নিষাদ – ১১

১১

সুরুলপুরে ফেরার সময় সিন্ধুরার কাছে পরপর দুটো ফোন আসে। একটা করে অগ্নীশ পাল, অন্যটা শাম্ব। প্রথম ফোনটাই ছিল অগ্নীশের। তখন দহলা স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে সিন্ধুরা।

‘গাড়ি পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

এবার অগ্নীশ গাঢ় স্বরে বলল, ‘‌কেমন লাগল সিন্ধুরা?‌’

‌সিন্ধুরা একটু চুপ করে থেকে লজ্জাভরা গলায় বলল, ‘জানি না।’

অগ্নীশ সামান্য হাসল। বলল, ‘‌আমার যদি শরীরটা ভাল থাকত, আমি নিজে গিয়ে আজ তোমাকে সুরুলপুরে পৌঁছে দিয়ে আসতাম।’

সিন্ধুরা শান্তভাবে বলল, ‘আপনি রেস্ট নিন। শরীরটা সারাতে হবে।’

‌অগ্নীশ বলল, ‘‌তুমিই আমাকে সারিয়ে দিয়ে গেলে সিন্ধুরা। আবার কবে আসবে?‌’

সিন্ধুরা বলল, ‘এখন হবে কী করে?‌ সামনে দলের কত কাজ।’

‌অগ্নীশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘রাখ তোমার দল। নিজেদের সুখ, নিজেদের প্রাপ্তি নিয়েও তো ভাবতে হবে। শুধু অন্যের জন্য আর কত খেটে মরব? আর পেলামই বা কী?‌’

সিন্ধুরা চমকে উঠল। এই মানুষটা এতদিন ছিল দূর থেকে দেখা ‌আইকন, আজ হয়েছে ব্যক্তিগত আর ‌ঘনিষ্ঠ‌। তার মুখে এ কী কথা! সে কি ভুল শুনল‌?‌

অগ্নীশ জোরের সঙ্গে বলল, ‘‌সিন্ধুরা, এখনই একটা কথা জেনে রাখ, এই পার্টি পলিটিক্স করে আগের সংসার আমি ভেঙেছি। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক আমি ভাঙব না।’‌

সিন্ধুরা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে একটু ঝুঁকে কথা বলছিল। এবার সোজা হয়ে বসল, ‘এসব আপনি কী বলছেন অগ্নীশদা!‌ শান্ত হন।’

‘আমি ভেবেচিন্তেই বলছি সিন্ধুরা। তোমার সম্মতি যখন পেয়ে গিয়েছি, আর দেরি করব না। বারবার একই ভুল করব না। পার্টি যদি আমার আর তোমার সম্পর্ক নিয়ে কোনও আপত্তি তোলে, আমি যে কোনও এক্সট্রিমে যেতে রাজি আছি। সেরকম হলে দল পর্যন্ত ছেড়ে দেব। দল আমাকে কী দিয়েছে যে কথা শুনতে হবে?‌’

সিন্ধুরার শরীর কেঁপে ওঠে। কী বলছে অগ্নীশদা!‌ মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘এই প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে!‌‌ আপনি উত্তেজিত হবেন না। শরীর খারাপ আপনার। আমরা পরে কথা বলব।’

‌অগ্নীশ দম নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, পরেই না হয় কথা হবে। আমি আমার মনোভাবটা তোমায় জানিয়ে রাখলাম। সেরকম হলে তুমিও দলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবে। ও, আর একটা কথা, স্কুলের কাজটায় এই সপ্তাহেই জয়েন করে যাও। একটা চিঠি ম্যানেজমেন্টের কাছে দিয়ে দিলেই হবে। সেখানে ভুল স্বীকার করবে।’

সিন্ধুরা যেন জোরে ধাক্কা খেল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘ভুল!‌ কীসের ভুল?’

‌‌অগ্নীশ সহজভাবে বলল, ‘ও কিছু নয়। সেই যে ঝগড়া করেছিলে, তার জন্য একটা ক্ষমা চেয়ে চিঠি দিও। সেখানে একটা লাইন লিখে দিও, ভবিষ্যতে এমন আর হবে না। দু’লাইনের তো ব্যাপার। এই নিয়ে আর কথা বাড়িও না। যা বলছি লক্ষ্মী মেয়ের মতো করে দিও।’

মাথায় আগুন জ্বলে উঠল সিন্ধুরার। মানুষটা কী মনে করছে?‌ দুর্বল মুহূর্তে শরীর পেয়েছে বলে নিজেকে সিন্ধুরা সেনগুপ্তর মালিক ভাবছে?‌ যে অগ্নীশ পালকে সে ভালবেসেছে, সে তো এই মানুষ নয়!‌ তবে কি মুখোশ ছিল?‌ আজ পোশাকের সঙ্গে তাও খুলে ফেলল?‌ একই সঙ্গে রাগ আর কষ্ট হচ্ছে সিন্ধুরার। দমবন্ধের মতো লাগছে। লোকটা এতটা মিথ্যে?‌ এতটা বানানো?‌

দাঁতে দাঁত ঘষে সিন্ধুরা বলল, ‘আমি কোনও চিঠি দেব না। চাকরি ফেরত চাই না আমার। অগ্নীশদা, বলতে খুব খারাপ লাগছে, তাও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি যেমন দুর্বল হতে জানি, তেমন কঠিনও। আমাকে ব্ল্যাকমেল করে চাপ দেওয়া যাবে না।’

অগ্নীশের ফোনটা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাম্বর ফোন। সে এক নিশ্বাসে খবর জানাল।

সুরুলপুরে ভয়ংকর গোলমাল হয়েছে। পথের ধারে যেখানে কয়েকজন ধর্নায় বসেছিল, বিকেলে সেখান থেকে হঠাৎই ইট-পাথর ছোড়া শুরু হয়। গাড়ি ভাঙচুর হয়, আগুন লাগে। পুলিশ আসে। পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়, টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটাতে হয়। অনেকে জখম হয়। তার মধ্যে দু’জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রাতে তাদের খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।

শাম্ব বলল, ‘আমার ভয় করছে সিন্ধুরা। খুব ভয় করছে। আমি রাতের বাস ধরে কলকাতায় মামাবাড়ি চলে যাচ্ছি। তুইও কোথাও চলে যা।’‌

সিন্ধুরার বুক কেঁপে উঠল। ঘটনা এতখানি ছড়াবে, সে ভাবতেও পারছে না। কথা তো ছিল, মাত্র ক’টা ইট-পাটকেল পড়বে। সেখান থেকে এত বড় গোলমাল হয়ে গেল!‌‌ নাকি কেউ বাড়িয়ে দিল?‌ বাঁশরীকে ফোন করতে গিয়ে নিজেকে সামলাল সিন্ধুরা। কারও সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ করা এখন ঠিক নয়।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে সাইকেলে থমথমে সুরুলপুরের মধ্যে দিয়ে বাড়ি যেতে যেতে মনে হল, সন্ধেতেই নিঝুম রাত নেমেছে। বাড়িতে ঢোকার আগে অগ্নীশের নম্বর টিপল সিন্ধুরা। ফোন বন্ধ। ভিতরে ঢুকে দেখল, মা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রয়েছে। চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে।

গভীর রাতে পুলিশ এসে দরজায় ধাক্কা দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *