নিশীথ
মা,
আমার বড্ড ভয় করছে। নিশীথ আজ একটা অদ্ভুত কথা বলল— ও আমাকে আর ভালবাসে না। আমি নাকি ওর উপযুক্ত নই। আমি কিছু অ্যাচিভ করিনি। আমার কোনও গুণ নেই যে ওর পাশে দাঁড়াতে পারি। ও ক্রমশই উঁচুতে উঠছে মা, আর আমি ওর চোখে ততই ছোট আরও ছোট হয়ে যাচ্ছি। মা, আমি কি চেষ্টা করলেও সোশ্যালাইট টাইপ হতে পারব? আমার যে একদম ভাল লাগে না। তার চেয়ে অনেক ভাল লাগে শায়রীকে নিয়ে খেলা করতে। ওকে পড়াতে। যে ক’জন বন্ধুবান্ধব আছে তাদের ফোন করতে। তোমাদের ফোন করতে। —আমি কি চলে যাব মা? তোমাদের ফোন খারাপ। এই চিঠি কত দিনে পৌঁছোবে, কে জানে। তত দিনে হয়তো তোমার ঈশা আর নেই।
রঞ্জা তিরের মতো উঠে দাঁড়াল। স্তব্ধ টেলিফোনযন্ত্রের দিকে চেয়ে বলল — বি. এস. এন. এল— তুমি নিপাত যাও।
নিজের মোবাইল থেকে তৎক্ষণাৎ ঈশার নাম্বারে ফোন করল।
—হ্যালো!
—ঈশ্—মা বলছি। তুই আমার মোবাইলে ফোন করতে পারতিস তো।
—নম্বরটা ভুলে গেছি মা, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
—কোথাও লিখে রাখিসনি?
—নাঃ, খুঁজে তো পাচ্ছি না।
—তোর টেলিফোন-বুকটা নে, এক্ষুনি লিখে রাখ— নাইন এইট ওয়ান…
—আমার টেলিফোন বই নেই যে।
—সে কী?
—কোথাও ছিল। এখন কোথাও নেই। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। সেই যে তুমি ডায়েরিটা দিয়েছিলে, সফ্ট, ব্লু রঙের— সেটাও না, কুক-বুকগুলোও নেই। কে আমার সব দরকারি জিনিস ওলটপালট করে দিচ্ছে মা। ওলটপালট ধুলট পুরাণ জীবন ওড়ে, ইন্দ্রপতন হচ্ছে মাগো আকাশঘরে, কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না আর ধুলোর ঝড়ে, ভূ-হৃৎকম্পে জীবন ভাঙে জীবন গড়ে। কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না মা…. কিছুই খুঁজে কিছুই খুঁজে… মাগো একটা একানড়ে ভয় দেখাচ্ছে। ভীষণ ভয় মা, ভীষণ ভয় মা। সব জানলা সব দরজার কপাট ধরে…
—ঈশা— আ। ভয় নেই। ভয় কোরো না। এরকম কোরো না। আমি আছি— আমরা তো আছি।
ওদিকে ফোন নীরব হয়ে গেল। হাজার চেষ্টা করেও আর লাইন পেল না রঞ্জা। কিছু খুঁজে পাচ্ছে না! ভীষণ উথালপাথাল হয়ে রয়েছে। কীরকম যেন করছে! কী সব বলছিল—মনে করতে গিয়ে হঠাৎ সে আবিষ্কার করল—ঈশা যা বলছিল সেটা একটা কবিতা, তার ছন্দ আছে, মিল আছে। ও কি কবিতা লিখছে? লিখতেই পারে! কিন্তু কেমন যেন প্রলাপের মতো কবিতা। ও লেখেনি। বলেছে মাত্র। ভূ-হৃৎকম্প। নিজের মানসিক অবস্থা বোঝাতে ঈশা এই অদ্ভুত শব্দটা বার করেছে। সে মনে করে করে পুরোটা লিখে ফেলল নিজের ডায়েরিতে। ইন্দ্রপতন, ভূ-হৃৎকম্প… একানড়ে….. লেখেনি, বলেছে। উক্ত কবিতা। সে শুনেছে—শ্রুতি। শ্রুতিই তো ছিল, ছিল ওর্যাল ট্র্যাডিশন… সব ভুলে গেছে শুধু ডায়েরির সফ্ট ব্লুটা ওর মনে আছে? হালকা নীল— ওটাই বোধহয় ঈশার মনের রং। নীলের রহস্য, মিস্টিক একটা দূরত্ব, গভীর, খুব নরম, খুব ভঙ্গুর, খুব দুর্বল। নিশীথ বুঝতে পারল না! মর্যাদা দিতে পারল না! আর সেটা প্রকাশ করছে এই এখন ন’ বছর পরে, যখন মেয়ের বয়স সাত পেরিয়ে গেছে! একটা অন্ধ রাগ, ভয়ানক আক্রোশ ঝড়ের সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো লাফিয়ে উঠল ভেতরে। ভেবেছে কী নিজেকে ছেলেটা? এত অহংকার? কীসের অহংকার এত? টাকা রোজগার করছিস এত এত? তাই? যখন প্রায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলি ঈশাকে চেয়ে! কিছুতে দিতে চায়নি তারা। অত তাড়াতাড়ি! অত আদরের ছেলেমানুষ মেয়ে! —কেন চাও বিয়ে করতে— নিশীথ! — নিশীথ অপ্রস্তুত মুখে চুপ। সুবীর ধরিয়ে দিচ্ছে কথাটা! —ডু ইউ লাভ্ হার?
—হ্যাঁ, আর কী জন্যে মানুষ….. নিশীথ কথা শেষ করে না।
—তুমি কি নিশ্চিত, বাইরের রূপটা দেখে মোহগ্রস্ত হওনি?
—আ অ্যাম ম্যাচুঅর এনাফ টু-আন্ডারস্ট্যান্ড দি হোয়াই অব মাই ফিলিংস।
ভালবাসা কিন্তু কোনও বাইরের চাহিদার ওপর নির্ভর করে না। — দাঁতে দাঁত চেপে বলল রঞ্জা।—ভালবাসা…জানো তোমরা শব্দটার পুরো মানে? কেন ব্যবহার করো? কেন করেছিলে? কতকগুলো ব্যবহারিক কাজ-কর্ম, রান্না-ঘর সাজানো—ঠিকঠাকমতো সেবা। বাইরের অতিথিদের আপ্যায়ন, নিজেরা পার্টিতে শামিল হওয়া। ছেলেমেয়ের জন্ম, ও তাদের মানুষ করার পুরো দায়িত্ব সামলানো একা-একা—এই সব হল—কারণ—বিয়ের পেছনে। ভালোবাসা-টাসা আবার কী? যে মানুষটা অন্তর্মুখী স্বভাবের, মিশুকে নয়—তাকে দিয়েও সামাজিকতা হয়। হয় বই কী! তার তরিকা আছে কতকগুলো। রঞ্জার সেজদাদা মিলিবউদিকে কীভাবে গাইড করেছে। এত ভিতু, মুখচোরা ছিল মিলিবউদি! তাকে ভালবেসে, সম্মান দিয়ে, সবাইকে বুঝতে দিয়ে যে হতে পারে এ তত ওস্তাদ সামাজিক নয়। কিন্তু একে আমি ভালবাসি। এখন সে কী করবে? কী করবে? মা হয়ে সে সাহস দিতে পারে। আশ্রয় দিতে পারে। কিন্তু স্বামীর থেকে প্রাপ্য যে ভালবাসা, সম্মান—তা কি দিতে পারে? এত সহজ! বলে দিল—আর তোমাকে ভালবাসি না! কী ভীষণ কঠোর কথা! কেউ কাউকে বলে? জীবন এগোতে এগোতে কতজনের জীবনসঙ্গীর ওপর ভালবাসা ক্ষয়ে যায়। আর সেই মাদকতা, সেই মাধুর্য থাকে না। মায়া থাকে, বিশ্বাস থাকে। মুখে বলে ওঠা— আর আমি তোমাকে ভালবাসি না…. এত নিষ্ঠুরতা? মেয়েটা একেবারে ভেঙেচুরে গেছে! এখন যদি একটা নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হয়! চন্দ্রকেতুগড়ের কাজ জোর চলছে, এখন এই বিপদ! সে কী করে সামলাবে?
—সুবীর! সুবীর! —সে আর্ত আকুল হয়ে ডাকল।
—কী হল আবার? অন্য দিকের ঘর থেকে আওয়াজ এল।
—শুনে যাও একবার, শোনো না!
জামাকাপড় পরতে পরতে এসে দাঁড়াল সুবীর…
—ঈশা বোধহয় খুব বিপদে পড়েছে।
—মানে?
—ওদের মধ্যে কোনও মন কষাকষি….
—সে তো দম্পতির মধ্যে নিত্য হচ্ছে— বিপদটা কী?
—ওকে একেবারে উদ্ভ্রান্ত শোনাল ফোনে। একটা চিঠি আজই এল। দেখো!
—ইডিয়ট! —চিঠিটা পড়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল সুবীর।
—নিশীথের মোবাইলটার নম্বর দাও দেখি।
—না, না। ভেবেচিন্তে কাজ করো। আগে মেয়েকে সাহস দাও, সান্ত্বনা দাও। ফট করে নিশীথকে কিছু বলতে যেয়ো না। কে জানে কী হয়েছে! সেন্টিমেন্টাল মেয়ে।
হ্যাঁ, সে কথা একশোবার সত্যি। ছিঁচ-কাঁদুনি মেয়ে তৈরি করেছ একটি। নিজে এমন সবলা হয়ে যে অমন অবলা একটি মেয়ে কেমন করে।
—সেক্ষেত্রে বলতে হয়—ও গুণটি ও বাবার থেকে পেয়েছে।
—বাঃ, অমনি আমার দোষ হয়ে গেল?
—না দোষ না। তুমি বললে, তাই আমিও বললাম। ওসব ছাড়ো। এখন তুমি মেয়েকে একটা ফোন করো তো!
সুবীরের ফোনটা কী ভাগ্য, লাগল।
—ঈশা, বাবা বলছি। কী হয়েছে তোর?
—কিছু না বাবা। আমি এখন দরকারে বেরোচ্ছি, সেই আবিদের দিকে। আজ আবার শায়রী তাড়াতাড়ি আসবে। টেস্ট হয়ে ছুটি হয়ে যাবে তো! রাখি বাবা। হ্যাঁ! ভেবো না।
—ঠিক আছে। যে কোনও পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা, মাথাটা পরিষ্কার রাখাই আসল। জীবনে অনেক সময়ে অনেক জটিল পরিস্থিতি হয়। বি কুল। র্যাশ কিছু ভাববে না, বলবে না, করবে না।
—কী বলল? —ফোন রাখতে রঞ্জা জিজ্ঞেস করল।
—কিছু তেমন না। আমি যা বলার তা তো বললুম, শুনলে। বলল— ভেবো না। ইমপালসিভ স্বভাব তো! সকালে বোধহয় কোনও কথা-কাটাকাটি হয়ে থাকবে। তাইতেই অশ্রু ঝরে, তাতেই দীর্ঘশ্বাস।
সুবীর বেরিয়ে গেল। যাবার সময়ে পেছন ফিরে বলে গেল— অ্যাগ্রেসিভ, ইগোয়িস্ট টাইপের। আমি কোনও দিনই স্বস্তি পাইনি। তোমার ওই জামাই…
—ইগোয়িস্ট তো সবাই— এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ— রঞ্জার মুখে এসেছিল, সামলে নিল।
তার শাড়ির প্লিট ভাল হল না। কোল-আঁচল বেরিয়ে রইল, সে টের পেল না, খানিকটা চুল মাথায় ঠিকঠাক বসেনি। রঞ্জা চন্দ্রকেতুগড়ে চলল। যেতেই হবে।