নিশুতিপুর – প্রেমেন্দ্র মিত্র
নিশুতিপু—র! নি—শু—তি—পুর!
রাণু ধড়মড়িয়ে বাঙ্কের ওপর উঠে বসল। এইখানেই নামবার কথা না? সঙ্গে মালপত্র তো কিছু নেই! সুতরাং নেমে পড়লেই তো হয়। যেমনই মনে হওয়া, তেমনই বাঙ্ক থেকে কামরার মেঝেতে, আর কামরার মেঝে থেকে একেবারে প্ল্যাটফর্মে।
কী ঘুটঘুটে অন্ধকার রে বাবা! এমন অখদ্যে স্টেশন তো কখনো দেখিনি। ব্ল্যাক—আউট তো উঠে গেছে। স্টেশনে এখনও একটা আলো দিতে পারে না? দূরে যদি—বা একটা মিটমিটে আলো দেখা গেল, সেটা জ্বলে উঠেই আবার গেল নিভে।
এখন কী করা যায়? ট্রেনটাও ঠিক স্টেশনের মতোই অন্ধকার, দেখতে দেখতে সেটাও যেন অন্ধকার কুয়াশার সঙ্গে মিলিয়ে গেল।
কার সঙ্গে যেন রাণুর দেখা করবার কথা। কে যেন তাকে নিয়ে যেতে আসবে বলে কথা দিয়েছিল। কিন্তু কোথায় কে!
দূরে ওখানে ক—টা টিমটিমে আলোর জটলা দেখা যাচ্ছে না? ওদিকে এগিয়ে খবর নেওয়া ছাড়া আর উপায় কী! রাণু সেদিকেই পা বাড়াল দোনামনা হয়ে।
‘এই যে!’
রাণু থমকে দাঁড়াল। গলাটা সে যেন চেনে।
‘তোমাকেই খুঁজতে এসেছিলাম।’
রাণু অন্ধকারে একটা ঝাপসা চেহারা দেখতে পেয়ে বললে, ‘কিন্তু আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না!’
‘দাঁড়াও, আলোটা একটু জ্বালছি!’
মিটমিটে একটা ছোট্ট কুপির মতো আলো এবার জ্বলে উঠলে রাণু ছেলেটিকে দেখতে পেল। তার বয়সিই হবে। ছেলেটি লাজুকের মতো একটু হেসে বলল, ‘আমি তামসকুমার।’
‘তামসকুমার!’
রাণুর মনে হল, তামসকুমারেরই যেন তার জন্যে স্টেশনে আসবার কথা।
তামসকুমারের সঙ্গে পরিচয়ও যেন তার অনেক দিনের। শুধু এখন সব কথা মনে পড়ছে না।
আলোটা কিন্তু ইতিমধ্যে আবার নিভে গিয়েছে। আবার সেই গাঢ় অন্ধকার চারিদিকে। এ অন্ধকারে কতক্ষণ এমনই করে দাঁড়িয়ে থাকা যায়! কোথাও যাবার উপায়ও তো নেই। পথই তো চেনা যাবে না।
‘তোমার আলোটা আবার নিভে গেল নাকি?’ রাণু এবার জিজ্ঞেস করল।
‘না, নিভিয়ে দিলাম।’ বলল তামসকুমার।
‘নিভিয়ে দিলে!’ এ আবার কী অদ্ভুত কথা! শখ করে কেউ এই অন্ধকারে থাকে নাকি! রাণু একটু বিমূঢ় হয়েই বলল, ‘কেন, তেল নেই নাকি বাতিতে?’
‘তেল? না, তেল একেবারে নেই এমন নয়। তবে—’ তামসকুমারের কেমন যেন একটু কুণ্ঠিত ভাব।
‘তবে কী?’
‘কী তা তো তুমিও জানো ভাই।’ তামসকুমার একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল।
বলে কী তামসকুমার! রাণু তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।—অথচ—অথচ তার যেন বোঝা উচিত, মনের ভেতর এরকম একটা সন্দেহও হচ্ছে।
যাই হোক, বোকা বলে ধরা দিতে রাণু সহজে রাজি নয়। একটু ভারিক্কিভাবেই বলল, ‘তা কি আর জানি না, তবে একটু জ্বাললে দোষ কী? কেউ তো আর ধরে নিয়ে যাবে না!’
‘ধরে নিয়ে যাবে না! বলো কী! আর তা হলে ধরবে কীসে?’ তামসকুমার সবিস্ময়ে বলে উঠল।
না, মাথাটা একেবারে গুলিয়ে দিয়ে ছাড়লে! আলো জ্বাললে ধরে নিয়ে যায়—এ আবার কোন মগের মুল্লুক?
মনে যাই হোক, বাইরে নিজের চাল বজায় রাখবার জন্যে রাণু গম্ভীরভাবে বলল, ‘আহা, ঠাট্টা করছিলাম, বুঝতে পারছ না? তবে যদি আলোটা একটু জ্বালতে ভাই, একটু খুঁজে নিতাম।’
‘কিছু হারিয়েছে নাকি! কী খুঁজতে চাও?’ তামস উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘তেমন কিছু নয়, নিজের হাত—পাগুলো আছে কি না একটু খুঁজে দেখতাম।’
তামস একটু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, এত করে যখন বলছ তখন একটুখানি না হয় জ্বালছি। তবে বুঝতেই তো পারছ, যতখানি পারা যায়, তেল আজ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেই মুহূর্তটির জন্যে যার যত আলো সব দরকার।’
ও বাবা! ধাঁধা যে ক্রমশ আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে।—এ আবার কোন মুহূর্তের কথা বলে! যাই হোক, আলোটা তো জ্বলুক! অন্ধকারে বুদ্ধিটাও যেন কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে।
কিন্তু আলো জ্বালা আর হয়ে উঠল না। তামসকুমার দেশলাই না চকমকি—পাথর কী একটা ঠোকাবামাত্র অদূরেই লোহা—বাঁধানো জুতোর আওয়াজের সঙ্গে বাজখাঁই গলার হাঁক শোনা গেল—’কৌন হ্যায়। বত্তি জ্বালাতা কৌন?’
চোখের পলক পড়তে—না—পড়তে তামসকুমার সেই হাঁক শুনেই রাণুকে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে টেনে দৌড়।
হোঁচট খেয়ে হাত—পা ছড়ে অনেকদূর গিয়ে যখন সে থামল তখন দুজনেই বেশ হাঁফাচ্ছে।
‘আর একটু হলেই ধরে ফেলেছিল আর কী!’ তামস বলল।
চালাক সেজে থাকা বুঝি আর চলে না। তবু কায়দা করে ব্যাপারটা জানবার ফিকিরে রাণু একটু বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে বলল, ‘ধরে ফেলত! ধরে আর করত কী?’
‘ধরে আর কী করত!’ তামসকুমার সত্যি যেন স্তম্ভিত হয়ে বলল, ‘তুমি কি সব ভুলে গেছ নাকি? ধরলে জেলে পুরে দিত না! আমার কি আলোর লাইসেন্স আছে।’
‘আলোর লাইসেন্স?’ রাণুর মুখ দিয়ে আপনা থেকেই কথাটা বেরিয়ে গেল।
‘হ্যাঁ, আলোর লাইসেন্স নেবার মতো টাকা আমার কোথায়! এ তো আমার চোরাই আলো।’
রাণুর মুখ দিয়ে এবার আর কোনো কথা বেরোল না—সে সত্যি তাজ্জব বনে গেছে।
তামসকুমারই আবার বলল, ‘শুধু আজকের জন্যে, কত কষ্টে যে এই চোরাই আলো জোগাড় করেছি, কী বলব।’
‘কিন্তু আজকে—’ রাণু কথাটা ইচ্ছে করেই শেষ করল না। এখনও সে একেবারে ধরা দিতে প্রস্তুত নয়।
‘বাঃ, আজকেই তো শ্রাবণের অমাবস্যা—মহামহিমের অভিষেক তিথি তো আজই।’
‘ওঃ, তাও তো বটে! ভুলেই গেছলাম।’ নিজের মর্যাদা রাণু এখনও বাঁচাবার চেষ্টা করছে।
‘সেই কথাটাই ভুলে গেছলে? তাহলে এসেছ কী করতে?’ তামসকুমার বেশ যেন ক্ষুণ্ণ।
কী করতে এসেছে তা কী ছাই সে নিজেই জানে! কিন্তু এসে যখন পড়েছে ব্যাপারটা না বুঝে সে যাবে না। আপাতত কথাটা তাড়াতাড়ি চাপা দেবার জন্যে রাণু বলল, ‘আচ্ছা, আমারও তো চোরাই আলো একটা হলে হত। কোথায় এখন পাওয়া যায়, বল তো!’
তামস এবার উৎসাহিত হয়ে উঠল, ‘চোরাই আলো চাই? তা বলোনি কেন এতক্ষণ?’ চোরাই আলোর অনেক আড্ডা আছে। তবে পুঁথি—পাড়াতে যাওয়াই সবচেয়ে সুবিধে।’
‘কেন?’ রাণু সোজাসুজি এবার জিজ্ঞেস করে ফেলল।
‘ওদের আলো ভারি মজার। ফুঁ দিয়ে নেভে না, জলে ডোবালেও জেগে থাকে। আর লুকিয়ে নিয়ে বেড়াবার ভারী সুবিধে। চৌকিদাররা সহজেই চিনতে পারে না। তা ছাড়া ও আলোর কখনো ক্ষয় নেই। বিনা তেলেই যুগযুগান্ত জ্বলে। চল, ওই পাড়াতেই যাই।’ তামস রাণুর হাত ধরে এগিয়ে চলল।
দু—পাশে আবছা সব বাড়ি অমাবস্যার অন্ধকারে যেন বিভীষিকার মতো দাঁড়িয়ে আছে! কোনোটা একেবারে অন্ধকার, কোনোটার বদ্ধ জানালার ভেতর দিয়ে অতি ক্ষীণ একটু আলোর রেখা যেন ভয়ে ভয়ে উঁকি দিচ্ছে।
এই অন্ধকারের ভেতর রাস্তার একটা মোড় ঘুরে হঠাৎ দূরে এক প্রকাণ্ড উজ্জ্বল ঝলমলে বাড়ি দেখে রাণু একবারে অবাক হয়ে গেল।
‘ওটা কী?’
‘বাঃ, ওটাই তো জেলখানা। এতদিন যেখানে যে—কেউ বে—আইনি আলো জ্বেলেছে। সকলের হয়ে আলো জ্বালবার অধিকারের জন্যে যারা লড়াই করেছে, সবাই ওই জেলখানায় বন্দি। সারাবছর ওরা নীরবে সব সয়ে যায়, শুধু বছরে এই একটিবার ওরা বিদ্রোহ করে। ও তো ওদের বিদ্রোহেরই আলো! দেখতে পাচ্ছ না, এরই মধ্যে জমাদারেরা সব নিভিয়ে ফেলছে। ও আলোর দিকে চাওয়াও যে অপরাধ।’
সত্যি! দেখতে দেখতে সে আলো নিভে গেল। আবার সেই জমাট অন্ধকার।
পুঁথি—পাড়ার দিকে বেশিদূর কিন্তু আর তাদের যেতে হল না। রাস্তার ধারে হঠাৎ একটা আলো তারা কুড়িয়ে পেল।
তামসকুমার তার হাতে আলোটা তুলে দিতে রাণু অবাক হয়ে বলল, ‘এ আলো এখানে এমনভাবে পড়ে ছিল কী করে?’
‘হয়তো কেউ ধরা পড়ার ভয়ে ফেলে গেছে, কিংবা কেউ হয়তো আমাদের মতো কারও হাতে পড়বার আশাতেই এ আলো এখানে রেখে গেছে। নিজের জীবন দিয়ে কতজন এমন আলোর আয়োজন করে রেখে যায় ভবিষ্যতের জন্যে।’
তামসের কথা শেষ হতে—না—হতেই দূরে মাঝ রাতের প্রহর বাজছে শোনা গেল। যেখানে যা সামান্য আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল সব এবার একেবারে গেল নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে। সঙ্গে সঙ্গে কাছেই কোথায় অশরীরী কণ্ঠে না বেতারে, বজ্রগম্ভীর ঘোষণা শোনা গেল—’জয় তিমিরেশ্বরের জয়, যিনি আদি, যিনি অনন্ত, যিনি শাশ্বত, সেই তিমিরেশ্বরকে আমরা প্রণাম করি।’
‘হে আমার নিশুতিপুরের ভক্ত প্রজাবৃন্দ—’
রাণু ভয়ে ভয়ে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করল, ‘এ আবার কী ভাই?’
এই স্বর শুনেই তামসকুমার কীরকম যেন হয়ে গেছে।
কেমন যেন অভিভূতভাবে সে বলল, ‘চুপ চুপ! মহামহিমের আহ্বান—বুঝতে পারছ না।’
রাণু হতভম্ব হয়ে একেবারে নীরব হয়ে গেল। মহামহিম তখন বলে যাচ্ছেন—’আমার অভিষেক—তিথির এই সাংবাৎসরিক উৎসবে তিমিরেশ্বরের পদতলে দাঁড়িয়ে সেই কথাই আবার আমি তোমাদের জানাই—আলোক আমাদের পরম শত্রু, আমাদের জীবনের অভিশাপ। সমস্ত অমঙ্গল, সমস্ত অশান্তি, সমস্ত বিপ্লব বিপর্যয়ের মূল—এই আলো। যার চোখ একবার আলোর স্পর্শ পেয়েছে, সমস্ত জীবন তার অভিশপ্ত—দেহ—মন তার চিরদিনের মতো বিষাক্ত, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর আলোর তৃষ্ণায় জীবনে কোনোদিন সে আর শান্তি পায় না। আলোক—পিপাসার এই সংক্রামক ব্যাধি অন্যের মধ্যেও সে ছড়িয়ে দেয়।
আলোকের এই অমঙ্গল থেকে চিরদিন আমি তোমাদের রক্ষা করে এসেছি, চিরদিন রক্ষা করব। এখনও এদেশ সম্পূর্ণ নিরালোক করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু ভ্রান্ত, ধর্মভ্রষ্ট, সমাজদ্রোহী যে সমস্ত পাষণ্ড আলোকের মাদকতার দ্বারা ভুলিয়ে এই পরম শান্তি ও সুখের রাজ্যের ভিত্তি শিথিল করতে চায়, তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে কোনোদিন আমি ত্রুটি করিনি। আমাদের একমাত্র উপাস্য, তিমিরেশ্বরকে প্রণাম করে আবার আমি বলি, চির—স্নিগ্ধ, চিরমধুর, চির—কল্যাণময় অন্ধকার আমাদের আচ্ছাদিত করে রাখুক, এ রাজ্য থেকে সমস্ত আলো নির্বাপিত হয়ে যাক।’
‘জয়, তিমিরেশ্বরের জয়!’
‘জয়, তিমিরেশ্বরের জয়!’ বলে হঠাৎ তামসকুমারকে তার হাতের আলোটা ফেলে দিতে দেখে রাণু অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘ও কী করছ কী?’
তামসকুমার কাতরভাবে বলে উঠল, ‘না, না, আমি পাপী, আমি পাষণ্ড। হে তিমিরেশ্বর, আমার অপরাধ তুমি মার্জনা কর।’
তামসকুমার সেইখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর কী! তার ঘাড় ধরে বেশ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে রাণু বলল, ‘দেখতে পাচ্ছ, ওদিক দিয়ে কারা আসছে?’
‘কারা আসছে?’ তামস যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। অবাক হয়ে বলল, ‘সত্যিই তো, ওই তো বিদ্রোহী আলোর মিছিল চলেছে পাহাড়ের ওপর তিমিরেশ্বরের মন্দিরে। অন্ধকার যাঁর চিরদিনের আবরণ সেই আদর্শনীয় মহামহিমকে ওরা স্বচক্ষে দেখবে। নিজের মুখে তাঁকে জানাবে নিজেদের নিবেদন।’
ফেলে—দেওয়া আলোটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সে আবার বলল, ‘কিছু মনে কোর না ভাই, কিছুক্ষণ কেমন যেন বেহুঁশ হয়ে গেছলাম। মহামহিমের স্বর শুনলেই কেমন যেন আমার সমস্ত দেহমন অবশ হয়ে যায়। কিন্তু আর ভয় নেই—এই মিছিলে যোগ দিতেই তো আমরা এসেছি, চল!’
তারা কয়েক পা যেতে—না—যেতেই কিন্তু চারিদিকে ভয়ংকর কাণ্ড বেধে গেল। কোথা থেকে যমদূতের মতো বিশাল মিশমিশে কালো সব প্রহরী এসে আলোর মিছিলের ওপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল সব দল। একে একে সবাই বুঝি বন্দি হয়ে যাচ্ছে, সমস্ত আলো যাচ্ছে নিভে।
রাণুর শরীরের ভেতর দিয়ে যেন একটা আগুনের শিখা লাফ দিয়ে উঠল। মিছিলের একজনের হাত থেকে একটা জ্বলন্ত মশাল তুলে নিয়ে তামসকে টানতে টানতে ঝড়ের বেগে সে সমস্ত প্রহরীদের এড়িয়ে একেবারে সেই তিমিরেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে থামল।
মন্দিরের দরজা বন্ধ। কিন্তু রাণুর আর তামসকুমারের গায়ে এখন যেন শত হস্তীর বল। দুজনের ধাক্কায় মন্দিরের দরজা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। মশাল হাতে মন্দিরের ভেতর ঢুকে পড়ে এদিক—ওদিক চারিদিকে ব্যাকুল চোখ বুলিয়ে তারা অবাক। কোথায় বা তিমিরেশ্বরের মূর্তি, কোথায় বা মহামহিম! তাদের কোনো চিহ্নই নেই। শুধু কয়েকটা ধেড়ে ইঁদুর আলো দেখে সভয়ে চারিদিকে দুড়—দাড় করে ছুটে পালাল।
হঠাৎ একদিকে চোখ পড়তে তারা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। আমসির মতো শুকনো আর কোলা ব্যাঙের মতো ধুমসো গুটি পাঁচেক লোক একদিকে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে কাঁপছে। তাদের কারও কাছে মুখে দিয়ে চেঁচাবার চোং, কারও হাতে পুজোর ঘণ্টা, কারও বা বাটখারা, কারও বা গায়ে শ্যামলা, কারও মাথায় ঝলমলে জরির পাগড়ি। রাণু আর তামসকে এগিয়ে আসতে দেখে তারা কাঁপতে কাঁপতে চাদর সরিয়ে বেরিয়ে এসে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, ‘দোহাই বাবা, আমাদের প্রাণে মেরো না, তোমরা যত খুশি আলো জ্বাল, আর আমরা কিছু বলব না। যত তেল লাগে কেনা দামে তোমাদের দেব!’
‘ও, তোমরাই তা হলে এতদিন ফাঁকি দিয়ে আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে এসেছ! আচ্ছা, দাঁড়াও!’
কিন্তু সে কিছু করবার আগেই যমদূতের মতো সেই সব প্রহরীরা মন্দিরের ভেতর ঢুকে পড়ে তাদের জাপটে ধরল। একজন রাণুর হাত থেকে মশালটা কেড়ে নিয়ে মন্দিরের জানলা দিয়ে নীচে ছুড়ে ফেলে দিল। অন্যেরা তখন পিছমোড়া করে তাদের বাঁধছে।
রাণু প্রাণপণে তাদের হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে উঠল, ‘বুজরুকি, তোমাদের সব বুজরুকি আমি ফাঁস করে দেব।’
হঠাৎ নীচে থেকে তাকে নাড়া দিয়ে মামাবাবু বললেন, ‘আরে পড়ে যাবি যে! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কার সঙ্গে কুস্তি করছিস?’
রাণু ধড়মড় করে ওপরের বাঙ্কে উঠে বসল। আরে—কোথায় নিশুতিপুর, কোথায় তিমিরেশ্বর, আর কোথায় মহামহিম! সে তো মামাবাবুর সঙ্গে ট্রেনে মধুপুর যাচ্ছে।
কিন্তু নীচে ডানদিকের বেঞ্চিতে ওই চিমসে রোগা আর ধুমসো মোটা লোক দুটিকে চেনা—চেনা লাগছে না!
তিমিরেশ্বরের মন্দিরে এদেরই দেখেছিল না কি?