নিষাদ – ১

রিসেপশনে বসা মেয়েটি ইন্টারকমে কথা বলছে।

ঠিক কথা বলছে না, নিচু গলায় ‘হুঁ, হাঁ’ করে ইন্টারকমের ওপাশের কথা শুনছে। ‘হুঁ, হাঁ’ শেষ হলে রিসিভার নামিয়ে মুখ তুলে বলল, ‘আপনি চলে যান। স্যার আজ দেখা করতে পারবেন না।’

নিষাদ বিস্মিত গলায় বলল, ‘সে কী, ‌দেখা করতে পারবেন না!‌‌‌ কেন?’

মেয়েটি কঠিন অথচ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কেন তো বলতে পারব না। উনি আমাকে কিছু বলেননি। আপনি পরে যোগাযোগ করে আসবেন।’

নিষাদ কাঁচুমাচুভাবে বলল, ‘আমি তো যোগাযোগ করেই এসেছি। উনি আমাকে আসতে বলেছেন। এগারোটার সময় আসতে বলেছেন। এখনও এগারোটা বাজতে সাত মিনিট দেরি।’

মেয়েটি একই রকম ঠান্ডা গলায় বলল, ‘উনি আপনাকে আসতে ‌বলেছিলেন, কিন্তু এখন হয়তো ইমার্জেন্সি কাজে আটকে গিয়েছেন। ইমার্জেন্সি কাজ কখন এসে পড়বে আগে থেকে তো বলা যায় না। যায় কি?’

নিষাদ এবার ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘আমার কাজটা খুব জরুরি ম্যাডাম।’

‘ম্যাডাম’ সম্বোধনে কমবয়সি মেয়েটি যে খুশি হল, এমন মনে হয় না। নিচু গলায় খানিকটা বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যারের ইমার্জেন্সি কাজ, না আপনার সঙ্গে দেখা করা, কোনটা বেশি জরুরি আমি বলতে পারব না। স্যার জানেন।’

নিষাদ বলল, ‘নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার নাম কি আপনি ঠিকমতো বলেছেন? আমার নাম নিষাদ, নিষাদ সেনগুপ্ত।’

মেয়েটি একমুহূর্ত চুপ করে নিষাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। পলক না ফেলেই তাকাল। সেই দৃষ্টিতে একই সঙ্গে অবজ্ঞা এবং বিস্ময়। তারপর কেটে কেটে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘মি. সেনগুপ্ত, স্যারের কাছে ভিজ়িটরের নাম ঠিক করে বলাটা আমার চাকরি। সারাদিন কম করে একশোটা নাম আমাকে ঠিক করে বলতে হয়। আপনার নামও আমি ঠিক বলেছি।’

নিষাদ অস্থিরভাবে বলে, ‘আমি তা বলিনি, হয়তো উনি ভুল শুনেছেন। এমনটাও তো হতে পারে। প্লিজ় আপনি স্যারের সঙ্গে আর একবার কথা বলুন। বলুন, আমার খুব প্রয়োজন। উনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, উনি জানেন।’

মেয়েটি অবাক গলায় বলল, ‘আপনার কি ধারণা এখানে লোক আসে স্যারের সঙ্গে গল্পগুজব করতে? মি. সেনগুপ্ত, এই অফিসে‌ সবাই প্রয়োজনে আসে। এটা নতুন করে আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।’

নিষাদ বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার সমস্যাটা আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না.‌.‌.‌আজ আমাকে দেখা করতেই হবে.‌.‌. ‌স্যার বলেছিলেন.‌.‌.‌’

সামনে কম্পিউটার থাকায় মেয়েটির পুরো মুখ সবসময় দেখা যাচ্ছে না। নড়াচড়ায় মাঝেমধ্যে ঢাকা পড়ছে। যখন দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, জোর করে কঠিন ভঙ্গিতে কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে, কঠিন কথা বলায় এই মেয়ে অভ্যস্ত। তবে কি আজ তাকে সেরকম নির্দেশ দেওয়া হয়েছে? বলা হয়েছে, ‘নিষাদ নামে কোনও যুবক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে তার সঙ্গে কঠিনভাবে কথা বলবে?’ মেয়েটির গায়ের রং কালোর দিকে। মুখে ঘনঘন পাউডার মাখায় দেখাচ্ছে ফ্যাকাসে। ঠোঁটে লিপস্টিকও বেশি। তারপরেও এক ধরনের আলগা শ্রী রয়েছে। বয়স কম হওয়ার শ্রী।

এবার ‘আলগা শ্রী’-এর মেয়ে কঠিন এবং ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘সরি, আমার কিছু করার নেই। আপনি এখন আসতে পারেন। আমাকে যেমন জানানো হয়েছে তেমনটাই বললাম। পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসবেন।’

কথা শেষ করে মেয়েটি মাথা নামিয়ে কম্পিউটারে মন দিল। তার সামনে যে উনত্রিশ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে, ভুলেই গেল যেন।

এই মেয়ে নিষাদকে চেনে, এমন নয়। নিষাদও চেনে না। নামও জানে না। অচেনা অফিসের রিসেপশনে বসা তরুণীর নাম জানার কোনও কারণ নেই। তবে মুখ চেনা হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে তিনদিন হল নিষাদ এখানে আসছে। প্রথম দিন ‘স্যার’-এর ঘর থেকে বেরনোর পর মেয়েটি নিষাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। পেশাদার হাসি। কে জানে, সেদিন হয়তো হাসারই নির্দেশ ছিল। গত দু’দিনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে এসেছিল নিষাদ। তখন একেবারে উলটো ব্যবহার করেছিল এই মেয়ে। সেই ব্যবহার ছিল যথেষ্ট মার্জিত। অথচ আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকা সত্ত্বেও কঠিন আচরণ করছে। অবশ্য একটু আগে করেনি, কঠিন হয়ে উঠেছে ওর স্যারের ঘর থেকে ফোন আসার পর।

নিষাদ এবার মিনতি করার ঢঙে বলল, ‘দয়া করে আর একবার ওঁকে জিজ্ঞেস করুন। আমার মোবাইল থেকে ফোনে পাচ্ছি না। আপনি একটু ফোনে ধরে দিন, আমি কথা বলছি। কোনও কারণে ভুলে গিয়েছেন হয়তো।’

মেয়েটি মুখ তুলে কিছু বলতে গিয়ে নিজেকে সামলায়। মনে হয় আরও কড়া কথা কিছু বলতে যাচ্ছিল। গলা নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘সরি, আমার কিছু করার নেই। স্যারকে আর ডিসটার্ব করা যাবে না।’

নিষাদ বলল, ‘আজ যদি ওঁর সঙ্গে আমার দেখা না হয়, আমি খুবই বিপদে পড়ব।’

অপূর্ব রায়কে নিষাদ সতেরো দিন আগে প্রথমবার ফোন করেছিল। তখন সকাল সাতটা বেজে চল্লিশ মিনিট।

‘স্যার, আমার নাম নিষাদ.‌.‌.’

ওপাশে যে মানুষটি ফোন ধরেছিল সে পুরো বাক্য শুনতে চায়নি, ঘুমভাঙা ভারী ও বিরক্ত গলায় বলে, ‘কে আপনি? এত সকালে ফোন করছেন কেন? আপনাদের কি কোনও সেন্স নেই?’

নিষাদ কঠিন কথায় অভ্যস্ত। প্রথমদিকে গায়ে লাগত। অপমানে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করত। মনে হত, এই শেষ। আর কোনওদিন কাউকে কাজের জন্য বলবে না, কারও কাছে যাবে না। যত সময় গিয়েছে বুঝতে পেরেছে, রাগ করে লাভ নেই। উপায়ও নেই। গত তিন বছর ধরে সে চাকরি খুঁজছে। আহামরি কিছু নয়, মোটের উপর ভদ্রস্থ একটা চাকরি। খুব বেশি বেতন লাগবে না। ছোটখাটো একটা বাড়ি ভাড়া করে, বাড়িতে অল্প কিছু টাকা পাঠিয়ে, সাধারণভাবে সংসার চললেই হবে। কম করে তিরিশ জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছে। তার মধ্যে সরকারি বেসরকারি দু’ধরনের কাজই রয়েছে। যত না পরীক্ষা দিয়েছে তার ডবল ইন্টারভিউ দিয়েছে। কোথাও অ্যাপ্লিকেশন করে ডাক পেয়েছে, কোথাও ফোন করায় পৌঁছে যেতে বলেছে। কোথাও আবার ‘ওয়াক-ইন ইন্টারভিউ’-এর ব্যবস্থা ছিল‌। ‘এসে কথা বলে, হাতে হাতে চাকরি নিয়ে যাও’ ধরনের ডাক। হোটেলে গিয়ে নিষাদ দেখেছে, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে গাদা ছেলেমেয়ে বসে রয়েছে। সকাল ন’টায় পৌঁছে ডাক পেয়েছে রাত দশটায়। ক্লান্ত, অভুক্ত অবস্থাতেই প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে।

‘ইংরেজিতে কথা বলায় স্বচ্ছন্দ?’

‘খুব বেশি নয়।’

‘সে কী!‌ ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ না হলে আমাদের এখানে কাজ করবেন কী করে?’

‘স্যার, কলকাতার বাইরে মফস্‌সলের স্কুলে পড়েছি।’

‘আমাদের ক্লায়েন্ট সে কথা শুনবে না। মফস্‌সলে লেখাপড়া করেও বহু ছেলেমেয়ে ইংরেজিতে ভাল হয়। যাক, প্রশ্নে আসা যাক। মি. সেনগুপ্ত, মনে করুন আপনি একটি পিঁপড়ে। পথের মাঝখানে একটা চিনির টুকরো। টুকরোটা আপনার শরীরের তুলনায় খুবই বড় আকৃতির। এই টুকরোটা নিয়ে আপনি কী করবেন? দেয়ার আর থ্রি অপশনস। টপকে বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া, যেটুকু পারা যায়, চেটে খেয়ে নেওয়া। থার্ড অপশনটি হল, কষ্ট করে টেনে কোনও গোপন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা, যাতে অনেকদিন ধরে সেটা নিজের থাকে। থার্ড অপশনে ফেল করার প্রবাবিলিটি ইজ় ভেরি হাই। কোনটা আপনি বেছে নেবেন?’

থতমত খায় নিষাদ। সে তো পিঁপড়ে বা চিনির কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসেনি। এ প্রশ্নের অর্থ কী‍‌!‌‌

নিষাদ আমতা আমতা করে, ‘স্যার, এই তিন উপায়ের বাইরে কি যাওয়া যাবে?’

‘যাওয়ার কথা নয়, তা-ও বলুন।’

নিষাদ বলে, ‘আমি যদি অন্যদের ডাকি?’

‘অন্যদের ডাকি মানে? আরও পিঁপড়েকে ডাকতে চাইছেন?’

নিষাদ একটু সাহস নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, কারণ অনেকে মিলে এটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে।’

‘নট আ ব্যাড আইডিয়া। কিন্তু তাহলে জিনিসটা তো সবার হয়ে যাবে। সবাই শেয়ার চাইবে।’

নিষাদ এবার উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘সেটাই তো ভাল। অত বড় টুকরোটা একা খাওয়া যায় না।’

কোট-প্যান্ট পরা ভারিক্কি চেহারার যে ভদ্রলোক ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন, তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘মি. সেনগুপ্ত, আমরা ইন্ডিভিজুয়াল পিঁপড়ে চাইছি যে একা নিজের এবং কোম্পানির লাভ দেখবে। আমরা সবাইকে চাইছি না। আপনি আসতে পারেন, গুড নাইট।’

পরে পলাশ তাকে বুঝিয়েছিল, এসব আসলে বাদ দেওয়ার প্রশ্ন। যে উত্তরই সে দিত, তার বিরুদ্ধে একটা কিছু বলে তাকে বাদ দেওয়া হত। নিষাদ জানে। তবে সব পরীক্ষা, ইন্টারভিউ যে একেবারে জলে গিয়েছিল এমন নয়। পাঁচ-ছয় জায়গায় কাজ জুটেছে। তার মধ্যে ছিল বাইরের থেকে আসা দুটো ভুঁইফোঁড় বিমা কোম্পানি, টাকা ডবল করার স্কিমের অফিস। কোথাও পঁচিশ, কোথাও পঞ্চাশ হাজার টাকা সিকিউরিটি জমা রাখতে হবে। কলসেন্টারও ছিল একটা। বানতলা পেরিয়ে অফিস।

‘প্রথম ছ’মাস ট্রেনিং হবে। এই সময় আমরা কোনও পয়সাকড়ি দেব না কিন্তু।’

নিষাদ অবাক হয়ে বলেছিল, ‘সে কী!‌ পয়সাকড়ি দেবেন না মানে!‌’

‘মানে মাইনেপত্র কিছু পাবেন না। আপনাকে ট্রেনিং-এ কোয়ালিফাই করতে হবে। যদি না পারেন তাহলে আরও দু’মাসের সুযোগ পাবেন।’

নিষাদ বলল, ‘আমার তো ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি রয়েছে।’

‘ওই ডিগ্রি দিয়ে কী হবে! আমাদের কল সেন্টারে কোন কম্মে লাগবে?’

নিষাদ আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘না মানে কলেজ, ইউনিভার্সিটি পাশ করেছি.‌.‌.‌আপনি মার্কশিট দেখুন।’

‘এই চাকরিতে ওসব পাশ লাগে না। হায়ার সেকেন্ডারিই বেশি।’

নিষাদ বলল, ‘তাহলে আমাদের ডাকলেন কেন?’

‘কী ‌করব? অত নীচে বললে ভিড় সামলাতে পুলিস ডাকতে হত যে। তাই বাড়িয়ে রেখেছি। তাতেই বাইরে ভিড় দেখুন না। আরে, খবরের কাগজে দেখছেন না? এমএ, পিএইচডি করে কোথায় যেন সুইপারের কাজ চেয়েছে? দেখেননি? দেশটার নাম ভুলে গেলেন? আসলে ব্যাপার কী জানেন ভাই, মিডিওকার বাঙালি কলেজ, ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি পেয়ে গর্তে পড়ে। না পারে কাদামাটিতে থেবড়ে বসে পড়তে, না পারে পাতা-লতা জাপটে ধরে গর্তের গা বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে। ছোট কাজে লজ্জা, বড় কাজের যোগ্যতা নেই। আপনারা হলেন সেই মিডিওকার।’

নিষাদ চুপ করে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ শোনার পর বলেছিল, ‘‘কিছুই পাব না?”

‘না, ছ’মাস ট্রেনিং লাগবে। তাও ইংরেজি বলতে পারলে একটা কথা ছিল। কমদিনে হয়তো হয়ে যেত। আপনার তো দেখছি ওদিকটা খুবই উইক। তবে আপনার সঙ্গে কথা বলে ভাল লেগেছে। ছ’মাসে না পারলে আপনাকে আরও একমাস সময় দেব। রাজি?’

কোনও জবাব না দিয়ে নিষাদ সেদিন বানতলা থেকে চলে এসেছিল।

সরকারি স্কুলে চাকরি প্রায় হয়ে যাচ্ছিল। প্রাইমারি স্কুল। শেষ মুহূর্তে ইনজাংশন পড়ে গেল। ক্যান্ডিডেট বাছাইতে নাকি গোলমাল। চান্স এখানে শেষ হয়নি। আরও একটা কাজ জুটেছিল। রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি মারফত জুটেছিল। বাইরে থেকে বেশ লোভনীয় ছিল। যেতে হবে দুবাই। তবে দু’বছরের মধ্যে চাকরি ছাড়া যাবে না, দেশেও আসা চলবে না। বন্ডে সই করে পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে। যাওয়ার খরচ নিজের। প্রথমবার বেতন পাওয়া পর্যন্ত নিজের খরচে থাকতেও হবে।

কাজের জন্য দেখা করেছে এমন লোকের সংখ্যা কত যে হয়েছে, নিষাদের হিসেব নেই। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে জেনে গিয়েছে, অপমানের কথা তাকে শুনতেই হবে। অপমান গায়ে মাখলে চলবে না। সেদিন সকালেও মনে জোর‌ এনে কথা শেষ করেছিল সে।

‘স্যার, ঐশানীদি আপনার নম্বর দিয়েছে। ঐশানী চ্যাটার্জি। ‌উনি সকাল আটটার মধ্যে আপনাকে ফোন করতে বলেছিলেন‌।’

অপূর্ব রায় এবার থমকে গেল।‌‌‌ গলার স্বর বদলে বলল, ‘ও হ্যাঁ, ঐশানী বলেছিল। সরি, আমার খেয়াল ছিল না। কী যেন নাম তোমার? কী যেন.‌.‌. একটা আনকমন নাম.‌.‌.‌ ‌তুমি করেই বলছি। যতদূর মনে পড়ছে, বয়স তিরিশের এদিক ওদিক।‌ তাই তো?’

ওদিকের মানুষটি তাকে চিনতে পেরেছে দেখে নিষাদ স্বস্তি পেল। বলল, ‘অবশ্যই স্যার, অবশ্যই তুমি করে বলবেন। আমার নাম নিষাদ, নিষাদ সেনগুপ্ত।’

অপূর্ব রায় উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ নিষাদ.‌.‌.‌মনে পড়েছে। নামটা আনকমন। কাজের ব্যাপার তো? আশা করি একটা কিছু হয়ে যাবে। যাক, তুমি এক কাজ করো, পরশু অফিসে চলে এসো.‌.‌.‌ না না, পরশু পারব না, পরপর মিটিং রয়েছে.‌.‌. ‌ফ্রাইডে এসো। আমার অফিস কোথায় জানো? ঐশানী বলেছে? অবশ্য ও জানবে কী করে। শুনে নাও। সিক্সটিন বাই টু টার্মিনাল প্লাজ়া। ক্যামাক স্ট্রিট পেট্রোল পাম্পটা ছাড়িয়ে বাঁদিকের রাস্তায় ঢুকবে, দুটো বাড়ি পরে দেখবে একটা সরু রাস্তা। তার লাস্ট বড় বাড়িটা। এগারো তলায় রয় ডিস্ট্রিবিউটার্স। মনে থাকবে?’

নিষাদ বলে, ‘মনে থাকবে স্যার। কখন যাব?’

অপূর্ব রায় নরম গলায় বলল, ‘আমি এগারোটা নাগাদ অফিসে ঢুকে পড়ি, তুমি সেকেন্ড হাফে চলে এসো, নাকি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে?’

নিষাদ একই সঙ্গে অভিভূত হল এবং লজ্জা পেল। তার মতো একজন অতি দোরে-দোরে ঘোরা চাকুরিপ্রার্থীকে লাঞ্চ খাওয়ানোর প্রস্তাব!‌

‘স্যার ওই সময়টা আমার একটা টিউশন আছে.‌.‌. ছেলেটার পরীক্ষা.‌.‌. ‌তারপরেও ‌আপনি যদি বলেন.‌.‌.‌’

অপূর্ব রায় হালকা গলায় বললেন, ‘না না, বেকার যুবকের রোজগারে কাঁটা হতে চাই না। লাঞ্চ পরে কোনওদিন হবে। তুমি লাঞ্চের পরেই এসো। এই ধরো তিনটে-সাড়ে তিনটে। পারবে?’

এই স্নেহমাখা গলা শুনে নিষাদের বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ভুল শুনছে না তো? না, এত ছোট মনের হওয়া ঠিক নয়। ঐশানীদি সত্যিই ভাল লোকের কাছে পাঠিয়েছে। যদিও ভালমন্দ মুখে কিছু বলেনি সে। শুধু বলেছিল, ‘একজনের ফোন নম্বর দিচ্ছি, কাল সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ফোন করবি। আমি বলে রাখব। দেরি করবি না। তারপর হয়তো অফিসে বেরিয়ে যাবে।’

নিষাদ বলল, ‘কী নাম?’

ঐশানীদি একটু থেমে বলল, ‘অপূর্ব রায়। ও ইচ্ছে করলে তোর একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে।’

‘চাকরি দিতে পারে’ এমন কোনও লোক যে এতটা ভাল ব্যবহার করে সে অভিজ্ঞতা তো দূরের কথা, ধারণাও নেই নিষাদের। অপূর্ব রায়ের দেওয়া সময় দুপুর তিনটে তো কিছুই নয়, বললে রাত তিনটের সময় চলে আসত।

নিষাদ ফোন চেপে ধরে বলে, ‘অবশ্যই পারব, স্যার।’

ফোন ছেড়েই ঐশানীদির নম্বর টিপল নিষাদ। ভিতরে গান বেজে গেল। ঐশানীদি নিশ্চয়ই ব্যস্ত। ব্যস্ত হওয়ারই কথা। বড় অফিসে কাজ করে। হঠাৎ সেদিন এসপ্ল্যানেডে মেট্রো স্টেশনের সামনে দেখা।

‘আরে!‌ বিষাদ না?’

কলেজে নিষাদের নাম ছিল‌ ‘বিষাদ’। কেউ কেউ তাকে ‘ক্যাবলা বিষাদ’ বলেও ডাকত।‌ ঐশানী ছিল দু’বছরের সিনিয়র। ঝকঝকে চেহারার, সুন্দরী। ইংরেজি পড়ত। দাপুটে মেয়ে হিসেবে কলেজে পরিচিত। ছেলেরা যেমন আশেপাশে ঘুরঘুর করত, তেমন সমঝেও চলত। তাকে নিয়ে নানারকম গুঞ্জন ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক। একেই ডাকসাইটে সুন্দরী, তার উপর স্বভাবে আতুপুতু ভাব নেই। ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে চলত বললে কম বলা হবে, কোনও কোনও সময় বেশিও চলত। ফেস্ট, পিকনিক, ফাংশনে ঐশানী চ্যাটার্জি থাকবেই। ফলো করেছিল বলে হেদুয়ার মোড়ে একবার দু’জন ছোকরার কলার চেপে ধরেছিল দু’হাতে। গায়ে শক্তি বেশি ছিল না, ব্যক্তিত্বই যথেষ্ট। সেদিন ইভটিজ়ারদের উপর বীরত্ব ফলাতে‌ রাস্তার পাবলিক সাহায্যে এগিয়ে এলে ঐশানী বলেছিল, ‘দয়া করে সরে যান। আমি অবলা নই, নিজের সিকিউরিটি নিজেই নিতে পারি।’ তারপর দুই ছোকরাকে কান ধরে ওঠবোস করিয়েছিল। বলেছিল, ‘এরপর যদি পিছনে দেখি, মুখে অ্যাসিড মারব। এই দেখ অ্যাসিডের শিশি,’ বলে সত্যি সত্যি ব্যাগ থেকে খাতা-বই সরিয়ে একটা শিশি বার করে দেখিয়েছিল। কোনও মেয়ের কাছে যে এই ধরনের শিশি থাকতে পারে কেউ ভাবতেও পারত না। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, শিশিতে সত্যি অ্যাসিড রয়েছে কিনা, ‌ঐশানী বলত, ‘ছুরিও আছে। দেখবি?’

নিষাদ কলেজে ঢোকার পরপর সেই ঐশানী চ্যাটার্জি একদিন ক্যান্টিনে ধরল।

‘অ্যাই ছেলে, তোর নাম নাকি বিষাদ?’

কলেজে ঢুকে নিষাদ কারও সঙ্গেই কথা বলত না, মেয়েদের সঙ্গে তো একেবারেই নয়। তা ছাড়া তখনও কথাবার্তা বলার মতো কারও সঙ্গে পরিচিতি হয়নি। ঐশানীর প্রশ্নে কোনওরকমে বলল, ‘আমার নাম নিষাদ। নিষাদ সেনগুপ্ত।’

‘ধুস, বললেই হবে! তোর কান্না-কান্না মুখ দেখেই বোঝা যায়, তোর নাম বিষাদ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।’

নিষাদ চুপ করে গিয়েছিল। একেই কলকাতা, তার উপর সুন্দরী। দুটো অভিজ্ঞতাই তার কাছে নতুন। সে মাথা নামিয়ে টোস্টে মন দিয়েছিল।

ঐশানী বলে, ‘মাথা নামাচ্ছিস কেন? বিষাদ কি লজ্জা পাওয়ার মতো কোনও ‌ঘটনা? খোদ মাইকেল লিখেছেন— এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে.‌.‌.‌ এর পরটুকু কী বল দেখি। বলতে পারলে বুঝব তোর বিষাদ নাম সার্থক।’

নিষাদ ঘামতে শুরু করল। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র এই অংশ তার জানা ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে কিছুই মনে পড়ল না। সে বিড়বিড় করতে থাকে। উলটো দিকে বসা মেয়ের দল হেসে ওঠে।

ঐশানী চ্যাটার্জি গলা খুলে ফর্সা হাতদুটো ছড়িয়ে বলল, ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে/ জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল/‌ রক্ষঃপুরে;‌ হায়, তাত উচিত কি তব/‌ এ কাজ.‌.‌.‌’ মনে নেই? কাল দশবার লিখে এনে দেখাবি। নইলে বিষাদ কাকে বলে উদাহরণ সহযোগে জানতে পারবি।’

সেই ঐশানী চ্যাটার্জি ক’দিনের মধ্যে নিষাদকে পছন্দ করে ফেলল। কেন করল, নিষাদ জানে না। সব পছন্দের কারণ জানা যায় না। নিষাদের সঙ্গে যে খুব কথা বলত, এমন নয়। বললেও দু’-‌একটা। কোনওদিন হয়তো একটু হাসত। তবে একটা অদ্ভুত কাজ করত। মাঝেমধ্যেই ক্যান্টিনে নিষাদের খাবারের দাম দিয়ে দিত। এমনকী, নিষাদ না থাকলেও ক্যান্টিনের ছেলেটাকে তার নাম করে টাকা জমাও দিয়ে আসত।

‘রতনদা, ‌বিষাদ খেতে এলে এখান থেকে দেবে।’

খুবই লজ্জার মধ্যে পড়ত নিষাদ। জানাজানিও হয়ে গিয়েছিল। নিষাদ মিনমিন করে বারণ করতে গেলে ঐশানী চোখ বড় করে বলত, ‘পাকামি করবি তো মাইকেলের কবিতা মুখস্থ ধরব।’ শুধু ক্যান্টিনের খাবারের দাম নয়, পিকনিকের চাঁদা, ফেস্টের ডোনেশনও দিয়ে দিত। নিষাদকে যোগ দিতে হবেই। কলেজের ছেলেমেয়েরা যে ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করবে, সে উপায় ছিল না। ঐশানী এমন কিছু বলে বসবে যে, পালানোর পথ পাওয়া যাবে না। নিষাদও ঐশানীর ভয়ে বেশি কিছু বলতে সাহস করেনি। ঐশানী চ্যাটার্জি কলেজ পাস করার পর আর যোগাযোগ হয়নি।‌ বহু বছর পর দেখা হতে চমকে উঠল নিষাদ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও সুন্দর দেখতে হয়েছে।

‘ঐশানীদি, তুমি!‌’

ঐশানী নিষাদের হাত ধরে হেসে বলল, ‘কলকাতার বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে চাকরি করছি। বিষাদ, তোর কী খবর? দেখে মনে হচ্ছে, এখনও তো একইরকম ক্যাবলা আছিস।’

নিষাদ সামান্য হেসে বলে, ‘তাই আছি।’

‘লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিস?’

নিষাদ বলল, ‘ইউনিভার্সিটির পালা কোনওরকমে শেষ করে কাজ খুঁজছি, পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, অত পর্যন্ত না গেলেই ভাল হত, অন্তত মুটে মজুরের কাজ জুটে যেত। এমএ পাশ করলে কেউ মুটের কাজ দেয় না।’

ঐশানী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘সরকারি ‌চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিস না? রেল, ব্যাঙ্ক?’

নিষাদ ম্লান হেসে বলল, ‘তুমি জানো না সেখানে কী অবস্থা ? যেটুকু যা আছে, তা তো সিন্ধুতে বিন্দু। কিছু বেকারকে গুলি করে মেরে ফেলতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। ‌‌বাদ দাও ওসব। চলো তোমাকে চা খাওয়াই, তেলেভাজাও খাওয়াব। তার বেশি পয়সা নেই।’

‘বিষাদ, কাল একবার আমার অফিসে আয় তো। ঠিকানা আর ফোন নম্বর‌টা রেখে দে। আজ তাড়া রয়েছে, কেটে পড়লাম।’

নিষাদ ফোন করতে ঐশানী অফিস থেকে নেমে এসেছিল। নিষাদকে নিয়ে পাশের একটা কফিশপে ঢুকল। স্যান্ডউইচ, কফি খাইয়ে অপূর্ব রায়ের ফোন নম্বর দিয়ে বলল, ‘ফোন করবি। মনে হয় না, এই লোক আমার রিকোয়েস্ট ফেলতে পারবে। জীবনে একটাই রিকোয়েস্ট করলাম।’

নিষাদ বলল, ‘কী বলব? থ্যাঙ্ক ইউ?’

ঐশানী সুন্দর হেসে বলল, ‘বাহ্‌, বেশ কায়দা করে কথা বলতে শিখেছিস তো? কোথায় থাকিস?’

‌নিষাদ বলল, ‘মেসে। বেড শেয়ার করে।’

ঐশানী ভুরু তুলে বলল, ‘বেড শেয়ার!‌ সেটা কী জিনিস?’

নিষাদ বলল, ‘দিনে একজন, রাতে আমি। ওসব বাদ দাও। কেমন আছ তুমি?’

‌ঐশানী হেসে বলল, ‘বোলো তারে বোলো/ এত দিনে তারে দেখা হল/ তখন বর্ষণশেষে ছুঁয়েছিল রৌদ্র এসে.‌.‌.‌। ‌বল কার লেখা। না পারলে শাস্তি।’

নিষাদ বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ। অসমাপ্ত।’

‘দশে দশ।’

নিষাদ বলল, ‘ইস্‌ ‌ঐশানীদি, তুমি কেন আমার চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকো না? এমন সব সোজা প্রশ্ন করবে।’

‌ঐশানী একটু যেন থমকে গিয়ে বলল, ‘সব প্রশ্ন সোজা না হওয়াই ভাল বিষাদবাবু। সব ভালবাসা না জানাই ভাল। সব জানলে জীবনটা বড্ড আনইন্টারেস্টিং হয়ে যায়,’ তারপর হাত ঘুরিয়ে বলল, ‘মজা খতম।’

শুক্রবার নিষাদ বেলা আড়াইটের আগেই টার্মিনাল প্লাজ়া অফিসের সামনে পৌঁছে যায়। উলটো দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভেবেছিল, বাড়িটায় ঢুকে পড়বে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থমকে গেল। পলাশের কথা মনে পড়ল।

পলাশ কলেজে সহপাঠী ছিল, কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল অন্যদের চেয়ে বেশি। বেশি বন্ধুত্ব হওয়ার যে কোনও কারণ ছিল এমন নয়, বরং না থাকলেই সেটা স্বাভাবিক হত। তারপরেও হয়েছিল।

দু’জনের চরিত্র একেবারেই উলটো। পলাশ হইচই-এর ‌মধ্যে থাকতে ভালবাসত। সে কলেজের ফাংশনই হোক আর গোলমালই হোক। কোথাও ফুর্তি হচ্ছে দেখলে যেমন তার মধ্যে ঢুকে পড়ত, ঝামেলা দেখলেও ঢুকত। শুধু ঢুকত না, ঢুকে জড়িয়ে পড়ত। কলেজে, ট্রামে বাসে, রাস্তাতে এরকম অনেক করেছে। বিপদেও পড়েছে। একবার হাওড়া স্টেশনের বাইরে এক পকেটমারকে ধরে জনতা পেটাচ্ছিল। দেশের বাড়ি থেকে কলকাতায় আসছিল পলাশ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সেই জটলার মধ্যে পড়ল ঢুকে। অফিসবাবু, যারা রোগাভোগা চেহারার পকেটমারকে পেয়ে হাতের সুখ করছিল, তাদের উপর চোটপাট শুরু করে দিল।

‘মারছেন কেন? সন্দেহ হলে পুলিশে দিন। আপনারা গায়ে হাত তোলার কে?’

‘তুমি কে হে ছোকরা?’

পলাশ বলল, ‘আমি কে আপনাদের‌ জানার দরকার নেই। মারধোর বন্ধ করুন।’

‘পুলিশ কিছু করবে ভেবেছ? পয়সা নিয়ে ছেড়ে দেবে।’

পলাশ বলল, ‘তা বলে, আপনারা পিটিয়ে মেরে ফেলবেন? আচ্ছা অমানুষ দেখছি তো।’

এই সময়ে জটলা মধ্যে থেকে কেউ বলল, ‘ছোকরার এত দরদ কীসের? এক দলের নয় তো? চোরে চোরে মাসতুতো ভাই মনে হচ্ছে।’

সঙ্গে সঙ্গে একথার সায় মিলে গেল। পলাশ গেল রেগে। চোখ মুখ লাল করে চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ আমি পকেটমার। তাতে আপনাদের কী? আগে পিটুনি বন্ধ করুন। থানায় চলুন।’

একজন বলে উঠল, ‘পিটুনি বন্ধ করব কী? তোকেও তো দু’ঘা দেওয়া দরকার মনে হচ্ছে। স্যাঙাতকে বাঁচাতে এসেছিস?’

পলাশ বলে, ‘বেশ করেছি।’

এরপরে আর জনতা দেরি করেনি। পলাশের‌ উপর কিল, চড় পড়তে শুরু করে। সে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে। বাইরে গুঞ্জন ওঠে। একটা নয়, দুটো চোর ধরা পড়েছে। সেদিন পুলিশ না এসে পড়লে, পলাশের যে কী হত বলা মুশকিল। সবাই ভেবেছিল, পলাশ এবার বদলে যাবে। হুজ্জতি এড়িয়ে চলবে। একমাসের মধ্যে সে আবার গোলমালে পড়ে। এবার আর চোর নয়, এবার তাকে গোলমালে ফেলেছিল এক সাধু। ভণ্ড সাধু। হাতিবাগানে ফুটপাতে ছড়িয়ে বসে শিকড়বাকড় বেচছিল। ক্যানসার থেকে ডেঙ্গু সব রোগ সারিয়ে দেওয়ার গ্যারান্টি। কলকাতার রাস্তায় এমন লোকঠকানো ব্যবসা‌ প্রচুর। বেশিরভাগ সময়েই লোক ফিরে তাকায় না। পলাশও তাকাত না, সেদিন কী যে হল!‌ সেই ভণ্ডকে নিয়ে পড়ল। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিতে লাগল।

‘শিকড়ে কী আছে? আপনি নিজে খেয়ে দেখান।’

ভণ্ড সাধুর চেলাচামুণ্ডারা চারপাশেই ছিল। তারা অল্পক্ষণের মধ্যে পলাশকে ফেলল ঘিরে। সেদিন কলেজের ছেলেরা না দেখে ফেললে আবার একটা ঝামেলা হত।

নিষাদ এসবের উলটো। চুপচাপ, শান্ত। ভিড় দেখলে সরে যায়, ঝামেলা দেখলে পালায়। অন্যের ব্যাপারে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, নিজের ব্যাপারেও জোর গলায় কিছু বলতে পারে না। আজও তাই হচ্ছে। তাকে ডেকে পাঠিয়েও অপূর্ব রায় দেখা করল না। কী বলতে পারল? বরং রিসেপশনে বসা মেয়েটির কাছে ধমক খাচ্ছে। ‘বিপদ’ কথাটা শুনে মেয়েটি আরও জোরে ধমক দিল।

‘এক কথা আপনাকে কতবার বলতে হবে? আপনি কি ছেলেমানুষ? আপনার বিপদ হবে, না সুবিধে হবে, আমি কী করতে পারি বলুন দেখি? আপনি প্লিজ় এবার যান। আমার কাজ রয়েছে। এটা একটা অফিস।’

কথা শেষ করে মেয়েটি এবার ইন্টারকম তোলে।

‘হ্যালো, আমি তৃষা বলছি। গেটের সিকিয়োরিটিকে বলে দিন, আমাকে না জানিয়ে কোনও ভিজ়িটরকে যেন অফিসে আসতে না দেয়। স্যার বিজ়ি রয়েছেন।’

আরও স্পষ্ট অপমান। এবার নিষাদের চলে যাওয়া উচিত। তারপরেও সে দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে বুঝতে পারছে না। নিজেকে ভারী পাথরের মতো মন হচ্ছে।

কলেজে পলাশ এসেছিল বর্ধমানের গুস্‌করা থেকে। বাড়ি ছিল শহর থেকে কিছুটা দূরে, গ্রামে। আর নিষাদ সুরুলপুরের ছেলে। ছোট মফস্সল শহর। কলকাতা থেকে একরাতের পথ। পলাশের সঙ্গে মিল বলতেই এইটুকুই। দু’জনেই কলকাতার বাইরে থাকে। পলাশ সিট নিয়েছিল বিডন স্ট্রিটের হস্টেলে। সে-ও এক কাণ্ড!‌ হস্টেলে সিট পাওয়া খুব কঠিন। গাদা গাদা অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে। তার উপর ছিল ধরা-করা, স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, এলাকার রাজনৈতিক দাদাদের মাতব্বরি। এর মধ্যেও যে ঠিকঠাক ছেলেমেয়েরা পেত না, এমন নয়, তবে সেখানেও অপেক্ষা করতে হত। একমাস অপেক্ষা করার পর, পলাশ বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে কলেজ অফিসের সামনে বসে পড়ল। অবস্থান বিক্ষোভ। একদিন মগ বালতি এনে স্নান করার আয়োজন করতে অফিস থেকে তাকে ডেকে পাঠায় এবং হস্টেলে ঘর দিয়ে দেয়।

‌সেই পলাশ কলেজ পাশ করে কাজ খুঁজতে শুরু করে, এখনও খুঁজছে। ওর বাবা সময় দিয়েছিলেন একবছর। পরে সেটা আরও একবছর বেড়েছে। এটা-সেটা ট্রেনিং নিচ্ছে বলে পলাশ আরও বাড়িয়েছে। দেশে কাজ না থাকলেও ট্রেনিংয়ের অভাব নেই। তবে তারও তো একটা সীমা রয়েছে। ভাল কাজকর্ম কিছু না জুটলে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে হয় লাঙল ধরো, নয় মুদি দোকানে বোসো। গাঁয়ের বাড়িতে দুটো ব্যবস্থাই ছিল। পলাশের তো মাথাখারাপ অবস্থা। কলকাতা ছেড়ে গিয়ে গাঁয়ে মুদি দোকানে বসার কথা ভাবতে পারে না। লাঙল চালানোরও প্রশ্ন ওঠে না। কাজ একটা পেতেই হবে। সারাদিন এর-তার কাছে কাজের জন্য ছুটে বেড়ায়। ছাত্র না থাকলেও বিডন স্ট্রিটে স্টুডেন্টস হস্টেলের একটা ঘর ‌ম্যানেজ করা আছে। এর মধ্যে নিষাদ ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়েছিল। এমএ পড়েছে। উপরের দিকে সেকেন্ড ক্লাস। এখন তিনটে টিউশন করে, আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক প্রেসে পার্টটাইম কাজও করছে। ক্লাবের সুভেনির, হ্যান্ডবিল, পোস্টার এলে বাক্য, বানান ঠিক করে দেয়। অনেকে আবার কতগুলো ছেঁড়া-ছেঁড়া কাগজের টুকরো এনে ফেলে দেয়। বলে, এখান থেকে ক্লাবের সম্পাদকের নামে একপাতা লিখে দিতে হবে। নিষাদের জন্য কাজ কঠিন কিছু নয়, সে লেখালিখিতে মস্ত কিছু না হলেও মন্দ নয়। পার্টি খুব খুশি হয় বলে প্রেসের মালিকও সন্তুষ্ট। কাজটা আজও রয়েছে। ধাপে ধাপে টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এরকম লোককে হাতছাড়া করা বোকামি। টিউশন আর প্রেসের কাজ করে নিষাদ শিয়ালদার এক মেসে থাকে। বাইরে খাওয়ার খরচও সামলে নেয়।

মাইনে পেলে একবার করে পলাশের হস্টেলের ঘরে ঢুঁ মারে নিষাদ। শিবুদার দোকান থেকে তেলেভাজা নিয়ে। সেই সময়ে নানারকম কথা বলে পলাশ। বেশিরভাগই চাকরি খোঁজার কথা।

‘কী করবি ভাবছিস?’

নিষাদ বলে, ‘কীসের কী করব?’

পলাশ বলে, ‘এই ভাবে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি পকেটে নিয়ে আর ছাপাখানায় বসে উঞ্ছবৃত্তি করে ক’দিন কাটাবি?’

নিষাদ চুপ করে থাকে। পলাশ বিছানায় আধশোওয়া হয়ে হাতের আধখাওয়া চপ চোখের সামনে তুলে ঘুরিয়ে দেখে বলে, ‘এখন এমএ, এমএসসি ডিগ্রির কোনও ভ্যালু নেই জানিস না! ওই ডিগ্রি দিয়ে আলুর চপও ভাজতে পারবি না।‌ হাত পুড়িয়ে ফেলবি।’

নিষাদ বলে, ‘জানি। তাও এতদিন টানলাম, আর একটু টেনে নিই। বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসে পড়ে রইলাম, তার একটা কৈফিয়ত তো দিতে হবে।’

‘ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি তোর কৈফিয়ত?’ চপের তেল ঠোঙায় মুছতে মুছতে বলে পলাশ।

নিষাদ বলে, ‘ওসব ছাড়। তোর কথা বল। ক’টা ইন্টারভিউ দিলি। কাজকর্মের কিছু হল?’

পলাশ বলে, ‘বুঝলি নিষাদ, বেকার ছেলেরা হল ইন্টারভিউ আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট বিশেষজ্ঞ।’

নিষাদ অবাক হয়ে বলল, ‘ইন্টারভিউয়ের দিকটা না হয় বুঝতে পারলাম, ‌অ্যাপয়েন্টমেন্ট বিশেষজ্ঞ মানে কী?’

পলাশ একমুঠো মুড়ি মুখে ফেলে বলল, ‘চাকরির জন্য তো শুধু ইন্টারভিউ দিলেই হয় না, দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে হয়। চাকরি দিতে পারে এমন লোকদের সঙ্গে দেখা করে তেল দিতে হয়। তার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে এক্সপার্ট হতে হয়।’

নিষাদ বলল, ‘সেটা কী রকম?’

পলাশ বলল, ‘জটিল বিষয়। ‌অ্যাপয়েন্টমেন্টে যেমন পরে যেতে নেই, তেমন আগেও যেতে নেই। পরে গেলে ফেল, আগে গেলে ফেকলু। ফেকলু মানে, তোর কাজকর্ম কিছু নেই, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াস। এমনও হয়েছে নিষাদ, সকাল সাতটায় হারামজাদা এক নেতা সময় দিয়েছে, ভোর পাঁচটায় চলে গিয়েছি। বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করেছি। দূর থেকে নজর রেখেছি। যাতে পালিয়ে না যায়। কিন্তু সাতটার আগে ডোর বেল টিপিনি।’

‌অপূর্ব রায়ের অফিসের সামনেও গিয়ে প্রথম দিন থমকে গিয়েছিল নিষাদ। না, আগে ঢোকা ঠিক হবে না। সময়মতো পৌঁছে রিসেপশনে নিজের নাম বলতেই রিসেপশনের মেয়েটি তাকে বসতে বলে এবং উঠে পিছনের ভারী দরজা ঠেলে ভিতরের ঘরে যায়। তখনও অবশ্য মেয়েটির নাম তার জানা ছিল না। আজ জানতে পারল। তৃষা।

লম্বাচওড়া, পেটানো চেহারার অপূর্ব রায়কে অবশ্যই সুদর্শন দেখতে। ব্যাক ব্রাশ করা চুল। গায়ে নেভি ব্লু শার্টের উপর গাঢ় নীল ব্লেজ়ার। চোখমুখে শুধু বুদ্ধির ছাপ নয়, একধরনের জেদ রয়েছে।‌ বয়সও বেশি নয়। নিষাদকে বলল, ‘এসো এসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।’

খাতির দেখে নিষাদ খানিকটা ঘাবড়েই যায়। টেবিলের উলটো দিকে গদি মোড়া দামী চেয়ার। নিষাদ জড়সড় হয়ে বসলে সহাস্য সহজ ভাবে কথা শুরু করল অপূর্ব।

‘তারপর নিষাদ, কেমন আছ?’

নিষাদ বলল, ‘ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন?’

‘আরে আমাদের কি আর ভাল থাকার সময় থাকে? এমন কোম্পানি খুলে বসেছি, সাপ্লাই দিতে দিতে চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে যায়। আর কী না সাপ্লাই দিতে হয়। জাহাজের নোঙর টু নাচের ঘুঙুর। মুম্বইতে অফিস রয়েছে, সেখানেও ছুটতে হয়। এবার চেন্নাইতে ব্রাঞ্চ করছি। ওদিককার পোর্টগুলো কাজে লাগছে।’

এত বড় কোম্পানি!‌ নিষাদ থতমত খেয়ে আরও চুপ করে যায়। অপূর্ব বললেন, ‘চা খাবে?’

‘না, স্যার।’

‘ঐশানীকে কীভাবে চিনলে?’

নিষাদ বলল, ‘কলেজের সিনিয়র‌‌।’

অপূর্ব রায় ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ও। তাহলে খুব বেশি চেনো না। কলেজে সিনিয়র ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কতটাই বা পরিচয় থাকে?’

‌নিষাদ একটু চুপ করে নিচু গলায় বলল, ‘যেটুকু দেখেছি তাতে জানি, ঐশানীদি একজন চমৎকার মানুষ।’

অপূর্ব রায়ের ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটল। চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথার উপর দুটো হাত রাখল আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে।

‘কেন এমন মনে হল?’

নিষাদ শান্তভাবে বলল, ‘খুব অল্পদিনেই তার ভাল মনের পরিচয় পেয়েছি।’

‌অপূর্ব রায় বলল, ‘তাই নাকি!‌ সেই পরিচয়টা কেমন জানতে পারি?’

নিষাদ অবাক হল। এ তো শুধু ঐশানীদিকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তার বিষয়ে তো ভদ্রলোক কিছু জানতে চাইছে না।

‘কী হল? চুপ কর গেলে কেন? বলো কেন ওকে ভাল মনে হয়েছিল।‌’

নিষাদ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। আমতা আমতা করে বলল, ‘ঐশানীদি যে ভাল কলেজে সবাই জানতাম.‌.‌. ‌আমার মতো অনেককেই নানাভাবে সাহায্য করেছেন.‌.‌.‌এই তো আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন.‌.‌.‌’

অপূর্ব রায় সোজা হয়ে বসে, ভারী গলায় বলে, ‘গুড। ঠিক বলেছ নিষাদ। তোমার এই দিদিটি একজন খুবই ভাল মেয়ে। অতি সুন্দর দেখতেও। শুধু দেখতেই সুন্দর নয়, মনটাও সুন্দর। আজকের দিনে মানুষের মন সুন্দর হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আমাকেই দেখো না, মনটাকে সুন্দর রাখতে চেষ্টা করি কিন্তু পারি কই? সারাদিন বিজ়নেসের জন্য হাজারটা খারাপ কাজ করলে কি মন সুন্দর থাকে?’

কথা শেষ করে অপূর্ব রায় অল্প হাসল। মানুষটা হাসলে যেন বেশি সুন্দর দেখায়। তারপরেও কেমন যেন অস্বস্তি হয় নিষাদের। ঐশানীদিকে নিয়ে বড্ড বেশি কথা হয়ে যাচ্ছে না?

‘তুমি ঐশানীর বাড়ি যাও?’

নিষাদ বলল, ‘না, স্যার। আমি তার বাড়ি চিনি না। কলেজের পর তার সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা হল।’

‌অপূর্ব রায় একটা প্যাড টেনে কাগজে খসখস করে কী সব লিখল। বেল বাজাতে পিওন ঢুকল। তার হাতে কাগজটা দিয়ে বলল, ‘যান, এটা এইচ আর ডিপার্টমেন্টের মি. সান্যালকে দিয়ে আসুন।’ তারপর নিষাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘তাহলে খুব বেশি চেনাজানা নয়? আমি ভেবেছিলাম, পিসতুতো, মাসতুতো ভাই-টাই কিছু হবে।’

‌নিষাদ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ওই তো যেটুকু বললাম।’

‌অপূর্ব রায় বলল, ‘আসলে কী জানো, অনেক সময় কম চেনাজানাতেও ভাব-ভালবাসা, পছন্দ হয়ে যায়। নইলে তোমার ঐশানীদি কি আর তোমাকে রেকমেন্ড করত?’

নিষাদের অস্বস্তি বাড়তে থাকে। এ কেমন ইন্টারভিউ!‌ করার কিছু নেই। যে চাকরি দেবে সেই ঠিক করবে, প্রশ্ন কেমন হবে, আদৌ হবে কিনা।

অপূর্ব রায় বলল, ‘আগে কোনও কাজটাজ করেছ?’

কাজের কথা আসায় নিষাদ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘করেছি স্যার। তবে ছোটখাটো, বলার মতো নয়।’

‘ও। চাকরি কি তোমার খুব দরকার?’

নিষাদ সোজা হয়ে বলল, ‘অবশ্যই স্যার। খুব দরকার।’

‘বাড়ি কোথায়?’

নিষাদ বলল, ‘সুরুলপুরে। এখানে মেসে থাকি। মেসের ভাড়াও বাকি.‌.‌.‌’

অপূর্ব রায় মুখ দিযে চুকচুক করে আওয়াজ করে বলল, ‘সত্যি কাজের বাজার দিনদিন খারাপ হয়ে পড়ছে। লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েরা যে কী করবে! বাড়িতে কে কে রয়েছে?’

নিষাদ বলল, ‘মা আর বোন। মা অসুস্থ। বোন একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াত।’

অপূর্ব রায় বলল, ‘পড়াত!‌ এখন?’

নিষাদ একটু থমকে বলল, ‘কাজটা নেই।’

অপূর্ব রায় চেয়ারটা অল্প দোলাতে দোলাতে বলল, ‘সব জায়গাতেই গল্প প্রায় এক। বুঝতে পারছি তোমার নিড খুবই বেশি। যাক, তোমার বিষয়টা আমি সিরিয়াসলি ভাবব। আমিও একসময়ে টাফ সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি নিষাদ। ঐশানী তোমাকে বলেছে কী না জানি না, গুরগাঁওতে বড় কোম্পানিতে চাকরি করতাম, একদিন দুম করে দিলাম কাজটা ছেড়ে। অত ভাল কাজ কেন ছেড়ে দিলাম? সেকথা থাক। কলকাতায় ফিরে এসে ডিসিশন নিলাম, দুর, আর চাকরি করব না। নিজে ব্যবসা করব। যা থাকে কপালে। এদিকে পকেট তো ঢুঢু। ব্যবসা করতে তো ক্যাপিটাল লাগবে। কোথায় পাব? কে দেবে? ব্যাঙ্কে গেলাম, সিকিয়োরিটি চাই। তা-ও নেই। সুতরাং এমন ব্যবসা করতে হবে যাতে খুব বেশি ইনভেস্টমেন্ট না লাগে। তাই এই সাপ্লাই, ডিস্ট্রিবিউশনের কোম্পানি খুলে বসলাম। সাত বছর হয়ে গেল। লং সেভেন ইয়ার্স। বুঝলে ভাই, ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। নইলে ঐশানী চ্যাটার্জি এতদিন পরে ফোন করে?’ কথা শেষ করে জোরে হাসল রূপবান মানুষটা।‌ নিষাদের বিস্ময় বাড়ল। এ কেমন ইন্টারভিউ হচ্ছে! মালিক নিজের কথা বলছে!‌ অপূর্ব রায় এবার চেয়ারের দুলুনি থামিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘এক কাজ করো নিষাদ, নেক্সট উইক, ফ্রাইডে একটা ফোন করে চলে এসো। আচ্ছা ফোন করতে হবে না, আমি এখনই সময় লিখে নিচ্ছি। তিনটের সময় চলে এসো।’

নিষাদ বলল, ‘স্যার, আমি কি পরীক্ষার মার্কশিটগুলো দেখাব?’

অপূর্ব রায় মুখ তুলে হাসল। বলল, ‘পরীক্ষার মার্কশিট দেখে কী করব? অমন মার্কশিট আমার কাছে হাজারটা জমা রয়েছে। এই দেখো ফাইল।’

সত্যি সত্যি টেবিলের উপর রাখা দড়িবাঁধা একটা ফাইল তুলে ধরলেন অপূর্ব রায়। একটু থামল। বলল, ‘আজকাল একটা অফিস খুলে বসলেই হল, আগেই গাদাখানেক চাকরির অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়ে যায়।’ আবার থেমে নিচু গলায় বলল, ‘আমার কাছে তোমার মার্কশিট ঐশানী চ্যাটার্জি। দ্য বিউটিফুল লেডি। আচ্ছা, আজ এসো।’

নিষাদ একই সঙ্গে ভাল এবং খচখচানি মন নিয়ে সেদিন বেরিয়ে এসেছিল। ভদ্রলোক এত ব্যক্তিগত কথা বলল কেন? ঐশানীদির প্রসঙ্গ তোলার সময় কথাগুলো কেমন যেন ছিল। নিষাদ নিজের মনকে ঝাড়া দিল। অকারণ ভাবছে। এই মানুষ তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছে, এতটা সময় দিয়েছে সেটাই অনেক। ঐশানীদির সঙ্গে সম্পর্ক ভাল বলেই হয়েছে। নইলে তাকে আবার ডাকবে কেন? একটা কিছু হয়েও যাবে মনে হচ্ছে।

‌পরদিন যেতেই রিসেপশনের মেয়েটি একগাল হেসে, আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আসুন।’

ঘরে ঢুকতে অপূর্ব রায় খানিকটা তাড়াহুড়ো করে বলেছিল, ‘আজ আর বসতে বলছি না। তোমার বিষয় আমার ডিসিশন নেওয়া হয়ে গিয়েছে। আমি তোমাকে নিচ্ছি। একজন নিডি ছেলেকেই খুঁজছিলাম। নিডি ছেলেরা চাকরির মূল্য বোঝে।’

নিষাদ কী বলবে বুঝতে পারল না। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। ছি ছি, এই মানুষটা সম্পর্কে কী সব ভেবেছে।

‘তুমি অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবে। পঁচিশ দিয়ে শুরু করো। ঠিকমতো কাজ করতে পারলে বাড়বে।’

নিষাদ কাঁপা গলায় বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।’

‌অপূর্ব রায় হেসে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ আমাকে নয়, তোমার ঐশানীদিকে দিও। তবে এখন নয়, একেবারে জয়েন করে বলবে। মনে থাকবে?’

‘থাকবে, স্যার।’

অপূর্ব রায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নেক্সট সোমবার এসে আমার কাছ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে সেদিনই কাজে জয়েন করতে পারো। চেন্নাইতে একটা কাপড়ের কনসাইনমেন্ট যাওয়ার আছে। সেটা দিয়ে তোমার ট্রেনিং শুরু হবে। এগারোটায় চলে আসবে। সেদিন সঙ্গে একটা অ্যাপ্লিকেশন আনবে।’

কথা শেষ করে টেবিলের ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে দেয় অপূর্ব রায়।

‘কনগ্র্যাচুলেশনস। মনে থাকে যেন ঐশানী চ্যাটার্জিকে আমি সারপ্রাইজ় দিতে চাই। সেদিন ওকে তুমি এই অফিস থেকে ফোন করবে। নট বিফোর দ্যাট।’

নিষাদ ঐশানীদিকে কিছু বলেনি। ঠিক করেছিল, কাজে জয়েন করে আজ বলবে। কিন্তু আজ এসে এ কী শুনল!‌ কাজে জয়েন করা তো দূরের কথা, অপূর্ব রায় নামের লোকটা তার সঙ্গে দেখাই করল না। প্রায় তাড়িয়েই দিল। প্রায় কেন? তাড়িয়েই তো দিল।

উঁচু অফিসে থেকে নেমে এল নিষাদ। কড়া রোদে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। রাস্তায় পা দিয়ে নিষাদের মনে হল, নিষ্ঠুর একটা শহর তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *