নিরুদ্দেশের দেশে – ১১

১১

কী করে এখানে সব ব্যবস্থা হয়ে যায় জানি না। দুপুরবেলা আমাকে বন্দনাদির বাড়িতে বসিয়ে রেখে ওরা সবাই চলে গেল আমার জন্য বাড়ি সাজাতে। জঙ্গলের ধারে একটা খালি বাড়ি আমি আগেই দেখেছি।

শুয়ে রইলুম একলা একলা। মনটা খুব হালকা লাগছে। এ পর্যন্ত জীবনে কোনো ব্যাপারেই গুরুতর কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। জীবনটা যেমন চলছে চলুক, এইভাবেই দিন কাটিয়ে এসেছি। কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, কোনো কিছুই নিজের করে পেতে চাইনি। তবে আমার কখনো কোনো কিছুর অভাবও হয় না। না পাওয়ার দুঃখ কাকে বলে এ জীবনে সেটাই বুঝলাম না।

এবারে আমার একটা নিজস্ব বাড়ি হবে। কী সুন্দর ব্যাপার, এখন থেকে আমি নিজের খাদ্য নিজেই উৎপন্ন করব। এখানে কোনো অতীত নেই। শুধু ভবিষ্যৎ। গোটা মানবসভ্যতা, যার মাথার ওপর ঝুলছে অ্যাটম বম, তার দিকে কাঁচকলা দেখিয়ে বলব, যাও, যাও, তোমাকে গ্রাহ্য করি না।

কাল রাতে ভালো ঘুম আসেনি, ভাবলুম এই সময়টা খানিকটা ঘুমিয়ে নেব, কিন্তু ঘুম আসে না। শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতন একটা উত্তেজনা রয়ে গেছে টের পাচ্ছি।

বিছানা মানেই বই। এমন কক্ষনো হয়নি যে আমি একা জেগে আছি অথচ কোনো বই পড়ছি না। এখানেও আমার ঝোলাতে দুটি বই আছে, কিন্তু উঠে গিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে না। বই ছাড়া শুয়ে থাকা, এ এক অভিনব ব্যাপার, একটা দারুণ মুক্তি।

বেগুন খেতে দুটি বুলবুলি পাখি এসে বসেছে। ডাকছে তেজি গলায়। দরজার কাছে মুখ বাড়িয়ে পাখি দুটোকে দেখতে লাগলুম। ছেলেবেলায়, তখন আমার দশ–এগারো বছর বয়েস, গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একটা বুলবুলি পাখির বাসা আবিষ্কার করেছিলুম, দুটি নীলচে ডিম চুরি করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল হাত থেকে। সে ঘটনাটা তখন মনে বিশেষ দাগ না কাটলেও ঘটনাটা ভুলিনি। কোথাও বুলবুলির ডাক শুনলেই মনে পড়ে যায়। কী নিদারুণ অপচয়। এই পৃথিবীর বাতাস দুটি বুলবুলি পাখির ডাক থেকে বঞ্চিত হলো। কোনো উপায়ে কি এটা শোধ দেওয়া যায়?

বুলবুলি দুটো আমার দিকে পেছন ফিরে ল্যাজ দোলাচ্ছে। ওরা কি আমার পরিচয় জানে?

বাইরে পায়ের শব্দ হচ্ছে। পাখির ডাক থেমে গেল। বন্দনাদিরা ফিরে এলো এত তাড়াতাড়ি?

একটি অচেনা মেয়ে বারান্দা দিয়ে উঠে এসে দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল। বোধহয় সে ঘরেই ঢুকে আসত, আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে।

মেয়েটির বয়েস তেইশ–চব্বিশের বেশি নয়, গায়ের রং পদ্মপাতার মতন, মাথার চুল খোলা, ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর, কপালে একটা হলুদ টিপ, সে পরেও আছে একটা হলুদ রঙের শাড়ি। দুহাত দিয়ে সে একটা খরগোশ ধরে আছে বুকের কাছে। খরগোশটার চোখদুটো লাল বোতামের মতন আর কানদুটো বাঁকুড়ার ঘোড়ার মতন লম্বা।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললুম, বন্দনাদি একটু বাইরে গেছে। খানিকটা বাদে ফিরবেন। আমার নাম নীললোহিত।

মেয়েটির চোখদুটি মনে হয় কাজলটানা। নাকটা চাপা। মনে হলো যেন সে আমার সঙ্গে কথা বলতে দ্বিধা করছে। এদিক ওদিক তাকাল, কান পেতে যেন শোনার চেষ্টা করল, বাড়িতে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা

তারপর সে বলল, এই খরগোশটা নিয়ে কী করি?

আশ্চর্য প্রশ্ন! একজন অপরিচিত মানুষের কাছে এরকম একটা বাক্য প্রথমে বলার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি এই খরগোশটা চেয়েছিল বুঝি?

মেয়েটি দুদিকে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, কাল রাত্তিরে বাগানে এসেছিল। ভালো করে দৌড়াতে পারে না।

মেয়েটি বোধহয় ঈষৎ তোতলা। থেমে থেমে কথা বলে। আমি পুরুষদের মধ্যে তোতলা আগে অনেক দেখেছি, কিন্তু মেয়ে–তোতলা তো কখনো দেখিনি। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি দ্রুত কথা বলে। শুনেছি, জন্মের পর ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা আগে কথা বলতে শেখে।

—এটা বুনো খরগোশ? তুমি ধরেছ?

—হ্যাঁ, আমি ধরেছি। আমার নাম, পিউ।

আমার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। একটু আগেই আমি বুলবুলি পাখির কথা ভাবছিলুম, তার পরেই পাখির নামে একটি তরুণী এসে উপস্থিত হলো। পিউ কাঁহা পাখি হলদে রঙের হয় না? এই মেয়েটাও হলুদ শাড়ি পরে এসেছে।

– তুমি এই খরগোশটা পুষবে?

—না। আমি কিছু পুষি না।

–তাহলে ওকে ছেড়ে দাও।

–ও যে দৌড়তে পারে না! কোথায় যাবে?

খরগোশটা মেয়েটির বুকে ছটফট করতেই সে সেটাকে আর ধরে রাখতে পারল না। খরগোশটা মাটিতে পড়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল ঘরের এক কোণে।

মেয়েটি তার একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে করুণভাবে বলল, ও আমাকে একবার আঙুলে কামড়ে দিয়েছে। কিছু হবে?

খরগোশে কামড়ালে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় এরকম আমি শুনিনি। মানুষকে খরগোশে কামড়েছে এরকম কোনো ঘটনাই আমার কানে আসেনি।

মেয়েটির বাড়ানো হাতটি আলতো করে ধরে আঙুলটা দেখে ডাক্তারি কায়দায় বললুম, গাঁদাফুল গাছ আছে এখানে? ঐ গাছের পাতা নিঙড়ে রস লাগিয়ে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।

–আমি তো গাছ চিনি না!

আমি একটু চিন্তা করলুম। এখানে গাঁদাফুল গাছ দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বন্দনাদির ঘরের জানলা দিয়ে একটা গাছের ডাল উঁকি মারে। খুব সম্ভবত আতা গাছ। উঠে জানলার কাছে গিয়ে সেই গাছের কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে চিপড়ে বললুম, এটা লাগিয়ে দাও, এতেই কাজ হবে।

খরগোশটা ঘরের কোণে বসে জুলজুল করে দেখছে। ঘর থেকে পালাবার কোনো লক্ষণ নেই। আমি আর কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললুম, খা।

পিউ বলল, তুমি কে?

–ঐ যে বললুম, আমার নাম নীললোহিত। আমি নতুন এসেছি। গতকাল।

—তুমি এখানে থাকবে? বন্দনাদির সঙ্গে।

—না। আমি অন্য বাড়িতে থাকব। জঙ্গলের ধারে। তুমি একা থাক?

—হ্যাঁ। একা। আমার কেউ নেই।

–তুমি এখানে কবে এসেছ, পিউ!

সরাসরি এরকম প্রশ্ন করা উচিত নয়। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গেলে কিছু প্রশ্ন তো করতেই হবে।

পিউ জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, অনেকদিন। মনে নেই।

–তোমার এখানে থাকতে ভালো লাগে?

—হ্যাঁ। বোধহয়।

নাঃ, এ মেয়ের সঙ্গে আলাপ জমানো সত্যিই খুব মুশকিলের ব্যাপার। ভালো লাগে কিনা, সেটাও বোধহয়।

পিউ এ ঘর থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। দরজার কাছটা এখন খালি। তবু খরগোশটা যাচ্ছে না। থাকতে চায় তো থেকে যাক।

পিউ একটু বাদে ঘুরে এসে বলল, এই, তুমি চা বানাতে পার?

–হ্যাঁ, পারি।

—আমাকে চা খাওয়াবে?

তাও একটা কাজ পাওয়া গেল। রান্নাঘরে গিয়ে বসলুম, দুপুরের রান্নার পর আঁচ এখনো নিভে যায়নি, আর একটা কাঠ গুঁজে দিয়ে ফুঁ দিয়ে ধরিয়ে ফেললুম। তারপর সসপ্যানে জল বসিয়ে দিয়ে ভাবলুম, কাল থেকে তো সব নিজেকেই করতে হবে, ট্রেনিং হয়ে যাক।

পিউ রান্নাঘরে আসেনি। ও ঘরেই রয়ে গেছে। দু’কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসে দেখি সে মেঝেতে বসে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

—কী হলো?

পিউ কান্না থামিয়ে আঁচলে চোখ মুছল। তারপর বলল, কিছু না।

আমি তাকে চা–টা দিয়ে বললুম, এটা কিন্তু অন্যায়। আমি তোমাকে চা খাওয়াচ্ছি, আর তুমি আমার সঙ্গে কোনো কথাই বলবে না? তুমি কেন কাঁদছ সেটা বলো!

এবারে সে একটুখানি হাসল। তারপর বলল, সত্যি, কোনো কারণ নেই। বোধহয়, আমার বুকে, অনেকখানি কান্না, জমা হয়ে গেছে। তাই, মাঝে মাঝে, একটু একটু খরচ করতে হয়।

আমি বললুম, লোকে যেমন টাকাপয়সায় বড়লোক হয়, তুমি তেমনি কান্নায় বড়লোক। অনেক জমা আছে বুঝি?

–এই, তোমার, কান্না, জমা নেই?

– নাঃ, আমি গরিব, সব ব্যাপারেই গরিব! বারবার এই এই করছ কেন? আমার একটা নাম আছে বললুম যে?

—তিন–চারদিন, দেখা হলে, তারপর তো লোকে, নাম ধরে, ডাকে।

—আশা করি তোমার সঙ্গে আমার তিন চার দিনের বেশি দেখা হবে। চায়ের কাপটা দেখিয়ে পিউ বলল, ভালো। এটা ভালো হয়েছে। আমি, একদিন, শোধ দেব!

আমি হেসে বললুম, শোধ দিতে হবে না। বন্দনাদির চা, আমি তোমাকে খাওয়াচ্ছি।

চা–টা শেষ করার পর পিউ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই?

আমি ঘাড় নেড়ে বললুম, আচ্ছা।

পিউ খরগোশটার দিকে তাকাল, আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, তুমি ওকে দেখো।

বারান্দা থেকে নেমে, বেগুন খেত পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় গিয়ে সে একবার ফিরে তাকাল। তারপর এক ঝলক হাসল। একটু পরেই সে মিলিয়ে গেল টিলার ঢালু দিকটায়।

আমার কেমন যেন একটা অলৌকিক অনুভূতি হলো। হলুদ রঙের দুপুরবেলায় হলুদ শাড়ি পরা একটি মেয়ে এলো, তার বুকে একটা বুনো খরগোশ সে একটুখানি কাঁদল, এক কাপ চা খেল, তারপর আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। মাঝখানের ঘটনাটা কি সত্যি না আমি কল্পনা করলুম!

কিন্তু খরগোশটা রয়েছে, ও তো বাস্তব খরগোশ। শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়েটির ঐ হাসি ঠিক যেন একটা দুর্লভ পুরস্কারের মতন।

আমার ইচ্ছে করছিল; ও আর কিছুক্ষণ থাকুক। কিন্তু ও যখন চলে যেতে চাইল তখন ওকে কী বলে আটকাব তা মনে পড়ল না। খরগোশটাকে তুলে এনে আমি ছেড়ে দিলুম বারান্দায়। ওর স্বাধীনতা থাকা উচিত ঘরে কিংবা বাইরে থাকার ওর একটা পায়ে চোট আছে ঠিকই।

এতক্ষণ বেশ ছিলুম, ঐ মেয়েটি এসে চলে যাবার পর এখন একা একা লাগছে। আমার বাড়ি সাজাবার সময় আমার সেখানে থাকা উচিত নয় বলে বন্দনাদিরা আমাকে এখানে রেখে গেছে। ওদের কতক্ষণ লাগবে কে জানে? বাড়ি সাজাবার কী আছে? ঝড়–বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য একটা ছাদ থাকলেই তো হলো।

এক কাপ চা খেয়ে মেয়েটা বলে কিনা শোধ দেব! অদ্ভুত ভাষা! হয়তো মেয়েটি তোতলা নয়, ওর কথা বলার ধরনটাই একেবারে আলাদা।

বিকেল পর্যন্ত বারান্দাতেই ঠায় বসে বসে কাটিয়ে দিলুম। তারপর এক সময় এলো জয়দীপ। রাস্তা থেকেই হাতের ইশারা করে বলল, চলে এসো।

আমি আমার ঝোলাটা তুলে নিয়ে চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। নিজের বাড়ি বলে কথা! লোকে যখন বিয়ে করতে যায়, তখনো কি এরকম লাগে?

জয়দীপ আমার আপাদমস্তক একবার দেখল, কোনো মন্তব্য করল না। এর মধ্যেই জয়দীপের চরিত্রটা বোঝা হয়ে গেছে। ওর যখন ইচ্ছে হবে তখন কথা বলবে, ভদ্রতা–সৌজন্যের কোনো ধার ধারবে না। মন্দ নয় ব্যাপারটা।

টিলা থেকে নামার পর জয়দীপ যেন দয়া করে বলল, তোমার বাড়িটা সুন্দর হয়েছে, বেশ নিরিবিলি।

আমি চুপ করে রইলুম। জয়দীপকে দেখাতে হবে যে আমারও মুড আছে।

একটু দূর থেকেই দেখতে পেলুম আমার বাড়ির সামনে বেশ একটা ছোটখাটো ভিড়। কী ব্যাপার, এরা কত লোককে খবর দিয়েছে? ভাবতে ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল ‘আমার’ বাড়ি?

বাড়িটায় বেশ কিছুদিন কেউ বসবাস করেনি। সামনে আগাছা জন্মে গিয়েছিল। সেসব পরিষ্কার করা হয়েছে। দরজার চারপাশে ফুলের মালা, সামনে একটুখানি জায়গাতে আঁকা হয়েছে আলপনা। বন্দনাদি ঘুরে ঘুরে তদারকি করছে।

আমাকে দেখে প্রথমেই এক ধমক দিল, নীলু, তুই এখনো ঐ ছেঁড়া চটি দুটোর মায়া ছাড়তে পারিসনি? এখানে কেউ জুতো পরে না, দেখিসনি?

আমি লজ্জা পেয়ে চটি জোড়া খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলুম পাশের একটা ঝোপে তারপর জিজ্ঞেস করলুম, এবারে কী করতে হবে?

বন্দনাদি বলল, এবারে এখানে ছোটোখাটো একটা নাটক হবে। তাতে তোরই মেইন পার্ট, কিন্তু তোকে কোনো ডায়লগ আগে থেকে শিখিয়ে দেওয়া হবে না।

–সে কি?

-এতে আশ্চর্য হবার কী আছে? তোকে যা জিজ্ঞেস করা হবে, তুই তার উত্তর দিবি। যা মনে আসে, তাই–ই বলবি।

– প্রত্যেকের বেলাতেই এরকম হয় বুঝি?

—নতুন যারা আসে, তাদের প্রথমে চার্চে জায়গা দেওয়া হয়। অনেকেই খুব ক্লান্ত থাকে বা বিষণ্ণ থাকে। সেইজন্য সবার বেলা এই অনুষ্ঠান হয় না। তোর বেলায় স্পেশাল কেস! তোকে যে অনেকেই এখানে আগে থেকে চেনে।

রোহিলা বলল, নীললোহিতেকে একটু সাজিয়ে দিলে হয় না!

আমি বললুম, ভ্যাট, সাজাবে আবার কী?

রোহিলা বলল, জানো, আমার বেলায় কিছু হয়নি। দু’জন লোক আমাকে একটা বাড়ি দেখিয়ে দিল, আর বিড়বিড় করে কী সব উপদেশ দিল আর কিছু খাবার দিয়ে গেল। অবশ্য সেদিন আমার খুব মন খারাপ ছিল।

বন্দনাদি বলল, অনেকেই প্রথম দিন এখানে এসে খুব কাঁদে। যা নীলু, তুই এবারে ঐ আলপনার ওপরে গিয়ে দাঁড়া। তারপর সামনে যে দরজাটা বন্ধ দেখছিস, তাতে তিনবার টোকা মার। সেখান থেকেই নাটকের শুরু।

আমি চারপাশটা একবার দেখে নিলুম। যারা উপস্থিত হয়েছে তাদের মধ্যে প্রভাসদা, বসন্ত রাও আর ইসমাইল সাহেব ছাড়া আর কেউ চেনা নয়। বিজন আসেনি। বিজনকে কাল রাতের মিটিং–এ বা আজ সকালে নদীর ধারেও দেখিনি। পিউ নামের মেয়েটিকে তো আমি নিজেই নেমন্তন্ন করতে পারতুম!

আলপনার ওপর দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলুম তিনবার। সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল ভিতর থেকে। একজন দীর্ঘকায় বৃদ্ধ, মুখে ধপধপে সাদা দাড়ি, খুব সম্ভবত নকল দাড়ি, মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, কে?

আমি বললুম, আমি একজন পথিক। এখানে আশ্রয় নিতে এসেছি।

যদিও সন্ধে হয়নি, তবু বৃদ্ধের হাতে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি। সেটা বাড়িয়ে আমার মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, মশায়ের কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

–অনেক দেশ ঘুরতে ঘুরতে আসছি। সেসব জায়গার নাম মনে নেই। বন্দনাদিরা চটাপট শব্দে হাততালি দিল। বুঝলাম যে ডায়লগ ঠিক আছে। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল, আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে যেন। আগে কোথাও দেখেছি কি?

—চেনা তো মনে হতেই পারে। সব পথিকেরই চেহারা একরকম।

–এই মুখখানা যেন খুব চেনা। এই চোখদুটো…

– আপনার কেউ কোনোদিন হারিয়ে গিয়েছিল কি? তাহলে সে–ই আবার ফিরে এসেছে।

—ঠিক ঠিক। এসো, ভেতরে এসো!

ভেতরে পা বাড়াতে যাচ্ছি, বৃদ্ধ এক হাত তুলে বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু একটা কথা! তুমি অতিথি, তুমি আসাতে ধন্য হয়েছে। কিন্তু তোমায় আপ্যায়ন করব কী করে? আমি বুড়ো মানুষ, আমি তো রান্না করতে পারি না।

–আমি নিজেই রান্না করে নিতে পারব।

—সামান্য চাল–ডাল ছাড়া আর কিছু নেই।

—খিদে পেলে তা দিয়েই অমৃত বানানো যায়।

বৃদ্ধ হঠাৎ হেসে ফেললেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, ও বন্দনা, এ যে ভালো ভালো ডায়লগ দিচ্ছে। আমি এর সঙ্গে পারছি না।

বন্দনাদি বলল, ঠিক হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে।

বৃদ্ধ এবারে দরজার আড়াল থেকে প্রায় এক হাত লম্বা একটা লোহার চাবি তুলে নিল। তারপর নিজে বাইরে বেরিয়ে এসে সেই চাবিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ওগো অতিথি, এখন থেকে এই পুরো বাড়িটাই তোমার। এই নাও চাবি!

আমাকে এখন ডায়ালগের নেশায় পেয়ে বসেছে। আমি চাবিটা হাতে নিয়ে বললুম, বাঃ, এ তো খুব চমৎকার। বাড়ির দরজায় কোনো তালা নেই কিন্তু মস্ত বড় চাবি আছে!

বৃদ্ধ বললেন, শরীরের অনেকগুলো দরজা আছে, তার চাবি হলো মন। শরীরটা ছোট কিন্তু মন প্রকাণ্ড, তাই না?

কয়েকজন হাত তালি দিয়ে বলল, দারুণ, দারুণ!

একজন চেঁচিয়ে বলল, ও ভুলাভাই, তোমার কোনো অতিথি এসেছে নাকি?

বৃদ্ধ বলল, হ্যাঁ, এসো, আলাপ করিয়ে দিই।

একজন লোক এগিয়ে এলো, বৃদ্ধ আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, এর নাম সুন্দররাজন, প্রতিবেশী হিসেবে অতি সজ্জন।

আমি বললুম, নমস্কার, আমার নাম নীললোহিত।

সে আমার দিকে একটি কাচের শিশি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্বাগতম্! এটা নিন, যখন যা প্রয়োজন হবে, আমাদের বলবেন।

সেই শিশিতে রয়েছে চিনি। তারপর একজন দিল চারটে মুরগির ডিম। কেউ খানিকটা চাল, কেউ খানিকটা ডাল।

আমার মনটা উদ্বেল হয়ে উঠল। পৃথিবীতে কি কোনোকালে এরকম প্রথা ছিল? কবে থেকে লোপ পেয়ে গেল? যার বেশি আছে, সে তো এখন আর অন্যকে তার ভাগ দেয় না? হায় সভ্যতা!

সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হবার পর বৃদ্ধ টান মেরে তার দাড়ি খুলে ফেলে বলল, আমার নাম ভুলাভাই নয়, অরবিন্দ। নাটক এখানেই শেষ। তবে, এই জিনিসগুলো কেউ ফেরত নিয়ে যাবে না। নীললোহিত, এগুলো তোমার!

আমি বললুম, কিন্তু আমি কী করে এর প্রতিদান দেব?

অরবিন্দ বলল, সে যখন সময় আসবে, তুমি ঠিকই অন্যকে কিছু দেবে। ও নিয়ে চিন্তা করো না। এখানে এসে তুমি সব রকম চিন্তামুক্ত হও! আমাদের এখানে দু’চারটে নিয়মকানুন আছে, তা আমরা নিজেরাই ঠিক করেছি। সেসব বন্দনা তোমায় আস্তে আস্তে জানিয়ে দেবে, ব্যস্ততার কিছু নেই। আমরা এবার যাই?

আমাদের নিজস্ব দলটা ছাড়া আর সবাই চলে গেল। শুধু বন্দনাদির পাশে একজন অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাফ প্যান্ট পরা, খালি গা। সে আমার সঙ্গে পরিচয় করতেও আসেনি।

বন্দনাদি বলল, নীলু, এর নাম সূর্যকান্ত। আমরা শুধু সূরয বলি। ও সপ্তাহে একদিন কোনো কথা বলে না! আজ সেই–ই দিন। সেই জন্য তোর সঙ্গে আলাপ হলো না। কাল কথা হবে।

আমি লোকটিকে নমস্কার করতে করতে ভাবলুম, এ তো বড় তাজ্জব ব্যাপার। এখানে কেউ ঘড়ি ব্যবহার করে না। নিশ্চয়ই ক্যালেণ্ডারও নেই। এরা এখানে সপ্তাহ, মাসের হিসেব রাখে কী করে? এই লোকটি কী করে ঠিক করে যে কোনদিন তাকে মৌন থাকতে হবে? দেয়ালে দাগ কেটে রাখে নাকি?

লোকটির চোখে হাসির ঝিলিক দিচ্ছে। বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু উত্তর দেবার তো উপায় নেই!

বন্দনাদি বলল, চল, নীলু তোকে এবারে ভেতরটা দেখিয়ে দিই।

বাড়ির মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক ধুলো–ময়লা জমে ছিল, এখন একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ করা। আসবাবপত্র কিছুই নেই, শুধু একটি ঘরের দেয়ালে রয়েছে একটি আলমারি। আর একটি রয়েছে বহুকালের পুরোনো ঠাকুর্দা–মার্কা ইজিচেয়ার, সেটাকে ফেলে দিলেই ভালো হয়! রান্নাঘরে রয়েছে অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিসপত্র। একটি দেশলাই আর দুটো মোমবাতি। আর একটি মোমবাতি আধপোড়া ভুলাভাই ওরফে অরবিন্দ ফেলে গেছে। সেটি বোধহয় ফাউ।

বন্দনাদি বলল, এখানকার নিয়মকানুন তুই তো কিছু কিছু জানিস। বাকিগুলোও আস্তে আস্তে জেনে যাবি। এমন কিছু কড়াকড়ির ব্যাপার নেই। তবে, প্রথম দিনের নিয়মটা শুধু বলে দিই। এখানে যারা আসে, তাদের সাত দিন একা থাকতে হয়। একা মানে, সে নেহাৎ দরকার না পড়লে অন্য কারুর বাড়িতে যাবে না, অন্য বাড়িতে কিছুতেই রাত কাটাবে না। তোর যদি ভূতের ভয় থাকে, তাহলে কিন্তু তোকে কেউ তার বাড়িতেও আশ্রয় দেবে না! তোর এখানে যে–কেউ দেখা করতে আসতে পারে, কিন্তু প্রথম সাত দিন রাত্তিরবেলা কেউ তোর সঙ্গে থাকবে না। কোনো মেয়ে তো নয়ই, কোনো পুরুষও না। অর্থাৎ আমরা সবাই একটু বাদে চলে যাব।

মেজেতে বসে পড়ে বন্দনাদি বলল, ওঃ, আজ সারা দুপুর বড্ড খাটুনি গেছে! তবে আমার চেয়েও বেশি পরিশ্রম করেছে রোহিলা। এই মেয়েটা খাটতে পারে বটে!

রোহিলা বলল, কেন বন্দনাদি, জয়দীপ? ও সাহায্য না করলে এত তাড়াতাড়ি কিছুই হতো না। শুধু এই বসন্ত রাও গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়িয়েছে।

বসন্ত রাও দুষ্টু হেসে বলল, আমি যে শিল্পী! আমি বেশি কাজ করি না। বেশি কাজ করলে আমার আঙুল নষ্ট হয়ে যাবে!

বন্দনাদি বলল, ফাঁকিবাজের কুযুক্তি! আর জয়দীপকে দেখো, আবার গোমড়ামুখো হয়ে আছে। গত এক ঘণ্টাতে ও একটাও শব্দ উচ্চারণ করেনি। ওর এই রোগটা কিছুতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না। এই জয়দীপ, তুমি কি ভাবছ অত?

জয়দীপ বন্দনাদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার কথাই ভাবছি, বন্দনা!

—তাই নাকি? আমার কী সৌভাগ্য!

–বন্দনা, আজ বুঝতে পারলুম, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি! আজ সকালে নদীতে দাঁড়িয়ে টাক–মাথাওয়ালা লোকটা যখন তোমার প্রতি খারাপ সুরে কথা বলছিল, তখন হঠাৎ আমার রক্ত জ্বলে উঠেছিল, মনে হয়েছিল, লোকটাকে মারি। খুব জোরে আঘাত করি। অথচ, তুমি তো জানো বন্দনা, আমি সামান্য পোকামাকড়ও মারতে পারি না, কষ্ট হয়। কিন্তু তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য আজ একটা বে–আদপ মানুষকে মারতে ইচ্ছে হয়েছিল।

বন্দনাদি আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম অনুযোগের সুরে বলল, দেখলে, দেখলে, তোমরা দেখলে! এরকম একটা কথা আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি করে বলা উচিত ছিল না ওর? ভালোবাসার কথা কেউ এত লোকের সামনে কাঠখোট্টা সুরে বলে?

জয়দীপ বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, কেন, একথা আড়ালে বলতে হবে কেন?

আমরা সবাই হো–হো করে হেসে উঠলুম। রোহিলা ছাড়া। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।

বন্দনাদি জয়দীপকে জিজ্ঞেস করলে, তুমি লোকটিকে টানতে টানতে নিয়ে গেলে, সত্যি ওকে মারোনি তো?

জয়দীপ বলল, না, মারিনি। মারার ইচ্ছে হয়েছিল।

বন্দনাদি বলল, ঐ লোকটি আমাকে কিছু অপমান করেনি, ও খারাপ ব্যবহার করেছে রোহিলার সঙ্গে। আমি লোকটির কথা অরবিন্দ আর ইসমাইল সাহেবকে বলেছি। ওরা খোঁজখবর নেবে! জয়দীপ, তুমি সত্যিই আজ আমাদের খুব সাহায্য করেছ।

বসন্ত রাও বলল, বন্দনা, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আজ জয়দীপ এক স্টেপ এগিয়ে গেল। মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে আমি কম্‌পিটিশনে পারব না। তাহলে আমি এখন থেকে আমার ভালোবাসা রোহিলার ওপরেই ন্যস্ত করি।

রোহিলার পিঠে হাত দিয়ে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে বসন্ত রাও বলল, কী রোহিলা, তুমি আমার ভালোবাসা নেবে? আমার ভালোবাসা কিন্তু অনেক ওজনদার, মাথা পেতে নিতে হবে!

রোহিলার চোখ চিকচিক করছে। কোনো কারণে সে এখন দুর্বল। সে আহত ভাবে বলল, ভালোবাসা নিয়ে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করো না, বসন্ত রাও! আমি কোনোদিন ভালোবাসা পাইনি। ভালোবাসা কাকে বলে আমি জানিই না। কিন্তু ভালোবাসা আমার খুব দরকার। যদি আমি যোগ্য না হই, আমাকে যোগ্য হয়ে ওঠার সময় দাও। তোমরা অনেক ভালোবেসেছ, তোমরা অনেক কিছু জানো।

বসন্ত রাও বলল, আমি ঠাট্টা করছি না। তোমার যত ভালোবাসা চাই সব আমি দেব। আমার অফুরন্ত ভালোবাসা মজুত আছে। এই নীললোহিত একবার আমাকে বলেছিল, ভালোবাসা হচ্ছে বিদ্যা বা জ্ঞানের মতন, যতই করিবে দান, তত যাবে বেড়ে। ঠিক কি না?

বন্দনাদি বলল, ওরে বাবারে, ভালোবাসা ভালোবাসা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। শোনো, তোমরা ভালোবাসা শব্দটা বেশি উচ্চারণ করে পুরোনো করে দিও না।

রোহিলা বলল, তুমি ঠিক বলেছ, বন্দনাদি। ঐ শব্দটা শুনলেই বুক চমকে উঠবে, তবে না?

বন্দনাদি বলল, শোনো, একটা কাজের কথা বলি। আমরা আজ সারা দুপুর– বিকেল নীলুর জন্য অনেক খাটাখাটনি করেছি। আজ আর বাড়ি ফিরে রান্না করার উৎসাহ নেই। আজ নীলুর আমাদের রেঁধে খাওয়ানো উচিত না? আমরাই আজ ওর বাড়িতে অতিথি!

বসন্ত রাও বলল, হিয়ার! হিয়ার! অতি মহত্ত্বপূর্ণ প্রস্তাব! আই সেকেণ্ড ইট!

বন্দনাদি বসন্ত রাও–কে বলল, ইস! এদিকে শিল্পী, ওদিকে খাওয়ার ব্যাপার শুনলেই উৎসাহে একেবারে ডগোমগো!

বসন্ত রাও বলল, আরে, শিল্পীরাই তো খাওয়ার ব্যাপারটা ভালো বোঝে। বাকি লোকরা স্রিফ পেট ভরাবার জন্য খায়। কেমন কিনা! তাছাড়া এই নীলু বান্দরটা কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝে যাবে যে শুধু নিজের জন্য রান্না করা, কী বিড়ম্বনা! দু’চার দিন বাদেই তোমার–আমার বাড়ি ঠিক খাওয়ার সময় গিয়ে ঘুরঘুর করবে। ঠিক কি না। সেইজন্যই তো বলছি, ঐ বেটা কয়েকদিন আমাদের রেঁধে খাওয়াক।

আমি বললুম, ঠিক আছে। তোমাদের আজ আমি খাওয়াব!

বন্দনাদি বলল, আমরা কিন্তু বেশির ভাগ দিনই সাহেবদের মতন সন্ধের সময়েই খেয়ে নিই। আজ তো এমনিতেই দেরি করা যাবে না, একটু রাত হলেই চলে যেতে হবে। নীলু, তুই ব্যবস্থা কর। আমরা ক’জন? রোহিলা, জয়দীপ, বসন্ত রাও, সূরয আর আমি। তোকে নিয়ে ছ’জন। চাল–ডাল যা পেয়েছিস কুলিয়ে যাবে। না হয় কাল আবার আমরা কিছু দিয়ে যাব।

সূরয নামের নিঃশব্দ লোকটি দু’হাত নাড়তে লাগল। অর্থাৎ সে যেদিন কথা বলে না, সেদিন খায়ও না। কিন্তু আড্ডার মধ্যে থাকতে ভালোবাসে। জয়দীপের কথা শুনে আমাদের সঙ্গে সে–ও শব্দ করে হেসেছিল।

বন্দনাদি বলল, সূরয, তুমি খাবে না? তা হলে তুমি বাড়ি যাও। একজন অভুক্ত লোকের সামনে আমাদের মোটেই খেতে ইচ্ছে করবে না!

বন্দনাদির হুকুম শুনে হাফ–প্যান্ট পরা জোয়ান চেহারার সূর্যকান্ত বাধ্য ছেলের মতো সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল। কলকাতায় থাকলে বন্দনাদি এতটা রানীগিরি করতে পারত কি? কলকাতায় যে অনেক রানী!

আমি রান্নার উদযোগ–আয়োজনের জন্য উঠে গেলুম। কিন্তু মেয়েরা সহজাত ভাবে সেবাপরায়ণ। আমার একার রান্না করার কথা, তবু বন্দনাদি এলো, আমার উনুন ধরিয়ে দিল, রোহিলা কুটতে বসল তরকারি। এমনকি জয়দীপও বয়ে এনে দিল এক বোঝা কাঠ।

চাল ডাল মিশিয়ে আমি যখন খিচুড়ি চাপাতে যাচ্ছি, তখন বন্দনাদি বলল, আসল জিনিসটাই কেউ দিয়ে যায়নি। যার অভাবে কোনো কিছুই খাওয়া যাবে না। নীলু, তুই কী রকম রাঁধুনি রে? তোর তো প্রথমেই মনে পড়ার কথা ছিল।

–কী? কী জিনিস?

—নুন! তোর বাড়িতে নুন আছে?

আমি জিভ কাটলুম। রোহিলা খিলখিল করে হেসে উঠল। বন্দনাদি বলল, অতি সামান্য জিনিস বলেই কেউ দেয়নি। আমার বাড়িতে অনেক আছে, কিন্তু আমিও আনতে ভুলে গেছি। এখন কে যাবে? আমার তো যেতে ইচ্ছে করছে না।

জয়দীপ বলল, আমি নিয়ে আসছি।

বন্দনাদি বলল, না, জয়দীপ। তুমি অনেক খেটেছ আজ। বসন্ত রাও তুমি যাও!

বসন্ত রাও বলল, আমি অবশ্যই যেতে রাজি আছি। এ আর কী কথা। তবে মনোরম সন্ধে হয়ে আসছে, এসময় কি একলা হাঁটতে ভালো লাগে? রোহিলা যদি আমার সঙ্গে যায় তাহলে ভালো হয়!

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, তুমি যাবে, রোহিলা?

রোহিলা বলল, সঙ্গে যেতে হবে? হাঁ, যেতে পারি।

তরকারি কোটা ছেড়ে উঠে পড়ল রোহিলা। বসন্ত রাও–এর সঙ্গে বেরিয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তটিতে আমি তাকাইনি রোহিলার দিকে।

খিচুড়ি যখন ফুটে এসেছে, বসন্ত রাও আর রোহিলা তখনও ফেরেনি, এইরকম এক সময়ে দূরে কোথাও বেজে উঠল মাদল। দ্রিম দ্রিম গম্ভীর ধ্বনি, শুনলে বুক কাঁপে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *