নিষাদ – ২

নিষাদ এলোমেলোভাবে হাঁটছে। কোথায় যাচ্ছে তার জানা নেই। আসলে কোথাও যাচ্ছে না। পরিচিত কোনও গলি থেকে অন্য অপরিচিত গলিতে চলে যাচ্ছে। পরিচ্ছন্ন, নির্জন সেই গলি পেরিয়ে ফের ঢুকে পড়ছে নতুন কোনও অপরিসর, ঘিঞ্জি গলিতে। যেন নিজের মনের ভিতর ঢুকে পড়েছে। কখনও চিনতে পারছে, কখনও পারছে না। নিষাদের হাতে মাত্র দু’ঘণ্টা সময়। তাও পুরো নেই। কী করবে সে? মেঘপর্ণাকে ফোন করবে? কী বলবে তাকে?

‘মেঘপর্ণা, একটা দুঃসংবাদ আছে।’

‘দুঃসংবাদ! আজ দুঃসংবাদ! আজ তো‌ সব ভাল খবরের দিন নিষাদ।’

মেঘপর্ণা কেঁদে ফেলবে হয়তো। সে সরল প্রকৃতির মেয়ে। এত চাপ নিতে পারবে না।

‘আমার চাকরিটা হয়নি মেঘপর্ণা।’

‘কী বলছ নিষাদ!‌ চাকরিটা হয়নি মানে কী? হতেই পারে না, তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে মজা করছ।‌ দোহাই তোমায়, এমন ভয়ংকর মজা আজ কোরো না। মজা করার জন্য সারা জীবন পড়ে র‌য়েছে।’

‘মজা করছি না। ওরা খুব খারাপ ব্যবহার করে আমাকে তাড়িয়ে দিল মেঘ। দেখা পর্যন্ত করল না।’

‘কোথাও ভুল করছ না তো নিষাদ? নিশ্চয়ই ভুল।’

‘আমার সব ভুল মেঘপর্ণা। জীবনের গোড়া থেকে আমি ভুল করে আসছি। ভালমানুষ হওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল। ভাল হওয়ার জন্য যোগ্যতা লাগে। সে যোগ্যতা আমার নেই। সবচেয়ে বড় ভুল মানুষকে বিশ্বাস করা। আজ আবার প্রমাণ হল।’

‘এখন কী হবে নিষাদ?’

‘আমি জানি না, আমি কিছুই জানি না মেঘ।’

দুঃসংবাদের কথা মেঘপর্ণাকে বলা অর্থহীন। আজ মেয়েটার আনন্দের দিন। সাধারণ আনন্দ নয়, মেয়েদের জীবনে যে অল্প কয়েকটা অসাধারণ আনন্দের দিন‌ থাকে, আজ তারই একটা। খানিক আগে ফোন করেছিল। নিষাদ তখন অপূর্ব রায়ের অফিসের সামনে। প্রথমদিনের মতো আজও সে চলে এসেছিল প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে। উলটো ফুটপাতে পায়চারি করে অপেক্ষা করেছে। মেঘপর্ণা তখনই ফোন করল। ফিসফিস করে বলল, ‘কোথায়?’

‘অফিসের সামনে।’

মেঘপর্ণা আহ্লাদি গলায় ‌বলল, ‘কার অফিসের সামনে?’

নিষাদ বলল, ‘কার আবার? আমার অফিস।’

মেঘপর্ণা খুশিতে গদগদ হওয়ায় গলায় বলল, ‘ইস, এখনও চাকরি জোটেনি বাবুর, বলছে কিনা আমার অফিস। আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পাও।’

নিষাদ মাথা তুলে অফিস বাড়িটার দিকে তাকাল। রোজই যেন আরও একটু বেশি উঁচু মনে হয়।

‘আহা, এখন না হোক, একটু পরেই তো আমার অফিস হবে। শুধু অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কেন, টেবিল-চেয়ার, ফাইল সব পাব। আমি সেখানে বসে ফাইল দেখব।’

মেঘপর্ণা গলা নামিয়ে বলল, ‘অ্যাই পাঁচটার মধ্যে ছুটি পাবে তো?’

নিষাদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘না পেলে, রেজ়িগনেশন লেটার দিয়ে গটগটিয়ে চলে আসব। বলব, যান প্রথমদিন চাকরি ছেড়ে দিলাম।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘ইস, আগে যদি জানতাম, আজই ওরা তোমায় জয়েন করতে ডাকবে, তাহলে এই তারিখটা পিছিয়ে নিতাম। তাড়াহুড়ো থাকত না।’

নিষাদ বলল, ‘তা কেন? একই দিনে দুটো ভাল কাজ। আমার চাকরি তোমার.‌.‌.‌’

মেঘপর্ণা বলল, ‘ঠিক বলেছ। তা ছাড়া বাড়িতে যা পরিস্থিতি, তাতে একটা দিনও অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।’

নিষাদ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছ মেঘ, আর দেরি করে লাভ নেই।’

মেঘপর্ণা দেখতে সুন্দর হলেও, নজরকাড়া নয়। গোলগাল চেহারা। টলটলে মুখে-চোখে একধরনের সারল্য রয়েছে। হাসলে বাঁদিক থেকে গজদাঁত উঁকি মারে। এই সৌন্দর্যে একধরনের স্নিগ্ধতা রয়েছে, চট করে বোঝা যায় না, ধীরে ধীরে অনুভব করা যায়। এই মেয়ের মনটাও তাই। সহজ সরল, আবার ভিতুও। বাড়ির একমাত্র মেয়ে। কলেজে পড়া শেষ করছে। জোরকদমে পাত্র দেখা চলছে। মায়ের ইচ্ছে সরকারি চাকুরে, বাবা চাইছে জামাই ব্যবসাদার হোক। ভুঁইফোঁড় ব্যবসা নয়, তিন পুরুষের পাকাপোক্ত ব্যবসা। ব্যবসায় নিজের ভাগ্য নিজের হাতে। কারও গোলামি নয়। নিজে চাকরি করে ভদ্রলোকের নাকি ঘেন্না ধরে গিয়েছে।

নিষাদের অফিসে রেজিগনেশন দেওয়ার ঠাট্টা শুনে মেঘপর্ণা আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘ওরে বাবা, চাকরি ছাড়বে কী!‌ ওসব করতে যেও না।’

নিষাদ হেসে ফেলল। সত্যি মেয়েটা সরল। মজাও সিরিয়াস ভেবে নিচ্ছে। সংসার করবে কী করে কে জানে। কথাটা ভেবে নিজেরই অবাক লাগে নিষাদের। তারও সংসার!‌

‘ধুস বোকা, ওরকম কেউ করে নাকি? কত কষ্ট করে একটা ভাল চাকরি পেয়েছি.‌.‌. ‌ইচ্ছে করছে ঐশানীদিকে ছুটে গিয়ে জানাই।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘নানা, এখন বোলো না। উনি দুঃখ পাবেন। অপূর্ব স্যার তো বলেছেন, অফিসে জয়েন করবার পর সব বলতে। তাই না? আর তো একটুক্ষণ।’

‌নিষাদ বলল, ‘শুধু চাকরি নয় মেঘ, আর একটুক্ষণ পরই আমাদের.‌.‌.‌’

‌মেঘপর্ণা চুপ করে রইল। নিষাদ বলল, ‘তুমি সাবধানে আছ তো? বাড়ির কেউ কিছু বুঝতে পারেননি তো?’

মেঘপর্ণা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এখন বুঝতে না পারলে কী হবে? একদিন তো বলতেই হবে। বিশেষ করে বাবা-মা যেভাবে বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। হাতে একেবারে সময় নেই। যতদূর বুঝতে পারছি এক-দু’দিনের মধ্যে ছেলে ফাইনাল হবে। তবে একটা বিষয়ে বাবা-মাকে থ্যাঙ্কস। আমাকে বেশি সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হয়নি। তোমায় বলেছি না, আমার বাবার খুব বুদ্ধি। আমাকেও প্রচণ্ড ভালবাসে। আর আমার কাছে সেটাই তো ভয়ের।’

নিষাদ বলল, ‘ভয় কীসের?’

মেঘপর্ণা বলল, ‘ও তুমি বুঝবে না। বাবা, ভীষণ ভাল ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে।’

নিষাদ একটু চু্প করে থেকে বলল, ‘তুমি ভাল করে ভেবেছ তো মেঘ? পরে আপশোস করবে না তো?’

মেঘপর্ণা বলল, ‘করলে করব। ‌তুমি সাদা শার্টটা পরে এসেছ?’

নিষাদ বলল, ‘অবশ্যই। অফিসে কি রঙচঙে জামা পরে আসা যায়? তবে ব্যাগে অন্য একটা জামা এনেছি। বিকেলে বদলে নেব। সেটা লাল রঙের। মেঘ, আমার যেন কেমন লাগছে।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘কেমন লাগছে?’

‘বলতে পারব না। মনে হয়, চিন্তা হচ্ছে। একই দিনে আমার জীবনে দু-দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে চলেছে।’

‌মেঘপর্ণা চাপা গলায় বলল, ‘আমারও ভয় করছে নিষাদ। এখন ফোন রাখছি। মা অনেকক্ষণ থেকে নজর করছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েই ফোন করবে। নইলে মেসেজ।’

নিষাদ তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি ফোন করতে পারব না। ফোন রিচার্জ করতে পারিনি। অফিস থেকে বেরিয়ে করব।‌ আশপাশে ফোন রিচার্জের জায়গা দেখছি না। এখন দূরে যাব না।’

মেঘপর্ণা চাপা গলায় বলল, ‘আচ্ছা, একঘণ্টা পর আমি করব। মনে হচ্ছে বাবা উপরে আসছে। এখন রাখছি।’

নিষাদ হেসে বলল, ‘বাবা উপরে আসছে তো কী হয়েছে? এখন তো তুমি কোনও বেকার ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলছ না। ভুলে যেও না, কালকের নিষাদ আর আজকের নিষাদ এক মানুষ নয় মেঘপর্ণা।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘তোমার এই চাকরিটার জোরেই তো মনে সাহস এনেছি। ভয়ে তো মরেই যাচ্ছিলাম। এখন তাও বাড়িতে বলার মতো একটা কিছু হল। অ্যাই, আর না, ছাড়লাম.‌.‌.‌’

‌নিষাদ বলল, ‘বাড়িতে কী বলে বেরোচ্ছ?’

