নিরুদ্দেশ ভাই (অর্থাৎ উত্তরাধিকারী পুত্রের বিষয় প্রাপ্তির আশ্চর্য রহস্য?)
প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রায় সাত বৎসর অতীত হইল, শারদীয়া পূজার তিন চারিদিবস পূর্ব্বে আমি আমার থানার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কি দেখিতেছি, এমন সময় একজন পোষ্টপিয়ন আসিয়া আমার হস্তে দুইখানি পত্র প্রদান করিয়া চলিয়া গেল।
সেইস্থানে দাঁড়াইয়াই প্রথম একখানি পত্ৰ খুলিলাম। দেখিলাম, এই পত্রখানি আমার জনৈক বিদেশস্থ বন্ধুর পত্র। “শারদীয় পূজার সময় ছুটি পাই নাই; সুতরাং দেশে গমন করিতে পারিব না” বলিয়া তিনি দুঃখ করিয়া এই পত্র লিখিয়াছেন।
প্রথম পত্র পাঠ সমাপন করিয়া দ্বিতীয় পত্রখানি খুলিলাম। পত্রখানি কাহার লেখা, জানিবার নিমিত্ত প্রথমে লেখকের নাম অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু পত্রের কোনস্থানে কাহারও নাম দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে পত্রখানি পাঠ করিলাম, উহাতে হাতে লেখা ছিল;—
“মহাশয়! তাপরাধীর যাহাতে দণ্ড হয় সেইদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখা আপনাদিগের কর্তব্যকর্ম্ম বলিয়া, আমার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া আপনাকে নিম্নলিখিত সংবাদটি প্রদান করিতেছি; বিশেষ অনুসন্ধান করিলেই ইহার সত্যাসত্য আপনি নিশ্চয়ই অবগত হইতে পারিবেন। পত্রে আমি আমার নাম ও ঠিকানা প্রকাশ করিতে সাহসী হইলাম না বলিয়া আপনি ভাবিবেন না, যে আমার প্রদত্ত এই সংবাদটি মিথ্যা। আপনাদিগের কর্তৃক টানাটানিতে পড়িবার ও সাক্ষ্য দিবার ভয়েই কেবল নিজের নাম গোপন রাখিলাম।
লিচুবাগানের মদনমোহন মৈত্র, প্রায় ছয় মাস হইল, ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন। মৃত্যুকালে তিনি নিতান্ত সামান্য সম্পত্তি রাখিয়া যান নাই, তাহা পাড়ার সকলেই অবগত আছেন। মদনমোহনের দুই সংসার ছিল, প্রথম পক্ষের স্ত্রী বহুদিবস হইল, লোকান্তরিত হইয়াছেন। কিন্তু তাঁহার কেদার নামক একটি পুত্র ছিল। আজ তাহারই বিষয় আপনাকে বলিবার নিমিত্ত আপনাকে এই পত্র লিখিতেছি। মদনমোহনের দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান উমাচরণ। সেও এখন বেশ বড় হইয়া সংসারের কর্ম্ম-কার্য্য করিতে শিখিয়াছেন। উমাচরণ তাহার মাতা বিরাজ এবং উমাচরণের বৈমাত্র ভাই কেদারকে রাখিয়া বৃদ্ধ মদনমোহন মৃত্যুগ্রাসে পতিত হন। বাল্যকাল হইতেই উমাচরণ এবং কেদারের মধ্যে বিশেষ সদ্ভাব নাই, এ কথাও পাড়ার সকলের নিকট অবগত হইতে পারিবেন। কেদার বয়সে বড় হইলেও উমাচরণের বল-বিক্রমের নিকট সে নিতান্ত ছোট। মদনমোহনের মৃত্যুর পর কেদার ও উমাচরণ উভয়েই পিতার পরিত্যক্ত সমস্ত সম্পত্তির সমান অধিকারী হওয়ায় উভয়ের মধ্যে শত্রুতার ক্রমেই বৃদ্ধি হইয়া আসিতেছিল। সম্প্রতি তিন দিবস হইতে কেদারকে আর কেহই দেখিতে পাইতেছে না। কেহ বলিতেছে, সে নিরুদ্দেশ হইয়াছে; কেহ বলিতেছে,—বিমাতা এবং বৈমাত্র ভ্রাতার অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া সে কোন প্রকারে আত্মহত্যা করিয়াছে। কিন্তু আমি যতদূর অবগত আছি, তাহাতে কেদার ঘর বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া যায় নাই, কোনরূপে আত্মহত্যাও করে না; উমাচরণ কর্তৃক সে হত হইয়াছে, এবং উমাচরণ তাহার লাস কোনরূপে গোপন করিয়া চিরশত্রুর হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে। এ বিষয়ে যদি আপনি বিশেষরূপে অনুসন্ধান করেন, তাহা হইলে আমার বিশ্বাস, কোন প্রকারে উক্ত লাস আপনি পাইলেও পাইতে পারেন এবং উমাচরণ সকল কথা আপনার নিকট স্বীকার করিলেও করিতে পারে। এরূপ অবস্থায় প্রতিবেশীর কর্তব্য, আপনাদিগকে এই সংবাদ প্রদান করা, এবং এই নিমিত্তই আপনাকে এই পত্র লিখিলাম। এখন আপনার যাহা কৰ্ত্তব্য হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন।”
এই পত্রখানি আমি একবার দুইবার করিয়া ক্রমে তিন চারিবার পাঠ করিলাম। কখন ভাবিলাম, এই পত্র উমাচরণের কোন শত্রুর লেখা; কখন ভাবিলাম, পত্রে লিখিত সংবাদ সত্য হইলেও হইতে পারে। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া যুগপৎ এ সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা কর্তব্য কি না, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
উপরিউক্ত পত্রখানি বাঙ্গালা ভাষায় লেখা। আমার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ-কর্মচারী বাঙ্গালা কথা কতক বুঝিতে পারিলেও কিন্তু পড়িতে পারেন না; সুতরাং ঐ পত্রখানি ইংরাজীতে অনুবাদ করিয়া তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিলাম। ভাবিলাম, দেখি, এ সম্বন্ধে ইনিই বা কিরূপ হুকুম দেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সেইদিবস রাত্রি দশটার সময় একজন প্রহরী একখানি পত্র আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। পত্রখানি আমার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ কৰ্ম্মচারীর নিকট হইতে প্রেরিত। খুলিয়া দেখিলাম, উহা আমারই প্রেরিত সেই বাঙ্গালা পত্র ও তাহার ইংরাজি অনুবাদ, অতিরিক্ত কেবল উহার এক স্থানে, উক্ত ঘটনা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত তিনি আমাকে আদেশ প্রদান করিতেছেন।
অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যখন আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারী আদেশ প্রদান করিতেছেন, তখন সে বিষয়ে আমার অনুসন্ধান করিতেই হইবে; কিন্তু রাত্রি দশটার পর প্রথম বহির্গত হইয়া অনুসন্ধানের কোনরূপ পন্থাই অবলম্বন করিতে সমর্থ হইব না, বা পাড়ার কোন লোকের সহিত সেই রাত্রিকালে যে দেখা হইবে, তাহাও বোধ হয় না। এই প্রকার নানারূপ ভাবিয়া সেই রাত্রিতে সে অনুসন্ধানে আর প্রবৃত্ত হইলাম না।
পরদিবস প্রত্যূষে থানা হইতে বহির্গত হইয়াই লিচুবাগান স্থানটি যে থানার অন্তর্গত, প্রথমে সেই থানায় গমন করিলাম। ইচ্ছা—সেইস্থান হইতে একজন স্থানীয় কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।
থানায় গিয়া জানিতে পারিলাম যে, চারিদিবস হইল, উমাচরণ থানায় আসিয়া লিখাইয়া গিয়াছেন, তাঁহার বৈমাত্র ভ্রাতা কেদার কাহাকেও কিছু না বলিয়া রাত্রিযোগে হঠাৎ বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক কোথায় চলিয়া গিয়াছেন। উমাচরণ ও তাঁহার অনুচরগণ অনুসন্ধান করিয়া তাঁহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই বলিয়া, যাহাতে কেদারকে পাওয়া যায়, তাহার নিমিত্ত তিনি পুলিসের সাহায্য প্রার্থনা করিতেছেন, এবং আরও লিখাইয়া গিয়াছেন, যে ব্যক্তি কেদারনাথের সন্ধান বলিয়া দিতে পারিবে, উমাচরণ তাহাকে একশত টাকা পারিতোষিক প্রদান করিবেন।
থানায় গিয়া এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া সেইস্থানের একজন কর্মচারীকে সঙ্গে লইয়া, লিচুবাগানে উমাচরণের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময়ে আমরা উমাচরণের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হই, তখন ঘড়িতে আটটা বাজিয়া গিয়াছে; কিন্তু সে পর্য্যন্ত উমাচরণের নিদ্রাভঙ্গ হয় নাই, তিনি বাড়ীর ভিতর তখন পর্যন্ত নিদ্রিত আছেন। একজন পরিচারিকা দ্বারা ভিতরে সংবাদ পাঠাইলাম। প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা পরে উমাচরণ চক্ষু মুছিতে মুছিতে বাহিরে আসিয়া যেন একটু অপ্রস্তুত ভাবে আমাদিগকে সম্বৰ্দ্ধনা করিলেন এবং আমাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন।
নিরুদ্দেশ কেদারের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি অনেক কথা আমাদিগকে কহিলেন। ক্রমে তাঁহার নিকট এবং প্রতিবেশীগণের নিকট হইতে আমরা জানিতে পারিলাম;
১ম। কেদার বা উমাচরণের পিতা মদনমোহন মৈত্র প্রায় ছয়মাস হইল, প্রকৃতই ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছেন।
২য়। মৃত্যুকালে ভদ্রাসন বাড়ী ও তাহার সংলগ্ন বৃহৎ বাগান ব্যতীত প্রায় দশ সহস্রমুদ্রা তিনি রাখিয়া গিয়াছেন।
৩য়। কেদারনাথ মদনমোহনের প্রথম পক্ষের সন্তান। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যুর পর মদনমোহন, উমাচরণের মাতা বিরাজকে বিবাহ করেন।
৪র্থ। কেদারনাথ ও উমাচরণ উভয়েই এই পৈত্রিক সম্পত্তির সমান অংশীদার, কিন্তু বাল্যকাল হইতেই উভয়ের মধ্যে অপ্রণয়। এমন কি পরস্পরের সহিত বাক্যালাপ পৰ্য্যন্ত নাই। পিতার মৃত্যুর পর হইতে বাল্যকালাগত সেই অপ্রণয় ক্রমেই বৃদ্ধি পাইয়া আসিতেছি। অল্পদিবস হইল উভয়ের মনের ভাব এরূপে পরিণত হইয়াছে যে, পরম শত্রুর উপরও সেইরূপ মনের ভাব হয় কি না সন্দেহ।
৫ম। উমাচরণের মাতা বিরাজও কেদারকে দুই চক্ষে দেখিতে পারেন না, এমন কি তাহার নাম পর্য্যন্ত শ্রবণ করিতে তিনি ইচ্ছা করেন না।
৬ষ্ঠ। কেদার ও উমাচরণ উভয়েই অবিবাহিত। উমাচরণের আহারাদি বা যত্নাদির উপর লক্ষ্য রাখেন—তাহার মাতা বিরাজ। কিন্তু কেদারকে সে বিষয়ে চাকর-চাকরাণীর উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে হয়। তাহাদিগের মধ্যে অধিকাংশই আবার বিরাজ বা উমাচরণের অনুগত। কেবলমাত্র দুই একজন কেদারকে অন্তরের সহিত ভালবাসে, কিন্তু তাহারাও বিরাজ বা উমাচরণের ভয়ে প্রকাশ্যে কিছুই করিতে সাহসী হয় না।
৭ম। একমাস হইতে কেদার তাহার সমস্ত সম্পত্তি বিভাগ করিয়া লইবার প্রস্তাব কহিতেছেন, কিন্তু বিরাজ ও উমাচরণ সে কথা গ্রাহ্য করেন না। বরং সময়ে সময়ে কেদারকে বলেন, মৃত্যুকালে মদনমোহন সমস্ত বিষয় উমাচরণকে প্রদান করিয়া গিয়াছেন, কেদারকে কিছুই দিয়া যান নাই। তবে যতদিবস কেদার উমাচরণের সহিত ভদ্রাসন বাড়ীতে থাকিবেন, ততদিবস তিনি কেবল আহারীয় ও পরিধেয় পাইবেন মাত্র। কিন্তু ভদ্রাসন পরিত্যাগ করিলে তাহাও পাইবেন না।
৮ম। চারি পাঁচদিবস অতীত হইল, রাত্রিকালে আহারাদি করিয়া কেদারনাথ বাহিরের গৃহে শয়ন করেন। কিন্তু তাহার পরদিবস প্রাতঃকাল হইতে কেহই আর তাঁহাকে দেখিতে পায় নাই। তিনি যে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইলেন কেন, তাহা কেহই বলিতে পারেন না। কেদার যে স্থানে শয়ন করিতেন, সেইস্থান অনুসন্ধান করিয়াও এরূপ কোন কাগজ বা পত্রাদি পাওয়া যায় নাই, যাহাতে জানিতে পারা যায় যে, কেদারনাথ কোথায় গমন করিয়াছেন, বা কি নিমিত্ত নিজের পৈত্রিক বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াছেন।
৯ম। বিশেষ শত্রুতা থাকিলেও কিন্তু উমাচরণ কেদারনাথের অনুসন্ধান করিতে কোনরূপে ত্রুটি করেন নাই।
সম্ভবত প্রায় সকল স্থানেই তিনি তাঁহার অনুসন্ধান করিয়াছেন, ও পরিশেষে তাঁহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত সন্ধানকারীকে একশত টাকা পারিতোষিক দিতেও সম্মত হইয়াছেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এই সকল বিষয় অবগত হইয়া আমার মনে ঘোর সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, পত্রে যে সকল বিষয় বর্ণিত হইয়াছে, তাহাকি তবে প্রকৃত? উমাচরণ কি প্রকৃতই বিষয়ের লোভে তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে হত্যা করিয়াছে? আর বিরাজ ও দাস-দাসীগণ কি এই ভয়ানক কার্য্যে উমাচরণের সহায়তা করিয়াছে? এইরূপ নানা প্রকার চিত্তা আসিয়া আমার মনকে অস্থির করিল। ভাবিলাম, ইহারা যদি কেদারকে হত্যা করিবে, তাহা হইলে—
১ম। যে যে স্থানে কেদারের থাকা সম্ভব, সেই সেই স্থানে উমাচরণ তাহার অনুসন্ধান করিবে কেন?
২য়। কেনই বা তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত একশত টাকা পারিতোষিক প্রদান করিতে স্বীকৃত হইবে?
৩য়। কেনই বা থানায় গিয়া ভ্রাতার হঠাৎ অন্তর্ধানের সংবাদ প্রদান করিবে? ইহা ব্যতীত—
৪র্থ। হত্যা করিয়া মৃতদেহই বা কোথায় লুকাইবে?
৫ম। কি প্রকারে এতগুলি চাকর-চাকরাণীর মুখ বন্ধ রাখিবে?
আবার ভাবিলাম,
১ম। যখন উভয়ের মধ্যে এরূপ শত্রুতা, তখন চিরশত্রু নিপাত করা কিছু সম্ভব নহে।
২য়। একজনকে হত্যা করিতে পারিলে, সমস্ত বিষয় যদি নিকণ্টকে ভোগ করিতে পারা যায়, তাহা হইলে বিষয়লোভী মনুষ্যের নীচান্তঃকরণে এরূপ নীচ-প্রবৃত্তির উদয় হওয়া যে একেবারে অসম্ভব, তাহাও নহে।
৩য়। যে স্থানের মধ্যে মধ্যে পিতৃহতা, মাতৃহত্যা, স্বামীহত্যা প্রভৃতি দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, সেইস্থানে ভ্রাতৃহত্যা কি একেবারে অসম্ভব?
৪র্থ। যে ভ্রাতার সহিত কথাবাৰ্ত্তা নাই, মুখ দেখাদেখি নাই, সেই ভ্রাতা নিরুদ্দেশ হইলে সে তাহার অনুসন্ধান করে কেন? তাহার নিমিত্ত সে পুরস্কার দিতে সম্মত হয় কেন? পুলিসে গিয়া সংবাদ লিখায় কেন? আপনার দোষ গোপন করিবার নিমিত্ত নয় কি? আপনাকে নিরপরাধ দেখাইবার নিমিত্ত নয় কি? আপনার উপর যাহাতে অপর কাহারও কোন প্রকার সন্দেহ না হয়, তাহারই পথ প্রশস্ত করিবার নিমিত্ত নয় কি?
আবার ভাবিলাম, ইহাও অসম্ভব নহে, যখন উমাচরণ দেখিলেন, তাঁহার ভ্রাতা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইয়াছেন, অথচ সেই ভ্রাতার সহিত তাঁহার চির-বিবাদ, এবং সেই ভ্রাতা সমস্ত বিষয়ের অর্ধেক অংশীদার, ইহাও সৰ্ব্বজন-বিদিত। এরূপ অবস্থায় হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইলে উমাচরণের উপর সেই ভ্রাতৃহত্যার সন্দেহ ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না; ইহা বিবেচনা করিয়াই হয় ত, তিনি তাঁহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। নিরুদ্দেশ ভ্রাতাকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে না পারিলে পাছে পুলিস কোনরূপে তাঁহাকে বিপদগ্রস্ত করে, এই ভয়েই হয় ত তিনি ভ্রাতার অনুসন্ধানে এত যত্ন করিতেছেন।
এইরূপ নানাপ্রকার চিত্তা আসিয়া যুগপৎ আমার হৃদয়ে উপস্থিত হইতে লাগিল। এখন আমার কি করা কর্তব্য নানারূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না!
পত্রের কথা বিশ্বাস করিয়া যদি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই, তাহা হইলে, উমাচরণ কেদারনাথকে হত্যা করিয়াছেন, এই সন্দেহে তাঁহাকে লইয়াই অনুসন্ধান আবশ্যক। কিন্তু কি করিয়াই বা হঠাৎ এরূপ ব্যবহার উমাচরণের সহিত করিতে প্রবৃত্ত হই? প্রকৃতই যদি কেদারনাথ হত হইয়া না থাকেন, অথচ উমাচরণকে আমি হত্যাকারী সাব্যস্ত করিয়া লই, তাহা হইলে ইহার কিরূপ ভয়ানক পরিণাম হইবে, তাহা বলা নিতান্ত সহজ নহে। এদিকে আবার কেদারনাথ যদি প্রকৃতই উমাচরণ কর্তৃক হত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে সেইরূপ ভাবে উমাচরণকে লইয়া উপযুক্ত রূপ অনুসন্ধান না করিলেও কর্তব্য কর্ম্মের ত্রুটি করা হয়। এইরূপ নানা প্রকার ভাবিতে ভাবিতে সে দিবস আমি উমাচরণের বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া আপনার স্থানে চলিয়া আসিলাম। ইচ্ছা, প্রথমে এ বিষয়ে উত্তমরূপে চিন্তা করিয়া দেখিব ও পরিশেষে আমার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ কর্মচারীকে সমস্ত বিষয় বুঝাইয়া বলিব। তিনি যেরূপ পরামর্শ দেন, পরিশেষে সেইরূপ ভাবেই কৰ্ম্মক্ষেত্রে উপস্থিত হইব।
থানায় আসিয়া এ বিষয়ে অনেক চিন্তা করিলাম, কিন্তু কোন বিষয় ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার মনে হইল, কেদারনাথ প্রকৃতই নিরুদ্দেশ হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছেন; আবার ভাবিলাম, নিরুদ্দেশ হওয়া অপেক্ষা হত হওয়াই সম্ভব। এইরূপে যখন কিছুতেই মনকে স্থির করিতে পারিলাম না, তখন আমার ঊর্দ্ধতন সেই ইংরাজ কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। এ বিষয় অনুসন্ধান করিয়া আমি যতদূর জানিতে পারিয়াছিলাম, আমার মনে যে প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, তাহার সমস্ত বিষয় এক এক করিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম। আমার সমস্ত কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, “যখন বিষয় লইয়া একটি গোলযোগ দেখা যাইতেছে, একজনকে হত্যা করিতে বা কোনরূপে চিরদিবসের নিমিত্ত স্থানান্তরিত বা আবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিলে, অপরে যখন সেই বিষয় সম্পূর্ণরূপে ভোগ করিতে সমর্থ হয়, তখন বিশেষরূপে অনুসন্ধান না করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে। আমার বিবেচনায় কেদারনাথ হত বা আবদ্ধ হইয়াছেন বিবেচনায়, এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া কৰ্ত্তব্য।
সাহেবের আদেশ শুনিয়া সে বিষয়ে আমি অধিক আর চিন্তা না করিয়া, সেই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়াই স্থির করিলাম।
কিন্তু ভাবিলাম, কেদারনাথ যে হত হইয়াছেন, এই কথা উমাচরণকে স্পষ্ট করিয়া না বলিয়া, কেদারনাথ কোনস্থানে অবৈধরূপে আবদ্ধ হইয়াছেন, এইমাত্র বলিয়া উমাচরণের বিপক্ষে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। উমাচরণের সেই বৃহৎ বাড়ীর কোন স্থানে বা কোন গৃহে কেদারকে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে কি না, এই বলিয়া বাড়ীটিতে একবার বেশ করিয়া খুঁজিয়া দেখিব।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পরদিবস প্রাতঃকালে আমি ও সেইস্থানীয় কর্ম্মচারী পুনরায় উমাচরণের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। উমাচরণকে ডাকিবামাত্র তিনি আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি তখন উমাচরণকে কহিলাম, “দেখুন, উমাচরণ বাবু! আপনার ভ্রাতা কেদারনাথ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়ায় আপনার মনে বিশেষ কষ্ট হইয়াছে, তাহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এবং নানাস্থানেও নানাপ্রকারে আপনি যে তাঁহার অনুসন্ধান করিতেছেন, তাহাও দেখিতে পাইতেছি, কিন্তু কি করি, সকলেই বলিতেছেন, কেদারনাথ আপনার সম্পত্তির একজন অংশীদার। কোন প্রকারে কেদারনাথ হত, আবদ্ধ বা স্থানান্তরিত হইলে আপনার উপকার ভিন্ন অপকার নাই। বিশেষ আপনাদিগের উভয়ের মধ্যে বালকাল হইতেই অসদ্ভাব। এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমার ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারীগণ সন্দেহ করেন যে, কেদারনাথ কোন না কোন স্থানে আবদ্ধ আছেন। কেদারনাথের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনার বাড়ীটি একবার উত্তমরূপে দেখিতে তাঁহারা আমাকে এইস্থানে অদ্য প্রেরণ করিয়াছেন। ইহাতে যদি আপনার কোনরূপ আপত্তি থাকে, তাহা এখন আপনি বলিতে পারেন।”
আমার এইকথা শুনিয়া উমাচরণ কোনরূপ প্রতিবাদ করিলেন না। আরও কহিলেন, “আপনারা আমার সহিত এখনই আগমন করুন। এক এক করিয়া প্রত্যেক গৃহ, এবং বাড়ীর প্রত্যেক স্থান আপনাদিগকে দেখাইয়া দিতেছি। দাদার সহিত আমার সদ্ভাব নাই, একথা সত্য; কিন্তু তাই বলিয়া কি বড় ভাইকে ছোট ভাই হত্যা করিতে পারে, না কোনস্থানে আবদ্ধ রাখিয়া আপনার মনস্কামনা সিদ্ধ করিতে সমর্থ হয়?”
এই বলিয়া উমাচরণ আমাদিগকে লইয়া তাঁহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। সেই বৃহৎ গৃহগুলি এক এক করিয়া আমাদিগকে দেখাইতে লাগিলেন। কিন্তু আমরা কোনস্থানেই কেদারনাথের কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না। উপরও নীচের সমস্ত গৃহগুলি উত্তমরূপে দেখিয়া পরিশেষে প্রাঙ্গন প্রভৃতি দেখিলাম। প্রাঙ্গনের প্রত্যেকস্থান উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম, কিন্তু অল্পদিবসের মধ্যে কোনস্থান যে খোঁড়া হইয়াছে, তাহা বোধ হইল না।
বাড়ীর ভিতর উত্তমরূপে দেখিতে প্রায় দুইটা বাজিয়া গেল। দিবা দুইটার পর বাড়ীর সংলগ্ন সেই বৃহৎ উদ্যানের ভিতর প্রবেশ করিলাম।
এই উদ্যানটি বাড়ীর সংলগ্ন, কিন্তু প্রাচীর বেষ্টিত নহে। ইহার তিনপার্শ্বে অপরাপর লোকের বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগ। এই উদ্যানের ভিতর প্রবেশ করিতে হইলে কাহারও না কাহারও বাড়ীর ভিতর দিয়া প্রবেশ করিতে হয়। তদ্ব্যতীত আর কোন পৃথক পথ নাই।
এই উদ্যানটি বহু পুরাতন, এবং পুরাতন বৃক্ষে পরিপূর্ণ। লতাপাতায় সেই বৃক্ষ সকল জড়ীভূত। উহার ভিতর আগাছা, এবং ঘাস প্রভৃতি এত জন্মিয়াছে যে, তাহার ভিতর দিয়া গমনাগমন করা নিতান্ত সহজ নহে। এই বাগানের মধ্যস্থলে একটি পুষ্করিণী আছে, তাহার অবস্থাও বাগানের অবস্থা অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহে। পানা, শেহালা প্রভৃতিতে উহা এরূপভাবে আচ্ছন্ন যে, সেই পুষ্করিণীর জল সহজে কাহারও নয়নগোচর হয় না। শুনিতে পাওয়া যায়, এই পুষ্করিণীতে বৃহৎ বৃহৎ অনেক মৎস্য ছিল; মদনমোহনের শ্রাদ্ধের সময় তাহার কতকগুলি ধরা হয়, কতকগুলি এখনও আছে।
লতা বৃক্ষ প্রভৃতি সমাকীর্ণ জঙ্গলময় বাগানে প্রবেশ করিয়া আমরা ক্রমে উহার সকল স্থান উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলাম; কিন্তু কোনস্থানে সন্দেহসূচক কোনরূপ চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে ক্লান্ত হইয়া দিবা চারিটির সময় সেই বাগান পরিত্যাগ করিতে মনস্থ করিয়া বাহিরে আসিবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময়ে একস্থানের উপর হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, উহার উপরিস্থিত লতাগুল্ম সকল যেন যেন স্থানচ্যুত হইয়াছে। আরও বোধ হইল, অল্পদিবস হইল, এইস্থানটি যেন খোঁড়া হইয়াছিল। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ হইল।
যে সময়ে আমি বাগানের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, সেই সময় আমার সহিত সেই পাড়ার আরও কয়েকজন ভদ্র এবং ইতর লোকও আমাদের সঙ্গে ছিল। উক্তস্থানের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া তাঁহাদিগের মনেও কেমন একরূপ সন্দেহ হইল। তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ আমাকে কহিলেন, “এইস্থানটি খুঁড়িয়া দেখিলে হয় না?” উত্তরে আমি কহিলাম, “এ স্থানটি খুঁড়িয়া উত্তমরূপে যে দেখিতে হইবে, সে বিষয়ে আর সন্দেহমাত্র নাই।”
আমার কথা শুনিয়া দুইজন দ্রুতপদে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল, ও দেখিতে দেখিতে দুইখানি কোদালিহস্তে তখনই প্রত্যাবৰ্ত্তন করিয়া সেইস্থান খনন করিতে আরম্ভ করিল।
অতি সামান্য ভাগ খনন করিবামাত্র সেইস্থান হইতে দুর্গন্ধ বাহির হইতে লাগিল। তখন আমাদিগের মনের সন্দেহ আরও দৃঢ় হইয়া আসিতে লাগিল। সেই সময়ে উমাচরণবাবু একটু দূরে ছিলেন, আমি তাঁহাকে ডাকিয়া আমার নিকটে আনিলাম ও কহিলাম, “উমাচরণবাবু! এইস্থান হইতে কিসের দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে?” আমার কথা শুনিয়া এবং সেইস্থান-নির্গত দুর্গন্ধ উত্তমরূপে অনুভব করিয়া, তিনি যেন একটু ভাবিত হইলেন ও সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন।
যাহারা মৃত্তিকা খনন করিতেছিল, তাহাদিগকে বিশেষ সতর্কবার্তার সহিত সেইস্থান খনন করিতে কহিলাম। তাহারা আস্তে আস্তে সেইস্থান খনন করিয়া ক্রমে সেইস্থানের মৃত্তিকা উঠাইতে লাগিল। সেইস্থান হইতে যতই মৃত্তিকা উঠিতে লাগিল, দুৰ্গন্ধ ততই তীব্র হইতে লাগিল, ক্রমে সেইস্থানে দাঁড়ান নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সেইস্থান হইতে প্রায় দেড়হস্ত পরিমিত মৃত্তিকা খাত হইলে, যাহারা মৃত্তিকা খনন করিতেছিল, তাহাদিগের মধ্যে একজন চীৎকার করিয়া উঠিল, ও কোদালি নিক্ষেপ করিয়া দূরে গিয়া দাঁড়াইল। উহার এইরূপ অবস্থা দৃষ্টি করিয়া সকলেই নিতান্ত কৌতূহল প্রযুক্ত সেই গর্ভের নিকট গমন করিয়া বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া পড়িল। “একি সৰ্ব্বনাশ!” বলিয়া উমাচরণ একবার চীৎকার করিয়া উঠিলেন; কিন্তু তাহার পর তাঁহার মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। কাঁপিতে কাঁপিতে অৰ্দ্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় তিনি সেই স্থানে বসিয়া পড়িলেন।
যে সময় এইরূপ অবস্থা ঘটিল, সেই সময়ে সেই মৃত্তিকার ভিতর হইতে সম্পূর্ণ কিছুই বাহির হয় নাই, মনুষ্য মস্তকের অর্দ্ধেকমাত্র কেবল দৃষ্টিগোচর হইতেছিল।
যাহারা উক্ত মৃত্তিকা খনন করিতেছিল, মস্তকের অর্দ্ধেক দেখিয়াই তাহারা কোদালি পরিত্যাগ করিল। সেইস্থান হইতে আর মৃত্তিকা উঠাইতে তাহারা কোন প্রকারেই সম্মত হইল না। তখন অনন্যোপায় হইয়া আমার সমভিব্যাহারী কর্মচারীকে ডোম আনিবার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। নিজে সেই ভয়ানক দুর্গন্ধময় স্থানে বসিয়া সেইস্থানের উপর পাহারা দিতে লাগিলাম।
প্রায় একঘণ্টা পরে কর্ম্মচারী তিনজন, ডোমের সহিত প্রত্যাগমন করিল। ডোমগণ আসিয়া উক্তস্থানের মৃত্তিকা আস্তে আস্তে উঠাইয়া ফেলিলে দেখিলাম, তথায় একটি মৃতদেহ প্রোথিত অবস্থায় রহিয়াছে। দেহটি মৃত্তিকার ভিতর হইতে উঠাইতে বলায়, উহারা তাহা উঠাইয়া যে স্থানে প্রোথিত ছিল, তাহার সন্নিকটে স্থাপিত করিল।
মৃতদেহটি একেবারে পচিয়া গলিয়া গিয়াছে, মাংস সকল খসিয়া পড়িয়াছে, কেবল স্থানে স্থানে একটু একটু মাংস লাগিয়া আছে। সুতরাং তাহা দেখিয়া উহা কাহার মৃতদেহ চিনিয়া উঠা যায় না। নাক মুখ বিকৃত হইয়া গিয়াছে, মুখের মাংস খসিয়া পড়িয়াছে, কেশ সহিত মস্তকাচ্ছাদক চৰ্ম্ম স্থানচ্যুত হইয়াছে। অবস্থা দেখিয়া বোধ হয়, মৃতদেহটি উলঙ্গ অবস্থায় পোঁতা হইয়াছে। মাটীর ভিতর দেহের নিকটেও কাপড় প্রভৃতি কিছুই নাই।
এইরূপের মৃতদেহ প্রাপ্ত হইবার পর আর কালবিলম্ব না করিয়া আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দিলাম। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র নিতান্ত হৃষ্টান্তঃকরণে তিনি অপর কয়েকজন কর্মচারীর সহিত সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
এদিকে মৃতদেহ দেখিয়া প্রতিবেশীগণের মধ্যে অনেকে অনেক কথা কহিতে লাগিল। কেহ কহিল, “বড় ভ্রাতা পিতার তুল্য, সেই ভ্রাতার হত্যাজনিত মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত এইরূপেই হইয়া থাকে।” কেহ বলিল, “অর্থলোভে ভ্রাতৃহত্যার ফল এইরূপ হাতে-হাতেই ফলিয়া থাকে।” এইরূপ যাহার মনে যাহা আসিতে লাগিল, সে তাহাই কহিতে লাগিল। কেহ বা সম্মুখে দাঁড়াইয়া উমাচরণকে সহস্র গালি প্রদান করিতে লাগিল।
উমাচরণ এখন মৃতপ্রায়। তাঁহার মুখে কথা নাই, কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাহার প্রকৃত উত্তর দিতে এখন উমাচরণ অসমর্থ। কি কথায় কি উত্তর দিতেছেন, কি বলিতে কি বলিতেছেন, তাহার কিছুমাত্র স্থির নাই।
এদিকে বাড়ীর ভিতর বিরাজের নিকট যখন সংবাদ পৌঁছিল, কেদারের মৃতদেহ বাগানের ভিতর প্রোথিত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে, এবং এই হত্যায় উমাচরণ প্রভৃতি বাড়ীর সকলের উপরেই সন্দেহ জন্মিতেছে, তখন বিরাজ একেবারে অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। কি করিবেন, বা না করিবেন, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া কেবল রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন।
এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত আমি যে সকল অনুসন্ধান করিতেছিলাম, উমাচরণ সঙ্গে থাকিয়া কেবল তাহাই দৃষ্টি করিতেছিলেন। এখন আর তাঁহার সেরূপ অবস্থা রহিল না। এখন অপরাপর কর্ম্মচারীগণ তাঁহাকেই লইয়া পড়িলেন। কিরূপে তিনি কেদারনাথকে হত্যা করিলেন, হত্যা করিবার সময় অপর আর কোন্ কোন্ ব্যক্তি তাঁহার সহায়তা করিয়াছিল, কোন্ কোন্ ব্যক্তি দ্বারা কেদারের মৃতদেহ মৃত্তিকার ভিতর প্রোথিত করা হয়, এইরূপ নানাপ্রকার প্রশ্ন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। “আমি কিছুই জানি না” বলিয়া উমাচরণ সকল কথায় উত্তর প্রদান করিতে লাগিলেন।
উমাচরণের কথায় আর এখন কে বিশ্বাস করেন? এখন তিনি খুনি মোকদ্দমার আসামী! এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত কেবল উমাচরণকে লইয়াই অনুসন্ধান চলিতেছিল, এখন অপরাপর সকলের দিকে কর্ম্মচারীগণের লক্ষ্য পড়িল। যাহা হউক, মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিয়া কৰ্ম্মচারীগণ সেই বাগান পরিত্যাগ করিলেন। এখন সকলের বসিবার স্থান হইল—উমাচরণের সদর-বাড়ী।
উমাচরণ এখন হত্যাপরাধে অভিযুক্ত, সুতরাং তাঁহার আর নড়িবার যো রহিল না। এতদ্ব্যতীত বাড়ীর চাকর—চাকরাণী প্রভৃতি সকলকেই সেইস্থানে একত্র করিয়া এক একজন কর্মচারীর জিম্মায় রাখা হইল। উদ্দেশ্য—যদি কোন কর্ম্মচারী কোন চাকর-চাকরাণীর নিকট হইতে কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইতে পারেন।
উমাচরণ এবং তাঁহার চাকর-চাকরাণীদিগের অদৃষ্টে যাহা ঘটিতে লাগিল, তাঁহার মাতা বিরাজের অদৃষ্টে কিন্তু তখন ততটা ঘটিল না। কিন্তু তাঁহাকে সেই নির্জ্জনপুরীর ভিতর একাকী থাকিতে হইল, এবং মধ্যে মধ্যে সেই পাড়ার দুই একজন লোকের দ্বারা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইতে লাগিল, যে, এ সম্বন্ধে তিনি কি কি বিষয় অবগত আছেন। তিনি কিন্তু প্রত্যেকের নিকটেই বলিতে লাগিলেন, তিনি কেদারনাথের হত্যাসম্বন্ধে কিছুই অবগত নহেন।
এইরূপভাবে অনুসন্ধান করিতে করিতে সেই রাত্রিও সেইস্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। সে দিবস যে স্নান—আহার একেবারেই হয় নাই, তাহা ভুলিয়া গেলাম।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শনিবার মৃতদেহ পাওয়া যায়, সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে করিতে, সকলের জবানবন্দী লিখিতে লিখিতে, সে দিবস অতিবাহিত হইল; রবিবারও চলিয়া গেল। কিন্তু কাহার দ্বারা এই হত্যা সংসাধিত হইল, কোন্ কোন্ ব্যক্তি ইহাতে লিপ্ত ছিল, তাহার কিছুই স্থির হইল না। কাহারও নিকট হইতে বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা পাওয়া গেল না। কোন চাকরাণী একবার বলিল, “উমাচরণ বাবু কেদারনাথকে হত্যা করিয়াছেন।” সে পরক্ষণেই আবার কহিল, “আমি কিছুই জানি না, ভয়ক্রমে মিথ্যা করিয়া উমাচরণ বাবুর নাম করিয়াছি।” কোন চাকর অপর চাকরের দোষ দিল। যে চাকর-চাকরাণীর মধ্যে পরস্পর অপ্রণয় ছিল, এই সুযোগে তাহারা একজন অপরের নাম করিতে লাগিল; কিন্তু পরক্ষণেই সে সকল কথা মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন হইতে লাগিল। এইরূপ গোলযোগে দুইদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু প্রকৃত কথা যে কি, তাহার কিছুই জানিতে পারা গেল না।
সোমবার প্রাতঃকালে আমার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী আমাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র আমি তাঁহার নিকট গমন করিলে তিনি আমাকে কহিলেন, “এরূপ অবস্থায় এ মোকদ্দমা আর রাখা যায় না, যাহাকে আসামী করা বিবেচনা হয়, তাহাকে অদ্যই চালান দেয়া উচিত।”
উত্তরে আমি কহিলাম, “এ মোকদ্দমায় কোন্ কোন্ ব্যক্তি চালানের উপযুক্ত, তাহা এ পর্য্যন্ত ঠিক হইল না, পরে যে হইব, সে ভরসাও নাই; সুতরাং কাহাকে চালান দিব?”
ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী। আর কাহাকেও না হয়, উমাচরণকে চালান দিতেই হইবে।
আমি। কি প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া উমাচরণকে চালান দিব?
ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী। উমাচরণকে দোষী সাব্যস্ত করিবার প্রমাণ যথেষ্ট আছে :—
১ম। কেদারনাথ হঠাৎ নিরুদ্দেশ।
২য়। কেদার উমাচরণের সমস্ত বিষয়ের তুল্য অংশীদার।
৩য়। কেদারনাথের সহিত উমাচরণের চিরবিবাদ।
৪র্থ। এরূপ অবস্থায় কেদারনাথকে মারিয়া ফেলিলে, যদি কাহারও কোন উপকার হইবার সম্ভাবনা থাকে, তাহা উমাচরণ ভিন্ন এ জগতে আর কাহারও হইবে না।
৫ম। উমাচরণের বাগানে মৃতদেহ পাওয়া যাইতেছে। এরূপ অবস্থায় সেই মৃতদেহ কেদারনাথের মৃতদেহ ভিন্ন অপর কাহারও মৃতদেহ হইতে পারে না। যদি অপর কাহারও মৃতদেহ হইত, তাহা হইলে উমাচরণ তাহা নিশ্চয়ই বলিতে পারিত।
সাহেবের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “উমাচরণকে চালান দেওয়াই যখন আপনার অভিমত, তখন এ বিষয়ে আমার কোনরূপ কথা কহা অন্যায়। আমি হত্যাপরাধে তাহাকে এখনই চালান দিতেছি; কিন্তু আমার বিবেচনায় এ মোকদ্দমায় উমাচরণের কিছুই হইবে না—বিচারে সে খালাস পাইয়া চলিয়া আসিবে। কারণ,
১ম। যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা এরূপভাবে গলিয়া গিয়াছিল যে, কেহই কেদারের দেহ বলিয়া চিনিয়া উঠিতে পারে নাই।
২য়। যাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার যে কিরূপে মৃত্যু হয়, হত্যা, আত্মহত্যা, কি স্বাভাবিক মৃত্যু, তাহা ডাক্তারের পরীক্ষায় স্থির হইবার কোন উপায় নাই।
৩য়। যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেইস্থানে উমাচরণ ব্যতীত নিকটবর্ত্তী বাটীর অপর কেহ যাইতে ইচ্ছা করিলে অনায়াসেই যাইতে পারে। এরূপ অবস্থায় উমাচরণের অধিকারে উক্ত লাস পাওয়া গিয়াছে, এ কথা কোন জুরি বিশ্বাস করিবেন না।
৪র্থ। যখন, কেদারনাথ হত হইয়াছেন, ইহার প্রমাণ করিতে পারিতেছি না, তখন উমাচরণ কেদারনাথকে হত্যা করিয়াছেন, ইহা জুরিদিগকে বিশ্বাস করান নিতান্ত সহজ হইবে না।
এরূপ অবস্থাতে আপনি উমাচরণকে চালান দিতে বলিতেছেন বলিয়াই, নিতান্ত অনিচ্ছায় আমি তাহাকে চালান দিতে প্রস্তুত হইতেছি। বাস্তবিক আমার মনেও দৃঢ়বিশ্বাস হইয়াছে যে, যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা কেদারনাথ ব্যতীত অপর আর কাহারও মৃতদেহ নহে, এবং উমাচরণ ব্যতীত এ হত্যা আর কাহারও দ্বারা সম্ভব না। তবে হইতে পারে, উমাচরণের সাহায্যকারী অপর ব্যক্তি আছে। কিন্তু উমাচরণের অনভিমতে একার্য্য কোনরূপেই সম্পন্ন হয় নাই। সুতরাং মূলতঃ উমাচরণ যে দোষী, তাহাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ বিশ্বাস থাকিলেও আপনাদিগের যে আইন, তাহাতে একেবারে হাতে হাতে ধরা না পড়িলে আসামীর শাস্তি হওয়া অসম্ভব বলিয়াই উমাচরণকে চালান দিতে আমার অমত।”
ইংরাজ-কর্মচারীর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হওয়ার পর আমি উমাচরণের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম ও সেইস্থান হইতে উমাচরণকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণার্থে লালবাজারে পাঠাইয়া দিলাম।
যে সময়ে উমাচরণকে তাঁহার বাড়ী হইতে লালবাজারে পাঠাইয়া দিলাম, সেই সময়ে সেই বাড়ীর যে কিরূপ অবস্থা হইল, বিরাজ যে কিরূপ ভাবে আর্তনাদ করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন, তাহা বর্ণনা করা নিতান্ত সহজ নহে।
উমাচরণকে পুলিসে চালান দেওয়া হইল বলিয়াই, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ যে তাঁহার বাড়ী পরিত্যাগ করিলেন, তাহা নহে। পূৰ্ব্বে যে প্রকার অনুসন্ধান চলিতেছিল, এখনও সেইরূপ অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। দাস-দাসীগণকে লইয়া এখনও সকলে নাড়া-চাড়া করিতে লাগিলেন। উমাচরণের অবর্তমানে তাঁহার চাকর-চাকরাণীগণ যদি কিছু বলে, সেই দিকে সকলেই বিশেষ লক্ষ্য রাখিলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
হত্যাপরাধে উমাচরণ মাজিষ্ট্রেটের কোর্টে প্রেরিত হইলেন, কিন্তু সেই সময়ে পূজার নিমিত্ত কাছারী বন্ধ ছিল। বন্ধের পর মোকদ্দমার দিন পড়িল, উমাচরণ হাজতে রহিলেন।
দ্বাদশী কি ত্রয়োদশীর দিবস সন্ধ্যার পর আমি বাহির হইতে আসিয়া দেখিলাম, আমার টেবিলের উপর একখানি পত্র রহিয়াছে। পত্রখানি ডাকের। শিরোনামায় আমার নাম লেখা। পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলাম। উহাতে লেখা ছিল :—
“মহাশয়! পূজার ছুটি পাইয়া কলিকাতা হইতে বাড়ী আসিয়াছি। বাড়ীও কলিকাতার বহুদূরে; সুতরাং কলিকাতার বিশেষ সংবাদ কিছুই জানিতে পারিতেছি না। তাহাতে এ সময়ে অধিকাংশ সংবাদপত্রও কিছুদিবসের নিমিত্ত অবসর গ্রহণ করিয়াছে। আমাদিগের এইস্থানের একজন জমীদার একখানি ইংরাজী দৈনিক সংবাদপত্র গ্রহণ করেন, ঘটনাক্রমে সেই পত্রিকাখানি আমার হস্তে পতিত হয়। তাহা পাঠে কেবলমাত্র অবগত হইলাম, আপনি উমাচরণ মৈত্র নামধেয় এক ব্যক্তিকে, তাহার ভ্রাতা কেদারনাথ মৈত্রকে হত্যা করা অপরাধে, ধৃত করিয়াছেন। তাহাদিগের বাড়ীর সংলগ্ন বাগানের ভিতর হইতে মৃতদেহও প্রাপ্ত হইয়াছেন। এই সংবাদ যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে যে পৰ্য্যন্ত আমি কলিকাতায় গমন করিতে না পারিব, তাহার মধ্যে বিচার শেষ না হইলেই ভাল হয়। কারণ, আমি বোধ হয়, এ সম্বন্ধে বিশেষ সংবাদ প্রদান করিতে পারিব। তবে সকল কথা অগ্রে না জানিয়া আমি কোন কথা প্রকাশ করিতে চাহি না বলিয়া, যাহা আমি অবগত আছি, তাহা এই পত্রে লিখিলাম না। ছুটি পাইয়া বাড়ী আসিয়াছি, দুই পাঁচদিবস আমোদ-আহ্লাদ করিবার ইচ্ছা আছে; সুতরাং আমার দেশের ঠিকানাও এই পত্রে লিখিলাম না। কারণ মনে ভয়, যদি আপনারা আমার ঠিকানা জানিতে পারেন, তাহা হইলে ছুটি শেষ হইবার পূর্ব্বেই আপনারা হয়ত আমাকে এখান হইতে লইয়া যাইবেন ও বৎসরাবধি যে সকল আশা করিয়া আসিতেছিলাম, তাহা হইতে বঞ্চিত করিবেন। কলিকাতা গিয়াই আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। আমার কলিকাতায় থাকিবার স্থান উমাচরণবাবুর বাগানের সন্নিকট। ইতি—
শ্রী:-”
পত্রখানি পাঠ করিয়া ভাবিলাম, এ আবার কি? যিনি এরূপভাবে পত্র লিখিলেন, তিনি তাঁহার নাম ও ঠিকানা গোপন করিলেন কেন? পত্রের ভাবে বোধ হইতেছে, যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহারই নিকটবর্তী কোন স্থানে ইনি থাকেন। আরও বোধ হইতেছে, ইনি বিশেষ সংবাদ অবগত আছেন। হয়ত যে ব্যক্তি কেদারনাথকে হত্যা করিয়াছে, তাহাকে ইনি দেখিয়াছেন, বা যে সকল ব্যক্তি দ্বারা কেদারনাথের লাস পোঁতা হইয়াছে, তাহাদিগকে ইনি জানেন।
এই ভাবিয়া পত্রের খামখানি বিশেষ করিয়া দেখিলাম, কারণ, কোন্ ডাকঘরে এই পত্রখানি প্রথম দেওয়া হয়, পত্রের উপর দেখিয়া যদি তাহার কিছু স্থির করিতে পারি। যাহা ভাবিয়াছিলাম, পত্র দেখিয়া তাহার কিছুই হইল না। বুঝিতে পারিলাম, চলিত-গাড়ী-সংলগ্ন ডাক-গাড়ীতে পত্র দেওয়া হইয়াছে, সুতরাং কোন্ স্থানে উহা যে প্রথম দেওয়া হইয়াছে, তাহা স্থির করা যাইতে পারে না।
কোন স্থান হইতে পত্রখানি আসিয়াছে, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া উমাচরণের বাগানের সন্নিকটে কাহারা থাকেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তিই বা দেশে গিয়াছেন, সেই বিষয়ে একটু অনুসন্ধান করিতে মনস্থ করিলাম।
পরদিবস প্রাতঃকালে সেইস্থানে গমন করিয়া সামন্য অনুসন্ধানেই জানিতে পারিলাম যে, যে স্থান হইতে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার সন্নিকটে একটি পাকাবাড়ী আছে। উহাতে আট দশজন লোক অবস্থিতি করেন। তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ বা কোন অফিসে কর্ম্ম করেন, কেহ বা লেখাপড়া করেন। পূজার বন্ধে সকলেই আপন আপন দেশে গমন করিয়াছেন; গৃহ সকল এখন চাবিবদ্ধ। স্কুল, কলেজ বা অফিস খুলিলেই সকলেই পুনরায় আগমন করিবেন।
এইরূপ অবস্থা দেখিয়া মনে মনে নিতান্ত আনন্দিত হইলাম। ভাবিলাম, এত চেষ্টা করিয়াও উমাচরণবাবুর বাড়ীর চাকর-চাকরাণীদিগের নিকট হইতে যে সকল কথা বাহির করিতে সমর্থ হই নাই, বন্ধের পর সেই সকল কথা বাহির হইয়া পড়িবে। বাসার এক ব্যক্তির নিকট হইতে যদি বিশেষ সংবাদ প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে হয়ত সেই বাসার অন্য লোকের নিকট হইতেও আরও অনেক কথা জানিতে পারিব। তখন এই হত্যাকাণ্ডে যে যে ব্যক্তি সংলিপ্ত ছিল, একে একে সকলের নাম প্রকাশ হইয়া পড়িবে। তখন সকলকেই রাজদণ্ডে দণ্ডিত করিতে সমর্থ হইব।
যে সময়ে আমি এইরূপ ভাবিতেছি, সেই সময়ে আমার সেই ঊর্দ্ধতন ইংরাজ-কর্মচারী কোথা হইতে আসিয়া হঠাৎ আমার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমি একটু বিস্মিত হইলাম। পরে আমার হস্তস্থিত পত্রখানি তাঁহাকে পড়িয়া শুনাইলাম। এই হত্যাসম্বন্ধে আমার মনে এখন যেরূপ বিশ্বাস হইয়াছিল, দেখিলাম, তাঁহারও মনে সেইরূপ ধারণা হইল। তখন তিনি আমাকে কহিলেন, “যে দিবস মোকদ্দমার দিন স্থির আছে, তাহার মধ্যে যদি সেই ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত হয়, ভালই; নতুবা বিচারককে এই পত্র দেখাইয়া পুনরায় মোকদ্দমা মুলতবি করিতে হইবে।” এই বলিয়া তিনি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
সর্ব্ব-কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া আমি প্রত্যহ সংবাদ লইতে লাগিলাম, সেই বাসা-বাড়ীর যে সকল লোক দেশে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ প্রত্যাগমন করিয়াছেন কি না। এইরূপে ক্রমে মোকদ্দমার দিন আসিয়া উপস্থিত হইল; কিন্তু সেই বাসায় কেহই আগমন করিল না বিচারের দিবসে বাধ্য হইয়া আমাকে পূর্ব্বোক্ত পত্র বিচারককে দেখাইতে হইল। পত্র দৃষ্টি করিয়া তিনি এই মোকদ্দমা আরও পনরদিবসের নিমিত্ত মুলতবি রাখিলেন।
দেখিতে দেখিতে ছুটি শেষ হইয়া আসিল। যে সকল ব্যক্তি ছুটি পাইয়া দেশে গমন করিয়াছিলেন, এক এক করিয়া তাঁহারা সকলেই কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিতে লাগিলেন। যাঁহাদিগের নিমিত্ত আমি নিতান্ত উদ্বিগ্ন ছিলাম, তাঁহারা ক্রমে ক্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
যখন দেখিলাম, সেই বাসায় সকলেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, সেই সময় একদিবস সন্ধ্যার পর পূর্ব্বোক্ত পত্রখানি সঙ্গে লইয়া আমি একাকী সেই বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। জানিলাম, সকলেই সেই সময়ে বাসায় উপস্থিত আছেন। আমি একেবারে উপরে উঠিয়া একটি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই গৃহের ভিতর দুইটি লোক বসিয়াছিলেন, আমাকে দেখিয়া তাঁহাদিগের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?’
উত্তরে আমি কহিলাম, “আমি যাঁহার অনুসন্ধান করিতেছি, তাঁহার নাম জানি না।” এই বলিয়া তাঁহাদিগের নিকট উপবেশন করিলাম।
প্রশ্ন। যাহার অনুসন্ধান করিতেছেন, তাহার নাম জানেন না, কহিলেন; কিন্তু তাহাকে চিনেন ত?
উত্তর। না মহাশয়! নামও জানি না, চিনিও না।
প্রশ্ন। তবে তাহাকে আপনি কিরূপে বাহির করিবেন?
উত্তর। বাহির করিবার একটু সামান্য উপায় আছে?
এই বলিয়া আমি আমার পকেট হইতে সেই পত্রখানি বাহির করিয়া উঁহাদিগকে দেখাইলাম ও কহিলাম, যিনি আমাকে এই পত্র লিখিয়াছেন, তাঁহারই সহিত একবার সাক্ষাৎ করিতে চাই। এই বলিয়া সেই পত্রখানি তাঁহাদিগের একজনের হস্তে প্রদান করিয়া কহিলাম, “এই পত্রখানি এখন আপনারা পড়িবেন না। আবশ্যক হয়, সময়মত আপনাদিগকে ইহা পড়িতে দিব। এখন কেবল এইমাত্র দেখুন, ইহা আপনাদিগের বাসার কাহার লিখিত পত্র?”
আমার কথা শুনিয়া তাহাদিগের মধ্যে একজন সেই গৃহ হইতে উঠিয়া গেলেন, ও যে যে ব্যক্তি সেই বাসায় থাকেন, সকলকেই ডাকিয়া আমার নিকট আনিলেন। সকলে আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলে আমি সকলকেই কহিলাম, “দেখুন দেখি, এই পত্রখানি আপনারা কে লিখিয়াছেন?”
আমার কথা শুনিয়া তাঁহাদিগের মধ্যে একজন পত্রখানি হস্তে লইয়া কহিলেন, “এ পত্র আমি লিখিয়াছি। আপনি কি জানিতে চাহেন, বলুন। আমি যাহা কিছু অবগত আছি, তাহা এখনই আপনাকে বলিতেছি।” এই বলিয়া পত্রখানি অপর আর একজনের হস্তে প্রদান করিলেন, তিনি আমার অনুমতি লইয়া তখন উহা সর্ব্বসমক্ষে পাঠ করিলেন।
ইহার পর আমি তাঁহাকে তাঁহার নাম জিজ্ঞাসা করিলাম, উত্তরে তিনি কহিলেন, তাঁহার নাম– নরহরি দে।
আমি। এ সম্বন্ধে আপনি কি অবগত আছেন?
নরহরি। কি সম্বন্ধে?
আমি। কেদারনাথের হত্যা সম্বন্ধে।
নরহরি। কেদারনাথ? কোন্ কেদারনাথ?
আমি। উমাচরণবাবুর ভাই, কেদারনাথ।
নরহরি। উমাচরণবাবু এখন কোথায়?
আমি। তিনি এখন হাজতে আছেন।
নরহরি। কেদারনাথের লাস আপনারা পাইয়াছেন কি?
আমি। পাইয়াছি।
নরহরি। কোথায়, এবং কি প্রকারে পাইয়াছেন?
আমি। আপনাদিগের এই বাড়ীর নিকট উমাচরণবাবুর বাগানের মৃত্তিকার ভিতর প্রোথিত অবস্থায় পাইয়াছি। এখন আপনি এ সম্বন্ধে যাহা কিছু অবগত আছেন, তাহা অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক বলিলে বাধিত হইব। উমাচরণ নিজেই কি কেদারনাথকে হত্যা করিয়াছেন? কোন্ কোন্ ব্যক্তি সেই মৃতদেহ পুঁতিয়াছিল, তাহাও বোধ হয় আপনি দেখিয়া থাকিবেন?
নরহরি। আমি যাহা কিছু দেখিয়াছি, বা যাহা কিছু অবগত আছি, তাহার সমস্তই আপনাদিগকে বলিব বলিয়া আপনাকে এই পত্র লিখিয়াছি; কিন্তু যদি কোন কথা না বলি, তাহা হইলে আপনারা আমার কিছুই করিতে পারেন না। কারণ, আমি কিছুই জানি না, বা এ পত্র আমার লেখা নয় বলিলেই, বোধ হয়, সমস্তই শেষ হইয়া যায়। কিন্তু আমি তাহা করিতে চাহি না, আমি যাহা জানি, তাহার কোন কথা গোপন করিতে ইচ্ছা করি না। তবে কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, কিরূপে কেদারনাথের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, কিরূপেই বা উমাচরণ এই হত্যা সম্পন্ন করিয়াছেন, সেই সম্বন্ধে কিরূপ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, সেই সমস্ত কথা পরিষ্কাররূপে আমাকে প্রথমে বলুন, শ্রবণ করিয়া আমিও যাহা অবগত আছি, পরিশেষে তাহার সমস্ত আপনাকে বলিতেছি।
নরহরির কথা শুনিয়া মনে মনে ভাবিলাম, যে সকল বিষয় তিনি অবগত আছেন, তাহা প্রকাশ করিতে তিনি এত ইতস্ততঃ করিতেছেন কেন? উমাচরণের উপর সন্দেহ করিবার কিরূপ প্রমাণ সংগ্রহ হইয়াছে, তাহাই বা প্রথমে জানিতে চাহিতেছেন কেন? ইনি কি তবে উমাচরণের পক্ষীয় কোন লোক হইবেন? আমাদিগকে প্রলোভন দেখাইয়া, উমাচরণের বিপক্ষে কি কি প্রমাণ আমরা সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহাই জানিয়া লইবার নিমিত্ত কি ইনি কৌশলজাল বিস্তার করিলেন। যখন আমার নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইতে পারিবেন, তখন যাহা মনে আইসে, একটা মিথ্যা কথা কহিয়া আমাকে বিদায় করিয়া দিবেন, এই কি ইঁহার অভিপ্রায়? ইনি প্রকৃতই যদি উমাচরণের হিতকারী ব্যক্তি হয়েন, তাহা হইলে এরূপ অবস্থায় ইঁহার নিকট প্রথমে সকল কথা প্রকাশ করা আমার কর্তব্য কিনা?
এই প্রকারের নানারূপ চিন্তা ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার মনকে আকৃষ্ট করিল। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, এ পর্য্যন্ত উমাচরণের বিরুদ্ধে যে কিছু অনুসন্ধান করিয়াছি, বা যে কোন প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহার কিছুই গোপনভাবে হয় নাই; পাড়ার অধিকাংশ লোকই তাহা অবগত আছে। এরূপ অবস্থায় সমস্ত কথা নরহরির নিকট প্রকাশ করিলে আমার বা মোকদ্দমার বিশেষ যে কোনরূপ অনিষ্ট হইবে, তাহা বোধ হয় না। এই ভাবিয়া, যেরূপভাবে কেদারনাথ নিরুদ্দেশ হন, যেরূপে আমরা তাঁহার অনুসন্ধান করি, এবং উমাচরণ ও কেদারনাথ সম্বন্ধে যাহা কিছু অবস্থা অবগত হইতে পারিয়াছি, আনুপূর্ব্বিক তাহার সমস্ত কথা নরহরির নিকট বর্ণনা করিলাম। প্রথমে আমি যে বেনামী পত্র পাইয়াছিলাম, কেবল তাহার কথা গোপনে থাকিল। ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর আদেশে যেরূপে আমি উমাচরণের ঘর বাড়ীর অনুসন্ধান করি, ও পরিশেষে যেরূপে বাগানের ভিতর লাসের সন্ধান পাই, তাহার কোন কথাই আমি গোপন করিলাম না। যতদূর মনে আসিল, এক এক করিয়া তাহার সমস্তই নরহরিকে কহিলাম। আমার কথাগুলি বিশেষ মনোযোগের সহিত নরহরি ও বাসার অপরাপর সকলেই শ্রবণ করিতে লাগিলেন। যখন আমার কথা শেষ হইল, তখন ‘একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া নরহরি কহিলেন, “যাহা অনুমান করিয়া আমি মহাশয়কে পত্ৰ লিখিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা কি কেদারনাথের দেহ বলিয়া কেহ চিনিতে পারিয়াছে?
আমি। মৃতদেহটি পচিয়া একেবারে গলিয়া গিয়াছিল বলিয়া উহা সনাক্ত হয় নাই; কিন্তু উহা কেদারনাথের মৃতদেহ ভিন্ন অপরের মৃতদেহ হওয়া একেবারে অসম্ভব। আমি যতদূর জানি, তাহা আপনাকে কহিলাম। এখন আপনি যে যে বিষয় অবগত আছেন, তাহা বলিয়া আপনার প্রতিজ্ঞা পালন করুন।
নরহরি। কি আর বলিব মহাশয়! উমাচরণ কেদারনাথকে হত্যা করিয়াছেন কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু যে দেহ কেদারনাথের মৃতদেহ বলিয়া আপনারা স্থির করিয়াছেন, সেই মৃতদেহ কেদারনাথের নহে। এ সম্বন্ধে আপনাদিগকেও আমি দোষ দিতে পারি না; কারণ যেরূপ অবস্থায় কেদারনাথ নিরুদ্দেশ, তাহাতে উমাচরণের উপর সন্দেহ ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না। তাহার উপর তাহারই বাগানের ভিতর হইতে যখন একটি মৃতদেহ পাওয়া যাইতেছে, তখন কে না বলিবে যে, উক্ত মৃতদেহ কেদারনাথের নহে? কিন্তু মহাশয়! যদি আমার কথায় আপনি বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে আমি বলিতে পারি, যে, সেই মৃতদেহ কেদারনাথের নহে, অপরের।
নরহরির কথা শুনিয়া ভাবিলাম, ভাল লোকের নিকট উমাচরণের বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিতে বা এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃততত্ত্ব অবগত হইতে আসিয়াছি। পূর্ব্বে যাহা ভাবিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, তাহাই দাঁড়াইল। উমাচরণকে বাঁচাইবার নিমিত্ত তাঁহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া দেখিতেছি, ইনি সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। সামান্য সাক্ষ্য নহে, ইনি দেখিতেছি, প্রমাণ করিতে বসিয়াছেন যে, উক্ত মৃতদেহ কেদারনাথের নহে, অপরের। দেখা যাউক, ইনি আরও কি বলেন।
আমি। ইহা যে অপরের মৃতদেহ, তাহা আপনি কি প্রকারে জানিতে পারিলেন?
নরহরি। না জানিলে কি আপনাকে বলিতেছি? আমিও এই বাসার আরও কয়েকজন একত্র হইয়া সেই দেহ উক্তস্থানে প্রোথিত করিয়া রাখিয়াছি।
আমি। উঃ! কি সৰ্ব্বনাশ! এ জগতে না হইতে পারে এমন কৰ্ম্মই নাই! কাহার মৃতদেহ আপনারা সেইস্থানে প্রোথিত করিয়া রাখিয়াছেন?
নরহরি। কাহার মৃতদেহ তাহা আমরা অবগত নহি, কিন্তু প্রোথিত করিয়া রাখিয়াছি, ইহা ঠিক। এই বলিয়া নরহরি আমার নিকট উপবেশন করিলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
নরহরি কহিলেন, “মহাশয়! সংবাদপত্র পাঠে যখন জানিলাম, যে উমাচরণের বাগানের ভিতর একটি লাস পাওয়া গিয়াছে, তখনই আমার মনে সন্দেহ হইল। হয়ত আমাদিগের দ্বারা-প্রোথিত লাস পাওয়া গিয়াছে, ও সেই লাসকে কেদারনাথের লাস বলিয়া সনাক্ত হওয়ায় উমাচরণ হত্যাপরাধে ধৃত হইয়াছে। এই ভাবিয়া মহাশয়কে পত্র লিখিয়াছিলাম। এখন দেখিতেছি, যাহা ভাবিয়াছিলাম, প্রায় তাহাই ঘটিয়াছে।
“কিরূপে এই লাস আমরা উক্তস্থানে পুঁতিয়া রাখিয়াছি, তাহা বলিবার পূর্ব্বে আমার একটু সামান্য পরিচয় দেওয়া কৰ্ত্তব্য। আমিও এই বাসার আরও কয়েকজন এই সহরের একটি সরকারী স্কুলে ডাক্তারি পড়িতেছি। এই বৎসর আমরা যে শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিতেছি, সেই শ্রেণীতে মৃতদেহ কাটিয়া আমাদিগকে শিক্ষা প্রদত্ত হইয়া থাকে। আপনি, বোধ হয়, অবগত আছেন যে, হাসপাতালে যে সকল লোক মরিয়া যায় ও যাহাদিগের মৃতদেহ তাহাদিগের আত্মীয়স্বজন কর্তৃক গৃহীত হয় না, সেই সকল মৃতদেহ ছেদ করিয়া, মানুষ শরীরের কোন স্থান কিরূপে নির্ম্মিত, কোন স্থানকে কি বলিয়া থাকে, কোন্ শিরা কোন্ স্থান দিয়া কোথায় গমন করিয়াছে, প্রভৃতি বিষয়ের শিক্ষা অধ্যাপকেরা প্রদান করিয়া থাকেন। যে দিবস অধিক পরিমাণে মৃতদেহ সংগৃহীত হয়, সেইদিবস যদি কোন ছাত্র আপনারা নিজে পরীক্ষা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত কোন মৃতদেহ প্রার্থনা করেন, তাহা হইলে সময়ে সময়ে এক আধটি মৃতদেহ ছাত্রগণকে প্রদান করা হয়। ছাত্রগণ উক্ত মৃতদেহ ইচ্ছামত স্থানে রাখিয়া, পরিশেষে আপনারাই উহা ছেদ করিয়া পুস্তকের সহিত মিলাইয়া মনুষ্য শরীরের অবস্থা শিক্ষা করেন। পরিশেষে সেই ছেদিত লাস অপরাপর লাসের সহিত রাখিয়া দিলে, হাসপাতালের নিয়ম-মত উহার দাহ হইয়া থাকে।
“এইরূপ প্রকারে একদিবস কতকগুলি মৃতদেহ আমাদিগের হাসপাতালে জমা হয়। সুযোগ বুঝিয়া আমরা এই কয়েকজন মিলিয়া একটি মৃতদেহ পাইবার প্রার্থনা করি। আমাদিগের সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয়, এবং আমরা একটি লাস প্রাপ্ত হই। সেইদিবস হাসপাতালে অনেক শবচ্ছেদ হয়, ও ছাত্রগণের অতিশয় ভিড় হয়; সুতরাং সেই স্থানে আমাদিগের সুবিধা না হওয়ায় আমরা লাসটি সন্ধ্যার পর আমাদিগের বাসায় আনয়ন করি, এবং নির্জ্জনস্থানে ছেদন করিয়া আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করি। আমাদিগের কার্য্য শেষ হইয়া গেলে, ছেদিত লাস পুনরায় আর হাসপাতালে লইয়া না গিয়া, উমাচরণবাবুর নির্জ্জন বাগানের ভিতর উহা পুঁতিয়া ফেলি। পরে যেমন আমাদিগের স্কুল বন্ধ হয়, অমনি আমরা আপন আপন দেশে গমন করি। যে দিবস আপনারা উক্ত লাস প্রাপ্ত হন, সেইদিবস যদি আমরা এখানে থাকিতাম, তাহা হইলে এত গোলযোগ হইতে পারিত না, বা উমাচরণ বাবুর অদৃষ্টে এরূপ কষ্টও হইত না।
“এদিকে উমাচরণবাবুর ভ্রাতা কেদারনাথ নিরুদ্দেশ হইলেন। বিষয়-লোভে উমাচরণ কেদারকে হত্যা করিয়াছে, এইরূপ জনরব চারিদিকে প্রচারিত হইল। আপনারা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং উমাচরণবাবুর দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদিগের প্রোথিত লাসও সেই সময়ে তাঁহার বাগান হইতে বাহির হইয়া পড়িল। সুতরাং তিনি হত্যাপরাধে ধৃত হইয়া হাজতে কষ্টভোগ করিতেছেন। আমার বিশ্বাস, এ বিষয়ে উমাচরণ নির্দোষ, তবে কেদার সম্বন্ধে তিনি কিছু অবগত আছেন, বা না আছেন, তাহা ভগবানই জানেন। আমি যাহা অবগত ছিলাম, তাহাই মহাশয়কে বলিলাম। এখন আপনাদিগের যাহা কর্তব্য হয়, তাহা করিতে পারেন।” এই বলিয়া নরহরি চুপ করিল।
নরহরি এবং সেই বাসার অপরাপর ব্যক্তিগণের কথা শুনিয়া একবার ভাবিলাম যে, ইঁহারা সকলে প্রকৃত কথা বলিতেছেন। নিরপরাধ অবস্থায় উমাচরণকে আমরা কষ্ট দিতেছি। কিন্তু পুনরায় মনে আসিল, উমাচরণ একজন দরিদ্র লোক নহেন; অথচ যে মোকদ্দমায় তিনি পড়িয়াছেন, তাহাতে তাঁহার জীবন-সংশয়! এরূপ অবস্থায় চতুর লোকের পরামর্শ, এবং অর্থের বলে কোনরূপ কলাকৌশলের অবলম্বন হয় নাই ত? এইরূপ ঘটনার যোগাযোগ যদি চেষ্টা করিয়া কল্পিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে এতগুলি লোকের সাক্ষ্যসত্ত্বে উমাচরণ কখনই দণ্ডিত হইবেন না। কৌশল-চেষ্টায় যে এতগুলি লোককে হাত করিতে পারে, হাসপাতালেও সে তদ্বিষয়ক সাক্ষ্য-প্রমাণ যে ঠিক না করিয়াছে, তাহা হইতে পারে না। হাসপাতাল হইতেও এখন ইঁহাদিগের পোষক সাক্ষ্য নিশ্চয়ই বাহির হইবে। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে আমি সেই ঊর্দ্ধতন-কর্ম্মচারীর নিকট গমন করিলাম, এক এক করিয়া তাঁহাকে সমস্ত কথা বলিলাম; তিনি শুনিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। স্থির করিলেন, মোকদ্দমার দিবস এ সকল কথা বিচারকের নিকট স্পষ্ট করিয়া বলিবেন, কোন কথা গোপন করিবেন না।
হাসপাতালে আমাকে যাইতে হইল না। সে অনুসন্ধান উক্ত কর্ম্মচারী নিজেই করিলেন। আমি পূর্ব্বে যাহা অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, কার্য্যে তাহাই দাঁড়াইল। সেইস্থান হইতে অনেকেই নরহরির পোষকতা করিয়া সাক্ষ্য দিল।
আমার মন কোন সময় বিশ্বাস করিল যে, নরহরি প্রভৃতি সকলে যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত; যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা কেদারনাথের মৃতদেহ নহে। আবার কখনও মনে হইল, এই সমস্তই অর্থের খেলা; উমাচরণ প্রকৃতই দোষী। এইরূপে কখনও এদিকে, কখনও ওদিকে মন ধাবিত হইতে লাগিল। প্রকৃত যে কি, তাহা কিন্তু কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
দশম পরিচ্ছেদ
উমাচরণের বিচারের কেবলমাত্র দুই তিনদিবস বাকী আছে, এমন সময় একদিবস আমার অধীনস্থ জনৈক কর্ম্মচারী আসিয়া আমাকে কহিল, “যে মোকদ্দমার নিমিত্ত আপনি সর্ব্বদা চিন্তিত, যে হত্যা উমাচরণের দ্বারা সংসাধিত হইয়াছে বলিয়া আপনি সন্দেহ করেন, যে বিষয় লইয়া আপনি সৰ্ব্বদাই অপরাপর কর্ম্মচারীগণের সহিত তর্ক-বিতর্ক করিয়া থাকেন ও উমাচরণ যে নির্দোষ, তদ্বিষয়ে সর্ব্বদা যুক্তি প্রদর্শন করিয়া আসিতেছেন; আজ কিন্তু আমি যে সংবাদ পাইয়াছি, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সে বিষয়ে আপনার মনে আর কোনরূপ সন্দেহই থাকিবে না। উমাচরণের দ্বারা যে ভ্রাতৃহত্যা সংসাধিত হইয়াছে, সে বিষয়ে আপনার নিশ্চিত বিশ্বাস হইবে?”
যে সময় উক্ত কৰ্ম্মচারী আমাকে এই সংবাদ প্রদান করিল, সেই সময় আমি শুইয়াছিলাম। উহার কথা শুনিয়া আর আমি শুইয়া থাকিতে পারিলাম না, উঠিয়া বসিলাম। কৰ্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এমন কি সংবাদ পাইয়াছ, যাহাতে তুমি স্থির করিলে যে, কেদারনাথ উমাচরণ কর্তৃকই হত হইয়াছেন?”
কর্ম্মচারী। আমি যে সংবাদ পাইয়াছি, তাহাতে আমার আরও বিশ্বাস হইয়াছে যে, কেদারনাথের মৃত্যুর কারণ, বিষ-প্রয়োগ এবং সেই বিষ উমাচরণ কর্তৃকই প্রদত্ত হইয়াছে।
আমি। তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সকল গোলই মিটিয়া যাইবে। কেদারনাথের মৃত্যুর কারণ যে বিয-প্রয়োগ, ও উমাচরণই যে সেই বিষ প্রয়োগ করিয়াছেন, একথা তোমাকে কে বলিল?
কর্ম্মচারী। একথা অবশ্য আমাকে কেহ বলে নাই; কিন্তু আমি ঠিক বলিতে পারি, সেঁকো-বিষ-প্রয়োগ করিয়া কেদারনাথকে হত্যা করা হইয়াছে।
আমি। কি প্রকারে এবং কাহার দ্বারা কেদারনাথ হত হইয়াছেন, সে বিষয় পরে বিবেচনা করা যাইবে। এখন তুমি কি সংবাদ পাইয়াছ, তাহা পরিষ্কার করিয়া বল।
কর্ম্মচারী। আমি জনৈক বিশ্বস্ত লোকের নিকট হইতে জানিতে পারিয়াছি যে, পূজার কিছুদিবস পূর্ব্বে নূতন বাজারের হলধর দাঁর দোকান হইতে উমাচরণ সেঁকো-বিষ ক্রয় করিয়া লইয়া গিয়াছেন। যিনি আমাকে এই সংবাদ দিয়াছেন, বিষ ক্রয়ের সময় তিনি সেই দোকানে উপস্থিত ছিলেন। আবশ্যক হয়ত তিনি সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত আছেন। কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া ভাবিলাম, যদি এ সংবাদ প্রকৃত হয়, তবে বিশেষ সন্দেহের কারণই বটে। এই ভাবিয়া কালবিলম্ব না করিয়া কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া নূতন বাজারে হলধর দাঁর দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
হলধর দাঁ, বেণেমসলা বিক্রেতা। তাহার বয়সও নিতান্ত কম নহে। বৃদ্ধ হইলেও হলধর অতিশয় চতুর। সে আমাদিগকে দেখিবামাত্রই পুলিস-কৰ্ম্মচারী বুঝিতে পারিয়া আস্তে আস্তে দোকান হইতে উঠিল, ও দোকান বন্ধ করিবার উদযোগ করিতে লাগিল। বুঝিলাম, হলধর পলাইবার চেষ্টা করিতেছে। তখন হলধরকে বলিলাম “হলধর! তুমি যে কার্য্য করিয়াছ, তাহাতে পলাইয়া নিস্তার পাইবে না। তুমি উমাচরণকে উত্তমরূপে জান, এবং তিনি যে এখন ভ্রাতৃহত্যা অপরাধে হাজতে আছেন, তাহাও নিশ্চয় শুনিয়াছ। এখন উমাচরণ সকল কথা স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন এবং তুমি তাঁহার নিকট বিষাক্তদ্রব্য সেঁকো বিক্রয় করিয়া প্রকারান্তরে তাঁহার ভ্রাতৃহত্যার সহায়তা করিয়াছ।”
আমার কথা শেষ হইতে বৃদ্ধ হলধর কাঁপিতে কাঁপিতে সেইস্থানে বসিয়া পড়িল, এবং অনায়াসে বলিল, “উমাচরণ কে? তাহাকে আমি চিনি না, বা তাহার নিকট কখনও সেঁকো বা অপর কোন বিষ বিক্রয় করি নাই।”
হলধরের কথা শুনিয়া ও তাঁহার ভাবভঙ্গী দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, সে মিথ্যা কথা কহিতেছে। তখন তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “যদি তুমি উমাচরণের নিকট সেঁকো বিষ বিক্রয় না করিয়া থাক, ভালই; কিন্তু তোমার দোকানে সেঁকো বিষ আছে, কি না?”
উত্তরে হলধর যদিচ কহিল যে, তাহার দোকানে সেঁকো বিষ নাই; কিন্তু তাহার ভাবভঙ্গিতে এবং দোকানস্থিত দ্রব্যাদির উপর চাহনি দেখিয়া আমার মনে দৃঢ়বিশ্বাস হইল যে, এ ব্যক্তি বিষ বিক্রয় করিয়াছে, এবং এখনও ইহার দোকানে তাহার কতক মজুত আছে। তখন হলধরকে কহিলাম, “তুমি এখনও প্রকৃত কথা বল; নতুবা এখনই আমি তোমার দোকান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিব। তাহাতে যদি দোকানে সেঁকো পাওয়া যায়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই জানিও যে, উমাচরণের সহিত তোমাকে একত্র যাইতে হইবে।” এই বলিয়া যখন দেখিলাম,—হলধর আর কোন কথাই কহিল না, তখন তাহার দোকানে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। অনুসন্ধানে একটি টীনের কৌটার ভিতর কিয়ৎ পরিমাণ সেঁকো পাওয়া গেল। এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া হলধর নিতান্ত ভীত হইয়া পড়িল ও পরিশেষে কহিল, মহাশয়! আমি অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছি, সকল কথা সকল সময় মনে হয় না। আমাকে এ যাত্রা রক্ষা করুন। উমাচরণবাবুর নিকট আমি কখনও কোন বিষ বিক্রয় করি নাই, তবে আমার পুত্র যদি বিক্রয় করিয়া থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। আমার দোকান হইতে যখন যে দ্রব্যের আবশ্যক হয়, উমাচরণবাবু তখন চিঠি লিখিয়া সেই দ্রব্য আমার দোকান হইতে লইয়া যান। এইরূপে যদি সেঁকো প্রভৃতি কোন বিষাক্তদ্রব্য আমার পুত্রের নিকট হইতে ক্রয় করিয়া থাকেন, তাহা হইলে এই ফাইলে তাঁহার পত্র থাকিবার সম্ভাবনা।” এই বলিয়া দোকানের ভিতর হইতে একটি ফাইল আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। উক্ত ফাইল অনুসন্ধান করায় তাহার ভিতর হইতে বাস্তবিকই উমাচরণ বাবুর স্বাক্ষরিত একখানি পত্র বাহির হইল; ইহাতে লেখা ছিল, “প্রেরিত লোক মারফত দুই আনার মূল্যের সেঁকো বিষ দিবে, বিশেষ প্রয়োজন আছে।’
এই পত্র দেখিয়া উমাচরণ যে সেঁকো বিয ক্রয় করিয়াছেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রহিল না। সুতরাং হলধরের পুত্রের অনুসন্ধানেরও কোন প্রয়োজন দেখিলাম না। তখন পত্রখানি হস্তে লইয়া উমাচরণের বাটীতে গমন করিলাম। বাটীর সরকার প্রভৃতি সকলকেই এই পত্রখানি দেখাইলাম; কিন্তু সকলেই কহিল যে, এ পত্র উমাচরণবাবুর স্বাক্ষরিত নহে। এই কথায় উমাচরণের উপর আরও সন্দেহ হইল। তখন তিনি এ বিষয়ে কি বলেন, জানিবার জন্য জেলের ভিতর গমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহাকে উক্ত পত্রখানি দেখাইলে তিনি কহিলেন, উহা তাঁহারই লেখা। ইন্দুরের উৎপাত হওয়ায় তিনি পত্র লিখিয়া সেঁকো আনাইয়াছিলেন। কিন্তু নানাকারণে সেই সেঁকো ব্যবহৃত হয় নাই; যে শয্যায় তিনি শয়ন করেন, সেই গদির নিম্নে উহা রক্ষিত আছে।
উমাচরণের কথা শুনিয়া প্রথমে তাঁহার কথায় বিশ্বাস হইল, কিন্তু পরিশেষে তাঁহার বিছানা অনুসন্ধান করিয়া যখন সেই সেঁকো বিষ প্রাপ্ত হইলাম না, তখন তাঁহার উপর আরও সন্দেহ হইতে লাগিল।
ক্রমে মোকদ্দমার দিন আসিয়া উপস্থিত হইল, হাজত হইতে উমাচরণ বিচারালয়ে আনীত হইলেন। আমরাও সমস্ত সাক্ষী প্রমাণাদি লইয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, নরহরি ও তাঁহার বাসার সকলেই এবং গন্ধবণিক হলধর প্রভৃতি আসিল। সময়মত বিচারক মহাশয় এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ করিলেন। একজন সাক্ষীকে ডাকিয়া তাহার জবানবন্দী লিখিতে লাগিলেন।
সেই সময়ে আদালতের বাহিরে ভয়ানক গোলযোগ উত্থিত হইল। কিসের গোলযোগ জানিবার নিমিত্ত আদালতের মধ্যস্থিত দর্শকগণের সকলেই সেইদিকে গমন করিলেন। গোলযোগ ক্রমে আরও অধিক হইতে লাগিল।
এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া কিসের গোলযোগ, জানিবার নিমিত্ত আমিও বাহিরে গমন করিলাম। কিন্তু সেইস্থানে গিয়া যাহা দেখিলাম ও শুনিলাম, তাহাতে আমার বুদ্ধিলোপ হইল, মুখের কথা বন্ধ হইয়া গেল। ক্ষণকালের নিমিত্ত হিতাহিত জ্ঞান আমাকে পরিত্যাগ করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে যখন আমি প্রকৃতিস্থ হইলাম, তখন আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া বিচারালয়ের ভিতর প্রবেশ করিলাম। মাননীয় বিচারকের নিকটে গিয়া কহিলাম, “আপনি যে মোকদ্দমার বিচার করিতেছেন, তাহা আর করিবার প্রয়োজন নাই। উমাচরণ সম্পূর্ণরূপে নিদোষ, তাহাকে এখনি মুক্তিপ্রদান করুন: আমরা বিষম ভ্রমে পতিত হইয়া উমাচরণকে হত্যার অপরাধে আপনার নিকট প্রেরণ করিয়াছি। তিনি তাঁহার ভ্রাতা কেদারনাথকে হত্যা করেন নাই, যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহাও কেদারনাথের মৃতদেহ নহে। এখন দেখিতেছি কেদারনাথ হত হন নাই; তিনি নিজেই আসিয়া এখানে উপস্থিত হইয়াছেন। তাহারই নিমিত্ত আদালতের বাহিরে এত গোলযোগ।”
আমার কথা শুনিয়া বিচারক মহাশয় সাক্ষীর জবানবন্দী লওয়া স্থগিত করিলেন, উমাচরণকে আসামীর স্থান হইতে বাহির করাইয়া দর্শকের স্থানে বসিতে আদেশ দিলেন, এবং কেদারনাথকে তাঁহার সম্মুখে আনিবার নিমিত্ত একজন কর্ম্মচারীকে প্রেরণ করিলেন। দেখিতে দেখিতে কেদারনাথ বিচারক মহাশয়ের সম্মুখে আনীত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র উমাচরণ উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিলেন। বিচারক মহাশয় তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কেদারনাথকে জিজ্ঞাসা করিলেন—”তোমার নাম কি?”
“আমার নাম শ্রী কেদারনাথ মৈত্র।”
বিচারক। এই উম্মচরণ তোমার কে হন?
কেদার। আমার বৈমাত্র ভ্রাতা।
বিচারক। তুমি হঠাৎ বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিলে কেন? এবং এতদিবস কোথায়ই বা ছিলে?
কেদার। মহাশয়! দুঃখের কথা বলিব কি, আমার পিতার মৃত্যুর পর উমাচরণ ও তাঁহার মাতা আমার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিতেন, তাহা বলিবার নহে। ইঁহাদিগের ব্যবহারে আমি নিতান্ত জ্বালাতন হইয়া পিতার পরিত্যক্ত সমস্ত বিষয়ের অর্দ্ধেক অংশ আমাকে প্রদান করিতে বলি। আমার কথায় উঁহারা আমার উপর আরও অসন্তুষ্ট হন, এবং আমাকে আমার পৈত্রিক বিষয় হইতে বঞ্চিত করিবার নিমিত্ত কহেন যে, আমার পিতা মৃত্যুকালে সমস্ত বিষয় উমাচরণকে প্রদান করিয়া গিয়াছেন। এই কথা শুনিয়া আমার আপাদ-মস্তক জ্বলিয়া গেল। কিন্তু আমার সহায় সম্পত্তি কিছুই না থাকায়, আমি সেই সময় কোনরূপ প্রতিবাদ করিতে পারিলাম না। সেইদিন হইতেই আমি আমার সহায় অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। ক্রমে ঈশ্বর আমার সহায় জুটাইয়া দিলেন।
“সেই সময় হুগলীর জনৈক প্রতাপান্বিত ব্যক্তি আমার অবস্থা শুনিয়া বিশেষ দুঃখিত হইলেন, ও তিনিই আমার পক্ষ অবলম্বন করিয়া, যাহাতে আমি আমার সমস্ত বিষয় প্রাপ্ত হইতে পারি, তাহার উপায় করিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাকে তাঁহার একটি বয়স্থা কন্যার পাণিগ্রহণ করিতে হইবে, ইহাও আমাকে প্রতিশ্রুত করাইয়া লইলেন। উমাচরণ ও তাঁহার মাতা এবিষয় কিছুই জানিতে পারিলেন না। ওদিকে গোপনে গোপনে আমার বিবাহের সমস্ত স্থির হইয়া গেল। বিবাহের একদিবস পূর্ব্বে সেইস্থানে গমন করিবার নিমিত্ত আমি এক পত্র পাইলাম। পত্র প্রাপ্ত হইয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া রাত্রিযোগে গৃহ পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক আমি হুগলিতে গমন করিলাম। সেইস্থানে আমার বিবাহ কার্য্য শেষ হইয়া গেল। শ্বশুরের অনুরোধে পূজার সময় আমি সেইস্থানেই অতিবাহিত করিলাম। অদ্য আমি সেইস্থান হইতে আগমন করিয়াছি। বাড়ীতে গিয়া শুনিলাম, আমাকে হত্যা করার অপরাধে উমাচরণ ধৃত হইয়াছে, অদ্য তাহার মোকদ্দমার দিবস। এই কথা শুনিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না, দ্রুতপদে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।”
কেদারের কথা শুনিয়া বিচারক উমাচরণকে ছাড়িয়া দিলেন। কেদার, উমাচরণ প্রভৃতি সকলেই আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। বলা বাহুল্য, কেদারনাথ তাঁহার শ্বশুরের সাহায্যে মদনমোহনের পরিত্যক্ত সমস্ত বিষয় উমাচরণের সহিত সমান অংশে বিভক্ত করিয়া লইলেন।
এই মোকদ্দমায় আমাদিগেরও বিশেষ শিক্ষালাভ হইল। সেইদিবস হইতে প্রতিজ্ঞা করিলাম যে, মৃতদেহ সনাক্ত না হইলে এবং কিরূপে মৃত্যু হইয়াছে জানিতে না পারিলে, আর কখনও কোন আসামীকে ধৃত করিব না। “আমি স্বচক্ষে মারিতে দেখিয়াছি” কোন সাক্ষী এইরূপভাবে সাক্ষ্য প্রদান করিলেও, লাসের বিনা-সনাক্তে সেই সাক্ষীর উপর আমি নির্ভর করিব না।
[আশ্বিন, ১৩০১ ]