নিরুদ্দেশ যাত্রা
এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, ‘তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।’ আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস। এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্ত-কাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ কতোদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’, সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে। আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই। সন্ধেবেলা আম্মার ঘরে যখন যাচ্ছি, আকাশ কালো, রাস্তার মানুষজন নেই, চারটে জানলায় আমাদের পাতাবাহারের ছায়া লুফে নিয়ে পালিয়ে গেলো দুটো ফক্সওয়াগন, কাক আর বাদুড়েরা চিৎকার করে উঠলো; আমার মনে হলো আজ আমি একটাও ঘুমোতে পারবো না। আধ ঘন্টা একা কাটিয়ে আম্মার ঘর থেকে যখন ফিরছি তখন ভরা স্বরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার খারাপ লাগলো, আজ আমার একটুও ঘুম হবে না। আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।
আম্মার ঘরে যাবার জন্যে রঞ্জু উঠে দাঁড়ালো। দরজার সামনে এসে ছিটকিনি খুলবে বলে হাত তুলতেই মনে পড়লো বাইরে থেকে এটা বন্ধ। মাঝখানে একটা ঘর পার হয়ে আম্মাদের ঘর। তবু দরজার ছোটো একটা ফুটোয় ছুঁচলো ঠোঁট রেখে নিচু ও নরম স্বরে ফিসফিস করে উঠলো, ‘আম্মা, দরজা খোলো, দরজা খোলো।’
বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমে আসছিলো, রঞ্জু জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলো এখন একেবারে নেই। বকুল পাতার নিশ্বাস বড়ো শূন্য মনে হয়। ল্যাম্পোস্টে ভিজে আলোয় ইলেক্ট্রিক তারের ওপর সার বেঁধে জ্বলছে বৃষ্টির শিশির, জলের ফোঁটাগুলো এক পলক পর পর গানের টুকরোর মতো নিচে ঝড়ে পড়ছে। কাজলা দিদি এই তারের মধ্যে দিয়ে কোথায়, কার বাল্বে জ্বলে উঠছে? কোথায়? ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই, মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই?’ এই জায়গায় এসে কাজলা দিদির জন্যে রঞ্জুর ভারি খারাপ লাগলো। ব্যাকুল ও দ্রুত হাতে ধাক্কা দিতে দিতে রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকলো, ‘আম্মা দরজা খোলো, দরজা খোলো, আম্মা দরজা খুলে দাও, খোলো না তাড়াতাড়ি, খোলো। কয়েক সেকেণ্ড অনিয়মিত বিরতি দিয়ে এমনি চার পাঁচবার ডাকবার পর দীর্ঘ একটা বিরতির মধ্যে রঞ্জু জড়ানো একজোড়া স্বর শুনতে পায়।
‘কে? কে যেন ডাকছে না?’ স্বপ্নের মধ্যে থেকে আম্মা ছিঁড়ে আসছে, বেচারি মা আমার।
‘রঞ্জু।’ একটু থেমে আব্বা ফের বললো, ‘রঞ্জু না?’
‘রঞ্জু?’
‘হুঁ। এখনো ঘুমোয় নি।’
‘দরজা খুলে দিতে বলছে না?’
‘হুঁ। চ, চ। ডাক্তার কাল বললো না ওয়েদার পাল্টালে একটু ইম্প্রুভ করতে পারে?’
‘এই যে শোনো, ফের ডাকছে। কি করি, এ্যা? দরজা খুলে দেবো?’
আম্মার ভীরু স্বর শুনে রঞ্জুরো একটু ভয় করলো।
‘দরজা? দাও, খুলেই দাও। নইলে আরো বাড়তে পারে।’
‘যদি বেরিয়ে যেতে চায়?’
‘যাবে। এতো রাতে এসব ভাল্লাগে না। খুলে দাও।’
‘চলো, তুমিও চলো।’
‘একা যেতে ভয় করছে?’
পর্দার কাঁপা কাঁপা ছায়াকে মনে হয় অন্য কোনো মানুষ কিম্বা একজন মানুষ নয়। ‘পুকুর ধারে নেবুর তলে, থোকার থোকায় জোনাই জ্বলে,’ নেবুপাতার মর্মর শুনতে শুনতে রঞ্জু ফের বিমর্ষ হলো : একজন বিপরীত লোককে আমি মিছেমিছি প্ৰতিবিম্বিত করছি। বাইরে তালা খোলার শব্দ পেয়ে টেনে ছিটকিনি খুলে ফেললো। ঢেউ তোলা পর্দায় তাকিয়ে দ্যাখে এ্যাবসার্ড প্রতিবিম্ব টুকরো টুকরো ভেঙে পড়ছে।
‘এতো রাতেও ঘুমোসনি বাবা!’ বৃষ্টির পর আব্বার চুল শাদা, বিষণ্ন ও অল্প হয়ে গিয়েছে। আব্বার শুকনো কণ্ঠস্বরে প্রয়াস বড়ো করুণ।
রঞ্জু যেনো ট্রাঙ্কলে একটা শোক সংবাদ শুনছে।
‘এখনো ঘুমোসনি বাবা, কতো রাত হয়ে গেছে, যাও শুয়ে পড়ো।’ ঘুমভাঙা জিভের মধ্যে লুটোপুটি খেয়ে আম্মার শব্দগুলো ক্লান্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। আম্মা বেঁটে, ফর্সা ও গোলগাল। আম্মার ও আব্বার ছায়া তিরতির করে কাঁপছে দেখে রঞ্জু একটু অবাক হলো। এমন কেন হয়?
‘আম্মা, তোমাদের ঘরে ইয়ে ফেলে এসেছি।’
‘আমাদের ঘরে? কি ফেলে এসেছিস?’
‘কখন? কি ফেলে এলি?’
‘অই যে বিকেলবেলা, বৃষ্টি আসছে যখন’, সাজিয়ে কথা কইতে ভালো লাগছে, যেনো কথা এঁকে রঞ্জু সেই ছবি হাওয়ায় টাঙিয়ে দিচ্ছে, ‘আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে, তুমি যে বলছিলে, ‘অঞ্জুটা এখনো ফিরলো না, কোথায় যে আছে, ‘ তালগাছ থেকে মস্ত একটা ডাল উড়ে এসে তারের ওপর ঝুলতে লাগলো, ধুলোয় চারদিক একাকার, তখন তোমার ঘরে ফেলে এসেছি।’
‘কি, কি ফেলে এসেছিস?’
রঞ্জু ভারি বিব্রত হয়ে দেখলো ওর অনিচ্ছুক ছায়া আরো দ্রুত কাঁপতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা মেঝে, চেয়ারের গাঢ় খয়েরি পা ও টেবল ক্লথের লোটানো লতায় অগোছালো তাকিয়ে রইলো।
‘কি ফেলে এসেছিস কি?’
হঠাৎ অপরাধী, বিনয়ী ও এলোমেলো বলে ফেললো রঞ্জু, ‘ঠিক মনে করতে পাচ্ছি না, ভুলে গেলাম, কি যেনো ফেলে এসেছি।’
‘আচ্ছা, অই ঘরে চলো আমাদের সঙ্গে, কি ফেলে এসেছো, দেখবে চলো।’
আব্বা অসহিষ্ণু হাসলো একটুখানি, ‘চলো, তাড়াতাড়ি চলো।’
পর্দার এপারে এলে আলোছায়া আর রইলো না। অঞ্জু মঞ্জু দুটো বিছানায় অনায়াস ঘুমোচ্ছে, স্বপ্নময়, নরম অন্ধকারে, সাধের মধ্যে সেঁধে। শেলফে আলমারিতে বইগুলো সারি সারি কফিনের মতো শুয়ে রয়েছে, এসব পার হয়ে ওরা একটা বড়ো ঘরে ঢুকলো, আব্বা, আম্মা আর রঞ্জু।
দেওয়ালে কোনোদিন-উড়বে-না তুলোর শাদা প্রজাপতি ও সবুজ সুতোর প্রেমিক ময়ুর দম্পতি লালচে হয়ে গিয়েছে। ইজি চেয়ারের বিস্তৃত হাতায় বেহায়া বার্নার্ড শ’র ওপর আব্বার পুরু চশমা মশারিকে পানসে তাকাচ্ছে।
‘কোথায়? কি ফেলে গিয়েছো মনে পড়ছে?’
সন্ধেবেলা, তখনো আকাশ ভারি মেঘলা, চারদিকে আঁধার করে আসছে, এই ঘরে কি যেনো ফেলে গেলাম।
আলমারির লম্বা আয়নায় পেছনের দেওয়াল শাদা ও নিরুদ্বেগ প্রতিফলিত। আব্বার পালঙের মাথায় অন্তরঙ্গ টেলিফোনে কারো কণ্ঠস্বর জড়ানো রয়েছে স্পঞ্জের মধ্যে, রিসিভার তুললেই বাজতে শুরু করবে।
‘কোথায়, রঞ্জু?’ আব্বাকে বিকেলবেলা অনেক পুরুষ শোনা যায়, কিন্তু এখন এতো সাধারণ, রঞ্জুর একটু দুঃখ হলো, দিনদিন আব্বা বড়ো সাধারণ ও সংসারী হয়ে পড়ছে।
‘কোথায়, মনে পড়ছে এখন? কি ফেলে গিয়েছিলে? কি?’
‘রঞ্জু, ভেবে দ্যাখো না বাবা, মনে পড়ছে?’
মৃত্যুমন্থর এই রাত্রি কেবলি সময়হীন ছড়িয়ে পড়ে। রোগা হয়ে রঞ্জু একটু কাঙাল হাসলো। ফ্যাকাশে বলতে লাগলো, ঠিক মনে করতে পাচ্ছি না আম্মা, একেবারে ভুলে গেলাম।’ কি জিনিশ বারবার ভুলে যাচ্ছি। সন্ধেবেলা, যখন চারদিক আঁধার করে এলো, না তবে বোধ হয় অন্য কোনো সময়ে কি যেনো ফেলে গেলাম, আমি ঠিক—কি যেনো। চোখের মনির মধ্যে তখন আশ্চর্য একটা অকাল আঁধার সূর্যোদয়ের মতো জেগে উঠলো ধীরে ধীরে, ঝাপশা ও নিরাকারকে নিরনুভব স্থির তাকিয়ে রঞ্জু কন্ঠের ঘন লবন-লালে মর্মর করে উঠলো, ‘তবে অন্য কোথাও বোধ হয়।’ ওর আরো ভেতরে হৃদপিণ্ড ও এ্যাবডোমেনের চামড়ার দেওয়ালে ভাসা ভাসা প্রতিধ্বনিত হলো, ‘কোথায় যেনো ফেলে এসেছি।’ চোখের চোপসানো চুলোয় বলকানো আঁধার ফুটিয়ে রঞ্জু আব্বা ও আম্মার সঙ্গে নিজের ঘরে ফিরলো।
‘আমরা যাই, তুমি ঘুমোও, কেমন?’ ওর গায়ে একটা চাদর টেনে দিয়ে আম্মা আব্বার দিকে তাকালো। আম্মা ও রঞ্জু দেখলো আব্বার চোখ ভারি ছলছলে।
‘রঞ্জু!’ আব্বার ডাক শুনে রঞ্জু অবাক হলো। কন্ঠস্বর ফের অন্যরকম হয়ে গিয়েছে, নিচু, ক্ষীণ ও নেই-নেই।
‘এখন ঘুমিয়ে পড়ো বাবা। দুটো দরজাই খোলা রইলো। যদি খুব খারাপ লাগে বারান্দায় যেও, রাস্তার বেরিয়ো না, আকাশ আজ ভারি বিশ্রী। ঘুমিয়ে পড়ো, কেমন?’
‘আমার ঘুম আসে না।’ রঞ্জু গুনগুন করে উঠলো।
‘চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকো। ভাবতে থাকো, সামনে মস্ত এক মাঠ, মাঠে অনেকগুলো ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে, অগুণতি ভেড়া, হাজার হাজার লাখ লাখ ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। অইগুলো গুনতে থাকো, মনে মনে গোনো, এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়।’
কোথায় যেনো আমি এমনি একটা মাঠ দেখেছি। সেই মাঠের একদিকে ধূসর রঙের পাহাড়, দীর্ঘ একজন মানুষ পাহাড়ের বিপরীত দিকে হাজার হাজার ভেড়ার পেছনে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কবে দেখেছি? কবে? কোন জন্মে?
‘এমনি গুনতে থাকো, দেখবে টায়ার্ড হয়ে পড়ছো, তখন তোমার ঘুম পাবে।’
‘টায়ার্ড হয়ে পড়লে ঘুম আসবে?’ আমি তো সব সময়ই ভারি ক্লান্ত হয়ে থাকি, আমি এক জন্ম-ক্লান্ত লোক, আমার তবে ঘুম আসে না কেন? ‘হ্যাঁ বাবা, চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষন ধরে গুনতে থাকো, দেখো, কেমন সুন্দর ঘুম পাবে। আমি কতোদিন এমনি করে ঘুমিয়েছি।’
ওরা চলে যাবার পরো আম্মার শাড়ির ঘুম ঘুম গন্ধ সারা ঘরে নিথর জমে রইলো। নীল আলোর ফ্যাকাশে গন্ধ, বাইরের সোঁদা মাটির আভাস, আব্বার ছড়িয়ে যাওয়া সিগ্রেটের লুপ্ত ধোঁয়া, নিচে পুরোনো স্টেটসম্যান, ধুলোভরা স্লিপার, টেবলে শোপেনহাওয়ারের অনন্ত সৌরভ রঞ্জু নিবিষ্ট কুঁকড়ে শুয়ে সমস্ত ঘর ব্যাপী ঘন গভীর নিশ্বাস নিতে শুরু করলো।
এই ঘরের গন্ধ দিন দিন পাল্টাচ্ছে। আগে ভোরবেলা এখানে নোতুন ‘ছড়ার ছবি’র গন্ধ করতো। মনে হল, জবাব এল, ‘আমরা নাই নাই’। —এই কথাগুলো যে পাতায় ছিলো সেখানে সুন্দর তেতো গন্ধে চোখ রাখলে আমার ঘুম আসতো। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গিয়েছে আম্মার নীল জর্জেটের শাড়ির গন্ধে। অই শাড়িটার পুরোনো পুরোনো গন্ধ ছিলো একটা। ন্যাপথলিন, বাক্সের চামড়া, বাতাস সব মিলিয়ে এই সুবাস কতোরাতে রঞ্জুকে জাগিয়ে তুলেছে।
‘আম্মা, ছবি দেখতে যাচ্ছো?’
‘ও মা, তুই ঘুমোসনি এখনো?’ শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে আম্মা মিষ্টি করে তাকাতো, ‘যাও বাবা ঘুমোও, এসব বড়োদের ছবি, তোমাদের দেখতে নেই।’ তখন রূপমহলে কেবল বাঙলা ছবি চলতো। আম্মা আমাকেও নিয়ে গেছে মাঝে মাঝে, ‘সেতু’ ছিলো একটা ছবির নাম, ‘সংসার’, ‘নিয়তি’, ‘বাবলা’, আরো সব কি নাম, মনে নেই। আব্বা একটু একটু রাগ করতো, ‘এসব ছবি তোমাদের জন্যে নয়, তোমাকে ‘টারজান’ দ্যাখাবো।’
মঞ্জু আর আমি আব্বার সঙ্গে নিউ পিকচার হাউসে টারজানের ছবি দেখে এলাম। তখন বুঝি সিনেমায় সিগ্রেট খাওয়া বারণ নেই, আব্বা সিগ্রেট ধরিয়েছিলো, আমার মনে আছে। ইন্টারভ্যালের সময় সামনের সিটে একজন কাকে যেনো একটু জোরে জোরে বললো, ‘আরে না না, এবারো ফেল করেছে।’ কেউ বোধ হয় কোনো পরীক্ষায় ফেল করেছিলো। সে কি বারবার ফেল করতো?
হঠাৎ দ্রুত ও বিরতিহীন ঘন্টাধ্বনি শুনে দিশেহারা বুকে রঞ্জু জানলার সামনে দাঁড়ালো। চাদরটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে, অর্ধেকটা বিছানায়, জমানো প্রবাহিত হচ্ছে বিছানা থেকে মেঝেয়। ঢং ঢং চিৎকার করে ছুটে গেলো ফায়ার ব্রিগেডের লাল রঙের দ্রুতশ্বাস গাড়ি, কার সর্বনাশ ঘটলো এতো রাতে, ফর হুম দ্যা বেল টলস্? কার বাড়ি ধ্বসে গিয়েছে, এইরাতে আগুন লেগেছে কোনখানে? চারদিকে জলের পাতলা জালে আলোর ইল্যুশন ফেলে গাড়িটা কোথায় মিলিয়ে গেলো। তখন কেমন হতাশ চিত্তে ও বাইরে এসে দাঁড়ালো। ঘর থেকে নীল আলোর একটুখানি এখানে এসে পড়েছে; আকাশে কালো মেঘ, কিন্তু বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, গাছপালায় ভিজে অন্ধকার ছিপছিপে ছড়ানো; এই আলো ও আঁধারিতে, এই নীরব নিসর্গে ছমছম ভয় করে আমার।
কাঠের পুরোনো ছোটো ভিজে গেটটা নরম হয়ে গিয়েছে। ডান হাতের নখ দিয়ে রঞ্জ অল্প একটু কাঠ তুলে ফেললো। খুব ফ্যাকাশে, নেই-নেই একটা ভিজে গন্ধে ভারি পাতলা করে দুবার নিশ্বাস নিলো।
রাস্তার লাল সুরকির ফাঁকে ফাঁকে জল একটু একটু ঘোলা, ইলেক্ট্রিক তার, মেঘলা আকাশ, ল্যাম্পোস্টের বিনীত মাথা সেই জলে তির তির কাঁপে। ম্লানআলো বাল্বের অইটুকু ছায়ায় রঞ্জু দেখতে পেলো নিশ্চিন্তপুরের সময়-কাঁদা, নির্লিপ্ত মাঠে দুপুর ঝাঁ ঝাঁ করছে। ছোটো ছোটো ছায়া ফেলে দুর্গার সঙ্গে রঞ্জু রেললাইন দেখতে কতোদূরে পাড়ি দিচ্ছে। দুর্গা সিঁদুরের কৌটো চুরি করে তাকের ওপর লুকিয়ে রেখেছিলো বলে রঞ্জুর বড়ড়ো মন খারাপ করে। ‘দিদি, তুই সিঁদুরের কৌটা চুরি করলি কেন?’ দুর্গাকে শুধোবে বলে রঞ্জু সামনের দিকে সোজা স্পষ্ট তাকালো। দেখলো, অন্ধকার ও জলের মধ্যে নিশ্চিন্তপুর অতল ডুবে গিয়েছে। ল্যাম্পোস্টে ঠেস দিয়ে দুর্গা রঞ্জুকে ভারি সময়হীন তাকাচ্ছে। দুর্গার শরীর একজন নিপুণ প্রতিমা হয়ে রঞ্জুর সমস্ত স্মৃতিকে গেঁথে রেখেছে। রঞ্জ উদ্বেল বুকে কলকল করে উঠলো, ‘দিদি!’
তখন প্রচণ্ড, নির্বাক, নিষ্পন্দ, সাংঘাতিক আতঙ্কে ওর গলা লম্বা হয়ে গেলো, শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোতহীন দাঁড়িয়ে পড়লো শীতল প্রাণহীন রক্ত : কতোকাল হলো দুর্গা মারা গিয়েছে!
ওকে নিরভর ও স্নায়ুহীন করে গামবুট রেনকোটে মোড়া দুর্গা হান্টার হাতে এগিয়ে এলো।
‘কে?’ উত্তর না পেয়ে লোকটা ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো, ‘আপনি? ইলিয়াস সায়েবের লড়কা না? কুথায় যাচ্ছেন?’
‘কোথাও না।’
‘এতো রাতে ডাঁড়িয়ে আছেন কেনো?’ পুলিস জিগ্যেস করলো, ‘ঘরে চলে যান। এই মেঘলা রাতে বাহারে এসেছেন কেনো?’
রঞ্জু বললো, ‘এমনি। ঘুম আসছে না। বাদলা রাতে আমার ঘুম হয় না।’
‘নিদ আসছে না, না? একটু পাইচারি করেন রাস্তায়, বেশ আরাম লাগবে, দেখবেন।’
বৃষ্টি আর পড়ছে না। কিন্তু আকাশ জুড়ে কালো কানা মেঘ শেষ তারাটিকেও নিভিয়ে দিয়েছে। দুদিকের গাছ থেকে টিপটিপ জলপড়া শুনতে শুনতে পুলিসের সঙ্গে রঞ্জু হাঁটতে লাগলো।
‘আপনি কালিজে পড়েন?’
‘না।’
‘চাকরি করেন, না?’
‘না।’
‘কেনো? কিছু করেন না?
‘এমনি, ভালো লাগে না।’
‘ভালো লাগে না?’ পুলিস একবার রঞ্জুর দিকে তাকালো, আপনার দাদার তবিয়ত এখন কেমন?
‘আপনি দাদাকে চেনেন?’
‘হুঁহ্!’ পুলিশ একটুখানি হাসলো, ‘চিনি না? আপনের দাদা যখন কাটিহারে ছিলেন, তখুনি তো হামি পরথম কনস্টেবল হলাম। তারপর হাওড়া, শান্তাহারেও একসাথ ছিলাম। আপনের আব্বারা তো তখন সব ছেলেমানুষ।’
‘আপনি আমার আব্বাকে চেনেন?’
‘তোমার জন্মের আগে থেকে চিনি বাবা, বহুত দিন থেকে চিনি।’ উচ্ছাসে পুলিসের কন্ঠ বলকানো দুধের মতো শব্দ করে উঠলো। একাগ্রচিত্তে রঞ্জু এই স্মৃতিশিহরিত মানুষকে ব্যাকুল তাকিয়ে রইলো। ‘কাটিহারে থাকতে, তোমার দাদা যখন কাটিহারে ছিলো, খুব দাপটে থেকেছে, অমোন বড়োবাবু হামি আর দেখলাম না।’
এক হাত কোমরে রেখে হান্টারটা নিজের হাঁটুতে ঠেকিয়ে পুলিস দাঁড়িয়ে পড়লো। বাঁ দিকের রাস্তার শেষে ল্যাম্পোস্টে তাকিয়ে স্বগতের মতো মর্মর করতে লাগলো, ‘তোমার আব্বা তখন কোলকাতায় পড়তো আর খালি মিটিং করতো ছাত্রদের সাথে মিলে। এই আজ রাণাঘাট তো কাল ঢাকা তো পরসোঁ বর্জোয়ান, ফের সেরাজগঞ্জ, কখনো পাটনা, দিল্লী চলে গিয়েছে—এই খালি ঘুরতো আর মিটিং করতো। বড়োবাবু কতো রাগ করেছে, তুমি এইসব করবে তো পঢ়ালিখা করবে কখন?’
রঞ্জুর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে : এইসব দিন আমার জন্মের কতো আগে মিশে গিয়েছে। এদের জন্যে আমার এমন করে কেন? আব্বার রক্তের সঙ্গে এই দিনগুলো কি আমার শরীরে উজান বয়ে এলো? আমার ভারি ইচ্ছে করে একবার এদের ছুঁয়ে দেখি।
তখন কোথায় যেনো বাজ পড়লো, অতর্কিত স্বাভাবিক কণ্ঠে পুলিস বললো, ‘আমি এই রাস্তায় চলে যাবো ডিউটি দিতে। বাদলা রাত পেয়ে শালারা বহুত সুবিধা পেয়ে যাবে। আপনি বাড়ি যান বাবা, কোথায় বাজ পড়লো, বিজলী চমকাচ্ছে, ফির বারিশ হোবে।’
রেনকোটে ঢাকা কনস্টেবল স্মৃতি ও বিষাদে নুয়ে সাধহীন হেঁটে চলে গেলো ধীরে ধীরে। দুই দিকের বাড়িঘর সরে সরে গিয়ে ওকে পথ করে দিচ্ছে। মোড়ে ল্যাম্পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পুলিস রঞ্জুকে অবশ হাত নাড়লো। এখন একটুও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। মাথা নিচু করে সামনে তাকিয়ে রঞ্জ অন্ধকারের পানে পা বাড়ালো।
গায়ের ওপর ঝিরঝির বৃষ্টি পড়লে রঞ্জু ওপরে তাকিয়ে দ্যাখে মেঘে মেঘে আকাশ কতো নিচে নেবে এসেছে। চারদিকটা কেমন ছায়া ছায়া। পুরোনো জামগাছটায় হাজার হাজার ভিজে পাতা উদ্বন্ধন আত্মহত্যায় অতৃপ্ত ঝুলছে। রঞ্জুর গা’টা শিরশির করে উঠলো, এই যে পুলিশ আমার গতরক্তের স্মৃতিকে রোদন করে গেলো এ কি পুলিস, না অন্য কেউ? এ কি কেউ, না কেউ-নয়? এ যদি কেউ-নয় হয়? না, আর ভাবা যায় না, মাথা নিচু করে কোনো দিকে না তাকিয়ে হন হন হাঁটতে শুরু করলো।
এখানে শহর শেষ। নদীর ওপর ঢেউ-খেলানো লম্বা মাঠটা গেরুয়া নিশ্বাস নেয়, বৃষ্টিতে ভিজে এখন একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। নদীর তীরে একটা পুরোনা শিমূল গাছ সারাদিনরাত ওপারে তাকিয়ে থাকে। মন্থর মেঘগুলো অনিয়মিত বিদ্যুতে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, রঞ্জু বিদ্যুতের আলোয় দ্যাখে : এই মাঠে আমি আগে মেলা এসেছি। এক হাজার নয়শো তেতাল্লিশ বছর আগে আমার স্কুলের বন্ধুরা এখানে ক্রিকেট খেলতো। আমি নদী তীরে বসে, মাঝে মাঝে ওদের দিকে, কখনো নদীর পানে চেয়ে সময় ও বিষাদ কাটিয়েছি। শেলী কতোবার ডেকে গেলো, এই রঞ্জু, খেলবি নিকি? আমার ভয় করতো, আমি একদিনো খেলিনি। কতোদিন সন্ধে হতে দেখেছি এখানে। সন্ধের পরো উঠতে ইচ্ছে করতো না; মলিন নদীতে দুঃখী চাঁদ ফ্যাকাশে জ্যোস্না ঢেলে দিলো, আঁধারে নিসর্গ হয়ে উঠলো মূর্তি; নদীর শীর্ণ সুবাস, জলের অন্তর্বাস থেকে উঠে আসা নিরেট ভারী গন্ধের মধ্যে অকাললুপ্ত হয়ে গেলো, আমার কেমন লাগতো। একদিন ওরা ক্রিকেট বল হারিয়ে ফেলেছিলো। সারা বিকেল খুঁজলো, চাঁদমারির তিনদিকে ছোটো ছোটো ঝোপ, পশ্চিমে শিরীষ পাওয়া গেলো না, ছেলেরা অন্ধকার, শিমূলতলা—সেই বল কোথাও খারাপ করে বাড়ির দিকে চলে গেলো।
আমি কোথায় কি যেনো হারিয়ে এসেছি। ওর চিত্ত ভারি এলোমেলো হয়ে পড়লে আমি কোন ভয়ানক উদ্বিগ্ন বোধ করে; উৎকণ্ঠ হয়ে কেবলি মনে করতে লাগলো, আমি কোথায় কি যেনো ফেলে এসেছি। কোথায়? তখন বিহ্বল রঞ্জু শিমূল গাছের নিচে শুয়ে পড়লো, নদীর জলে উন্মুখ কান পেতে।
কালো আকাশ ভেঙে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। ওর এখন একটু একটু তেষ্টা পেয়েছে; জিভ দিয়ে ঠোঁট বুলোতে বুলোতে রঞ্জু শুনতে পায়, নদীর অনিকেত জলে পাগল ঢেউয়েরা জন্ম নিচ্ছে কেবলমাত্র মরবার জন্যেই। শিমূল গাছের বুকে মাতাল সমীরণ বেপরোয়া জায়গা করে নিচ্ছে। মেমোরি-মর্মরিত রঞ্জু তখন আব্বার শাদা রঙের তরল-ঘন সাধ, আম্মার রাঙা আঁধার থেকে শুরু করে নিশ্চিন্তপুরের মাঠ, নদীর জল, পাতার মর্মর সবাইকে এক ঠাঁই করে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াতে লাগলো। এ রকম এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য, এইকাল থেকে সেই কাল ঘুরে ঘুরে রঞ্জুর তেষ্টা ওর কণ্ঠের মধ্যে শুঁড় বসিয়ে দিলো।
রঞ্জু জলের জন্যে কাঙাল হাঁ করে রইলো। বৃষ্টির জল ওর চিবুকে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, নাকের ডগা থেকে ছিটকে চলে যায় কোথায়, গালে জলের ছিটে লাগছে। চারদিকে এতো জল, একটি ফোঁটাও ওর পাতলা ঠোঁট বেয়ে পড়লো না যা কিনা এলোমেলো দাঁতের সারি পার হয়ে জিহ্বার সড়ক ধরে কণ্ঠে পৌঁছে যেতে পারে। রঞ্জু জনের প্রত্যাশায় জলে-ডোবা মানুষের মতো এলোপাথাড়ি ঢোঁক গিলতে লাগলো। প্রত্যেকটা ঢোক কাঁটা হয়ে ওর বুকের মধ্যে খোঁচা খোঁচা গেঁথে যাচ্ছে কেবল।
প্রবলরকম ঝড় হইতে শুরু করেছিলো। আর দ্যাখো, এমন সময় শিমুল গাছের মস্ত একটা ডাল তার সমস্ত মর্মরিত পাতা, কাকলিশূন্য নীড়, বৃষ্টির ছড়ানো ফোঁটা ও রঞ্জুর জন্যে বুকভরা বর নিয়ে ঢেউয়ের মতো শব্দ করে ভেঙে পড়লো। রঞ্জুর মনে হলো, আমার ওপর, আমার বুকের মধ্যে, কালো, অন্ধকার ও ভারী কোনো নিরাকার নিশ্বাস স্থায়ী আশ্রয় নিয়েছে। দ্যাখার জন্যে ও চোখ খুলতে চেষ্টা করলো; কিন্তু ভিজে শিমুল ফুলের রাশি স্তূপাকার পড়ে রয়েছে ওর চোখের ওপর। বুকে জড়িয়ে ধরবার সাধ করে হাত দুটো তুলতে গেলো; ওর হাতে শিমুল ডাল শাস্ত, অনিবার্য ছড়িয়ে রয়েছে। শুঁকবে বলে রঞ্জু জোরে নিশ্বাস নিতে চাইলো; কিন্তু ওর নিশ্বাস তখন শেষ হয়ে এসেছে, রঞ্জু সুবাস নিতে পারলো না।