‘বান্ধবীর জন্মদিন। উষ্ণির নাম বলেছি। বলেছি, সবাই শাড়ি পরব, নইলে মা সন্দেহ করবে। আমি তো একেবারে শাড়ি পরতে চাই না। ওদিকে সব ঠিক থাকবে তো?’

নিষাদ বলল, ‘আমার ক্ষমতা মতো আছে। পলাশ নিজে তো আসবেই, আরও দু’জনকে আনবে। ওরা সাক্ষী দেবে।’

মেঘপর্ণা এবার কাঁপা গলায় বলল, ‘আই লাভ ইউ নিষাদ। ছাড়ছি।’

আরও মিনিট পনেরো হাঁটাহাঁটির পর অপূর্ব রায়ের অফিস পর্যন্ত উঠে এসেছিল নিষাদ। কাচের দরজা ঠেলে রিসেপশন ডেস্কে বসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অল্প হেসেওছিল। মেয়েটিও ঠোঁটে সামান্য হাসির রেখা টেনে মুখ নামিয়ে নেয়। চাপা উত্তেজনা থাকলেও নিষাদের তাড়া ছিল না কোনও। সে গিয়ে সোফায় বসে। তখনও জানত না, একটু পরেই মাথা নামিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে।

আজকের রোদটা কি বেশি কড়া? নাকি লাগছে? নিষাদের ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে, এভাবে এলোমেলো না ঘুরে কোথাও একটু বসলে হত। কোথায় বসবে?

নিষাদের এখন নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সে যে মেসের ঘরটায় থাকে, সেটা দু’জনে ভাগ করে থাকতে হয়। একসময়ে সস্তায় ঘর পাওয়ার জন্য উন্মাদের মতো খোঁজ করছিল। শেষপর্যন্ত শিয়ালদার এই মেসে এসে পৌঁছোল। মেসের নাম ‘দ্য পিস’। ম্যানেজার কার্তিক দাঁ। বোর্ডাররা ঠাট্টা করে।

‘আমাদের ‌পিস পিস করে কাটবে বলে দাঁবাবু এরকম নাম রেখেছেন।’

প্রথমে ঘর নেই বলে নিষাদকে ভাগিয়েই দিয়েছিলেন মাঝবয়সি, টাক মাথার কার্তিক দাঁ। নিষাদ বেজার মুখে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে ফের ডাকলেন।

‘শুনুন, একটা চান্স হতে পারে। তিনতলার সতেরো নম্বর ঘরে ব্রজ থাকে। রেলে চাকরি করে। পাকা কিছু নয়, কনট্র্যাক্ট জব। সে ঘরের ভাড়া শেয়ার করতে চাইছিল।’

নিষাদ শুধু হাতে চাঁদ পেল না, যেন চাঁদে পৌঁছে গেল। বলল, ‘দয়া করে একবার দেখুন না। এতে তো ভাড়া খানিকটা কম পড়বে। পড়বে না?’

কার্তিক দাঁ চিন্তিত মুখে বললেন, ‘খানিকটা কেন, বেশ অনেকটাই কম পড়বে। তবে এখন ‌ওই লোক মত বদলেছে কিনা জানি না। মাসতিনেক আগে একবার বলেছিল বটে। কিন্তু প্রস্তাবটা অদ্ভুত। তাতে কি আপনার চলবে ভাই?’

নিষাদ মিনতির ঢঙে বলল, ‘আমার সবরকম ‌অদ্ভুতই চলবে। খরচটা কম হলেই হবে। আপনি একবার ওকে বলে দেখুন না। আমি তো থাকব শুধু রাতটুকু। সকালে উঠেই কাজকর্মে বেরিয়ে পড়ব। আবার ফিরব সেই রাত করে।’

কার্তিক দাঁ নিষাদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। বললেন, ‘সারাদিন থাকবেন না?’

‘না। মাঝখানে একবার খেতে আসতে পারি। বেশিরভাগ দিন তা-ও আসব না।’

‌কার্তিক দাঁ নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ‘তাহলে হয়তো হতে পারে। আসলে সতেরো নম্বর ঘরটা সিঙ্গল রুম, খাটও একটা। বললাম তো, ব্রজ কাজ করে রেলে। পাকাপাকিভাবে নাইট ডিউটি। সন্ধে পেরোলেই বেরিয়ে পড়ে, ফেরে সেই সকালে। সেদিন আমায় বলছিল, সারারাত ঘরটা তো ফাঁকাই পড়ে থাকে। দেখুন যদি কেউ থাকতে চায়, ভাড়াটা ভাগ হয়। ছুটিছাটায় তো থাকি না। কাঁচরাপাড়ায় দিদির কাছে চলে যাই। তখন গোটা দিনই ঘর ফাঁকা পাবে। আমি গা করিনি। এমন অদ্ভুত প্রস্তাবে কে ঘর নেবে? ও ঘরে যে আর একটা তক্তপোষ ঢুকবে সে উপায়ও নেই। আপনাকে দেখে মনে হল.‌.‌.‌।’

নিষাদ হড়বড় করে বলেছিল, ‘আমি রাজি, খুব রাজি। আপনি কথা বলুন।’

‌কার্তিক দাঁ সেই লোকের সঙ্গে কথা বললেন। ব্যবস্থাও হয়েছে। সন্ধে সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘর নিষাদের। ঘর না বলে ঘরের তক্তপোষটি বলাই ভাল। আবার সকাল সাতটা থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত ঘরের দখল নেয় মাঝবয়সি ব্রজ। খাট ছাড়ার আগে নিজের বিছানাটি বান্ডিল করে তক্তপোষের নীচে ঢুকিয়ে দিলেই হয়। সময়ের একটু এদিক-ওদিক হলে ঘরের বাইরে বারান্দায় বেঞ্চ রয়েছে, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ায় অসুবিধে নেই। নয়তো মেস ম্যানেজারের অফিস রয়েছে। সেখানে বসতে দেয়। জ্বরজ্বারি, অসুখবিসুখ হলে একতলার সিকরুম। তিনদিনের বেশি হলে পাশের সরকারি হাসপাতালে চালান। ব্রজর আবার সে ঝামেলা নেই। সে কাঁচরাপাড়ায় চলে যায়। মেসের বাকি বোর্ডাররা নাক কুঁচকোলেও ‌কার্তিক দাঁ খুশি। তিনি তক্কে-তক্কে রয়েছেন, আর দু’-একটা ঘরে যদি এই সিস্টেম চালু করা যায়।

এখন মেসে ফেরা যাবে না। ব্রজ রয়েছে। লম্বাচওড়া চেহারার লোকটা বয়সে নিষাদের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়। কথাবার্তা প্রায় বলেই না। ঘুমের সময় ঘরে আওয়াজ পেলে বিরক্ত হয়। বাকি কোনও কিছুতে আপত্তি নেই। কাপড়-জামা রাখার জন্য ম্যানেজারবাবু একটা বেঁটে আলমারি দিয়েছে। বারান্দায় তো দড়ি রয়েছে।

নিষাদ পার্কে ঢুকল। কলকাতায় এসে পার্কের বেঞ্চে বসে থাকার অভিজ্ঞতা তার কম নয়। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় কাছেই পার্ক ছিল। যখন ভাল লাগত না, পার্কে গিয়ে বসেছে। ছাউনি দেওয়া বেঞ্চে শুয়ে ঘুমিয়েওছে কতবার। মেঘপর্ণা শুনে রাগ করত।

‘এ মা!‌ পার্কে শুয়ে ঘুমোবে কেন?’

নিষাদ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, অসুবিধে কী? তোমাদের কলকাতার পার্কগুলো তো সু্ন্দর। গাছ টাছ রয়েছে…’‌

‌মেঘপর্ণা নাকমুখ সিঁটকে বলেছে, ‘থাকুক, তুমি একদম পার্কে ঘুমোবে না। যারা ভিক্ষে করে আর ভবঘুরে তারা পার্কে ঘুমোয়।’

নিষাদ হেসে বলল, ‘আমিও তাই। ভিখিরিই তো।’

মেঘপর্ণা গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘এরকম কথা বলবে না।’

নিষাদ বলল, ‘মনখারাপ কোরো না। আমার অবস্থা কিন্তু সত্যি খুব খারাপ। ঠিকমতো কোনও কাজকর্ম নেই। ভিখিরির চেয়েও খারাপ বলতে পারো। কলেজ-ইউনিভার্সিটি পাশ করে সময় নষ্ট করতে হয়নি তাদের।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘সব সময় কাজ নেই, কাজ নেই বলবে না তো। আমিও তো বিএ পাশ করেছি, আমি কি চাকরি করি? আমার বন্ধুরাও করে না। পরীক্ষা দিচ্ছে তো দিচ্ছেই।‌ কাজকর্মের অবস্থা খুব খারাপ। আমার পিসতুতো দাদা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ঘরে বসে রয়েছে।’

নিষাদ বলল, ‘আমাকে কাজ পেতেই হবে। বাড়িতে টাকা নেই, এদিকে তুমি আছ।’

মেঘপর্ণা বলল, ‘সে যখন হবে, তখন হবে। আগে বলো আর কোনওদিন পার্কের বেঞ্চে ঘুমোবে না। আমার গা ছুঁয়ে বলো।’

নিষাদ মেঘপর্ণার ছেলেমানুষিতে হেসে ফেলেছিল। তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ছুঁয়ে বলে, ‘কলকাতার মেয়েরা এসব বিশ্বাস করে নাকি! কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে তো দেখিনি।‌’

মেঘপর্ণা মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘আমি করি। আমি তো তোমার কলেজ, ইউনিভার্সিটির বান্ধবীদের মতো মডার্ন নই।’

নিষাদ বলল, ‘রাগ করছ কেন? আমি কি তাই বলেছি? আচ্ছা বাবা, আর কোনওদিন পার্কের বেঞ্চে ঘুমোব না।’

পার্কে ঢুকে কোনার দিকে একটা বেঞ্চে বসল নিষাদ। লোহার ভাঙা বেঞ্চ। তার কিছু ভাল লাগছে না। ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়তে। একমাত্র ঘুমিয়ে পড়লে হয়তো সব ভুলে থাকা যাবে।

‌মেসবাড়িতে থাকা নিষাদের অবশ্য এই প্রথম নয়। কলকাতায় এসে সে প্রথম ঘর জোগাড় করেছিল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের এক মেসবাড়ির চিলেকোঠায়। ম্যানেজার একসময় সুরুলপুরে থাকত। সুরুলপুরের ছেলে শুনে নামমাত্র ভাড়ায় নিষাদকে ব্যবস্থা করে দেয়। সে ভাড়াও ঠিকমতো দেওয়া হত না। ম্যানেজার নিজের পকেটে থেকে দিয়ে দিত। বছর দুয়েক এভাবে চলার পর সেই ম্যানেজারের চাকরি গেল। তিনদিনের নোটিসে নিষাদেরও সেখান থেকে পাট উঠল। কলেজে তখন ফাইনাল ইয়ার চলছে। বিরাট বিপদের মধ্যে পড়ে নিষাদ। কলেজের অ্যাসিসট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান অসিত সরখেল, নিষাদের চুপচাপ, একা থাকা স্বভাব বহুদিন ধরেই নজর করেছিল। ফাঁক পেলেই ছেলেটা লাইব্রেরিতে এসে বসে। যেন সবার থেকে পালিয়ে আসে। ছেলেমেয়েদের হুল্লোড়ে আগ্রহ নেই, বরং ভয় রয়েছে। লাইব্রেরিতে বই নিয়ে বসত ঠিকই, তবে মাঝেমধ্যেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকত বাইরে। ছেলেটার মুখে একধরনের বিষণ্ণ ভাব। মুখোমুখি হলে হাসত, সেই‌ হাসিটাও যেন মনখারাপের। সবার জীবনেই অল্প কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছাড়াই যাদের পছন্দ হয়ে যায়। অসিত সরখেলেরও তাই হয়েছিল। নিষাদকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তবে কথা কমই হত। কিছু জিজ্ঞেস করলে এই ছেলে ‘চলছে, দেখি’ ধরনের উত্তর দিয়ে চুপ করে যেত। অন্যের মুখ থেকে নিষাদের কলকাতায় থাকার সমস্যা জানতে পেরেছিল অসিতদা।

‘নিষাদ, আমি সব শুনেছি, তুমি আমার বাড়িতে থাকবে চলো।’

‘তা কী করে হয় অসিতদা? আপনার অসুবিধে হবে।’

‘কিচ্ছু অসুবিধে হবে না, একজন একস্ট্রা মানুষের থাকার মতো‌ ঘর আমার রয়েছে।’

‘থাক, আমি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে নেব।’

‘তোমাকে তো দেখছি বাপু, ব্যবস্থা করার ছেলে তুমি নও। এতদিন হয়ে গেল, হস্টেলে একটা সিট ম্যানেজ করতে পারলে না। যদি আমি চেষ্টা করব বলি, তাতেও রাজি হবে না।’

নিষাদ নিচু গলায় বলল, ‘চেষ্টা করে লাভ কী? খরচ দিতে পারব না।’

‘ফ্রিতে থাকারও নিয়ম রয়েছে। ফ্রি স্টুডেন্টশিপ। বলো তো সেটা দেখি।’

‘দরকার নেই অসিতদা, ওতে বিরাট লাইন। লাইন টপকে কিছু করতে পারব না। সবাই আঙুল তুলবে, সে বড় বিচ্ছিরি।’

অসিত সরখেল হেসে বলল, ‘এই জন্যই তোমাকে হয়তো পছন্দ হয়। ঠিক আছে। ক’টা দিনের জন্য না হয় আমার ওখানে চলো। ফাইনাল পরীক্ষাটা তো দিতে হবে। যতদিন ঘর না পাও, আমার কাছে থাকবে।’

সংকোচ আর অনিচ্ছে নিয়েই গিয়েছিল নিষাদ। উপায় ছিল না কোনও। ক’দিনের জায়গায় সে-ও গড়িয়ে তিন মাস হয়ে যায়। এরপর গৃহকর্ত্রী আপত্তি করলেন। বাড়িতে তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে। সে বড় হচ্ছে। এই সময় উটকো কাউকে বাড়িতে রাখা বিপজ্জনক। মেয়ের বাপের কাণ্ডজ্ঞান না থাকতে পারে, মায়ের তো রয়েছে। নাবালিকার শ্লীলতাহানির খবর তো খবরের কাগজে আকছার বেরোচ্ছে। মহিলা একদিন রাতে স্বামীর উপর খুব চোটপাট করলেন।

‘তুমি বোঝ কী? পুরুষমানুষের নোংরামো বোঝ? মেয়েমানুষের গা দেখার জন্য তারা কেমন ছোঁকছোঁকানি করে জানো? বয়সের বাছবিচার করে না।’

‘এসব কী বলছ? আস্তে বলো, ছেলেটা শুনতে পাবে।’

‘পাক। তিনদিন বলে যে তিনমাস থেকে যায়, তার এসব শোনা উচিত।’

‘নিষাদ খুব ভাল ছেলে। চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির ছেলে। ওর বাবা একজন অনেস্ট মানুষ ছিলেন। আমি সব খোঁজ নিয়েই ওকে থাকতে দিয়েছি।’

‘মুখচোরা টাইপের ব্যাটাছেলেরা বেশি বদ হয়। ওকে তুমি এখনই তাড়াও।’

রাতে অসিতদা মুখ চুন করে এসে বলল, ‘আমার কিছু করার নেই। তুমি তো সব জানো। আরও দিনতিনেক না হয় সময় নাও।’

নিষাদ বলল, ‘আপনি তো অনেক সময় দিয়েছেন। তিনদিন লাগবে না। কালই চলে যাব।’

ফাইনাল পরীক্ষা সেবারের মতো মুলতুবি রেখে বইখাতা বাক্সপ্যাঁটরায় ভরে সুরুলপুরে ফিরবে ঠিক করেছিল নিষাদ। এমন সময় যোগাযোগ হল কানু পালের সঙ্গে। এন্টালির কাছে লেদ মেশিনের ব্যবসা। গাড়ি আর মেশিনের পার্টস ঘষামাজা হয়। কারখানায় সকালে বিকেলে দু’ঘণ্টা করে বসার লোক খুঁজছিল কানু। সৎ, সাদাসিধে লোক। কাজ কিছু করতে হবে না, লেবারদের উপর নজর রাখলেই চলবে। ফাঁকি দিলে মালিককে রিপোর্ট করতে হবে। পার্টি এলে দরদস্তুর করে টাকাপয়সা বুঝে ক্যাশবাক্সে ফেলতে হবে। কারখানায় কানু পাল নিজেই থাকে। তবে সকালে পুজোআচ্চা করে আসতে দেরি হয়ে যায়। অনেকসময় পার্টি ফসকে যায়। বিশেষ করে গাড়ির ছোটখাটো কাজ অফিসটাইমের আগেই হয় কিনা। তাড়া থাকে। আবার বিকেলে একটু বিশ্রাম না দিলে শরীরটা আজকাল বাগে রাখা যাচ্ছে না। বয়স বাড়ছে। পঞ্চান্ন ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই কারণেই লোক খোঁজা। নিষাদ শেষ চেষ্টা করল। যদি একটা ঘর ভাড়ার টাকা জোগাড় করা যায়। দিনে কাজ করে, রাত জেগে তো কতজনেই পড়াশোনা করেছে।

পাকানো চেহারার কানু পালের গায়ের রং ময়লা। চোখ চঞ্চল। লেদ মেশিনের স্পিন্ডলের মতো ঘোরে। মানুষটা একটু পর-পর চশমা চোখে নামায় আর কপালে তোলে। মুদ্রাদোষের মতো। চশমা একবার চোখে নিয়ে, একবার কপালে তুলে নিষাদকে খানিকক্ষণ দেখল।

‘লেদের কাজ কিছু জানো? ড্রিলিং, রিমিং, থ্রেডিং কী বলতে পারবে?’

‘না।’

‘এটা ভাল কথা। কাজকর্ম জানা মানেই চুরি চামারির ফাঁকফোকর জানা। করো কী?’

নিষাদ বলল, ‘কলেজে পড়ি।’

‘থাকো কোথায়?’

‌নিষাদ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘সুরুলপুরে। কলকাতায় ‌পাকাপাকি কোথাও থাকার জায়গা নেই। কাজকর্ম পেলে ঘর দেখতে পারি।’

কানু পাল একটু ভেবে, ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কাজের বদলে ঘর প্রকল্পে রাজি আছ‌?’

নিষাদ অবাক হয়ে বলে, ‘কাজের বদলে ঘর প্রকল্প!‌ সেটা কী?’

‘পাইকপাড়ায় আমার একতলা বাড়ি রয়েছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একাই থাকি, যদি রাজি হও পিছনের ঘরটা খুলে দিতে পারি। খাট, মশারি পাবে। সেখানে থেকে কাজও করবে, আবার কলেজেও পড়বে। রাজি থাকলে বলো। তাহলে কিন্তু মাইনেপত্তর হবে না।’

‌নিষাদ একটু থমকে থেকে বলে, ‘রাজি আছি।’ এর বাইরে তার বলার মতো কিছু ছিলও না। আগে তো মাথা গোঁজা।

পাইকপাড়ার সেই ঘরেও বেশিদিন টেকা যায়নি।

একদিন সেই বাড়িতে ফিরে নিষাদ দেখল ঘর খোলা। কানু পালের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। দরজার ফাঁক দিয়ে নিষাদে দেখে, কানু পাল খাটে আধশোয়া। এক মহিলা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে তার কপাল টিপে দিচ্ছে। আর ঝুঁকে পড়ে চাপা স্বরে কিছু বলছে। দরজার ফাঁক দিয়ে মহিলার নগ্ন বুকও দেখা যাচ্ছে। সেই বুক সে কানুর ঘাড়ে পিঠে ছুঁইয়ে রেখেছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল নিষাদের। সে পা টিপে সরে আসে। ফেরে অনেক রাতে। পরদিন খুব সকালে জামাকাপড় ব্যাগে ভরে ঘর ছাড়ে কানু পালকে কিছু না জানিয়েই।

নিষাদের ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম পাচ্ছে। সে ভাঙা বেঞ্চে পা তোলে।

স্কুলে পড়ার সময় বাবা শাশ্বত সেনগুপ্ত মারা যায়। সুরুলপুর শহর থেকে একটু সরে বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেছিল শাশ্বত। ছোট বাড়ি। চাকরিও ছিল ছোট। ব্যাঙ্কের লোন পেয়েছিলেন সামান্য। বাকিটা এর তার কাছ থেকে ধার। সেই আড়াই কামরার বাড়ি অসমাপ্ত রেখেই মানুষটা ‘গুডবাই’ বলল। স্ত্রী নয়নতারা ছোট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পড়ল অথৈ জলে। মাথায় ধারের পাহাড়, সংসার চালানোর মতো সঞ্চয় কিছু নেই। উইডো পেনশনটুকু ভরসা। পরে মহিলাদের এক এনজিওতে যুক্ত হয়ে সেলাই বোনায় ঢুকল। সে আর কতটুকু?

এই অবস্থায়‌ স্কুল শেষের পরীক্ষায় আহামরি কিছু না করলেও, মোটের উপর ভাল রেজ়াল্ট করে ফেলল নিষাদ। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে বসল। বলল, ‘কলকাতায় পড়তে যাব।’

ছেলের কথায় নয়নতারা আকাশ থেকে পড়ে।

‘কলকাতায় পড়ানোর পয়সা কোথায় আমার? তুই কি পাগল হলি?’

‘মা, কলকাতায় সুযোগ বেশি। ওখানে ভাল কলেজ রয়েছে।’

নয়নতারা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এখানেও তো কলেজ রয়েছে। ভাল মাস্টার, দিদিমণি রয়েছেন। কলকাতার মাস্টাররা কী এমন দিগ্‌গজ?’

মায়ের বিরক্তিতে খানিকটা গুটিয়ে গিয়েছিল নিষাদ। নয়নতারা সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকে। দুনিয়ার কোনও কিছুই তার ভাল লাগে না। স্বামীর মৃত্যু তার কাছে শোকের চেয়েও অনেক বেশি সমস্যার। সে সর্বক্ষণ স্বামীকে দোষারোপ করে। কী দরকার ছিল এত ধারের বোঝা নিয়ে বাড়ি করার? ভাড়াবাড়িতে কী থাকা যেত না? রাগ করার আরও কারণ আছে। দেশের জমিজমার ভাগ থেকে শাশ্বত নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। অভাব হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয় নয়নতারাকে, কম বয়সের বিবেক, মূল্যবোধ, নীতিজ্ঞানের কোনও মূল্য নেই। তারা শুধু ক্ষতিই করে। চিন্তা আর পরিশ্রমে শরীরটাও ভেঙে গিয়েছে। প্রেশার বেশি, সুগারও হয়েছে। রাতে ঘুম হয় না। জেগে বসে থাকে। আলো জ্বেলে সেলাই নিয়ে খুটখাট করে। ছেলে আগে থেকেই আলাদা শোয়, মেয়ে তার সঙ্গে শুত, রাতে মায়ের খুটখুটানিতে ঘুমের অসুবিধে হয় বলে সেও ঘর বদলেছে।

নিষাদ আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘এখানে ভাল টিচার রয়েছেন ঠিকই, তবে কলকাতায় অনেক বেশি ‌রয়েছে।’

‌নয়নতারা ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘ওখানে ‌খরচও বেশি। বোকার মতো কথা বলবে না। বড় হয়েছ, সংসারের অবস্থা বুঝে চলতে শেখ। কত তাড়াতাড়ি একটা চাকরি জোটাতে পার, জুটিয়ে সংসারে একটু স্বস্তি দিতে পার, সে কথা ভাব।’

নিষাদ নিচু গলায় বলল, ‘কলকাতায় কাজ পাওয়ার সুযোগ বেশি।’

নয়নতারা বলল, ‘সে সুযোগ তুমি এখানে লেখাপড়া করলেও পাবে। ভাল করে লেখাপড়া করলে কাজ পেতে অসুবিধে হয় না। যা পারব না তা নিয়ে আবদার কোরো না। তোমার বাবা ছোট চাকরি করত, চলেও গেল মাথার উপর একগাদা ধার রেখে। এক পয়সাও সঞ্চয় করেনি। বোকার মতো রাজনীতি করেছে। সংসারের কথা না ভেবে মিটিং, মিছিল করেছে। ওই সময় দুটো ছেলে পড়ালে ক’টা পয়সার মুখ দেখতে পেতাম। দেখছ তো কত কষ্ট করে চলতে হয়। এ বিষয়ে আর একটা কথাও বলবে না।’

মায়ের ধমকে চুপ করে যায় নিষাদ। কিন্তু কথা বলেছিল সিন্ধুরা। সিন্ধুরা তখন স্কুলে। বয়সের তুলনায় এই কিশোরী বেশি বুদ্ধিমতী। মায়ের সঙ্গে তার খটামটি লেগেই থাকে। মেয়েদের বেশি বুদ্ধির এটাই সমস্যা। সমাজের ঠিক করে দেওয়া নিয়ম চুপচাপ মেনে নেওয়ার বদলে তারা কথা বলতে শুরু করে। সিন্ধুরাও তাই। সে তার দাদার মতো নয়। সে তার বাবার মতো।

‘দাদা চাইছে যখন, আটকাচ্ছ কেন ‌মা? যেতে দাও।’

নয়নতারা মেয়েকে ধমক দিয়েছিল‌, ‘তুই চুপ কর। ছেলেমানুষ ছেলেমানুষের মতো থাক। সব বিষয়ে পাকামি করবি না। কলকাতায় থাকা খাওয়ার খরচ জানিস? এখানে তাও তোর কাকা-জেঠারা দেশের বাড়ি থেকে বছরের চালটা পাঠায়, তাই রক্ষে।’

সিন্ধুরা বলে, ‘ওই দয়ার চাল তুমিও না হয় দাদাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবে। ‌দাদা কষ্ট করে থেকে যাবে কোথাও।’

নয়নতারা চোখ পাকিয়ে বলেছিল, ‘দয়ার চাল!‌ তুই ঠাট্টা করছিস?’

কিশোরী সিন্ধুরা শান্ত গলায় বলে, ‘ঠাট্টা করব কেন? যে সম্পত্তির ভাগ বাবা ঘেন্নায় ছেড়ে দিয়েছিল, তার থেকে আসা চাল তুমি সিরিয়াস মুখে নিতে পারলে, আমি কেন তা নিয়ে ঠাট্টা করতে যাব ‌মা?’

নয়নতারা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিল, ‘এটা ‌তোর বাবার অনেকগুলো ভুলের একটা। বাড়ি-জমির ভাগ ছাড়া উচিত হয়নি। বিপ্লবীপনা দেখাতে হলে সংসার না করাই উচিত ছিল। ওই চাল দয়ার নয়, আমাদের হকের। ওরা কম দেয়, আরও দেওয়া উচিত। জমির ভাগও দেওয়া উচিত। তোর বাবা যে ভুল করেছিল, তা যে সংশোধন করা যাবে না, এমন তো কোনও নিয়ম নেই।’

সিন্ধুরা মুচকি হেসে বলেছিল, ‘এখন আর ওকথা ভেবে লাভ কী মা? বাবা যা ভুল করার সেটা করে কেটে পড়েছে। তুমি তো আর ভুল করছ না। চাল তো আসছে।’

নয়নতারা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘সেই চাল তো দু’বেলা তুমিও গান্ডেপিন্ডে গিলছ।’

সিন্ধুরা বলল, ‘এখন উপায় নেই বলে গিলছি, যেদিন থাকবে গিলব না।’

সিন্ধুরা কিশোরী বয়স থেকেই দেখতে সুন্দর। শুধু স্বভাব নয়, দেখতেও বাবার মতো হয়েছে। গায়ের রং কালোর দিকে, রোগা চেহারায় ধারালো ভাব। আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের চেয়ে লম্বা। উজ্জ্বল দুটো চোখ, কাজল ছাড়াই গভীর। সাজগোজ একেবারেই করে না। নয়নতারা চাপাচাপি করলে লম্বা চুলে বিনুনি করে নেয় শুধু। আর একটু বেশি হলে চওড়া কপালে ছোট একটা টিপ। আচরণে বাড়তি মেয়েলি ভাব নেই। নিষাদ আবার তার মায়ের মতো। ফরসা, নরমসরম চেহারা। চোখে মায়া। কোঁকড়ানো চুল। নয়নতারাও বয়সকালে সুন্দর ছিল।

নয়নতারা আর রাগ ধরে রাখতে পারেনি। চিৎকার করে বলেছিল, ‘তুই সামনে থেকে চলে যা সিন্ধু। তোর মুখ দেখতে চাই না। ‌এরপর কিন্তু চড়-থাপ্পড় মেরে দেব।’

সিন্ধুরা বলে, ‘তুমি যে আমার মুখ দেখতে চাও না, সেটা আজকের নয়, অনেক পুরনো ঘটনা মা। আমি সব জানি। বারবার মনে করাও কেন?’

নিষাদ এগিয়ে তার বোনের হাত ধরে নিচু গলায় বলে, ‘সিন্ধু, তুই যা তো। নিজের ঘরে গিয়ে পড়তে বোস।’

‌নয়নতারা এসে মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়। রাগে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলে, ‘কী জানিস? কী জানিস তুই?’

সিন্ধুরা বলে, ‘বললে তোমার ভাল লাগবে না মা। নিজের লজ্জার কথা শুনতে ভাল লাগে না। বেশি বয়সে তো একেবারেই নয়।’

‌‌নয়নতারা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। মেয়ের গালে সপাটে চড় মারে। সিন্ধুরার গাল থেকে সেই চড়ের দাগ মুছতে সময় লাগে। তবে নয়নতারা ছেলেকে কলকাতায় পড়তে যাওয়ার অনুমতি দেন।

নিষাদের মনে পড়ল, পলাশকে ফোন করতে হবে। এখনই করতে হবে। কিন্তু তার মোবাইলে যে পয়সা নেই! পার্কের বাইরে বেরিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে। সে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়ল।

কলেজে পলাশ সর্বক্ষণ হইহই করত, একবার বকবক শুরু করলে থামত না। বাজি ধরে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে পারত। দু’-চারদিনের মধ্যে সেই মেয়েকে নিয়ে হয় সিনেমায়, নয় চলে যেত রেস্টুরেন্ট। মনের আনন্দে কাটলেট চিবোত। রাজনীতিও করেছে। বিরাট কিছু না। স্টুডেন্টস ইউনিয়ন থেকে ডাকলে টুক করে গিয়ে কলেজ স্ট্রিটে একটু হয়তো মিছিল করে আসত। পলাশ কেন যেন নিষাদকে গার্ড দিয়েছে বরাবর। হয়তো মায়া হত। কলেজে সহপাঠীরা ঠাট্টা করলে পলাশ তাদের ধমক দিত।

মোবাইলে রিচার্জ করে পলাশের নম্বর টিপল নিষাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *