নির্জন বাড়ির বাসিন্দা
মূল গল্প Picture in the House (Howard Phillips Lovecraft)
অলৌকিকের পিছু ধাওয়া করেন যারা তাদের আপনি কোথায় খুঁজে পাবেন? উত্তরগুলো বেশ সহজ৷ ধরুন মাটির তলায় লুকানো কোনও শবাধার, কিংবা প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনও দুর্গের চূড়ার ঘরে, অথবা ঘন ভূতুড়ে কোনও জঙ্গলের গভীরে৷ কিন্তু যাঁরা সত্যিকারের অলৌকিকের সন্ধান পেতে চান তাঁদের এসব জায়গায় যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই৷ আমাদের এই নিউ ইংল্যান্ডেরই কোনও প্রান্তিক গ্রামে কোনও ভেঙে পড়া পলেস্তারা খসে পড়া পরিত্যক্ত বাড়িতে অলৌকিক তাদের জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে৷
ধরে নিন পায়ে চলা রাস্তা থেকে খানিকটা সরে এসে ঘণ্টাখানেক হেঁটে এরকম একটা নির্জন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন আপনি৷ একটা ঘাসের জমির উপরে মূর্তিমান দৈত্যের মতো দুশো বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা৷ মাটি থেকে গুল্মতা উঠে এসে সমস্ত দেহ ছেয়ে ফেলেছে৷ গুল্মের আবরণের ভিতর থেকে শুধু অন্ধকার জানলাগুলো জেগে রয়েছে৷ যেন ভয়ঙ্কর কোনও অতীতের স্মৃতি হাতড়ে আমাদের কিছু দেখাতে চায় তারা৷
এই ধরনের বাড়িতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কিছু অদ্ভুত মানুষ বসবাস করে৷ মানবসভ্যতার সঙ্গে এদের যোগাযোগ খুব ক্ষীণ৷ কিছু একটা রহস্য যেন ঘিরে থাকে এদের৷ সে রহস্য যে ঠিক কী, তা কেউ বলতে পারে না৷
আঠারোশো ছিয়ানব্বই সালের নভেম্বর মাসের এক দুপুরে বৃষ্টির হাত থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে আমি ঠিক এইরকম একটা বাড়ির সামনে উপস্থিত হই৷ সেসময়ে কোম্পানির কাজে মিস্কাটনিক ভ্যালি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম৷ জায়গাটা মূলত পার্বত্য অঞ্চল৷ খুব একটা বেশি মানুষজনের যাতায়াত নেই৷ আমি সারাদিন একটা ছোট সাইকেলে চেপে এদিক-ওদিক ঘুরে জায়গাটা জরিপ করতাম, ভালো করে সন্ধে নামার আগেই হোটেলে ফিরে আসতাম৷
সেদিন কিন্তু দুপুর গড়ানোর আগেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল৷ বুঝলাম ঝাঁপিয়ে ঝড়বৃষ্টি নামতে আর বেশি দেরি নেই৷ এদিকে উদ্দেশ্যহীনের মতো সাইকেল চালাতে-চালাতে একটা মেঠো রাস্তায় এসে পড়েছি৷ আশপাশে তাকিয়ে মাথা গোঁজার মতো কিছুই চোখে পড়ল না৷ দু-পাশ জুড়ে উঁচু-নীচু টিলার সারি৷ উদভ্রান্তের মতো চতুর্দিকে তাকাতে একটা ছোট টিলার নীচের দিকে ছোট কাঠের বাড়ি চোখে পড়ল৷ যদিও আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে বাড়িটা, তাও উপায়ন্তর না দেখে সেটা লক্ষ্য করেই সাইকেল ছুটিয়ে দিলাম৷ এদিকে বৃষ্টি শুরু হলে সহজে থামার নাম করে না৷ টাকাপয়সা কাছে কম নেই, বাড়িতে যেই থাকুক না কেন কিছু টাকাপয়সার বিনিময়ে যদি আজ রাতটা থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায় তাহলেই আমি খুশি৷
বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখে কিন্তু হানাবাড়ি জাতীয় কিছু বলে মনে হল না৷ তবে ভারী নির্জন৷ একতলায় ঢোকার মুখে একটা দরজা আছে৷ সেটা ভিতর থেকে বন্ধ৷ দরজার বেশ কয়েকটা জায়গা ভেঙে গেছে৷ তার মধ্যে দিয়ে ভিতরের অন্ধকার চোখে পড়ে৷ লক্ষ করলাম বাড়ির ভিতরে কোথাও আলো জ্বলছে না৷
কেন জানি না মনে হচ্ছিল বাড়িটা পরিত্যক্ত৷ তবে আরও কিছুটা সামনে পৌঁছাতে সে ধারণাটা ভেঙে গেল৷ বাড়ির বাইরে একটা ছোট বুনো ফুলের ঝোপ আছে৷ চেহারা দেখে মনে হল মাঝে-মাঝে কেটে পরিষ্কার করা হয়ে সেগুলো৷
খানিকটা সেই কারণেই দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার বদলে আমি দরজায় টোকা দিলাম৷ টোকা দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই কেমন অবর্ণনীয় অস্বস্তি শুরু হল মনের ভিতরে৷ বাইরে শ্যাওলা ঢাকা পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে বাড়ির দোতলার জানলাগুলো দেখতে পেলাম৷ যদিও জানলাগুলো বেশ পুরনো আর ধুলো ঢাকা, তাও কোনও জায়গায় ভেঙে যায়নি৷ অর্থাৎ বাড়ির ভিতরে লোক থাকে৷ এবং সে লোক মোটেই বাড়িটার যত্ন নেন না৷
আমার টোকাতে কিন্তু কোনও কাজ দেয়নি৷ আরও বারকয়েক টোকা দেওয়ার পর আমি বাধ্য হয়েই হালকা হাতে ঠেলা দিলাম দরজায়৷ একটা মিহি আওয়াজ করে খুলে গেল কাঠের দরজাটা৷ ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম একটা ছোট বাইরের ঘর৷ ঘরের দেওয়াল থেকে প্লাস্টার খসে পড়েছে৷ সেই সঙ্গে নাকে এল একটা বিশ্রী গন্ধ৷ সাইকেলটাকে ঘরের ভিতরে এনে রেখে আমি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলাম৷
আমার ঠিক সামনে থেকেই একটা সরু সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে৷ সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে একটা সেলারের দরজা৷ সিঁড়ির দু-পাশে আরও দুটো বন্ধ দরজা চোখে পড়ল৷ সেগুলো বোধহয় একতলার ঘর৷ সাইকেলটা একদিকের দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে আমি বাঁদিকের ঘরের দরজাটা খুলে ফেললাম৷
এ ঘরটার সিলিং বেশ নীচুতে৷ দু-দিকের দুটো ধুলো ঢাকা জানলা দিয়ে কিছুটা আলো এসে আলোকিত করে রেখেছে ঘরটাকে৷ আসবাব বলতে প্রায় কিছুই নেই এখানে৷ ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল আর গোটা কয়েক চেয়ার দেখে মনে হল এই ঘরটা হয়তো এ বাড়ির বসবার ঘর৷ ঘরের একদিকের দেওয়ালের নীচ বরাবর বেশ বড়সড় একটা ফায়ারপ্লেস আছে৷ তার উপরে একটা অ্যান্টিক ঘড়ি টিকটিক করে বেজে চলেছে৷
কিছু ছড়ানো-ছিটানো বই আর কাগজপত্রও চোখে পড়ল৷ বইয়ের নামগুলো আধো অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পেলাম না৷ তবে একটা জিনিস খেয়াল করে বেশ অবাক হলাম আমি৷ এখানকার প্রায় সব বাড়িতেই দেখেছি প্রাচীন জিনিসপত্র দিয়ে ঘর সাজানোর একটা বাতিক আছে মানুষের৷ এই ঘরটায় এমন কিছু জিনিস চোখে পড়ল যার বয়স আমার আন্দাজে অন্তত শদুয়েক বছরের কম নয়৷ বাড়িটা যদি আরেকটু সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা যেত তবে দিব্যি একটা সংগ্রহশালা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত৷
গোটা একতলাটা দেখতে-দেখতে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি এসে চেপে ধরল আমাকে৷ সেটা ভালো লাগার নাকি ভয়ের তা ঠিক বুঝতে পারলাম না৷ তবে এই গোটা বাড়িটা যেন একখণ্ড অতীত বুকে করে দাঁড়িয়ে আছে৷ যেন কোথাও গোপন কিছু একটা লুকিয়ে রাখা আছে৷ এমন কিছু যা পৃথিবীর মানুষের আর মনে নেই৷
বসতে ইচ্ছা করছিল না আমার৷ কেমন যেন নেশায় পেয়েছে আমাকে৷ যা কিছু হাতের সামনে পাচ্ছি সেগুলোই অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম৷
টেবিলের উপরে একটা মাঝারি সাইজের বই চোখে পড়ল৷ এতটাই পুরনো যে দেখে মনে হল কোনও মিউজিয়াম থেকে চুরি করে এনে এখানে রেখেছে কেউ৷ বইটা চামড়ায় বাঁধানো, স্পাইনের কাছে ধাতুর পাত দিয়ে আটকানো আছে পাতাগুলো৷ এরকম একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে এমন একটা বই রাখা আছে তা কল্পনাও করা কষ্টকর৷
বইটা খুলে কয়েকটা পাতা উল্টাতেই কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম আমি৷ প্রাচীন সাধু পিগাফেট্টার কঙ্গো অঞ্চলের বিবরণ৷ পুরোটাই ল্যাটিনে লেখা৷ এই বইটার কয়েক কপি যে এখনও পৃথিবীর কোথাও রয়ে গেছে সে কথা আমি আগেও শুনেছিলাম৷ একটু আগের অস্বস্তিটা ভুলে গিয়ে আমি পরপর পাতা উল্টাতে লাগলাম৷
বইতে যা লেখা আছে তার কথা এ বাড়ির মালিক আর আমি ছাড়া অন্য কোনও মানুষ জানে বলে মনে হয় না৷ ভিতরে বেশ কয়েকটা হাতে আঁকা ছবি দেওয়া আছে৷ তেমন একটা ছবিতে এসেই আমি থেমে গেলাম৷ একটা কসাইয়ের দোকানের ছবি আঁকা আছে সেখানে৷ তার বিবরণ আমি আর এখানে দিতে চাই না৷ ছবিটা দেখেই বইটা বন্ধ করে রেখে দিলাম আমি৷
বাকি বইগুলোর উপরে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতেই মনে হল উপর থেকে একটা মিহি পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে৷ প্রথমে একটু চমকে গেছিলাম৷ আমার দরজায় দেওয়া টোকাতে কেউ সাড়া দেয়নি, এখন তাহলে বাড়ির ভিতরে লোক এল কোথা থেকে? পরক্ষণেই মনে হল বাড়ির মালিক হয়ত এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন৷ এবার তিনি ঘুম ভেঙে নীচে নেমে আসছেন৷
ঘরে ঢুকে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম৷ সিঁড়ির নীচ অবধি নেমে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল৷ বুঝলাম বাইরের ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটা চোখে পড়েছে তাঁর৷ পরমুহূর্তেই দরজার বাইরে থেকে খচখচ করে শব্দ হল একটা৷ দরজা খুলে গেল৷
দরজার ওপাশে যে মানুষটা এসে দাঁড়িয়েছে তাকে দেখে ভয় বা সঙ্কোচের বদলে বেশ কিছুটা শ্রদ্ধা এসে জমা হল আমার মনের ভিতর৷ দীর্ঘ, ঋজু চেহারা৷ বয়স অন্তত ষাটের কাছাকাছি৷ মুখভরতি একগাল উস্কোখুস্কো সাদা দাড়ি৷ বয়সের তুলনায় চেহারা বেশ শক্তসমর্থ৷ দাড়ির ভিতর থেকে গালের কাছে উঁচু হয়ে থাকা হাড়দুটো চোখে পড়ে৷ এই বয়সেও চামড়ায় বলিরেখার কোনও দাগ নেই৷ ঘন নীল চোখে কিছুটা যেন লালের আভাস৷ গোটা চেহারার মধ্যে একটা আলুথালু ভাব৷ বোঝা যায় বয়সের ভারে ঝুঁকে না পড়লেও দারিদ্র তাঁকে কুড়ে-কুড়ে খেয়েছে৷
আমার দিকে তাকিয়ে মিহি হাসলেন ভদ্রলোক, তারপর ধীরে-সুস্থে এগিয়ে এসে আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসতে-বসতে বললেন, ‘হঠাৎ বৃষ্টির আগমনে আটকে গেছিলে, তাই তো?’ একটু হেসে আবার বললেন, ‘তা আমার বাড়িখানা খুঁজে পেয়ে ভালোই করেছ৷ আমি আসলে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, নতুবা নিজেই দরজা খুলে দিতাম৷ তোমার মতো অল্পবয়স তো নয় আর, একটু বেশি ঘুম দরকার পড়ে৷’
আমি সৌজন্য দেখিয়ে একটু হাসলাম৷ ভদ্রলোকের কথা বলার ধরন কেমন যেন সেকেলে৷ একা থাকেন বলেই মনে হয় কথা বলার অভ্যাসটা চলে গেছে৷
‘দূরদেশে যাচ্ছিলে মনে হয়৷ আজকাল তো এদিকটায় বড় একটা কেউ আসে না৷’
‘আশপাশে কোনও বাড়ি নেই৷ আমি উপায় না দেখে… আসলে এভাবে কারও বাড়িতে না বলে ঢুকে যাওয়াটা…’
‘আরে না-না…’ উচ্ছ্বাস মেশানো হাসি হেসে উঠলেন ভদ্রলোক, ‘তোমাকে দেখে আমি খুশিই হয়েছি৷ এদিকটায় নতুন মুখ তো প্রায় চোখেই পড়ে না৷ তুমি আসছ কোথা থেকে?’
‘এখানে কাজে এসেছি, থাকি বোস্টনে….
‘বোস্টন!’ কী যেন ভাবলেন একটু, ‘আমি নিজে কখনও বোস্টন যাইনি, কিন্তু চুরাশি সাল নাগাদ যে স্কুলে পড়াতাম সেখানে আমার এক বোস্টনবাসী সহকর্মী ছিল, ভদ্রলোক হঠাৎ করেই পড়ানো ছেড়ে দিয়ে…’ থেমে একবার জিভ কেটে হাসলেন, ‘বয়স হয়েছে বুঝতে পারছ তো, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে চলে যাই…’
লোকটাকে আমার খারাপ লাগছে না৷ তাকে দেখে রাশভারী মনে হয় বটে কিন্তু আমার সঙ্গে তো বেশ যেচে পরেই এতগুলো কথা বলছেন৷ পিগাফেট্টার রেগনাম কঙ্গোটার কথা মনে পড়তে আমি মুখ তুলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, এই বইটা আপনি কোথা থেকে পেলেন বলুন তো?’
ভেবেছিলাম ভদ্রলোক অসন্তুষ্ট হবেন৷ তার বদলে বেশ খুশি হয়েই উত্তর দিলেন তিনি, ‘অহ ওই বইটা? আমার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন এবেনেজারের কাছে ছিল বইটা৷ আটষট্টি সাল নাগাদ তিনি যুদ্ধে দেহ রাখতে এই বইটা আমার হস্তগত হয়৷’
ক্যাপ্টেন এবেনেজারের নামটা আমার চেনা লাগল৷ তবে এর আগে কোথায় শুনেছি সেটা ঠিক মনে পড়ল না৷ পরে জিজ্ঞেস করে নেব ভেবে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না৷
‘এবেনেজার একসময়ে সালেমের জাহাজের নাবিক ছিল৷ যে বন্দরে জাহাজ ভিড়ত সেখান থেকেই পুরনো জিনিসপত্র সংগ্রহের একটা বাতিক ছিল তার৷ তার বাড়িতে একবার ঘোড়া বেচতে গিয়েছিলাম আমি৷ তখনই দেখতে পাই বইটা৷ বইতে আঁকা ছবিগুলোর উপরে একরকম আগ্রহ জন্মায় আমার৷ বিশেষ করে ওই জায়গাটায়… আমার চশমাটা…’
টেবিলের নীচ থেকে ধুলো-ময়লা ঘেঁটে একটা নোংরাটে ভাঙা কাচের চশমা বের করে আনেন ভদ্রলোক৷ তারপর সেটা চোখে গলিয়ে বইটা সামনে টেনে নিয়ে পাতা উল্টাতে-উল্টাতে বলেন, ‘এবেনেজার ল্যাটিন কিছুটা পড়তে জানত৷ আমি একেবারেই পারি না৷ এক স্কুলমাস্টারকে একবার জোগাড় করেছিলাম, সে আমাকে পড়ে শোনাত৷ কিন্তু মুশকিল হল, সে একদিন পুকুরে ডুবে মরল৷ তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো তো কিছু বুঝতে পার কি না…’
ল্যাটিন ভাষাটা আমি কিছুটা জানতাম৷ বইটা সামনে এনে প্রথম দিক থেকে কয়েকটা প্যারাগ্রাফ পড়ে মানে বুঝিয়ে দিলাম তাকে৷ দু-একটা ভুল যে হয়নি তা নয় কিন্তু লোকটার সেটা বোঝার উপায় নেই৷ উল্টে মনে হল আমি মানে বুঝিয়ে দেওয়ায় বেশ কিছুটা খুশিই হয়েছেন তিনি৷ উৎসাহ একটু-একটু করে বেড়ে উঠতে লাগল তাঁর৷ বুঝলাম এতদিন কৌতূহলের বশে কেবল ছবিগুলোই দেখে গেছেন৷ আজ তাদের মানে জানতে পেরে একটু বেশিই খুশি হচ্ছেন৷
আঙুল দিয়ে একটার পর একটা জায়গা আমাকে দেখিয়ে যেতে লাগলেন তিনি, একটা বিশেষ জায়গায় এসে দেখলাম তাঁর ভুরু দুটো কুঁচকে গেল, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে… এই জানোয়ারটা কী বলো তো?’
বইয়ের পাতায় যে প্রাণীটা আঁকা আছে সেটা আগে কোনওদিন পৃথিবীতে ছিল বলে আমার মনে হয় না, অর্ধেকটা ড্রাগন আর বাকিটা কুমিরের মতো৷ প্রায় দুটো পাতা জুড়ে আঁকা আছে ছবিটা৷ তবে খুব একটা বর্ণনা কিছু করা নেই৷ তার ঠিক পরের পাতাতে কিন্তু একটা চেনা ছবি চোখে পড়ল, আধা-মানুষ আধা-বানরের মতো দেখতে একটা জন্তু, মোটামুটি একটা ধারণা করে আমি বললাম, ‘এগুলো তো বিবর্তন বোঝাতে চেয়েছেন মনে হচ্ছে৷ তবে শিল্পী কিছুটা যে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন তা তো বুঝতেই পারছেন৷’
‘কল্পনা! কল্পনা বলছ কেন?’ লোকটা আমার দিকে চেয়ে একটা লুকানো হাসি হাসল, ‘বিবর্তনের পথে এমন অনেক প্রাণী জন্মেছিল যার হদিস আমরা এখনও পাইনি৷’
‘তা বলে ড্রাগন আর কুমিরের হাইব্রিড!’
‘আশ্চর্যের কিছু নেই৷’ লোকটা আমার দিকে থেকে চোখ নামিয়ে নিল, তারপর দ্রুত পাতা উল্টাতে-উল্টাতে বলল, ‘তবে এবার আমি তোমাকে এই বইয়ের সব থেকে আশ্চর্য জিনিসটা দেখাব৷’
লোকটার হাতটা কেঁপে যাচ্ছে বারবার৷ লক্ষ করলাম তার চোখ দুটো এখন আগের থেকে আরও কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে৷ পাতাগুলো নাড়াচাড়া করতে সহজে সরে যেতে লাগল তারা৷ যেন বইটা নিজেই একটা বিশেষ জায়গা দেখাতে চাইছে আমাদের৷
যে ছবিটা আমার চোখের সামনে খুলল সেটা একটু আগেই দেখেছি আমি৷ একটা কসাইয়ের দোকান৷ হাতে একটা চপার নিয়ে দোকানের একেবারে মাঝখানে একটা ভয়াবহ চেহারার মানুষ বসে আছে৷ এবং দোকানের ভিতরে চারদিকের দেওয়ালে ঝুলছে কিছু মৃত প্রাণীর দেহ৷ প্রাণীগুলো কোনও পশু নয়৷ মানুষের হাত, পা, কাটা মাথা৷
সেই হলদে হয়ে যাওয়া ছবি দেখেও ঘৃণায় আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম৷ লোকটা কিন্তু সেই রকম উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রইল সেই দিকে৷ সম্মোহিতের মতো বলল, ‘এর কিছু মানে বুঝতে পারছ কি? এই যে এই লোকটা, এই কসাইটা ছুরি হাতে বসে আছে৷ একে দেখলেই আমার শরীরটা কেমন যেন চনমনিয়ে ওঠে৷ একটু আগেই হয়তো ওই ছুরিটা দিয়ে একটা মানুষের মাথা কেটে নিয়েছে ও, কিংবা ধরো এই যে পা-টা দেওয়াল থেকে ঝুলছে… ওটা হয়তো একটা মাঝবয়সি লোকের… আর এই মাংসের স্তূপটা কোনও শিশুর… এই দেখো না এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার…’
লোকটার গলার আওয়াজ কমে আসছে একটু-একটু করে৷ তার চশমা পরা বৃদ্ধ মুখটা বিকৃত হয়ে উঠছে এবার৷ নিজের কথা আমি বলতে পারি না৷ একটু-একটু করে যে ভয়গুলো আমার মনের ভিতরে এসে জড়ো হয়েছিল সেইগুলো সবক-টা জমাট বাঁধা হয়ে একসাথে বেরিয়ে আসতে চাইল গলা দিয়ে৷
আমার সামনে বিকৃত মুখে বসে থাকা প্রাচীন পৈশাচিক প্রাণীটাকে আমি চিনি না৷ তার গলার স্বর এখন প্রায় ফিসফিসে পরিণত হয়েছে৷ সেই চাপা গলার স্বর আমার বুকের ভিতর অবধি ঢুকে আমাকে কাঁপিয়ে দিল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ক্যাপ্টেন এবেনেজারের কথা মনে পড়ে গেল৷ নামটা আমি শুনিনি আগে কোথাও৷ পড়েছিলাম৷ ইতিহাস বইতে৷ আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে যুদ্ধে মারা যান ক্যাপ্টেন এবেনেজার৷ কিন্তু তাহলে এই লোকটা তার সঙ্গে…
‘এবেনেজারের কাছে বইটা দেখতে ওটা সঙ্গে করে নিয়ে আসি আমি৷ মদের ঘোরে আমার কাছে বইটার ব্যাপারে কিছু কথা বলে ফেলেছিল এবেনেজার৷ তাতেই আগ্রহ জন্মেছিল আমার৷ পরে স্কুলমাস্টারকে দিয়ে বইটা পড়িয়ে জানতে পারি বইয়ের একটা বিশেষ জায়গায় নিজের আয়ু বৃদ্ধি করে নেওয়ার একটা উপায় বলা আছে তাতে৷
মানুষের মাংস, নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে মানুষের মাংস ভক্ষণ করলেই মানুষের আয়ু আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে যায়৷ স্কুলমাস্টার আমাকে ব্যাপারটা ভেঙে বলতে চাননি৷ উল্টে ফেলে দিতে বলেছিলেন বইটা… তাই তাকে…’
‘আপনি… আপনি…’
চেয়ার থেকে উঠে পড়ি আমি৷ একটু-একটু করে পিছিয়ে যেতে থাকি৷ লোকটার মুখ থেকে শয়তানি হাসিটা মিলিয়ে যাচ্ছে এবার, দুটো হাত তুলে আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আরে! তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? ওসব আজ বহুদিন হল ছেড়ে দিয়েছি আমি৷’
‘মিথ্যে বলছেন আপনি…’
‘বিশ্বাস করো৷ এত বছরে আমার দীর্ঘজীবী হওয়ার শখ ঘুচে গেছে৷ ও পাপ করতে চাই না আর৷’
পিছিয়ে যেতে-যেতে থেমে গেলাম আমি৷ বইটা এখনও আমার হাতে ধরা আছে৷ কোথা থেকে যেন মৃদু একটা আওয়াজ আসছে৷ বাইরে এতক্ষণে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে৷ তার মাঝেই অন্য একটা শব্দ৷ লোকটার মুখ করুণ হয়ে আসছে৷ আমার দিকে উঠে থাকা দুটো হাত তিনি নামিয়ে নিলেন৷
আর সঙ্গে-সঙ্গে ছাদের দিক থেকে তরল কিছু একটা এসে পড়ল আমার হাতে ধরা বইয়ের পাতাটার উপরে৷ ভেবেছিলাম ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে৷ মুখ নামিয়ে সেদিকে তাকাতেই ভুল ভাঙল—তরলটা লাল৷ দেখলাম চুঁইয়ে পড়া রক্তের ফোঁটায় ভিজে গেছে বইয়ের পাতা৷ চকিতে উপরে তাকালাম আমি৷ ছাদের দেওয়ালের ঠিক মাঝ বরাবর একটা লম্বা চেরা ফাটল৷ সেই ফাটলের গোটাটা ভরে গেছে তাজা লাল রক্তে৷ উপরের দোতলার কোনও ঘর থেকে চুঁইয়ে আসা রক্ত ঝালরের মতো ঝুলে রয়েছে সেখানে৷
সামনে থেকে একটা অতিমানবিক হাসি কানে এল আমার৷ সেটা নারী না পুরুষের তা বোঝা যায় না৷ সেই আদিম রক্তলোভী প্রাণীটা এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে৷ পরমুহূর্তে চকিত বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা বাড়িটা৷ আমি ছিটকে পড়লাম মেঝের উপরে৷ মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে আর কোনও কিছু লক্ষ না করে দৌড়াতে লাগলাম বাইরের দরজার দিকে৷
সেইভাবে মিনিট দশেক উদভ্রান্তের মতো দৌড়াতে বাড়িটা ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর চলে এলাম আমি৷ এতক্ষণে বাইরে সজোরে বৃষ্টি নেমেছে৷ সর্বাঙ্গ ভিজে গেল আমার৷ জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম আমি৷
সেই বৃষ্টির ধারার মধ্যে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম আকাশ থেকে নেমে আসা লেলিহান বিদ্যুতের একটা শিখা ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রাস করছে গোটা বাড়িটাকে৷
অনূদিত