1 of 2

নিশীথে সুকুমার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

নিশীথে সুকুমার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রায় পঁচিশ বছর আগে সুকুমার হাফ প্যান্ট পরত। এখন সে সরু পাজামার ওপর কলিদার পাঞ্জাবি পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। রাত বারোটা। বউ পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে।

এই ড্রেসিং টেবিলটি সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই মেয়ের। তারা সম্প্রতি শাড়ি ধরেছে। পিঠোপিঠি ওরা। আয়না সমেত এটি কিনতে সুকুমারের একশো কুড়ি টাকা লেগেছে। দক্ষিণের এক চাকুরে বাসা তুলে দিয়ে ত্রিবান্দ্রম বদলি হওয়ার সময় যা-ইচ্ছে দামে নানান জিনিস ঝেড়ে দিয়ে যায়। তখন সুকুমাবের বউ বেলা গিয়ে কিনে আনে।

আয়নার পাশেই মেয়েদের খাট। দুজনই মশারির ভেতর ঘুমোচ্ছে। ছোটটি শাড়ি খুলে এখন ইজেরে আছে। ওপরে ব্লাউজ। বড়টির কাঁথা মুড়ি দিয়ে শোয়া অভ্যেস। তাই তার মুখ দেখতে পেল না সুকুমার। তখন আয়নায় নিজের মুখে তাকাল। এই মুখখানি সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব প্রিয়। বহুদিন ধরে দেখে আসছে। এখন ওই মুখের দু’ পাশে দু’খানি স্থায়ী পাউরুটি। মাত্র দশ বছর আগে ভাগ্যিস ব্যাকব্রাশ করে চুল আঁচড়ানো বন্ধ করে ছিল। তখন থেকে সিঁথি কেটে আঁচড়ানোর ফলে এখনও তার সমবয়সীদের মতো মাথার চুল অতটা পিছিয়ে যায়নি। সব মিলিয়ে একটা নির্বোধ তৃপ্তভাবে গোল মুখখানা সব সময় ভাসছে! এই জিনিসটিই সুকুমারের সাইনবোর্ড।

পাঞ্জাবির ওপর শরীরের বিষুবরেখার জায়গাটি যে কিছু উঁচু আয়নাতেও তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। ওখানে তার পেট এখন আস্ত একটা তরমুজ। বেড়েই চলেছে। দম বন্ধ করে পেট কমিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে ভাল করে দাঁড়িয়ে সে পরিষ্কার বুঝল—এরকম যখন ছিলাম—তখন যুবক ছিলাম।

পা টিপে টিপে সুকুমার নিজের ঘরে ঢুকল। ইদানীং বাইরে খাওয়া-দাওয়া করলেই তার অম্বল হয়ে যায়। তাই শাদা কাপে ঝাঁঝালো যোয়ানের আরক জল মিশিয়ে খেয়ে নিল। তারপর কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে মশারির ভেতরে চলে গেল।

বউকে হাতড়াল। বউ বলল, উঁহু। আঃ। তারপর সেই ভঙ্গিতে পাশ ফিরে শুল, যাতে কিনা সুকুমারের শরীর আরও খারাপ হয়।

সম্মান বলে একটা কথা আছে। বিয়ের সতেরো বছর পরে এই পাশ ফিরে শোওয়াটা তার বড় অপমান লাগল। সে খানিকক্ষণ চিৎ হয়ে থাকল। তারপর মাথার নীচের জোড়া বালিশ থেকে একটি কমিয়ে পায়ের দিকে ছুড়ে দিল। উঁচু বালিশে শুয়ে শুয়ে একটা অসুখ তাকে ধরে ফেলেছে। আর কিছুদিন পরেই গলায় বগলস লাগিয়ে ঘুরতে হবে। এখনও সাবধান হওয়ার সময় আছে। তার ঘাড় কাত হয়ে যাচ্ছে। গর্দানে অনেক মাংস হয়ে গলাটি হারিয়ে গেছে। এখন তার ধড়ের ওপর মাথাটি স্রেফ কাটামুণ্ডুর মতন জুড়ে দেওয়া বলে মনে হয়।

খালি গায়ে পাজামা পরে পাশের ঘরে গেল। আবার সুইচ টিপে আলো করে নিল ঘরখানা। মশারি তুলে ঘুমন্ত ছোট মেয়ের গালে একটা চুমু দিল। মুশকিল বাধাল বড় মেয়ে। কাঁথা টেনে মুখ খুঁজতে যেতেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, রোজ খেয়েদেয়ে রাত করে ফিরবে। ঘুমোও না গিয়ে—

চুমু দেবার জন্য সুকুমারের মুখ নিচু হয়ে এসেছিল। মুখ জায়গামত তুলে নিয়ে বলল, কেন? গন্ধ পেলি?

এখন জ্বালিয়ো না যাও। বলে মেয়ে পাশ ফিরে শুল। আবার কাঁথা দিয়ে মুখখানা ঢেকে ফেলল।

নিজের ঘরে ফিরে এসে সেই চুমোটা বউয়ের গালে দিল। অঘোরে ঘুমুচ্ছিল বলে কিছুই টের পেল না। বউকে আবার ভাল করে দেখল সুকুমার। ভগবান যে কি করে মেয়েলোক বানায়। একটু বেঁকে শুলেই অন্যরকম। তখনই পাওয়ার ইচ্ছে হয়। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল। এভাবে অপমান সহ্য করে বউয়ের ঘুম ভাঙিয়ে আদর করতে তখন রাজি ছিল না সুকুমার। বিয়ের পর এত বছর হয়ে গেল—কই? কোনওদিন তো বেলা তাকে নিজে দু হাতে গলা জড়িয়ে একটা চুমু দেয়নি। একবারও ওগো বলে ডাকেনি। এত সংযত কেন? এরই নাম কি অহংকার? না, ফ্রিজিড?

দু-একবার জিজ্ঞাসাও করেছে সুকুমার। তুমি এ-রকম কেন?

কি রকম?

একদিনও তো নিজে থেকে একটা চুমু খেলে না আমায়।

ওগো হ্যাঁগো ওসব বাড়াবাড়ি আমার একদম আসে না।

সুকুমার নিজেকে প্রশ্ন করল একটা।

তোমার কি এসবের আর বয়স আছে?

আলবৎ আছে।

না। নেই।

কেন নেই?

কারণ, তুমি বুড়িয়ে গেছ। তুমি জোরে হাসতে পারো না। হাসলে ঠিকই আওয়াজ হয়। আর হা করে হাসলে খুনির মতো লাগে।

কিন্তু আমি তো একটা পোকাকেও কোনও দিন ব্যথা দিইনি। সিলিং থেকে টিকটিকি নীচে পড়লে আলগোছে তুলে দিই।

কিন্তু আমি তো একটা পোকাকেও কোনও দিন ব্যথা দিইনি। সিলিং থেকে টিকটিকি নীচে পড়লে আলগোছে তুলে দিই।

তবু তোমাকে খুনির মতো দেখায় হাসলে।

আমি তো বেশির ভাগ সময় গম্ভীর থাকি।

তখন তোমাকে গরুর মতো নির্বোধ লাগে।

কোনও ব্যক্তিত্বই ফুটে ওঠে না? মানে যাকে বলে পার্সোনালাটি। চার্ম?

একদম না। গম্ভীর অন্যমনস্ক অবস্থায় তোমাকে আরও খাবাপ লাগে। মনে হয় কোনও মতলব ভেজে চলেছ।

তা সত্যি। আমার লাকটাই এরকম। বেশির ভাগ লোক আমাকে ডিসলাইক করে। অথচ দেখি দু’-একজনকে, তাদের কোনও চেষ্টা ছাড়াই বেশির ভাগ লোক তাদের খুব লাইক করে।

তবে!

নিজের সঙ্গে এরকম কথোপকথনের পর সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়—হাইট পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, উমর তিতাল্লিশ, ছাতি একচল্লিশ—আলমারির আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে পাজামা ছেড়ে ফেলল। নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে কোথাও মনে হল না শ্যাওলা পড়েছে। বাঁ উরু এবং গাল বেশ গরম। এসবের ভেতর দিয়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছিল। চর্বি থাক থাক জমে ছিল। প্রায়ই পান করা সত্ত্বেও ব্লাড ক্লোরোস্টাল খুব নর্মাল।

প্রতিবেশীদের দোতলার জানলাগুলি খোলা। অন্ধকার। সুকুমারের একতলা ফ্ল্যাটের টানা খোলা লাল বারান্দায় আলো জ্বালিয়ে নিল। নিশুতি রাতে পরিত্যক্ত বিয়েবাড়ির চেহারা। সেখানে নিজের মনোমত স্টাইলে সুকুমার নিজের আবিষ্কৃত মুদ্রায় নাচতে শুরু করে দিল।

ফাঁকা বারান্দায় আলোর নীচে নিজের নাচ সুকুমারের খুব ভাল লাগতে লাগল। এক একটা পাক দিয়ে কোমরের ওপরের দিকটা ঘুরিয়ে নিয়েই মনে হয়—আমি পারি। ঠিক উদয়শংকরের মতো। চিবুকের নীচে বাঁ হাতের পাতা পাত্রের মতো ধরে মাথাটি নাড়াল। একেবারে একদম কত্থুক ভঙ্গি। নিজেকেই শুনিয়ে সুকুমার বলল, কী গ্রেস!

এমন সময় সুকুমারের মনে হল উলটোদিকে দোতলার ঝুলবারান্দায় আলোর একটা লাল ফুলকি রেলিংয়ের বাইরে ঝুলছে। অর্থাৎ বেশি রাতে বাড়ি ফিরে গণেশ ডাক্তার সিগারেট টানছে। ঘুম আসছে না।

সুকুমার তার নাচের স্পিড বাড়িয়ে দিল। নিজের মুদ্রায় সুকুমার যখন বিভোর—তখন ঝুলবারান্দা থেকে প্রশংসার তিনটি হাততালি পর পর ভেসে এল। অন্ধকার অডিটরিয়ামে দর্শক একমাত্র গণেশ। শর্টে গেণু ডাক্তার। তবু সুকুমার যেন বিরাট হলঘরের বিশাল দর্শকপুঞ্জকে কৃতার্থ করে দিচ্ছে—নাচ থামিয়ে সেই ভাবে নুয়ে পড়ে বাও করল।

কতটা হয়েছে আজকে? গেণুর একদম মাজা গলা। বাড়ি গিয়ে দেখালে আট টাকা ভিজিট। চেম্বারে ষোল। ভিড় লেগেই থাকে। নিজের গাড়িতে পাখা এবং চিক লাগিয়েছে। ফ্রিজে ছানা রেখে খায়। চোখ দেখাতে গিয়ে সুকুমার একদিন খেয়েছিল। তার আজকাল খালি চোখে ক ব ষ খ—সব সমান লাগে। পড়তে গিয়ে মনে হয় প্রতিটি হরফের গা থেকে ছাল উঠে গেছে।

তোমার কতটা?

আজকাল বেশি পারি না। দুটো বড়—একটা ছোট। তাই মাথা ভার লাগে।

একটু নেচে নাও না। হালকা হয়ে যাবে।

নাচার মতো অতটা খাইনি। তুমি তো বেশ নাচো।

খারাপ নাচব কেন? নাচ আমাদের ধর্ম এখন।

কলকাতার বাড়িগুলো পাশাপাশি। গেণু ডাক্তারের ঝুলবারান্দা থেকে ফিতে ফেলে মাপালে সুকুমারের লাল বারান্দা দশ ফুটের ভেতর। নাচ আমাদের ধর্ম এখন—বলেই সুকুমার আবার নাচতে শুরু করে দিয়েছে। নিওনের আলো পড়ে তার উরু দু’খানি তরুণ শালতরুর মাংস মাখানো হাড় হয়ে অন্ধকারে আলোয় একবার ঝলকাচ্ছিল, একবার হারিয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই সদা সদ্য নিজের আবিষ্কৃত সব মুদ্রায় দুঃসাহসিক শরীর ঘোরানো পা মেলে দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে সুকুমার আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিল। আমি যে এত সুন্দর নাচি কোনও দিন জানতাম না তো!

একথা ভেবেই একটা বিশ্বাস ফিরে আসছিল মনে। সেই জোরেই বলল অনেক আগেই আমাদের নাচা উচিত ছিল।

আর নেচো না। গা ব্যথা করবে। অভ্যেস নেই তো।

তা কেন। তোমার মতো অল্পেই গলে যাই না আমরা। চেম্বারে এয়ার কুলার বসিয়েছে।

সে তো তোমাদের মতো পেশেন্টদের জন্যে।

সারা দিন ভিজিট কত পাও?

গুনে দেখিনি।

না গুনেই ব্যাঙ্কে পাঠাচ্ছ!

ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ঘরে গিয়ে একটা লুঙি পাজামা যা হয় পরে ফেল।

তা তো বলবেই। নাড়ি টিপে এখন অঢেল পয়সা।

পরিশ্রম করে পাই।

কচু পরিশ্রম। ডাক্তারি শাস্ত্রটাই আন্দাজি।

মাঝ রাতে এ নিয়ে তোমার সঙ্গে আর তর্কে যাব না সুকুমার। কলম পিষে কী এমন হাতি ঘোড়া করছ শুনি?

একথায় সুকুমার তেরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। আমার মাইনে কত জান?

কত?

মাসে ন’ হাজার টাকার মতো।

কি রকম?

আমার ওপরওয়ালা যিনি কাজ দেন তার দিনে মাইনে সত্তর টাকার মতো। আমি সে-কাজটা করি। আমার দিন মাইনে পঞ্চাশ টাকার মতো। সে-কাজটা যিনি চেক করন—তার দিন মাইনে তিরিশ টাকা। এসব কাজ যিনি অবহেলায় ফেলে দিয়ে সন্ধেয় ক্লাবে যান তার দিন মাইনে দেড়শো টাকার মতো। সব মিলিয়ে তিনশো টাকার মতো আমার কাজের জন্যে খরচ হয়। তার মানে মাসে ন’ হাজার টাকার মতো খরচ। তারপর সে সব কাজ ফেলে দেওয়া হয়।

বেশ আছ!

কোথায় ভাই! এর চেয়ে যখন আমরা দু’জনে স্কুলে পড়তাম—তখন সব কাজের একটা মানে ছিল। তাতে যত অল্প পয়সাই লাগুক। এখন কত খরচ হয়। অথচ কোনও কাজের কোনও মানে হয় না। যত বছর যাচ্ছে—তত মাইনে বাড়ছে। অথচ কোনও কাজ নেই। রবীন্দ্রসংগীত, ভাষাতত্ত্ব, পূর্ব ভারত, ব্ৰজেন শীল নিয়ে কী সুন্দর আলোচনা করে যাচ্ছি। বলতে বলতে সুকুমার আবার নাচতে শুরু করে দিল।

ভেতরে শুতে যাবার আগে গণেশ ডাক্তার চেঁচিয়ে বলে গেল, আলোটা নিভিয়ে নাচো। এখন বয়স হয়েছে তোমার। কে কোনদিক থেকে দেখে ফেলবে।

সুকুমার আলোটা নিভিয়ে দিল। সে-জায়গায় রাত করে পাঠানো চাঁদের আলো এসে সুকুমারের সঙ্গে নাচে জয়েন করল। একটু তামা মাখানো আলো। তাই ময়লা মতো। তার ভেতরে সুকুমারের ভালই লাগছিল নাচতে।

অফিস। সংসারের প্রয়োজনের গর্তগুলোয় নানারকমে নোট জোগাড় করে এনে গুঁজে দেওয়া ইত্যাদি করার পর সে আর কোনও দিন নিজেকে এমন করে পায়নি। পাওয়ার মধ্যে নাচের মতো ঘাম ঝরানো একটা বাপার থাকায় সুকুমার রীতিমতো সুকুমারকে টাচ করতে পারছিল।

এই সময় বেলা বারান্দায় উঠে এসে নাচিয়ে সুকুমারকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ভ্রূ কুঁচকে গেল। কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে কলঘরে চলে গেল। ফি রাতে মোট তিনবার যায়। বড় পাতলা ঘুম হয়ে গেছে ইদানীং। ফিরে এসে বলল, কি হচ্ছে শুনি? এসব কি! এভাবে একটা ধাড়ি লোক—

আমার কেউ নেই বেলা—তাই—একা একা—দেখছিলাম—

কি করে কেউ থাকবে শুনি। রোজ যদি খাওয়াদাওয়া করে ফেরো! না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। খাও কেন বলতো?

খাবার পর ঠোঁটের নীচে বাঁ দিকে একটু কাঁপতে থাকে। ঝিমুনি একদম থাকে না। তখন সিগারেট টেনে কত সুখ। খিদে বেড়ে যায়—

তবে খাও না কেন বাড়ি এসে?

আগেই অনেক কিছু খেয়ে ফেলি তো। তাছাড়া—

কি?

একা একা কোন শালা ভাত খায় বলো। লাইট জ্বালিয়ে—

তোমার এখন থেকে একাই কাটবে। যাও। দেখতে ভাল লাগছে না। আমি কতক্ষণ না খেয়ে বসে থাকব বলতে পার?

তখনই সুকুমার আবার নাচ শুরু করে দিল। বেলার কাছাকাছি এসে পাক খেয়ে পিছিয়ে গেল। যাবার সময় বলল নাচ আমাদের এখন ধর্ম। তুমি এই ধর্ম নেবে? নাচতে নাচতে ফিরে এসে বেলার কাছে চিবুকটা কত্থকের ভঙ্গিতে দুলিয়ে আবার বলল, এই ধর্ম তুমি নেবে? স্বামীর ধর্ম?

বেলার মুখে এসেছিল, শুয়োর। কিন্তু স্বামীকে কোনও দিন এসব কথা বলেনি বলে আস্তে বলল, বিচ্ছিরি। কালই আমি সালকে চলে যাব।

সালকে সুকুমারের শ্বশুরালয়। সেখানে বর্ষাকালে গেলে তার পাম্পসু আমসত্ত্ব হয়ে যায়। নাচ না থামিয়েই সুকুমার আবার বলল, তোমার স্বামীর ধর্ম নেবে?

অসভ্যতা? তাই নিতে হবে। যে কোনও বাড়ির আলো জ্বললেই তোমায় এ অবস্থায় দেখতে পাবে। ভেতরে এসো।

কেউ এখন আলো জ্বালবে না। নিজের ওপর মুদ্রায় হাতের আঙুলগুলো ঘোরালো সুকুমার। বিশেষ ঘোরে না। গাঁটে গাঁটে চর্বি। তরমুজ সমেত কোমরটি বেঢপ। চাঁদের ময়লা লাইটে প্রাচীন মূর্তি হয়ে বেলা দাঁড়ানো।

জামাকাপড় পরে এসে খাও।

এরকম কি তুমি আমায় আগে আর দ্যাখোনি?

অনেকবার দেখেছি। নেশা কেটে গেলে গা ব্যথা হবে খুব।

ব্যথা মনে থাকে। ভালবাসা মনে থাকে। তুমি আমায় আর ভালবাসো না কেন?

বন্ধুদের ভালবাসা তো পাচ্ছ অনেক।

হ্যাঁ, খুব মেশামিশি হচ্ছে।

যাও পাজামা পরে এসো। আর নেচো না। মেয়েরা হঠাৎ জেগে উঠতে পারে।

ওরা এখন জাগবে না। এই দ্যাখো অরিয়েন্টাল ডান্স। এরকম পারবে?

হাঁফাচ্ছ তো। একটু জিরিয়ে নাও বরং।

একথায় সুকুমার বারান্দার বেঞ্চটায় বসে পড়ল। কোমরে দুটো বড় ঘামের ফোঁটা। হাসতে হাসতেই আস্তে বলল, কাছে এসে বোসো না।

বসব। কিন্তু ছোঁবে না বলে দিলাম।

কেন বলতো? ছুঁলে পুড়ে যায়?

বসতে বসতে বেলা বলল, ওকি অসভ্যের মতো বসেছ? বাবু হয়ে বোসো। পা ভাঁজ করে বসতে জান না?

সে তো ট্রাউজার পরলে বসি। এখন তো দিব্যি চাঁদের আলোয় আছি। বলে সুকুমার বেলার কাঁধে ডান হাতখানা রাখল। যেন বিয়ের আগেকার তারা দুজন সন্ধের কোনও পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। পার্থক্য শুধু: বেলা চাররকমের চারটি জিনিস পরে আছে। শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার। আলো থাকলে দেখতে পেত, কাজলও আছে চোখে। কপালে সিঁদুরের টিপ। হাতে লোহা, শাঁখা এবং চুড়ি। কানে নতুন কানপাশা।

সুকুমারের গায়ে কোনওরকমের কিছু নেই। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল তার। মোটর মিস্ত্রিব ওভারঅলের মতো শুধু একখানা চামড়া দিয়ে সারা গা মোড়া। এখন তা গরম। এখানা নিয়েই জন্মেছিল। ইলাসটিক। তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সমান তালে বেড়ে বেড়ে সবসময় তার মাংস, চর্বি, হাড়, রক্তের ওপর এই চামড়াখানি লেগে আছে। তাতে কোথাও কোথাও ফুটো। সেখানে চোখ, নাক, কান ইত্যাদি সব বসানো।

লোকে বাজার করে। সংসার করে। ছেলেমেয়ে পড়ায়। রেশান আনে। তার কোনও ঝঞ্ঝাট তোমাকে পোহাতে দিই না আমি।

একটা ঝক্কি আমি পোহাই কিন্তু। টাকা আনি। অফিসে গিয়ে ঘর ঝাঁট দিই। বাসন মাজি। কাপড় কাচি। বাবুদের গা টিপি। তাদের মন বুঝে হাসি৷ মন বুঝে কাশি। তাতে ভালবাসা আসে না। মেশামিশি হয় না। সব বাসি গন্ধ বেরোয়। তার নাম কাজ। কতকগুলো মরা কাজ। সেজন্যে মাসে মাসে টাকা দেয়। তাই নিয়ে আমাদের সংসার হয়।

কি বাজে বকছ সেই থেকে। সবাই তো এরকমই করে।

আমিও তো তাই বলছি। তুমি আমার ধর্ম নেবে?

কিসের ধর্ম?

এই নাচের ধর্ম। নাচ আমাদের ধর্ম এখন। এতে মিশে যেতে হয়। তাতে ভালবাসা-বাসি হয়। পুরনো ভাল ভাল দিন তাতে ভেসে চলে আসে। একদম তীরে। দাঁড়ালেই দেখা যায়।

কতটা খেয়েছ আজ? কে কে ছিলে বলতো!

সবাই ছিল। সবাইকে চিনতে তুমি। ছুঁতে পারবে না কিন্তু। আমাদের ধর্ম নিলে তবেই না টাচ করা যায়। এসো নাচি। লজ্জা কিসের? এসো না—

উঁহু। আমার হয় না। আমার আসে না।

তুমি আসতে দাও না বলে আসে না। গান জানো তবু গাও না। তুমি গাইলে আমি তোমায় কত টাচ করতে পারি। ভালবাসতে পারি। আমি জানলে তো নিশ্চয় তোমাকে শোনাতাম। ছোঁবে না—

চেষ্টা করলে পারো।

সুকুমার তখন নাচতে নাচতে বলছিল, আমার হয় না। আমার দেখছি—আজই রাতে দেখছি— আমি কত সুন্দর নাচতে পারি। বলতে বলতে সুকুমার প্রবাহিত স্রোতের প্রথম ঢেউটির ধারায় বাঁ পা খানা এগিয়ে প্রায় ভেসে বেলার কাছে চলে এল। তখন দু’খানা হাতের পাতা দুটি ছায়াসত্রের মতো তার মাথা ও চিবুকের নীচে। সেই অবস্থায় পাকা কত্থক শিল্পীর স্টাইলে সে তার আস্ত মাথাটা বেলার মুখের কাছে নিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে ফিরে এল।

তখন বেলার চোখে যে-দৃষ্টি তার অর্থ মরণ!

তাতে একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে নাচতে নাচতেই সুকুমার বলল, তুমি আমার ধর্ম নেবে?

কোনও জবাব না পেয়ে এবার সুকুমার তার নিজের তৈরি স্রোতধারার ভেতর নিজস্ব মুদ্রায় ভাসতে ভাসতেই বলল আমার বড় গান শিখতে ইচ্ছে করে। গুন গুন করে।

শিখলে পারো।

হারমোনিয়াম নেই। সরগম জানি না।

কিনে দেব। শিখিয়ে দেব। বলেই বেলা সবে টের পাচ্ছিল, সে কতকাল পরে আবার সুকুমারের সঙ্গে মেশামেশি করতে পারছে। প্রায় ভালবাসাবাসির মতো। এখন বোধহয় সে সুকুমারের ধর্ম নিতে পারে। তাই ভেবে যেই না নিজস্ব মুদ্রায় প্রবাহিত হতে গেল—অমনি অন্ধকার বারান্দায় গণেশ ডাক্তারদের আলো এসে লাফিয়ে পড়ল। সেই ঝোঁকেই বেলা একলাফে ঘরে। গেণুর বউ শেষরাতে অনেক ফেনা করে রোজকার মতো বারান্দার বেসিনে দাঁত মাজতে শুরু করেছে। তারই আলো।

ভেতরে এসো বলছি।

সুকুমার যেতে পারছিল না। মাত্র একটা লাফ দিলেই ঘরে যাওয়া যায়। সেটা কিছুতেই টপকাতে পারল না। সে তখন স্বচ্ছন্দ শরীরে তারই নিজের বানানো স্রোতে অবলীলায় এগোচ্ছিল, পিছোচ্ছিল।

তোমার বন্ধুর বউ দেখতে পেলে কিন্তু একটা কেলেঙ্কারি হবে। সারা পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে যাবে।

সুকুমার তার প্রবাহে ভাসতে ভাসতেই বলল, ওকে আমার ধর্ম নিতে বলব।

৩ আগস্ট ১৯৭৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *