নিষাদ – ৪

এখন বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে। মেঘপর্ণা নিজের ঘরে। সে বসে রয়েছে খাটের উপর। মুখ ফ্যাকাসে। দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা এক পা, এক পা করে সরছে, আর বুকের ভিতর ধড়াস করে উঠছে মেঘপর্ণার।

মেঘপর্ণার মুখ ফ্যাকাসে হওয়াটাই স্বাভাবিক। খানিক আগে যা ঘটেছে, তাতে মুখ ফ্যাকাসে তো সহজ বিষয়, আরও বড় কিছু হলেও আশ্চর্যের ছিল না। মেঘপর্ণার ধারণা, খুব শিগগিরই আরও বড় কিছু ঘটবে। বাবা বাড়ি ফিরে এলেই ঘটবে। এই বয়সে মারধোর হবে না, কিন্তু যা হবে তা মারধোরের চেয়ে কম কিছু নয়। এই মানুষটা শীতল গলায় যখন কথা বলে তখনই শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। বাবাকে মেঘপর্ণা ভয় পায়। ছোটবেলা থেকেই। বাবা যে রাগারাগি করত, এমন নয়। কখনও মেয়ের গায়ে হাতও তোলেনি, তারপরেও কড়া নিয়মের একটু এদিক ওদিক হলে মেয়েকে ডেকে শীতল গলায় প্রশ্ন করে।

‘তুমি কি কাল বাড়ি ফিরতে দেরি করেছিলে?’

‘বাবা, কাল আমাদের কোচিং স্যার দেরি করে ছেড়েছেন।’

‘কেন? দেরি করে ছেড়েছেন কেন?’

‘কাল ‌উনি কেনসের অর্থনীতি বোঝাচ্ছিলেন। বিষয়টা কঠিন। বুঝতে সময় লাগছিল।’

‘কেনস না কী নাম বললে, ওই ভদ্রলোকের অর্থনীতি কি রাত ন’টার সময় বোঝাতে হয়? আগে বোঝানো যায় না?’

মেঘপর্ণা মাথা নামিয়ে রইল। কী উত্তর দেবে সে?

‘তুমি কি তোমার স্যারকে বলেছিলে, আমার রাত হয়ে যাচ্ছে? এবার আমাকে ছেড়ে দিন। আমার বাড়িতে চিন্তা করবে…’

মেঘপর্ণা মাথা নামানো অবস্থাতেই অস্ফুটে বলল, ‘না বলিনি। তবে মাকে তো ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, দেরি হবে।’

‘মাকে জানালে কি রাত ন’টা সন্ধে ছ’টা হয়ে যায়? তুমি তোমার টিচারকে বলোনি কেন? তুমি জানো না, এখন দিনকাল কত খারাপ? পথেঘাটে মেয়েদের বিপদ নিয়ে চলাফেরা করতে হয় জানো না তুমি? কিছু ঘটে গেলে কে তোমাকে বাঁচাবে? ওই যে কী নাম বললে কেনস সাহেব না কী, উনি?’

‌মেঘপর্ণা আবার বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যারের কোনও দোষ নেই, আমরাই বুঝতে পারছিলাম না। ফিস্‌কাল পলিসি নিয়ে কেনস সাহেব খুব বড় কাজ করেছেন। বড় আর জটিল।’

মেয়েকে থামিয়ে সুবিমল দস্তিদার‌ বললেন, ‘কেনস সাহেব বড় কাজ করতে পারেন, তোমার কোচিং স্যার দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেছেন। আরও একদিন যদি উনি এমন করেন, তাহলে তুমি ওখানে যাওয়া বন্ধ করবে। নতুন কোনও কোচিং ঠিক করবে।’

মেঘপর্ণা কাঁপা গলায় বলল, ‘বাবা, উনি খুব ভাল পড়ান।’

সুবিমল গলা আরও শীতল করে বললেন, ‘এটা কোনও কথা হল না মা। আমাদের এখানে আর কিছু পাওয়া না যাক, ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল, কলেজ, ‌কোচিং সেন্টার আর প্রাইভেট টিউটর পাওয়া যায়। এসব কেন পাওয়া যায় জানো? দুটো কারণে। এক, শিক্ষিত বেকারদের টিউশন ছাড়া কিছু করার নেই। আবার ছেলেমেয়েদের নানারকম পড়া ছাড়াও অন্য কোনও কাজ নেই। যতদিন লেখাপড়া, নানা রকম ট্রেনিংয়ের খেলা চালানো যায় তত সুবিধে। সুতরাং টিউটর পাওয়াটা কোনও সমস্যা নয়।’

বাবার এই শাসনে মেঘপর্ণা অস্থির হয়ে থাকে। মাও তাই। এক কাঠি বেশি। মেঘপর্ণা অবশ্য বাবার মতো মাকে ভয় পায় না। মুখে মুখে তর্ক করে।

‘আজকালকার দিনে এরকম চলে না মা। এটা তোমাদের যুগ নয়। এটা আধুনিক সময়। মেয়েরা এখন ছেলেদের সমান, অনেক ব্যাপারে বেশিও। তারা গোটা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার চেনাজানা তিনজন বিদেশে গবেষণা করতে গিয়েছে। তাদের সঙ্গে কি তাদের বাবা-মা গিয়েছে? ‌কোনও সমস্যায় পড়লে তারা নিজেরাই সলভ করে। নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা মেয়েদের এখন আছে মা।‌’

সংযুক্তা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ‘রাখ তোদের আধুনিক সময়। কত আধুনিক তো দেখতেই পাচ্ছি। মেয়েদের মুখে অ্যাসিড ছুড়ছে, রেপ করে পুড়িয়ে মারছে। মেয়েরা সমানে সমানে, দুনিয়া কাঁপাচ্ছে, ওসব বড় বড় কথা ফেসবুকে লিখবি, আমাকে শোনাতে আসিস না। আমাদের সময়টা অনেক ভাল ছিল। তখন আর যাই হোক, এরকম ছিল না। মেয়েদের হাতে লঙ্কাগুঁড়ো নিয়ে পথে বেরোতে হত না। জামাকাপড় ছোট পরলেই সমাজ আধুনিক হয়ে যায় না পর্ণা।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘আমি তো ছোট জামাকাপড় পরি না, যারা পরে তারাও নিজের ইচ্ছেতেই পরে। এর সঙ্গে ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটির কোনও সম্পর্ক নেই। শর্ট স্কার্ট, লং স্কার্ট সবেতেই অপরাধ করবে।’

সংযুক্তা বলল, ‘ওসব আমার শুনে লাভ নেই, আমরা আমাদের মেয়েকে আমাদের মতোই মানুষ করব। আড়ালে সবাই তাই করে।’

এই বাবা-মায়ের মেয়ে হয়ে কীভাবে যে সে প্রেম করল, ভেবে অবাক হয় মেঘপর্ণা। স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ে গাড়িতে যাতায়াত করেছে। যেটুকু ছাড় ছিল, তাও কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কখন ফেরা— সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে, তবে অনুমতি মিলেছে। এখন কলেজ যেতে হয় না, ফলে এখন তো আরও নজরদারি। এমন নয় বাড়ি থেকে বেরোনোয় নিষেধাজ্ঞা, তবে গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। সংযুক্তাও মোবাইলে অবিরত যোগাযোগ রাখে।

‘এখন কোথায়? সঙ্গে কে?’

তবে একটা রক্ষে ছিল, মেয়ের মোবাইল ফোন নিয়ে তার বাবা-মা কখনও ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। মেয়ের গোপনীয়তায় তাদের কোনও উৎসাহ নেই, তাদের উদ্বেগ নিরাপত্তা নিয়ে।

নিষাদের সঙ্গে মেঘপর্ণার আলাপ হয়েছিল বড় অদ্ভুতভাবে। সেবার কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশনের সুভেনিয়র তৈরির দায়িত্বে ছিলেন নন্দিতা ম্যাডাম। তিনি কাজে সাহায্যের জন্য একটা টিম করে দিলেন। সেই টিমে ফাইনাল ইয়ার থেকে মেঘপর্ণাকেও রাখা হল। মেঘপর্ণার তো খুব উৎসাহ। নানা ধরনের লেখা জোগাড়ের পর ম্যাডাম ঝাড়াইবাছাই করে দিতেন। সেগুলোকে নিয়ে যেতে হত প্রেসে। তারপর প্রুফ নিয়ে আসা। প্রেস থেকে বলেছিল, প্রুফ দেওয়া-নেওয়ার জন্য তারাই লোক পাঠাবে, নন্দিতা ম্যাডাম রাজি হননি। প্রেসের লোক সময় ঠিক রাখতে পারবে না। ইচ্ছে করে দেরি করবে, হয়তো ক্লাসের সময়ে এসে হাজির হবে। নিজেরা হাজির হলে তাড়াতাড়ি কাজটা করে দেওয়ার চাপ থাকবে। প্রেস কলেজের কাছে, ফলে যাতায়াতে কোনও সমস্যা ছিল না। এ গলি সে গলি দিয়ে যাওয়া যেত। এই কাজটায় মজা পেয়েছিল মেঘপর্ণা। ওই সময়টুকু অন্যরকম স্বাধীনতা। প্রেসে যাতায়াতের সময় ওর সঙ্গে যেত হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের উষ্ণি। ‘ভূতে পাওয়া’র মতো উষ্ণি ছিল একজন ‘প্রেমে পাওয়া’ মেয়ে। ফাইনাল ইয়ারে পড়লেও তার ঝুলিতে প্রেমের অভিজ্ঞতা ছিল অজস্র। প্রেসে যাওয়ার পথে সেইসব গল্প শোনাত। তার মধ্যে শরীরও থাকত। চুমু তো ছিলই, তার চেয়ে বেশিও ছিল। উষ্ণির মত, শরীর না বুঝলে মন বোঝা যায় না। বান্ধবীরা মজা পেয়ে বলত, ‘তুই কী করে এত সব গোপন কথা বুঝলি?’

উষ্ণি বলে, ‘বুঝলাম ছেলেগুলো বেশিরভাগই ভেদামারা, আমার অযোগ্য। মুখে এক, শরীরে আর এক।’

বান্ধবীরা আরও হাসে। বলে, ‘ছেলেরা কেমন হলে তোর যোগ্য হত?’

উষ্ণি সহজভাবে বলে, ‘যতক্ষণ আমি চাইব, ততক্ষণ আদর চালাতে হবে।’

কেউ এই মেয়ের কথার তেমন বিশ্বাস করত না। তারা মনে করত, প্রেম নয়, এসব হল উষ্ণির প্রেমের বাতিক। আর গল্পগুলো হল উষ্ণির কল্পনা, ফ্যান্টাসি। তবে ফ্যান্টাসি হলেও শুনতে ভাল। ছেলেরা কীভাবে মেয়েদের শরীর চায়, সেই ফিরিস্তি শুনতে শুনতে প্রেস পর্যন্ত চলে যেত মেঘপর্ণা। কাজ অনেকটা এগোনোর পর, প্রেসের বয়স্ক মালিক বলাইবাবু একদিন বললেন, ‘তোমরা এর পরদিন নিষাদের সঙ্গে কথা বলে নিও। ও তোমাদের লেখায় গোলমাল পেয়েছে। সে নাকি সিরিয়াস ভুল। আজই চাকরির পরীক্ষা দিতে চলে গিয়েছে।’

নিষাদ!‌ সে আবার কে? কলেজের কাজে সে ভুলই বা ধরতে যাবে কেন?

উষ্ণি রেগে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ভুল!‌ কীসের ভুল? বানান?’

প্রেসের মালিক বললেন, ‘বলতে পারব না। কী যেন বলছিল। আমি অতশত বুঝি না।’

উষ্ণি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘নিষাদটা কে?’

‘আমাদের প্রেসের প্রুফ দেখে। ক্লাবের পুজোর হিসেব, ফুটবল টুর্নামেন্টের সুভেনিয়র এলে লেখাটেখা দেখে দেয়।’

ঠোঁট বেঁকিয়ে উষ্ণি বলল, ‘আমাদের ভুল আমরা বুঝে নেব। কারও সঙ্গে দেখা করতে হবে না। মনে রাখবেন, এটা ফুটবল ক্লাবের হিসেব নয়, কলেজের পত্রিকা। আপনার অবসাদবাবু না কী যেন নাম বললেন? ওঁকে বলে দেবেন, এতে যেন বিশেষ নাক না গলান। আমাদের ম্যাডাম দেখেশুনেই লেখা ছাপতে পাঠাচ্ছেন।’

এর তিনদিন পর একাই গিয়েছিল মেঘপর্ণা। সেদিনই প্রথম তার দেখা হল নিষাদের সঙ্গে। এক কোনায় টেবিলে বসে মাথা নামিয়ে প্রুফ দেখছিল। জায়গাটা একটু অন্ধকার মতো। মানুষটাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। প্রেসের মালিক তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই যে নিষাদ, কলেজ থেকে এসেছে। তোমার ভুলের কথা বলতে গিয়ে এদের কাছেই গাল খেয়েছিলাম। তুমি মিটিয়ে নাও বাপু।’ তারপর‌ মেঘপর্ণাকে বলল, ‘যাও ওই টেবিলে গিয়ে ফয়সালা করে নাও। পরে আমি কিন্তু তোমাদের ম্যাডামের কথা শুনব না। ‌গতবার এরকম একটা ঝামেলা হয়েছিল। বিল আটকে যায় আর একটু হলে।’

নিষাদ কাজ থামিয়ে মুখ তুলল। মেঘপর্ণা থমকে যায়। নিষাদের মায়াকাড়া চোখ, এলোমেলো চুল, বিষণ্ণ চাউনি তার সব গোলমাল করে দিল যেন।

‘কী বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।’

বলাইবাবু বললে, ‘আরে সেদিন নিষাদের কথা বলতে তোমার বন্ধু দু’কথা শুনিয়ে দিল না? নিষাদকে তাই বলছি। ওই তো এখানে এসে মাঝেমধ্যে লেখালিখি দেখে দেয়। ভুল হলে ঠিক করে। তোমাদের কাজেও ভুল ধরেছে।’

মেঘপর্ণা এবার নিজেকে সামলে লজ্জিতভাবে বলল, ‘ওহ্‌ মনে পড়েছে। সরি, উষ্ণি ওরকমই মেয়ে। কী বলতে কী বলে ফেলে। কিছু মনে করবেন না,’ তারপর‌ নিষাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে বলুন, কী ভুল হয়েছে।’

কলেজে নিষাদ মেয়েদের সঙ্গে পড়েছে। এড়িয়ে চললেও সুন্দরী মেয়ে দেখে সে অভ্যস্ত। ঐশানী চ্যাটার্জিকে তো এড়াতেও পারত না। তারপরেও মেঘপর্ণাকে দেখে থতমত খেল।

‘না না, সেরকম কিছু নয়.‌.‌.‌’

নার্ভাস হওয়া যুবকটিকে দেখে মেঘপর্ণা এবার মজা পেল। আত্মীয়-পরিজনদের বাইরে ছেলেদের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা কম। মেয়েদের কলেজে পড়ে। ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়নি, ইচ্ছেও নেই। তা ছাড়া ছেলেদের সম্পর্কে ধারণা তার ভাল নয়। নানারকম ঘটনা কানে আসে। এই তো ক’দিন আগে তাদের ক্লাসের সপ্তদীপারও হয়েছে। মাসতুতো বোনের সঙ্গে বয়ফ্রেন্ডের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল বেচারি। সেই ছেলে এখন সপ্তদীপাকে ভুলে তার সেই বোনের সঙ্গে সিনেমায় যাচ্ছে। সপ্তদীপা তো কেঁদেকেটে একসা। মেঘপর্ণা বুঝেছে, এদের থেকে দূরে থাকাই ভাল। কিন্তু এই ছেলেকে অন্যরকম লাগছে কেন? কেমন যেন নার্ভাসও। নামটাও অদ্ভুত। নিষাদ কারও নাম হয়? এই নামের মানে কী?

মেঘপর্ণা নরম গলায় বলল, ‘আপনি বলুন কী ভুল হয়েছে। আমি আমাদের টিচারকে গিয়ে বলব। ম্যাগাজ়িনে ভুল থাকাটা ঠিক হবে না।’

নিষাদ ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হড়বড় করে কাগজ ঘেঁটে একটা পাতা বের করল। ঢোঁক গিলে বলল, ‘একটা লেখায় রবি ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা থেকে কোটেশন দেওয়া হয়েছে।’

মেঘপর্ণা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কোটেশন কি ভুল হয়েছে?’

‌নিষাদ ঢোঁক গিলে বলল, ‘না, ঠিক হয়েছে। আমি বই মিলিয়েছি,’ তারপর এক মুহূর্ত থেমে নিজে থেকেই পড়তে লাগল, ‘কাহারে হেরিলাম!‌ আহা!‌/ সে কি সত্য, সে কি মায়া!‌/সে কি কায়া,/সে কি সুবর্ণকিরণে.‌..‌।’

মেঘপর্ণার হাসি পেল। এই ছেলে শুধু ভিতু নয়, মস্ত বোকাও। সে হাসি সামলে বলল, ‘আপনি আবৃত্তি করছেন কেন!‌‌ আপনার ‌আবৃত্তি শুনে কী হবে? কোটেশনে কোথায় ভুল সেটা বলুন। আমি ফিরে গিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলব। তিনি যা করতে বলবেন তাই হবে।’

নিষাদ আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কোটেশনে তো কোনও ভুল নেই। আমি বই মিলিয়েছি,’ এই বলে টেবিলের একপাশ থেকে আধখানা মলাট ছেঁড়া, পাতা খোলা একটা গীতবিতান তুলে বলল, ‘এই তো বই। আমি নিয়ে এসেছি।’

মেঘপর্ণা আর হাসি চাপতে পারল না। হেসে ফেলে বলল, ‘আমাকে বই দেখাচ্ছেন কেন? আমি কি বই দেখতে চেয়েছি?’

‌নিষাদ তড়িঘড়ি বই নামিয়ে মাথা চুলকে বলল, ‘সত্যিই তো আপনাকে বই দেখাচ্ছি কেন.‌.‌.দুঃখিত.‌.‌.‌ আসলে আপনাদের লেখায় রয়েছে, এই কথা চিত্রাঙ্গদার.‌.‌.‌কিন্তু এ তো অর্জুনের কথা.‌.‌.‌প্রুফ দেখার সময় খটকা লাগল, বাড়িতে গিয়ে বই খুললাম.‌.‌.‌‌’

মেঘপর্ণা এবার গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি ম্যাডামকে গিয়ে বলছি। ফোন করে প্রেসে বলে দেব।’

বলাইবাবু দূরের টেবিলে বসে টাকাপয়সার হিসেব করছিলেন। গলা তুলে বললেন, ‘এসব খটমট ব্যাপারে আমি নেই। মূর্খ মানুষ, নিষাদ, তুমি নিজের ফোন নম্বরটা দিয়ে দাও বাপু। এই যে মেয়ে, তুমি ওকে ডাইরেক্ট বলে দিও। নিষাদ তোমার নম্বর একটা কাগজে লিখে দাও।’

প্রেস থেকে বেরিয়ে মেঘপর্ণা ফোনের নম্বর লেখা কাগজ ব্যাগে রাখতে রাখতে নিজের মনে আবার হেসে ফেলেছিল। ছেলেরা এমন ক্যাবলাও হয়! সব ছেলে হয় না, তবে এই ছেলে অবশ্যই ক্যাবলা।‌ নিজের ফোন নম্বর লিখতেও কাটাকুটি করেছে। মনে হয়, মেয়েকে দিচ্ছে বলে গুবলেট করে ফেলেছে। ছেলেটার চোখদুটো মায়াকাড়া। গলার আওয়াজটাও চমৎকার। ‌

কলেজের ম্যাডাম ঘটনা শুনেই জিভ কাটলেন।

‘ইস্‌, বিচ্ছিরি ভুল, সিলি মিসটেক। প্রেসের‌ ভদ্রলোকের তো বেশ পড়াশোনা রয়েছে দেখছি। এই ভুলটা সবার চোখে পড়ার কথা নয়।’

মেঘপর্ণা তাড়াতাড়ি বলল, ‘প্রেসের মালিক নয়, ওদের একজন স্টাফ, স্টাফ ঠিক নয়, মাঝেমধ্যে এসে প্রুফ টুফ দেখে, সে ধরেছে।’

ম্যাডাম বললেন, ‘তাই নাকি!‌ ‌ভেরি গুড। তুমি এখনই জানিয়ে দাও। ফোন নম্বর আছে না?’

মেঘপর্ণা কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে মাথা নাড়ল। একটু অপেক্ষা করে বলল, ‘আচ্ছা ম্যাডাম, নিষাদ মানে কী?’

‘কী বললে?’

‌মেঘপর্ণা বলল, ‘নিষাদ।’

ম্যাডাম চশমা কপালে তুলে বলল, ‘নিশি শুনেছি, নিষাদ তো মনে পড়ছে না।‌ তুমি বরং তোমাদের বাংলার টিচারকে জিজ্ঞেস কর।’

‌মেঘপর্ণা একটু ভয় পেয়ে গেল। দুম করে প্রশ্নটা করা ঠিক হল না। এখন যদি ম্যাডাম জানতে চান, কেন জানতে চেয়েছে‌? ঠিক তাই হল।

ম্যাডাম বললেন, ‘কেন নিষাদ নিয়ে আবার কী হল? ম্যাগাজ়িনে কোথাও আছে নাকি? ভুল হয়েছে?’

মেঘপর্ণা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না না, তা নয়, শব্দটা শুনলাম, মানেটা জানি না তো, তাই কৌতূহল হচ্ছে।’

ম্যাডাম জানাতে বলেছিলেন বেলা তিনটের সময়, মেঘপর্ণা ফোন করল সন্ধে ছ’টায়। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে, হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে। নিজের ঘরে খাটে বসল হেলান দিয়ে।

‘কে বলছেন?’

গলা শুনে বুকের ভিতরটা কেমন ধক করে উঠল মেঘপর্ণার। চমকে উঠল। কেন এমন হবে? গলার আওয়াজ শুনে বুক ধক করে ওঠে নাকি? কই আগে তো কখনও তার এমন হয়নি।‌‌

‘আমি মেঘপর্ণা।’

‌ওপাশ থেকে অবাক হওয়া গলায় নিষাদ বলল, ‘মেঘপর্ণা!‌ মেঘপর্ণা কে?’

মেঘপর্ণা মজা পেল। বলল, ‘বাহ্‌, এর মধ্যে ভুলে গেলেন!‌ এই তো খানিকক্ষণ আগে দেখা হল।’

‌নিষাদ ওপাশে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘দেখা হল!‌ কার সঙ্গে দেখা হল?’

মেঘপর্ণার হাসি পেল। গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা জবরদস্ত ঘাবড়েছে। মেয়েদের ফোন ধরায় অভ্যস্ত নয়। হাসি সামলে মেঘপর্ণা গলা গম্ভীর করল।

‘কী বলছেন এসব!‌ এই তো দুপুরে দেখা হল। আপনি কত কথা বললেন।‌’

নিষাদ অবাক হয়ে বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বললাম! ‌আমি তো আপনাকে চিনতেই পারছি না।’

মেঘপর্ণা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘আমার নাম মেঘপর্ণা। এবার চিনতে পেরেছেন?’

নিষাদ বিড়বিড় করে বলল, ‘কী বললেন? মেঘপর্ণা.‌.‌. ‌এই নাম তো কখনও আমি শুনিনি।’

মেঘপর্ণা গলায় নাটুকে ভাব এনে বলল, ‘সেটা আপনার সমস্যা। কোন নাম শুনবেন, কোন নাম শুনবেন না, সেটা তো অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে না।’

নিষাদ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি ভুল করছেন। ভুল নম্বরে ফোন করেছেন।’

মেঘপর্ণা হাসি চেপে বলল, ‘তা হলেও সেটা আপনার দোষ। নম্বর আপনি দিয়েছেন। ভুল ঠিকের দায়িত্ব আপনার নিষাদবাবু।’

নিজের নাম শুনে আরও যেন ঘাবড়ে গেল নিষাদ। আমতা আমতা করে বলল, ‘কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।‌’

মেঘপর্ণার মায়া হল। সহজ সরল ছেলেটা এবার টেনশনে অসুস্থ হয়ে না পড়ে। মেঘপর্ণা সহজভাবে বলল, ‘অত চিন্তা করতে হবে না। ভুল কিছু হয়নি, বরং আপনিই ভু‌ল ধরিয়ে দিয়েছেন। আজ আমি কলেজ থেকে ম্যাগাজ়িনের কাজ নিয়ে আপনাদের প্রেসে গিয়েছিলাম। প্রেসের মালিক বলাইবাবু আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলেন। মনে পড়ছে? ‌আপনি.‌.‌.‌‌‌’

এই পর্যন্ত বলার পরই নিষাদ বলে ওঠে, ‘ওহো এবার মনে পড়েছে। ছি ছি, কিছু মনে করবেন না, আমি চিনতে পারিনি।’

মেঘপর্ণা বলে, ‘চেনার কথা নয়। আপনি টেলিফোনে আমার গলা কখনও শোনেননি।’

নিষাদ বলল, ‘আসলে, আপনার নামটা জানতাম না।’

মেঘপর্ণা গলা নামিয়ে বলল, ‘জানবেন কী করে? জানতে চাইলে তো বলব।’

ওপাশে নিষাদ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। বলল, ‘আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।’

‌মেঘপর্ণা ঘরের বন্ধ দরজা দেখে নিয়ে বলল, ‘যাক, আজ একটা ভুল ধরাতে গিয়ে অনেকগুলো ভুল করে ফেলেছেন। পরের দিন গেলে চা খাইয়ে দেবেন। আপনাদের প্রেসের উলটো দিকের ফুটপাতে চা বিক্রি হয়। যদিও চা আমি মোটে পছন্দ করি না। তারপরেও আপনি যদি খাওয়ান, খাব।’

নিষাদ বলল, ‘আর তো আপনাদের প্রেসে আসার কোনও দরকার নেই।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘মানে!‌ দরকার নেই কেন?’

‌নিষাদ বলল, ‘আপনাদের ম্যাগাজ়িনের কাজ শেষ। আজ বিকেলেই ছাপতে চলে গিয়েছে। মনে হয় এতক্ষণে ছাপা শেষ। বলাইবাবু নিজে গিয়ে কলেজে ডেলিভারি দিয়ে আসবেন। শনিবার আপনাদের ফাংশন না? ওই জন্যই তো তাড়াহুড়ো করে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে সব দেখিয়ে নিলেন।’

মেঘপর্ণা ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসল। ছেলেটা কী বলছে এসব!‌

‘ম্যাগাজ়িন ছাপা হয়ে গিয়েছে মানে!‌‌ ওই ভুলটা ঠিক করেছেন?’

নিষাদ সহজ ভাবে বলল, ‘কোনটা? চিত্রাঙ্গদা না অর্জুন? ‌ঠিক করব কী করে? আপনি তো কিছু জানালেন না। বলেছিলেন, ফিরে গিয়ে ফোন করবেন। আমি বলাইদাকে ব‌ললাম, উনি বললেন, কলেজ থেকে যখন কিছু বলেনি, যা লেখা হয়েছে, তাই থাক।’

মেঘপর্ণা ঝপ করে খাট থেকে নেমে পড়ল। আর্তনাদ করে বলল, ‘কী বলছেন‍‌ নিষাদবাবু!‌ ওই ভুলটা ম্যাগাজ়িনে ছাপা হয়ে গেল? আপনি ঠিক করে দিতে পারলেন না?’

‌‌নিষাদ অবাক হয়ে বলল, ‘আমি ঠিক করব!‌’

মেঘপর্ণা এবার চিৎকার করে বলল, ‘করবেন না? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নিয়ে এরকম একটা বিচ্ছিরি ভুল কলেজ ম্যাগাজ়িনে বেরিয়ে যাবে? আপনি জেনেবুঝেও কিছু করলেন না?’

নিষাদ আমতা-আমতা করে বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করুন, আমি করতে চেয়েছিলাম। বলাইবাবুকে সেকথা বলেওছিলাম। উনি বলেছেন, ভুল ধরার জন্য আপনারা নাকি খুব রাগারাগি করেছেন। আজও তো আপনি আমাকে বিশ্বাস করলেন না, বইও দেখাতে চেয়েছিলাম। আপনি দেখলেন না, জানাবেন বলে জানালেনও না। অপেক্ষা করে বলাইবাবু ছাপতে দিয়ে দিলেন।’

মেঘপর্ণার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ইচ্ছে করল টেলিফোনের ওপাশে গিয়ে ছেলেটার গলা টিপে ধরতে। ম্যাগাজ়িনে এমন একটা ভুল হওয়া মানে কলেজের প্রেস্টিজ। আজ সঙ্গে উষ্ণিও ছিল না। ফলে গোটা দায়িত্ব তার একার ঘাড়ে এসে পড়বে। লেখাটা আবার ম্যাডামের নামে ছাপা হচ্ছে। তার মানে দাঁড়ায়, উনি ভুল করেছেন। সবাই ওঁর দিকে আঙুল তুলবে, হাসাহাসিও হতে পারে… এবার কী হবে? ভাবতে পারছে না মেঘপর্ণা। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। ম্যাডাম তাকে ছেড়ে দেবেন না।

মেঘপর্ণা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আপনি তো আমাকে বলেননি, আজই ম্যাগাজ়িন ছাপা হবে। বলেছেন কী?’

‌নিষাদ বলল, ‘ছাপার ব্যাপার তো আমি জানতে পারি না।’

মেঘপর্ণা শান্ত মেয়ে, কিন্তু তখন তার পক্ষে শান্ত থাকা ছিল অসম্ভব। সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ‘ছাপাখানায় কাজ করেন, আর ছাপা কখন হবে, জানতে পারেন না? বললেই বিশ্বাস করব?’

নিষাদ শান্তভাবে বলল, ‘আপনি অকারণ আমার উপর রাগ করছেন। আমি কোথাও কাজ করি‌ না। বলাইবাবু টুকটাক কাজ থাকলে আমাকে ডেকে পাঠান।’

মেঘপর্ণা থমকাল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আপনার মতো বুদ্ধিমানের কোথাও কাজ পাওয়া মুশকিল। দয়া করে আপনি আপনার বলাইবাবুর ফোন নম্বরটা দিয়ে উপকার করতে পারবেন কি? নাকি সে-ও আপনি জানেন না?’

নম্বর টুকে নিয়ে কোনও কথা না বলেই বিশ্রীভাবে ফোন কেটে দিল মেঘপর্ণা। কখন মা ঘরে ঢুকে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। তার মাথার ঠিক নেই।

‘কাকে বকছিস?’

মেঘপর্ণা বলল, ‘একটা গাধাকে মা। এমন বোকা ছেলেও দুনিয়াতে আছে!‌’

সংযুক্তা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কোন ছেলে বোকা?’

মেঘপর্ণা বলল, ‘হতাশ না অবসাদ কী যেন নাম বোকাটার .‌.‌.‌না না মনে পড়েছে, নিষাদ.‌.‌.প্রেসে কাজ করে.‌.‌.গাধাটা‌ আমাকে বিরাট বিপদে ফেলেছে.‌.‌.‌’

সংযুক্তা বলল, ‘আহা, মাথা ঠান্ডা কর।’

‘আর মাথা ঠান্ডা, চিত্রাঙ্গদা না অর্জুন ইসুতে আমাকে কলেজ থেকে তাড়িয়ে না দেয়।’

মেঘপর্ণা কাঁপা হাতে প্রেসের মালিককে ফোন করল। বলাইবাবু যা বললেন, তাতে ধড়ে প্রাণ ফিরল মেঘপর্ণার। মেশিনম্যানের শরীর খারাপ বলে আজ আগেই ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছেন। কাল বা পরশু ম্যাগাজ়িন ছাপা হবে। মাকে ধরে একপাক নেচে নিল মেঘপর্ণা।

‘যাক, বোকাটা বিপদে ফেলতে পারেনি।’

সংযুক্তা বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘বুঝতে হবে না মা, বিপদ কেটে গিয়েছে।’

রাতে খেতে বসে বাবা-মাকে বোকা ছেলের গল্প বলল মেঘপর্ণা।

সুবিমলবাবু হাসতে হাসতে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ টু ইয়োর ম্যাডাম। ছেলেরা যে কত বোকা হতে পারে, সে ব্যাপারে তোমাকে একটা অভিজ্ঞতার সুযোগ দিয়েছেন। তোমাকে যদি প্রেসের কাজে ইনভলভ না করতেন, তুমি জানতে পারতে না।’

সংযুক্তা অবশ্য বলল, ‘দোষ তোরও। ম্যাডাম তো আগেই জানাতে বলেছিলেন।’

সুবিমলবাবু বলল, ‘একথা বোলো না সংযুক্তা, ছোকরা বোকা বলেই অপেক্ষা করেনি। এই জন্য এই জেনারেশনের কিছু হয় না। তাদের নিজেদের কোনও ডিসিশন নেওয়ার ইচ্ছে নেই। ভুলটা যদি প্রকাশ পেত, তোমার মেয়ে বিশ্রী একটা ট্রাবলের মধ্যে পড়ে যেত।’

অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল মেঘপর্ণার। জানলার ফাঁক দিয়ে রাতের আলো ঢুকছে। গাঢ় নীল আলো। সেই আলোয় চেনা ঘরও কেমন যেন অচেনা লাগছে। মন খারাপ হয়ে উঠল মেঘপর্ণার। সে উঠে বসল। ছি ছি, নিষাদ নামের সঙ্গে ছেলেটার সঙ্গে কী বিশ্রী ব্যবহার করেছে!‌ মা তো ঠিকই বলেছে। তার তো আগেই জানানো উচিত ছিল। খুব অন্যায় কাজ হয়েছে। শুধু গলা চড়িয়ে বকাবকি করেনি, খারাপ কথাও বলেছে। বুদ্ধি নিয়ে বিদ্রূপ করেছে, চাকরি নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। এই ছেলেই তো ভুলটা ধরেছে। কই আর কারও চোখে তো পড়েনি। লেখাপড়া জানা ছেলে প্রেসে প্রুফ দেখে হয়তো কিছু উপার্জন করছে, তাকে এভাবে বলাটা খুব খারাপ হয়েছে। অথচ ছেলেটি কোনও প্রতিবাদ করেনি। অন্য কেউ হলে, আপত্তি করত। শুধু তো আজ নয়, আগের দিন নাম না করে উষ্ণিও তাকে গাল দিয়ে এসেছে।

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল মেঘপর্ণা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করল। ভোর রাতে মোবাইলে মেসেজ লিখে নিষাদের নম্বরে পাঠিয়ে দিল—

‘এই যে ভাল এবং বোকামানুষ, আমাকে ক্ষমা করবেন। মেঘপর্ণা।’

কলেজের ফাংশন হয়ে গেলে একদিন ফোন করেছিল মেঘপর্ণা।

‘আমি মেঘপর্ণা বলছি, নামটা সেভ করে রেখেছেন‌ নাকি ডিলিট করে দিয়েছেন? দেখা করতে চাই।’

নিষাদ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘কার সঙ্গে দেখা করতে চান?’

‘নিশ্চয়ই অন্যের সঙ্গে দেখা করার জন্য আপনাকে ফোন করছি না।’

নিষাদ আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘ওহ্‌ তা তো ঠিকই। কখন দেখা করবেন?’

মেঘপর্ণা বলল, ‘কাল কলেজ ছুটির পর। চিন্তা করবেন না, এক‌ মিনিটের বেশি সময় নেব না। আরও কম হতে পারে।’

নিষাদ আমতা আমতা করে বলল, ‘আচ্ছা।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘আপনি আপনার প্রেস থেকে একটু এগিয়ে বাঁদিকে দাঁড়াবেন।’

নিষাদ বলল, ‘আচ্ছা।’

‌মেঘপর্ণা বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী তখন থেকে আচ্ছা-আচ্ছা বলছেন।‌ আপনি অন্য কথা জানেন না?’

‌নিষাদ আরও বেশি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’

পরদিন এক মিনিটের চেয়েও কম সময় নিয়েছিল মেঘপর্ণা। গাড়ি থেকে নেমে একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয় নিষাদের দিকে।

‘নতুন গীতবিতান । পুরনোটা তো ছিঁড়ে ফেলেছেন। নিন ধরুন এবং আচ্ছা বলুন।’

সেই শুরু। তারপর প্রেম গড়িয়েছে। মেঘপর্ণা খুব বেশি যে দেখা করতে পেরেছে, এমন নয়। সে সুযোগ কমই ছিল। কলেজের পাট শেষ হলে, লেখাপড়াও থমকাল। ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বাড়িতে রাজি হয়নি। মা বলেছিল, বেশি ডিগ্রি থাকলে পাত্র পাওয়া মুশকিল, পড়তে হলে বিয়ের পরে পড়াই ভাল। শ্বশুরবাড়ি যেমন বুঝবে। এই বিষয়ে তর্ক করতে গিয়েছিল মেঘপর্ণা।

সংযুক্তা বলল, ‘জানি কথাটা শুনতে মান্ধাতার আমলের মতো লাগছে তো? সে লাগুক, কিছু করার নেই। এখনও বেশিরভাগ বাড়িতে এমনটাই মনে করে। দু’-চারজনকে দেখে ভুল ভেবে লাভ কী? শুনতে যেমনই লাগুক, ঘটনা সত্যি।’

মেঘপর্ণার বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে এক বছর হল। এখন গতি পেয়েছে। পাত্র পছন্দের ফাইনালে তিনজনে এসে ঠেকেছে। সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে এক ইঞ্জিনিয়ার যুবক। সুবিমল দস্তিদার ব্যবসা পছন্দ করলেও এই ছেলেকে দেখার পর তিনি মত বদলেছেন। এই ছেলেকে তার খুবই পছন্দ। সংযুক্তারও তাই। ছেলে অবশ্য ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাকতে চায় না। সে এমবিএ পাশ করেছে, এবার বিদেশি কোম্পানিতে ম্যানেজার হতে চায়। মেঘপর্ণার পিসিরা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত এই ছেলে রাজি হওয়ার অর্থ হাতে চাঁদ আসা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। কখন ছেলেপক্ষ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়। এই কারণেই মেঘপর্ণা আর নিষাদ বিয়ের পরিকল্পনা করতে বাধ্য হয়েছে। পরিকল্পনা যদিও উষ্ণির। সেই মেঘপর্ণাকে জোর করেছে।

‘মেঘা, এরপর আর চান্স পাবি না। বিয়েটা করে রাখলে সব দিক থেকে সেফ।’

‌মেঘপর্ণা আঁতকে উঠেছিল।

‘বিয়ে!‌ তুই কি পাগল হলি?’

‌উষ্ণি সহজ ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘পাগল হওয়ার কী হয়েছে? তোরা প্রেম করিস, অ্যাডাল্ট, বিয়ে করার অধিকার তোদের রয়েছে। তোর বাবা-মাকে বলেকয়ে এই বিয়ে হবে না। নিষাদ এমন ক্যাবলা ছেলে, সে যে তোর বাড়িতে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বিয়ের কথা বলবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। অবশ্য বলেও কোনও লাভ হত না। বেকার চালচুলোহীন ছেলের সঙ্গে কে মেয়ের বিয়ে দেবে? তুই হলে রাজি হতিস?’

উষ্ণি এরকম চাঁচাছোলা কথা বলতেই অভ্যস্ত। রাগও হয়, আবার না শুনে উপায়ও থাকে না। মেঘপর্ণা বোঝে, মেয়েটা তাকে পছন্দ করে। ভাল চায়। উষ্ণি কলেজ শেষ করে কম্পিউটার ট্রেনিং নিতে ঢুকেছে। এক বছর হয়েও গিয়েছে। সেখানকার এক ট্রেনারের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম শুরু করেছে। সেই গল্পও বলেছে। তবে ওর প্রেমের গল্প মানে শরীরের গল্প। রসিয়ে বলতেও পারে। এখন আরও নির্লজ্জ হয়েছে।

‘আমি বুকের বেশি যেতে দিতে চাই না। জামা খুলে দিই। সম্রাটদা তাতেই হাঁকপাক করে। সামলাতে পারে না।’

মেঘপর্ণা বলে, ‘উফ্‌, তুই থামবি‌ উষি?’

উষ্ণি পাত্তা না দিয়ে হেসে বলে, ‘হাঁকপাক করবে না-ই বা কেন? আমার বুক‌ তো ফুরোতে চায় না।’

মেঘপর্ণা কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। বলে, ‘আমি কিন্ত ফোন রেখে‌ দেব।’

উষ্ণি এতেও পাত্তা দেয় না। বলতেই থাকে।

‘ওই সামলাতে তোদের সম্রাটদার দম বেরিয়ে যায়। তার মধ্যে‌ চুড়িদার ধরে টানাটানি শুরু করবে। বাবুর সব চাই। ইস্ রে, আগে এটা সামলা তারপর তো। আমি অবশ্য সঙ্গে প্রোটেকশন রাখা শুরু করেছি। কখন কী হয় তার ঠিক আছে বল?’

মেঘপর্ণা তাড়াতাড়ি বলে, ‘আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে, এবার থাম।’

উষ্ণি থামে না। বলতেই থাকে।

‘আমি অবশ্য মাঝেমধ্যে অ্যালাও করি। ছেলেরা হল বিড়ালের মতো। তাড়াতেও হয় আবার দুধটা, মাছের কাঁটাটা দিতেও হয়। বুঝলে সোনা? নইলে অন্য বাড়িতে চলে যাবে। ধরে রাখা যাবে না।’

কথা শেষ করে হেঁচকি দিয়ে হাসতে থাকে উষ্ণি। একই বয়স। তারপরেও এরকম ভাবতে পারে না মেঘপর্ণা। অন্য মেয়েরা অবশ্য এখনও বলে উষ্ণি বেশিটাই বানায়। শরীর নিয়ে ওর কোনও সমস্যা রয়েছে। কে জানে? হতে পারে। তবে মেয়েটা যে তার ভাল চায়, এতে কোনও সন্দেহ নেই মেঘপর্ণার। একদিন বলল, ‘অ্যাই মেঘা, তোর মায়ের মোবাইল নম্বরটা দে তো।’

‘কী করবি?’

‘তোর ডায়েট চার্ট বলব। মোটা হয়ে যাচ্ছিস। নিশ্চয় একমাত্র কন্যাকে ঠেসে খাওয়াচ্ছেন। নম্বরটা দে দেখি।’

সেই উষ্ণি যখন বিয়ের কথা বলে, মেঘপর্ণা থমকে না গিয়ে পারে না।

‘এসব গল্প উপন্যাসে হয় উষ্ণি। আমার জীবন কোনও গল্প উপন্যাস নয়।’

উষ্ণি বলল, ‘বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি হয়। বাড়ির মত না থাকলে ছেলেমেয়েরা কী করবে? আর কাজটা তো খুব ইজ়ি। কেউ জানতেও পারবে না। পরে তো সেই বাড়িতেই ফিরে আসবি। নিষাদ যখন চাকরিবাকরি পাবে, একটু গুছিয়ে নেবে, তখন বাড়িতে ‘টাটা’ বলে সংসার করতে চলে যাবি। বাবা-মা প্রথমটায় গোমড়া মুখে থাকলেও পরে মেনে নেবে। না দিয়ে যাবে কোথায়? দেখ, মেঘা, আমরা জীবনে যতই ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, শপিং মল, নারীর স্বাধীনতা, পুরুষের উদারতার মধ্যে ঢুকি না কেন, প্রেম আর সেক্সে আমরা এখনও হাজার বছর আগেই পড়ে রয়েছি। এখনও ভালবাসার মানুষের জন্য মনকেমন করে, সেই মানুষটা আদর করলে আনন্দে শিউরে উঠি। ফর্মটা বদলেছে। আগে মনকেমন করলে রাজকন্যে রাজপ্রাসাদের অলিন্দে গিয়ে দাঁড়াত, এখন মোবাইল ফোনে অলিন্দ খোলে। যে যতই আধুনিকতার বড়াই করি না কেন, প্রেম আর সেক্স এখনও আদিম, তাই এত খাঁটি।’

খানিকটা ভেবে, খানিকটা আবেগে আর বেশিটাই অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিষাদকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মেঘপর্ণা। নিষাদও দোনামোনা করে রাজি হয়েছিল।

কিন্তু বিয়ের একঘণ্টা আগে এই গোলমাল হবে মেঘপর্ণা ভাবতেও পারেনি। সে নানারকম অশান্তির জন্য প্রস্তুত ছিল, এই অশান্তির জন্য নয়।

মেঘপর্ণার ঘনঘন গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে টেবিলে রাখা জলের বোতল তুলে বারবার চুমুক দিচ্ছে, লাভ হচ্ছে না। এখন তেমন গরম নেই, তারপরেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মেঘপর্ণা অভ্যেসে হাত বাড়িয়ে মোবাইল খোঁজার চেষ্টা করল। ফোন টেবিলে নেই। মেঘপর্ণার মনে পড়ে গেল, ফোন তার মায়ের সামনে। একটাই রক্ষে, শেষ মুহূর্তে সে ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে। মা ফোন খুলবে না তো? আগে কখনও খোলেনি, কিন্তু আজকের দিনটা তো অন্য দিনের মতো নয়।‌

সংযুক্তা বসে রয়েছে ড্রইংরুমের সোফায়। মাথায় হাত। তিনবার চেষ্টা করার পর স্বামীর ফোন পেয়েছে। সুবিমল অফিসে।‌ মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনবারের বার ফোন তুলল।

‘এই সময় তোমায় ফোন করতে বারণ করেছি তো সংযুক্তা।’

সংযুক্তা এসব কথা না শুনে হাউমাউ করে উঠলেন, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।’

সুবিমল থতমত খেয়ে বলল, ‘কী বলছ আজেবাজে কথা? কী হয়েছে?’

সংযুক্তা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভাবতেও পারছি না, আমাদের মেয়ে এমন করতে পারে।’

সুবিমল কঠিন গলায় বলল, ‘কী করেছে মেঘ?’

সংযুক্তা ফোঁপাতে‌ ফোঁপাতে ঘটনা বলতে থাকে। সেই ঘটনা এরকম—

খানিক আগে সংযুক্তার মোবাইলে একটা ফোন আসে। অচেনা ল্যান্ডফোনের নম্বর। সংযুক্তা বিরক্ত হয়ে ফোন ধরেছিল। এই সময় সে টিভিতে রান্নার প্রোগ্রাম দেখে। রান্না করতে তার একদম ভাল লাগে না। টিভি বা ইউটিউবে রান্না দেখতে ভাল লাগে। এই সময়ে ফোন আসা মানে বিরক্তি। ফোন করছে একটি মেয়ে। সে ঠান্ডা গলায়, সহজভাবে একটি খবর জানায়। তার গলা শুনে মনে হতে পারে, সে আবহাওয়ার খবর জানাচ্ছে। খবরটি এরকম—

মেঘপর্ণা বাড়িতে বলেছে, আজ তার এক বান্ধবীর জন্মদিনে যাবে। এই তথ্য সত্য নয়। সে যাবে বিয়ে করতে। ছেলের নাম নিষাদ। একটু পরে এন্টালিতে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে দু’জনে সইসাবুদ করতে চলেছে। পাত্র ছাপাখানায় প্রুফ দেখে। খবর এখানেই শেষ নয়, মেঘপর্ণার হবু বর এক মেসে অন্য লোকের সঙ্গে বিছানা ভাগ করে থাকে। একা ঘর ভাড়া নেওয়ার মতো সাধ্য তার নেই।

এরপরে মেয়েটি ফোন কেটে দেয়। সংযুক্তা সেই নম্বরে ফোন করে। ফোন ধরে একজন পুরুষ জানায়, সেটা একটা মিষ্টির দোকান।

সংযুক্তা সর্বনাশের ঘটনা বলা থামালে সুবিমল একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি এই উড়ো ফোন বিশ্বাস করেছ?’

সংযুক্তা বলল, ‘মেয়েটি ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসের ফোন নম্বর, ঠিকানা দিয়েছে।’

সুবিমল থমথমে গলায় বলল, ‘তুমি কি তোমার মেয়েকে কিছু‌ বলেছ?’

সংযুক্তা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘বলব না? সে চোখের সামনে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে করতে চলে যাবে, আমি চুপ করে থাকব? কী বলছ তুমি!‌ আমি জিজ্ঞেস করলাম, আজ তোর বিয়ে?’

‘মেঘ কী বলেছে?’

সংযুক্তা বলল, ‘কী বলবে? কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে গিয়েছে। এর থেকেই তো বোঝা যায়, খবর সত্যি। বোঝা যায় না?’

সুবিমল ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, ‘সে কী!‌ ঘরে চলে গিয়েছে মানে? সর্বনাশ, মেয়েটা একটা কিছু করে‌ ফেলতে পারে। তুমি তাড়াতাড়ি যাও।’

সংযুক্তা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘মেয়ে কী করবে? গলায় দড়ি দেবে? দিক। ভিখিরিকে বিয়ে করে ফুটপাতে সংসার পাতার থেকে গলায় দড়ি দেওয়াই ভাল। এত পরিশ্রম করে মানুষ করার এই ফল?’

সুবিমল ধমক দিয়ে বলল, ‘বাজে কথা ছাড়। যা বলছি, তাই কর। ঘরে যাও, মেয়ের সঙ্গে থাক। বকাবকি করবে না। আমি আসছি। আর ওই রেজিস্ট্রি অফিসের ফোন নম্বরটা দাও।’

সংযুক্তা ঘরে গিয়ে দেখল, মেয়ে পাথরের মতো চুপ করে বসে রয়েছে। রাগ হল খুব। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল, আবার দুঃখও হল। ইচ্ছে করছে গালে কষিয়ে চড় দিতে, তারপর জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না, আমার মেয়ে হয়ে তুই এমন কাজ করবি।’

মায়ের কথার উত্তর দিতে পারে না মেঘপর্ণা। সে চুপ করে থাকে।

সুবিমল এল চল্লিশ মিনিট পর। সহজভাবে ঘরে এল। ‌বাবাকে দেখে অবাক মেঘপর্ণা। শান্ত, মুখে হালকা হাসি। যেন ঘটনায় মজা পেয়েছে। সংযুক্তাকে চা দিতে বলল। তারপর কাপ নিয়ে মেয়ের ঘরে এসে মুখোমুখি বসল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যাও, বাপ-বেটিতে একটু গোপন কথা বলি।’

চমকে উঠল মেঘপর্ণা। বাবা কি তাকে ঘরে আটকে রাখবে?

কিন্তু একেবারে অন্য ঘটনা ঘটল। সংযুক্তা চলে যেতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুবিমল সহজভাবে বলল, ‘তোর ভয়ের কোনও কারণ নেই। রাগারাগি করব না। বড় হয়েছিস, নিজের ভালমন্দ বুঝতে শিখেছিস, ডিসিশন যা নিয়েছিস, নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে নিয়েছিস,’ তারপর হাত উলটে ঘড়ি দেখে বলল, ‘সময় রয়েছে। আবদুলকে গাড়ি গ্যারাজে ঢোকাতে বারণ করেছি। তোকে নিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে চলে যাবে। যদি চাস আমি আর তোর মা সাক্ষীও দিতে যাব। তোর মা যদি রাজি না হয়, আমি একা যাব। আর যদি না চাস, তাহলে তুই একা চলে যাবি। এবার গোপন কথাটা বল তো, ছেলেটাকে তুই কতদিন ধরে চিনিস মা?’

বাবার নরম গলায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হল মেঘপর্ণা। সে মাথা নামিয়ে বসে থাকে।‌

সুবিমল বলল, ‘মাথা নিচু করে আছিস কেন? মাথা নিচু করার মতো তো কিছু করিসনি। যাকে ভালবাসিস তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিস, এতে অন্যায়ের কী? আমি হলেও একই কাজ করতাম। মাথা তুলে কথা বল। কতদিনের পরিচয়?’

মেঘপর্ণা এবার মুখ তুলে বলল, ‘বেশি নয়, দু’বছর। এক-দু’মাস কম হবে।’

‌সুবিমল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘এটা কম বেশির কিছু বিষয় নয়। দেখ মা, মানুষ এক মুহূর্তে কাউকে ভালবেসে ফেলতে পারে, আবার সারাজীবন একসঙ্গে থাকলেও ভালবাসা হয় না। তুই তো লম্বা সময় পেয়েছিস। এতদিনে নিশ্চয়ই সবদিক ভেবে নিয়েছিস।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘নিষাদ খুব ভাল ছেলে বাবা। খুব অনেস্ট।’

সুবিমল হেসে বলল, ‘নিষাদ? বাহ্‌, ভাল নাম তো। মানে কী?’

মেঘপর্ণা বলল, ‘ব্যাধ।’

সুবিমল চোখ বড় করে বলল, ‘বাপ রে, ব্যাধ! মানে‌ শিকারি তো? ছেলে যে ভাল সে বুঝতেই পারছি। নইলে আমার মেয়ে তার সঙ্গে মিশবে কেন? কিন্তু মেঘ, ছেলে ভাল মানেই ভাল স্বামী হবে, এমন কিন্তু নয়। ভাল স্বামীকে ভাল ছেলে না হলেও চলে। জীবনে একটা মেয়ের ভাল ছেলে পাওয়া যেমন কঠিন, তেমন ভাল স্বামী পাওয়াও কঠিন। স্বামীকে জীবনে দাঁড়াতে হয়, মাথার উপর আশ্রয় লাগে, সংসার দেখতে হয়, সন্তানদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। টাকাপয়সার অভাব থাকলে এসব সে করতে পারে না। তখন তাকে হয় হাত পাততে হয়, নয়তো অসৎ পথে যেতে হয়। অনেক অভাবী ভাল ছেলে তখন আর ভাল থাকতে পারে না। সংসার তাকে নষ্ট করে দেয়।’

মেঘপর্ণা অস্ফুটে বলল, ‘বাবা, নিষাদ একটা চাকরি পেতে চলেছে।’

সুবিমল নড়েচড়ে বসে বলল, ‘কী চাকরি?’

‘একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে। ডিস্ট্রিবিউটার না ‌কী যেন।’

সুবিমল স্থির চোখে বলল, ‘কোন পোস্টে?’

‌মেঘপর্ণা আমতা আমতা করে বলল, ‘সেটা ঠিক জানি না। তবে খুব বড় কিছু নয়।’

সুবিমল দাঁত চেপে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। কী যেন কোম্পানি আর না জানা পোস্টের চাকরি কেমন হবে আমি বুঝতে পেরেছি। সে যাক, তুই যদি মনে করিস, একজন ওয়েল অফ, সেটলড, বড় চাকরি করা, বিদেশে থাকা ছেলের চেয়ে এই ছেলেটি বর হিসেবে তোর পক্ষে বেশি কমফর্টেবল, আমি খুশি মনে মেনে নেব। বিয়ে তো আমরা করছি না, তুই করছিস। সংসারের অভাব-অনটন যদি তুই ফেস করতে পারিস, আমার কী? তোর ব্যাপার।’

‌‌‌মেঘপর্ণা বলল, ‘নিষাদ যদি চেষ্টা করে, বড় হতে পারবে না?’

‌সুবিমল বলল, ‘অবশ্যই পারবে। কেন পারবে না? না পারলে বা অনেক সময় লাগলে কী হবে তা নিয়েও চিন্তা করিস না। আমি‌ সাহায্য করব। টাকা দেব, ঘর দেব। ও কুণ্ঠিত হয়ে সেই সাহায্য নেবে। তোর জন্যই নিতে হবে। এটাই নিয়ম। একজন সৎ, ভাল ছেলে আমার সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকবে। অপেক্ষা করবে, কখন আমি দয়া করব।’

মেঘপর্ণা কেঁপে উঠল। সে বলল, ‘বাবা, এসব কী বলছ?’

সুবিমল অল্প হাসল। দম নিয়ে বলল, ‘ঠিক বলছি, বাস্তবটাই বলছি মেঘ। রিয়্যালিটি, হার্ড রিয়্যালিটি। ভয় দেখাচ্ছি না, আগাম জানিয়ে রাখছি, তুই যাকেই বিয়ে করিস না কেন আমি তোর পাশে থাকব। যে পরিবারে, যে স্ট্রাকচারে বড় হয়েছিস, সেখান থেকে একবারে জলে পড়তে চলেছিস। কঠিন কথা বললাম বলে রাগ করিস না। যে ছেলে মেসে অন্য লোকের সঙ্গে বিছানা ভাগ করে ঘুমোয়, তাকে বিয়ে করা মানে জলে পড়া ছাড়া আর কী? আর জলে পড়লে খড়কুটো ধরে বাঁচতে হবে না? চিন্তা নেই, তোর বাবা সেই খড়কুটো হবে। তখন দেখবি দুনিয়াটা বদলে গিয়েছে। ভাল ছেলে হাত পাতা ছেলে হয়ে যাবে। তুইও হবি। আমি সে কথাই বলে রাখলাম, নিঃসংকোচে হাত পাতবি।’

মেঘপর্ণা এবার দু’হাতে মুখ ঢেকে মাথা নামাল। সুবিমল মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের কোণে হাসি, মেয়ের ভেঙে পড়ায় তিনি খুশি। সে কাঁদছে।

সুবিমল নিচু, নরম গলায় বলল, ‘আমাদের উপর এত রাগ? আমাদের ভরসা করতে পারলি না? যাক, এরপরে যখন বিপদে পড়বি তখন অন্তত ভরসা করিস।’

মেঘপর্ণা মুখ তুলল না। সুবিমল খানিকটা যেন নিজের মনেই বলল, ‘ভালবাসা সহজ নয়। যে ভাল ছেলে, মাথা নামায় না, তাকে তার মতো থাকতে দিতে হয়। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সময় দিতে হয়। যেন পরে কারও কাছে হাত না পাততে হয়। তাড়াহুড়ো করে তার ঘাড়ে চেপে বসলে, ভাল হয় না।’

মেঘপর্ণার কেমন যেন লাগছে। এই বাড়ির মানুষগুলো যে তাকে নিয়ে এত চিন্তা করে, তার ভাল চায়, তার জানাই ছিল না! অথবা জানা ছিল, নিজের রাগ, অভিমান আর ভয় দিয়ে চাপা‌ দিয়ে রেখেছিল এতদিন। সুবিমল দস্তিদার মানুষটাকে আজ যেন সে নতুন করে চিনতে পারছে। তার সেই আগের বাবা নয়, অন্য বাবা। এতদিন সে জানত, তার বাবা-মায়ের একমাত্র কাজ তাকে শাসনে রাখা। নিজেদের পছন্দ চাপিয়ে দেওয়া। একশো বছর আগে মেয়েদের যেভাবে আগলে রাখা হত, তাকে সেইভাবে রাখা হয়েছে। বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে পারলেই এরা যেন নিশ্চিন্ত। এখন বাবার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার ভাবনাটাই ভুল হয়েছে। বাবা তো ঠিকই বলছে। সে শুধু নিজের মেয়ের ভাল চাইছে না, নিষাদের ভাল চায়!‌ তাকে আরও সময় দেওয়া উচিত। বাবা ঠিকই বলেছে, এই বিয়ের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। এই বিয়ে মানে নিজেকে তো বটেই, নিষাদকেও বিপদে ফেলা ছাড়া আর কিছু নয়। দেরি হলে তো ক্ষতি নেই।

সুবিমল উঠে পড়ে বলল, ‘চল সময় হয়ে গেল।’ তারপর মুচকি হেসে বলল, ‘আমরা কি আমাদের একমাত্র রাজকন্যেটির বিয়েতে হাজির থাকতে পারি?’

‌মেঘপর্ণা চোখ মুছে শক্ত গলায় বলল, ‘বাবা, মাকে আমার মোবাইলটা দিতে বল। আমি নিষাদকে ফোন করব। এখন বিয়ে হবে না।’

সুবিমল অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী!‌’

মেঘপর্ণা বলল, ‘ভুল করেছি, এবার আমাকে একটা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দাও বাবা।’

সুবিমল একটু চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলল, ‘এত চটজলদি কোনও সিদ্ধান্ত নিস না মেঘ, সেটাও ভুল হবে। একটা দিন ভাব। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা হল, সঙ্গী বেছে নেওয়া। সেখানে কোনও ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? ভালবাসার নামে কাউকে করুণা করে বসছিস না তো? নিজের মনের কাছে এই প্রশ্নটা কর। মন যদি বলে, না, হচ্ছে না, নিশ্চিন্তে এগিয়ে যা। আমাদের আপত্তি শুনবি না। আর যদি কোনও দ্বিধা, সংশয় মনে জাগে থমকে যাবি। আমি কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না।’

মেঘপর্ণা অসহায় ভাবে বলল, ‘এখন আমি কী করব বাবা? ও যে অপেক্ষা করবে?’

সুবিমল উঠে দাঁড়িয়ে, সামান্য হেসে বলল, ‘সারাজীবনের জন্য ভুল করার চেয়ে ক’টা দিনের অপেক্ষা কোনও বিষয় নয়। কী করবি সিদ্ধান্ত তোর।’

সুবিমল ঘর থেকে চলে যাওয়ার পর, মেঘপর্ণা কিছু সময় চুপ করে বসে থাকল। তারপর মন শক্ত করে ফোন টেনে নিয়ে বন্ধ করে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *