নিষাদনামা

নিষাদনামা

বলপয়েন্ট নামে আমি ব্যক্তিগত কিছু লেখা লিখেছি। বই আকারে বেরও হয়েছে। আনন্দ, দুঃখ এবং বঞ্চনার আরো কিছু গল্প আমার ঝুলিতে আছে। মাঝে মধ্যে লিখতে ইচ্ছা করে। ‘কাঠপেন্সিল’ নাম দিলাম, কারণ এই লেখাগুলি ইরেজার দিয়ে মুছে ফেললে সাহিত্যের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং লাভ হবার সাবনা আছে।

পুত্র নিষাদকে দিয়ে শুরু করি।

বইমেলা (২০০৯) শেষ হয়েছে। প্রকাশকরা লেখকদের প্রাপ্য কপি দিয়ে গেছেন। বন্ধুবান্ধবদের বিলিয়েও ঘরভর্তি বই।

পুত্র নিষাদ প্রতিটি বইয়ের ফ্ল্যাপ খোলে। তার বাবার ছবি বের করে এবং এইটা আমার বাবা বলে বিকট চিৎকার দেয়। তার এই চিৎকার আমার কানে মধু বর্ষণ করে।

দুই বছর বয়সে হঠাৎ এক দুপুরে সে সমালোচকের কঠিন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। আমাকে এসে বলল, বাবা, বই ছিঁড়ব। আমাকে বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি কখনো না বলব না। তার অনেক কর্মকাণ্ডে তার মা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আমি করি না। করুক না যা ইচ্ছা।

আমি বললাম, ঠিক আছে বাবা বই ছেঁড়ো। সে কয়েকটা বই ছিঁড়ল এবং বুঝতে পাড়ল, বই ছেঁড়া খবরের কাগজ ছেঁড়ার মতো এত সহজ না। তখন সে বলল, বাবা, তোমার বইয়ের উপর আমি পিসু করব।

আমার কঠিন সমালোচকদের মুখে এবার নিশ্চয়ই হাসি ফুটেছে। তাঁরা আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলছেন, পিসাব করার মতোই জিনিস। আরো আগেই পিসাব করা উচিত ছিল। দেরি হয়ে গেছে।

যাই হোক, আমি আমার বইয়ের স্তূপের ওপর পুত্রকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। সে হাসিমুখে পিসাব করল।

এখন আমার বন্ধুবান্ধবরা বই নিতে এলে প্রথমেই বলেন, পিসাব ছাড়া কোনো বই আছে? থাকলে দিন।

দশ বছর বয়সের নিচের শিশুদের প্রতি আমার অন্য একধরনের মমতা আছে। তারা তাদের ভুবনে আনন্দ নিয়ে বাস করে। তাদের সঙ্গে গল্প করলে তাদের অদ্ভুত ভুবনের কিছুটা আঁচ পাই। তারা বিচিত্র ধরনের খেলা খেলে। সেই খেলায় অংশ নেয়াও আনন্দের ব্যাপার।

পুত্র নিষাদের বর্তমান খেলা হলো, সে তার নিজের ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের মগ নিয়ে এসে বললে, বাবা, এটা গরম চা। খুব গরম। খাও।

আমি খুব গরম চা খাওয়ার অভিনয় করলাম। তারপর সে নিয়ে এল ঠান্ডা চা। আমি ঠান্ডা চা খাওয়ার অভিনয় করলাম।

তারপর চলে এল ঝাল চা। আমাকে ঝাল চা খেয়ে কিছুক্ষণ উহ আহ করতে হলো। তখন হঠাৎ খেয়াল হলো, বারবার যে সে মগে করে পানি আনছে, কোত্থেকে আনছে? বোতল থেকে সে তো পানি ঢালতে পারে না। আমি বললাম, বাবা, পানি কোত্থেকে আনছ?

সে বলল, বাথরুম থেকে।

আমি বললাম, কী সর্বনাশ! বাবা, তুমি কি কমোড থেকে পানি আনছ? যেখানে তুমি হাগু কর সেখান থেকে?

সে বলল, হ্যাঁ।

আমি কমোডে তিন মগ পানি খেয়েছি। আমার একটাই সান্ত্বনা, আমার কিছু বন্ধুবান্ধবও নিষাদের সঙ্গে চা খাওয়ার খেলা খেলেছে। তারা চায়ের উৎস জানে না। এইজন্যেই কবি বলেছেন, ignorerice is bliss.

আমি আগেই বলেছি, দশ বছর নিচের বয়েসী শিশুদের আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। দশ পার হলেই off limit. যাদের বয়স দশের চেয়ে বেশি তাদের ঠিক চিনতে পারি না। নিষাদের দশ হতে এখনো আট বত্সর বাকি।

আমি ঠিক করেছি আমার অন্য বাচ্চাদের আমি যেভাবে আনন্দ দিয়েছি তাকেও সেভাবে দেব। আমার অন্য বাচ্চারা ভাইবোনদের মধ্যে বড় হয়েছে। সে বড় হচ্ছে একা।

কাজেই আমি একদিন ঘোড়া সেজে বললাম, বাবা, পিঠে উঠ। আমি তোমাকে নিয়ে ঘুরব।

নিষাদ বলল, ঘোড়ায় উঠব না, তুমি ফেলে দিবে।

আমি ফেলব না। আমি অত্যন্ত শান্ত ঘোড়া। প্রায় গাধাটাইপ।

পুত্র ঘোড়ায় চড়ল। তাকে নিয়ে হামা দিয়ে এগুচ্ছি। পুত্রের মাতা বলল, কী হচ্ছে?

আমি বললাম, ঘোড়া হয়েছি। পৃথিবীতে বৃদ্ধ ঘোড়াও কিন্তু আছে।

সে বলল, তুমি একজন লেখক মানুষ। তুমি ঘোড়া হয়ে ঘুরছ, দেখতে কেমন জানি লাগছে।

আমি বললাম, আমাদের নবিজী (দ) ঘোড়া সেজে তার নাতি হাসান হোসেনকে পিঠে নিয়ে ঘুরতেন। আমি কোন ছাড়। লেখকদের গ্র্যান্ডমাস্টার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নাতনিদের পিঠে চড়িয়ে ঘুরতেন। ঘোড়ার প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতাও ছিল। ঘোড়াকে নিয়ে তার বিখ্যাত সব কবিতা আছে।

ঘোড়া নিয়ে তিনি কখন কবিতা লিখলেন?

আমি কবিতা আবৃত্তি করলাম–

তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।

অশ্বারোহীর মা ক্যামেরা নিয়ে এল। তার একটা ডিজিটাল ক্যামেরা আছে। এই ক্যামেরায় এক লক্ষ ছবি তোলা হয়েছে, যার সবই পুত্র নিষাদের। বললাম, একটা ছবি মানবজমিন কাগজে পাঠিয়ে দাও। ওরা অনেক দিন আমাকে নিয়ে কিছু লিখতে পারছে না। লেখার সুযোগ করে দাও। ক্যাপশন হবে—হুঁমায়ুন আহমেল এখন ঘোড়া।

মাটি কাটা ছাড়া এই জগতে দ্বিতীয় কঠিন কাজ হচ্ছে শিশুদের ঘুম পাড়ানো। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে যিনি শিশুদের ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করেন প্রায়ই দেখা যায় গানের সুরে তিনিই ঘুমিয়ে পড়েন, শিশু জেগে থাকে।

নিষাদকে ঘুম পাড়ানোর কঠিন কাজটি আমাকে প্রায়ই পালন করতে হয়। আমি গল্প বলে এই চেষ্টাটা করি।

গল্প শুনবে বাবা?

শুনব।

রাজার গল্প?

না।

রানিদের গল্প? শেখ হাসিনা, খালেদা?

না।

ভূত-প্রেত রাক্ষস-খোক্কস?

না।

তাহলে কিসের গল্প শুনবে?

এসির গল্প।

এসি নামক যন্ত্রটি তার মাথায় কীভাবে ঢুকে গেছে আমি জানি না। একটা কারণ হতে পারে গরমে যখন কষ্ট পায় তখন এসির ঠাণ্ডা বাতাসে আরাম পায়। দ্বিতীয় কারণ, চারকোনা একটা বড় বোতাম টিপলেই হিম হাওয়া দেয় এই রহস্য।

যাই হোক, আমি এসির গল্প বলার প্রস্তুতি নিলাম। গল্প বানানো তো আমার জন্যে তেমন কঠিন না (চল্লিশ বছরের অভ্যাস)। কিন্তু পড়লাম মহাবিপদে। এসি নিয়ে কী গল্প বলব! বাবা এসি, মা এসি এবং তাদের শিশুসন্তান এসির মানবিক গল্প? সেটা তো বিশ্বাসযোগ্য হবে না। যে-কোনো গল্পকেই বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। আমি শুরু করলাম, একদেশে ছিল একটা এসি।

নিষাদ বলল, আর ছিল একটা এসি রিমোট।

আমি বললাম, গল্পের মাঝখানে কথা বলবে না বাবা। গল্পের মাঝখানে কথা বললে গল্প বন্ধ হয়ে যায়।… একদিন কী হলো শোনো। এসিটা বলল, মানুষকে ঠান্ডা বাতাস দিতে আমার খুব কষ্ট হয়। আমার শরীর গরম হয়ে যায়। তখন জ্বর আসে। আমি সারারাত মানুষকে ঠান্ডা বাতাস দেই। আর সারারাত আমার গা এত গরম হয়ে থাকে। এত জ্বর আসে।  

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি এসির প্রতি মমতায় আমার পুত্রের ঠোঁট ভারী হয়ে এসেছে। সে বলল, বাবা, এসি বন্ধ করে দাও, আমার ঠান্ডা লাগবে না।

এই ঘটনা আমি কীভাবে দেখব? গল্প সৃষ্টির ক্ষমতা হিসেবে, না-কি দু বছর বয়সী শিশুর বিশুদ্ধ আবেগ হিসেবে? লেখক হিসেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করার জন্যে আমি প্রথমটা নিলাম।

আমার বড় পুত্র নুহাশের কাছ থেকেও আমি আত্মশ্লাঘা অনুভব করার মতো উপকরণ একবার পেয়েছিলাম। তার বয়স তখন বারো। সে আমাকে বলল, বাবা, আমি তোমার কোনো বই যখন পড়ি তখন বাথরুমে বসে পড়ি।

আমি বললাম, বাথরুমে বসে পড়তে হবে কেন বাবা?

তোমার বই পড়তে গেলে কিছুক্ষণ পর পর চোখে পানি আসে। সবার সামনে কাঁদতে ভালো লাগে না। এই জন্যে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে পড়ি।

পুত্র নিষাদের কাছে ফিরে যাই। তার গল্প দিয়ে নিষাদনামার ইতি টানি।

নিষাদ খুব গানভক্ত। তার অতিরিক্ত সঙ্গীতপ্রীতি আমার মধ্যে সামান্য হলেও টেনশন তৈরি করে। কারণ গানের প্রতি অস্বাভাবিক দুর্বলতা অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে দেখা যায়।

নিষাদের পানপাগল হবার অনেকগুলি কারণ অবশ্যি আছে। তার মা শাওন গায়িকা। তার নানি তহুরা আলিও বেতার এবং টিভির তালিকাভুক্ত একজন সঙ্গীত শিল্পী। তার বড় মা (শাওনের নানিজান) একজন গায়িকা।

নিষাদের বাবা গায়ক না, গলায় কোনো সুর নেই, কিন্তু গানপাগল। তার দাদার গলাতেও সুর ছিল না, তিনিও ছিলেন গানের মহাপাগল। তার বড়দাদা (আমার দাদা) মাওলানা মানুষ ছিলেন। বাড়িতে গানবাজনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। তিনি একদিন আমার ছোটবোন শেফুর গাওয়া তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ঘোষণা করলেন বাড়িতে ইসলামি গান চলতে পারে। শেফুকে পর পর তিনবার একবৈঠকে গান শোনাতে হলো এবং দাদাজান কয়েকবার আহা আহা করলেন।

নিষাদ যেহেতু এই ঘরানার, গানের প্রতি তার মমতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। মায়ের সব গান এবং মনপুরা ছবির সব গান তার মুখস্থ।

এক দুপুরের কথা। লেখার টেবিলে বসেছি। মাতাল হাওয়া উপন্যাস লিখছি। জটিল অংশে আছি। এই অবস্থায় হাতি দিয়ে টেনেও টেবিল থেকে আমাকে নড়ানো সম্ভব না। পুত্র নিষাদ এসে তার কোমল হাতে আমাকে ধরে বলল, বাবা আসো।

আমি বললাম, কোখায় যাব?

 নিষাদ বলল, ছাদে। ঝড় হবে। তুমি ঝড় দেখবে।

আমি ঝড় দেখতে গেলাম। বৈশাখ মাসের দুপুর হঠাৎ করেই মেঘে মেঘে অন্ধকার। আকাশে এমন ঘন কালো মেঘ দেখেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রথম ভাব সমাধি হয়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে আকাশের ঘন কালো মেঘ দেখছি। হঠাৎ বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করল। আর তখন আমাকে ভয়ঙ্করভাবে চমকে দিয়ে পুত্র নিষাদ গাইল—

আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে।

এই গানটি তার মা গিয়েছে। নয় নম্বর বিপদ সংকেত ছবিতেও ব্যবহার করেছি। ছবিতে তানিয়া প্রচণ্ড ঝড় বাদলায় নাচতে নাচতে গানটি করছিল। এই গান পুত্র নিষাদ মুখস্থ করে রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো, গানটা ঝড় বাদলায় গীত হতে হবে এই বোধ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ পরে তাঁর রচনা পঠিত হবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। শত বছরেরও পরে দুবছরের একটি শিশু তাঁর গান করবে, এটি কি কখনো ভেবেছিলেন? আমার হঠাৎ মনে হলো, রবীন্দ্রনাথ এই দৃশ্যটি দেখছেন। এবং নিজের কবিতা থেকেই বলছেন, আমারে তুমি অশেষ করে একি এ লীলা তব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *