নিশি কবরেজ

নিশি কবরেজ

হারানো একটা পুঁথিতে নিশি কবরেজ একটা ভারী জব্বর নিদান পেয়েছেন। গাঁটের ব্যথার যম। তবে মুশকিল হল পাচনটা তৈরি করতে যে পাঁচরকম জিনিস লাগে তার চারটে জোগাড় করা যায়। কিন্তু পাঁচ নম্বরটাই গোলমেলে। পাঁচ নম্বর জিনিসটা হচ্ছে আধ ছটাক ভুত।

নিশি কবরেজ রাতে খাওয়ার পর, দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আচমন করছিলেন। ঘুটঘুটি অন্ধকার রাত্রি। চারদিক নি:ঝুম। শীতকালের কুয়াশা আর ঠান্ডাটাও জেঁকে পড়েছে। আঁচাতে-আঁচাতে নিশি কবরেজ পাচনটার কথাই ভাবছিলেন। রাজবল্লভবাবু বিরাট বড়লোক! কিন্তু গাঁটের ব্যথায় শয্যাশায়ী। ব্যথাটা আরাম করতে পারলে রাজবল্লভবাবু হাজার টাকা অবধি দিতে রাজি বলে নিজে মুখে কবুল করেছেন। কিন্তু ভূতটাই সব মাটি করলে। আধ ছটাক ভূত এখন পান কোথায়? হঠাৎ নিশি কবরেজের মনে হল, উঠোনের ওপাশটায় হাঁসের ঘরের পাশটায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

‘কে রে? ওখানে কে?’

কেউ জবাব দিল না।

নিশি কবরেজ জলের ঘটিটা ঘরে রেখে হ্যারিকেন আর লাঠিগাছটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। দিনকাল ভালো নয়। চোর-ছাঁচড়ের দারুণ উপদ্রব। ঘরে কিছু কাঁচা টাকাও আছে। সোনাদানাও মন্দ নেই।

বাঁ-হাতে হ্যারিকেনটা তুলে ডানহাতে লাঠিটা নাচাতে-নাচাতে কয়েক পা এগোতেই উঠোনের ওপাশ থেকে একটু গলা খাঁকারির বিনয়ী শব্দ হল। চোরের তো গলা খাঁকারি দেওয়ার কথা নয়।

‘কে রে? ওখানে কে?’

ওপাশ থেকে খোনাস্বরে জবাব এল। ‘ইয়ে, আমি হলুম গে রামহরি—না, না থুড়ি, আমি হলুম ধনঞ্জয়।’

নিশি কবরেজ আলোটা ভালো করে তুলে ধরে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বললেন, রামহরি বা ধনঞ্জয় নামে এ গাঁয়ে আবার কে আছে? কোথা থেকে আসা হচ্ছে শুনি। দরকারটাই বা কী? রুগি দেখতে হলে রাতে বিশেষ সুবিধে হবে না বলে রাখছি। দিনের বেলা এসো।

কে যেন বলে উঠল, ‘আজ্ঞে ওসব কিছু নয়।’

নিশি কবরেজ লোকটাকে ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না। তাঁর চোখের জোর কিছু কম নয়। হ্যারিকেনেও কালি পড়েনি। তবু ভালোমতো লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন না। শুধু বুঝতে পারছেন, হাঁসের ঘরের পাশে খুব কালো একটা লম্বাপানা ছায়া-ছায়া কী যেন।

নিশি কবরেজ মনে-মনে ভাবলেন, ‘এ: চোখের বোধহয় বারোটা বাজল এতদিনে। না, কাল থেকে চোখে তিনবেলা ত্রিফলার জল দিতে হবে।

নিশি কবরেজ বললেন, ‘রুগির ব্যাপার নয় তো এত রাতে চাও কী? চোর-টোর নও তো বাপু?’

‘আজ্ঞে না, চোর-ডাকাত হওয়ার উপায়ও নেই কি না। একটা সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলুম আজ্ঞে।’

‘সমস্যাটা কী?’

‘আজ্ঞে বলে দিতে হবে যে আমি রামহরি, না ধনঞ্জয়।’

নিশি কবরেজ খ্যাঁক করে উঠে বললেন, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে? তুমি রামহরি না ধনঞ্জয় তা আমি কী করে বলব? আমি তোমাকে চিনিই না।’

‘আজ্ঞে আপনি আমাদের চেনেন—থুড়ি—চিনতেন। আমরা দুজনেই গেলবার ওলাউঠায় মরলুম, মনে নেই? আপনার পাচন ফেল মারল।’

নিশি কবরেজ আঁতকে উঠে বললেন, ‘তোমরা? ওরে বাবা।’

‘আজ্ঞে ভয় খাবেন না। আমরা ভারী দুর্বল জিনিস।’

নিশি কবরেজ কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, পাচনের দোষ নেই বাবা, সবই কপালের ফের। আমাকে তোমরা মাপ করো।

‘আজ্ঞে সেজন্য আপনাকে আমি দুষতে আসিনি। ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা একটা দেখা দিয়েছে। ভূত হওয়ার পর আমরা সব কেমন যেন ধোঁয়াটা মার্কা হয়ে গেলুম। শরীর-টরীর নেই, তবে কী করে যেন আছি। তা আমরা অর্থাৎ আমি আর ধনঞ্জয়—মানে আমি আর রামহরি—মানে কে যে কোন জন তা বলা মুশকিল—তা আমরা দুজন খুব মাখামাখি করি। খুব বন্ধুত্ব ছিল তো দুজনে। এ ওর শরীরে ঢুকে যাই, ও এর শরীরে মিশে যায়। কিন্তু ওই মাখামাখি করতে গিয়েই কে যে কোনজন তা গুলিয়ে গেছে।’

‘বলো কী? ‘

‘আজ্ঞে সেই কথাটাই বলতে আসা। দুজনে প্রায়ই ঝগড়া লেগে যাচ্ছে। কখনও আমি বলি যে, আমি রামহরি, ও ধনঞ্জয়। কখনও বলে যে, ও রামহরি আর আমি ধনঞ্জয়।’

নিশি কবরেজ এই শীতেও ঘামছিলেন। হাতের হ্যারিকেন আর লাঠি দুই-ই ঠকঠক করে কাঁপছে। পেটের ভেতরে গুড়গুড় করছে। মাথা ঘুরছে। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল, গাঁটের ব্যাথার পাচনটার জন্য আধ ছটাক ভূত লাগবে।

নিশি কবরেজ একগাল হাসলেন। তাঁর হাত-পায়ের কাঁপুনি বন্ধ হল। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘এ আর বেশি কথা কী? তবে এখন তোমার যেমন বেগুন পোড়ার মতো চেহারা হয়েছে তাতে তো কিছু বোঝবার উপায় নেই। একটু ধৌতি দরকার। বেশি কষ্ট হবে না। একটা পাচনের মধ্যে মিনিট দশেক সেদ্দ করে নেব তোমাকে, তাতেই আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসবে।’

‘বটে!’ বলে কালো জিনিসটা এগিয়ে এল।

নিশি কবরেজ আর দেরি করলেন না। নিশুতরাতেই পাচনাটা উনুনে বসিয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। ভূতটা সেদ্ধ হতে-হতে মাঝে-মাঝেই মাথা তুলে বলে, হল?

নিশি কবরেজ অমনি কাঠের হাতাটা দিয়ে সেটাকে ঠেসে দিতে-দিতে বলেন, হচ্ছে হে হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করলে কী হয়? তোমার তো আর গায়ে ফোস্কা পড়ছে না হে!

পাচনটা ভোররাতে তৈরি হয়ে গেল। আর আশ্চর্যের বিষয় ভূতের ঝুলকালো রংটাও একটু ফ্যাকাসে মারল। নিশি কবরেজ খুব ভালো করে জিনিসটাকে নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘আরে, তুমি তো রামহরি।’

ভূতটা একথায় ভারী খুশি হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে বাঁচালেন, ধনঞ্জয়ের কাছে রামহরি শ’তিনেক টাকা পেত কিনা। ভারী দুশ্চিন্তা ছিল আমার। পেন্নাম হই আজ্ঞে। বলে ভূতটা হাওয়ায় মিশে গেল।’

নিশি কবরেজ পাচনাটা বোতলে পুরে নিশ্চিন্ত মনে তামাক খেতে বসলেন, বড্ড ধকল গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *