম কম হইলেও তাহা গত কর্মসূচিগুলির চেয়ে বেশি সফল। তারপর এই নোট উপরতলায় চলে যাবে। স্কুলের মতো উপস্থিতির খাতায় টিক পড়বে।’
শাম্ব বলল, ‘তাহলে কি আমরা এই কর্মসূচি থেকে সরে আসব?’
অগ্নীশ বলল, ‘একেবারেই না। প্রোগ্রাম নিশ্চয়ই করব। তবে রুটিনে থেমে থাকলে হবে না। সুযোগ পেলে উত্তেজনা ছড়াতে হবে।’
সিন্ধুরা বলল, ‘এতে তো গোলমাল হতে পারে।’
অগ্নীশ একটু হেসে বলল, ‘সে তো একটু হবেই। ভয় পেলে চলবে না। মনে রাখবে, পাথর না গড়ালে শ্যাওলা জন্মায়। পার্টিরও সেই অবস্থা।’
সিন্ধুরা বলল, ‘কিন্তু কল্লোলবাবুরা যে বলে, পার্টি কর্মীদের এখন শান্তভাবে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে হবে, তাদের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠতে হবে? যে ভরসা চলে গিয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে? উত্তেজনা, রাগারাগির মধ্যে গেলে তারা আরও সরে যাবে!’
অগ্নীশ বলল, ‘কল্লোলবাবুরা এরকম কথাই বলবেন। তাদের পার্টি গাইডলাইনের বাইরে নড়াচড়া করার উপায় নেই। এই গাইডলাইন যতই ভুল হোক, অচল হোক, যতই ব্যর্থ হোক, তারা মুখ ফুটে বলতে পারবে না। পায়ে তাদের গাইডলাইনের শিকল। একটু এদিক ওদিক করলেই সেই শিকলে টান পড়ে। আমারও তাই, তবে আমি তাকে শিথিল করার চেষ্টা করি। এই দুঃসময়ে পার্টি বাঁচানোর জন্য শুধু বেঁধে দেওয়া পথ ধরে চললেই হবে না, পরিস্থিতি বিচার করে নতুন পথ বার করে নিতে হবে। সে সাহস এবং বুদ্ধি তোমাদের মতো কমবয়সিদেরই রয়েছে।’
অনির্বাণ বলল, ‘সেটা দলবিরোধী হয়ে যাবে না অগ্নীশদা?’
অগ্নীশ বিদ্রূপের সুরে বলল, ‘আরে বাবা, দল থাকলে তো দলবিরোধী। দলটাকে তো রাখতে হবে। তোমরাই দলটাকে রাখবে, বছরের পর বছর কাচের মিনারে বসে থাকা লিডারের কম্মো নয়। মনে রাখবে, এটাই দলের আশু কর্তব্য।’
সিন্ধুরা রাজনীতিতে এসেছে কলেজে ঢুকে। বাবা-ই কারণ। শাশ্বত রাজনীতি করত। জোরদারভাবেই করত। পার্টির কথামতো পড়ে থাকত গ্রামেগঞ্জে। অফিসে চাকরি করতে ঢুকে আর ইচ্ছেমতো বাইরে চলে যেতে পারত না, কিন্তু সুরুলপুরে কাজ করত পুরোদমে। মিটিং, মিছিল তো ছিলই, ভোট এলে একেবারে কোমর বেঁধে নামত। পার্টির হাতে তখন ক্ষমতা। ফলে মার খাওয়ার ভয় না থাকলেও, ভোটের সময় চোরাগোপ্তা গোলমাল লেগেই থাকত। সুরুলপুরে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। নয়নতারা স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকত। রাতে দেরি হলে বারান্দায় বসে থাকত। ছেলেমেয়েরাও সেই উদ্বেগের আঁচ পেয়েছে। রাতে শাশ্বত বাড়ি ফিরলে অশান্তিও হত।
‘আমি তোমাকে কতবার বারণ করেছি নয়ন, আমাকে এই নিয়ে কিছু বলতে এসো না। রাজনীতি আমি করবই। ওটা আমার রক্তে ঢুকে আছে।’
‘তোমাকে রাজনীতি করতে কে বারণ করেছে? পার্টি তো সবাই করছে। করে কিছু না কিছু বাগিয়ে নিচ্ছে। বাড়ি, জমি, চাকরি, প্রোমোশন। এই যে অমিয়বাবুর শালা লরি কিনে ফেলল। তারাও তো তোমাদের মিছিলে যায়, তোমার অত আগ বাড়ানোর কী আছে? ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকবে।’
শাশ্বত বিরক্ত গলায় বলত, ‘আমি ওদের মতো কিছু বাগিয়ে নেওয়ার জন্য পার্টি করি না। আমার রাজনীতি করার পিছনে মতাদর্শগত তাড়না রয়েছে।’
নয়নতারা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলত, ‘রাখ তোমার লেকচার। যারা বাগিয়ে নেওয়ার জন্য ঘুরঘুর করে তাদেরই তো তোমাদের মিছিলে দেখি।’
শাশ্বত বলত, ‘ভিড় বাড়াতে লোক লাগে নয়ন। এরা ভিড় ছাড়া কিছুই নয়। সুরুলপুরে আমরা কয়েকজনই পার্টির মাথা। মাথা ঠিক থাকলে কোনও সমস্যা নেই। শরীরের পচন থাকলে সে অংশটা কেটে বাদ দেওয়া যায়, আমরা সেটাই করি।’
নয়নতারা উদ্বেগের গলায় বলে, ‘এটাই তো ভয়ের। মাথার কিছু হলে গোটা পরিবারটাই তো ডুবে যাবে। সবাই তখন পালাবে। তোমার আগ বাড়িয়ে মাথা হওয়ার দরকার কী? পার্টি তো তোমাকে কিছু দেয়নি।’
শাশ্বত এবার রেগে গিয়ে বলত, ‘যা জান না, বোঝ না, তাই নিয়ে বাজে কথা বলবে না।’
রাজনীতি করা নিয়ে বাবা-মায়ের যতই অশান্তি হোক, সিন্ধুরা ছোটবেলা থেকেই বাবার এই পরিচয়ে গর্বিত। শিশু বয়সে বাড়িতে কচি হাত উপরে তুলে ‘মালছি না, মালব না’ বলে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়িয়েছে কতদিন। তার জন্য মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছে। এই শাসনে বাবার রাজনীতি করাকে যেন আরও পছন্দ করে ফেলেছিল মেয়েটা। নিষাদের এদিকে মন ছিল না। সে হইচই পছন্দ করত না। মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে শাশ্বত যখন যেত, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত সিন্ধুরা। তখন সে বালিকা। কোনও সভায় বাবা লেকচার দিলে দূরে দাঁড়িয়ে শুনত। কিছুই বুঝত না, তাও শুনত। বাবাকে নিয়ে স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে মারপিট হয়েছে। মারপিট না বলে, মেরেছে বলাই ঠিক হবে।
‘জানিস আমার বাবা লিডার।’
‘এ মা সিন্ধুরা, তোর বাবা চোর?’
‘তুই আমার বাবাকে চোর বললি কেন?’
‘আমার বাবা বলে, যারা লিডার হয় তারা চোর।’
ব্যস, ঝাঁপিয়ে পড়ল সিন্ধুরা। চুল টানা, খিমচানো, আঁচড়ে দেওয়া। স্কুল থেকে বাবা-মাকে ডেকে পাঠাল। নয়নতারা গেল। বাড়িতে ফিরে মেয়েকে মারলও। কিশোরীবেলায় ঢুকতে ঢুকতে রাজনীতি কাকে বলে, বাবা কেন রাজনীতি করে, রাজনীতি করলে কী হয় এসব জটিল বিষয় ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল সিন্ধুরা। সেই বোঝা স্পষ্ট নয়, আবছা। তবে একটা চেহারা পাচ্ছে। তখন সুরুলপুরে শাশ্বতদের পার্টির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বাড়তে শুরু করেছে। অন্যরা এককাট্টা হচ্ছে। শাশ্বতদের টেনশন বাড়ছে। ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে না তো? ততক্ষণে ধারদেনা করে সে বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেছে।
শাশ্বতর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পরে সিন্ধুরা দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জানতে পারল। একটা মায়ের সম্পর্কে, একটা বাবার। মায়ের ঘটনা জেনে সিন্ধুরার পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠেছিল। দুঃখে, রাগে, অভিমানে ভেঙে পড়েছিল সে। তবে কাউকে বুঝতে দেয়নি, মনকে শান্ত রেখেছে। ভেবেছিল মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে, পারেনি। এখন আর সে প্রশ্ন ওঠে না। মানুষটার বয়স বেড়েছে। অসুস্থও হয়েছে। তবে শাশ্বতর ঘটনা জানার পর বাবার প্রতি সিন্ধুরার গর্ব এক নিমেষে বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। যে ঘটনাকে নয়নতারা তার স্বামীর ‘চরম অবিবেচকের কাজ’ হিসেবে মনে করে, সেই ঘটনাকেই সিন্ধুরা পরিবারের সবচেয়ে ‘উজ্জ্বল পরিচয়’ বলে মনে করেছে।
মেয়ের কথা শুনে নয়নতারা বলেছিল, ‘এটা কোনও পরিচয় হল?’
সিন্ধুরা বলেছিল, ‘এর চেয়ে বড় আর কী পরিচয় চাও?’
নয়নতারা বলল, ‘তোর বাবা, তার প্রাপ্য থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে, এটাই তার পরিচয়!’
সিন্ধুরা জোরের সঙ্গে বলেছিল, ‘এটা পরিচয় নয়, কী কারণে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সেটা পরিচয়।’
নয়নতারা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিল, ‘কী কারণ? তোর জেঠা-কাকারা কার জমি নিয়েছে, তা নিয়ে তোর বাবার কী?’
সিন্ধুরা অবাক হয়ে বলল, ‘কার জমি নিয়েছে সেটাই তো বড় কথা মা। একজন উইডোর কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া জমির ভাগ নেব আমরা?’
নয়নতারা বলেছিল, ‘ছিনিয়ে নেওয়া কোথায়?’
সিন্ধুরা বলল, ‘অবশ্যই তাই। ঠকিয়ে নেওয়া আর ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে তফাত কোথায়?’
পুরোটা না হলেও, ঘটনা অনেকটা তাই। একসময় শাশ্বতদের জমিজমার একটা ছোট অংশ নিয়ে গোলমাল বেধেছিল। মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন গ্রামেরই এক মহিলা। সম্পত্তির মধ্যে একফালি জমির মালিকানা নাকি তার, শাশ্বতর বাবা জোর করে নিজের ভাগে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। মহিলা ছিলেন বিধবা, পয়সাকড়ির জোর ছিল না। দোরে দোরে ঘুরে নালিশ জানিয়ে কোনও লাভ হল না। হওয়ার কথাও নয়। সেই সময় শাশ্বতর বাবার যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। পঞ্চায়েতের নেতা, গ্রামের মুরুব্বিদের সঙ্গে ওঠাবসা। শাশ্বতর দুই ভাইও কম যেত না। ক্ষমতায় থাকা পার্টির গা ঘেঁষে থাকত। মহিলা শেষপর্যন্ত মামলা করলেন। মামলা চলাকালীন শাশ্বতর বাবা মারা গেলেন। তবে সেই মামলা জিততে খুব কিছু কসরত করতে হল না। সেই অর্থে মামলা জিতেই জমির দখল নেওয়া হয়েছিল। খাতায় কলমে বেআইনি কিছু নেই। তবে গ্রামের প্রায় সকলেই জেনেছিল, শাশ্বতর বাবা বেঁচে থাকতে থাকতেই জাল কাগজপত্র, ভুয়ো সাক্ষীর সব ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। রেজিস্ট্রি অফিসের খাতাতেও নাকি নাম কাটাছেঁড়া হয়েছে। শাশ্বত ভাইদের বলেছিল, মামলা জেতা হয়ে গিয়েছে, এবার মহিলাকে জমি ফেরত দেওয়া হোক। তারা লাফিয়ে উঠেছিল।
‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? এটা আমাদের ফ্যামিলি প্রেস্টিজ। বাবার আত্মার শান্তির ব্যাপার।’
শাশ্বত ঠান্ডাভাবে বলেছিল, ‘সেটাই তো বলছি। মামলা জেতা হয়ে গিয়েছে, তোমাদের কথামতো বাবার আত্মাও নিশ্চয়ই শান্তি পেয়েছে। এবার জমিটুকু ফেরত দিয়ে দেওয়া হোক। বেশি জমি তো নয়, অল্পই।’
‘হতেই পারে না। সবাই তাহলে ভাববে, ওই বদ মহিলার কথাই সত্যি। জমি তার ছিল।’
শাশ্বত সামান্য হেসে বলেছিল, ‘কিছু দেওয়ার মধ্যে পরাজয়ের কিছু নেই। আমাদের পরিবারের তরফ থেকে না হয় দান করেই দেওয়া হবে। তবে সবাই কী ভাববে তা নিয়ে মাথা ঘামালে তো এখনই কান পাতা দায় হচ্ছে। গ্রামের বেশিরভাগ লোকই আমাদের জাল-জুয়াচুরির কথা বলছে। কথাটা যে মিথ্যে নয়, তা আমি যেমন জানি, তোমরাও জানো।’
এরপরেই ভাইদের সঙ্গে তুমুল অশান্তি হয় শাশ্বতর। সে দু’দিনের মধ্যে স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দেয়, দেশের বাড়িজমিতে তার কোনও দাবি নেই। সে কিছু নেবে না।
শাশ্বত ছেলেমেয়েকে যখন এই ঘটনা বলে দুই ভাই-বোনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল একেবারে উলটো। নিষাদ নিচু গলায় বলেছিল, ‘তুমি যা ঠিক মনে করেছ, তাই করেছ। আমার কী বলার থাকতে পারে?’
সিন্ধুরা লাফ দিয়ে উঠে বলেছিল, ‘এই না হলে আমার বাবা। আমার বাবা জিন্দাবাদ... আমার বাবা জিন্দাবাদ।’
বাবার প্রতিবাদী চরিত্রটাই পেয়েছে সিন্ধুরা। কলেজে ঢুকে সরাসরি রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ততদিনে পার্টিকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে। প্রথমে ছাত্র ইউনিয়নে, তারপর কলেজ শেষ করলে সুরুলপুর পার্টি ইউনিটে। সেখানেও কয়েক বছর কাজ করতে হয়েছে। যদিও এই সময়টা পার্টির কর্মসূচি তেমন কিছু ছিল না। রাখা সম্ভবও ছিল না। সভা করলে দশটা চেয়ার ভর্তি করা কঠিন ছিল। যেদিন ইউনিটে সিন্ধুরাকে সদস্য করা হয়, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তার। এক সময়ে এই খাতাতেই শাশ্বত সেনগুপ্তর নাম ছিল। কল্লোলবাবু, বিভাস সাহা-রা আবেগমথিত হয়ে পড়ছিলেন। এই পার্টিতে কারও সদস্য হওয়া কোনও আড়ম্বর করা অনুষ্ঠান নয়, তারপরেও নিজেদের সামলাতে না পেরে তারা দু’ কথা বলে ফেললেন। যদিও পার্টি অফিসে তখন বেশি কেউ ছিল না। যারা ছিল, তাদের বেশিরভাগই শাশ্বত সেনগুপ্তকে দেখেনি। সুরুলপুর জায়গা খুব ছোট নয়। সবাইকে সবার চেনার কথাও নয়। আগে তাও মানুষ কম ছিল, এখন শহর বেড়েছে, মানুষও বেড়েছে। সদর না হোক, সদরের পরেই এখন সুরুলপুর। ফলে অনেক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসের শাখাপ্রশাখা খুলেছে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কও শাখা খুলেছে। একটা মল হয়েছে। বড় বাস টার্মিনাস হয়েছে একটা। অনেকে বাইরে থেকে বদলি হয়েও এখানে চাকরি করতে এসেছে। আবার পুরনো বাসিন্দারা কেউ কেউ বাইরে চলে গিয়েছে। পুরনোদের সঙ্গে নতুনরা মিলেমিশে একটা নতুন সুরুলপুর তৈরি হয়েছে বলা যায়।
কল্লোলবাবু বললেন, ‘আজ আমাদের পার্টি ইউনিটের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, আজ এমন একজনকে আমাদের সঙ্গে পেলাম, যার বাবাও এখানে কাজ করেছেন। মাঝখানের দীর্ঘ সময়ে আমাদের পার্টির উপর দিয়ে ঝড়ঝাপটা বয়ে গিয়েছে। সেই ঝড় এখনও থামেনি। তবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। ঝড়ের সময় লম্বা, বড় গাছের মাথা মুড়িয়ে যায়, ডালপালা ভেঙে পড়ে। আমাদেরও যেন সেই অবস্থা। এই অফিস আমরা খুলতে পারিনি বহু বছর। পার্টিতে লোকও কমে গিয়েছে। কীভাবে সবাই ছেড়ে পালিয়েছে সেকথা আপনারা যতটা না জানেন, তার চেয়ে বেশি আমরা জানি। এখন পার্টি অফিস কিছুক্ষণের জন্য হলেও খুলতে পারছি। পুরনো এবং নতুনরা কেউ কেউ আসছেন। সিন্ধুরা ছাত্রী অবস্থাতেই রাজনীতিতে ঢুকেছে। এবার পার্টিতে চলে এল। আমাদের আনন্দ এটাই, ও তার বাবার আদর্শকে বহন করছে।’
বিভাস সাহাকে বাবার সঙ্গে মিটিং মিছিল করতে দেখেছে সিন্ধুরা। বয়সে বাবার চেয়ে বেশ খানিকটা ছোটই ছিলেন। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিনের সুরুলপুর থেকে সরে যেতে হয়। কলকাতায় বোনের বাড়িতে গিয়ে ছিলেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরেছেন। এখন বয়স হয়েছে। সেদিন বিভাস সাহা বললেন, ‘আমি শাশ্বতর সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। ওর মতো অনেস্ট, ডিসিপ্লিনড, সিনিসিয়ার কর্মী খুব কমই পাওয়া যায়। বিশেষ করে দলের এই দুঃসময়ে ওর মতো কর্মীর প্রয়োজন। দল শুধু নীতি-আদর্শ দিয়ে তৈরি হয় না, মানুষ লাগে। মানুষ যদি ভুল হয়, আদর্শ হাজার ঠিক হলেও কোনও লাভ হয় না। আমার আজ ভাবতে ভাল লাগছে, একজন অনেস্ট নেতার কন্যা আমাদের দলের কর্মী হয়ে যোগ দিচ্ছেন। তাকে স্বাগত জানাই।’
রাজনীতি করার খবর মায়ের কাছে গোপন রেখেছিল সিন্ধুরা। তাও খবর পৌঁছল। নয়নতারার শরীর দিন-দিন খারাপ হচ্ছে। অল্প খাটাখাটনিতেই হাঁপিয়ে পড়ছে। একটু কাজ করেই খাটে শুয়ে পড়ে। রোগা যেমন হয়েছে, মুখ-চোখ কালোও হয়েছে। শুধু শরীরের অসুখবিসুখ নয়, সংসারের দু্শ্চিন্তাও তাকে অসুস্থ করে তুলছে। সিন্ধুরা জোর করে মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছে। গাদাখানেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে বলেছেন ডাক্তারবাবু। নয়নতারা অত টাকা খরচ করতে রাজি নয়। সিন্ধুরা বলেছিল, ‘টাকার কথা তোমায় ভাবতে হবে না।’
নয়নতারা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘আমি করব না তো কে করবে? আমার দুই রত্ন?’
সিন্ধুরা হেসে বলেছিল, ‘আমার উপর তো জন্ম থেকেই রেগে আছ মা। আমার নিপাট ভালমানুষ দাদাটি কী দোষ করল?’
নয়নতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘না, সে দোষ করেনি, দোষ আমার। আমি দোষ না করলে তার কেরিয়ার এরকম হয়? বড় বড় কথা বলে বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেল। কী হল? না করতে পারল ব্রিলিয়ান্ট রেজ়াল্ট, না পেল একটা ঠিকমতো কাজ। ভিখিরির মতো খুঁটে খায়।’
সিন্ধুরা বলল, ‘একই কথা তোমাকে কতবার বলব মা? কাজকর্মের অবস্থা খুব খারাপ।’
‘চুপ কর। খুব খারাপ হলে এত ছেলেমেয়ে কাজ পাচ্ছে কোথা থেকে?’
সিন্ধুরা বলল, ‘পাচ্ছে কই? দেখছ না ইঁট-বালি-সুরকির সাপ্লাই, নদীখাত থেকে বালি চুরি করা, খুব বেশি হলে নেতা-টেতা ধরে কনট্রাক্টরি।’
নয়নতারা বলে, ‘তোর দাদা তো এসবও পারে না। পারলে দুটো পয়সা আসত ঘরে। বাড়ির একমাত্র ছেলে যদি এমন গাধা, আনস্মার্ট হয়, তবে পরিবারের সবাইকে না খেয়েই মরতে হয়।’
সিন্ধুরা হেসে বলল, ‘সবাই সব পারে না। নিজের ছেলেকে তুমি চেনো না? সে একটা ভদ্রস্থ চাকরি করার ছেলে। বাবার মতো।’
নয়নতারা এবার নিজের মনেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
‘বাবার মতো... বাবার মতো করেই তো সংসারটা ছারখার হয়ে গেল। ছেলে বাবার মতো ভদ্র হতে গেল, মেয়ে বাবার মতো রাজনীতি শিখল। বাড়ির আর একজনের কথা কারও মনে রইল না। একবার ভাবল না, সে কীভাবে সংসার চালাবে, কোথা থেকে টাকা পাবে? দুনিয়ার সবাই যখন কেরিয়ার গোছাচ্ছে, রোজগার গোছাচ্ছে, গাড়ি-বাড়ি গোছাচ্ছে, আমার ছেলেমেয়ে দুটো বাবার ফোটো বুকে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী আছে তোদের বাবার? কোন কীর্তি করেছে সে? বিয়ে করেছে, ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছে। তারা কীভাবে বড় হবে সেকথা ভাবেনি কখনও। সব এই মহিলার ঘাড়ে চাপানো ছিল। নিজে অফিস আর পার্টি পলিটিক্স নিয়ে সর্বক্ষণ বাইরে থেকেছে বলে আমি একটা চাকরি পর্যন্ত করতে পারিনি। রাতেও বাড়িতে পার্টির লোক এনে মিটিং করত। তখন মনে হয়েছে, আমি বেরোলে সংসারের কী হবে? ছেলেমেয়ে মানুষ করবে কে? আর সুবিধেমতো একটা চাকরিও তো বউকে করে দিতে পারেনি। পার্টির কে গোছায়নি? ঘরের কাছে বউয়ের চাকরি, শালির চাকরি, ভাইয়ের ব্যবসা সবই তো করে নিয়েছে। অনেস্টি শুধু শাশ্বত সেনগুপ্তর বেলায়? অনেস্টি না ছাই। ভয়...ভয়।’
চুপ করে রইল সিন্ধুরা। এই মানুষটা তার মা, তাকে আদরে-যত্নে বড় করেছে, নিজের সাধ্যমতো আবদার মেনেছে যতটা সম্ভব, আগলে রেখেছে বিপদে-আপদে, তারপরেও যেদিন সেই ঘটনার কথা শোনে, সেদিন থেকেই মনে মনে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। প্রথমে ছিল রাগ-অভিমান, তারপর এসেছে এক ধরনের নিস্পৃহতা। বাবার বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদ্গার মায়ের থেকে সিন্ধুরাকে আরও দূরে সরিয়েছে। তারপরেও সে মাঝেমধ্যে বোঝানোর চেষ্টা করে। বোঝানো? নাকি প্রতিবাদ?
‘এই ভয়টাই সততা। খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়। আমার বাবার মতো খুব কমজনের মধ্যেই এই ভয় থাকে। তুমি আমার চেয়ে সেটা বেশি জান। আর আমার রাজনীতি করাটা তো আমার বিষয়। সেটা নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করবে না, করলেও আমার কিছু আসে যায় না। বাবা করত বলেই যে আমি রাজনীতি করছি এমনটা নয় মা, আমিও রাজনীতি করতে চাই বলেই করছি। বরং বলতে পারো বাবা আমাকে অন্যভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। বাবা যদি চাইত, তার নিজের বাড়িটা এমন ইনকমপ্লিট হয়ে পড়ে থাকত না। এমন সময় সে এমন দলের হয়ে রাজনীতি করেছে, যখন নেতাদের বাড়ি তৈরির জন্য টাকার অভাব হওয়ার কথা নয়। আর সেরকম কিছু হলে তুমিই বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি হতে।’
মাকে এত কড়া ভাষায় জবাব দিলেও দাদার বেলায় সিন্ধুরা ছিল অনেকটাই নরম। শান্ত, ভিতু, মুখচোরা দাদাকে বোন হিসেবে যতটা স্বাভাবিক ভালবাসা যায়, তার চেয়ে যেন খানিকটা বেশি ভালবাসে। নিষাদ বোনের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ায় ভয় পেয়েছিল।
‘তুই কি পাগল হলি সিন্ধু! পলিটিক্স করছিস!’
সিন্ধুরা বলেছিল, ‘কেন, কলেজেও তো করেছি।’
নিষাদ বলেছিল, ‘সে অল্প বয়সে যা হওয়ার হয়েছে। তখন রক্ত গরম ছিল। এখন বড় হয়েছিস।’
সিন্ধুরা হেসে ফেলে বলেছিল, ‘বাবাও তো বড় বয়সে রাজনীতি করেছে।’
নিষাদ বলল, ‘সেই সময়টা অন্যরকম ছিল। এখন পলিটিক্স খুব খারাপ হয়েছে। শুধু হাঙ্গামা, মারপিট। যে যার লাভ দেখে। নীতি-আদর্শ বলে কিছু আছে নাকি? তা ছাড়া তুই যে দলে ঢুকেছিস, তাদের তো এখন কোনও ক্ষমতা নেই। লোকও নেই। মার খাবি।’
সিন্ধুরা বলল, ‘মার খাওয়ার জন্যও তো দলে লোক লাগে। তুই চিন্তা করিস না। সুরুলপুরে আমাকে কেউ মারতে পারবে না। তা ছাড়া... আমাদের মতো পুরনো অপোনেন্ট না থাকলে বিপদ। নতুন কেউ জায়গা নেবে। তাই পার্টি অফিস খুলতে দিয়েছে। বেশি কিছু করতে পারি না, তবে খানিকটা তো করছি। তুই এসব নিয়ে মোটে ভাববি না দাদা। এটা তোর সাবজেক্ট নয়।’
নিষাদ বলল, ‘তোর বিপদ হলে ভাবব না!’
সিন্ধুরা হেসে বলল, ‘দুর, বিপদ কোথায়? বাবা-মায়ের কিছু স্বভাবচরিত্র তো ছেলেমেয়েদের মধ্যে থাকবেই। থাকবে না? আমি না হয় বাবার রাজনীতির করার স্বভাবটাই নিলাম।’
নিষাদ অন্যের বিষয়ে কখনওই নিজের মত বেশি প্রকাশ করতে পারে না। করেও না। সিন্ধুরার বেলাতেও চুপ করে গেল।
আজ অবশ্য অগ্নীশের ঘরে সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়ার জ্বালাতন নেই। কারণ আজ এসেছে মাত্র দু’জন। সিন্ধুরা আর শাম্ব। বাকিরা নানা কারণে আসতে পারেনি। অগ্নীশ পার্টির বই-পত্রিকা নেড়েচেড়ে সরিয়ে রাখল।
‘আজ ক্লাস থাক। অন্য একটা জরুরি কথা বলি। তোমরা নিশ্চয়ই জান সুরুলপুরের ডাকবাংলো মোড়ে একটা মুভমেন্ট চলছে। জান তো?’
শাম্ব বলল, ‘যাতায়াতের পথে দেখেছি, কয়েকজন ছোটখাটো প্যান্ডেল বেঁধে বসে আছে, তবে বিষয়টা জানি না।’
অগ্নীশ ভুরু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলল, ‘সে কী! জান না কেন? নিজেদের ইউনিট এলাকায় কিছু পুরুষ-মহিলা পথে বসে আন্দোলন করছে, কারণ জানবে না?’
শাম্ব অগ্নীশের বিরক্তিতে থতমত খেয়ে বলল, ‘আমাদের পার্টির কর্মসূচি নয় তো।’
অগ্নীশ আরও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমাদের আমাদের করেই পার্টির সর্বনাশ হয়েছে। আমাদের পার্টির না হলে, আমাদের লোক না হলে এই দুনিয়ায় যেন কোনও দাম নেই। এই অভ্যেস আর কবে যাবে বলতে পার? এখনও শিক্ষা হল না।’
এমন সময় সিন্ধুরা বলল, ‘আমি জানি অগ্নীশদা। ওখানে চাকরির ব্যাপারে একটা মুভমেন্ট হচ্ছে। সরাসরি কোনও পলিটিক্স নেই। যারা বসে আছেন, তারাও কোনও পার্টি পলিটিক্স চান না বলে শুনেছি। ওদের মূল ডিমান্ড চাকরিতে পার্মানেন্ট করা আর বেতন বাড়ানো। আমাদের এক প্রতিবেশী বাঁশরীদিও ওখানে ধর্নায় বসেছে। ওর মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তখন আমি সব জেনে নিয়েছি।’
অগ্নীশের চোখদুটো উজ্জ্বল উঠল। বলল, ‘ভেরি গুড সিন্ধুরা। খুব ভাল। এটাই আমি চাই। শুধু নিজেদেরটুকু নয়, সবার ক্ষোভ-বিক্ষোভের খবরই আমাদের রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দলের কর্মীরা আর পাঁচটা দলের মতো নয়, তারা আলাদা। সবার কথা ভাবে। আগে যা বলা হত, সব ভুলে যেতে হবে। যাই হোক, এবার কাজের কথায় আসি।’
বেতের চেয়ারে বসার ব্যবস্থা। তবে তিনজনের বেশি হলে মাটিতে মাদুর পাতা হয়। ঘরের এককোনায় চায়ের ইলেকট্রিক কেটল রাখা। পাশে কৌটোতে চা, চিনি আর কাগজের কাপ। নিজেদেরই চা করে নিতে হয়। মুড়ি, বাদাম এক-একদিন এক-একজন নিয়ে আসে। কোনও-কোনওদিন অগ্নীশ গলির মোড় থেকে গরম চপও আনায়। বিশেষ করে বৃষ্টির সময়। অগ্নীশ স্কুলে মাস্টারি করে। অঙ্কের মাস্টার। এক সময়ে পার্টি থেকে তাকে চাকরি ছেড়ে হোলটাইমার হওয়ার জন্য বলা হয়। ডিভোর্সের পর। পার্টি তখনও ক্ষমতায়। বলা হয়েছিল, ‘তুমি একা মানুষ। চাকরির প্রয়োজন কী?’ অগ্নীশ দ্বিধার মধ্যে ছিল। তারপরে চাকরি ছাড়ার জন্য মনস্থির করে। আর তখনই রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। কিছুদিন পর পার্টি এমনই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়ে যে কাউকে নতুন করে হোলটাইমার করা তো দূরের কথা, পুরনো কর্মীদের রাখাই কঠিন হল। অনেকে পার্টি ছাড়তে থাকে। অগ্নীশের আর চাকরি ছাড়া হয় না। চাকরি করেই রাজনীতি করতে থাকে। ফলে এদের মধ্যে টাকাপয়সা একমাত্র তারই রয়েছে।
একটা চেয়ারে বেত ছিঁড়ে গিয়েছে। ক’দিন ধরেই বসতে অসুবিধে হয়। অগ্নীশ চেয়ার ছেড়ে দিয়ে নিজে মোড়া নিয়ে বসেছে। সেই মোড়া এগিয়ে নিয়ে উত্তেজিত অথচ চাপা গলায় বলল, ‘ওই যে মুভমেন্ট হচ্ছে, কয়েকজন ধর্নায় বসেছে, এর মধ্যে আমাদের ঢুকতে হবে।’
শাম্ব বলল, ‘কী করে ঢুকব? ওরা তো চায় না।’
অগ্নীশ বলল, ‘চাওয়াতে হবে। পার্টির লোক নয়, বন্ধু সেজে কাছে যেতে হবে।’
শাম্ব একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘সুরুলপুর ইউনিট কি মেনে নেবে?’
অগ্নীশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘শাম্ব, এটা সুরুলপুর ইউনিট নয়, এখানে অগ্নীশ পালের কথাই ফাইনাল। তোমরা রাজি কিনা বল।’
শাম্ব কিছু বলার আগেই সিন্ধুরা বলল, ‘আমি রাজি। কী করতে হবে বলুন।’
অগ্নীশ সিন্ধুরার চোখের দিকে তাকাল। পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল বেশ কয়েক মুহূর্ত। সিন্ধুরার শরীরের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল! এই দৃষ্টিতে এক ধরনের হাতছানি রয়েছে।
অগ্নীশ গাঢ় স্বরে বলল, ‘সাবাস।’
সিন্ধুরা নিজেকে সামলে, ঘোর কাটিয়ে বলল, ‘কী করতে হবে?’
অগ্নীশ ষড়যন্ত্রের ঢঙে বলল, ‘তোমাকে ওই বাঁশরীদির কাছে যেতে হবে সিন্ধুরা। প্রতিবেশী হিসেবে যেতে হবে। একদিন নয়, পরপর তিনদিন যেতে হবে। ভাবটা এমন থাকবে যেন, তুমি ওদের এই বিক্ষোভ নিয়ে খুব চিন্তিত। ওদের লিডারকে খুঁজে বার করতে হবে। তিনদিনের মাথায় বোঝাতে হবে, এভাবে শান্ত হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কোনও লাভ নেই। কেউ জানতে পারবে না, দাবিদাওয়া তো মিটবেই না। একটাই পথ, গোলমাল পাকাতে হবে।’
সিন্ধুরা চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘ওরা আমার কথা শুনবে কেন?’
অগ্নীশ ঠোঁটের কোনায় হেসে বলল, ‘সেটাই তো তোমার পরীক্ষা সিন্ধুরা। পলিটিক্স করা মানে শুধু নেতাদের বেঁধে দেওয়া মিটিং, মিছিল নয়। নিজেকেও স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হয়। এটাও সেরকম। তুমি অভিনয় করবে। তিনদিনের জন্য ওদের একজন হয়ে যাবে। এটা একধরনের গেরিলা অপারেশন বলতে পার। বিশ্বের সর্বত্র এই ঘটনা ঘটেছে। আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলো একাজ করেছে। বড় লিডাররা ক্যামোফ্লেজ করে অন্যদের আন্দোলনে ঢুকে পড়েছে। সেই মুভমেন্টকে নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে এসেছে, অথবা তাকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। কাজটা কঠিন, তাও হাল ছাড়েনি। তোমার মধ্যে সেই গুণ, সেই ডেডিকেশন রয়েছে সিন্ধুরা। তুমি পারবে।’
অগ্নীশের বলার ঢঙে এমন একটা কিছু রয়েছে, সিন্ধুরা এক ধরনের রোমাঞ্চের মধ্যে ঢুকে গেল। সেও তবে লিডারদের মতো!
শাম্ব বলল, ‘আমাদের লাভ কী?’
অগ্নীশ উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘গোলমাল পাকানো। চারপাশে যত গোলমাল পাকবে, আমাদের সুবিধে। এটা তোমার সুরুলপুরের প্রাচীনপন্থী লিডাররা বুঝবে। বলশেভিক পার্টির ইতিহাস যদি পড়...যাক, সেকথা আর একদিন হবে। সিন্ধুরা আজ ফিরে গিয়েই তুমি কাজ শুরু করে দাও। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। মনে রাখবে, এটাও পার্টির কাজ। এর মূল্যায়ন আজ হবে না। হবে অনেক বছর পরে। তখন সবাই বলবে, অগ্নীশ পাল ঠিক করেছিল।’
অগ্নীশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শাম্ব একটু এগিয়ে পড়ে। সে অন্যমনস্ক। ঘাবড়েও গিয়েছে। সিন্ধুরা দরজার বাইরে পা রাখার সময় তার কাঁধে হাত রাখল অগ্নীশ। চমকে উঠল সিন্ধুরা। অগ্নীশ ফিসফিস করে বলল, ‘ভয় নেই, আমি তো আছি। একদিন একা এসো। আরও ভাল করে সব বুঝিয়ে দেব। এই অ্যাসাইনমেন্টে আর কাউকে নেওয়ার দরকার নেই, তুমি একাই পারবে।’
দহলা স্টেশন ঢুকতেই মোবাইল বেজে উঠল। নিষাদ। বুকটা ধক্ করে উঠল সিন্ধুরার। দাদার আজ চাকরিতে জয়েন করার কথা। তাকে তো বলেইছে, মাকেও জানিয়েছে।
‘কাল জয়েন করেই খবর দেব। জান মা, স্যার বলেছেন, প্রথমদিন থেকেই কাজের মধ্যে ফেলে দেবেন। ভয় করছে। আমি কি পারব?’
নয়নতারা অবাক হয়ে বললেন, ‘স্যার! স্যারটা কে?’
টেলিফোনের ওপার থেকে নিষাদ বলল, ‘বাঃ কাল থেকে যিনি আমার বস হবেন, তাকে স্যার বলব না?’
নয়নতারা গজগজ করে ওঠেন, ‘ইস্, কী আমার বস রে। তাহলেও বলার মতো একটা চাকরি হলে কথা ছিল।’
নিষাদ বলে, ‘মা, কোম্পানি কিছু ছোট নয়। তা ছাড়া, সিভিতে তো নামটা দিতে পারব। আবার যখন কোনও অ্যাপ্লিকেশন দেব, কাজে লাগবে। এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া আজকাল কেউ পাত্তা দেয় না।’
বোনকে নিষাদ চাকরি ছাড়াও আর একটু বেশি বলেছিল।
‘চাকরি ছাড়াও আর একটা খবর রয়েছে সিন্ধু।’
‘কী খবর?’
‘খুব গোপন খবর। কেউ জানে না।’
‘তাহলে আমাকেও বলতে হবে না। কেউ যখন জানে না, আমিই বা কেন জানব।’
বোনের অভিমানের কথা বুঝতে পেরে নিষাদ বলেছিল, ‘সিন্ধু, কাল আমি আর মেঘপর্ণা রেজিস্ট্রি করছি।’
সিন্ধুরা লাফিয়ে উঠেছিল।
‘কী বলছিস্ দাদা! তুই বিয়ে করছিস্? সাংঘাতিক ব্যাপার। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
নিষাদ বলল, ‘আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। জানি খুব ভুল করছি, কিন্তু উপায় ছিল না কোনও। মেঘপর্ণাই চাপাচাপি করল। ওর জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। যে কোনও দিন বিয়ে হয়ে যাবে।’
সিন্ধুরা বলল, ‘উফ্ এ তো সিনেমার মতো রে! আমিও কলকাতায় যাব, হোটেলে থেকে তোর বিয়ে দেব।’
নিষাদ তাড়াতাড়ি বলল, ‘খবরদার নয়, একেবারে নয়। সই-টই করতে দশ মিনিটও নেব না। মেঘপর্ণা বন্ধুর বাড়ি যাবে বলে বেরোবে।’
‘মাকে বলেছিস?’
নিষাদ বলল, ‘তুই কি পাগল হলি?’
সিন্ধুরা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ দাদা। আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছি। তোর মতো রামভিতু ছেলে এমন একটা সাহসের কাজ করছিস, আমি ভাবতেই পারছি না। এই জন্যই মনীষীরা বলেছেন, কার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে কে বলতে পারে? সারাজীবন মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে বোমা ফাটালি।’
নিষাদ বলল, ‘চাকরিটা পাচ্ছি বলেই খানিকটা জোর পেয়েছি।’
সিন্ধুরা হেসে বলল, ‘আমার ক্যাবলাচন্দর দাদা, দয়া করে কি আপনি আমার বউদি, সরি ভাবী বৌদির ফোন নম্বরটা একটু দেবেন? ওর সঙ্গে একটু আলাপ করব। জানতে চাইব, আমার দাদার মতো একজন ভালমানুষকে বিয়ে করার মতো বোকামি উনি কেন করছেন?’
নিষাদ বলল, ‘এখন একদম এসব নয়। রেজিস্ট্রির দিন সব হয়ে গেলে ফোনে ধরিয়ে দেব।’
নিষাদের নম্বর দেখে সিন্ধুরার সব মনে পড়ে গেল। নিশ্চয়ই দুটো ভাল খবর এসে গেল।
‘কনগ্র্যাচুলেশনস দাদা।’
ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলায় নিষাদ বলল, ‘চাকরিটা হয়নি রে সিন্ধু।’
দু’হাতে ফোনটা চেপে ধরে সিন্ধুরা বিড়বিড় করে বলল, ‘আর মেঘপর্ণাদি...’
নিষাদ শুকনো হেসে বলল, ‘সে ফোন ধরেনি। সময় চলে গিয়েছে।’
বিকট হুইসল বাজিয়ে স্টেশন কাঁপিয়ে মেল ট্রেন চলে গেল। এইসব ছোটখাটো অকিঞ্চিৎকর স্টেশনে বড় ট্রেন থামে না।