1 of 3

নিশীথ কুসুম

নিশীথ কুসুম

বিরাট জুতোর দোকানের কাছে নাকটা ঠেকাল যূথী। বেশ শীত, এই সময় ঠান্ডা কাচ ছুঁতে গা শিরশির করে, একটু আরামও লাগে।

পাশ থেকে মনসিজ জিগ্যেস করল, কোন জুতো জোড়া তোমার পছন্দ?

আঙুল দেখিয়ে যূথী বলল, ওইটা, ওইটা আর ওইটা।

তিন জোড়াই?

হ্যাঁ, ওই তিন জোড়াই আমার চাই।

প্রত্যেক জুতোর সঙ্গে নাম লেখা লেবেল ঝোলানো। মনসিজ ওই তিন জোড়া জুতোর দাম মনে মনে যোগ করল। একশো বাইশ টাকা সাতষট্টি পয়সা। মনসিজ পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, ঠিক আছে, কিনে নাও। যূথী চোখ কুঁচকে হাসল। তার পায়ে এক জোড়া বেশ পুরোনো চটি। সে বলল, যখন কিনব, একসঙ্গে তিন জোড়ার কম কিনব না। চল—ওরা কিন্তু জুতোর দোকানে ঢুকল না। আবার মন্থরভাবে হাঁটতে লাগল রাস্তা দিয়ে। শীতের মধুর দুপুর। ঝকঝক করছে রোদ, এখন চলার ছন্দে একটা আনন্দ স্পষ্ট অনুভব করা যায়।

এবার একটা শাড়ির দোকান। শো-কেসের সামনে আবার থেমে পড়ল যূথী। নতুন শাড়ির স্টক এসেছে। চেয়ে থাকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যে-কোনও একটার চেয়ে আরেকটা যেন বেশি ভালো।

মনসিজ বলল, কোনটা-কোনটা?

যূথী এবার পছন্দ করল পাঁচটা।

মনসিজ বলল, দেব, সবকটাই কিনে দেব।

যূথী বলল, কেন জানি না আজ আমার খুব সাজতে ইচ্ছে করছে। নতুন শাড়ি, নতুন ব্লাউজ, ব্রা, নতুন জুতো, সেইসঙ্গে একটা ভালো পারফিউম। মনসিজের হাতে একটা ব্রাউন প্যাকেটে তিনটে মোটা-মোটা বই। সে প্যাকেটটা যুথীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা একটু ধরো, আমি চট করে একটা ব্যাংক ডাকাতি করে কিছু টাকা নিয়ে আসি।

যূথী বলল, তুমি একলা পারবে না। আমিও সঙ্গে যাই। এই বইয়ের প্যাকেটটা দেখিয়ে আমি বলব, এর মধ্যে বোমা আছে। তুমি একটা খেলনা বন্দুক কিনে নাও না।

আবার হাঁটতে গিয়েই একজন লোকের সঙ্গে যূথীর ধাক্কা লাগল। লোকটি অস্পষ্টভাবে মাফ করবেন বলে দাঁড়িয়ে রইল একটু দূরে। মনসিজ লোকটির দিকে চেয়ে আছে। মনসিজের বিশাল চেহারা, প্রায় ছফুট, চওড়া কাঁধ।

লোকটি মনসিজকে ভয় পাচ্ছে, সে বলল, দেখতে পাইনি, মাফ করবেন।

মনসিজ নরম করে বলল, ঠিক আছে।

যূথী মুখ তুলে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

লোকটি চমকে উঠে দ্রুত পা চালাল।

মনসিজ হাসতে-হাসতে জিগ্যেস করল, তুমি লোকটাকে অমন বকলে কেন?

যূথী বলল, আমরা বুঝতে পারি।

কী?

কখন হঠাৎ লেগে যায় আর কে ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে।

ওই লোকটা ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরেছিল? ওর ঘাড়টা ভেঙে দিয়ে আসি? এখনও বেশি দূর যায়নি।

সেইজন্যেই তো ওকে চলে যেতে বললাম। আমার চোখের দিকে তাকালেই তুমি বুঝতে পারতে, তারপর ওর ঘাড় ভেঙে দিতে! চল, গঙ্গার ধারে যাব।

হেঁটে?

হ্যাঁ, হেঁটে, যতই দূর হোক।

তোমার খিদে পায়নি?

খুব।

চল, ওই পার্কটার কাছে একটা দোকানে ভালো ঘুগনি বানায়। পাঁউরুটি আর ঘুগনি। দোকানটায় টিনের চাল, চেয়ার নেই, বেঞ্চ।

তাতে কী হয়েছে, ঘুগনির স্বাদটা খুব ভালো।

আমার আজ ইচ্ছে করছে গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়ে খেতে। সব চেয়ে ভালো খাবার, গদি-মোড়া চেয়ারে বসে আমি পা দোলাব, ধপধপে সাদা পোশাক পরা বেয়ারা এসে খাবার দিয়ে যাবে।

ঠিক আছে, চল এ্যান্ড হোটেলে।

পকেটে কত আছে?

সাড়ে তিন টাকা। তাতে কোনও ক্ষতি নেই, বইগুলো ধরো একটু।

ব্যাঙ্ক ডাকাতি করবে?

না, তার দরকার হবে না। বলে বইয়ের প্যাকেটটা যূথীর হাতে দিয়ে মনসিজ কাছেই একটা ঘড়ির দোকানে ঢুকে গেল।

একটুক্ষণ অপেক্ষা করল যূথী। পথচারীরা তার দিকে ফিরে-ফিরে তাকায়। যূথী আগে এত সুন্দরী ছিল না, টি-বি থেকে সেরে ওঠার পর তার শরীরে, চোখে-মুখে একটা লাবণ্য এসেছে। প্রাচীন দিঘির মতন গভীর কালো চোখ। অন্য মেয়ের তুলনায় সে-ও বেশ লম্বা, আগে তাকে বড্ড রোগা লাগত, এখন চল-চল করছে স্বাস্থ্য। লাল ব্লাউজ ও লাল শাড়িতে সে অগ্নিকন্যা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন তাকে দেখে অনেকেই পতঙ্গ হতে চায়।

যূথী গিয়ে ঘড়ির দোকানে ঢুকল। কাউন্টারের ওপর মনসিজের হাতঘড়িটা খোলা। যূথী জিগ্যেস করল, কত দেবে বলছে?

মনসিজ মুখ না ফিরিয়েই বলল, সত্তর।

মোটে, একটা ঘড়ির দাম?

আমি নব্বই পেলেই–

কখনও না।

আহা এটা দেশিদামি ঘড়ি নয়, এইচএমটি সেকেন্ড হ্যান্ড–

যূথী কাউন্টার থেকে ঘড়িটা তুলে নিয়ে বলল, বিক্রি করতে হবে না, এসো। দোকানের লোকেরা হতভম্ব। মনসিজের আর কিছুই করার নেই। কারণ যূথী ঘড়িটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেছে। কাঁধ ঝাঁকানি দিয়ে বেরিয়ে আসতে হল মনসিজকে।

যূথী বলল, চল, আমি ঘুগনিই খাব। কাল আমি তোমাকে নিশ্চিত গ্র্যান্ড হোটেলে খাওয়াব। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই বিক্রি করে দিয়ে আসব ঘড়িটা।

কাল?

হ্যাঁ।

কাল আমি বাঁচব কি না জানি না।

ওসব কি পাগলের মতন কথা। তুমি তো একদম সেরে গেছ। তা ছাড়া টি-বি কি আজ আবার একটা অসুখ নাকি? জল ভাত।

তা জানি। কিন্তু লোকে তো অ্যাক্সিডেন্টেও মরে। সে জন্য নয়, আমি কালকের কথা ভাবছিনা। আমার আজকের দিনটাই দারুণ সুন্দর লাগছে। কী চমৎকার রোদ। শরীরটা এত ভালো আছে আজ আমার, নিজেকে রানি মনে হচ্ছে।

রানি হয়ে যাও, কে বারণ করছে?

আজ খুব টাকা খরচ করতে ইচ্ছে হচ্ছে! দারুণ ভালো-ভালো হোটেলে খাব, সারাদিন ট্যাক্সি চড়ে বেড়াব কিংবা ট্রেনে চড়ে বাইরে কোথাও চলে গিয়ে আমরা এক হোটেলে থাকব, ধরো, পুরীতে–

চল, পুরী চলে যাই।

আমার কাছে দশ টাকা আছে, তোমার কাছে সাড়ে তিন টাকা।

দাঁড়াও, ভেবে দেখি যদি কারুর কাছে ধার পাওয়া যায়।

ধার কেন? কেন আমাদের অনেক টাকা থাকবে না?

দাঁড়াও, ডাক্তারিটা পাশ করে নিই।

ওই লোকটাকে দ্যাখো–

গাড়ি থেকে একটা লোক নামল। গাড়িটা প্রায় নতুন, লোকটার গায়ে ঝলমলে স্যুট, মুখখানা গম্ভীর। অর্থবল থাকলে যে ধরনের গম্ভীরতা আসে। লোকটি মনসিজকে উপেক্ষা করে যূথীর দিকে দু-বার তাকাল।

যূথী বলল, লোকটার অনেক টাকা আছে তাই না?

মনসিজ বলল, টাকা থাকলেও এই ধরনের লোকদের অনেক দুঃখ থাকে। সে আমি জানতে চাই না। ওর অনেক টাকা। অথচ আমাদের কেন টাকা থাকবে না? কেন আমরা আনন্দ করতে পারব না?

পৃথিবীতে কত লোক খেতে পায় না। আমরা তবু–

ওসব কথা আজ আমি ভাবতে চাই না। আজ আমি শুধু নিজের কথাই ভাবছি। অনেক দিন তো কিছু না খেয়ে শুধু হেটে-হেঁটে ভালো লাগে। কিন্তু আজ আমার ইচ্ছে করছে যা খুশি তাই করতে, খুব হইহই করতে, অনেক দূরে-দূরে বেড়ানো—তুমি আমার হাতে এক ডজন লাল গোলাপ তুলে দেবে, আমি তোমার জামায় লাগিয়ে দেব মুক্তোর বোতাম।

মনসিজ গুম হয়ে রইল।

যূথী তার বাহু ছুঁয়ে খুব মায়াময় গলায় বলল, তখন স্যানাটোরিয়ামের বিছানায় শুয়ে থাকতাম, যখন-তখন মুখ দিয়ে রক্ত উঠত, আমি জানতাম, আমি মরেই যাব। টি-বি মোটেই শক্ত অসুখ না। তোমরা ডাক্তারেরা বলল, তবু তো এই অসুখে মানুষ মরে, মরে না? আমি ভাবতাম আমিও মরে যাব, কেন? কেন এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাব, চলে যাব এই পৃথিবী থেকে?

মনসিজ মৃদু গলায় বলল, তুমি এখন সেরে গেছ, তুমি একদম আমার চেয়েও বেশি দিন বাঁচতে পারো।

তা হোক। তবু আজ সকালে হাসপাতালের দিনগুলো মনে পড়ছিল হঠাৎ। তারপর ভাবলুম যখন বেঁচেই উঠেছি, তখন এই জীবনটা ইচ্ছে মতন খরচ করব না কেন? যতরকম আনন্দ আছে সব আমার চাই। সব। ঘুগনি, ঘুগনি খাবে না?

না, আগে গঙ্গার ধারে যাব।

গঙ্গা এখান থেকে অনেক দূর। অত দূর যূথীর পক্ষে হেঁটে যাওয়া উচিত নয়। যূথীর যখন ওখানে যাওয়ার খেয়াল হয়েছে, তখন যেতেই হবে। প্রতিটি বাসে সাংঘাতিক ভিড়, মনসিজ ট্যাক্সি। ডাকল তাতেই উড়ে গেল যূথীর দশ টাকা।

তারপর এক কাপ করে কফি আর দু-ঠোঙা করে ঝালমুড়ি। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ঝলমল করছে নিসর্গ।

কিন্তু নদীর ধারে বসে যুথীর মন আরও খারাপ হয়ে গেল। নদী দেখে তার মনে পড়ছে সমুদ্রের। কথা। পুরী কিংবা দীঘা। মনসিজের সঙ্গে একটা ঘরে অন্তত একটা রাত্রি।

একটু সন্ধে হয়ে আসবার পর গাছের আড়ালে মিশে মনসিজ যুথীকে গাঢ়ভাবে একটা চুমু খেল। যূথী একটুও বাধা দিল না কিংবা লজ্জা পেল না। সে বলল, আঃ! আঃ! তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে থাকো, যদি আর একদিনও না বাঁচি তবু যেন আজকের দিনটা…মনসিজ কিন্তু সরে গেল। গম্ভীরভাবে বলল, চল।

কোথায়?

চলই না।

এবার হেঁটে-হেঁটেই আসতে হল। চৌরঙ্গীর কাছে মনসিজ জিগ্যেস করল, যদি আজই পুরী যাই তুমি যেতে পারবে? এখনও ট্রেন আছে! যূথী বলল, কেন পারব না? বাড়িতে শুধু একবার বলে যাব যে চন্দনার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি। চন্দনাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব, কিংবা চন্দনা না গেলেও ক্ষতি নেই।

মনসিজ দু-এক মুহূর্ত ভেবে নিল। সে হোস্টেলে থাকে তার পক্ষে পালাবার কোনও অসুবিধে নেই।

মিউজিয়ামের সামনে যূথীকে দাঁড় করিয়ে বলল, তুমি এখন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। নিউ মার্কেটে আমার বাবার এক বন্ধুর একটা বড় দোকান আছে। উনি আমাকে ছোটবেলা থেকে চেনেন। একটা কিছু সাংঘাতিক গুল ঝাড়লে উনি চার-পাঁচশো টাকা ঠিক দিয়ে দেবেন। দোকান বোধহয় এখনও বন্ধ হয়নি। তুমি আমার পেছনে-পেছনে এসো না। প্লিজ। বাবার বন্ধু তোমাকে দেখে ফেললে…

তা বলে আমি এতটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকব?

বুঝছ না, উনি যদি বাইচান্স আমাকে একটু এগিয়ে দিতে আসেন, কিংবা বলেন, চল, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি, তাই তোমাকে এতটা দূরে…।

মনসিজ সেই যে গেল তো গেলই। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে গেল যূথীর। মনসিজ যদি সারারাতও না আসে, তা হলেও যূথীকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কারণ মনসিজ কোনও দিন তার কাছে একটাও মিথ্যে বলেনি! সে জানে প্রয়োজনের বেশি এক মুহূর্তও দেরি করবে না মনসিজ।

লোকেরা তার দিকে ফিরে-ফিরে তাকাচ্ছে। দু-একজন কাছাকাছি ঘুরঘুর করছে। তাতে ভয় নেই যূথীর। এটা কলকাতা শহর, এখনও আটটা বাজেনি, এখানে ভয়টা কী? আরও দু-একটা মেয়ে দূরে-দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে কারুর-না-কারুর জন্য।

একটা ট্যাক্সি একটু দূরে এসে থামল। সেটা থেকে নেমে এল একটা রোগা মতন লোক। আস্তে আস্তে হেঁটে লোকটি যূথীর ঠিক পাশে এসে দাঁড়াল। যূথীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল কয়েকবার। যূথীও দেখল লোকটিকে। লোকটির মুখে মদের গন্ধ।

লোকটি আরও কাছে ঘেঁষে এসে ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, যাবে? যূথী লোকটির চোখে চোখ রেখে বলল, কোথায়?

লোকটি বলল, ওই যে আমার ট্যাক্সি দাঁড় করানো আছে।

যূথী বলল, একটু দাঁড়ান, আমার এক বন্ধু আসছে, সে-ও যাবে আমার সঙ্গে।

বন্ধু, কে বন্ধু?

আপনার চেয়ে অনেক লম্বা, গায়ে খুব জোর।

লোকটি যেন কেঁপে উঠল। আর একটুও দেরি না করে হনহন করে এগিয়ে গেল ট্যাক্সির দিকে।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মনসিজ এসে পৌঁছল। সে একটু-একটু হাঁপাচ্ছে, দৌড়ে এসেছে তো!

ওই লোকটা কে?

জানি না তো!

তোমার সঙ্গে কথা বলছিল দেখলাম।

হাঁ, কথা বলছিল। তুমি এত দেরি করলে?

দেরি তো করিনি। গেলাম আর এলাম। ধুৎ, কাজ কিছুই হল না। আমার বাবার সেই বন্ধু একটু আগে বেরিয়ে গেছেন। দোকানে একজন কর্মচারী ছিল, সে-ও আমাকে চেনে, অনেক বুঝিয়ে বললাম, সে আমাকে চল্লিশটাকা দিল, ক্যাশের চাবি তার কাছে নেই।

তবু তো অনেক টাকা পাওয়া গেছে!

মাত্র এই কটা টাকা নিয়ে পুরী যাওয়া যায় না।

তাহলে আমরা ডায়মন্ডহারবার যাই।

মনসিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টাকার কাছে পৌরুষ অসহায়। যূথী নিজে থেকে পুরী যেতে চাইছে, অথচ নিয়ে যাওয়ার সামর্থ তার নেই।

যূথী বলল, ওই লোকটা আমাকে কী বলছিল জানো। বলছিল, চল! ও কোথায় নিয়ে যেতে চাইছিল আমাকে?

মনসিজ আবার চঞ্চল হয়ে সামনে তাকাল। ট্যাক্সিটা ছেড়ে গেছে, লোকটাকে আর ধরা যাবে না। মনসিজ তিক্তভাবে বলল, হয়তো কোনও হোটেলে। অথবা ডায়মন্ডহারবারে। এমনকী পুরীতেও নিয়ে যেতে পারত।

যূথী বলল, বাঃ বেশ মজা তো, তাহলে তো লোকটাকে আটকালেই হত। ওকে নিয়েই না হয় আমরা সেসব জায়গায় যেতাম।

তুমি পাগল! ও তোমাকে একা নিয়ে যেতে চায়। আমাকে সঙ্গে নেবে কেন?

তবু ওকে একবার বলে কয়ে বুঝিয়ে যদি রাজি করানো যেত।

যূথী ন্যাকার মতন কথা বলো না। ওইরকম একটা লম্পটের সঙ্গে আমরা যাবই বা কেন? যে লোক রাস্তাঘাট থেকে মেয়ে ধরে।

ওদের কেন অনেক টাকা? কেন আমাদের নেই? আমাদের বুঝি বাঁচতে ইচ্ছে করে না?

তোমার যদি এত আনন্দ করার লোভ থাকে, ওইরকম কোনও লোকের সঙ্গে গেলেই পারতে।

তুমি আমাকে এতরকম কথা বললে?

হ্যাঁ বললাম। আমার টাকা নেই, এই আমাদের মস্ত অপরাধ। তুমি যদি চাও, তুমি ওইরকম লোকের সঙ্গে আজ ফুর্তি করতে পারো। আমি কোনও আপত্তি করব না! কী আর আসে যায়, ফুর্তি নিয়ে তো কথা!

তুমি আপত্তি করবে না?

না।

ঠিক আছে, আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।

আর মাত্র দুমিনিট কথাবার্তাতেই ঝগড়া চরমে উঠল। মনসিজ বড্ড গোঁয়ার, সে যূথীকে একা ফেলে রেখে চলে গেল গটগট করে।

একটু বাদেই আর-একটা ট্যাক্সি থামল। একজন স্থূলকায় লোক তার থেকে নেমে হেলতে-দুলতে এগিয়ে এল। লোকটি বেশ মোটা আর বেঁটে, মাথায় বাবরি চুল।

সে-ও এসে যূথীর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, কী—যাবে?

যূথী অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, যাব।

কতদূরে? লোকটি পানের রস ভরতি লালা মুখে বলল, ওই যে ট্যাক্সি। লোকটির সঙ্গে গিয়ে যূথী ট্যাক্সিতে উঠল।

ট্যাক্সিটা ছাড়ার পর দশ বারো গজও এগোয়নি, আবার থেমে গেল ঘচাং করে। তার ভেতর থেকে যুথীর গলার চিৎকার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।

শীতের রাত, তবু রাস্তায় মানুষ জন আছে।

নারীর কণ্ঠ শুনে ছুটে এল অনেকেই। যূথী কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই লোকটা জোর করে আমার ওপর অসভ্যতা করছে।

রাস্তার লোকজন সেই বেঁটে মোটা লোকটাকে মেরেই ফেলত। তার মধ্যেই মনসিজ এসে ট্যাক্সিটার অন্য দরজা দিয়ে উঠে পড়ে লোকজনকে বলল, আমি একে চিনি, আর কোনও চিন্তা নেই। পথের লোকেরা যূথীকে দিয়ে যাচাই করে নিল সত্যিই সে মনসিজকে চেনে কি না?

মনসিজ ড্রাইভারকে বলল, আপনি গাড়ি চালান।

ট্যাক্সি একটু দূরে যাওয়ার পর মনসিজ জিগ্যেস করল, একে নিয়ে কী করব?

যূথী বলল, একে খুন করে ফেলো! এ আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।

মনসিজ লোকটার চুলের মুঠি চেপে ধরতেই সে হাউমাউ করে উঠল, প্রাণে মারবেন না, দয়া করুন, ছেড়ে দিন, জীবনে আর কখনও…মনসিজ লোকটার চুল ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে আবার জিগ্যেস করল, জড়িয়ে ধরেছে? আর কী করেছে? কোথায় হাত দিয়েছে? যূথী বলল, ওকে ছেড়ে দাও। ও একটা নরকের কীট। তোমার শাস্তির যোগ্যও নয়।

লোকটা পকেট একটা মোটা মানিব্যাগ বের করল, আমার সব টাকা নিন। আমাকে বাঁচান।

মনসিজ প্রচণ্ড এক চড় কষাল লোকটার গালে। ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি থামিয়েছে।

লোকটা প্রায় আলুর মতন গড়িয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে।

ট্যাক্সিওয়ালা জিগ্যেস করল, এবার যাব?

মনসিজ বলল, আর এক মুহূর্ত এখানে থাকলে আমি ওকে খুনই করে ফেলব! ট্যাক্সি চলতে শুরু করল আবার। মনসিজ জিগ্যেস করল, তোমার লেগেছে কোথাও? তোমাকে চুমু খেয়েছে?

যূথী বলল, না।

মনসিজ বলল, ড্রাইভারদাদা, আপনি একটু চোখ বুজবেন? ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, চোখ বুজে আমি গাড়ি চালাব? এসব কী হচ্ছে আজ? এত রকম কাণ্ড চলছে, আমি মাথার ঠিক রাখতে পারছি না।

মনসিজ বলল, চোখ বুজতে হবে না। কিন্তু আপনি এদিকে মুখ ফেরাবেন না। যূথী বলল, তুমি যদি আসতে আর এক মিনিট দেরি করতে, তাহলে আমার সারা জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যেত।

তুমি লোকটার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠলে কেন?

আমি দেখতে চেয়েছিলাম, তুমি কী করো।

মনসিজ যূথীকে নিজের বুকের কাছে টেনে এনে চুম্বনে আবদ্ধ করল। কিন্তু চুম্বনটি দীর্ঘস্থায়ী হল না। যূথী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে বলল, টি-বি রুগিকে অত বেশি চুমু খেতে নেই।

মনসিজ আবার তাকে টেনে নিতে যেতেই যূথী বলল, আমার পায়ে কী যেন ঠেকছে!

নীচু হয়ে সে তুলে নিল। একটা মানিব্যাগ। সেই বেঁটে মোটা লোকটার। ব্যাগটির মধ্যে অন্তত সাতশো টাকা।

মনসিজ স্থিরভাবে তাকাল যূথীর দিকে। দুজনের দৃষ্টি কয়েক পলক আবদ্ধ হয়ে রইল। টাকা! তার মানে পুরী, তার মানে আনন্দ, তার মানে যা খুশি করার স্বাধীনতা!

যুথী বলল, ট্যাক্সি ঘেরাও, এখনও লোকটাকে পাওয়া যেতে পারে। গাড়ি ঘুরিয়ে আনা হল সেই জায়গায়। না লোকটি নেই। পালিয়েছে। কিংবা সাতশো টাকার মূল্য ওর কাছে বেশি নয়।

মনসিজ বলল, এখনও পুরীর ট্রেন পাওয়া যায়।

যূথী বলল, আমার বুক ব্যথা করছে। এটা বোধহয় নতুন কোনও অসুখ।

বাড়ি যেতেই হবে।

মনসিজ বলল, টাকা দিয়ে কী হবে?

যূথী সেটা নিজের হাতে নিয়ে এক গোছা টাকা মুঠোয় ধরে হাতটা জানলায় রাখল। ফরফর করে উড়তে লাগল টাকাগুলো।

যূথী সারা মুখ হাসিতে ভরিয়ে বলল, তোমাকে বলেছিলাম না আজ আমার খুব টাকা ওড়াতে ইচ্ছে করছে? দ্যাখো সেই শখটা কেমন মিটে গেল!

মনসিজ বলল, সব টাকা উড়িও না। ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হবে কিন্তু। তা ছাড়া গ্র্যান্ড হোটেলে সেই খাবার ব্যাপারটা?

যূথী বলল, তুমি যদি আর এক মিনিট দেরি করে আসতে, তাহলে আমি ওই লোকটার সঙ্গে গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়ে খেতাম। কাল যদি শরীর ভালো থাকে, তোমাতে-আমাতে সেই ঘুগনি আর মিষ্টি খাব। দু-প্লেট করে? বাকি টাকাটা সে ফেলে দিল ট্যাক্সি ড্রাইভারের কোলে। বলল, এগুলো সব আপনার।

ট্যাক্সি থেমেছে ট্রাফিকের লাল আলোয়। একটা লোক দৌড়ে এসে বলল, ফুল? ফুল নেবেন?

ট্যাক্সি ড্রাইভার দরাজ গলায় বলল, যতগুলো আছে, সব দিয়ে দাও। ওই মেমসাহেবকে দাও।

ঠিক যেমনভাবে ট্যাক্সি ড্রাইভারের কোলের ওপর নোটের গোছা পড়েছিল, সেইভাবে যূথীর কোলের ওপর এসে পড়ল গুচ্ছ-গুচ্ছ ফুল।

যূথী একটা গোলাপ তুলে নিলে। তারপর আপন মনে বলল, কিছু ফুল দিনের বেলা ফোটে, কিছু ফুল রাত্তিরে। এগুলো সব দিনের বেলার ফুল।

মনসিজ বলল, এ ফুলগুলো ওরা কবরখানা থেকে চুরি করে আনে।

যূথী বলল, চমৎকার! তাহলে আমাকে খুব মানাবে! সব ফুলগুলো একসঙ্গে তুলে নিয়ে সে খুব আদর করতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *