1 of 2

নিশীথ দাসের ভেলকি – বাণীব্রত চক্রবর্তী

নিশীথ দাসের ভেলকি – বাণীব্রত চক্রবর্তী

রজনীবাবুর কাছে কেউ দেখা করতে এলে সকালের দিকে আসেন। এমনকী কিংকরবাবুও। হয়তো দু—একবার তিনি বিকালের দিকে এসেছেন। কিন্তু রাত এগারোটার সময় কে এল!

হরি গেটে তালা দিয়ে এসেছে। এখন খেতে বসবে। রজনীবাবুর খাওয়া হয়ে গেছে। নিজের ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। রজনীবাবু অবাক। এমন অসময়ে আবার কে এল!

সিগারেট শেষ করে লেখার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসতে হবে। কিংকর বর্মন একদিন দু—দিন অন্তর ফোন করেন। রজনীবাবুর খোঁজখবর নেন। দু—হপ্তা আগে এক রবিবারের সকালে এসেও ছিলেন। আসল ব্যাপার হল আর পাঁচ মাস বাদে পুজো। পুজোয় অমানিশা পত্রিকায় রজনীবাবুর গল্প চাই।

কোনো অলৌকিক অভিজ্ঞতা না হলে রজনীবাবু গল্প লিখতে পারেন না। তিনি ভূতের গল্প ছাড়া অন্য কোনো গল্প লেখেন না। ‘অমানিশা’য় কেবল ভূতের গল্প ছাপা হয়। সম্পাদক কিংকরবাবু আভাসে—ইঙ্গিতে জানার চেষ্টা করছেন রজনীবাবুর এর মধ্যে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা হল কি না। বিগত দু—দিন কিংকরবাবু ফোন করেননি।

আবার ডোরবেল বেজে উঠল। হরি আজকাল কানে কম শোনে। হয়তো এখন খেতে বসেছে। রজনীবাবু নিজেই চললেন সদর দরজা খুলতে।

রান্নাঘরের সামনে বসে হরি খাচ্ছে। পেছন ফিরে বসেছে বলে রজনীবাবুকে দেখতে পেল না। গোরুর নাকের মতো রবারের চটি রজনীবাবুর পায়ে। চলাফেরার সময় মৃদু ফটফট শব্দ হয়। সে—শব্দ হরির কানে গেল না।

রজনীবাবু সিঁড়ির আলো জ্বাললেন। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজা। দরজায় খিল লাগানো। তারপর কোলাপসিবল গেট। গেটে তালা লাগানো।

সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে মনে পড়ল গেটের তালার চাবিটা আনতে ভুলে গেছেন। এখান থেকে হাঁক পেড়ে হরিকে ডাকলে সে শুনতে পাবে না।

চাবি থাক। আগে দরজা খুলে দেখা যাক আগন্তুকটি কে! সদর দরজার খিল খুলে চমকে উঠলেন, ‘একী! কিংকরবাবু আপনি! এত রাতে!’ কিংকরবাবু রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘তালাটা খুলুন। আপনার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে।’

রজনীবাবুর মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে উঠল, ‘না, না। এখন কোনো কথাটথা হবে না। আপনি বরং কাল সকালের দিকে আসবেন।

সদর দরজায় খিল দিয়ে রজনীবাবু ভাবলেন কাজটা তিনি ঠিক করেননি। পঞ্চাশ বছরের পুরোনো বন্ধুর মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। অথচ দরজাটা খোলার ইচ্ছেও নেই। রজনীবাবু হঠাৎ এইরকম রেগে যান। তার ওপর তিনি অত্যন্ত জেদি।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনলেন ল্যান্ড ফোনটা বাজছে। বার দুই বাজার পর হরির গলা শুনতে পেলেন। সে হ্যালো হ্যালো করছে।

হরির হাতে ফোনের রিসিভার। রজনীবাবুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে সে অবাক হয়েছে।

রজনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে ফোন করছে।’ হরি বলল, ‘আজ্ঞে কিংকরবাবু।’ রজনীবাবুর মোবাইল ফোন বন্ধ আছে। তার মানে কিংকরবাবু এখনও চলে যাননি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁর মোবাইল থেকে ফোন করছেন। মাথাটা আবার গরম হয়ে উঠছে। রিসিভারটা নিয়ে বললেন, ‘এখনও আপনি আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন!’ ওদিকে কিংকরবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘আমি কেন এত রাতে আপনার বাড়ির সামনে যাব। বরং এত রাতে আপনিই তো আমার বাড়িতে এসে ডোরবেল পুশ করেছিলেন।’ হাতে ফোনের রিসিভার ধরিয়ে হরি চলে গেছে। রজনীবাবু অবাক। অদ্ভুত গোলমেলে ব্যাপার তো।

রজনীবাবু বললেন, ‘আমি যে স্পষ্ট আপনাকে দেখলাম। ডোরবেল শুনে নীচে নেমে গিয়েছিলাম। সদর দরজা খুলে দেখি আপনি। বললেন, কোলাপসিবল গেটের তালাটা খুলুন। আপনার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে। কিন্তু গেট খুলিনি। কাল সকালে আপনাকে আসতে বলে ওপরে উঠে আপনার ফোন রিসিভ করছি।’ সঙ্গে সঙ্গে কিংকরবাবু বললেন, ‘আমিও যে আপনাকে স্পষ্ট দেখেছি। দরজা খুলে দেখলাম, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আপনারে ঠোঁটে মুচকি হাসি। বললাম, ভিতরে আসুন। কোনো উত্তর দিলেন না। অদূরে একটা ফাঁকা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। আপনি সেই ট্যাক্সিটার দিকে এগিয়ে গেলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এ কী! আপনি চলে যাচ্ছেন কেন! উত্তর দিলেন না। ওই ট্যাক্সিটায় উঠে হু…স করে চলে গেলেন। তারপর আধঘণ্টা অপেক্ষা করে আপনাকে ফোন করছি।’

দুই

মাথার চুলগুলি যেন পুড়ে ঝলসে গেছে। মুখে বসন্তের দাগ। গায়ে শতচ্ছিন্ন কালো কোট। এখন শীতকাল নয়। তবুও। পরনে ময়লা পাজামা। বয়স বোঝা মুশকিল। ষাট হতে পারে আবার সত্তরও হতে পারে। সদর দরজা খোলা পেয়ে লোকটা রজনীবাবুর ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। তিনি লোকটাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘরে ঢুকেই লোকটা এমন একটা ভেলকি দেখিয়ে দিল যাতে রজনীবাবু অবাক হয়ে গেলেন। হরি নেই। সদর খোলা রেখে বাজারে গেছে।

লোকটা কোটের পকেট থেকে একজোড়া সাদা ইঁদুর মেঝেতে ছেড়ে দিয়ে হাতে তালি দিল। কোথায় ইঁদুর! এ তো দেখা যাচ্ছে একজোড়া সাদা পায়রা। পায়রা দুটো ডানা ঝটপট করে জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে উড়ে গেল। লোকটা হা হা করে হাসতে লাগল। লোকটার তিনটে দাঁত কুচকুচে কালো। পায়ে কোনো জুতো নেই। রজনীবাবু চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। টেবিলের ওপর সিগারেটের প্যাকেট। দেশলাই। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। স্তম্ভিত অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আপনি!’ লোকটা হাসতে হাসতে বলল, ‘ধরে নিন মানে! আপনার আর কোনো নাম আছে নাকি!’ লোকটা বলল, ‘আমার নাম নিশীথ দাস। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় অমাগ্রামে থাকি। ভেলকিবাজি দেখাই।’ ডানা ঝটপট করতে করতে পায়রা দুটো আবার ফিরে এল। এখনও বিকেলের আলো আছে। তবে খুব ফিকে। পায়রা দুটো একজোড়া সাদা ইঁদুর হয়ে গেল। নিশীথ দাস ইঁদুর দুটোকে কোটের পকেটে পুরল।

রজনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কীজন্যে এসেছেন!’

নিশীথ দাস বলল, ‘আপনাকে আমার ভেলকি দেখাতে।’ রজনীবাবু বললেন, ‘ভালো ভেলকি জানেন দেখছি। একশো টাকা দিচ্ছি।’ নিশীথ দাস খি খি করে হাসল, ‘দুশো দিন। অনেক দূর থেকে আসছি। বড়ো গরিব আমি। সংসারও বড়ো।’

রজনীবাবু চেয়ার থেকে উঠে ওঘরে টাকা আনতে গেলেন। এসে দেখেন লোকটা নেই। তাঁর চেয়ারে কিংকরবাবু বসে আছেন।

রজনীবাবু চেয়েছিলেন আজ সকালেই যেন কিংকরবাবু তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। কাল রাতে যা ঘটে গেল তা বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কিংকরবাবু বলেছিলেন, ‘সকালে হবে না। আমার ভায়রাভাই মুরারিমোহনের একটা অপারেশন আছে। সন্ধেবেলায় আসব।’

রজনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘সরাসরি নার্সিং হোম থেকে আসছেন বুঝি।’ কিংকরবাবু বললেন, ‘গিন্নিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে আসছি। দাঁড়ান, একবার বাথরুম থেকে ঘুরে আসছি।’ কিংকরবাবু বাথরুমে গেলেন।

চেয়ার দুটো। একটাতে রজনীবাবু বসলেন। নিশীথ দাস হঠাৎ চলে গেল কেন! হরি এখনও ফেরেনি। সময়মতো কিংকরবাবু ঠিক এসেছেন। রজনীবাবু একটা সিগারেট ধরালেন। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। এতক্ষণে হরি ফিরল।

হরি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘পরোটা খাবেন তো!’ রজনীবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। আগে দু—কাপ চা কর।’ হরি অবাক, ‘দু—কাপ কেন!’ রজনীবাবু বললেন, ‘কিংকরবাবু এসেছেন। উনি বাথরুমে গেছেন।’ হরি বাজারের থলি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। লোকটা এইরকমভাবে কেন বলল, ধরে নিন আমার নাম নিশীথ দাস। অদ্ভুত লোক। ভেলকি দেখাল। অথচ টাকা না নিয়ে চলে গেল।

হরি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল, ‘কোথায় কিংকরবাবু। কলঘরে তো কেউ নেই। দরজা হাট করে খোলা।’ রজনীবাবু চমকে উঠলেন, ‘সে কী!’

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। পরিচিত পায়ের শব্দ। কখন কিংকরবাবু বাথরুম থেকে বেরিয়ে একবারে রাস্তায় চলে গিয়েছিলেন! রজনীবাবু খেয়াল করেননি। কিংকরবাবুর তো উচিত ছিল তাঁকে একবার বলে যাওয়া। কিংকরবাবুর পায়ের শব্দ শুনে হরি চা করতে গেছে।

কিংকরবাবুকে রজনীবাবু ধমক দিয়ে বলতে চাইলেন, ‘আপনি কীরকম লোক মশাই।’ বলতে পারলেন না। কেননা কিংকরবাবুই ধমক দিয়ে তাঁকে বলছেন, ‘আপনি কীরকম লোক মশাই!’

রজনীবাবু হাঁ করে কিংকরবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিংকরবাবু বললেন, ‘আপনাকে কতবার ডাকলাম। আপনি যেন শুনতেই পেলেন না। আশপাশের লোকেরা আমাকে নির্ঘাত পাগল ভাবল। কেননা আপনাকে ডাকতে ডাকতে এই বুড়ো বয়সে আপনার পেছনে খানিকটা ছুটতেও হয়েছিল।’

রজনীবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে! কোথায়! কখন!’ কিংকরবাবু চেয়ারে বসলেন, ‘হ্যাঁ, আপনাকে। রাসবিহারীর মোড়ে। মিনিট কুড়ি আগে।’ রজনীবাবু বুঝলেন গোলমেলে ব্যাপারটা আবার শুরু হয়েছে।

হরি চা এনে টেবিলে রাখতে রাখতে কিংকরবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘একটু আগে আপনি বাবুর কাছে এসেছিলেন। তারপর কলঘরে যাচ্ছি বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন!’ কিংকরবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি এসেছিলাম! আমি তো এই এলাম।’ হরি বলল, ‘আপনারা চা খান। পরোটা ভেজে আনছি। আলুর দমও।’

কিংকরবাবু রজনীবাবুর দিকে তাকালেন, ‘হরি এসব কী বলছে।’ রজনীবাবু সিগারেট ধরালেন। দুজনে চায়ে চুকুম দিলেন। রজনীবাবু বললেন, ‘বড়ো গোলমেলে ব্যাপার। কিছুক্ষণ আগে সত্যিই আপনি এসেছিলেন। বললেন, নার্সিং হোম থেকে গিন্নিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এককাপ চা খেয়ে আসছেন।’ কিংকরবাবু বললেন, ‘আশ্চর্য! একথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। তারপর!’ রজনীবাবু বললেন, ‘তারপর বাথরুম গেলেন। তারপর আর কিছু নেই। সবটাই ভেলকি। আজ বুঝি গাড়ি নিয়ে আসেননি!’ কিংকরবাবু বললেন, ‘না। হীরালালের ক—দিন খুব ধকল চলছে। গিন্নিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ওকে ছুটি দিলাম। কিংকরবাবুর ড্রাইভারের নাম হীরালাল।

রজনীবাবু বললেন, ‘এবার বলুন। আপনি কী দেখলেন।’

কিংকরবাবু বললেন, ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। রাসবিহারীর মোড়ে সিগন্যালে আটকে পড়লাম। হঠাৎ আপনাকে দেখতে পেলাম। তক্ষুনি ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লাম। আপনি বেশ কয়েক হাত দূরে। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছিলেন। এই বয়সে আপনি এত তাড়াতাড়ি কীভাবে হাঁটছিলেন জানি না। আপনাকে ডাকছিলাম। আপনি শুনতেই পেলেন না। তারপর ছুটতে ছুটতে ডাকলাম। এই বয়সে কীভাবে ছুটলাম তাও জানি না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার লোকেরা অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। হঠাৎ আপনি ম্যাজিকের মতো ভ্যানিস হয়ে গেলেন।’

রজনীবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। ঠিক নিশীথ দাসের মতো।’ কিংকরবাবু অবাক, ‘তার মানে!’ রজনীবাবু বললেন, ‘তার মানে জানি না। আপনি যখন আমাকে অনুসরণ করছিলেন তখন আমি বাড়িতে। আজ সারাদিন বাড়িতে। একপা—ও বাড়ি থেকে বেরোইনি।’ হরি পরোটা আর আলুর দম নিয়ে এল।

খেতে খেতে কিংকর বর্মন জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিশীথ দাসটি কে!’ রজনীবাবু বললেন, ‘ভেলকি, বড় গোলমেলে ব্যাপার’। আর কিছু বললেন না। কিংকর বর্মন খানিকক্ষণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যখন বুঝলেন এ ব্যাপার রজনীবাবু আর একটিও কথা বলবেন না তখন আবার পরোটা আলুরদম খেতে লাগলেন।

তিন

ইসমাইলের কথা মনে পড়ল। ইসমাইল রজনীবাবুর গল্পের অন্ধভক্ত। বয়স তিপান্ন। পরিভ্রমণ মানে একটা ভ্রমণ—বিষয়ক পত্রিকা বার করে। অচেনা—অজানা জায়গার হদিশ সে দিতে পারে। দরকার অদরকারে তিনি ইসমাইলকে ফোন করেছেন। আগে মাঝে মাঝে সে রজনীবাবুর বাড়িতে আসত। ইদানীং খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ফোনে রজনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘অমাগ্রাম বলে কোনো গ্রাম আছে নাকি!’ ইসমাইল তো রজনীবাবুর ফোন পেয়ে অভিভূত। বলল, ‘হ্যাঁ আছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। খুব অবহেলিত গ্রাম। কেন বলুন তো!’ রজনীবাবু বললেন, ‘কীভাবে কোন ট্রেনে ওখানে যেতে হয় আমাকে বলবে। ওখানে রাত কাটানোর কোনো ব্যবস্থা আছে!’ ইসমাইল বলল, ‘দশ মিনিট সময় দিন। সব বলছি।’

মিনিট দশেক বাদে ইসমাইলের ফোন এল, ‘শেয়ালদা থেকে দুপুর দুটোয় লালপুকুর যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। ওই ট্রেনে যেতে হবে। ঘণ্টা দেড়েকের জার্নি। লালপুকুরে নেমে গোরুর গাড়িতে চেপে আরও একঘণ্টা। অমাগ্রামে রাত কাটাবার মতো কোনো হোটেল বা ধর্মশালা নেই। একটা শিবমন্দির আছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কবে যাবেন বলুন?’ রজনীবাবু বললেন, ‘কাল তোমাকে জানাব।’

পরের দিন সকালে রজনীবাবু কিংকর বর্মনকে ফোন করলেন, ‘কাল বেলা বারোটায় আমার বাড়িতে আসবেন। এখানে খাওয়াদাওয়া করবেন। তারপর আমরা দুপুর দুটোয় শেয়ালদা থেকে লালপুকুরের ট্রেন ধরব।’ কিংকরবাবু বললেন, ‘কাল আমার ছাপাখানা খোলা। কী করে লালপুকুর যাব! আর লালপুকুর হঠাৎ কেন যাব!’

রজনীবাবু বললেন, ‘তেমন অসুবিধে থাকলে আসবেন না। কাল এলে হয়তো ‘অমানিশা’র পুজো সংখ্যার গল্পটা এই হপ্তার মধ্যে পেয়ে যেতেন। তাহলে থাক। এ বছর আমার গল্প ছাড়া পত্রিকা বেরোক।’ কথা শেষ করে রজনীবাবু ফোন রেখে দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ড ফোনটা আবার বেজে উঠল। রজনীবাবু ফোন ধরলেন। কিংকরবাবু বললেন, ‘কাল আমি আপনার বাড়িতে আসছি।’ রজনীবাবু বললেন, ‘বেশ। বেলা বারোটার মধ্যে চলে আসছেন।’ তারপর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

এবার ইসমাইলকে ফোন করলেন। ইসমাইল ফোন ধরল, ‘বলুন রজনীবাবু।’ রজনীবাবু বললেন, ‘কাল আমরা অমাগ্রামে যাব। তুমি শিবমন্দিরে দু—জনের মতো থাকার বন্দোবস্ত কোরো।’ ইসমাইল বলল, ‘এক্ষুনি মাধব ভট্টাচার্যকে বলে দিচ্ছি, অমাগ্রামের শিবমন্দিরে এসে আপনি মাধববাবুর সঙ্গে দেখা করবেন।’

বেলা সাড়ে এগারোটার সময় হন্তদন্ত হয়ে কিংকর বর্মন এলেন। রজনীবাবু সবে চায়ের কাপে একটা চুকুম দিয়েছেন। ধপ করে তাঁর সামনের চেয়ারে বসে বললেন, ‘হরি আমাকে এককাপ চা দাও।’ রজনীবাবু মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আসল কিংকর বর্মন তো!’ কিংকরবাবুর ঠোঁটে মুচকি হাসি, ‘আমি তো আসল, আপনি!’ এবার রজনীবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘তা বটে। যেসব গোলমেলে ব্যাপার চলছে। লালপুকুরে তো কাল যাব। আজও কি ছাপাখানা না গিয়ে এখানে আড্ডা দেবেন!’ হরি চা দিয়ে গেল। কিংকর বর্মন বললেন, ‘না। আজ ছাপাখানায় যেতে হবে। লালপুকুর নিয়ে খুব কৌতূহল হচ্ছে। তাই জানতে এলাম।’

রজনীবাবু বললেন, ‘সব ভেলকি। নিশীথ দাসের মতো।’ একটু থেমে বললেন, ‘নিশীথ দাস নামটা নিয়ে সারাদিন ভাবুন। ভেবে কূল না পেলে সাত্যকি দত্তের সাহায্য নিন। কাল এখানে এসে বলবেন ওই নাম ও পদবি থেকে কী পাচ্ছেন।’

চা খেয়ে কিংকর বর্মন চিন্তিত মুখে বিদায় নিলেন।

চার

বেলা সাড়ে এগারোটায় কিংকরবাবু এলেন। চিন্তামগ্ন মুখ। রজনীবাবু বললেন, ‘একঘণ্টা পরে ভাত খাব। এখন চা খাওয়া যেতে পারে। শেয়ালদা থেকে দুটোয় লালপুকুর লোকাল ছাড়বে। ইসমাইলকে মনে আছে!’ কিংকরবাবু বললেন, ‘মনে থাকবে না কেন। কতবার এই বাড়িতে এসেছে। আপনার লেখার ভক্ত।’ হরি চা দিয়ে গেল।

রজনীবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘অমাগ্রামের হদিশ তো ইসমাইল আমাকে দিল। ‘পরিভ্রমণ’ কাগজের সম্পাদক। তাই ওকে সব জায়গার খুঁটিনাটি খোঁজখবর রাখতে হয়। ইসমাইম শুধু খোঁজ দিয়ে ক্ষান্ত নয়। গাড়ি নিয়ে আসবে। আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে। বুঝলেন!’

চায়ে চুমুক দিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে কিংকর বর্মন বললেন, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি একটুও বুঝতে পারছি না।’ রজনীবাবু বললেন, ‘আস্তে আস্তে আপনাকে বুঝিয়ে দেব। তা ওই নিশীথ দাসের মর্মোদ্ধার করতে পারলেন!’ কিংকরবাবু বললেন, ‘না।’ রজনীবাবু বললেন, ‘বলেছিলাম তো দরকার হলে গোয়েন্দা সাত্যকি দত্তের সাহায্য নিতে পারেন। নেননি।’ গম্ভীর মুখে কিংকর বর্মন বললেন, ‘তিনিও হেঁয়ালি করে উত্তর দিলেন। বললেন, দুই বন্ধু।’

রজনীবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘সাত্যকি দত্তের তো প্রখর বুদ্ধি। একবার শুনেই ধরে ফেলেছেন তো!’ কিংকরবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে রজনীবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

গোরুর গাড়ি যখন শিবমন্দিরের সামনে পৌঁছল তখন ঘড়িতে বিকাল পৌনে পাঁচটা। ইসমাইলের হিসাবে আরও পনেরো মিনিট আগে পৌঁছনো যেত।

গাড়ি থেকে দুজনে নামলেন। কিংকরবাবু ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। গোরুর গাড়িটা চলে গেল। গাড়ির শব্দ পেয়ে মন্দির থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে নমস্কার করে বললেন, ‘আমার নাম মাধব ভট্টাচার্য।’ রজনীবাবু নিজেদের পরিচয় দিলেন।

মাধববাবু ওঁদের নিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢুকলেন। খুব প্রাচীন মন্দির। কিংকরবাবুর ভক্তি খুব। দু—মিনিট ধরে প্রণাম করলেন। রজনীবাবু মন্দিরটা কত প্রাচীন এই নিয়ে মাধব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। উনি বললেন, ‘কত প্রাচীন জানি না। কলকাতার মল্লিকদের প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির। তাঁরাই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। বছর পাঁচেক হল এখানে আছি। অকৃতদার মানুষ। তাই কোনো পিছুটান নেই।’

মন্দিরের উঠোনের ওপাশে চারটে ঘর। তার মধ্যে একটা ঘরে রজনীবাবুদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

সেই ঘরে বসে চা খেতে খেতে রজনীবাবু বললেন, ‘কাল ভোর ছ—টা কুড়ির ট্রেনে আমরা কলকাতায় ফিরে যাব।’ মাধববাবু বললেন, ‘গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছি। রঘু আপনাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে।’

রজনীবাবু বললেন, ‘এখনও দিনের আলো আছে। আমরা বরং গ্রামটা একটু ঘুরে দেখে আসি।’ মাধববাবু বললেন, ‘এখানে দেখার কিছুই নেই। বড়ো গরিব এখানকার মানুষ।’ রজনীবাবু বললেন, ‘এই গ্রামে নিশীথ দাস বলে কেউ থাকেন! ম্যাজিক দেখান!’ মাধববাবু মাথা নাড়লেন, ‘না তো! তবে ব্রহ্মতোষ ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। এই মন্দিরের প্রাচীন পূজারি। তাঁর বয়স একশো এক। দক্ষিণের ঘরটিতে থাকেন। এখনও প্রখর স্মরণশক্তি। চলুন তাঁর কাছে আপনাদের নিয়ে যাই।’

নিশীথ দাসের নাম শুনে ব্রহ্মতোষ বললেন, ‘না। ওই নামে কোনো জাদুকরকে চিনি না। নামটা নিশি দাঁ নয় তো। তাঁর আবার তিনটে কালো দাঁত ছিল। ভোজবাজির খেলা দেখাতেন।’ রজনীবাবু বললেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। হয়তো আমিই নামটা ভুল বলছি। কীরকম খেলা দেখান!’ ব্রহ্মতোষ বিরক্ত হলেন, ‘বললাম তো খেলা দেখাতেন। কুড়ি বছর বয়সে এই মন্দিরে পুরোহিত হয়ে আসি। তখন অমাগ্রামে নিশি দাঁকে সবাই ভক্তিশ্রদ্ধা করত। জাদুকরের চেয়ে তাঁর একটা আরও বড়ো পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন পরোপকারী। তিনি মারা গেছেন সত্তর—পঁচাত্তর বছর আগে।’ রজনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই গ্রামে তাঁর বংশধররা কেউ নেই?’ উনি মাথা নাড়লেন, ‘না, কেউ নেই।’

রাত্তিরে মন্দিরের ভোগ খেয়ে রজনীবাবু ও কিংকরবাবু নির্দিষ্ট ঘরে বিছানায় পাশাপাশি শুয়েছেন। মাধববাবু বলেছেন ভোরে ডেকে দেবেন।

লালপুকুরে আসার সময় নিশীথ দাসের ভেলকির ব্যাপারটা রজনীবাবু কিংকরবাবুকে বলেছিলেন। সেই সাদা ইঁদুর ও সাদা পায়রার গল্প।

রজনীবাবু বিছানা থেকে উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘ঘুম আসছে না।’ কিংকরবাবুও উঠলেন, ‘আমারও একই অবস্থা। দিন, আজ একটা সিগারেট খাই।’ কিংকরবাবু বহুকাল আগে চেনস্মোকার ছিলেন। ইদানীং শখ হলে ন—মাসে ছ—মাসে একটা দুটো খান।

সিগারেটে টান দিয়ে কিংকরবাবু বললেন, ‘এই নিয়ে কী গল্প লিখবেন! নিশীথ দাস আপনাকে ভেলকি দেখিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অমাগ্রামে এসে শুনলাম তাঁর নাম নিশি দাঁ। সত্তর—পঁচাত্তর বছর আগে উনি মারা গিয়েছেন।’ রজনীবাবু বললেন, ‘মানুষটি সত্যি ভারি পরোপকারী ছিলেন। নিশীথ দাস একবার আপনার চেহারা নিয়েছেন আর একবার আমার। আমার গল্পহীন কলমে উনি এনে দিয়েছেন গল্প।’

কিংকরবাবু অবাক, ‘নিশি দাঁ কেন নিশীত দাস হলেন!’ রজনীবাবু মুচকি মুচকি হাসছেন। ‘এখনও বুঝতে পারেননি। সাত্যকি দত্ত কিন্তু ঠিক ধরে ফেলেছেন। নিশীথ মানে রজনী আর দাসের অর্থ কিংকর। আমরা দুই বন্ধু।’

কিংকর বর্মনের হাতে সিগারেট পুড়ছে। উনি হাঁ করে রজনীবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *