নিষাদ জানে না

নিষাদ জানে না

বলেছিল আসতে পরে৷ যে কোনোদিন৷ সত্যিই আসবে কে জানত৷ দেবাদিত্যর ডাকাডাকিতে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে আমি একেবারে হাঁ৷ এ কী দেখছি! ঠিক দেখছি তো৷ আমারই ঘরে, আমারই সোফায় বসে শৈবাল৷ হ্যাঁ, শৈবালই৷ অবিকল সেই আগের মতো বসার ভঙ্গি৷ পায়ের ওপর পা, হাত ছড়ানো সোফার হাতলে, মুখে সেই চিরন্তন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন— কী রে, খুব চমকে গেলি তো? বলেছিলুম চলে আসব…

চমকে গেছিই তো৷ বিশ্বাস হচ্ছে না, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না৷

—ওভাবে দেখছিস কী? আমি রে আমিই৷ তোর সেই গ্রেট হিরো শৈবালদা৷ তোর একমাত্র নায়ক৷

কথার ছিরি দ্যাখো! দেবাদিত্য রয়েছে না সামনে৷ তাড়াতাড়ি সামলে নেবার চেষ্টা করলাম, থাক৷ হয়েছে৷

দেবাদিত্য অবশ্য নির্বিকার৷ শৈবালের কাঁধ-ঝাঁকানো দেখে উল্টে মজা পাচ্ছে যেন৷

—আরে কী কাণ্ড! এত বড়ো খবরটা তো জানতাম না৷

—সেকী রে! বেমালুম চেপে গেছিস বরের কাছে?

—ইস! হাসতে গিয়ে গলাটা কেমন কেঁপে গেল, কী আমার উত্তমকুমার ছিলেন রে…

—যাহ৷ তাহলে তো তোকে সুচিত্রা সেন হতে হয়৷ তুই মোটেই অতটা সুন্দরী নোস৷

শৈবালের সঙ্গে দেবাদিত্যও হাসছে হ্যা-হ্যা করে৷ মুখটা কেমন বোকা-বোকা হয়ে গেল৷ ওদের মতো হাসতে পারছি না কিছুতেই৷ ফুসফুস দুটো এখনও চমকের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ কেন এসেছ শৈবাল? নিশ্চয়ই বাড়ি বয়ে শুধু আমার পিছনে লাগতে আসেনি৷ তাহলে? বিয়েবাড়িতে সেদিন বলেছিল বটে৷ হাল্কাভাবেই৷ কেমন ঘরসংসার করছিস গিয়ে একবার দেখে আসতে হবে৷

—সত্যিই? কবে আসবে বলো?

—ঠিকানা দিয়ে রাখ৷ যে কোনোদিন চলে যাব৷

শৈবাল এখনও একই রকম৷ চার বছর পরেও৷ হাসিখুশি৷ ঝলমলে৷ জড়তাহীন৷ কী সহজে ভাব জমিয়ে ফেলেছে দেবাদিত্যর সঙ্গে৷ সেই বিয়েবাড়ি থেকেই৷ দেবাদিত্যও দিব্যি অসংশয়৷ ছোটো সোফাটায় ছড়িয়ে বসে উপভোগ করছে শৈবালের কথাগুলো৷

—আপনার বউটা বোধ হয় আর সেরকম বোকা নেই, বুঝলেন? খেপালেও খেপছে না!

—একদম ভুল রিডিং৷ এখনও কথায় কথায় চোখ দিয়ে টপটপ…

—ইজ ইট? স্যাড— ভেরি স্যাড! আমি ভেবেছিলুম…

শৈবাল ভাবে? আমার কথা? মিথ্যে বলছে৷ প্রতিবাদ জানানোর দরকার৷ মাঝখান থেকে বলে উঠলাম, অনেক হয়েছে আমাকে নিয়ে গবেষণা, এখন কী খাবে বলো? চা? কফি? সরবত?

—চা-ফা তো হবেই৷ তার আগে একটু জল খাওয়া দেখি৷

—শুধু জল কেন? একটু সরবত করে দি?

—দিবি? দে! বেত না আসা পর্যন্ত কানমলাই চলুক৷

সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে, শোবার ঘর পেরিয়ে, সোজা একেবারে ডাইনিং স্পেসে৷ ফ্রিজের ডালা খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ৷ কেমন একটা নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে৷ গলা শুকিয়ে মরুভূমি৷ ঠাণ্ডা জলের বোতল খুলে ঢকঢক ঢাললাম গলায়৷ কেন এমন হচ্ছে? এতদিন পরও? ভেতরে ভেতরে বিশ্রী এক অস্থিরতা৷ তুলতুলির বিয়ের দিনও ঠিক এরকমই হয়েছিল৷ সবে তখন উপহার তুলে দিচ্ছি তুলতুলির হাতে, মালা কোত্থেকে এসে টানল হাত ধরে৷ আচমকা৷

—এত দেরি করে এলি যে?

—দেরি কোথায়? ও অফিস থেকে ফিরলে তবে তো আসব!

—হয়েছে৷ হয়েছে৷ আমার সঙ্গে একটু আয় তো এখন৷

—কোথায়?

—আয় না৷ ছোড়দাভাই তোকে কখন থেকে খুঁজছে৷

ছোড়দাভাই শব্দটাতে এখনও এত জাদু আছে কে ভেবেছিল! চার বছর পরেও! শিরদাঁড়ায় শক খেলাম যেন৷ মস্তিষ্ক পলকে অবশ৷ গলা থেকে আপনাআপনি শব্দ ছিটকে এল, কবে এসেছে শৈবালদা?

—কাল৷ হঠাৎই? আমরা তো ভেবেছিলাম তুলতুলির বিয়েতেও বোধ হয় আসতে পারল না৷ আমার বিয়েতে তো পারেনি জানিসই৷

জানি৷ অনেক দূরে উড়ে গেলে ফেরা কঠিন৷ সকাল-সন্ধেটাই সে দেশে বদলে যায়৷ ভাবতে ভাবতে একটু বুঝি দূরমনস্ক হয়েছি, মালা আবার টানল আমাকে, চল৷ আমার কাছে অনেকবার তোর খোঁজ করেছে৷ বলতে বলতে চোখ ঘোরাচ্ছে, রহস্যটা কী রে? ছোটদাভাই-এর সঙ্গে তোর কোনো ব্যাপার-স্যাপার ছিল নাকি? গভীর… গোপন…?

—থাকলে তুই জানতে পারতিস না?

এ ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারতাম মালাকে৷ গোপনীয়তা কিছু থাকলেও সে যে শুধু আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব৷ কাউকে বলা যায় না৷ ভালোবাসায় হেরে যাওয়ার মতো লজ্জা আর কিছুতে নেই৷ নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা বোধ হয় আরও কষ্টের৷ সে কষ্ট আমি জানি৷ তবু চেষ্টা একবার করেছিলাম৷ বেহায়ার মতো৷ শৈবালের নিউইয়র্কে যাবার তারিখ তখন একেবারে কাছে৷ ঠিক দু-দিন পরে৷

—তুমি তাহলে সত্যিই চলে যাচ্ছ শৈবালদা?

—কেন? এখনও তোর সন্দেহ আছে নাকি?

—তা নয়, চলে যাবে?

—ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপটা যখন পাইয়েই দিল, দেখাই যাক না… ঘুরে আসি…

—একা একা ওখানে খুব মন খারাপ লাগবে তোমার, দেখো! মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম, এই সবাই মিলে এখানে হইচই… এত নাটক-টাটক করা…

খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও শৈবাল সেই প্রথম যেন উদাস হয়েছিল একটু৷ সময় স্থির হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য৷ ব্যাস, সেই টুকুনি৷ তারপরই দুনিয়া-ওড়ানো হাসি৷ স্বভাবমতন৷

—যাওয়াটা তাহলে ক্যানসেলই করে দিই, কি বল৷

—আমি কি সে কথা বলেছি নাকি? নিশ্বাস চেপে বলে ফেলেছিলাম, গ্রুপ তো ভেঙে যেতেই বসেছে৷ আমাকেও হয়তো চলে যেতে হবে শিগগিরই…

—কোথায় যাবি? প্রশ্ন করেই মনে পড়ে গেছে শৈবালের৷ সঙ্গে সঙ্গে হই-হই করে উঠেছে, রাঁচি!

মালা বলেছিল, বটে৷

—কতদূর এগোল রে ব্যাপারটা? দিন ঠিক হয়ে গেলে আমাকে খবর দিবি কিন্তু৷ তোর বিয়েতে আসতে না পারি, শুভেচ্ছা তো পাঠাতে পারব৷

এরপর আর কত নির্লজ্জ হওয়া যায়৷ প্রাণপণে শুধু নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি, কিছুতেই যেন কেঁদে না ফেলি৷

সেই কান্নাটা কি এখনও রয়েছে বুকের ভেতরে৷ গলার কাছে তবে এত বাষ্প জমছে কেন! ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে৷ গ্লাসে জল ঢেলেও স্কোয়াশ দিতে ভুলে গেছি৷

বাইরের ঘর থেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে দেবাদিত্য যে এসে দাঁড়িয়েছে, সে হুঁশও নেই, আমার, কী হল? সরবত করতে এত দেরি?

দেবাদিত্যর মুখে বিস্ময়৷ নাকি সন্দেহ? তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিলাম নিজেকে, দ্যাখো না কী বিশ্রি ব্যাপার৷ কৌটো খুলে দেখি চিনি নেই৷ কী করি বলো তো?

বিশ্বাস করল কিনা বোঝা গেল না৷ ভুরু কুঁচকে তাকাল৷ —এনে দেব?

—থাক৷ ওর হাত চেপে ধরতে যাচ্ছিলাম প্রায়৷ ভাগ্যিস ধরিনি৷ বাড়াবাড়ি হয়ে যেত৷ অভিনয় নিখুঁত করার চেষ্টা করলাম৷ রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বাটি নিয়ে এলাম একটা, তুমি বরং শৈবালদার সঙ্গে ততক্ষণ কথা চালিয়ে যাও, প্লিজ৷ আমি চট করে পেছনের দরজা দিয়ে কল্পনাদির কাছ থেকে…

চিনির বাটি হাতে টেবিলের কাছে ফিরে এসেও হাঁপাচ্ছি৷ বুক ঢিপঢিপ করছে৷ আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যেতাম৷ কী ভাবত আমাকে ঘরের মানুষটা? ছি ছি! এখন আর এ ধরনের যুক্তিহীন আবেগের কোনো মানেই হয় না৷ আমার সংসার সুখী৷ নিরুদ্বেগ৷ সুন্দর৷ কোথাও ফাঁকি নেই এখানে৷ দেবাদিত্যর সঙ্গে সম্পর্কেও না৷ আরেকজনও এসে যাচ্ছে শিগগিরই৷ মাসতিনেক আগে তার আসার সূচনা হয়ে গেছে আমার শরীরে৷ আমি তাকে প্রতি পলে অনুভব করি৷

সরবত নিয়ে যাবার সময় শোবার ঘরের আয়নায় চোখ পড়ে গেল৷ ট্রে নামিয়ে আটপৌরে আঁচল সাজিয়ে নিলাম কাঁধে? চুলে আলতো চিরুনি বোলালাম৷ একটুও অগোছালো যেন না লাগে৷ মুখে যেন ভাবান্তর না ফোটে৷

শৈবাল যথারীতি জমিয়ে গল্প করে চলেছে দেবাদিত্যর সঙ্গে৷ —দিন সাতেক আছি আর৷ ফিফটিনথ ফিরছি৷ যাবার আগে বম্বেতে একটা ইন্টারভিউ আছে…

—ওদেশে তাহলে সেটল করছেন না?

—নাহ৷ তেমন একটা চান্স পেলেই…

—হ্যাঁ৷ এবার এখানে এসে একটা বিয়ে-থা করে ফ্যালো৷ পর্দা সরিয়ে নিপুণ হাসি ঝুলিয়ে নিলাম ঠোঁটে, আমরা বেশ পাত পেড়ে নেমন্তন্ন খাব৷

—তোর বিয়ের খাওয়াটা খাওয়া আগে৷

—এনি ডে৷ এসো৷ কবে খাবে বলো?

—মাথা খারাপ৷ এক গ্লাস সরবত খাওয়াতেই যা করলি… পাক্কা আধঘণ্টা… খেতে ডেকে হয়তো…

—না… মানে… আসলে কী হয়েছে, জানেন তো? দেবাদিত্য সহসা ত্রাণকর্তার ভূমিকায়৷ বউ-এর দোষ ঢেকে দিতে চাইছে— সরবত বানাতে গিয়ে দেখে চিনি নেই৷

—সো হোয়াট? তোর আঙুলটা একবার ডুবিয়ে দিলেই পারতিস৷…

—উফ৷ শৈবালদা তুমি না… বিশুদ্ধ ভাঁজ আনলাম ভুরুতে, —নাও, খেয়ে নাও৷

—দরকার নেই৷ তোর কর্তা প্লেন জলে আমার চেষ্টা মিটিয়ে দিয়েছে৷

তার মানে আমি যখন চিনি আনতে গেছি, দেবাদিত্য আবার গিয়েছিল ভেতরে৷ জল আনতে৷ হূৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল বেয়াড়াভাবে৷ রান্নাঘরে গিয়ে চিনির কৌটো খুলে দেখেনি তো! দেখলেও আর কিছু করার নেই৷ অস্বস্তি চাপা দেবার জন্য কথা ঘোরাতে চাইলাম, তারপর আর কী খবর বলো? মালা শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেছে?

—এই তো কালই গেল৷ তুলতুলিরাও৷

সবরত শেষ করে সিগারেট ধরিয়েছে শৈবাল৷ প্যাকেট বাড়াল দেবাদিত্যর দিকে৷ আগুন দেওয়া-নেওয়ার পালা চলছে৷ ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম৷ এখনও ঝাঁড়পোঁছ হয়নি৷ টিউবলাইটের কোণে পাতলা ঝুল৷ বই-এর র্যাকে ধুলো৷ পর্দাগুলোও নোংরা হয়েছে৷ বেশ এলোমেলো সব কিছু৷ শৈবাল সত্যি আসবে জানলে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যেত৷ পরিবেশের অবিন্যস্ততা নিজেকেও বড়ো আলুথালু করে দেয়৷

দেবাদিত্য আর শৈবাল আবার গল্প শুরু করেছে৷ আমেরিকা থেকে রাজনীতি ঘুরে ভারতে এল৷ বুশ থেকে ভি পি সিং৷ আবার ঘুরে পোল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়ায়৷ সেখান থেকে ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরবে৷ ওদের বিশ্ব-পরিক্রমায় মাঝে মাঝে ফুট কাটছি আমিও৷ পেট্রোলিয়াম সমস্যা নিয়ে বেশ খানিক মতামতও জানিয়ে দিলাম৷ মূল্যবৃদ্ধি লোডশেডিং নিয়ে বিরক্তিও৷ ক্রমে শান্ত হয়ে আসছে ভেতরটা৷ মোটেই আর ঝটপট করছে না৷ এক সময় দেবাদিত্যই দেশবিদেশ থেকে ঘরের মাটিতে চলে এল দুম করে, এই, তুমি যে বসে বসে গল্প করে যাচ্ছ৷ ভদ্রলোককে কিছু খাওয়াবে-টাওয়াবে না?

—শৈবালদা, আজ দুপুরে এখানেই খেয়ে যাবে৷ না হয় দুপুরের খাওয়া সন্ধের মুখে…

—ওরে বাবাহ! কথা পুরো শেষ হবার আগেই শৈবাল মাথা ঝাঁকাচ্ছে সজোরে, বউদি আজ দুপুরে হেভি অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছে৷ ওটা মিস করে এখানে রিস্ক নিতে একদম রাজি নই আমি!

ব্যাস, হয়ে গেল৷ বলার ধরনই এমন যেন পৃথিবীর শেষ রায় দেবার অধিকার শুধু ওরই৷ তার ওপর কোনো অ্যাপিল চলবে না৷ দেবাদিত্য তবু গৃহকর্তার সৌজন্য দেখিয়ে চলেছে, ঠিক আছে৷ কিছু অন্তত তো খাবেন৷ প্রথম দিন এসেছেন…

—সুদে বাড়ুক না৷ পরে একদিন উশুল করা যাবে৷

—তা কী করে হয়? আপনি বরং ওর সঙ্গে কথা-টথা বলুন, আমি এক্ষুনি…

দেবাদিত্য উঠে পড়েছে৷ কী কাণ্ড৷ সত্যি সত্যি বেরোবে নাকি? আমাকে একা ফেলে? একটু আগের সহজ হয়ে আসা ভাব পলকে উধাও৷ শরীর শিরশির করছে৷ জেনে বুঝে বেরিয়ে যেতে চাইছে নাকি! মনে হয় না৷ এতক্ষণ তবে সাদা মনে আড্ডা মারল কী করে? কী জানি! বলা যায় না! ছেলেরা মনের সন্দেহ সহজে প্রকাশ করে না৷ দেবাদিত্য তো বড্ড চাপা!

দেবাদিত্যর পাশাপাশি উঠে দাঁড়িয়েছি, দোকানে যাওয়ার দরকার কী? বাড়িতে যা আছে… শৈবালদা, ওমলেট খাবে? কিমা দিয়ে করে দিতে পারি৷ কথা দিচ্ছি পাঁচ মিনিটে দেব৷

—দাঁড়া৷ দাঁড়া৷ তোরা হঠাৎ এত ব্যস্ত হয়ে পড়লি কেন? এক কাজ কর, ভালো করে চা বানিয়ে ফেল তো দেখি!

—পাগল নাকি? শুধু চা? ওসব হবে না৷ দেবাদিত্য খাওয়াবেই, একে শ্বশুরবাড়ির লোক, তার ওপর বউ-এর হিরো৷ নিজের মুণ্ডুটা তো বাঁচাতে হবে— বসুন, বসুন৷

বলতে বলতে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল৷ মানিব্যাগ নেবে৷

দেবাদিত্য বেরিয়ে যাবার পর ভীষণভাবে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি৷ কোনোভাবেই দুর্বল হয়ে পড়তে চাই না৷

—শুনলাম তুমি রিসার্চটাও শেষ করোনি? ওখানে চাকরিতে ঢুকে পড়েছ?

—আর কতদিন ইউনিভার্সিটির ঘাড় ভাঙব রে? রোজগারপাতি করতে হবে না?

—বোকো না, তোমার আবার রোজগারপাতির ভাবনা৷ বেশি গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছ তাই বলো৷

—সেটাই বা পারলাম কই! কী যে হল… সবটাই কেমন…

শৈবাল নতুন সিগারেট ধরিয়ে হেলান দিল সোফায়৷ হঠাৎ যেন সামান্য অন্যমনস্ক৷ ঠোঁট চেপে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে কী যে ভাবছে! আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে যেন৷ সমূলে নাড়া খেলাম৷ পরিষ্কার টের পাচ্ছি একটা কিছু ঘটতে চলেছে৷ এক্ষুনি পালিয়ে যাওয়া দরকার, শৈবালের সামনে থেকে৷

—শৈবালদা, এক সেকেন্ড, আমি চায়ের জলটা বসিয়ে দিয়েই আসছি৷

ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি, পেছনে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত স্বর, দাঁড়া৷

খোলা দরজার দিক থেকে ফাল্গুনি বাতাস আসছে৷ ঘরের সব পর্দা দুলে উঠল৷ দোলনার মতো৷ বাইরের আলোর ঝলকানি ঘরে ঢুকে মৃদু জ্যোতি৷ শৈবাল হঠাৎ একেবারে অন্যরকম৷

—এদিকে আয়৷ এখানে এসে বোস৷

এমন হওয়ার তো কথা ছিল না৷ ওই স্থির তাকিয়ে থাকা মুখ একদম অপরিচিত৷

—কী হল, আয়! তোর সঙ্গে আমার একটা খুব জরুরি কথা আছে৷

ভরাট পুরুষকণ্ঠ নয়, সাপুড়ের বাঁশি ডাকছে সাপিনীকে৷ পায়ের তলায় ছড়িয়ে যাচ্ছে স্পন্দন৷ সব ওলটপালট হয়ে গেল৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চলেছি৷ এগোনো না পিছানো৷ চতুর্দিক আবছা হয়ে এল৷ বিশ্বসংসার, দেবাদিত্য, সব— সবাই৷

—একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি কথা বলবি?

—কী কথা?

নিজের গলাটা আর আমার আয়ত্তে নেই৷ কেঁপে গেল৷

—আমার জানা খুব দরকার৷ চার বছর ধরে কথাটা আমাকে উন্মাদের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ তোকে সত্যি কথা বলতেই হবে, বল বলবি?

এবার চোখও বিবশ৷ পলক ফেলতে ভুলে গেছে৷

—তুই কি আমাকে কোনোদিন কিছু বলতে চেয়েছিলি? ঠিক করে বল তো…

শরীরের সমস্ত রোমকূপ যেন খুলে গেল৷ লক্ষ সরোদ বেজে উঠল শিরা উপশিরায়৷ আজ শৈবাল এতদিন পরে.. সেই শৈবাল…

দীর্ঘ সুঠাম শরীর উৎসুক ঝুঁকে আছে৷ নিষ্পলক দৃষ্টি আমারই চোখে স্থির৷ চেতনা ক্রমে অবশ হয়ে আসছে৷ সম্বিত ফিরতে পৃথিবীর বয়স বেড়ে গেল কয়েক হাজার বছর৷ অথবা কয়েক মুহূর্ত মাত্র৷ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম৷ প্রবল ভূমিকম্পের পর মাটি শান্ত হচ্ছে৷

—না তো শৈবালদা৷ সেভাবে তো কোনোদিন কিছু বলতে চাইনি তোমায়৷ না তো! কেন তোমার মনে হয়েছে একথা?

সমুদ্রের মতো গাঢ় চোখে মেঘের ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল৷ আবার সেখানে ঝলমলে উচ্ছল ঢেউ৷ স্খলিত মুহূর্তটাকে কী অবলীলায় সেই ঢেউ-এ ভাসিয়ে দিল শৈবাল৷ বুঝলই না সমস্ত কথারই নির্দিষ্ট একটা সময় থাকে৷ সেই সময় চলে গেলে সে কথার মৃত্যু হয়৷ হরিণী বসে থাকে না নিষাদের প্রতীক্ষায়৷ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শৈবাল আবার হাসছে শব্দ করে৷

—এত কাঁপছিস কেন রে বোকা? ঠাট্টাও বুঝিস না?

আমার চার বছর আগের প্রতি রাত্রের সব স্বপ্নই কী ঠাট্টা এখন!

দেবাদিত্য কেন ফিরছে না? এক্ষুনি ফিরে আসুক৷ এই মুহূর্তে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *