নিশীথদা

নিশীথদা

কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র, খ্যাতনামা ব্যারিস্টার, নিঃস্বাৰ্থ দেশসেবক শ্ৰীযুক্ত নিশীথচন্দ্ৰ সেন ইহলোক ত্যাগ করেছেন। এদেশের বহু গুণী জ্ঞানী, বহু প্ৰখ্যাত কমী তার সংস্রবে এসেছিলেন—এমন কি একথা বললে ভুল বলা হবে না যে, দেশসেবা করেছেন, কিন্তু শ্ৰীযুক্ত নিশীথ সেনের সঙ্গে তার যোগসূত্র স্থাপিত হয় নি, এরকম লোক বাঙলা দেশ দেখে নি। তাই নিৰ্ভয়ে বলতে পারি, কৃতী নিশীথ সেনের কর্মজীবনের প্রশস্তি কীর্তন করার লোকের অভাব হবে না।

আমি কিন্তু নিশীথদাকে সেভাবে চিনি নি। আমি তাঁকে পেয়েছিলুম। বন্ধুরূপে, তার জীবন-অপরাহ্নে। তিনি তখন কলকাতার ভিতর-বাইরে এতই সুপরিচিত যে প্রথম আলাপের দিন কেউ আমাকে বুঝিয়ে বলল না, নিশীথ সেন বলতে কি বোঝায়। তারপর নানা রকম গাল-গল্পের মাঝখানে কে যেন আমাকে বললে, ‘আনন্দবাজারে যে ইংরেজকে একটু-কাঁটব্য আরম্ভ করেছ (আমি তখন সত্যপীর’ নাম নিয়ে ঐ কাগজে কলমে ধার দিচ্ছি) তার আগে খবর নিয়েছ কি, সিডিশন, ডিফেমশন, মহারাণীর বিরুদ্ধে লড়াই, এসব জিনিসের অর্থ কি?’ আমি কোনো কিছু বলবার আগেই নিশীথ সেন বললেন, ‘আমরাই জানি না, উনি জানবেন কি করে? আপনি তো দর্শনে ডক্টর, না? আমি সবিনয়ে বললুম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ নিশীথ সেন আমার দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, ইংরেজ তার সমালোচককে জেলে ঠেলবার জন্য যেসব আইনকানুন বানিয়েছে, সেগুলো কোন স্থলে প্ৰযোজ্য, কাকে সেই ডাণ্ডা দিয়ে ঠ্যাঙানো যায়, তার টীকাটিপ্লনী, নজীর-দলিল। ইংরেজ আপন হাতেই রেখেছে। সুবিধেমত কখনো সেটা টেনে টেনে রবারের মত লম্বা করে, কখনো ফাঁদ ঢিলে করে পাখিকে উড়ে যেতেও দেয়। এ দেখুন না, লোকমান্য টিলককে যে আইনের জোরে জেলে পুরল, সে আইন ওরকম ধারা কাজে লাগানো যায়। সে কথা একেবারে আনাড়ি উকিলও মানবে না। তবু টিলককে তো জেলে যেতে হল। তাই সিডিশন কিসে হয়। আর কিসে হয় না, সেকথা ঝানু উকিলরা পর্যন্ত আগেভাগে বলতে পারে না। ইংরেজ যদি মনস্থির করে আপনাকে আলিপুর পাঠাবে। তবে সে তখন আপনার বিরুদ্ধে অনেক নূতন-পুরাতন আইন বের করবে। আমরা—অর্থাৎ উকিল ব্যারিস্টাররা-তখন তার বিরুদ্ধে লড়ি, সব সময়ে যে হারি তাও বলতে পারি নে।’ তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমার ফোন নম্বরটা জানেন তা? কোনো অসুবিধে হলে ফোন করবেন! আমি যা পারি করে দেব।’

প্যারীদা কান পেতে শুনছিল, লক্ষ্য করি নি। তক্ষুনি বললে, নম্বরটা টুকে নাও, ওহে আলী। কাজে লাগবে।’

পরে খবর নিয়ে জানতে পারলুম, নিশীথদা কত বড় ডাকসাইটে ব্যারিস্টার এবং তার চেয়েও বড় কথা, সেই আলিপুরের আলম থেকে আজ পর্যন্ত পাঁচজনের জানা অজানাতে কত অসংখ্যবার ফীজ না নিয়ে বিপ্লবীদের জন্য লড়েছেন। লোকটির প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে উঠলো।

কিন্তু থাক এসব কথা। পূর্বে নিবেদন করেছি, এসব কথা গুছিয়ে বলবার জন্য লোকের অভাব হবে না।

নিশীথদা প্ৰায় আমার বাপের বয়সী ছিলেন, কিন্তু কি করে তিনি যে একদিন দাদা হয়ে গেলেন এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলুম, তাকে ‘তুমি’ বলতে আরম্ভ করে দিয়েছিসে শুধু যাঁরা নিশীথদাকে চিনতেন তাঁরাই বলতে পারবেন।

একই প্লেনে শিলং গেলুম, সেখানে প্যারীদার বাড়িতে উঠলুম। সিগার ফুকতে ফুকতে আমার ঘরে ঢুকে খাটের একপাশে বসে বললেন, ‘কবি (বিশ্বসাক্ষী, আমি কবি নই), চমৎকার ওয়েদার, বাইরে এসো।’ বাইরে মুখোমুখি হয়ে বসলুম, তিনি নানা রকমের প্রাচীন কাহিনী বলে যেতে লাগলেন; অরবিন্দ ঘোষ, সুরেন বাঁড়ুয্যে, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, রাসবিহারী ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, আশুতোষ মুখুজ্যে, আব্দুর রসুল এঁদের সম্বন্ধে এমন সব কথা বললেন, যার থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলুম যে, কতখানি পাণ্ডিত্য, কত গভীর অন্তদৃষ্টি এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকলে পরে মানুষ এত সহজে বাঙলা দেশের পঞ্চাশ বৎসরের ইতিহাস এবং তার কৃতী সন্তানদের জীবনী একবার মাত্র না ভেবে অনর্গল বলে যেতে পারে। আজ আমার দুঃখের অবধি নেই, কেন সেসব কথা তখন টুকে রাখলুম না।

আমি মুর্খের মত মাঝে মাঝে আপত্তি উত্থাপন করেছি এবং খাজা গবেটের মত আইন নিয়েও। নিশীথদার চোখ তখন কৌতুক আর মৃদুহাস্যে জ্বলজ্বল করে উঠত। চুপ করে বাধা না দিয়ে শুনতেন। তারপর মাত্র একদিন চোখা যুক্তি দিয়ে আমাকে দুটুকরো করে কেটে ফেলতেন। আমার তাতে বিন্দুমাত্র উত্তাপ বোধ হয় নি। তাই শেষের দিকে যখন যে সব জিনিস নিয়ে আমি মনে মনে দম্ভ পোষণ করি, এই লোকটির সংস্রবে। আসতে পেরেছি বলে।

কী অমায়িক অজাতশত্রু পুরুষ! আর কী একখানা মেহকাতর হৃদয় নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। আইন আদালতের খররৌদ্র তার সে শ্যামমনোহর হৃদয়ে সামান্যতম বাণ হানতে পারে নি।

তার বয়স তখন সত্তর। সেই শিলঙে একদিন সকাল বেলা দেখি, ড্রেসিং গাউনের পকেটে হাত পুরে বারান্দায় ঘন ঘন পইচারি করছেন, মুখে সিগার নেই। কথা কয়ে ভালো করে উত্তর পাইনে। কি হয়েছে, ব্যাপার কি নিশীথদা?

তিন দিন ধরে স্ত্রীর চিঠি পান নি।

সে কি নিশীথদা, সত্তর বছর বয়সে এতখানি?

সেই জ্বলজ্বলে চোখ-সে চোখ দুটি কেউ কখনো ভুলতে পারে।–দিয়ে বললেন, ‘কবি, সব জানো, সব বোঝে, কিন্তু বিয়ে তো করো নি, তাহলে এটাও বুঝতে।’

নিশীথদা, বউদিকে বড্ড ভালোবাসতেন। আমি জানি নিশীথদা আরো কিছুদিন কেন এ সংসার থাকলেন না।

ফেব্রুয়ারি মাসে অখণ্ডসৌভাগ্যবতী শ্ৰীমতী শোভনা ইহলোক ত্যাগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে নিশীথদার জীবনের জ্যোতি যেন নিভে গিয়েছিল।

আজ বোধ হয় নিশীথদার আর কোন দুঃখ নেই–আমাদেরও দুঃখের অন্ত নেই।

ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *