নির্বাসন
3 of 3

নির্বাসন

১. গোথেমবার্গে বইমেলা হচ্ছে। এর বিষয় ‘মত প্রকাশের অধিকার এবং নির্বাসন’। বিষয়টি আমার বিষয়। কিন্তু আমি আমন্ত্রিত নই মেলায়। ১৯৯৪ সালে গোথেমবার্গ বইমেলা উদ্বোধন করেছিলাম আমি। মনে আছে আমার জন্য কী বিশাল নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তখন। আগের দিন থেকেই নাকি মেলা ভরে গিয়েছিল কুকুরে। বোমডগগুলো শুঁকে শুঁকে যাচ্ছিল স্টল। কোথাও আবার কেউ বোমা রেখে গেল কি না। পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় ঘটা করে নিরাপত্তার কাহিনী প্রচার হয়েছিল। এ বছর বইমেলায় গেলে সাধারণ দর্শকের মতো হেঁটে বেড়াবো। কেউ হয়তো চিনবেও না আমি কে। ২২ বছরে অনেক পাল্টে গেছে চারদিক। তখন আমি ছিলাম সবার চেনা নির্বাসিত লেখক। আজ আমি একা নির্বাসিত নই। অনেক লেখকই নানা দেশ থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন। শুধু আমার দেশে নয়, অন্য অনেক দেশেও লেখকের মত প্রকাশের অধিকার নেই। ধর্মান্ধদের মতের চেয়ে বা সরকারি মতের চেয়ে ভিন্ন কোনও মত প্রকাশ করলে তাদের জেলে ভরা হয়, অথবা চাবুক মারা হয়, অথবা কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়। যতদিন ধর্মান্ধতা, বর্বরতা রয়ে যাবে, ততদিন মুক্তচিন্তকদের নির্বাসন হতেই থাকবে। আজ আমি, কাল আরেকজন।

২. নির্বাসন শুধু লেখকদের ঘটছে না, সাধারণ মানুষও নির্বাসিত হচ্ছেন। সিরিয়া থেকে তুরস্ক এসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকো ভাসিয়ে দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। নৌকোয় চড়ে যারা ইউরোপে ঢুকেছে, তাদের প্রায় সবাই এখন জার্মানি আর সুইডেনে। জার্মানিতে ষোলো লাখ। সুইডেনে এক লাখ। সুইডেনে প্রতি সপ্তাহে দশ হাজার শরণার্থী ঢুকছে। এদের জায়গা দেওয়ার জায়গা নেই। পুরোনো ইস্কুলঘর, পুরোনো স্টেশন, গির্জা সব ভর্তি হয়ে গেছে। তাঁবু ফেলেও কাজ হচ্ছে না। মানুষ বিরক্ত। ডানপন্থীরা তো বিরক্তই। পাশ্চাত্যের উদার বামপন্থীদের অনেকেই বিরক্ত। তারা জানে না এই শরণার্থীদের কী করে তারা দীর্ঘকাল খাওয়াবে পরাবে। জার্মানির কিছু বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছে, যে বন্ধুরা সাধারণত শরণার্থীদের বিপদ-আপদে দাঁড়ান। তাঁরাও বলছেন, এত বেশি শরণার্থী নেওয়া জার্মানির উচিত হয়নি। সুইডেনে আমি এখনও কাউকে বলতে শুনিনি, শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে অতি উত্তম কাজ করেছে সুইডিশ সরকার। এক বামপন্থী লেখক-বন্ধু দু’দিন আগেই আমাকে বললো, ‘আফগানিস্তান থেকেও অনেক শরণার্থী এসেছে। সিরিয়া থেকে তো বটেই। অনেক তরুণ শরণার্থীর সঙ্গে পরিবারের কেউ নেই। তারাই হয়তো সুইডিশ মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ‘সুইডিশ মেয়েরা ফ্রি সেক্সে বিশ্বাসী’। এরকম একটা অদ্ভুত যুক্তিহীন বোধহীন কথা তারা বিশ্বাস করে। সুইডেনে থাকে এমন এক বাঙালিকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সিরিয়ান রিফিউজিদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি?’ বাঙালি বললো, ‘ওরা তো চুরি করে। ওদের কারণে সুইডিশরা অতিষ্ঠ’। শুধু সুইডিশ কেন, মনে হচ্ছে বাঙালিও অতিষ্ঠ। সবচেয়ে বেশি অতিষ্ঠ চরম ডানপন্থী দল। ইউরোপের দেশে দেশে তারা এখন অতি বীভৎস দৈত্যের মতো হাওমাওখাও বলে মাথা তুলছে। শরণার্থীরা এক দৈত্যের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক দৈত্যের কবলে পড়বে না তো!

৩. সুইডেনের শরণার্থীদের পঁচাত্তর ক্রোনোর করে প্রতিদিন দেওয়া হয়। ওই টাকা দিয়ে তিন বেলা খাবার জোটানো সহজ নয়। কিন্তু এখনও ওদের কাজ করার কোনও অনুমতি নেই। সুইডেনের রাস্তায় আমি এখনও কোনও সিরিয়ার শরণার্থীকে ভিক্ষে করতে দেখিনি। ভিক্ষে করছে রুমানিয়া থেকে আসা জিপসিরা। জিপসিরাও নির্বাসিত। তাদের প্রায় সব দেশ থেকেই তাড়ানো হয়। কোনও এক কালে ভারতের রাজস্থান থেকে তারা চলে এসেছিল ইউরোপের দিকে। আজও তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশ করছে। কেউ কেউ বলে, জিপসিরা এক জায়গায় বাস করতে পারে না, থিতু হওয়া ওদের চরিত্রে নেই। জিপসিদের জিজ্ঞেস করলে বলে, আমরা থিতু হতে চাই, কিন্তু আমাদের থিতু হতে দেওয়া হয় না, যে দেশেই যাই সে দেশ থেকেই আমাদের তাড়ানো হয়।

৪. অক্টোবরে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া প্রকাশ করছে আমার বই ‘নির্বাসন’। নির্বাসন বইটি কলকাতা থেকে আমাকে কী করে প্রথমে দিল্লি তারপর ভারত থেকেই বের করে দেওয়া হয়েছিল, সেটার বর্ণনা। জীবনে নির্বাসন আমার কতবার যে হলো। কত দেশ থেকে, রাজ্য থেকে, শহর থেকে আমাকে নির্বাসন দেওয়া হলো। কত প্রিয় প্রিয় অঞ্চল ছেড়ে আমি চলে যেতে বাধ্য হলাম। গত কয়েকদিন সুইডেনে এক বন্ধুর বাড়িতে বহু বছর যাবৎ পড়ে থাকা আমার বইপত্র ভারতে আমার অস্থায়ী ঠিকানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ব্যবস্থাটি করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ সুইডেনের বন্ধুটি তার বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু আমি ভারতে ছাড়া আর কোথায় নেবো আমার জিনিসপত্র? ভারতে আমার বসবাসের কোনও নিশ্চয়তা নেই, পায়ের তলায় সামান্য মাটি নেই। পৃথিবীর একটি দেশেই আমার একটি স্থায়ী ঠিকানা আছে। সেটি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আমাকে অন্যায়ভাবে ঢুকতে দেয় না সরকার, তাই আমার ঢোকা হয় না। ভারতে এই যে টন টন বই নেবো আমি, বইয়ের তাকে বইগুলো সাজিয়ে রাখবো, তারপর একদিন ভারত সরকার আর ভিসা দেবে না, তারপর একদিন ভারত সরকার মুখের ওপর বলে দেবে তোমাকে দেশ ছাড়তে হবে। তখন? তখন কোথায় যাবো না জেনেই আমাকে ভারত ত্যাগ করতে হবে। আমি যেখানেই কদিন বাস করি, সেখানেই আমার সংসার শেকড় ছড়াতে থাকে। শেকড় উপড়ে নিয়ে বার বার আমাকে দেশান্তরী হতে হয়েছে। যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন হবে। আমি নির্বাসন থেকে দূরে থাকতে চাইলেও নির্বাসন আমার থেকে মোটেও দূরে সরতে রাজি নয়। বয়স তো অনেক হলো। এই বয়স দেখে অনেক মানুষের মায়া হয়, কিন্তু সরকারের মায়া হয় না। সরকারদের হয়তো মায়া মমতা বলে কিছু থাকে না।

৫. বার্লিন লিটারেচার ফেস্টিভেলে আমন্ত্রিত হয়ে বার্লিন ঘুরে এলাম। আমার খুব দেখার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের ব্লগাররা যারা জার্মানিতে নির্বাসন জীবন কাটাচ্ছে, তারা আছে কেমন। সুইডেনেও বেশ ক’জন ব্লগার আশ্রয় নিয়েছে। দেশে বসে কেউ কেউ অপেক্ষা করছে আইকর্নের সাহায্য নিয়ে নরওয়ে চলে যাওয়ার জন্য। দেশে দেশে লেখক সাহিত্যিকদের সংস্থা ‘পেন’ অনেককে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে। ঝুঁকিহীন নির্বাসন জীবন সকলেই কাটাতে চাইছে। সবাই ভাষা শিখছে। সবারই ইচ্ছে বিদেশ বিভূঁইয়ে বাকি জীবন বাস করার। আমিই পারিনি। আমারই নির্ঝঞ্ঝাট জীবন সয় না। যেখানে যে কেউ যে কোনও সময় আমাকে খুন করতে পারে, যেখানে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, যেখানে কথা বলার স্বাধীনতা নেই, যেখানে মত প্রকাশের কোনও অধিকার নেই, যেখানে অত্যাচার অনাচার অন্যায় নির্যাতন একটি দিনের জন্যও ছুটি নেয় না, যেখানে দারিদ্র্য, যেখানে অশিক্ষা— সেখানে আমি বাস করতে চাই, সেটিই আমার দেশ। সেটিই আমাকে প্রেরণা দেয় প্রতিবাদ করার। সেখানেই আমি সাম্যের জন্য, সমতার জন্য, সমানাধিকারের জন্য, সুশিক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে পারি। আমার সংগ্রাম রাস্তায় নেমে নয়। আমার সংগ্রাম লেখায়। জীবনে খুব বেশি আর সময় নেই। এভাবেই কেটে যাবে বাকিটা জীবন। প্রাচুর্য আর নিশ্চিন্তির লোভ ছিল না কখনও। এখনও নেই। আমার দীর্ঘ নির্বাসন জীবনে আমি সেই কাজটিই করতে চাই, যেটি আমি করছিলাম। জীবনকে যেভাবে অর্থপূর্ণ করছিলাম, সেভাবেই করতে চাই বিরুদ্ধ স্রোতে অনড় দাঁড়িয়ে।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *