নিরুদ্দেশ জানলা
নটবর মামা একদিন এসে বললেন, কুকুর পুষেছিস কখনও? তখন আমার একটা কাজের খুব দরকার। আত্মীয়-বন্ধু, জানা-চেনা সবাইকে অনুরোধ করে ক্লান্ত হয়ে গেছি। চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার থেকে রেলের টিকেট কালেক্টর প্রত্যেক দিন ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি।
এমন সময় নটবর মামাই আনলেন এই কাজের খবরটা। একটা কুকুরের দেখাশোনা করতে হবে, পুকুরপাঁতিয়ার মহারাজকুমারী বিরাটেশ্বরী দেবী নাকি এমন একজন লোকের অনুসন্ধান করছেন, যে কুকুরের তত্ত্বাবধান, পরিচর্যা ইত্যাদিতে মোটামুটি অভ্যস্ত।
অল্প বয়সে দু-একটা নেড়ি কুকুরকে পাতের ভাত খাইয়েছি, একবার সপ্তাহ দুয়েক রাস্তা থেকে একটা কুকুরের বাচ্চা কুড়িয়ে এনে ইজের বাঁধবার দড়ি গলায় বেঁধে পোষ মানাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে নেড়ি কুকুর হলে কথা ছিল, এইসব রাজা-মহারাজাদের কুকুর দশাসই বুলডগ কিংবা অ্যালসেসিয়ান-ই হয়তো হবে। চাকরির আমার খুব দরকার, কিন্তু…
আমার দোনামনা ভাব দেখে নটবর মামা বললেন, তুই একটা সামান্য কাজও যদি না করতে পারিস, এই দুর্দিনে কাজ দেবে কে তোকে? তোদের বয়েসে রং-মিস্ত্রিদের সঙ্গে কাজ করেছি, মনুমেন্ট-হাওড়া ব্রিজের মাথায় উঠে রং মাখিয়েছি।
আমি বললাম, রাজা-মহারাজার কুকুর, কী জাতের কে জানে, শেষে কামড়ে-টামড়ে মেরে ফেলবে নাকি!
নটবর মামা বললেন, তবু চল, দেখাই যাক না। তার কথায় কী যেন এক আশ্বাসের আভাস রয়েছে।
পরের রবিবার সকালে নটবর মামা আমাকে নিয়ে গেলেন পুকুরপাঁতিয়ার মহারাজকুমারীর। কাছে। পুকুরপাঁতিয়ার ম্যানেজারের এক শালা নটবর মামার কী করে যেন পরিচিত, সেই সূত্র। বরানগরে এক বিরাট বাড়ি; পুকুরপাঁতিয়ার মহারাজার ওই হল কলকাতার বাসা। মহারাজা দীর্ঘদিন পরলোকগত, একমাত্র সন্তান মহারাজকুমারী, এখন প্রায় চল্লিশ বছর বয়েস হল, নটবর মামা যতদূর জানেন, বোধহয় অবিবাহিতা।
রাজবাড়িতে গিয়ে প্রথম ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হল। তিনি বললেন, আপনি এ কাজ আগে কখনও করেছেন?
আমার হয়ে নটবর মামা বললেন, না, এর আগে এরকম সুযোগ পায়নি।
আমি উশখুশ করছিলাম ম্যানেজারকে আর বিশেষ কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, আপনাদের কুকুরটা কী জাতের বলতে পারেন?
ম্যানেজার আমার দিকে একটু বক্রদৃষ্টিতে তাকালেন, তারপর বললেন, পুলিশ ডগ, গোয়েন্দা পুলিশেরা যে কুকুর পোষে এ হল গিয়ে সেই কুকুর।
ইতিমধ্যে মহারাজকুমারীর তলব এল। ম্যনেজার আমাকে আর নটবর মামাকে নিয়ে উপস্থিত করলেন। আমার তখন কাজ করার ইচ্ছা একেবারে চলে গেছে। পুলিশের কুকুর মানে বিরাট জাতের কোনও অ্যালসেসিয়ানই হবে, তার আদর যত্ন তদ্বির করা আমার সাধ্য নয়।
মহারাজকুমারী ভিতরের বারান্দায় গলা উঁচু গেঞ্জির কাপড়ের কামিজ আর থ্রি-কোয়ার্টার খাকি কাপড়ের প্যান্ট পরে একটা রিভলভারের নল পায়রার পালক দিয়ে পরিষ্কার করছিলেন। সামনে কয়েকটা গুলি একটা চিনেমাটির প্লেটে সাজানো, দেখে মনে হয় যেন আচার রৌদ্রে দেওয়া হয়েছে।
আমার বুকের মধ্যে ঢিব ঢিব করছিল। মহারাজকুমারী কিন্তু কোনও প্রশ্নই করলেন না, শুধু আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, বয়েস?
বয়েস বললাম। সামনে একটা স্লেট পেনসিল ছিল, সেটা হাতে নিয়ে আমার বয়েসটা লিখে দশমিক তেরো দিয়ে ভাগ দিলেন, ম্যানেজারবাবুকে বললেন, দেখুন তো ভাগটা।
ম্যানেজারবাবু দেখেশুনে বললেন, ঠিক আছে।
এবার মহারাজকুমারী আমাকে বললেন, না, তুমি বিশেষ অপয়া নও, তোমাকে দিয়ে চলবে।
এর আগে কখনও কুকুর পুষেছি কি না, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে কোনও প্রশ্নই হল না, আমার চাকরি হয়ে গেল। ষাট টাকা মাইনে, খাওয়া-দাওয়া, পরের দিনই যোগ দিতে হবে। বিহারের এক স্বাস্থ্যকর শহরে মহারাজকুমারী দু মাসের জন্য যাচ্ছেন, তার সঙ্গে কুকুর নিয়ে আমাকে যেতে হবে।
জীবনের প্রথম চাকরি কিন্তু কুকুরের ভয়ে প্রাণে এক বিন্দু আনন্দ বা উত্তেজনার সঞ্চার হল না। মহারাজকুমারীর কথা শুনছি আর পরে পরে নটবর মামার মুখের দিকে তাকাচ্ছি। এতটা দূর হওয়ার পর চাকরিটা আমার পক্ষে না নেওয়া চলে না তবু এই এক মারাত্মক সংশয়।
অচিরেই অবশ্য সংশয় ভঞ্জন হল। মহারাজকুমারীর কথা শেষ হলে ম্যানেজার বললেন, তা হলে সব ঠিক হল, এবারে আপনার ডিউটি বুঝে যান, কুকুরটাকে একবার…
ম্যানেজার বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারলেন না, মহারাজকুমারী একেবারে খেঁকিয়ে উঠলেন, কুকুরটা কুকুরটা করছেন কেন, ওর একটা নাম নেই নাকি? ম্যানেজার একটু অপদস্থ এবং বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। যা হোক, মহারাজকুমারীর সামনে থেকে গুটি গুটি আমরা তিনজন সরে বেরিয়ে এলাম।
ম্যানেজার বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, কুকুরটার নাম হল জানলা।
জানলা? আমি বিস্মিত বোধ করলাম।
হ্যাঁ, ম্যানেজার জানালেন, মনে করুন এমন একজন কেউ মহারাজকুমারীর কাছে এসেছে, যাঁকে মহারাজকুমারী সহ্য করতে পারেন না আবার বলতেও পারেন না চলে যান। সেক্ষেত্রে তিনি কী করবেন? নিজের প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন ম্যানেজারবাবু, মহারাজকুমারী কাউকে চেঁচিয়ে বলবেন–এই, জানলা খুলে দে– অতিথি কিছু বুঝতে পারবেন না কিন্তু এদিকে কুকুরটা শেকল থেকে ছাড়া পেয়ে মহারাজকুমারীর কাছে ছুটে আসবে। আর ওই রকম একটা বিশ্রী নেড়ি কুকুরকে সহ্য করবে এমন অতিথি রাজবাড়িতে আসে না।
আমি বিচলিত ভাবে বললাম, নেড়ি কুকুর বলছেন কী মশায়? এই বললেন পুলিশ ডগ, গোয়েন্দা কুকুর?
ম্যানেজারবাবু বললেন, আমি তো দেখেছি স্পষ্ট নেড়ি কুকুর। আপনার মামা এই নটবরবাবু আর আমার শালা দুজনে মহারাজকুমারীর কাছে গোয়েন্দা কুকুর বলে বেচে গেছেন দেড় হাজার টাকায়।
ইতিমধ্যে একটা মেটে রঙের বিশ্রী নেড়ি কুকুর আমাদের সামনে এসে লেজ নাড়তে শুরু করেছে। ম্যানেজারবাবু বললেন, এই হল আপনার জানলা।
এটা পুলিশ ডগ? আমি অবাক হয়ে নটবর মামার মুখের দিকে তাকালাম। নটবর মামা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, চুপ, বলছি না গোয়েন্দা কুকুর। এটাকে দেখলে যদি বোঝা যায় পুলিশ ডগ, তা হলে কাজ হবে নাকি! প্লেন ড্রেসে মানে সাদা পোশাকে ছদ্মবেশ, গোয়েন্দাদের কিছুই জানিস না না-কি?
যা হোক, আমার কী আসে যায়। আমার বরং নেড়ি কুকুর না হলেই অসুবিধে ছিল।
পরের দিন মহারাজকুমারী আর জানলার সঙ্গে হাওড়া স্টেশন থেকে রাতের গাড়িতে রওনা হয়ে গেলাম মহারাজকুমারীর স্বাস্থ্যনিবাসে। সাঁওতাল পরগনা আর কয়লাখনির মধ্যবর্তী অঞ্চলের ছোটখাটো জেলা শহর। বিরাট কম্পাউন্ডওয়ালা মহারাজকুমারীর নিজের বাড়ি পুকুরপাঁতিয়া নিবাস।
এক দিনেই জানলার সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল। এমনি কোনও অসুবিধা ছিল না, শুধু নেড়ি কুকুর বোধ হয় ডগ সোপের গন্ধটা মোটেই সহ্য করতে পারে না। আর একটা চার্টে ছয় ঘণ্টা অন্তর ওর টেম্পারেচার রিপোর্ট করতে হয় মহারাজকুমারীকে, এই থার্মোমিটার লাগানোটা ভীষণ কঠিন। নাড়ির গতিরও রিপোর্ট থাকার কথা, কিন্তু কুকুরের নাড়ি শরীরের ঠিক কোথায় বুঝতে না পেরে ঘড়ি দেখে মিলিয়ে আমার নিজের নাড়ির গতি যা হত সেটা রিপোর্ট করতাম।
দু-চারদিন গেল। সপ্তাহে এক দিন জানলার নখ কাটাবার কথা। কিন্তু সারা বেলা খুঁজেও পুরো জেলা শহরে একটাও নাপিত কুকুরের নখ কাটতে রাজি হল না। আমি আর মহারাজকুমারী দুজনে আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, কিন্তু না, অসম্ভব। জানলা ভীষণ লাফাতে লাগল। শেষে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে নখ কাটালাম।
বিপর্যয়টা ঘটল এর পরেই। বিকেলে জ্ঞান ফেরার পর জানলা পা উলটিয়ে ঘাড় চুলকোতে গিয়ে। ভীষণ অস্বস্তিতে ছটফট করতে লাগল। নখ কাটা গেছে, লোমের নীচের চামড়ায় কিছুতেই ধার লাগছে না। কী যে হল, ঘর বারান্দায় ছুটোছুটি করতে লাগল। মহারাজকুমারী সব দেখেশুনে আদেশ দিলেন, ওকে আজ রাতে আর বেঁধো না।
এবং ওই রাত্রিতেই জানলা নিরুদ্দেশ হল। পরদিন সকালে যখন আবিষ্কার করলাম জানলা পলাতক, মহারাজকুমারী ভীষণ হইচই বাধিয়ে দিলেন, যেন সমস্ত দোষটা আমার। আমি সকাল থেকে সারা বেলা ধরে সমস্ত তল্লাট চষে ফেললাম কিন্তু কোথাও জানলার কোনও পাত্তা পেলাম। না।
ম্লান মুখে পুকুরপাঁতিয়া নিবাসে ফিরে দেখি সেই প্রথম দিনের মতোই মহারাজকুমারী চিনেমাটির প্লেটে রিভলবারের গুলি কয়টা রোদে দিচ্ছিলেন। মহারাজকুমারী আমাকে দেখে একবার চোখ না তুলে মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন, যেভাবে তোক জানলাকে আমার ফিরে চাই। তারপর এক চোখ বুজে আর এক চোখে রিভলভারের নলটা লাগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আরও ঠান্ডা গলায় আদেশ করলেন, যাও, থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি করে এসো, কুকুর ফিরে পেলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, আর এখানে একটা পরগণা বার্তা না কী কাগজ বের হয় সেখানেও একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে এসো।
আবার বেরিয়ে গেলাম। সারা দিন স্নান খাওয়া কিছুই হয়নি। তবু চাকরি করতে গেলে কত কী করতে হয়।
থানায় কিছুতেই কুকুর হারানোর ডায়েরি নেবে না। তারপর যখন বললাম পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার, জমাদার কেমন অবাক হয়ে আমাকে দেখতে লাগল, তারপর তিন গেলাস জল খেল, কুকুরের বর্ণনা শুনে আরও তিন গেলাস। ডায়েরি লিখে নিয়ে বলল, ঠিক হ্যায়, কাল সুবাহমে মিল যায়গা।
জমাদার সাহেবের কথায় যে খুব ভরসা পেলাম তা নয়, খুঁজে খুঁজে এর পরে সাপ্তাহিক পরগণা বার্তার অফিসে গেলাম। পরগণা বার্তা তখন ছাপা হচ্ছে, পরের দিন রবিবার সকালে বেরোবে। বিজ্ঞাপন আছে শুনে তাড়াতাড়ি ম্যানেজার প্রেস থেকে ম্যাটার নামিয়ে সম্পাদককে ডেকে আনলেন। সম্পাদক একটা বিজ্ঞাপন এসেছে শুনে তিন গেলাস জল খেলেন, তারপর বিজ্ঞাপনটা পড়ে আরও তিন গেলাস জল খেলেন। অনেকক্ষণ পরে দম নিয়ে আমাকে ভাল করে দেখলেন, বললেন, আঁ, পাঁচ হাজার?
যা হোক, আমি ফিরে এলাম। ডায়েরি করে এসেছি আর বিজ্ঞাপন দিয়েছি মহারাজকুমারীকে জানালাম। মহারাজকুমারীর কোনও ভাবান্তর নেই।
একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, রাতের মধ্যে জানলা ফিরে আসতে পারে। কিন্তু ফিরল না।
পরদিন সকালে উঠে প্রথমেই গেলাম পরগনা বার্তার কার্যালয়ে। ভাবলাম বিজ্ঞাপনটা এনে মহারাজকুমারীকে দেখালে যদি একটু কাজ হয়। আর জানলা যখন নেই, আমার চাকরিও শেষ। আমি মানে মানে কেটে পড়ব।
পরগনা বার্তার অফিসের পথে একটা পত্রিকার স্টল। সেখানে খোঁজ করলাম, না পরগনা বার্তা বেরোয়নি। পরগনা বার্তা অফিসে গিয়ে দেখি দরজা হাটখোলা, মেশিনে আধছাপা পত্রিকা, আশে-পাশে ঘরে বাইরে কেউ কোথাও নেই।
অনেকক্ষণ এদিক ওদিক করে তারপরে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। তাজ্জব কাণ্ড, লোকগুলো সব উধাও হয়ে গেল কোথায়? হঠাৎ পাশের একটা ছোট টিলার নীচে ঝোঁপের ভিতর থেকে সম্পাদক বেরিয়ে এলেন, উসকোখুসকো চুল, চোখ লাল দেখে মনে হয় সারারাত ঘুমোননি, সম্পাদক আমাকে চিনতেই পারলেন না, আমি কিছু বলার আগেই তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, মশায়, একটা মেটে রঙের নেড়ি কুকুর দেখেছেন কোথাও? জানলা বলে ডাকলে সাড়া দেয়!
আমি আর কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম। বাজারের পথে প্রেসের ম্যানেজারকে দেখলাম একটা মিষ্টির দোকানের সামনে গোটাকয়েক নেড়ি কুকুরকে জিলিপি খাইয়ে নারকেলের দড়ি দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করছে। পথে এদিকে ওদিকে আরও দু-একজনকে দেখলুম, কেউ একটা কুকুর কাছে নেওয়ার চেষ্টা করছে, কেউ চেন বকলস নিয়ে ঘুরছে, মনে হল এদের কাউকে কাউকে যেন কাল ওই প্রেসে দেখেছি।
থানায় গেলাম। লক-আপ মালখানা পর্যন্ত হাটখোলা, সেপাই জমাদার দারোগা কয়েদি বা আসামি পর্যন্ত নেই। বারান্দায় একটা বেল, ঘণ্টা পেটা হয় তাতে। একটা বাচ্চা ছেলে একটা টুলের ওপর ওঠে ছুটির ঘণ্টা ইস্কুলে যেভাবে পেটায় সেইভাবে ঢং ঢং করে বাজাচ্ছে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার?
সে বলল, ছুটি। আজ কুকুর হারানোয় ছুটি হয়ে গেছে। বাবা কুকুর খুঁজতে গেছে। বলে আরও ঢং ঢং করে ঘণ্টা পেটাতে লাগল।
আমি ক্লান্ত অবস্থায় পুকুরপাঁতিয়া নিবাসের দিকে ফিরলাম। একটা মোড় ঘুরলে প্রায় শ তিনেক গজ দূরে বাড়িটা, সেই মোড় পর্যন্ত পৌঁছে ভীষণ হট্টগোল হইচই, শ দেড়েক কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পেলাম। এগিয়ে দেখি সাংঘাতিক ব্যাপার। সেপাই, জমাদার, দারোগা, কম্পোজিটার, মেশিনম্যান, প্রেস ম্যানেজার কারওর কোলে, কারওর কাঁধে, কারওর হাতে নারকেলের দড়িতে বাঁধা চেন বকলসে লটাকানো অসংখ্য নেড়ি কুকুরের একটা হাট জমে গেছে নিবাসের সামনে। আর সমস্ত কুকুর পরস্পরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে, কোথাও বা রীতিমতো মারামারি চলছে।
দূর থেকে পুকুরপাঁতিয়া নিবাসের ভিতরের দিকে তাকালাম। দেখলাম চিনেমাটির প্লেট থেকে রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া কার্টিজগুলো মহারাজকুমারী স্থির হাতে একটা একটা করে রিভলভারের মধ্যে ভরছেন।
আমার আর পুকুরপাঁতিয়া নিবাসে ফেরা সম্ভব হয়নি। প্রায় দিন তিনেক পরে কলকাতায় খবরের কাগজে একটা সংবাদ পড়েছিলাম, মফস্সল বার্তায় কুকুরের উৎপাত এই হেড লাইনের নীচে–
কী এক অজ্ঞাত কারণে শতাধিক কুকুর অদ্য মধ্যাহ্নের কিছু পূর্বে পুকুরপাঁতিয়া নিবাস সমবেতভাবে আক্রমণ করে। এইরূপ ঘটনা এখানে আর কখনও ঘটে নাই। ফলে এতদঞ্চলে যথেষ্ট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। পুকুরপাঁতিয়ার মহারাজকুমারী বিরাটেশ্বরী দেবীকে অবশেষে আত্মরক্ষার্থে রিভলভার পর্যন্ত চালাইতে হয়। সৌভাগ্যবশত ঘটনার সময়ে সেপাই জমাদার সহ স্থানীয় থানার দারোগা অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিই অবস্থা আয়ত্তে আনেন। সংবাদপত্র পরগণা বার্তার প্রতিনিধিরাও অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনিতে থানার দারোগাকে যথেষ্ট সাহায্য করেন।…