1 of 2

নিশ্বাস – প্রবোধবন্ধু অধিকারী

নিশ্বাস – প্রবোধবন্ধু অধিকারী

ভয়ঙ্কর এই নিশ্বাস। এই নিশ্বাসের জন্যই দত্ত-বাড়ির সমস্ত শান্তি বিনষ্ট। অশান্তির চেয়েও ভয়াবহ এই নিশ্বাস। ছোট থেকে বড়, বড় থেকে বৃদ্ধ সকলের মনেই কী এক উৎকণ্ঠা, কী এক দারুণ ভীতি চোখে-মুখে। মনে হয়, এ-বাড়ির কারও চোখেই ঘুম নেই। ঘুমোতে পারছে না ওরা বহুকাল ধরে। নিশ্বাস বলে যে ছোট্ট কথাটা—নাসারন্ধ্র-পথে বায়ুগ্রহণ আর পরিত্যজন এই নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর ভীতির প্রসারও যে হওয়া সম্ভব, সে কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। শুধু কঠিনই নয়, নিতান্ত অবিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু কারও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ওপরে নির্ভর করে পৃথিবী চলে না। সুতরাং বাস্তবে সত্যই এরকম ঘটেছে। যার জন্য রাত্রির নৈঃশব্দে এ-বাড়ির কারও দুটি চোখের পাতা এক করবার উপায় নেই। উৎকর্ণ হয়ে থাকতে হয় সকলকে সেই একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্য। সেই ভয়, সেই উৎকণ্ঠা। কখন পড়বে সেই নিশ্বাসটা, আর সেইসঙ্গে তীব্র আর্তনাদে সমস্ত বাড়িটাতে শোরগোল পড়ে যাবে। হইচই করে আসবে সকলে। তারপর রীতিমতো একটা কলরব, আর সেই-সঙ্গে এ-বাড়ির প্রত্যেকের মনে ছায়া-ছায়া দুলবে সেই ভয়-ভয় রহস্য। এ ওর মুখে-মুখে তাকাবে এবং সেইসঙ্গে প্রবলতম ত্রাসে গায়ের লোমগুলোও কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে যাবে টানটান হয়ে।

গত ছ’মাস ধরেই এই দারুণতম ভীতি দত্ত-বাড়ির কোঠায়-কোঠায়, আনাচে-কানাচে আর প্রত্যেকটি মানুষের মনে। প্রতিটি রাত্রির আসন্ন সম্ভাবনায় কী এক অজানিত ত্রাসে সকলে কুঁকড়ে আসে। ওরা ভয় করে রাত্রিকে। জানে, রাত্রি আসা মানেই সেই নিশ্বাস—আর নিশ্বাস মানে যে কী ভয়ঙ্কর—সে-কথা ভাবতে গিয়েও শিউরে উঠতে হয়।

ছ’মাস আগেও বাড়ির সকলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারত। ঘুমোবে না-ই বা কেন? অশান্তির কোনও ইঙ্গিতই ছিল না এ-বাড়িতে। দত্তরা শহরের মান্যগণ্যই শুধু নয়, রীতিমতো ধনশালী পরিবার। দু-তিন রকমের চালু ব্যবসা, প্রচুর ধন-সম্পত্তি রেখে স্বর্গে গেলেন প্রাণহরি দত্ত। সংসারে পড়ে রইল তাঁর বিধবা-স্ত্রী উমাসুন্দরী, দুই ছেলে নন্দ আর অরিন্দম, আর একটি মাত্র মেয়ে সুজাতা। সুজাতার বিয়ে হয়ে গেছে। নন্দকে আগেই বিয়ে দিয়ে সংসারী করে গেছেন প্রাণহরি দত্ত। বাকি অরিন্দম। সে এখন পোস্ট-গ্রাজুয়েটের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। বলতে গেলে রীতিমতো সুখের সংসার। কিন্তু সেই সংসারে এমন করে অশান্তির আগুন জ্বলবে কে ভাবতে পেরেছিল তখন?

 সেই ভয়ঙ্কর নিশ্বাসটা যে কখন, রাত্রির কোন নির্দিষ্ট প্রহরে পড়বে তার স্থিরতা নেই। ছ’মাস আগে শ্রাবণ মাসের এক রাত্রিতে হঠাৎ মৃত্যুদূতের মতো নিশ্বাসটা ঢুকেছিল। ঢুকে সকল শান্তি বিনষ্ট করে ভয়াবহ সঞ্চারিত ত্রাসে সকলের সুখ কেড়ে নিয়েছিল চোখের পাতা থেকে।

শ্রাবণের থমথমে বর্ষা-রাত্রি। ঝিরঝির করে সন্ধ্যা থেকেই ক্লান্ত বৃষ্টি পড়ছিল। সেই বৃষ্টির সঙ্গে একটু শৈত্যের মোলায়েম রমণীয় স্পর্শে ঘুম নেমে আসতে বিলম্ব হয়নি। বাইরে বর্ষণমুখর শ্রাবণ তামসী কী এক নৈঃশব্দ্যের কুজ্ঝটিকা সৃষ্টি করেছে। দত্ত-বাড়ির ঘরে-ঘরে সকলে পরম আয়েশে ঘুমোচ্ছে। এমনকী তেতলার বারান্দার এক কোণে গুটিশুটি হয়ে ঘুমে অচৈতন্য হয়েছে অরিন্দমের শখের কুকুর বিউটি পর্যন্ত। হঠাৎ, একান্ত আকস্মিকভাবেই সেই সতেরোই শ্রাবণ বর্ষণ-ঘন তামসীর মধ্য-প্রহরে সমস্ত বাড়িটাকে সচকিত করে ফেটে পড়ল ভয়াবহ তীব্র আর্তনাদ। সে-আর্তনাদে ঘরে-ঘরে ছড়িয়ে পড়ল ভয়ঙ্কর ত্রাস। হুটোপুটি, ঝুটপাট অন্ধকারের মধ্যে। তারপর সঙ্গে-সঙ্গেই টুকটাক আলো জ্বলে উঠল সমস্ত ঘরে।

মুহূর্তের মধ্যে সকলে জড়ো হল বারান্দায়। এ-ওর দিকে তাকাল। এই মধ্যরাত্রে অমন করে আর্তনাদ করে উঠল কে? সহসা সকলে ছুটে এল। একসঙ্গে দুপদাপ দরজায় ঘন-ঘন করাঘাত। একসঙ্গে।

উমাসুন্দরী হঠাৎ কেঁদে ফেললেন, বললেন, এ আমার কী হল? ও নন্দ, নন্দ। দরজা ভাঙ বাবা, ভেঙে ফেল।—বলেও যেন স্বস্তি পাচ্ছেন না উমাসুন্দরী। দরজায় ঘন-ঘন করাঘাত করছেন, চিৎকার করে বলছেন, অরু, অরু, দরজা খোল বাবা। কী হল রে তোর?

 ভেতর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। চুপচাপ। নিঃশব্দ। তারপর দরজায় কান পেতে একসময় উমাসুন্দরী হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠলেন : ওরে নন্দ, তোরা দরজা ভাঙ, অরু গোঙাচ্ছে।

রীতিমতো ভয়ের কারণ। কে জানে এমন মধ্যরাত্রিতে কোন আততায়ী কী করে বসেছে। খুন? জখম? হ্যাঁ, তাও হতে পারে। হতে পারে না এ-কথা বলা শক্ত। আর সেই কথা ভেবে উমাসুন্দরী ঠকঠক করে কাঁপছেন। কী একটা সংশয়ে রুদ্ধ-নিশ্বাসে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত দরজা ভেঙে যখন একসঙ্গে সকলে ঢুকল, দেখল, সোফার ওপর আধশোয়া হয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে অরিন্দম। এমনভাবে বসে রয়েছে যেন হঠাৎ দেখলে মনে হবে একটা নিষ্প্রাণ দেহ। কিন্তু না, নিষ্প্রাণ নয়। অরিন্দমের বুকের পাঁজরের তলায় ধুকপুক করছে হৃৎপিণ্ড। নিশ্বাস নিচ্ছে। নিচ্ছে খুব আস্তে। কিন্তু ওর চুলগুলোর ওপর দিয়ে এই কিছুক্ষণ আগে যেন ধুলোর ঝড় বয়ে গেছে। পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো অবিন্যস্ত। সেখানে একটা বিপর্যয়ের চিহ্ন। সারা দেহে ওর অবশ ক্লান্তি। সেই ক্লান্তিতে চোখ দুটো আধ-বোজা করে স্থাণুর মতো নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে রয়েছে। ঘরখানিও এলোমেলো। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড একটা টাইফুনে ছত্রখান হয়ে গেছে একটা জনপদ আর তার মধ্যে মূলোৎপাটিত পত্রবহুল বিটপীর মতো কাত হয়ে পড়ে রয়েছে অরিন্দম।

ঝড়ের বেগে ছুটে এসে উমাসুন্দরী জাপটে ধরলেন ছেলেকে। বার-দুই ঝাঁকি দিয়ে বললেন, কী, কী হয়েছে রে, অরু?

অরিন্দম নিরুত্তর।

সে-দিন বাকি রাত্রিটুকু আর শয্যায় ফিরে যায়নি কেউ। অরিন্দমকে নিয়ে নিদারুণ উৎকণ্ঠায় ঘুম দূরে থাক, একটু ঘুমের আমেজ পর্যন্ত আসেনি দু’চোখের পাতায়।

দ্বিতীয় দিনও ঠিক একই ব্যাপার। রাত্রির মধ্যপ্রহরে আবার সেই তীব্র আর্তনাদ। আবার দুপদাপ হইচই। তৃতীয় দিনে নন্দ আর উমাসুন্দরী অরিন্দমের ঘরে বিছানা করলেন। দেখা যাক, কী এমন হয়। দুজনেই অরিন্দমের মাথার কাছে বসেছিলেন। খানিকক্ষণ পরে একটু তন্দ্রার আবেশ দেখা গেল অরিন্দমের চোখে। চুপচাপ বসে-বসে দেখছিলেন মা-ছেলে দুজনে। কিন্তু এমনি আশ্চর্য যে, একই ঘরে তিনজন মানুষ থাকা সত্ত্বেও উমাসুন্দরী আর নন্দের মনে ছমছমে একটা ভয় নেমে এল। রুদ্ধ নিশ্বাসের প্রহর গুনতে লাগল ওরা সন্ত্রাসে।

সময় এগুচ্ছে যত, তত মা আর ছেলে মুখোমুখি তাকাচ্ছে। বাইরে ঝিমঝিম করছে নিথর কালো রাত্রি। সমস্ত এলাকাটা বরফ-শীতলতায় সুষুপ্ত। জানালার পরদা উড়িয়ে কয়েকবার ঝাপটা বাতাস এসে দেওয়ালে-দেওয়ালে আছড়ে পড়ল। আহত পাখির মতো ঝটপট করে ডানা ঝাপটাল ক্যালেন্ডারগুলো। ঘরের ঠিক মাঝখানে দড়িঝোলা বিজলি-বাতিটা দুলল। আর তারচেয়েও রহস্যজনকভাবে দুলতে লাগল, অতন্দ্র উৎকণ্ঠিত দুটি প্রাণীর ত্রাসায়িত মন। সেই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ভয়ে-ভয়ে ওরা তাকাল দেওয়ালের দিকে, জানালায় আর দড়িঝোলা বিজলি-বাতির দিকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে আবার সেই ভয়ঙ্কর আর্ত-চিৎকার। সমস্ত বাড়িটা কেঁপে উঠল। প্রাণপণ শক্তিতে লাফিয়ে উঠে এসে সোফার মধ্যে এলিয়ে পড়ল অরিন্দম। সদ্য জবাই-করা পাঁঠার মতো ছটফট করল খানিকক্ষণ। তারপর স্থির, পাষাণ।

পাঁচ দিনের মাথায়ও এ-রহস্যের কোনও নিশ্চিন্ত সমাধান খুঁজে পাওয়া গেল না। ওরা তো পারলই না তিনজন ডাক্তার পর্যন্ত হিমসিম। তাঁদের মতে এটা নিতান্তই ভয় থেকে উৎপত্তি। কিন্তু মধ্যরাত্রিতে অরিন্দমের হঠাৎ এই আর্তনাদের পশ্চাতে কোন রোগ, কোন রহস্য অথবা কোন ভৌতিক আত্মার কারসাজি দিন-দিন নিরঙ্কুশ ভীতি-প্রাবল্যে এমন করে ত্রাসায়িত করে তুলেছে সকলকে, তার কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ আবিষ্কার হল না। আর হল না বলেই এ-ঘরে কায়েমি হয়ে রাত্রিযাপন করতে হচ্ছে নন্দ আর উমাসুন্দরীকে। প্রায় প্রত্যেকটা রাত্রি সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ঝিমঝিম মধ্যরাত্রির বরফ-শীতল নৈঃশব্দ্যে সেই ঝলক-ঝলক ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। পরদা উড়ু-উড়ু জানালার। দড়িঝোলা বিজলি-বাতির দোদুল্যতা আর দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারগুলোর ঝটপটানির থরথর আশ্চর্য রহস্য। আর সেই মুহূর্তে সহসা অরিন্দমের তীব্র আর্তনাদ।

উমাসুন্দরী ভেবে পেলেন না, এমন সোনার ছেলে—তার কেন এ-পরিণতি! হ্যাঁ, বলতে গেলে অরিন্দম দত্ত সোনার টুকরো। ভয়ানক লাজুক স্বভাব। যতক্ষণ বাড়িতে থাকবে, ওই পড়ার ঘর আর বই-খাতা-কলম। ইউনিভার্সিটিতে অরিন্দম জুয়েল। চেহারায় রাজপুত্র। বয়স ছাব্বিশ। রঙ ফরসা। হৃষ্টপুষ্ট নাতিদীর্ঘ দেহ। কিন্তু আশ্চর্য শান্ত। সেই ছেলে এমন হবে, কে ভাবতে পারে সে-কথা?

প্রায় দিন দশেক পরে প্রথম কথা বলল অরিন্দম। এ-দশ দিনের মধ্যে তার কণ্ঠ থেকে কোনও একটা বাক্যাংশও কেউ শুনতে পায়নি। দুজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন থাকা সত্বেও নয়।

গভীর রাত্রির দ্বিতীয় যামে ঠিক তেমনি উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছিল নন্দ আর উমাসুন্দরী।

সহসা লাফিয়ে উঠল অরিন্দম। তীব্র আর্তনাদ করে উচ্চকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল : নিশ্বাস! নিশ্বাস! উঃ! আগুন!

নিশ্বাস! অবাক হয়ে মা-ছেলে মুখোমুখি তাকাল।

ডাক্তাররাও অবাক। নিতান্তই একটা রহস্যজাল ওই নিশ্বাস কথাটার মধ্যে। রোজ নিয়মিতভাবে রাত্রির মধ্যপ্রহরে ওই নিশ্বাসটা নির্দিষ্ট একজনের ওপর পড়বে। সামান্য সেই নিশ্বাসের জন্য এমন করে আর্তনাদ করে ওঠবার মূলে কোনও রহস্য থাকতে পারে কেউ ভেবে পেল না। তবে কি ভৌতিক অথবা প্রেতাত্মাজনিত কোনও ব্যাপার! না, তাও হতে পারে না। এই বিংশ শতাব্দীতে সেরকম কিছু সন্দেহ করাটা নিতান্ত মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রেতাত্মাজনিত কোনও কুসংস্কারে ডাক্তারদের বিশ্বাস নেই। তাহলে কী হতে পারে? কেউ বলল এটা ম্যানিয়া, কারও মতে নিউরোসিস, আর একজন বলল অ্যানিমিক রিয়্যাকশন অথবা মানসিক ব্যাধি। কিন্তু মেন্টাল আন-ইজিনেসটা কী থেকে আসতে পারে?

মাসতিনেক কাটল এইভাবে। এই তিন মাসে স্বাস্থ্য ভাঙল, চেহারা হল বিশীর্ণ আর সেইসঙ্গে চোখের ঘুমটুকু পর্যন্ত মুছে গেল। স্পষ্ট একটা কালিমা চোখের কোলে গাঢ় হতে লাগল দিনে-দিনে। কিন্তু অনেক রাত্রির বিনিময়েও সেই নিশ্বাসের ত্রাসটা কমল না অথবা কমবার কোনও সম্ভাবনাও দেখা গেল না।

ডক্টর পুরকায়স্থের ডায়েরি

আজ আমার নতুন রোগী অরিন্দম দত্তকে দেখলাম। প্রথমত, ওকে চেয়ারে বসিয়ে খুঁটিনাটি পরীক্ষা করলাম। পালসের বিটিংস উইক। অ্যানিমিক টেন্ডেন্সি। অতি সহজ কারণেই হার্টের প্যালপিটিশন হয়। অন্য সব নরমাল। একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি, যখনই যতবার আমি কাছে গিয়েছি, রোগী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছে আমার দিকে। খানিকটা বোকার মতো, খানিকটা আতঙ্ক ওর চোখের তারায়। যত আমি ওর চারপাশে ঘুরছিলাম, ভয়ে-ভয়ে চোখ ঘুরিয়ে তত তাকাচ্ছিল আমার দিকে। রোগীর অনুভূতি প্রবল। গা স্পর্শ করলে চমকে ওঠে। একেবারে কথা বলতে চায় না। অনেকগুলো প্রশ্ন একাধিকবার জিজ্ঞাসা করেও জবাব পাইনি। এবারে আমি মুখোমুখি বসে ওর চোখের দিকে তাকালাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কী?

রোগী চোখ তুলল না।

বললাম, তাকাও তো, তাকাও আমার চোখের দিকে। শুনছ? ওর কাঁধে হাত রাখলাম।

চমকে উঠল ও। ঠোঁট দুটো থরথর কাঁপছিল। চোখ দুটো ঘন কুঞ্চিত করে শিউরে উঠল চোখ!

—হ্যাঁ, তাকাও এদিকে।

ভয়ে-ভয়ে তাকাল ও।

—কষ্ট হয় কোথাও?

আবার সেই আতঙ্ক।

ইশারা করে বললাম, কষ্ট, ব্যথা?

মাথা নেড়ে সায় জানাল রোগী।

—কোথায়?

রোগী নিরুত্তর।

……তিনদিন ধরে পরীক্ষা করে, লক্ষণ, দু-একটি কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে রোগটা মানসিক। অভিভাবকদের রিপোর্ট থেকে জানলাম, শ্রাবণ মাসের কোনও এক রাত্রে হঠাৎ র্আতনাদ করে ওঠে রোগী। তার কয়েকদিন পরে একটা কথাই শুধু বলেছিল। বলেছিল—”নিশ্বাস, নিশ্বাস, উঃ! আগুন।” তারপর থেকে প্রায় রোজই এক ব্যাপার। সেই নিশ্বাস। আগেকার ডাক্তারদের মতে রোগী নিশ্বাসজনিত কোনও একটা ঘটনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ অথবা ভৌতিক ব্যাপারে ভয় পেয়ে থাকবে। কিন্তু যতদূর জানতে পেরেছি ভৌতিক ব্যাপারে রোগীর কোনও আস্থা নেই বা ছিল না।

…..আজ সাতদিন। কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হয়েছে আমাকে। ওর খাতাপত্র ও অন্যান্য ছুটছাট কিছু লেখা কাগজ। ওগুলো সংগ্রহ করেছি এইজন্যই যে, ওগুলো থেকে যদি কিছু সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। কাগজপত্রগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করেও বিশেষ কোনও ইঙ্গিত সুস্পষ্টভাবে আবিষ্কার করা দুরূহ। অনেকগুলো কাগজে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে আনমাইন্ডফুলি দু-একটা করে কথা লেখা রয়েছে। এক জায়গায় খাতার কোণে লিখেছে, ‘তা হলে তাই হোক।’ অন্য এক জায়গায় ‘ভুলব না’। তারপর একের পর এক কথাগুলো যথাক্রমে—’সু—’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘একুশে’, ‘দু-দিন’, ‘শান্তি হোটেল’, ‘ভালো লাগে না’, ‘বুধবার’, ‘দুই’, ‘ডাকগাড়ি’, ‘আনন্দ’, ‘মন’ ইত্যাদি।

….কেসটা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি। ডক্টর গুপ্তকে সব বললাম, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করলাম কেসটা নিয়ে। ডক্টর গুপ্তের মতে রোগীকে মেসমেরিজম করে, ডিলিরিয়াম থেকে যদি কিছু পাওয়া যায়।

মেসমেরিজমের পর ডিলিরিয়ামের নোট

…বিকেল! হ্যাঁ, বিকেলের মতো লাগছে। আকাশটা ফ্যাকাশে…ছাদ! তারপর আকাশ! আকাশ হলদে…কিন্তু মেঘ কই? আকাশ আর মেঘ এক হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য! ক্রিসানথিমামের ঝাড়টা কেমন? কষ্ট হচ্ছে আমার, তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ নাচছে—তাকাতে পারছি না। না না, পারব না…ভয় করছে। রডোডেনড্রনে উৎকট ওটা কী!…নড়ছে। সাদা হলদে হয়ে গেল…নীল-সবুজ,…হ্যাঁ লাল-কমলা। পাখি! হ্যাঁ, পাখা ঝাপটায়…তাকায়, কটমট করে তাকায়। ভয় করে—পাখির মানুষ-মুখ! পাখি-মানুষ! মাথা ঘুরছে। মারবে, পাখি কাঁদে! জ্বালা, এইখানে জ্বালা—উঃ! আগুন, আগুন!’

ডক্টর নলিনাক্ষ পুরকায়স্থ ইঙ্গিত করলেন। নার্স এগিয়ে এল। কলম তুলে নার্সের কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে বললেন, টেক অ্যাওয়ে দি লাইট শেড! নার্স শেডটা সরাল রোগীর মুখের ওপরকার আলো থেকে। সরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ডক্টর পুরকায়স্থ কলম নিয়ে আবার ব্যস্ত হলেন।

‘দিন! বিকেলের পর দিন! কিন্তু! না না, দিনের পর—উঃ! জ্বালা। আগুন। ধরো ধরো, মা আমাকে ধরো।’ একটু অনুচ্চ চিৎকারের পর স্তব্ধ হয়ে গেল রোগী।

ডক্টর চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। শুধু স্টকিংস পরা পা দুটো টিপে-টিপে রোগীর শিয়রের কাছে এসে দাঁড়ালেন। স্পর্শ না করে কিছুক্ষণ দেখলেন, রোগীর চোখ দুটো বিস্ফারিত প্রায়। কপালের ওপর তিন-চারটি ভাঁজ স্পষ্ট। চোখের তারা স্থির।

আবার এসে নিজের চেয়ারে বসলেন ডাক্তার। বসে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করলেন।

টুক করে আলো নিভিয়ে দিল নার্স। একরাশ অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত থিয়েটারে। শুধু শেড দেওয়া টেবিল-ল্যাম্পের এক চিলতে আলোর রশ্মি ডাক্তারের ছোট্ট টেবিলে। রোগীর বেড থেকে অনেক নিচু টেবিল, আর ঠিক মাথার কাছ-বরাবর রাখা। অন্ধকারের মধ্যে দু’পাশের দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো কাচের সুদৃশ্য আলমারির মধ্যে ঝকঝক করছে পালিশ করা স্টিলের দ্যুতি। অনেক রকমের ইনস্ট্রুমেন্টের ঝকমকানি। মাথায় ওপরে দুশো পাওয়ার বালবে সাদা শেডটা অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। বেডের ওপর বুক পর্যন্ত সাদা চাদরে আবৃত রোগী মৃত মানুষের মতো পড়ে আছে। মাথার কাছে ডাক্তারের আদেশের অপেক্ষায় স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে নার্স। ওর সমস্ত পরিচ্ছদ সাদা। অন্ধকারের মধ্যে নিঝুম একটা ভৌতিক ভাব।

কয়েকটা মুহূর্তের পর পা টিপে আস্তে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে নার্স বলল, হি ইজ শেকিং।

কয়েকটা মুহূর্ত ব্যবধান।

‘উঃ! মাথা ঘুরছে। জল…না না, জল নয়। গলা বুজে আসছে—হলদে জল! হলদে—না না, কান্না, জলে কান্না—। ভুল।’

আবার খানিকক্ষণ স্তব্ধ।

‘রাত! না না, যাব না…ভুল। আমার শেষ—যাক। ব্যথা—। ঘুম আসে না। ভয়। আসবে—হ্যাঁ, আসবে, আসছে—জল—কান্না—উঃ! আগুন! জ্বলে গেল, নিশ্বাস, নিশ্বাস—মা—!’

টুক করে টেবিলে কলম ঠুকে শব্দ করলেন ডক্টর পুরকায়স্থ। মাথার ওপরের দুশো পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠল। ঝলমল করে উঠল সমস্ত থিয়েটার। রোগী নিস্তব্ধ।

ডিলিরিয়ামের নোটস আর অরিন্দমের টুকরো-টুকরো কথাগুলো পাশাপাশি রেখে অনেক ভাবলাম। একটা সূত্র আমার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পেশেন্ট ইজ মেন্টালি শকড বাই সাম পার্সন। কিন্তু একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। মেন্টাল শক-এর সঙ্গে নিশ্বাসের যোগসূত্রটা কোথায়!

….পরপর কয়েকটা রাত্রি রোগীর সঙ্গে একই ঘরে কাটালাম। আজকাল ভয়ঙ্করভাবে আর্তনাদ করে না, কিন্তু সেটা ওর দুর্বলতার জন্যে। ও পারে না। রোগী এতদিন এত বয়স পর্যন্ত এমন শাসনে ছিল বা পরিবারের খ্যাতির জন্যেই কোথাও বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। দৈহিক ক্ষুধা আমার রোগীর মধ্যে আগে ছিল অধিক পরিমাণে। কিন্তু কোনও স্কোপ না পেয়ে, অথবা শাসনের ভয়ে অগ্রসর হতে সাহস করেনি। আমার মনে হয় নারীঘটিত কোনও ব্যাপারে মানসিক আঘাত পেয়ে রোগীর এ-অবস্থা। আমার মনে হচ্ছে, আমি অন্তত পঞ্চাশ পারসেন্ট ওর রোগটা ধরতে পেরেছি।

….অরিন্দম দত্তের একখানা ডায়েরি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। আর ওর রুমের বাক্স-পেঁটরা হাতিয়ে একখানা মাত্র চিঠি পেয়েছি। ডায়েরিটা আগাগোড়া আমি পড়লাম, এ থেকে তিন দিনের লেখা আমাকে সাহায্য করবে বলে। তিনটি তারিখের লেখা তুলে নিলাম আমি।

২০ জুলাই : আমার কেমন ভয়-ভয় করছে। কী এক অজানিত আশঙ্কায় থেকে-থেকে নিজেই নিস্পৃহ হয়ে পড়ছি আমি। কিন্তু উপায় নেই। এ যদি না হয়, তা হলে আমার সমস্ত জীবনের স্বপ্ন ব্যর্থ হবে। আর সে-ব্যর্থতার নিদারুণ জ্বালা নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না। কী করে বাঁচব যদি না পাই সেই আকাঙ্ক্ষিতাকে। এতদিন যে ভয় করতাম শাসনের, তাকাতাম আমাদের বংশ-গৌরবের দিকে, আজ যদিও সে-জন্য একটু আধটু ভয় করছে আমার, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি এসব কিছুই নয়। আমার জীবনের মুখ্য যদি কিছু থেকে থাকে, সে আমার ফুটবার অপেক্ষা, আমার আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করা। আর তার জন্য আমি অনায়াসে সব ফেলে দিতে পারব। হ্যাঁ, আমাকে সুখী হতে হবে। কয়েকটা বৎসর ধরে যে-জ্বালা শুধু শাসন আর বংশ-গৌরবের দিকে তাকিয়ে পুষে-পুষে মরছি, অবশেষে সেই জ্বালা ফুলের মতো হাসবে সে কি কম আনন্দ! আমার অনেক কথা মনে হচ্ছে, আর মাত্র একটা দিনের ব্যবধান। সত্যি, যতবার ভাবছি তত আনন্দে ভরে উঠছে আমার মন।

২৬ : জুলাই না না না, এ হতে পারে না। কিছুতেই নয়। কী কথা ছিল আর কী হয়ে গেল! এমনই করবার যদি ইচ্ছা ছিল ওর তবে কেন এ-প্রবঞ্চনা? কী ক্ষতি করেছিলাম আমি ওর? আর এতই যদি মনে ছিল তবে শেষ প্রতিশ্রুতিরও কোনও কারণ নেই। এখন বুঝতে পারছি সবটাই প্রবঞ্চনা। কিন্তু আমি বাঁচব কেমন করে, কী নিয়ে! মনে হচ্ছে, আমার সমস্ত বুকটাই বুঝি ভেঙে যাবে। আমার কেমন করছে যেন। আমি মরব। কিন্তু….এ-সৌজন্যের কী দরকার? চিঠি আমি চাইনি।

১৩ মে : আজ দু’দিন। কিন্তু কেন আসছে না? কিছুই ভালো লাগছে না আমার। সময়-সময় আমার মনে হয়, ওকে ছাড়া কিছুতেই বাঁচব না আমি। একদণ্ড বেঁচে থাকতে পারব না। তবে কি যাব? কিন্তু বড় লজ্জা করে। কেমন একটা মোহ আমাকে পাগল করে তুলছে। ফুলের কলি যেমন প্রস্ফুটিত হয়ে সার্থক হয়, তেমনি মানুষও সার্থক হতে চায় জীবনে। আমিও তাই চাই। ওকে পেলে আমিও ফুটব।

…পুরো কয়েকটা দিন ভয়ানক পরিশ্রম গেছে আমার। কাগজপত্র, ডায়েরি এবং চিঠি থেকে কেসটা অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। যতদূর মনে হচ্ছে, প্রেমঘটিত কোনও কারণে পেশেন্ট শকড। কিন্তু এতে নিশ্বাস-সম্বন্ধীয় কোনও ইঙ্গিত পাচ্ছি না আমি। যে-চিঠিটা আমি উদ্ধার করেছি, সেটা একটি মেয়ের চিঠি। চিঠিটা লোক-মারফত পাঠিয়েছে সে অরিন্দমের কাছে। তাতে লেখা আছে :

কলিকাতা-২৬

অরু,

আমার জীবনের সব কিছু তছনছ হয়ে গেল। তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না, কিন্তু সত্যিই আমার মনের কথা বলছি তোমাকে—এ আমি চাইনি। কিন্তু আমরা যে কত অসহায়, তা তুমি বুঝবে না। প্রতিশ্রুতি ভেঙে গেল মা-বাবার জন্যে। হল না—কিছুই হল না আমাদের। কিন্তু আর আশ্বাস দিয়ে লাভ নেই। তুমি ভুলে যেয়ো—হ্যাঁ, ভুলো। আমিও তাই চাই।

ইতি—

সু

চিঠি পড়ে অরিন্দমের ডায়েরিটা খুললাম। অনেক আগেই ওটা লক্ষ করেছি আমি। ডায়েরির একেবারে এক কোণে যত ছোট সম্ভব সেইরকমভাবে অস্পষ্ট একটা ঠিকানা লেখা ছিল। খুলে দেখলাম, সেটাও কলিকাতা-২৬। গোয়েন্দাগিরি করতে হয়েছে আমাকে। আমি গিয়েছিলাম সেই ঠিকানায়। গৃহকর্তার সঙ্গে অনেক বাক্যালাপের পরে জানলাম তাঁর কন্যার নাম সুমনা। ওঁরা ব্রাহ্মণ। সান্যাল। এবং বিয়ে হয়েছে তেইশে জুলাই তারিখে।

অনেক রকম কথা বলে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করলাম—বললাম, আপনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন। যদি সম্ভব হয় আমার চেম্বারে একদিন আসুন। আমিই অরিন্দমের কেসটা হাতে নিয়েছি।

শুনেই চমকে উঠলেন। একটু অস্থিরও। বললেন, হ্যাঁ, যাব। কাল দুপুরেই যাব আপনার ওখানে।

….বেলা আড়াইটার সময়ে সুমনা দেবী এলেন। একা নয়—সঙ্গে আর-একটি মেয়ে। সম্ভবত মেয়েটি সুমনা দেবীর বোন। এসেই বললেন, সময় বেশি দিতে পারবেন না তিনি। সিনেমা দেখার নাম করে এসেছেন। আমি বললাম, দু-ঘণ্টা সময় পেলেই আমার যথেষ্ট। কিন্তু আপনাকে এ-পাশের রুমে আসতে হবে।

—কেন?

—সব কথা বলতে পারবেন, এঁর সামনে?—মেয়েটিকে দেখিয়ে বললাম আমি।

কেমন লজ্জা পেলেন সুমনা দেবী—বললেন, চলুন—ও-ঘরেই চলুন।

প্রথমে চিঠিটা আমি ওঁর হাতে দিলাম। বললাম, এটা চিনতে পারেন?

একবার চমকে উঠলেন। তারপর মুখটা নিচু করে বললেন, হ্যাঁ, এটা আমিই লিখেছিলাম অরুকে।

বললাম, তার বর্তমান অবস্থা জানেন?

—শুনেছি।

সুমনার কথা

সুমনা সান্যাল আকাশ থেকে পড়ল সেদিন। হ্যাঁ, খবরটা মা দিলেন। কথাবার্তা চলছিল, বিয়ের তারিখও পাকাপাকি। আপত্তি জানাল সুমনা। অনুরোধ করল মাকে কয়েকটা দিন পিছিয়ে দিতে। কিন্তু যে-বিয়ের তারিখ পর্যন্ত স্থির, তা পিছিয়ে দেওয়া কি অতই সোজা? যে ওর স্বামী হতে যাচ্ছে, সব দিক দিয়েই সে উপযুক্ত। পাটনা ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট। ব্যবসায়ী মানুষ। বিরাট ধনী লোক। কিন্তু জীবনের সেটাই মুখ্য কামনা বা আকাঙ্ক্ষা নয় সুমনার। মনকে প্রতারণা করে কে কবে খুশি হতে পেরেছে? সুমনার মন জুড়ে শুধু একজনই ধ্রুবতারার সম্ভাবনায় জ্বলজ্বল করছিল। সত্য হয়ে উঠতে চাইছিল। সে অরিন্দম। ভালো লাগা এবং ভালোবাসার প্রশ্ন সেখানে। সেখানে জাতি-ধর্মের কোনও পার্থক্যই নেই। আর সেই বিশ্বাসেই অরিন্দমকে জীবনের পরমপুরুষ ভাবতে দ্বিধা আসেনি মনে। হৃদয় যা চায়, তার চেয়ে বড় চাওয়া মানুষের জীবনে কী থাকতে পারে? তিন-তিনটি বৎসর ধরে প্রেমের অনাবিল স্রোতে ওরা দুজনে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। অনেক রোমাঞ্চ, অনেক মোহনীয়, রমণীয় মুহূর্ত কেটেছে একসঙ্গে। ও ভেবেছিল, অরিন্দম সত্য হবে ওর জীবনে। কিন্তু সত্যিই বিচলিত হয়ে পড়ল, যতই দিন এগোতে লাগল। দুজনেরই অনেক রাত্রির অতন্দ্র প্রহর কেটেছে। ঘুমোতে পারেনি। এখানে-ওখানে একসঙ্গে বেড়িয়েছে, আর সমাধানের পথ খুঁজে মরেছে।

কিন্তু আর নয়। আর বিলম্ব নয়। যা হোক, স্থির করতে হবে। উনিশে জুলাই ওরা এল আউটরামের জেটিতে। গঙ্গার তীরে সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘন হয়ে বসে রইল। দুজনের মনেই ঝড়ের দুর্বার তুফান তছনছ করে দিচ্ছিল। যেন এই মুহূর্তে ওরা অনেক শূন্যে ঝুলছে। নাগাল পাচ্ছে না কিছু আঁকড়ে ধরবার।

সুমনা বলল, যা হয় করো, অরু। আমি বাঁচতে চাই। আর সে বেঁচে থাকায় তুমি না থাকলে আমার সব অন্ধকার। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না আমি।

—কিন্তু—। কী যে বলবে, স্থির করে উঠতে পারছে না অরিন্দম। বলল, কিন্তু কী করব?

এই মুহূর্তে আকাশ-পৃথিবীতে বিরাট ফারাক রাখা চলবে না। খেইহারার মতো শূন্যে ঝোলাও চলবে না। আকাশ-পাতাল সব এক করতে হবে। তারপর স্থির হল, পালাবে ওরা। হ্যাঁ, পালিয়ে যাবে। প্রথমে সরাসরি মাদ্রাজ-মেলে ওয়ালটেয়ার। সেখানে শান্তি হোটেলে ক’দিন থাকবে। তারপর গন্তব্য স্থির করা যাবে।

মাঝখানে একটা দিনের ব্যবধান। ওরা স্থির করল, সঙ্গে কিছুই নেবে না। অরিন্দম কিছু মোটা টাকা নেবে। আর সুমনা তার অলঙ্কার ছাড়াও ধনী-বাবার তহবিল হাতিয়ে যা পারে নিয়ে সরে পড়বে। কলকাতা থেকে রাত্রিতে ট্যাক্সি করে ওরা পাড়ি দেবে বাগনানে। পরদিন মাদ্রাজ-মেল।

হ্যাঁ, একুশে জুলাই রাত্রিবেলায় দিন স্থির। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় শেষ সিনেমা-শো থেকে বেরিয়ে সুমনা চলে আসবে লেকে। সেখান থেকে ওর দুজনে একসঙ্গে রওনা হবে।

২১ জুলাই, রাত

রাত এগারোটা। হ্যাঁ, অরিন্দম এসেছে। কিন্তু কেন যেন এই দু’দিন থেকে মনটা ভয়ানক খারাপ লাগছে সুমনার। আশা-নিরাশা, বাস্তব-কল্পনার রৌদ্র-ছায়া খেলা করছে ওর মনে। ও নিজেই খেই হারিয়ে ফেলেছে। পালিয়ে যাবে এই যে কথাটা, তাই ভেবে বার-বার ও নিজে কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়ছে। সিনেমায় যায়নি সুমনা। বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণের অজুহাতে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে ও। কিন্তু ও রিক্ত। সামান্য কপর্দকও সঙ্গে নেই ওর। মনস্থির করে এসে দাঁড়িয়েছিল ও। যে দুটো জীবন অনায়াসে ফুল হয়ে ফুটতে পারে, সার্থক হতে পারে, আর তারই জন্য পালিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন আজ। কিন্তু কেন? পালিয়ে গেলে জীবনের সার্থকতা যতটা, তার চেয়েও ব্যর্থতার কলঙ্ক অনেক বড়—অনেক বেশি। আর পালিয়ে গিয়েই জীবনের স্থিরতা আসবে, তারও কোনও মানে নেই। এ যেন জেনেশুনে অগাধ সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে অক্ষমের আপ্রাণ প্রস্তুতি। নিজের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন যা বলে বলুক। কিন্তু অরিন্দমের পরিবার থেকে কথাটা যখন উঠবে, সকলেই বলবে, হ্যাঁ, সেই ডাইনিটাই ভুলিয়ে নিয়ে গেছে ছেলেকে। না-না, সে হতে দেবে না সুমনা। কলঙ্ক নিয়ে চাঁদ হওয়ার মূলে যত সার্থকতাই থাক, চাঁদে যে কলঙ্ক রয়েছে সে-কথাটা ঘুচবে না। কোনওদিন, কোনওকালে।

অরিন্দম বলল, চলো।

সুমনা নিরুত্তর।

—চটপট চলো।

সুমনা নির্বাক, স্থির।

—কী হল?

আস্তে করে সুমনা বলল, যাব না।—যেন কথা নয়, ওর একঝলক কান্না।

—মানে?—বিস্ময়ে প্রায় আঁতকে ওঠে অরিন্দম।

—হ্যাঁ। যে-জীবনে কোনওদিন স্বীকৃতি নেই, সে-জীবন না চাওয়াই ভালো, অরু।

—তবে?

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল সুমনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছল। তারপর খুব কাছে সরে এল। অরিন্দমের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদল অনেকক্ষণ। তারপর একসময়ে বলল, না-না, সে আমি পারব না অরু। আমি স্বীকৃতি চাই। তুমি আমার হবে, এই স্বীকৃতি চাই সকলের কাছ থেকে। আর যতদিন তা না পারো, সে যত সময়ই হোক, আমি বিয়ে করব না। কাউকে নয়। শুধু যেদিন তুমি সত্য হবে আমার জীবনে, সেদিন আমি হাসব। অরিন্দমের বুকে মুখ রেখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সুমনা বলল, আর তুমি? হ্যাঁ, তুমিও আমাকে কথা দাও।

স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল অরন্দিম। তার দু-চোখেও তখন অশ্রুর প্লাবন। একসময়ে ধরা গলায় সে বলল, দিলাম—তোমাকে কথা দিলাম সুমু।

ঠিক সেই অবস্থায় অনেকগুলো মুহূর্ত কাটল ওদের। সুমনার চোখের জলে অরিন্দমের জামার খানিকটা ভিজে গেছে। ঠান্ডা-ভেজা স্পর্শ লাগছে বুকে। ওর মাথায় চিবুক ঘষে বলল, কিন্তু কী করে থাকব সুমু?

জোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল সুমনা। যেন ওর হৃদয়ের যত উত্তাপ, ওর যত মনের আগুন সব নিঃশেষে বেরিয়ে এল। ভিজে জামার ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও সেই আগুনের স্পর্শ পেল অরিন্দম। মনে হল, ওর সমস্ত বক্ষদেশটাই যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

সুমনা চলে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল ডক্টর নলিনাক্ষ পুরকায়স্থ। হৃদয়-মনের সমস্ত যেন কী এক অভূতপূর্ব বেদনায় টনটন করছে। নিজের ডায়েরিটা তুলে নিয়ে অরিন্দম দত্তের সেই ছুটছাট কথাগুলো ডায়েরির যে-পাতায় নোট করেছিলেন, চোখের সম্মুখে তুলে ধরলেন সেই জায়গা। দেখলেন, সু—, রজনীগন্ধা, একুশে, দু-দিন, শান্তি হোটেল, ডাকগাড়ি, আনন্দ। সব যেন নক্ষত্রের দ্যুতির চেয়ে ভাস্বর। সব স্পষ্ট। স্পষ্টতম।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

জুন-জুলাই, ১৯৫৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *