৬
জিন্স আর জয়পুরী কাজ করা জামা পরায় রোহিলার চেহারাটা একেবারে বদলে গেছে। তার মুখখানি এখন রক্তমাংসের একটি ফুল। পোশাক অনুযায়ী মানুষের গমনভঙ্গিও বদলে যায়। গাম্ভীর্য বা প্রতিরোধের বাতাবরণ একেবারেই খসে গেছে।
আমার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে রোহিলা কৌতুক ঝলমল গলায় বলল, তুমি যখন প্রথম আমার বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ালে, আমি ঘরের মধ্যে থেকে তোমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। তখনই আমি একবার ভেবেছিলাম, আজই আমার এখানে থাকার শেষ। আমায় চলে যেতে হবে।
–কেন, ওরকম মনে হলো কেন? আমায় কি ভগ্নদূতের মতন দেখাচ্ছিল? তুমি ভেবেছিলে, আমি তোমায় কোনো খারাপ খবর দিতে এসেছি?
–না, তা নয়। আমি অনেক খারাপ পেরিয়ে এসেছি, আর বেশি কী হবে? আমি এখন শুধু ভালো লাগা–না–লাগার ওপর নির্ভর করে চলি। তোমাকে আমি ঘরের মধ্যে ডেকে খাটের ওপর বসতে বললাম কেন বলো তো? আমি দেখতে চেয়েছিলাম, তুমি প্রথম সুযোগেই আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করো কি না!
–যাঃ, তা আবার হয় নাকি? ভালো করে আলাপ–পরিচয়…কিংবা প্রেম– ট্রেম হবার আগে কেউ কোনো মেয়ের গায়ে হাত দেয়?
—তুমি পৃথিবীটা কিছুই চেনো না মনে হচ্ছে। তোমার চেয়ে আমি অনেক বেশি দেখেছি। আমি যখন প্রথম কাঁদলুম, তখন ভেবেছিলুম তুমি নির্ঘাৎ আমার মাথায় হাত দেবে, উঠে এসে আমাকে তোমার বুকে চেপে ধরবার চেষ্টা করবে। তা বলে আমি মিথ্যেমিথ্যি কাঁদিনি। সত্যি হঠাৎ কান্না এসে গিয়েছিল। আমি অভিনয় করা একেবারে ছেড়ে দিয়েছি।
– আমি সেরকম কিছু করলে কী হতো?
—ভাবতুম যে এই দিকশূন্যপুর অন্যান্য যে–কোনো জায়গার মতনই একটা পচা জায়গা। এখানেও ছ্যাচড়ারা রয়েছে। চলে যেতুম কাল সকালেই।
–যাক, আমি তাহলে দিকশূন্যপুরের মান বাঁচিয়েছি।
—তুমি কী করো, নীললোহিত? তুমি আমার সব কথা শুনলে, তোমার নিজের কথা কিছু বললে না?
– আমি কী করব, সেইটাই এখনো ভেবে ঠিক করতে পারিনি। এটাই আপাতত আমার নিজের কথা!
—অর্থাৎ তুমি বলবে না কিছু! ঐ যে বন্দনা বলে মেয়েটির কথা বললে, ও তোমার কে হয়?
সর্বনাশ, তোমার কৌতূহল যে খুব বেশি দেখছি! রোহিলা, এখানে কেউ ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেই না বলতে গেলে। অবশ্য আমার বেলা সেটা খাটে না। বন্দনা আমার সেরকম কেউ হয় না। এমনিই আমার চেনা।
টিলার নিচে কুয়োর পাশের বাড়িটিতে মোমের আলো জ্বলছে না। অঙ্কের পণ্ডিতটিকেও দেখা যাচ্ছে না। সে বাড়ির পাশ দিয়ে টিলার ওপরের দিকে উঠতে যেতেই ডুম্ ডুম্ শব্দ শুনতে পেলুম। অনেকটা মাদলের আওয়াজের মতন। এমনিতেই এখানে গাড়ি–ঘোড়া চলে না বলে শব্দ কম, সন্ধের পর সব দিক একেবারে অদ্ভুত নিস্তব্ধ। মাদলের আওয়াজটা খুব কাছে মনে হয়
রোহিলা যেন ভয় পেয়ে আমার হাত চেপে ধরে বলল, ও কিসের আওয়াজ?
আমি বললুম, হয়তো কাছাকাছি কোনো আদিবাসীদের গ্রাম আছে। আর কোনো সন্ধেবেলা এরকম শব্দ শোনোনি?
—না তো!
ডুম্ ডুম্ শব্দটা বেজেই চলেছে।
টিলার ওপর থেকে কে যেন নেমে আসছে, পায়ের আওয়াজে বোঝা গেল। আমরা এক পাশে সরে দাঁড়ালুম। কাছে আসতে দেখতে পেলুম বন্দনাদিকে। হাতে একটা টর্চ, আমাদের দেখার পর জ্বালল।
আমি বললুম, বন্দনাদি, এর নাম রোহিলা। তোমার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য নিয়ে এসেছিলাম।
বন্দনাদি প্রথমে চিনতে পারল না। তারপর বলল, ও আপনিই তো মাসখানেক আগে এসেছেন?
রোহিলা বলল, আমি কালো শাড়ি পরে থাকতাম। এই ছেলেটি বলল, ঐ পোশাকে আর্মাকে মড়া মড়া দেখায়।
আমি বললুম, তা বলিনি। বলেছি, মূর্তির মতন।
বন্দনাদি বলল, নীলু, তুই এত দেরি করলি, আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছিলুম। আজ আমাদের মিটিং আছে, ঐ যে শুনছিস না ডাকছে মাদল বাজিয়ে!
—ওটা তোমাদের মিটিংয়ের ডাক? আমি যেতে পারি সেখানে?
—খোলা রাস্তার ওপর মিটিং হবে, যে–কেউ যেতে পারে। চল, তাড়াতাড়ি চল।
আমরা আবার উল্টোদিকে ফিরলুম।
রোহিলা আমাকে বলল, এই, তুমি ওকে দিদি বলছ কেন? আগে যে বললে কেউ হয় না?
আমি বললুম, সত্যি, দিদি বলার কোনো মানে হয় না। নিছক একটা অভ্যেস বন্দনাদি, আজ থেকে আমি তোমায় শুধু নাম ধরে ডাকব?
বন্দনাদি বলল, মোটেই না,! ওসব চলবে না। আমায় নাম ধরে ডাকলে চাঁটি খাবি।
রোহিলা বলল, তা হলে আমাকেও দিদি বলা উচিত। আমি তোমার থেকে নিশ্চয়ই বয়েসে বড়!
আমি বললুম, আরে, আমি কি বিশ্বশুদ্ধ মেয়ের সঙ্গে দিদি পাতাব নাকি? ওসব আমি বিশ্বাসই করি না।
টিলার নিচের রাস্তায় একজন, দু’জন মানুষ দেখা যাচ্ছে। সবাই চলেছে মিটিং– এ। একটু একটু জ্যোৎস্না আছে আকাশে। বাতাসে কিসের যেন চাপা গন্ধ। এই রকম রাতে বসে থাকার চেয়ে বেড়াতেই ভালো লাগে।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি, মিটিং কে ডাকে? তোমাদের এখানে কী প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারির কোনো ব্যাপার আছে!
–না–না, সেসব কিছু নেই। যে–কেউ ডাকতে পারে। তবে তার আগে আর অন্তত যে–কোনো দু’জনের সম্মতি নিতে হয়। অর্থাৎ যদি মোট তিনজন মনে করে কোনো একটা ব্যাপার সবাইকে জানানো দরকার, তাহলেই মিটিং ডাকা যায়!
—সন্ধেবেলা মিটিং হয়?
— গরমের দিনে সন্ধেবেলাই তো ভালো, বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা থাকে। শীতকালে মিটিং হয় দুপুরে। জানিস তো, এমনও হতে পারে, আজকের মিটিংটা তোকে নিয়ে।
–অ্যাঁ? আমাকে নিয়ে। তার মানে?
—তুই বাইরের লোক হয়েও এখানে মাঝে মাঝে আসিস, সেটা অনেকের পছন্দ না হতেও পারে।
—কিন্তু কেউ যদি এরকম চলে আসে, তাকে কি তোমরা বাধা দিতে পার? এই জায়গাটা প্রাইভেট প্রপার্টি নয় নিশ্চয়ই।
—তা নয় অবশ্যই। জানি না ওরা কী বলবে!
– ধরো, বাইরে থেকে যদি একদল ছাত্র এখানে ট্রাকে চেপে পিকনিক করতে আসে, বিকট সুরে মাইক বাজায়, গাছপালা নষ্ট করে, তাহলে তোমরা কী করবে?
–ভাগ্যিস সেরকম কিছু হয়নি এখনো। তুই এসব অলক্ষুণে কথা বলছিস কেন রে?
রোহিলা বলল, আমি যখন এখানে পৌঁছলুম, তখন দুপুর, রাস্তার একজন লোককে জিগ্যেস করলাম, আমি এখানে থাকতে পাব? সে একটা খালি বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। আশ্চর্য, একটা কথাও জিজ্ঞেস করল না।
বন্দনাদি বলল, এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? একটা খালি বাড়ি পড়ে থাকলে নতুন কেউ এসে সেখানে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
—কিন্তু ভাড়াটাড়া লাগে না? পৃথিবীতে এমনি এমনি কোথাও বাড়ি পাওয়া যায় নাকি?
—এখানেও ভাড়া লাগে। শুধু প্রথম বছরটায় কোনো ভাড়া দিতে হয় না, কারণ প্রথম আসার সময় অনেকের কাছেই পয়সা থাকে না। তখন সব কিছু ফ্রি। এক বছর পর থেকে যে–কোনো ভাবে উপার্জন করে সব শোধ দিতে হয়।
–কাকে শোধ দিতে হয়? কে বাড়ি ভাড়া নেয়?
–অত সব তোকে বলব কেন রে? তুই তো বাইরের লোক!
মাদলের আওয়াজটা থেমে গেছে। এবারে বোধহয় সভা শুরু হয়ে যাবে। আমরা প্রায় দৌড়তে লাগলুম।
বন্দনাদি রোহিলাকে বলল, আপনি যদি রান্না না করে থাকেন, তাহলে রাত্তিরে ফিরে এসে আমার ওখানে খেয়ে নিতে পারেন। আমি বেশি করে রেঁধে রেখে এসেছি।
রোহিলা বলল, আমাকে তুমি আপনি বলছ কেন? এই নীললোহিত, একে তুমি বলে দাও!
আমি বললুম, বন্দনাদি, এই মেয়েটির বয়স মাত্র তিন বছর। সুতরাং ওকে আপনি বলার দরকার নেই।
রোহিলা বলল, আমাকে কেউ আপনি বলবে না। আমিও কারুকে আপনি বলতে পারি না।
আমি বললুম, তোমাদের বোম্বেতে মারাঠী ভাষায় বোধহয় আপনি শব্দটাই নেই। রোহিলার বয়েস তিন বছর শুনেও বন্দনাদি চমকাল না। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক আন্দাজ করে নিয়েছে। সে বলল, আপনি–টাপনি আমারও ঠিক পছন্দ নয়। এখানে বিশেষ কেউ বলে না।
নদীর ধারে আমরা অনেক মানুষের মাথা দেখতে পেলুম। আকাশে পাতলা জ্যোৎস্না, কিন্তু এখন দু’একটা মেঘও ঘোরাঘুরি করছে। একটা উঁচু পাথরের ওপর কেউ জ্বেলেছে একটা মশাল, সেখানে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা ও দু’জন পুরুষ। সামনে জমায়েত হয়েছে প্রায় পাঁচ–সাতশো মানুষ, যুবক–যুবতী, বৃদ্ধ–বৃদ্ধা, কিশোর–কিশোরী, একেবারে বাচ্চা একটিও নেই। এরা কেউ কারুর সম্পর্কিত নয়, কে কোথা থেকে এসেছে, কেউ জানে না। কিসের জন্য এরা ঘর ছেড়েছে আর এখানে এসেই বা কী শান্তি পেয়েছে কে জানে!
এখন এই নদীরেখাঙ্কিত প্রান্তরে, জ্যোৎস্নার তলায় এই মনুষ্য সমাবেশটিকে কেমন যেন আদিম দুনিয়ার একটি দৃশ্য বলে মনে হয়। বিশেষত ঐ মশালটির জন্য। এখানে যারা রয়েছে, তাদের কেউ কেউ এককালে নামকরা পণ্ডিত ছিল, কেউ উচ্চপদস্থ চাকুরে, কেউ কেউ শিল্পী, কেউবা উচ্চ সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবারের সন্তান। কিন্তু এখানে কারুর কোনো আলাদা পরিচয় নেই। শুধু নাম ছাড়া, কারুর কোনো পদবীও শোনা যায় না।
বন্দনাদি বলল, ভিড়ের মধ্যে আমরা যদি হারিয়ে যাই তাহলে মিটিং শেষে আমরা ঐ যে লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছটা, ওর তলায় মিট করব, কেমন?
রোহিলা আমার হাত চেপে ধরে বলল, আমার হারিয়ে যেতে ভয় করে। তুমি আমার পাশে পাশে থেকো।
উঁচু পাথরের ওপর একজন পুরুষ তিনবার মাদলের ধ্বনি দিতেই সব গুঞ্জন থেমে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি, ঐ ভদ্রলোক বুঝি এখানকার নেতা?
বন্দনাদি ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ!
উঁচু পাথরের মঞ্চ থেকে প্রথমে মহিলাটি বলল, নমস্কার। আপনারা সবাই এসেছেন আমাদের ডাক শুনে, সে জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের কয়েকটি ঘোষণা আছে। আজকের সন্ধেটি বড় সুন্দর, এখানে আমাদের ইচ্ছে মতন নাচ গানের অনুষ্ঠান হতে পারে। তার আগে আমরা সংক্ষেপে কাজের কথাগুলো সেরে নিই। প্রথমে বলবে, আপ্পা রাও।
আপ্পা রাও পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সে নমস্কার করে বলল, আমার বক্তব্য আলু বিষয়ে।
শ্রোতাদের মধ্যে একটা হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল।
আপ্পা রাও লোকটি বেশ রসিক। প্রথম বাক্যেই হাসি শুনে সে ঘাবড়ে গেল না। নিজেও হেসে বলল, আমি প্রেম বিষয়েই ভালো বলতে পারি, কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে আজ আমাকে আলু বিষয়েই বলতে হবে।
কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, বলুন, বলুন!
আপ্পা রাও বলল, আলু জিনিসটা বেশ সুস্বাদু, নানা রকম রান্নার কাজে লাগে আপনারা সবাই জানেন। আলু সেদ্ধ, আলু ভাজা, আলুর দম, মাংসের আলু, তরকারির আলু, কত দিক থেকে আলু আমাদের উপকারী। আলু বিষয়ে আমি একটা গান লিখেছিলুম, কিন্তু সুরটা ভুলে গেছি!
রোহিলা চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকাল। যেন সে বলতে চায়, সন্ধেবেলা চাঁদের আলোয় মিটিং ডেকে এ আবার কী ধরনের কথাবার্তা? খাদ্য বিষয়ে বেশি চিন্তা সে পছন্দ করে না।
আপ্পা রাও আবার বলল, কিন্তু তবু একটা কথা আছে। এবারে দেখা যাচ্ছে অনেকেই ঘরে ঘরে আলুর চাষ করেছে। প্রচুর আলু জমে গেছে। এত আলু কেউ খাবে না। কেউ আর আলু নিতে চায় না। সেইজন্য অতিরিক্ত আলু শহরে গিয়ে বিক্রি করে আসতে হবে। এটাই আমার প্রস্তাব। পরশু আমি শহরে যাব, আপনাদের যার যার ঘরে অতিরিক্ত আলু আছে, আমার বাড়িতে কাল বিকেলের মধ্যে জমা করে দিয়ে আসতে পারেন। শহর থেকে কিছু আনতে হলে সেই লিস্টিও পেশ করবেন। ব্যস, আমার কথা শেষ!
সবাই একসঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠল।
মহিলাটি ঘোষণা করল, এবারের বক্তব্য রাখবেন ইসমাইল সাহেব।
ইসমাইল নামের ব্যক্তিটি একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে। তারপর হঠাৎ বেশ জোরাল গলায় গান শুরু করে দিল। গজল ধরনের গান। গজল শুনলেই আমার নিজেকে বেশ বোকা বোকা লাগে, কারণ ঐ গানের কথার এক বর্ণও মর্ম বুঝতে পারি না। অবশ্য ইসমাইল সাহেবের কণ্ঠস্বরটি সুরেলা।
দু’তিন মিনিট বাদেই গান থামিয়ে ইসমাইল বলল, এবারে একটা গল্প শুনুন। এক ছুতোর মিস্তিরির এক দজ্জাল বউ ছিল। বউটি অতি মুখরা। অনেকদিন সহ্য করার পর ছুতোর মিস্তিরি ভাবল, আর নয়, এবারে একটা কিছু করতেই হবে। তখন থেকে সে বউকে খুন করার ফন্দী আঁটতে লাগল। কী ভাবে খুন করবে শুধু সেই কথাই ভাবে। বিষ খাওয়াবে? মাথায় হাতুড়ি মারবে? গায়ে আগুন লাগিয়ে দেবে? ঠিক মনস্থির করতে পারে না। একদিন এই সব কথা ভাবতে ভাবতে ছুতোর মিস্ত্রি নদীর ওপরের একটা সাঁকো পার হচ্ছিল। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেল নদীতে। ছুতোর মিস্তিরি সাঁতার জানত না! ব্যস!
এই পর্যন্ত বলে থেমে গেল ইসমাইল সাহেব। আর কিছু বলে না।
দু’একজন জিজ্ঞেস করল, তারপর? তারপর?
ইসমাইল বলল, নদীতে বেশি জল ছিল না। আর দু’জন জেলে সেখানে মাছ ধরছিল, তারা ছুতোর মিস্তিরিকে বাঁচিয়ে দিল।
—তারপর? তারপর?
ইসমাইল সাহেব হেসে বলল, তারপর আবার কী? আমি কি গল্প বানাতে জানি নাকি? ছুতোর মিস্তিরির জীবন যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগল।
একসঙ্গে হেসে উঠল অনেকে।
ইসমাইল সাহেব বলল, সেই ছুতোর মিস্তিরি আর বউকে খুন করার কথা ভাবে না। আবার তারা ভালোবাসতে শেখে। আমার নিজের জীবনেই এরকম ঘটেছিল। এবারে আমার বক্তব্য রাখি? আমি আজ জঙ্গলে নীহারদাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আপনারা সবাই জানেন, নীহারদা তিন দিন ধরে সেখানে শুয়ে আছেন। আজ আমি গিয়ে দেখলাম, তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে, মনে হলো। তবে কষ্ট নেই। আমাদের মধ্যে একজন, যার সঙ্গে নীহারদার খুব কটু ঝগড়া হয়েছিল, নীহারদা –তাকে ক্ষমা করেছেন। নীহারদা আমাকে সেই কথা জানাতে বলেছেন। আসুন, আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীহারদার জন্য দোয়া করি।
সবাই উঠে দাঁড়াল, কিন্তু শোকসভার মতন নীরবতা পালন করল না। এক সঙ্গে বলতে লাগল, নীহারদা ফিরে এসো, নীহারদা ফিরে এসো!
একটা ব্যাপারে আমি চমৎকৃত হলুম। এরা এখানে কোনো কাজের কথা নিছক কেজো ভঙ্গিতে বলে না। তার আগে একটু মজা করে গান গায়, গল্প বলে, এই প্রথাটা বেশ সুন্দর তো!
মহিলাটি বলল, এবারে আমার কথা। আমি আকাশ সম্পর্কে বলব। আপনারা সবাই জানেন, পৃথিবীর প্রায় সব জন্তু মাথা নিচু করে চলে। তারা সব সময় মাটি দেখে। একমাত্র মানুষই যখন তখন আকাশ দেখতে পারে। তবু আমরা আকাশ দেখি না। যখন শহরে থাকি, তখন আকাশ দেখার কথা মনেই পড়ে না। শহরের আকাশের চেয়ে খোলা জায়গার আকাশ অনেক বেশি সুন্দর। এখানে এসেও আকাশ দেখে দেখে আমার আশ মেটে না। আমার গলায় সুর নেই, সে জন্য আমায় ক্ষমা করবেন, তবু আমি একটা ছোট্ট গান গাইছি। “এই তো তোমার আলোক ধেনু সূর্য তারা দলে দলে…”
মহিলা বিনয় করছিল। তার গলা বেশ সুরেলা। গানটা সে গভীর উপলব্ধির সঙ্গে গাইল, গাইতে গাইতে তার গলা বুজে এলো কান্নায়।
একটু থেমে, নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে বলল, আমার একটা সামান্য বক্তব্য আছে। কিন্তু সেটা আমি নিজের মুখে এখন বলতে পারছি না, ইসমাইল ভাই অনুগ্রহ করে বলে দিন।
ইসমাইল সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে সেই মহিলার কাঁধে হাত রেখে বলল, এই মেয়েটির নাম জ্যোৎস্না। ও আকাশ কত ভালোবাসে তা তো আপনারা শুনলেন। আমার তো মনে হয় ও সারা শরীরে সব সময় আকাশ শুষে নিতে চায়। খুব ঝড়–বৃষ্টি না হলে ও রাত্তিরেও দরজা–জানলা বন্ধ করে না। শুয়ে শুয়ে যতক্ষণ ও জেগে থাকে ততক্ষণ আকাশকে আড়াল করতে চায় না।
ইসমাইল সাহেব একটু থেমে সকলের দিকে তাকাল। তারপর জ্যোৎস্নাকে ইঙ্গিত করল নিচে নেমে যেতে। হাত তুলে গুঞ্জন থামাবার অনুরোধ করে বলল, এবারে একটা দুঃখের কথা জানাব। জ্যোৎস্না কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়বার পর তার ঘরে একজন অতিথি এসেছিল। একজন অনাহূত অতিথি। তার উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। তার কোনো কিছুর প্রয়োজন থাকলে সে জ্যোৎস্নাকে ডেকে তুলে চাইলেই পারত। কিন্তু সে তা করেনি। জ্যোৎস্না হঠাৎ জেগে উঠতেই সে জ্যোৎস্নাকে আক্রমণ করে। জ্যোৎস্না তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেও পারেনি। সে একজন পুরুষ এবং শক্তিশালী। এবং আমার ধারণা, সে বিকারগ্রস্ত। জ্যোৎস্না চিৎকার করে উঠতেই সে তার গলা চেপে ধরে। সে হয়তো জ্যোৎস্নাকে মেরেই ফেলত, কিন্তু জ্যোৎস্নার চিৎকার শুনে পাশের বাড়ি থেকে একজন ছুটে আসে। তখন সে পালিয়ে যায়। আপনাদের মনে হতে পারে যে এর সবটাই জ্যোৎস্নার কল্পনা বা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু আমরা কয়েকজন আজ সকালে জ্যোৎস্নার গলায় পাঁচ আঙুলের দাগ দেখেছি। তাছাড়া, আপনারা বিজয়বাবুর কাছ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা শুনুন। বিজয়বাবু, অনুগ্রহ করে একবার এখানে আসুন।
পাজামা পাঞ্জাবি–পরা একজন লোক উঠে এসে বলল, আমি সংক্ষেপে যা দেখেছি তাই বলছি। আমি জ্যোৎস্নার কাছাকাছি বাড়িতে থাকি। বেশির ভাগ রাতেই আমি ঘুমোই না। দিনের বেলার চেয়ে রাত্তিরবেলা কাজকর্ম সারতেই আমার ভালো লাগে। কাল রাতেও আমি জেগেছিলাম। জ্যোৎস্নার বাড়ি থেকে এক সময় আমি একটা চাপা আর্তনাদ শুনতে পাই। সেই সঙ্গে একটা ভারি কিছু জিনিস পড়ে যাওয়ার শব্দ। কৌতূহলী হয়ে আমি এগিয়ে যাই ওর বাড়ির দিকে। প্রথমে বাড়ির মধ্যে ঢুকিনি, সামনের বাগানে দাঁড়িয়ে ডেকে বললাম, জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্না, কী হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? কোনো উত্তর পেলাম না। তখনই একজন লোক ঝড়ের মতন জ্যোৎস্নার ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে পালাল। আমি তাকে ধরার সুযোগ পাইনি। তার মুখটাও দেখা যায়নি। কাল রাতে আকাশ মেঘলা ছিল। তখন আমি জ্যোৎস্নার ঘরে ঢুকে দেখলাম, সে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমি তার চোখে মুখে জলের ছিটে দিই। আমার ধারণা, একজন সাংঘাতিক ধরনের আগন্তুক এসেছিল জ্যোৎস্নার ঘরে। আমাদের মধ্যে যদি এরকম কোনো মনোরোগী থেকে থাকে, তাহলে সেটা খুব দুশ্চিন্তার কথা। আমরা অনেকেই রাত্তিরে দরজা–জানলা বন্ধ করি না। এখন থেকে কি ভয়ে ভয়ে রাত কাটাতে হবে?
সবাই কয়েক মুহূর্ত একেবারে বজ্রাহতের মতন চুপ। যেন এরকম অবিশ্বাস্য কাহিনী তারা আগে কখনো শোনেনি। তারপরেই শুরু হয়ে গেল পারস্পরিক আলোচনা।
রোহিলা আমাকে খানিকটা হতাশভাবে জিজ্ঞেস করল, যাঃ! এখানেও এই কাণ্ড হয়?
আমি বললুম, স্বর্গেও মাঝে মাঝে দৈত্যরা গিয়ে উপদ্রব করে।
বন্দনাদিকে একজন কে যেন জোর দিয়ে বলল, আমাদের মধ্যে এরকম কোনো ম্যানিয়াক থাকতেই পারে না। এ নিশ্চয়ই বাইরের কোনো লোকের কাজ। চুপি চুপি ঢুকে পড়েছে।
বন্দনাদি আমার দিকে তাকাতেই আমি বললুম, আমি কিন্তু আজ দুপুরে এসেছি। কাল ছিলাম অনেক দূরে।
বন্দনাদি হাসি মুখে বলল, তোকে মঞ্চে তুলে দেব? সেখানে দাঁড়িয়ে তুই সবার সামনে নিজেকে ডিফেন্ড কর!
–আগে আমার নামে কেউ অভিযোগ আনুক!
রোহিলা বলল, না, এ ছেলেটা সে রকম নয়। এ আজ একা অনেকক্ষণ আমার ঘরে ছিল। আমি বাবা রাত্তিরে দরজা বন্ধ করে শোব।
বন্দনাদি বলল, বাইরের লোক বলে মনে হয় না। এখানকারই কেউ। কয়েকদিন ধরেই আমার বারবার মনে হচ্ছে, এখানে একটা খারাপ কিছু ঘটবে।
বন্দনাদির পাশে একজন মাঝবয়েসী মহিলা ম্লান মুখে বললেন, আমার খুব মন খারাপ লাগছে। কেন জানো? এই একটা বাজে বিষয় নিয়ে এখন আমাকে চিন্তা করতে হবে। আমার মন থেকে আমি এইসব জিনিসগুলো একেবারে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম!
মহিলাটিকে মা–মা দেখতে। লাল পাড় শাড়ি পরা। তিনি কেন বাড়িঘর ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন? গল্পটা জানার জন্য আমার সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহল হয়। কিন্তু উপায় নেই।
পাথরের মঞ্চ থেকে ইসমাইল সাহেব আবার সবাইকে চুপ করতে অনুরোধ জানালেন। তারপর হাত জোড় করে বললেন, মিটিং শেষ করার আগে শুধু আর একটাই কথা আছে। আমাদের অনেকেরই ধারণা, জ্যোৎস্নার ঘরে কাল রাতে যে এসেছিল, সে বাইরের লোক নয়, সে আমাদেরই এখানকার একজন। হয়তো সে অসুস্থ কিংবা পুরোনো জীবনের টানে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় এরকম কিছু করে ফেলেছে। সে দোষ স্বীকার করলে জ্যোৎস্না তাকে ক্ষমা করবে বলেছে। সর্বসমক্ষে দোষ স্বীকার করারও দরকার নেই। শুধু রজতদার কাছে নিরালায় দেখা করে বললেই চলবে। আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন, রজতদা একসময় বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন, তিনি সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আজকের সভা এখানেই শেষ!
আর একটা ব্যাপার আমার অদ্ভুত লাগল। যে–তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো, তার মধ্যে জ্যোৎস্নার ব্যাপারটাই নিশ্চয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সে কথাটা প্রথমেই তোলা হয়নি।
সভা ভঙ্গ হবার পর অনেকেই ছড়িয়ে পড়ল ছোট ছোট দলে। জ্যোৎস্নার ঘটনা শুনে সবাই যে খুব উদ্বিগ্ন তা মনে হলো না। দু’এক জায়গায় শোনা গেল স্বতঃস্ফূর্ত গান। তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ।
আমার খুব ইচ্ছে করল, জ্যোৎস্না নামের মেয়েটিকে কাছাকাছি গিয়ে দেখতে। কিন্তু এখন এই ভিড়ের মধ্যে কোথায় তাকে খুঁজে পাব?