চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

নির্জনতায় আমরা ভয় পাই, সজনতায় বিরক্ত হই

নির্জনতায় আমরা ভয় পাই, সজনতায় বিরক্ত হই

সরতে সরতে আমরা সবাই খোপে এসে ঢুকেছি। আমাদের এই মধ্যবিত্ত অস্তিত্ব, আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, জীবনচর্চা, চিন্তাভাবনা, সবই আমাদের ঝ্যাটা-পেটা আরশোলার মতো কানকোভাঙা, দাড়া-ভাঙা একধরনের প্রাণিতে পরিণত করেছে। চামচে-মাপা ধুর্তের জীবন। মেপে মেপে পা ফেলা। কত রকমের শৃঙ্খল; আমাদের বংশপরিচয়, স্ট্যাটাস, মান-সম্মান, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব যেন সূক্ষ্ম তন্তু। মাকড়সার জালে-জড়ানো বাহারি কাচপোকা, সময়ের শঙ্কা কালো মাকড়সার মতো আলপিনের চোখে তাকিয়ে আছে, ধীরে ধীরে সরে আসছে রোমশ দাড়া নেড়ে। এই বুঝি আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হল। বাঁধা মাইনের চাকরিটা ষাট বছর পর্যন্ত থাকবে তো? সেই সময়ের মধ্যে ছেলে জীবিকায় প্রতিষ্ঠিত হবে তো? মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে হবে তো? ব্যাঙ্কে বার্ধক্যের সঞ্চয় মাস চালানোর মতো সুদ আনবে তো? রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়াবে না তো? বাতে পঙ্গু হব না তো? জীবকোষের কোথাও হঠাৎ কর্কটরোগ বাসা করবে না তো? শেষ অবধি বোলচাল, ঠাটবাট ঠিক থাকবে তো? লোকে সেলাম বাজাবে তো? মৃত্যুটা না ভুগে হবে তো? স্ত্রীর আগে যেতে পারব তো? ছেলে মুখাগ্নি করবে তো? অশৌচান্তে মস্তক মুণ্ডন করবে তো? শ্রাদ্ধে যথেষ্ট ঘটা হবে তো? দেওয়ালে বড় মাপের ছবি ঝুলবে তো! কেউ দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলবে তো! হরেকরকমের তো? জীবন যেন সার্কাস-কন্যার তারে হাঁটা। সব সময় আতঙ্ক, এই বুঝি ভারসাম্য হারিয়ে চিৎপাত হয়ে কয়েকশো ফুট নীচে পড়ে গেলুম। পতন রোধের জন্যে নীচে কোনও জাল বিছানো নেই।

পরিসর যত ছোটই হোক, দেওয়াল চাই। মাথার ওপর ছাদ থাকা চাই, দোতলার ঘর হলে ভালো হয়। তার ওপর যেন আরও কয়েকটি তলা থাকে। তাহলে গ্রীষ্মের উত্তাপে তেমন কষ্ট হবে না। দক্ষিণটি যেন খোলা থকে। সেদিকে একটি মাঠ বা জলাশয় থাকে। দু-একটি বৃক্ষ। বৃক্ষের ডালপালা যেন জানালায় এসে খোঁচা না মারে। ঝড়ের দুলুনির জন্যে যেন মাপা জায়গা থাকে। ডালের ঝাপটায় মাথার ওপর বৈদ্যুতিক তার যেন ছিঁড়ে না যায়। ভোরে দু-একটি গানজানা পাখি যেন উড়ে এসে গান শুনিয়ে যায়। চব্বিশ ঘণ্টা কলে যেন অফুরন্ত জল থাকে। মাথার ওপরের প্রতিবেশী যেন শান্তশিষ্ট, ভদ্র হয়। নি:শব্দে চলা ফেরা। আমি সরব হলেও তারা যেন নীরব হয়। বেশি কাচ্চাবাচ্চা যেন না থাকে। তাদের বাড়ির মেয়েরা যেন সুন্দরী হয়। হিসেবি জীবনের সমস্যা অনেক। শরীরের বাইরে যত চেকনাই, ভেতরটা নড়বড়ে। বেশিরভাগই পিপুফিশুর দল! মুখে বচনের স্টেনগান।

সকালে ভালো কাপে খুসবুওয়ালা চা চাই। আবার মাসকাবারি চায়ের খরচ নিয়ে চেল্লানো চাই। বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মাখন খাওয়া একটি দর্শনীয় ক্রিয়াকাণ্ড। একশো গ্রামে সারা পরিবার এক সপ্তাহ। কেন্দ্র বা রাজ্য কী বাজেট করে! মধ্যবিত্তের বাজেট এক অসাধারণ অর্থনৈতিক ব্যায়াম। সানমাইকা লাগানো একটি খানা-টেবিল না হলে জাতে ওঠা যায় না। আহার শেষে কার ঘাড়ে মোছার ভার পড়বে, এই ভয়ে খবরে কাগজ পেঁতে খাওয়া। মাখমের পাত্রটি অবশ্যই সুদৃশ্য। ছুরিটিও বেশ চিকন। রুটিতে মাখন মাখাবার সময় পারস্পরিক দৃষ্টি বিনিময়। সকলেই সকলের নজরবন্দি। ছুরির ডগা দিয়ে বেশি মাখন কেটে নিলে নাকি? কত্তার বাজেট শেষ মাসে বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। স্নেহবস্তুর মৃদু স্পর্শে মানস আহার। রোজ মাছ না হলে মাথায় বজ্রাঘাত। সে মাছের চেহারা কেমন! মাইক্রস্কোপ দিয়ে খুঁজে নিতে হয়। পাতার পাশে কাঁটা পড়ে থাকে, বেড়াল মুচকি হেসে সরে যায়। বাবু এমন চোষন করেছেন, কাঁটার খাঁজে সামান্য একটু ফাইবারও লেগে নেই। ট্যাবলেট আকৃতি দুটি সন্দেশ, শৌখিন প্লেট, ঝকঝকে চামচ, বাহারি গ্লাসে জল, অতিথি সেবার আধুনিক ব্যবস্থা। এর বেশি, ইচ্ছে থাকলেও সঙ্গতি নেই। ইয়ার দোস্তকে মধ্যাহ্ন ভোজনে আপ্যায়িত করার ইচ্ছে হলে এক সপ্তাহ আগে গৃহিণীর কাছে লিখিত আবেদন পেশ করতে হবে। মঞ্জুর হলে তবেই আবাহন জানানো যাবে। সে অবস্থা আর নেই। পকেটে ক্যালকুলেটার, ঘরে ঘরে ক্যালকুলেটার। অসময়েও এক কাপ চায়ের প্রয়োজন হলে ডাকাবুকো কর্তাকে ততোধিক ডাকাবুকো গৃহিণীর সামনে গিয়ে মোসায়েবের মতো হেঁহেঁ করতে হবে। অফিসে যাঁর আস্ফালনে কেরানিকুল তটস্থ, গৃহে তাঁর অন্য চেহারা। হ্যাঁগা, হাঁগা, করে দিনাতিপাত। আলোচনার বিষয়বস্তু বৃত্তাকার, ওয়াইফ কিম্বা মিসেসের হয় হাইপ্রেসার, না হয় অ্যানিমিয়া, না হয় মাইগ্রেন, না হয় ফ্ল্যাটুলেনস, না হয় অম্বল, না হয় বাত। ছেলের এডুকেশান। আর শ্বশুরবাড়ির কৃতী কারুর সাফল্যের বৃত্তান্ত। কোনও একজন শ্যালক, অথবা শ্যালিকাকে আমেরিকায় থাকতেই হবে। যেমন আমাদের বরাত! তা না হলে শুনতে হবে কেন, কী দেশ! কী মাইনে? দেখতে হবে কেন, হোমিওপ্যাথিক শিশিতে যাওয়ার সময় দিয়ে গেছে বিলিতি পারফুম। জামা সাত সাতবার ধোওয়ার পরও গন্ধ লেগে আছে।

একটি খাট চাই। তার ওপর হয় এলাহি একটি ছোবড়ার গদি, সামর্থে কুলোলে আধুনিক ফোম ম্যাট্রেস। লতাপাতা-কাটা বেডকভার চাই। সেটি অবশ্যই এক্সপোর্ট কোয়ালিটির। দাম পঁয়ত্রিশ টাকার বেশি হলে হৃদয় চলকে উঠবে। দামি একটি বেড কভার তোলা থাকবে। মেয়েকে দেখতে এলে, অথবা কত্তার অফিসের বন্ধুরা এলে পাতা হবে। অভ্যাগতদের কেউ তার ওপর অ্যাশট্রে, কী খাবারের প্লেট রাখলে, গৃহিণী অন্তরালে কর্তাকে ফিসফিস করে বলবেন, দিলে তো বারোটা বাজিয়ে।

বারোমাস পাখার বাতাস চাই। রাতে লোডশেডিং হলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাই মুখপোড়া। ইলেকট্রিক বিলের অঙ্ক সামান্য বাড়লেই চিৎকার , স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই, ভাইপোতে ঝটাপটি। বাথরুমের আলো জ্বাললে কেউ নেবায় না। লক্ষ্মীছাড়ার দল।

বাজার খরচের চেয়ে প্রসাধনের খরচ বেশি। আধকৌটো পাউডার মেখে মহাদেব হয়ে তার ওপর গেঞ্জি আর জামা। মেয়েরা মুখে সাবান ঘষছে তো ঘষছেই। সাবানদানিতে জল থইথই। পঞ্চাশ ভাগ গলেই চলে গেল, টুথপেস্ট টিউবের আকৃতি ক্রমশই বোম্বাই হচ্ছে। ফ্যামিলি সাইজ। দুহাতে তুলতে হয়। টিপলে ফুটখানেক বেরোবে। দাঁতে লাগবে আধ ইঞ্চি, বাকিটা বাতিল। পেনি-ওয়াইজ পাউন্ড-ফুলিশের দল।

অভ্যাসের দাস, অর্থনীতির দাস, বাকসর্বস্ব, অকর্মণ্য এই প্রাণীটিকে হঠাৎ যদি কেউ বলে—যাও বৎস, তোমার সাদা-কলারের চাকরিটি কেড়ে নেওয়া হল, তোমার ভুয়ো নিরাপত্তার বোধ আর রইল না, কথা বেচে, দালালি করে আর চলবে না। ব্যাঙ্কের কাউন্টারে মানুষের সারি, বেতনভোগী বুদ্ধিজীবী, যাঁর বাক-চাতুর্যে সবাই অস্থির, জ্ঞানের যিনি হ্যালেজেন বাতি, তিনি সহকর্মীর সঙ্গে কাজ ভুলে খেলার আলোচনায় মশগুল। রেলের টিকিট-ঘুলঘুলিতে হাত ঢুকিয়ে একটি টিকিটের জন্যে আকুলিবিকুলি, ট্রেন ছেড়ে যায়, নিজের অধিকার-বোধে ষোল আনা সচেতন কর্মবীর, শুনেও শুনছেন না। এইসব প্রাোটিন-সচেতন, অর্থ-সচেতন, পরিবার-সচেতন, স্বার্থ-সচেতন, ফ্ল্যাটবাসী, পণ-আদায়কারী, কালীমন্দির গমনকারী, হিন্দি ছবিসেবী, পেপারব্যাক-প্রেমী কর্মবীরদের যদি বলা হয়, যাও বৎস, ফুটপাথে, নীল আকাশের নীচে নিরালম্ব অবস্থান করো, নিজের মুরোদটি একবার যাচাই করো।

তাহলে কী হবে! অনেকেই চোখে ধুতরো ফুল দেখবেন।

অথচ এই স্বাধীন ভারতের বৃহদংশ পড়ে আছে পথের পাশে। মাঠে ঘাটে ঝুপড়িতে। সব আয়োজনই তো, অর্থশালীদের জন্য। ভদ্রগোছের একটি আস্তানা—ভাড়া সাতশো। সেলামি পাঁচ হাজার। ভদ্রলোকের দৈনিক জীবন-যাত্রার খরচ শতের অধিক। সংখ্যা-গরিষ্ঠের মাসিক আয় একশো হলেও খুব হল। এঁদের জন্যেই যত জ্ঞানের কথা, ত্যাগের কথা, পরিকল্পনার যত তামাশা।

তবু এঁরা সুখী। ভাঙা আয়না, ফেলে-দেওয়া চিরুনি, বাবুর বাড়ির উচ্ছিষ্ট, রোদে-শুকনো রুটি, ফেলে-দেওয়া টিনের কৌটো, ছেঁড়া চট, ভাঙা লণ্ঠন, সিনেমার পোস্টার, এইসব সামান্য সামান্য বৈভব নিয়ে জীবনকে যাঁরা নির্ভয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, তাঁরাই এ দেশের সংখ্যা-গরিষ্ঠ নাগরিক। তাঁদের মাথার ওপর হোডিং-এ সিনেমার রাগী নায়কের বিদ্রোহ, নায়িকার প্রেম, সেরা মিলের সেরা কাপড়ে যুবক-যুবতী, চুলের শ্যাম্পু, মুখের মেক-আপ, প্রেশার কুকার, নিরামিষ প্রাোটিন, ষাট লক্ষ টাকার লটারি। এঁদের লজ্জা দিতে গিয়ে সারা দেশ আজ লজ্জায় সঙ্কুচিত। জীবনের শেষ কথা, মাথার ওপর আকাশ, পায়ের নীচে মাটি। যেতে একদিন সকলকেই হবে—সাজানো ঘরের সুন্দর খাট থেকেই হোক আর ফুটপাত থেকেই হোক। তবে মানবতার আকাশ-প্রদীপটি যেন নিবে না যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *