২
স্টেশন থেকে নেমে সাইকেল রিক্সা। স্টেশনটি অতি নগণ্য, কিছুই নেই বলতে গেলে, প্রায় কেউ নাম জানে না। কাছাকাছি দুটো কারখানা আছে বলে এখানে দু’একটা ট্রেন থামে। সাইকেল রিক্সায় মিনিট পনেরো গেলে হাইওয়ে। এ রাস্তায় বাস চলে না। তবে ট্রাকগুলোকে হাত দেখালে থামে, দু’পাঁচ টাকা দিলে কিছু দূর নিয়ে যায়।
প্রায় এগারো মাইল দূরে একটা ছোট জঙ্গলমাখা টিলার পাদদেশে আমি নেমে পড়লুম ট্রাক থেকে। ছ’টাকা ও তিনটি সিগারেট খরচ হয়েছে।
এবারে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটা পথ। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন দিন, গরম নেই বলতে গেলে, এরকম সময়ে হাঁটতে ভালো লাগে। আমার কাঁধে শুধু একটা ঝোলা কাপড়ের ব্যাগ। এগুলোকে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ বলে। এক সময় বহুরূপী–দলের ‘পথিক’ নামের একটা নাটক বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে সেই নাটকটি সিনেমা ও হয়। তাতে শম্ভু মিত্রকে সব সময় কাঁধে এইরকম একটা ব্যাগ নিয়ে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। তখন এর নাম হয়ে যায় পথিক ব্যাগ। বেশ চালু হয়ে গিয়েছিল নামটা, কিন্তু বেশিদিন টেকেনি।
শান্তিনিকেতন নয়, আমি এই ব্যাগটা কিনেছিলুম রাজারহাট–বিষ্ণুপুর থেকে। ব্যাগ থেকে একটা বাঁশি বার করে ফুঁ দিলুম।
আমি বাঁশি বাজাতে পারি না। আমার এক মামা বাঁশি বাজাতেন এবং তিনি টি বি–তে মারা গিয়েছিলেন। সে বহুকাল আগেকার কথা। বোধহয় আমার জন্মের আগের। কিন্তু সেই থেকে আমার বাড়ির লোকদের ধারণা, বাঁশি বাজালে যক্ষ্মা হয়।
বাড়িতে তো বাজাতে পারি না, তাই দিকশূন্যপুরে যাওয়ার এই জঙ্গলের রাস্তাটায় আমি বাঁশি প্র্যাকটিস করি। বেসুরো হলেও এখানে তো ভুল ধরবার কেউ নেই।
আগেরবার এই পথে একটা সাপ দেখতে পেয়েছিলুম। কোটা কী জাতের সাপ আমি চিনি না। সাপ দেখলেই আমার গা শিরশির করে। ভেবেছিলুম আমার বাঁশি শুনেই আকৃষ্ট হয়ে সে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভয়ে হাত পা কাঁপলেও আমি বাঁশি বাজাতে বাজাতেই দ্রুত পার হয়ে গেছি সে জায়গাটা।
পরে অবশ্য বই পড়ে জেনেছি যে বাঁশির সুর শুনে সাপেদের মুগ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা একেবারে গাঁজাখুরি। সাপেদের নাকি কান নামের বস্তুটাই নেই। সাপুড়েরা বাঁশি বাজাবার সময় দু’দিকে হাত নাড়ে, সেই দেখে দেখে সাপ মাথা দোলায়। অর্থাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা লাইন ঈষৎ বদলে নিয়ে বলা যায়, “তারে কানে শুনিনি, শুধু বাঁশি দেখেছি!”
চতুর্দিকে তন্নতন্ন চোখে চেয়ে চেয়ে হাঁটছি। এই জঙ্গলে ময়ূরও আছে শুনেছি। এবারে একটা ময়ূর দেখতে পেলে মন্দ হয় না। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো আকাশ। শাল, সেগুন আর আকাশমণি গাছই বেশি। যে– দিকটায় শাল সেদিকটা বেশ পরিষ্কার তকতকে, সেগুনের বড় বড় পাতার জন্য সেদিকটা ভিজে ভিজে আলো–ছায়াময়। কিছু কিছু গাছ চিনি না। এ জঙ্গলে এখনো কাঠ–চোরদের উপদ্রব শুরু হয়নি।
পথ সংক্ষেপ করবার জন্য একটা টিলার ওপর উঠতে হয়। কাছাকাছি অন্যান্য টিলার মধ্যে থেকে এই বিশেষ টিলাটি আমি চিনে রেখেছি একটি শিমূল গাছ দিয়ে। বনস্পতির মতন তার মাথা সব গাছ ছাড়িয়ে। তার গুঁড়িতে কে যেন কবে একটা আধ–ফালি চাঁদ এঁকে রেখেছে।
কঠিন গ্রানাইট নয়, ঝুরো ঝুরো লাল পাথরের সেই টিলাটির ওপর উঠে আসতে দেরি লাগে না। তখনই চোখে পড়ে দিকশূন্যপূর। গাছপালার ফাঁকে–ফাঁকে ছোট ছোট বাড়ি। চোখ জুড়িয়ে গেলেও বুকটা আকুলি বিকুলি করে, মনে হয় আর দেরি করতে পারছি না, পাখির মতন উড়ে যাই।
কোনো অপ্সরীর ভুল করে ফেলে যাওয়া অলংকারের মতন নিঃশব্দে পড়ে আছে নদীটা, ওর নামও চন্দ্রহার। এই বর্ষায় কিছুটা জল হয়েছে। নদী কি তার গর্ভের নাম না জলের নাম? সুবর্ণরেখায় যখন একটুও জল থাকে না, তখনও তো তার নাম সুবর্ণরেখা।
টিলার এদিকটা বড় খাড়াই, পা টিপে টিপে নামতে হয়। কাঁটা ঝোপ। কয়েক রকম ক্যাকটাসও আছে এখানে, কিন্তু একটাতেও ফুল ফোটেনি। কোনো একটা ঝোপের মধ্যে সরসর শব্দ হতেই থমকে দাঁড়ালুম। বাঁশি আগেই ব্যাগে ভরে রেখেছি, সেই সাপটা নাকি?
সাপ নয়, একটা ধূসর রঙের বেজি। তার গায়ে সিল্কের মসৃণতা। তার শরীর বিভঙ্গ যেন চিত্রার্পিত – গতি।
ঝোপ থেকে বেরিয়ে বেজিটা আমার দিকে ফিরে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
আমি কুর্নিশ জানিয়ে বললুম, ওহে, নকুল, তুমি কি দ্বাররক্ষী? আমি পরিচিত মানুষ, আমায় যেতে দাও!
বেজিটি তবু নড়ে না। মনে হয় যেন সে আমার কাছ থেকে পাস ওয়ার্ড বা মন্ত্রগুপ্তি শুনতে চায়।
আমি গলা ফুলিয়ে, ভাবগম্ভীর স্বর আনার চেষ্টা করে বললুম, স্বস্তি ন ইন্দ্ৰো বৃদ্ধশ্রবাঃ স্বস্তি নঃ পূষা বিশ্ববেদাঃ…।
ঠিক শূন্যে উড়ে যাবার ভঙ্গি করে বেজিটা স্যাৎ করে মিলিয়ে গেল পাশের ঝোপে। এমন মনে করা যেতে পারে যে আমার কথা শুনেই সে পথ ছেড়ে দিল। যা তা কথা তো বলিনি, একেবারে বেদবাক্য ঝেড়ে দিয়েছি!
বেজির বদলে ময়ূরের দেখা পেলে ভালো হতো, ময়ূর সম্পর্কে আমার ভালো ভালো কবিতা ও গানের লাইন জানা ছিল। বেচারা বেজিকে নিয়ে কবি–টবিরা তো দূরে থাক, মুনি–ঋষিরাও বোধহয় কিছু লেখেননি।
আগেরবার চন্দ্রহার নদী হেঁটেই পার হয়েছি, এবারে মনে হলো বেশ জল। আশা করেছিলুম, নদীর ওপারে কারুকে দেখতে পাব। ছবি আঁকার জন্য বসন্ত রাও তো প্রতিদিনই নদীর ধারে আসে। কিন্তু আজকের এত বেশি সাদা রোদ বোধহয় ছবি আঁকার পক্ষে প্রশস্ত নয়।
একটা কাজ করা যেতে পারে। পাজামা–পাঞ্জাবি খুলে ব্যাগে ভরে, সেই ব্যাগটা এক হাতে উঁচু করে, অন্য হাতে সাঁতরে পার হবার তো অসুবিধে কিছু নেই। ছেলেবেলায় এ রকম অনেকবার করেছি। নগ্নতার জন্য লজ্জা পাবারও কারণ নেই, কেউ দেখছে না। অবশ্য আকাশ দেখবে, পাহাড়–জঙ্গল–নদী ও বাতাস দেখবে, কিন্তু জামাকাপড় পরা মানুষ তো ওরা দেখছে এই সেদিন থেকে, মাত্র চার–পাঁচ হাজার বছর।
আঃ, কী ঠাণ্ডা, নির্মল জল। সারা শরীরে যেন মোহময় আদর অনুভব করলুম। কোমর থেকে বুক জল এলো, এখনো হেঁটে যেতে পারছি, পাহাড়ী নদী তাই কাদা নেই, রুপোলি জলের স্রোতের মধ্যে ছোট ছোট মাছ।
ঠাণ্ডা জলের মধ্যে নামলেই হিসি পেয়ে যায়। গঙ্গায় নাইতে নেমে আমি কতবার হিসি করেছি, কিন্তু আমার এই প্রিয় ছোট নদীটিকে আমি অপবিত্র করব না। বুক জল ছাড়াল না বলে সাঁতার কাটতে হলো না, তবু আমি ডুব দিয়ে মাথা ভেজালুম।
অন্য পারে উঠে গা মাথা মুছে নেবার পর একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললুম আমি দিকশূন্যপুরে পৌঁছে গেছি। এখানে আসবার অন্য আরো রাস্তা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার এই পথটাই পছন্দ।
পৌঁছে যখন গেছি, তখন আর তাড়া নেই। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধীরে সুস্থে এগোনো যায়।
নদীর এপাশটায় এবড়ো খেবড়ো উঁচু পাথরের প্রাচীরের মতন হয়ে আছে। মাঝখানে মাঝখানে সুঁড়িপথ। একটা বড় পাথরের চাঙে কেউ ছেনি মেরে মেরে একটি বিরাট মানুষের মূর্তির আদল গড়েছে। প্রথমটায় চমকে উঠলুম, আমারই মূর্তি নাকি? তারপর ভালো করে দেখলুম, না, এর মুখে রয়েছে সামান্য দাড়ি এবং তলোয়ারের রেখা।
পাথরের দেওয়াল পার হবার পর চোখে পড়ল একটা হলুদ সর্ষের ক্ষেত। এটাও যেন একটা আঁকা ছবি। কারণ ক্ষেতটি চতুষ্কোণ বা গোল নয়, বিশাল ক্যানভাসে জল রঙে আঁকা নদীর মতন। আগেরবার আমি এখানে সর্ষের ক্ষেত দেখিনি।
সেটাকে পাশ কাটিয়ে একটি তরুণ শাল জঙ্গলের মধ্যে ঢোকবার পর চোখে পড়ল প্রথম বাড়িটি। টালির ছাদ দেওয়া বাংলো। সামনের চাতালে একটি টিউবওয়েল।’সেই টিউবওয়েলের জল দিয়ে একটি গরুকে স্নান করাচ্ছেন শর্টস ও গেঞ্জি পরা একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। খুব যত্ন করে তিনি গোরুটির গা ঘষে দিচ্ছেন।
আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ডাকলুম, তপনদা!
তিনি চমকে মুখ তুললেন, তারপরই খুশির হাসি ছড়িয়ে গেল সেই মুখে তিনি বললেন, নীলু? এসো, এসো! কখন এলে?
আমি বললুম, ভালো আছেন, তপনদা? আমি এই মাত্র পৌঁছেছি। পরে আসব।
–এসো না। একটু বসে যাও। অনেক কথা আছে।
—বিকেলে আসব তপনদা। আগে এক জায়গায় যেতে হবে।
–জানি কোথায় যাবে। ও বেলা ঠিক এসো কিন্তু!
খানিকটা এগুতেই দেখি একটা বড় মহুয়া গাছের নিচে তুলি ক্যানভাস নিয়ে বসন্ত রাও খুব গভীরভাবে মগ্ন। গাছতলাটায় ছায়া ছায়া। আলো আসছে উত্তর দিক থেকে।
নিঃশব্দে তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালুম।
এখনো এ ছবিতে কোনো মূর্তি আসেনি, বসন্ত রাও শুধু চাপিয়ে যাচ্ছেন রং। বোধহয় আমার সামান্য ছায়া পড়েছে, তাতেই মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।
—নীলু। হোয়াট আ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ। তুমি আমাদের জন্য বাইরের দেশের খবর এনেছ।
—কেমন আছ বসন্ত ভাই।
—খাসা আছি, উত্তম আছি, মনোরম আছি। তুমি কিছু কহানী শুনাও।
—পরে গল্প হবে। তুমি কিসের ছবি আঁকছ?
–কী জানি। আপনা আপনি যা গড়ে ওঠে। রং থেকে রেখা আসে। রেখা থেকে আয়তন। তারপর আসে স্বর্গ কিংবা নরক। মাঝখানের পৃথিবীটা সহজে আসতে চায় না। বাস্তবের জন্য ধেয়ান করতে হয়!
বাস্তবের জন্য ধেয়ান করতে হয় শুনে আমার মজা লাগল। চোখের সামনে যা দেখি, তাই–ই তো বাস্তব। চোখ বুজে ধ্যান করতে হয় তো অতীন্দ্রিয় কিছুর জন্য। কিন্তু বসন্ত রাও না বুঝে–সুঝে কিছু বলেন না। শিল্পীদের কথা বোঝা শক্ত।
বসন্ত রাও মধ্যপ্রদেশের মানুষ, কোথায় বাংলা শিখেছেন কে জানে। কিন্তু ওঁর ভাষা বড় মিষ্টি। টানা টানা চোখ দুটি সব সময় সজল মনে হয়।
দু’জনে কথা বলছি, এমন সময় একটা প্রজাপতি উড়তে উড়তে এসে ক্যানভাসের ওপরে বসল।
আমি হেসে বললুম, দ্যাখো দ্যাখো বসন্ত ভাই, তোমার ছবির ওপর একটা বাস্তব নিজে থেকে চলে এসেছে। তোমার ছবিতে ওর দাবি আছে।
বসন্ত রায় ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ। তারপর এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রজাপতিটির দিকে।
প্রজাপতিটি চঞ্চল ভাবে কয়েকবার ডানা খুলল, বন্ধ করল, তারপর পরিপূর্ণ ভাবে মেলে স্থির হলো।
বসন্ত রাও ফিসফিস করে বলল, এই পতঙ্গটাকে দ্যাখো। একটা উড়ন্ত পোকা, মাত্র দু’চারদিনের জীবন, অথচ কী সুন্দর, কী নরম, কত নিখুঁত বর্ণমালা, কত যত্ন নিয়ে আঁকা, কোনো ভুল নেই। একে এমন সুচারু নিখুঁতি করে কে বানাল নীলু?
আমি মুচকি হেসে বললুম, তোমাদের মধ্যপ্রদেশে তার নাম ভগবান। আমরা বাংলায় বলি প্রকৃতি।
–কেন রে ব্যাটা, আমাদের মধ্যপ্রদেশের বুঝি প্রকৃতি নেই? না ঠাট্রা নয়, নীলু, এত পলকা একটা প্রাণী, কত ক্ষণস্থায়ী তবু এত সুন্দর কেন? সুন্দর কি এত অপ্রয়োজনীয়?
—ফুলও তো একদিন দু’দিনে ঝরে যায়। একটা গোলাপ যখন কুঁড়ি থেকে ফুল হয়, তখন সেটা বিস্ময়কর নির্মাণ মনে হয় না? অথচ মোটে দু’একদিনের মামলা!
–হাঁ, এ নিবন্ধে কথা আছে। আমি অনেক ভেবেছি। আমরা ফুল দেখে মুগ্ধ হই, ছবি আঁকি, কবিতা লিখি, ফুলের গান গাই, কিন্তু কোনো ফুলই তা জানে না। ফুল কখনো মানুষের জন্য সাজে না, মানুষকে তোয়াক্কাই করে না। ফুল যে এত রং মেখে সুন্দরী হয় তা এই সব পতঙ্গ–কীট, পোকামাকড়ের জন্য।
—সেটা সত্যি কথা। এই সব পোকামাকড়রা কি রং চেনে? ছবি বোঝে?
– আলবাৎ বোঝে। তুমি ভাবো, এক জায়গায় যদি দশ–বারো রকমের ফুল ফুটে থাকে, সেটা আসলে কী? একটা জীয়ন্ত ছবির একজিবিশান নয়? এই সব পোকামাকড়রা ধেয়ে আসে সেই প্রদর্শনী দেখতে, ঘুরে ঘুরে বিচার করে, তারপর যার যেটি পছন্দ তার মুখে চুমা দেয়। সব ফুল এত সাজসজ্জা করে শুধু কোনো প্রেমিকের মন পাবার জন্য, এই সব প্রেমিক। মানুষ নয়, মানুষ তো ফুলকে গর্ভবতী করতে পারবে না। হায় হায়, নীলু, সব মানুষই ফুলের কাছে উপেক্ষিত, অনাদৃত, ব্যর্থ প্রেমিক!
দূরে একটা ছায়া দেখে আমি চোখ তুলে তাকালুম।
কালো শাড়ি পরা একজন রমণী একা একা হেঁটে আসছে এই দিকে। তার গায়ের রং গৌর, কালো শাড়িটির জন্য আরো ফর্সা দেখায়। মাথায় চুল খোলা, খালি পা।
এই রমণীকে আমি আগে দেখিনি।
সেই কৃষ্ণবসনা এদিকে আমাদের দিকে চেয়ে আসতে আসতে হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়াল। তারপর পাশ ফিরে তাকাল একটা সোনাঝুরি গাছের দিকে।
আমি বসন্ত রাও–কে জিজ্ঞেস করলুম, ইনি কে?
বসন্ত রাও মুখ তুলে বলল, জানি না। এক–দু’ হপ্তা হলো এসেছেন, কেউ এখনো এর নামটি পর্যন্ত জানে না। ইনি কথা বলেন না। কিন্তু বোবা নন, মাঝে মাঝে গলায় সুর শোনা যায়, সেই সুরে কোনো ভাষা নেই।
—উনি এই জায়গার সন্ধান পেলেন কী করে?
—কী জানি! আমরা প্রাইভেটলি ওঁর নাম দিয়েছি আকুলা রাই।
—সব সময় কালো পোশাক পরেন?
—হ্যাঁ। শোনো, নীলু, তুমি ওঁর সঙ্গে কিন্তু যেচে কথা বলতে যেও না। আমাদের এখানকার নিয়ম জান তো? কেউ নিজে থেকে পরিচয় না দিলে আমরা জিজ্ঞাসিত হতে পছন্দ করি না। বাতাস, জল, আকাশের মতন স্বাভাবিক বলে মেনে নিই।
প্রজাপতিটা উড়ে গেছে। আমি বললুম, আবার পরে দেখা হবে বসন্ত ভাই। কৃষ্ণবসনা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার পাশ দিয়েই আমাকে যেতে হবে। বসন্ত রাও তাকিয়ে রইল আমার যাওয়ার পথের দিকে। আমি নিয়মভঙ্গ করি কিনা দেখবার জন্য। আমি দেবর লক্ষ্মণের মতন শুধু মহিলার পা দুটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলুম। ওর পায়ে ফাটা দাগ নেই, এমনিই সাধারণ যত্নে রাখা মেয়েদের পা, পায়েল বা অন্য কোনো অলঙ্কারও নেই, তবু কেন যেন আমার মনে হলো, এই নারী আগে চিত্রতারকা ছিল!
অন্য বাড়িগুলোর কাছাকাছি কোনো মানুষজন আর দেখতে পেলুম না। না দেখাই ভালো, এখন আর থামা যেত না। আমার বেশ খিদে পেয়েছে।
একটা ছোট্ট টিলার গায়ে কয়েকটি বাড়ি। আমাকে পৌঁছতে হবে একেবারে টঙে।
প্রথম বাড়িটির সামনে একটা বেশ বড় কুয়ো। উঁচু করে পাড় বাঁধানো। ভারি সুস্বাদু জল। এখান থেকেই অনেকে জল নিতে আসে। এখন কেউ নেই।
কুয়োটা পেরিয়ে আমি চলে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ মনে পড়ল আমি নিয়মভঙ্গ করছি।
কুয়োর ধারে দুটি লাল টুকটুকে পলিথিনের বালতি রয়েছে, খালি। এখানকার প্রথা হচ্ছে, পথ–চলতি কেউ ওরকম খালি বালতি দেখলে ভরে দিয়ে যাবে। কারুর তো জল তোলার অসুবিধে থাকতে পারে।
ফিরে এসে আমি দড়ি–বাঁধা বালতি নামিয়ে দিলুম কুয়োর জলে। যে ছোট বালতি ফেলে জল তোলা হয়, সেটার আলাদা একটা নাম থাকা উচিত। যে হাতি দিয়ে অন্য হাতি ধরা হয় তার যেমন নিজস্ব নাম আছে। আমি এই বালতিটার নাম দিলুম ডুবুরি। ওরে, ডুবুরিটা কোথায় গেল? এই যাঃ, ডুবুরিটা দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেল! ডুবুরি তোলবার জন্য এবার ডুবুরি ডাকতে হবে!
প্রথমে ঠাণ্ডা জলে আমি মুখ হাত ধুয়ে নিলুম। একটু তেষ্টা থাকলেও পান করলুম না, এই জল সাঙ্ঘাতিক হমি, এখন আমার খালি পেট, নাড়ি–ভুঁড়ি হজম করে দিতে পরে।
দুটি লাল বালতি ভরা হতেই পাশের বাড়ি থেকে এক বৃদ্ধ আস্তে আস্তে হেঁটে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। মাথার চুল সব সাদা। পরনে সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি, হাতে একটি ছড়ি। এঁকেও আমি আগে দেখিনি।
বৃদ্ধটি ধীর স্বরে বললেন, দু’দিন জ্বর হয়েছিল, আমার হাতের জোর কমে গেছে।
আমি বললুম, নমস্কার। আমার নাম নীললোহিত। আমি আজই এখানে এসে পৌঁছেচি।
বৃদ্ধ হাত তুলে বললেন, শুভমস্তু।
এই ধরনের আশীর্বাদ পাওয়ার অভ্যেস নেই আমার। এখানেও আগে শুনিনি। এর উত্তরে কী বলতে হয় আমি জানি না।
বৃদ্ধ বললেন, তুমি বালতি দুটো আমার বাড়ির মধ্যে পৌঁছে দেবে?
আমি বললুম, নিশ্চয়ই।
সদর দরজা পেরিয়ে একটা ছোট উঠোন, তার এক পাশে রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরের সামনে আমি বালতি দুটি নামিয়ে রাখলুম। বৃদ্ধ আমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন, তিনি বারান্দায় একটি চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসো।
আমি বললুম, এখন নয়, পরে এক সময় আসব।
উনি আবার বললেন, বসো। একটু বসো।
এবারে আমি বিনীত দৃঢ়তার সঙ্গে বললুম, মাপ করবেন, এখন আমার বসার নিষেধ আছে।
বৃদ্ধ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মূহূর্ত। তারপর রান্নাঘরের কাছে গিয়ে পা দিয়ে জলের বালতি দুটো উল্টে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, যাও!
এই বুড়োটা ক্ষ্যাপা নাকি? আমার হাসি পেয়ে গেল।
আমি বললুম, আপনি রাগ করলেন, কিন্তু সত্যি আমার এখন বসার উপায় নেই।
বৃদ্ধ ছড়ি তুলে হুকুমের সুরে বললেন, যাও!
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, আমি পিঠ ঘোরালাম। বালতি বয়ে দিয়েছি বলে উনি বোধহয় বিনিময়ে আমাকে কিছু খেতে–টেতে দিতে চাইছিলেন। কিংবা একাকিত্ব অসহ্য লাগছে, তাই খুঁজছিলেন একজন কথা বলার সঙ্গী। কিন্তু সঙ্গী নির্বাচনে ওঁর ভুল হয়েছে।
এই ভর–দুপুরে মুরগি ডেকে উঠল যেন কোন্ বাড়িতে।
আমি টিলার গা দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে উপরে উঠতে লাগলুম। আগের দিন বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই কোথাও রুক্ষতা নেই।
কালো শাড়ি পরা মহিলাটির পা–দুখানির কথা মনে পড়ছে। আমি ওর মুখ ভালো করে দেখিনি। দিনের বেলা চড়া রোদের মধ্যে ঐ রকম মিশমিশে কালো শাড়ি পরে ঘুরতে আমি আগে কখনো দেখিনি। কী রকম যেন অপ্রাকৃত লাগে। মনে হয় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে।
একেবারে পৌঁছলুম বাড়িটার পেছন দিকে। এটাও দু’খানা ঘরের বাড়ি, টালির ঢালু ছাদ। কোনো জানলাতেই পর্দা নেই। এখানে সূর্য ছাড়া আর কেউ জানলা দিয়ে উঁকি মারে না।
ছাদের ওপর একটা শঙ্খচিল চুপ করে বসে আছে। তার ঠোটেরই মতন তার দৃষ্টি। যেন সে এই বাড়ির পাহারাদার। চিলের মতন এত সুন্দর শরীর– সৌষ্ঠব আর খুব কম পাখিরই আছে, কিন্তু বেচারাদের গলায় আওয়াজটা বড় দুর্বল।
ঘুরে এলুম সামনের দিকে। একটা ছোট মতন বাগান। এক পাশে ফুল। অন্য পাশে কিছু না কিছু তরকারির চাষ হয়। গতবারে দেখে গিয়েছিলুম পেঁয়াজকলি, এবারে দেখছি বেগুনের খেত। বেশ নধর বেগুনি রঙের বেগুন ফলেছে। বন্দনাদি একটা ঝারি নিয়ে জল দিচ্ছে সেই ক্ষেতে।
কলকাতা ছাড়বার পর বন্দনাদিকে আমি শাড়ি পরতে দেখিনি। তার পোশাক অনেকটা বেদেনীদের মতন, এই পোশাক বন্দনাদি নিজেই তৈরি করে নেয়। কোমরের নিচে একটা ঘাগরা, মনে হয় যেন গাছের পাতা শেলাই করা। ওপরে একটা টাইট জামা, হাত–কাটা, চার পাশে লেশ বসানো। মাথায় একটা লাল রঙের ফেট্টি।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে বন্দনাদিকে দেখতে লাগলুম।
কিন্তু পুরুষ মানুষদের উপস্থিতির একটা উত্তাপ আছে। মেয়েরা ঠিক টের পেয়ে যায়। হঠাৎ পেছন ফিরে বন্দনাদি বলল, কে?
আমায় দেখে মোটেই অবাক হলো না। ভুরু তুলে বলল, নীলু? আমি ঠিক জানতুম, তুই দু’একদিনের মধ্যে আসবি।
বাগানে ঢুকে এসে আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুমি আমায় ডেকেছ, তাই না?
হাতের ঝারিটা নামিয়ে রেখে বন্দনাদি আকাশের দিকে তাকাল। তারপর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, আজকের দিনটা খুব সুন্দর।
এতক্ষণে আমার দিকশূন্যপুরে ঠিকঠাক পৌঁছনো হলো।