নিশি মিয়া
নিশি মিয়াকে আমি সেদিনের আগে কখনও দেখিনি। দেখেছি তাও অনেক দিন হলো। হয়তো সময়ের হিসাবে বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে গেছে। ঠিক মনে নেই কতদিন আগে। তবে তখন আমি মনে হয় ক্লাস ফাইভে কিংবা সিক্সে পড়ি। অনেক ছোট ছিলাম। গরমের ছুটিতে গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে কেউ থাকে না। আমরা শহরেই থাকি। সেই জন্য মাঝে মাঝে আমার স্কুল ছুটি হলেই বাবা-মা আমাকে নিয়ে ছুটে যান আমাদের বাড়িতে।
আমাদের বাড়িটা বিশাল। বিশাল বলতে আক্ষরিক অর্থেই বিশাল। কিন্তু মানুষজন নেই বললেই চলে। আমার দাদার একমাত্র ছেলে আমার বাবা আর আমি আমার বাবার একমাত্র ছেলে। বাবা ব্যবসা দেখার জন্য শহরে চলে। এসেছেন। সাথে আমার লেখাপড়ার চিন্তাও মাথায় ছিল। সেই জন্য আমাকে শহরে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়েছেন ভাল স্কুলে। কিন্তু বাবা গ্রামে কেয়ারটেকার রেখে সেখানকার সবকিছু পরিচালনা করেন। মাসে মাসে গ্রাম থেকে আমাদের জন্য চাল-ডাল আসে। আর প্রতি মৌসুমে আসে ফলফলাদি।
তবে কেয়ারটেকার বেচারা অনেক বুড়ো ছিল। আর সেই সুবাদে আমাদের বড় পুকুরের পাড়ে জংলায় আস্তানা গেড়েছিল নিশি মিয়া। খানিকটা পাগল টাইপের ছিল বলে তাকে আর কেউ ঘটায়নি। এমনকী আমার বাবাও নিশি মিয়াকে বেশ ভাল মতই দেখা-শোনা করার কথা বলে দিয়েছিলেন কেয়ারটেকারকে। কেন বলেছিলেন সেটা আমি জানি না।
সেদিন আমি বাড়িতে পৌঁছেই পাড়ার ছেলেদের সাথে মিলে খেলাধুলো করলাম। কিন্তু পরেরদিন বাবা যেই ছিপ নিয়ে পুকুর পাড়ে গেলেন, আমিও পিছু পিছু আরেকটা ছিপ নিয়ে বাবার থেকে দূরে আরেকটা ঘাটে বসে পড়লাম। বাবা শহুরে জীবনে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারেন না। তাই গ্রামে আসলেই বসে পড়েন বড় পুকুরের ধারে। আমিও বাবার কাছেই মাছ ধরা শিখেছি। কিন্তু আমার ছিপে মাছ সহজে আসে না। কী এক নেশা! এই নেশা সেই ক্লাস থ্রি থেকে আমাকে পেয়ে বসেছিল। মাঝে মাঝেই আমাকে নিয়ে বিভিন্ন লেকে মাছ ধরতে যেতেন বাবার। কিন্তু গ্রামে আসলেই আমাকে না বলেই চলে যান মাছ ধরতে। আর আমিও বাবার সাথে পাল্লা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করি।
সেদিনও আমি বসেছি মাছের আশায়। ছিপে কেঁচো লাগিয়ে বসে আছি তো বসে আছি-কিন্তু মাছ আসে না। ইচ্ছে ছিল বাবার আগেই আমার মাছ আসবে ছিপে। কিন্তু আসে না। আমিও বসে আছি।
বাবা, এভাবে বসলি তো একটাও মাছ পাইবা না, পেছন থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় কে যেন বলে উঠল।
পেছনে তাকিয়েই আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ছোট্ট হৃৎপিণ্ড আমার লাফাতে শুরু করল পাগলের মত। আমি বাবা বলে চিৎকার করতেও ভুলে গেলাম প্রায়। লোকটা লাল রঙের একটা নেংটী পরা। সারা শরীরে আর কিছুই নেই। জায়গায় জায়গায় বড় বড় কিছু তাবিজ ঝোলানো।
জটপাকানো চুল দাড়ির ভিতর দুটো লালচে চোখ। এই দেখে আমার ভয়ে কাঁপাকাপি অবস্থা।
লোকটা বলল, বাবা, ভয় পাইসো? ভয় পাইয়ো না, আমি তোমারে কিছু করুম না, বলেই বিকট চিৎকার করে একটা হাসি দিল সে ভাঙা গলায়।
আমার ততক্ষণে কিছুটা সাহস ফিরে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম আপনার?
আমার পাশে এসে ঘাটে বসতে বসতে বলল, আমারে
সবাই নিশি মিয়া নামে ডাকে।
এটা কেমন নাম?
হা হা হা-এটার কোনও মানে নাই, বলেই আমার দিকে হেসে হেসে তাকাল। আমার ততক্ষণে মজা লাগতে শুরু করেছে। কারণ সে আমার পাশে বসার সাথে সাথে আমি একটা মাছের টোপ গেলা টের পেয়েছি আমার হাতে। ছিপে টান মেরে মাছটাকে ধরে কোনওরকমে আমার পাশে রাখা বেতের ঝুড়িতে রাখলাম। ঝুড়িতে আমার সদ্য ধরা মাছটা লাফালাফি করছে। বঁড়শিতে আপন মনে আবার কেঁচো মেশানো বিস্কিটের দলা লাগিয়ে ছুঁড়ে দিলাম পানিতে
আর সাথে সাথে আরও একটা মাছ পেলাম। আমার পাশে মাছটাকে রাখতে রাখতে আমি খেয়াল করলাম, লোকটার শরীর থেকে কেমন যেন কাঁচা মাছের গন্ধ বের হচ্ছে। আমি পাত্তা দিলাম না। খানিকটা সরে এসে বসলাম। আর সাথে সাথে আরেকটা মাছ পেলাম আমি।
আপনি কী করেন? মাছটাকে ছিপ থেকে খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলাম।
আমি? কিছু করি না, আবার অনেক কিছুই করি, বলেই খিক খিক করে হেসে ফেলল সে।
মানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মানে আমি নিশি ডাকি মাঝে মইধ্যে।
এটা কী জিনিস? এটা হইল এমন জিনিস…যদি আমি সফল হই তাইলেও মানুষ মরে, সফল না হইলেও মানুষ মরে।
তা মানুষ মরার কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে যাব, এমন সময় পেছন থেকে নিশি মিয়া আমাকে ডেকে বলল, বাবা, আমারে একটা মাছ দিয়া যাও, মুখের হাসি হাসি ভাবটা উধাও। সেখানে হুকুমের সুর।
আমিও ভয়ে একটা মাছ তাকে দিয়েই সেদিনের মত বিদায় নিলাম। বাসায় বাবার আগেই মাছ ধরে আনতে পারার খুশিতে সেদিন ভুলেই গেলাম নিশি মিয়ার কথা। কিন্তু আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয় সেদিন আমি মাছটা দেয়ার সাথে সাথে পেছন ঘুরে কাঁচা মাছটাই খাওয়া শুরু করেছিল নিশি মিয়া। হয়তো আমি ভুল দেখেছিলাম। হয়তো না। কে জানে।
পরের দুই দিন আমি নিশি মিয়াকে বেমালুম ভুলে গেলাম। কারণ টগর আর ওর মা-বাবা, মানে আমার ফুফা ফুফু এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে। আমার থেকে এক বছরের বড় টগর আমার সাথেই স্কুলে পড়ত। আর ওকে পেয়েই আমি ভুলে গেলাম সবকিছু। দুইজনে যত পারলাম দুষ্টামি করলাম। নিজেদের আমবাগান ফেলে আরেকজনের বাগানে হানা দিলাম। ইচ্ছেমত চুরি করা, ইচ্ছেমত ডাব খাওয়া-এভাবেই কেটে গেল তিনটা দিন।
পঞ্চম দিনে হঠাৎ করে সব আনন্দ থেমে গেল। সকাল বেলা ফুফা নাস্তা করে বাজারে গেছিলেন। সেখান থেকে লোকজন ধরাধরি করে আনল বাড়িতে। প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় উনি কাতরাচ্ছেন। আমরা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। ডাক্তার ডাকা হলো। উনি নিয়ে যেতে বললেন সদর হাসপাতালে। বাবা খুব দ্রুত ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেখানে ডাক্তার ওঁকে ওষুধ দিলেন। কিন্তু বুকের ব্যথা কমে না। আমরা সবাই হাসপাতালে ছিলাম। বাবা আমাকে আর টগরকে নিয়ে বাড়িতে চলে এলেন।
বাড়িতে এসেই কেয়ারটেকারকে দিয়ে ডাকালেন নিশি মিয়াকে। নিশি মিয়া আসার আগেই আমাকে আর টগরকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিলেন বাবা। কিন্তু আমার কেন যেন সন্দেহ হলো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়ালে থেকে ওঁদের কথা শুনলাম।
বাবা, আমার বোন-জামাইরে তুমি বাঁচাও, নিশি মিয়া।
নিশি মিয়া, বাঁচাইতে পারুম, তয় আমারে কাইল রাইত পর্যন্ত টাইম দেয়া লাগব।
বাবা, তোমাকে বিনিময়ে কী দেব?
নিশি মিয়া, বেশি কিছু না, শুধু আমারে দুইখান কাঁচা মাছ আর মুরগি দেবেন। পেটে বড় খিদা।
বাবা, আর যদি তুমি বাঁচাইতে না পারো?
নিশি মিয়া, না পারলে আমি আমার নিজের শইলের মাংস কাইটা খামু।
ওইটুকু শুনেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম আমার ঘরে। সেখানে ঢুকেই কিছুক্ষণ ভয়ে কথা বলতে পারিনি। পরে টগরকে বলেছিলাম। কিন্তু সে কোনওভাবেই বিশ্বাস করেনি।
পরের দিন আমি দুইবার হাসপাতালে গিয়ে ফুফাঁকে দেখে এসেছি। ওঁর অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেছে। কিছুক্ষণ উনি ঘুমান। আবার কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করেন। এর মাঝে সন্ধ্যার দিকে নিশি মিয়া এসে দেখে গেছে। ওঁকে। আমি মায়ের কাছে শুনেছি নিশি মিয়া নাকি ফুফাঁকে কী একটা পানি খাইয়ে দিয়েই চলে গেছে কাজে। সেদিন সন্ধ্যায় টগর ছিল ওর বাবার সাথে। আমি একা একা কাটিয়েছি বাসায়। পাশের পাড়ার সুমন আর সুমি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। সুমন এসেই আমাকে এক আজগুবি গল্প শোনাল। নিশি মিয়া নাকি ধুপ ধুনো নিয়ে তৈরি হয়ে গেছে। সে আজকে নিশি ডাকবে। প্রতি বাড়ি বাড়ি গিয়ে একবার ধুনো দেবে আর বাড়ির মানুষের নাম ধরে একবার একবার করে ডাকবে। যদি কেউ সেই ডাকে সাড়া দেয় তবে তার মরণ হবে। আর আমার ফুফা বেঁচে উঠবেন।
শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। বাসায় বাবা ছিলেন নিচে। আমি আর মা ছিলাম উপরে। নিশি মিয়ার কাছে বলা ছিল সে যেন আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায়ও না আসে। আমাদের এই কারণে কোনও ভয় ছিল না। সারারাত ধরে আমি দুরুদুরু বুকে কেঁপেছি নিশি মিয়ার ডাক শোনার জন্য। হঠাৎ করে মনেও হয়েছিল কে যেন অনেক দূরে ডেকে ডেকে চলেছে। কিন্তু মনের ভুল মনে করে আমি আবার ঘুমিয়ে গেছি।
এর পরের দিনটা আমাদের জন্য অনেক খারাপ একটা দিন ছিল। ফুফু রাতের বেলাতেই মারা গেছেন। নিশি মিয়ার নিশি ডাক কোনও কাজ করতে পারেনি। লাশ নিয়ে যাওয়া হলো ফুফার বাড়িতে। সেখানে আমরা সবাই গেলাম। সবার মন খারাপ। ফুফু আর টগরের চোখের কান্না দেখে আমিও থাকতে পারিনি। অনেক কেঁদেছি। জলজ্যান্ত মানুষটাকে মরে যেতে দেখলাম আমি। মরে যাওয়া মানুষের শরীরের গন্ধ শুকলাম সেই প্রথম। ফুফাঁকে গোসল করানোর সময় ফুফার শরীরের দিকে তাকিয়ে কেন যেন মনে হচ্ছিল উনি মরেননি। ঘুমিয়ে আছেন মাত্র।
ফুফার দাফন সম্পন্ন করে সেদিন রাতে আমরা থেকে গেলাম ফুফুদের ঘরে। ওঁরা খুব একটা অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন না। একটা কুঁড়ে ঘর ছিল ওদের। ফুফাঁকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে এর থেকে সামান্য দূরে একটা ডোবা আছে। সেখানে ওঁদের ঝুলন্ত পায়খানা ছিল। আর সামনে একটুকু উঠান-এই নিয়ে ছিল ওঁদের বাড়ি।
রাতে আমরা কোনও রকমে কিছু একটা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। এক ঘরে আমি, টগর আর আম্মা। অন্য ঘরে ফুফু আর ওঁদের বাড়ির আরেকজন। আব্বা বাইরের ঘরে শুলেন। আর ঘরের ভেতর এই সময় প্রস্রাব আসলে একটা পিতলের পাত্রে করতে হবে এই ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু হঠাৎ আমার প্রচণ্ড পায়খানা ধরল। রাতের বেলা আমি আম্মাকে ডেকে তুলতে ভয় পেলাম। সারাদিন অনেক কেঁদে কেঁদে আম্মা মাত্র ঘুমিয়েছেন। আমি টগরকে ডেকে তুললাম। বললাম আমার সাথে যেন একটু বাইরে পায়খানার কাছে যায়। টগর ল্যাম্প জ্বেলে আমার সাথে আসল।
পায়খানা ছিল বাঁশের তৈরি। নিচের দিকে একটা সিমেন্টের পাত বসানো। তাতে একটা ফুটো। উপর দিকে খোলা। গ্রামের খুব সাধারণ পায়খানাটা আমার কাছে কেমন যেন ভয়ানক মনে হলো। টগর বাইরে একা একা দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছিল। আমি বুদ্ধি করে দরজা খোলা রেখে পায়খানাতে বসলাম। কিন্তু বসার পরপরই মনে হচ্ছিল কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারপাশ। দূরে কোথাও যেন একটা পাখি ডেকে উঠল। জঙ্গুলে পরিবেশে এর আগে কোনও দিন, আমি এত রাতে ঘর থেকে বের হইনি।
আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছিল ভয়ে। মনে হচ্ছিল ভয়ে পায়খানা না করেই দৌড় দিই। তবুও মনে মনে সুরা পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে বসলাম পায়খানাতে। কিন্তু হঠাৎ করে মনে হলো আমি পানি নিয়ে আসিনি। টগর বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে বললাম একটা কিছুতে করে কিছু পানি নিয়ে আসতে। টগর দৌড় দিল শুনেই।
একা একা বসে আছি। মনে হচ্ছে চারপাশে কেমন যেন একটা মরা মরা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোট বেলায় আমার মন ছিল অনেক কুসংস্কারে পূর্ণ। রাক্ষস খোক্কসের গল্প পড়ে পড়ে মনের ভেতর জন্ম হয়েছিল অন্ধকারের প্রতি নিদারুণ ভয়। আজকে সেটা মনে করে আমার হাসি পায়। কিন্তু সেদিন আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম।
খানিক পর টগর পানি আর ল্যাম্প দুই হাতে ধরে নিয়ে এল। আমি এতক্ষণ অন্ধকারে ছিলাম সেটা টগরের হাতে ল্যাম্প দেখে মনে পড়ল। ভালয় ভালয় আমি পায়খানা সেরে যেই বের হতে যাব, এমন সময় আমার পায়ের কাছে কিছু একটা টুপ করে পড়ল। আমি কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলাম। প্রথমে শিশির মনে করলেও পরে টগর আমার পায়ের কাছে। ল্যাম্প ধরে দেখে লালচে কিছু একটা। আমি আর টগর প্রায় একসাথে উপরে তাকালাম। দেখি আমাদের ঠিক উপরেই কেউ একজন বসে আছে। দেখেই আমার শরীরে কাঁপুনি ধরে। গেল। ভয়ের চোটে গলা শুকিয়ে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি টগরের গা শক্ত হয়ে গেছে ভয়ে। ভয়ে ভয়ে টগরের হাত থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে আমি উপর দিকে ধরলাম। যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। লোকটার সারা শরীরে কিছু নেই। মুখ ভর্তি দাড়ি আর গোঁফ। পা ঝুলিয়ে বসে বসে কিছু একটা খাচ্ছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখা যাচ্ছে চোখ দুটো। লালচে সাদা চোখ দেখেই আমি চিনে ফেললাম ওকে। সে আর কেউ নয়-আমাদের নিশি মিয়া।
কিন্তু সে এখানে কী করে? এই সব ভাবার আগেই দেখি নিশি মিয়া পেটের খানিকটা নিচের দিক থেকে এক টুকরো মাংস কেটে নিল। তারপর ঘঁাচঘঁাচ করে কেটে খেতে খেতে বলল, খোকা বাবু, কথা দিসিলাম রোগীরে বাঁচাতি না পারলি নিজের মাংস খামু। হের লাইগা তোমাগোরে দেখাইয়া দেখাইয়া খাইতেসি।
বলেই ধারাল কিছু একটা দিয়ে নিজের রান থেকে। গ্র্যাচর্ঘ্যাচ করে এক টুকরো মাংস কেটে খেতে শুরু করল। টপটপ করে রক্ত পড়ে চলেছে। পড়ছে ঠিক আমার সামনে। ভয়ে টগরের দিকে আমার তাকানোর সময় ছিল না। আমি সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই।
পরের দিন আমাদের দুজনকে অজ্ঞান অবস্থায় আম্মা দেখতে পান। পরে আমাদের দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনেক খোঁজ করেও নিশি মিয়ার দেখা পায়নি কেউ। আব্বা অনেক খোঁজ করেছিলেন। কিন্তু পাননি। মাঝে আমিও বড় হয়ে যাই। অনেক দিন কেটে গেছে। আমি হাই স্কুল পাশ করে কলেজে উঠে যাই। দেখতে দেখতে আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হই। অনেকগুলো বছর পার হয়ে যায়। আমিও ভুলে যাই নিশি মিয়ার কথা। এখন আমি পড়াশোনার কাজে থিসিসের জন্য এসেছি আমার গ্রামের পাশের গ্রামে। এখানে থাকতে হবে এক বছর। এই এক বছর গ্রামে থেকে গ্রামের মানুষদেরকে নিয়ে থিসিস করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে এইখানে থাকাটা আমার মন্দ লাগছে না। শুধু থাকা-খাওয়াটা একটা সমস্যা। তবে এখানে এখন বেশ কেটে যাচ্ছে সময়।
এই লেখাটা যখন লিখছি তখন অনেক রাত। অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ নেই। নেই কোনও মেঘ। চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আমি রাত জেগে পড়াশোনা করি। কিন্তু আজকে আমার মন কিছুটা বিক্ষিপ্ত। গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবের শরীর অনেক খারাপ। ডাক্তার অনেক ট্রিটমেন্ট করেও তাকে ভাল করতে পারেনি। তার পরিবারের লোকজন বলাবলি করছিল অন্য ব্যবস্থা নেবে। ওঁর হার্টের কোনও একটা প্রবলেম। এই সব ভাবতে ভাবতে রাত জেগে থিসিসের কাজ করছি। এমন সময় অনেক দূর থেকে কারও মৃদু চিৎকার শোনা গেল। আমি পড়া ছেড়ে উঠে বাইরে বের হয়ে এলাম। কাউকে দেখতে না পেয়ে ঘরে ঢুকে যাব, এমন সময় অনেক দূরে একটা আগুনের শিখা দেখতে পেলাম। আমার ঘর থেকে সোজা দেখা যায় অনেক দূর। গাছ-পালা কম। অন্ধকারের মাঝেই দেখলাম একটা আগুনের শিখা এগিয়ে আসছে কিছুটা, আবার থামছে। প্রতিটি বাড়ির সামনে থেমে থেমে বাড়ির মানুষের নাম ধরে একবার করে ডেকে ডেকে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কিছুটা সামনে আসতেই আমি বেশ ভালভাবেই দেখলাম লোকটাকে। মাথায় সেই বিশাল ঝাঁকড়া চুল। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। আর সেই ভয়ানক দুটো চোখ। একটু ভাল করে লক্ষ করতেই দেখলাম সেই নিশি মিয়া। আমার বাড়ির দিকেই আসছে। নাম ধরে ডেকে চলেছে মানুষকে। যে-ই সাড়া দেবে সে-ই বেঘোরে প্রাণ হারাবে। আরেকটু ভালভাবে দেখতেই দেখি নিশি মিয়ার পেটের ঠিক নিচটায় কেমন যেন খাবলানো। রানের জায়গায় জায়গায় মাংস নেই। কেউ যেন কেটে নিয়ে গেছে সেখানকার মাংসগুলো….
রাজীব চৌধুরী