নির্ণেয় সরলফল
প্রধানমন্ত্রীর ঝাঁ চকচকে স্টাডি।
ঈশ্বর বাগচী চিরাচরিত রাজনীতি ঘৃণা করেন। সত্যিকারের রাজনীতি অনেক গভীর। আর সত্যিকারের রাজনীতিকেরাও থাকেন অনেক অনেক গভীরে। তাদেরকে দেখা যায় না, কিন্তু তাদের রাজনীতি অনুভব করা যায়। প্রকৃত রাজনীতি একটা সাধনা, কিন্তু প্রচলিত রাজনীতি একটা ব্যবসা। তিনি অবশ্য দুটোর কোনটাতেই নেই-অন্তত তিনি সেটাই মনে করেন। বিদ্যায় বিশ্বাসী তিনি। বিদ্বান মানুষ কখনও ক্ষমতার লোভ করবে না। কখনও অন্য মানুষদেরকে ব্যবহার করবে না। অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে না। এই তিনটা কাজ বিশ্বের প্রতিটা প্রচলিত রাজনীতিবিদই করেন। না করলেও করার চেষ্টা করেন। এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত। নিজের অভিমত তিনি কারও ওপরে চাপাতে যাননি।
এই কারণেই ঈশ্বর বাগচী খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। তার সামনে প্রধানমন্ত্রী তফিসুল বারী বসে আছেন। এই মানুষটাকে তিনি অপছন্দ করেন না। আবার পছন্দও করে না। তফিসুল বারী ঈশ্বর বাগচীকে পিরিচে বসানো চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। ঈশ্বর হাত বাড়িয়ে সেটা নিলেন।
তফিসুল বললেন, “বাগচী। কেমন আছেন?”
“ভাল আছি।”
“এই বয়সেও এত ভালো থাকেন কিভাবে বলেন তো? আমার তো প্রতি সেকেন্ড কাটে চাপের ভেতরে। ভালো থাকা যে কাকে বলে ভুলেই গিয়েছি।”
“হুম। আমাকে কেন ডেকেছ বল?”
“এমনি। অনেক দিন খোঁজ খবর নেই। কেমন আছেন না আছেন।”
“কারণ ছাড়া তো ঈশ্বরকে কেউ স্মরণ করে না। কেউ স্মরণ করে নরকের ভয়ে, কেউ স্বর্গের লোভে, কেউ একটা সুন্দরী বউয়ের জন্য, কেউ ধন সম্পত্তি টাকা পয়সার জন্য। কাজেই তুমি আমাকে এমনি এমনি স্মরণ করবা এইটা বিশ্বাস করার মত না।”
তফিসুল বারীর মুখ থেকে হাসি গায়েব হয়ে গেল। তিনি চোখ মুখ শক্ত করে বললেন, “আপনাকে ডাকাটা কি আমার অপরাধ হয়ে গিয়েছে?”
“না তা হয়নি। তবে, তুমি অনেক বদলে গিয়েছ। এই চেয়ারটায় যেই বসে, সেই কেন জানি বদলে যায়। তুমি আমাকে তিনটা জীবন দিয়েছিলে। তিনটা মানুষ। ওরা আমার কাছে ভালোই আছে। হয়ত এখন জীবন নেওয়ার জন্য ডেকেছ। যাই হোক, বল কার জীবন নিতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী একটা ছবি বাড়িয়ে ধরলেন। ঈশ্বর বাগচী ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলেন। তারপর ফতুয়ার পকেটে রাখলেন। তারপর বললেন, “ছেলেটা কয়েকদিন আগে এসেছিল আমার কাছে। তাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম। কাজটা না করেই সে উধাও হয়ে যায়। তো এই ছেলেটা কি করেছে জানতে পারি? কি যেন নাম ছেলেটার? দাঁড়াও ওহ……হ্যাঁ……. শংকর।”
“পাঁচ বছর আগে পাহাড়ি জেল ভাঙ্গার ঘটনায় বশিরের সাথে এই লোকটাও ছিল। অনেক চেষ্টা করেও এই লোকটাকে খুঁজে বের করতে পারিনি। এই লোকটাই বশিরকে ওই জেলখানার ঠিকানা দিয়েছিল। তাছাড়া, লোকটা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারে। আমি নাকি ওই জেলখানায় কয়েদী পুষতাম। ওদেরকে দিয়ে নানা অপকর্ম করাতাম। এইসব মিথ্যাচার করতে পারে। আমি সেই ঝুঁকি নিতে চাই না। এই দেশ, এই জাতির আমার প্রয়োজন। খুব বেশি প্রয়োজন।”
“আচ্ছা। আমি দেখব।”
তফিসুল বারী বললেন, “আজ আমার সাথে দুপুরে খেয়ে যাবেন। আপনার দাওয়াত। ছোট মেয়েটার একটা ছেলে সন্তান হয়েছে। সুইজারল্যান্ড থেকে সকালেই ফোন করেছিল। কাজের ব্যস্ততায় যেতে পারছি না।”
ঈশ্বর বাগচী ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “আজ থাক। আরেকদিন আসব। আর প্রতিটা জন্মই কোন না কোনভাবে এক একটা মৃত্যুর কারণ। আর প্রতিটা মৃত্যুই এক একটা জন্মের কারণ। প্রতিটা জন্মই আরেকটা মৃত্যুর ফল। তোমার নাতিকে আমার স্নেহ পৌঁছে দিও।”
“ওহ্ একটা কথা।”
ঈশ্বর বাগচী ঘুরে দাঁড়ালেন।
“বল?”
“গুজব কিনা জানি না, শুনছি কংসচক্র আবার ফিরে এসেছে। সত্যি মিথ্যা জানি না। ওদিকে জেনারেল খুন হয়েছেন ভারতে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কংসচক্রের ঘটনা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর মত দুঃসংবাদ আর হবে না।”
“তুমি কংসচক্রের কিচ্ছু করতে পারবে না তফিসুল। তাই অযথা চিন্তা করো না। ওদের পুরোন পাপই ওদের একমাত্র ধ্বংসের কারণ হবে।”
“কী সেই পাপ?”
“বাসবী শক্তি।”
“কী এটা?”
বাগচী উত্তর দিলেন না। মাথা নিচু করে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। তফিসুল বারীর ব্যক্তিগত সহকারী বাগচীকে ধরতে গেলেন। বাগচী মিষ্টি হেসে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, তিনি একাই যেতে পারবেন।