নিরুদ্দিষ্ট – সুধাংশুকুমার গুপ্ত
যে সময়কার কথা বলছি, তখন ব্রহ্মদেশে ভাগ্যান্বেষী বাঙ্গালীর আমদানি বেশি হয়নি। আর যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন চাকুরিজীবী। আমি ছিলাম রেঙ্গুনে। ওখানকার এক সরকারি অফিসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। আমার বাসা ছিল শহরের এক নিরালা অঞ্চলে। বাসায় আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না। ছিল একজন পাচক আর অফিসের দুজন চাপরাশি। অফিসের রুটিন-বাঁধা কাজ আর সঙ্গীহীন জীবনের একঘেয়েমি যখন একান্ত অসহ্য হয়ে উঠত, তখন বাইরে কোথাও বেরিয়ে পড়তাম কিছুদিনের জন্যে। সেবার পুজোর ছুটির দিনকয়েক আগে আমন্ত্রণ পেলাম বাল্যবন্ধু অনিমেষের কাছ থেকে। অনিমেষ পিয়ানতাজায় ডাক্তারি করে। পসারপ্রতিপত্তি ভালই। বছর দুই আগে ওর ওখানে হপ্তাখানেক একবার কাটিয়ে এসেছিলাম। জায়গাটা ভালই লেগেছিল আমার। অনিমেষকে লিখে দিলাম, অফিস বন্ধ হলেই রওনা হচ্ছি, সে যেন গাড়ি পাঠিয়ে দেয় স্টেশনে।
স্টেশনে এসে হাজির হলাম ট্রেন ছাড়ার আধ ঘণ্টা আগেই। একখানা খালি ফার্স্ট ক্লাশ কামরা দেখে নিয়ে উঠে পড়লাম। এ লাইনে ফার্স্ট ক্লাশ যাত্রীর সংখ্যা কম। গার্ড-সাহেবকে বললাম, আমার শরীর ভাল নেই, একটু বিশ্রামের প্রয়োজন, অন্য কোন যাত্রী এ কামরায় যাতে না ওঠে, সেদিকে যেন তিনি একটু নজর রাখেন। গার্ড বেশ ভালো মানুষ বলেই মনে হল, আমার অনুরোধে কামরার দরজায় চাবি লাগিয়ে দিলেন তিনি।
বেঞ্চের ওপর আরাম করে বসে, চুরুটটা ধরিয়ে সবে একখানা ডিটেকটিভ নভেল পড়তে শুরু করেছি, এমন সময় দেখি প্ল্যাটফর্মের ওধার থেকে স্যুটপরা একজন ভদ্রলোক হনহন করে এসে উঁকি মারলেন আমার কামরার মধ্যে এবং পরক্ষণেই পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন ব্যস্তভাবে। ট্রেন ছাড়তে তখন আর মাত্র এক মিনিট বাকি। ভদ্রলোকের আগমনে আমি যে মোটেই খুশি হতে পারলাম না, একথা বলাই বাহুল্য।
বইখানা এক পাশে রেখে ভদ্রলোকটির পানে তাকালাম। মনে হল যেন চেনা চেহারা, এঁকে কোথাও দেখেছি ইতিপূর্বে। বয়স পঞ্চাশের ওপর, লম্বা একহারা, দাড়ি-গোঁফ কামানো, কাঁধটা একটু ঝুঁকে পড়েছে যেন, মাথার মাঝখানে মস্ত টাক, চারপাশে কাঁচা-পাকা কয়েকগাছি চুল। সঙ্গে একটা হালকা ওয়াটারপ্রুফ কোট, একটা ছাতা আর মাঝারি সাইজের একটা স্যুটকেস। স্যুটকেসটা বেঞ্চের নিচে নামিয়ে রেখে ভদ্রলোকটি বসে পড়লেন ঠিক আমার সামনে।
এতক্ষণে আমার সহযাত্রীকে চিনতে পারলাম আমি। মনে পড়ল বছর দুই আগে অনিমেষের বাড়িতে দেখেছি ওঁকে। ওঁর নাম সুব্রত রায়, রেঙ্গুন হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট। যতদূর মনে পড়ে উনি অনিমেষের স্ত্রীর মামা। দিনের আলো তখন ম্লান হয়ে এসেছে, সন্ধ্যা হয় হয়, সেই আবছা আলোয় সুব্রত রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন এই দু’বছরে ওঁর স্বাস্থ্যের বিশেষ অবনতি ঘটেছে। মুখখানা অত্যন্ত ফ্যাকাশে আর চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন একটা অস্থিরতা—যা দেখিনি কোনদিন। কপালে চিন্তার সুস্পষ্ট রেখা, রগ দুটো বসে গেছে অনেকখানি। বেশ বোঝা যায়, কোন কঠিন ব্যাধি অথবা মানসিক কষ্টে বিপর্যস্ত তিনি। বার কয়েক সুব্রত রায় যখন আমার পানে তাকালেন, তখন আমি আর চুপ করে থাকা সঙ্গত মনে করলাম না।
‘আপনি কি মিঃ সুব্রত রায়?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
‘হ্যাঁ।’ মিঃ রায় একটু সরে এলেন আমার দিকে।
‘বছর দুই আগে পিয়ানতাজায় আপনাকে দেখেছিলাম অনিমেষের বাড়িতে।’
মিঃ রায় মাথাটা একটু নেড়ে সায় দিলেন আমার কথায়।
‘আপনার মুখ আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে, অথচ আপনার নামটা····’
‘আমার নাম সুনীল—সুনীল মিত্র। অনিমেষ আমার বাল্যবন্ধু—একসঙ্গে পড়াশুনা করেছি বরাবর। ওর ওখানে যাই মাঝে-মাঝে। আপনার সঙ্গে দেখা হল, ভালোই হল। আমরা বোধ করি একই স্থানের যাত্রী?’
‘না—অবশ্য আপনি যদি অনিমেষের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করে থাকেন,’ জবাব দিলেন মিঃ রায়, ‘আমি চলেছি বার্মা রেলওয়েজ-এর কাজে। পেগু থেকে একটা ব্রাঞ্চ লাইন খোলা হচ্ছে থঙওয়া পর্যন্ত।’
‘তাই নাকি? আপনি বুঝি বার্মা রেলওয়েজ-এর উকিল?’
‘হ্যাঁ। শুধু তাই নয়, রেলওয়ের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইসরি বোর্ডের সদস্যও আমি। ব্রাঞ্চ লাইনের স্কীম আমিই দিয়েছিলাম। ক’মাস ধরে যা খাটনি যাচ্ছে, তা বলবার নয়।’
নিজের কৃতিত্বে উল্লসিত মিঃ রায় অতঃপর ওই ব্রাঞ্চ লাইনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন উচ্ছ্বসিতভাবে। বোর্ডের সদস্যদের বিরোধিতা, জমিদারদের স্বার্থপরতা ও লোভ, স্থানীয় অধিবাসীদের অসুবিধা, খবরের কাগজওয়ালাদের ঔদাসীন্য ইত্যাদি সম্বন্ধে অনর্গল তিনি বক্তৃতা করে যাচ্ছিলেন, শুনতে শুনতে ক্লান্তি এসে গিয়েছিল আমার, চোখ দুটো ধীরে ধীরে বুজে আসছিল ঘুমের আবেশে। হঠাৎ আমার চমক ভাঙল মিঃ রায়ের উচ্চ কণ্ঠস্বরে।
‘পঁচাত্তর হাজার টাকা—বুঝলেন কিনা, নগদ পঁচাত্তর হাজার টাকা দিতে হবে জমিদারকে!’
নিজের ত্রুটি সেরে নেবার জন্য কণ্ঠস্বরে যথাসম্ভব আগ্রহের ভাব টেনে এনে মিঃ রায়ের কথার পুনরুক্তি করলাম, ‘পঁচাত্তর হাজার টাকা! মোটা টাকা দিতে হবে বলুন?’
‘তা বৈকি····আর ওই টাকাটা রয়েছে এইখানে’, মিঃ রায় অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন নিজের বুকপকেটের দিকে—‘কিন্তু জমিদারদের সবশুদ্ধ যে টাকাটা দিতে হবে, তার একটা অতি সামান্য অংশ হচ্ছে এটা।’
‘বলেন কি! আপনার ওই পকেটের মধ্যে পঁচাত্তর হাজার টাকা রয়েছে!’ অবাক হয়ে চাইলাম মিঃ রায়ের মুখের পানে।
‘কী আশ্চর্য! এই কথাই তো বলছিলাম এতক্ষণ।’ বিরক্তির সুরে বললেন মিঃ রায়—‘আজই রাত সাড়ে আটটায় এই টাকাটা দিতে হবে জমিদার উ পো থার উকিলের হাতে—নইলে কাজ অনেক পিছিয়ে যাবে।’
‘কিন্তু এই রাত্রে অত টাকা সঙ্গে নিয়ে যাবেন কি করে থঙওয়া?’
‘থঙওয়া!’ মিঃ রায় বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। ‘আমার কথা আপনি তাহলে বুঝতে পারেননি ঠিক মতো। আমি যাব পেগুর কাছাকাছি এক গ্রামে—থঙওয়ায় নয়। ওই অঞ্চলটা উ পো থার জমিদারির মধ্যে।’
‘মাপ করবেন আমায়’, লজ্জিতভাবে বললাম আমি, ‘আমি সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।····তাহলে আপনি যাবেন পেগুর নিকটে একটি গ্রামে?’
‘হ্যাঁ। পেগু স্টেশনে একটা গাড়ি যোগাড় করে নেব। গাড়ি না পেলেও ক্ষতি নেই—মাইল দুয়েকের পথ বৈ তো নয়। আপনি বোধ করি আগে থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, অনিমেষকে লিখেছি গাড়ি পাঠাতে স্টেশনে। আপনার যদি অনিমেষকে কিছু জানাবার থাকে, আমায় বলতে পারেন অনায়াসে।’
‘অনিমেষকে বলবেন, আপনার সঙ্গী হতে পারলে বিশেষ খুশি হতাম—যদি সম্ভব হয় তবে বড়দিনের ছুটিতে ওদের আতিথ্য গ্রহণ করতে পারি।’
‘আর কিছু জানাবার আছে?’
মিঃ রায়ের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল। ‘হ্যাঁ, অনিমেষের স্ত্রী অর্থাৎ কিনা আমার ভাগিনেয়ী নমিতাকে বলবেন, এবার যখন ওদের অতিথি হব, সে যেন দোতলার ঘরে আমার শোবার ব্যবস্থা না করে নিচের হলঘরটা আমায় ছেড়ে দেয়। ওঘরে আমি আর থাকছি না কিছুতেই।’
‘কেন, ওঘরে আপনার কোন অসুবিধা হয়েছিল বুঝি?’
‘অসুবিধা—বিলক্ষণ! একদিন রাত্রে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাই—পড়ে গিয়ে পায়ে এমনি চোট লাগে যে সাতদিন শয্যাশায়ী ছিলাম।·····আমরা কি পেগুতে এসে পড়লাম নাকি?’
মিঃ রায় যখন নিজের করুণ অভিজ্ঞতা সবিস্তারে বর্ণনা করছিলেন, সেইসময় ট্রেন এসে থামল এক জায়গায়। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, অদূরে স্টেশনের আলো জ্বলছে। আর একটা ট্রেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় আমাদের ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পারেনি। গার্ড এই অবসরে গাড়ি থেকে নেমে টিকিট চেক করতে শুরু করেছিলেন। এ লাইনে অনেকে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করে বলে গার্ডই অনেক সময় টিকিট চেক করেন। ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে না বুঝতে দেখি, আমাদের কামরার সামনে লালমুখো সেই গার্ড দাঁড়িয়ে।
‘টিকিট।’ গার্ড এগিয়ে এলেন দরজার কাছে।
‘আমি যাব পিয়ানতাজা।’ ছোট্ট টিকিটখানি উঁচু করে তুলে ধরে জবাব দিলাম আমি।
টিকিটখানা নিয়ে হাতে-ঝুলানো লণ্ঠনের আলোয় পরীক্ষা করলেন গার্ড, তারপর টিকিটটা আমায় ফিরিয়ে দিয়ে তাকালেন কামরার ভিতরে। মনে হল যেন তিনি আমার সহযাত্রীর দিকে তীক্ষ্ণ একটা কটাক্ষ নিক্ষেপ করলেন, তারপর সরে গেলেন সেখান থেকে।
‘গার্ড আপনার টিকিট দেখতে চাইলেন না তো? মিঃ রায়কে লক্ষ্য করে বিস্ময়ের সুরে বললাম আমি।
‘ওরা কখনও টিকিট চায় না আমার কাছে।’ জবাব দিলেন মিঃ রায়, ‘আমাকে ওরা সকলেই চেনে····আর রেল কোম্পানির কাজ করি বলে বিনা ভাড়ায়-আমি যাতায়াত করি।’
ট্রেনখানা স্টেশনে প্রবেশ করতেই কুলিরা হাঁক দিয়ে উঠল, ‘পেগু! পেগু!’
বেঞ্চের নিচে থেকে স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে টুপিটা মাথায় দিলেন মিঃ রায়। তারপর ছাতা আর ওয়াটারপ্রুফটা হাতে করে উঠে দাঁড়ালেন।
‘ধন্যবাদ, মিঃ মিত্র। আপনার সঙ্গ পেয়ে কয়েক ঘন্টা ভালোই কেটেছে।’ সাবেকি ধরনে নমস্কার জানিয়ে মিঃ রায় এগুলেন দরজার দিকে।
‘নমস্কার!’ হাতখানা আমি বাড়িয়ে দিলাম মিঃ রায়ের দিকে।
মিঃ রায় হয়তো সেটা লক্ষ করেননি, কিংবা লক্ষ্য করে থাকলেও নামবার তাড়ায় শিষ্টাচার পালন করার সময় ছিল না তাঁর। দান হাতে টুপিটা ঈষৎ তুলে প্লাটফর্মে নেমে পড়লেন তিনি। তারপর ধিরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে মিশে গেলেন যাত্রীদের ভিড়ে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানলায় ঝুঁকে পড়ে লক্ষ করছিলাম মিঃ রায়কে। হঠাৎ কিসের ওপর যেন পা পড়ল আমার, নিচু হয়ে দেখি একটা সিগার-কেস। নিশ্চয়ই অতা পড়ে গেছে মিঃ রায়ের ওয়াটারপ্রুফ কোটের পকেট থেকে। কালো মরক্কো চামড়ায় তৈরি, একপাশে রুপোর সুদৃশ্য মনোগ্রাম। গার্ড হয়তো কামরার দরজা বন্ধ করতে আসছিলেন, তাড়াতাড়ি আমি নেমে পড়লাম প্ল্যাটফর্মে।
‘এক মিনিট ঘুরে আসতে পারি?’ উদ্বিগ্নকণ্ঠে প্রশ্ন করলাম গার্ডকে, ‘রেঙ্গুন থেকে যে ভাদ্রলোকটি আমার সাহযাত্রী ছিলেন তিনি তাঁর সিগার-কেসটি ফেলে গেছেন। এখনও তিনি স্টেশনের বাইরে যেতে পারেননি নিশ্চয়।’
‘আর মাত্র দেড় মিনিট সময় আছে,স্যর’, জবাব দিলেন গার্ড, ‘আপনি ফিরে আসবেন তাড়াতাড়ি।’
আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি ছুটতে শুরু করলাম। যত দ্রুত পারি ছুটতে থাকি। মস্ত বড় স্টেশন, মিঃ রায় হয়তো এতক্ষণে প্লাটফর্মে অর্ধেকটা ছাড়িয়ে চলে গেছেন।
কিছুদূর আসার পর দেখতে পেলাম মিঃ রায়কে। ভিড়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন তিনি। একটু যখন কাছাকাছি এসেছি, দেখলাম তিনি একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছেন। খানিক পরেই দেখি ওঁরা দুজন ভিড় থেকে একটু তফাতে সরে গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আলাপ করেছেন নিবিষ্টচিত্তে। যেখানে ওঁদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, সেই দিকে আমি এগোলাম ত্বরিতপদে। ওঁদের মাথার ঠিক ওপরেই একটা আলো জ্বলছিল ল্যাম্পপোস্টে এবং সেই আলো এসে ছড়িয়ে পড়েছিল ওঁদের মুখে। দুজনকেই আমি বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম—মিঃ রায় ও তাঁর সঙ্গীকে। রুদ্ধশ্বাসে ছুটছিলাম আমি—কখনো বা কুলিদের ঠেলাগাড়ির সামনে এসে পড়ছি, কখনো বা ধাক্কা লাগছে যাত্রীদের সঙ্গে। তার ওপর প্রতি মুহূর্তে ভয় ওই বুঝি ট্রেন ছেড়ে দিল আমাকে না নিয়েই! কিন্তু মনের ওই অবস্থাতেও আমি লক্ষ্য করলাম, মিঃ রায়ের সঙ্গীটি বয়সে মিঃ রায়ের চেয়ে অনেক ছোট আর দৈর্ঘেও ইঞ্চি দুই কম। রঙ বেশ ফর্সা, চুল কটা রঙের, সুপুষ্ট গোঁফ ও ঘন দাড়ি, আর পরনে টুইডের স্যুট। আর মাত্র পনেরো ষোলো গজের ব্যবধান। ব্যস্তভাবে এগোতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লুম এক মোটাসোটা ভদ্রলোকের গায়ের উপর। কোনরকমে তাল সামলে নিয়ে ওই জায়গাটার কাছে যখন পৌঁছুলাম, ঠিক সেই সময় বেজে উঠল গার্ডের হুইসিল। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওঁরা গেলেন কোথায়! মাত্র দু’সেকেন্ড আগে ওঁদের দেখেছি এখানে, এরই মধ্যে ওঁরা অদৃশ্য হলেন কি করে? চারিদিকে তাকালাম হতবুদ্ধির মত, কোথাও ওঁদের চিহ্নমাত্র নেই! তবে কি প্ল্যাটফর্মটাই হঠাৎ মুখব্যাদান করে ওঁদের উদরস্থ করে ফেলেছে!
নিকটেই একজন কুলি দাঁড়িয়েছিল।
‘এক মিনিট আগে এখানে দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন, কোন্ দিকে ওঁরা গেলেন বলতে পারো?’ জিজ্ঞাসা করলাম কুলিকে।
‘কই, হুজুর, আমি তো কাউকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি,’ জবাব দিলে কুলি।
আবার হুইসিল বেজে উঠল। প্ল্যাটফর্মের ওধার থেকে হাত উঁচু করে গার্ড আমায় ফিরে আসবার জন্যে ইশারা করছেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম ট্রেনের দিকে। গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে, লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম ফুটবোর্ডে, গার্ড ঠেলে দিলেন কামরার মধ্যে। তখনও আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। মিঃ রায়ের সিগার-কেস হাতে করে তখনও আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে আছি প্ল্যাটফর্মের দিকে।
ব্যাপারটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু তবু ওটা বার বার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। আর যতই ওই সম্বন্ধে ভাবতে লাগলাম, ততই যেন অস্থিরতা বাড়তে লাগল। কিছুতেই ওই রহস্যের সমাধান করতে পারলাম না। পেগু থেকে পিয়ানতাজা পর্যন্ত সারা পথটা ওই নিয়ে চিন্তা করলাম, কিন্তু সমাধানের সূত্র খুঁজে পেলাম না। পিয়ানতাজায় নেমে ঘোড়ার গাড়ি চেপে যখন অনিমেষের বাড়ি চলেছি, তখনো ওই চিন্তা মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। এ যেন সত্যিই ভোজবাজি! চোখের পলকে জ্বলজ্যান্ত দুটো মানুষ উধাও হয়ে গেল, কেউই দেখতে পেলে না!
স্টেশন থেকে অনিমেষের বাড়ি মাইল তিনেকের পথ। আধঘন্টার মধ্যেই গাড়ি এসে দাঁড়াল অনিমেষের বাড়ির ফটকে। বৈঠকখানায় আলো জ্বলছে। সামনের বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছে সেই আলো। কাঁকর বিছানো পথটুকু পেরিয়ে বারান্দায় উঠতেই বন্ধু এসে জড়িয়ে ধরল পরম সমাদরে। অনিমেষ চিরদিনই বন্ধুবৎসল। অনেকদিন পরে দেখা—আমাকে পেয়ে অনিমেষ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বৈঠকখানায় আমায় বসিয়ে সে অন্দরমহলে চলে গেল আমার চায়ের ব্যবস্থা করতে।
ইতিমধ্যে অনিমেষের বাড়িতে আরও তিনজন অতিথির সমাগম হয়েছে। অনিমেষের শ্বশুর, শ্যালক ও শ্যালকের এক বন্ধু। সবাই খেতে বসলাম এক সঙ্গে। নানান বিষয়ে গল্প শুরু হল। অনিমেষ চিরদিনই স্বল্পভাষী। কথা বলছিলেন অনিমেষের শ্বশুর। ভদ্রলোক কলকাতার এক কলেজের অধ্যাপক। নানান জায়গায় ঘুরেছেন—অভিজ্ঞতা খুব। কোন দেশের লোকের কি রকম আচার অনুষ্ঠান, কোথায় কি অদ্ভুত জিনিস দেখেছেন, সেই সব কাহিনী তিনি বলতে লাগলেন সবিস্তারে। খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা এসে বসলাম বৈঠকখানায়।
আমার আজকের বিচিত্র অভিজ্ঞতাটা সকলকে জানাবার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠছিল। কিন্তু অনিমেষের শ্বশুর মশায় গল্পে এমন মেতে উঠেছিলেন যে সুযোগ পাইনি এতক্ষণ। এবার আর নিজেকে সংযত করে রাখতে পারলাম না। অনিমেষের দিকে চেয়ে বললাম, ‘তোমার এক বিশিষ্ট আত্মীয়ের সঙ্গে আজ দেখা হল ট্রেনের কামরায়।’
অনিমেষ ততক্ষণে একখানা খবরের কাগজ হাতে করে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পড়েছে। কাগজে চোখ বুলোতে বুলোতে বললে, ‘তাই নাকি? কে বল তো?’
‘মিস্টার সুব্রত রায়—তোমার মামাশ্বশুর।’
কাগজখানা রেখে অনিমেষ একটু চঞ্চলভাবে উঠে বসল। অনিমেষের স্ত্রী নমিতা উৎসুক দৃষ্টিতে আমার পানে তাকাল, কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।
‘আর তিনি আপনাকে জানাতে বলেছেন, নমিতা দেবী, যে এবার যখন তিনি আসবেন, দোতলার ঘরে তাঁর শোবার ব্যবস্থা না করে নিচের হলঘরটা তাঁকে ছেড়ে দেবেন, কারণ ওঘরে তিনি আর থাকতে চান না—রাত্রে সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে নাকি পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন গুরুতর।’
কথা শেষ করবার আগেই আমি লক্ষ্য করলাম, যেন সবার মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। মনে হল যেন এমন কিছু আমি বলেছি, যা না বলাই উচিত ছিল। হতবুদ্ধির মত আমি বসে রইলাম—কিছু বলবার সাহস হল না আমার। মিনিট দুই ঘরের ভিতর একটা দুঃসহ স্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল।
অনিমেষের শ্বশুর হাই তুলতে লাগলেন। রাত অনেক হয়েছে, সবাই একে একে উঠে পড়ল শুতে যাবার জন্য। অনিমেষের শ্যালক সুরজিৎ যখন উঠতে যাচ্ছে, আমি তাকে ইশারা করলাম একটু বসবার জন্য।
‘আচ্ছা, ব্যাপারটা কি হল বল তো? আমি কি এমন কিছু বলেছি—’ মৃদু স্বরে বললাম সুরজিৎকে।
‘আপনি আমার মামা সুব্রত রায়ের কথা বলছিলেন কিনা,তাই⋯’ সুরজিৎ জবাব দিলে কুণ্ঠিতভাবে।
‘কি হয়েছে তাতে? ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, একথা বলা কি ঠিক হয়নি?’
‘ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার।⋯যাঁকে দেখেছেন, তিনি যে সুব্রত রায় এ সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিত?’
‘নিজের সম্বন্ধে আমি যতখানি নিশ্চিত, ঠিক ততখানি,’ জবাব দিলাম আমি, ‘আমরা রেঙ্গুন থেকে পেগু পর্যন্ত সারা পথটাই কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু এতে তোমরা আশ্চর্য হচ্ছো কেন?’
‘কারণ’, সুরজিৎ কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব নিচু করে বলল, ‘মামা রেল কোম্পানির পঁচাত্তর হাজার টাকা আত্মসাৎ করে ফেরার হয়েছেন মাস তিনেক আগে, আর তাঁর কোন পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না।’
সুব্রত রায় ফেরার হয়েছেন তিন মাস আগে, আর মাত্র ঘণ্টা কয়েক পূর্বে তাঁর সঙ্গে দেখা হল আমার! আশ্চর্য তো! মিঃ রায় রেল কোম্পানির পঁচাত্তর হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন অথচ উনি বললেন টাকাটা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন জমিদারকে দেবার জন্য!
পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে বসে অনিমেষের সঙ্গে আলাপ হল মিঃ রায়ের অন্তর্ধান সম্পর্কে।
‘আমার বিশ্বাস মিস্টার রায় নিরাপরাধ’, মন্তব্য করলাম আমি, ‘যখন তাঁর সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম, তখন তাঁর আচরণে কিছুমাত্র চাঞ্চল্য দেখিনি। এমন কি গার্ড যখন কামরায় এল, তখনও তিনি বিচলিত হননি এতটুকু। অত্যন্ত খোলাখুলি ভাবেই তিনি আলাপ করছিলেন আমার সঙ্গে। কেন যে তিনি পেগু চলেছেন, তাও বলতে দ্বিধাবোধ করেননি তিনি।’
‘এ যে নিতান্ত আশ্চর্য ব্যাপার। মিস্টার রায়কে ভালোরকম জানি, তিনি অত্যন্ত হুঁশিয়ার লোক। সত্যিই তিনি তোমাকে বলেছিলেন যে তাঁর পকেটে পঁচাত্তর হাজার টাকা রয়েছে?
‘হ্যাঁ।’
এক মিনিট থেমে অনিমেষ বলল, ‘নমিতা কি বলে জানো?’
‘কি বলে?’
‘তার ধারণা, মিস্টার রায় টাকাটা আত্মসাৎ করতে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন—এই তিন মাস তিনি আত্মগোপন করে রয়েছেন লোকালয় থেকে দূরে কোন নির্জন জায়গায়, আর সম্ভবত লড়াই করছেন বিবেকের সঙ্গে—টাকাটা নিয়ে পালিয়ে যেতেও পারছেন না, আবার ফিরে এসে টাকাটা ফেরৎ দেবারও সাহস নেই তাঁর।····মানুষের মনের ভেতরে প্রবেশ করবার মেয়েদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে—নমিতার অনুমানকে একেবারে অবহেলা করা চলে না।’
‘কিন্তু এখন তো ফিরে এসেছেন মিস্টার রায়’, মন্তব্য করলাম আমি।
‘সেইটাই এখন ভাববার বিষয়। বোধ করি রেল কোম্পানির কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন, আর টাকাটা ফেরৎ দেওয়ার দরুন রেল কোম্পানি তাঁকে মার্জনা করেছে এবং যে কাজের ভার তাঁর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল, সেটা চালিয়ে যাবার অনুমতিও দিয়েছে তাঁকে।’
‘তোমার মত বুদ্ধিমান লোকের একথা বলা সাজে না। রেল কোম্পানির ডিরেক্টারেরা অতখানি উদার কোনদিনই হবে না। মার্জনা তারা হয়তো করতে পারে তাঁকে, কিন্তু একবার যদি বিশ্বাসভঙ্গ করে থাকেন, তখন কিছুতেই তাঁর হাতে ওই কাজের দায়িত্ব তারা আবার দেবে না।’
‘কথাটা ঠিকই, কিন্তু এক্ষেত্রে এ ছাড়া আর কি অনুমান সম্ভব হতে পারে? যাই হোক, চল আজই একবার পেগু স্টেশনে ঘুরে আসি, দেখা যাক এ সম্পর্কে কোন খবর মেলে কিনা।····হ্যাঁ, একটা কথা—সুরজিৎ বলছিল তুমি নাকি মিস্টার রায়ের সিগার-কেস কুড়িয়ে পেয়েছ?’
‘হ্যাঁ, এই দেখ সেই সিগার-কেস।’ বুক পকেট থেকে সিগার-কেসটা বের করে টেবিলের উপর রাখলাম।
সিগার-কেসটা নিয়ে অনিমেষ ভালো করে পরীক্ষা করে বলল, ‘এটা যে মিস্টার রায়ের সিগার-কেস সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এটা তাঁকে আমি ব্যবহার করতে দেখেছি। এই দেখ তাঁর মনোগ্রামও রয়েছে একপাশে—R এর ওপর S আঁকা। ওঁর চিঠিপত্রেও এই মনোগ্রাম দেখেছি বহুবার।’
‘এ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হচ্ছে যে আমি স্বপ্ন দেখিনি—মিস্টার রায়ের সঙ্গে সত্যিই সাক্ষাৎ হয়েছে আমার।’
‘ব্যাপারটা অত্যন্ত ঘোরালো—তবে তোমার কথা আমি অবিশ্বাস করছি না।’
আমাদের পেগু যাবার কথা কারো কাছে যাতে প্রকাশ না করি, সে সম্বন্ধে আমাকে সতর্ক করে দিয়ে কি একটা কাজে বেরিয়ে গেল অনিমেষ।
সেইদিনই তাড়াতাড়ি আহারাদি সেরে বেলা দশটার ট্রেনে পেগু রওনা হলাম। পৌঁছুলাম বেলা দেড়টার সময়। ট্রেন থেকে নেমেই আমরা সোজা স্টেশন মাস্টারের ঘরে এসে হাজির হলাম। স্টেশন মাস্টার একজন আধাবয়সী মাদ্রাজী ভদ্রলোক। অনিমেষের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, মিঃ রায়কে তিনি ভালো রকমই চেনেন এবং অনেকবার তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ করবার সুযোগ হয়েছে তাঁর।
‘কাল তিনি ট্রেন থেকে এই স্টেশনে নেমেছেন, এ খবর তো পাইনি কারো কাছ থেকে। এ লাইনে এখন যে তিনি যাতায়াত করতে ভরসা পাবেন, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি না। এমন একজন স্টেশন মাস্টার, গার্ড অথবা কুলি এ লাইনে নেই যে মিস্টার রায়কে না চেনে—যেখানেই তাঁকে দেখতে পাওয়া যাবে, পুলিশে খবর চলে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। ২৫শে জুলাই এর পর থেকে তাঁর সম্বন্ধে একটা বিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়েছে রেলের সর্বত্র।’
‘আচ্ছা, বলতে পারেন এই স্টেশনে কাল রাত্রে টিকেট চেক্ করেছিল কে? প্রশ্ন করলে অনিমেষ।’
‘পারি বৈকি—মিস্টার ব্রাইট।’
‘ওঁর দেখা পাওয়া যাবে কোথায়?’
‘আপনি যদি আটটা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করেন, তাহলে দেখা হতে পারে। রেঙ্গুন থেকে যে এক্সপ্রেস আসবে রাত আটটায়, তাতে মিস্টার ব্রাইট থাকবেন নিশ্চয়ই। ট্রেনখানা এখানে অপেক্ষা করে দশ মিনিট।’
আপ্ এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করা আমরা সঙ্গত মনে করলাম। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়টা কাটাই কি করে? স্টেশনের বাইরে এসে আমরা পাকা সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা প্রায় শহরের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছুলাম। সে জায়গাটা স্টেশন থেকে প্রায় মাইল চারেক দূরে। ফিরতে হবে আটটার মধ্যে, কাজেই আর এগিয়ে না গিয়ে ফিরে চললাম স্টেশনের দিকে।
আপ্ এক্সপ্রেস ঠিক সময়েই এল। লালমুখো হৃষ্টপুষ্ট সেই গার্ড—যাঁকে পূর্বদিন আমার ট্রেনে যেতে দেখেছি—নামলেন গাড়ি থেকে।
স্টেশন মাস্টার আমাদের পরিচয় দিয়ে বললেন, এঁরা মিস্টার রায়ের সম্বন্ধে আপনাকে দু’একটা প্রশ্ন করতে চান, মিস্টার ব্রাইট।’
মিস্টার ব্রাইট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন।
‘মিস্টার রায়—ফিন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইসারি বোর্ডের ভূতপূর্ব সদস্য?’
‘হ্যাঁ, তাঁরই কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই আমরা।····তাঁকে যদি আপনি দেখেন, চিনতে পারবেন কি?’
‘যেখানেই দেখি না কেন, তাঁকে চিনতে আমার দেরি হবে না।’
‘কাল বিকালের আপ্ এক্সপ্রেসে তিনি ছিলেন কি?’
‘না, তিনি ছিলেন না।’
‘এমন নিশ্চিতভাবে আপনি বলছেন কি করে?’
‘কারণ প্রত্যেকটি কামরা আমি দেখেছি এবং যাত্রীদের কারো মুখই আমার নজর এড়ায়নি। আমি শপথ করে বলতে পারি, ও গাড়িতে মিস্টার রায় ছিলেন না। এই ভদ্রলোকটি ছিলেন একখানি ফার্স্ট ক্লাস কামরায়—’ বলেই মিস্টার ব্রাইট ফিরলেন আমার দিকে, —‘পূর্বে ওঁকে কোনদিনই দেখিনি আমি, কিন্তু ওঁর মুখ আমার পরিষ্কার মনে আছে।····আপনি এই স্টেশনে একবার নেমেছিলেন কি কাজে এবং আর একটু দেরি হলেই হয়তো ট্রেনে আর উঠতে পারতেন না। আপনি নেমে যান পিয়ানতাজায়।’
‘আপনি যা বললেন সবই ঠিক, কিন্তু যে ভদ্রলোকটি রেঙ্গুন থেকে পেগু পর্যন্ত আমার সঙ্গে একই কামরায় এলেন, তাঁর মুখ কি আপনার মনে পড়ে না?’
‘আমার ধারণা আপনি একা ছিলেন কামরার মধ্যে’, বিস্ময়ের সুরে জবাব দিলেন মিঃ ব্রাইট।
‘কখনোই না। আমার একজন সহযাত্রী ছিলেন পেগু পর্যন্ত —তিনি গাড়িতে যে সিগার-কেসটি ফেলে গিয়েছিলেন, সেটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে গিয়েই ট্রেন হারাতে বসেছিলাম।’
‘হ্যাঁ, একটা সিগার-কেস সম্বন্ধে আপনি কি যেন বলেছিলেন বটে,’ গার্ডসাহেব বললেন।
‘কিন্তু····এই স্টেশনে গাড়ি ঢোকবার আগেই আপনি আমার টিকিট দেখতে চেয়েছিলেন।’
‘তা চেয়েছিলাম।’
‘তখন নিশ্চয়ই আপনি আমার সহযাত্রীকে লক্ষ্য করে থাকবেন। দরজার কাছেই তিনি বসেছিলেন বেঞ্চের এক কোণে।’
‘সত্যিই কাউকে আমি দেখিনি।’
গার্ড ও স্টেশন মাস্টার পরস্পরের দিকে তাকালেন। পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে গার্ড চঞ্চলভাবে বললেন, ‘আর চার মিনিট বাদেই আমাকে বিদায় নিতে হবে, স্যর।’
‘আর একটি প্রশ্ন বাকি আছে আমাদের,’ হতাশার সুরে বলল অনিমেষ, ‘এই ভদ্রলোকটির সহযাত্রী যদি মিস্টার রায় হতেন এবং তিনি যদি বসে থাকতেন দরজার কাছে—যেখান দিয়ে আপনি টিকিট নিয়েছিলেন, আপনার পক্ষে মিস্টার রায়কে না-দেখা ও না-চেনার সম্ভাবনা ছিল কি?’
‘মোটেই না।’
‘এবং আপনি কি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে আপনি তাঁকে দেখেননি?’
‘নিশ্চিত বৈকি। ওই কামরায় আপনাকে ছাড়া কাউকে দেখিনি আমি। ক্ষমা করবেন, স্যর—আমার সময় নেই আর।’
গার্ড টুপিটা ঈষৎ তুলে বিদায় নিলেন এবং পরক্ষণেই ইঞ্জিনের ঘস্ ঘস্ শব্দ শোনা গেল আর ট্রেনখানা ধীরে ধীরে চলে গেল স্টেশনের বাইরে।
কয়েক মুহূর্ত আমরা চুপচাপ বসে রইলাম পরস্পরের মুখের পানে চেয়ে। মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে। প্রথমে কথা বললাম আমি।
‘তবে কি আমি যা দেখেছি সব স্বপ্ন? কিন্তু যে ব্রাঞ্চ লাইনের কথা কোনদিন আমি শুনিনি, তার সম্বন্ধে স্বপ্ন দেখলাম কি করে? মিস্টার রায় যে পঁচাত্তর হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন, তাই বা স্বপ্ন দেখা কি করে সম্ভব হতে পারে?’
‘হয়তো ওই ব্যাপার সম্বন্ধে কোথাও কিছু শুনে থাকবে তুমি। যখন শুনেছিলে, তখন তোমার মন আকৃষ্ট হয়নি ওইদিকে, কিন্তু স্বপ্নের মাঝে ওটা ফিরে এসেছে মনে, আর এই ফিরে আসার ব্যাপারে সাহায্য করেছে সংশ্লিষ্ট স্টেশনের নামগুলি।’
‘তা না হয় মানলাম। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় মিস্টার রায়ের পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়াটা? ও খবরটা কি পথে কোথাও শুনেছি বলে মনে কর?’
‘না, তা করি না। আমি স্বীকার করি, ওই বিষয়ে একটা অসুবিধা রয়েছে।’
‘আর ওই সিগার-কেসটা?’
‘হ্যাঁ, ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে। ওটাকে কোনমতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সত্যি, ব্যাপারটা রহস্যজনক এবং এর সমাধান করতে হলে তীক্ষ্ণবুদ্ধি একজন ডিটেকটিভের দরকার। আমার মনে হয়, এখানে আর অযথা সময় নষ্ট না করে আমাদের পক্ষে এখন ফিরে যাওয়াই সঙ্গত হবে।’
এক সপ্তাহ না যেতেই একখানা চিঠি পেলাম বার্মা রেলওয়েজের সেক্রেটারির কাছ থেকে। চিঠিতে তিনি আমায় অনুরোধ করেছেন রেলওয়ে বোর্ডের একটি বিশেষ মিটিং-এ উপস্থিত হবার জন্য। আমার উপস্থিতির প্রয়োজন সম্পর্কে চিঠিতে তিনি কোন কারণ দেখাননি, কিন্তু এটা সহজেই অনুমান করতে পারলাম, আমি যে নিরুদ্দিষ্ট মিঃ রায় সম্পর্কে পেগু স্টেশনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, তা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কানে গিয়েছে এবং তাঁরা আমাকে পরীক্ষা করতে চান এই বিষয়ে। তখনও আমি অনিমেষের গৃহে অতিথি, নির্দিষ্ট দিনে রেঙ্গুন রওনা হলাম অনিমেষকে সঙ্গে করে।
দেখলাম একটি সুসজ্জিত প্রশস্ত প্রকোষ্ঠে একখানা বড় টেবিলের চারিধারে বারো জন সদস্য বসে আছেন—তাঁরা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য মিলিত হয়েছেন, তা তাঁদের মুখ দেখেই বোঝা যায়। বোর্ডের চেয়ারম্যান সাদরে অভ্যর্থনা করে আমাদের বসতে বললেন। আমরা আসন গ্রহণ করতেই তিনি বলতে শুরু করলেন, পেগু স্টেশনে মিস্টার রায় সম্পর্কে আমি যে সব কথা বলেছি, তা তাঁরা জানতে পেরেছেন এবং সেই সম্পর্কে আমার সঙ্গে একটু আলোচনা করতে চান তাঁরা।
এরপর যথারীতি পরীক্ষা শুরু হল। প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল মিস্টার রায়ের সাথে আমার পরিচয় আছে কিনা, সে পরিচয় কতদিনের এবং দেখবামাত্র আমি তাঁকে চিনতে পারি কিনা। তারপর আমায় প্রশ্ন করা হল, শেষ কবে আমি দেখেছি তাঁকে। তার উত্তরে বললাম এই মাসেরই ৪ঠা—৪ঠা অক্টোবর। এবার প্রশ্ন হল, ওই তারিখে কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। উত্তরে বললাম, অপরাহ্ণ পাঁচটার আপ এক্সপ্রেসে একখানি ফার্স্ট ক্লাস কামরায় দেখা হয় তাঁর সঙ্গে—ট্রেন যখন স্টেশন ছাড়বার উপক্রম করছে ঠিক সেই সময় তিনি এসে কামরায় ওঠেন এবং নেমে যান পেগু স্টেশনে। চেয়ারম্যান তখন জিজ্ঞাসা করলেন, মিস্টার রায়ের সঙ্গে আমার কোন কথাবার্তা হয়েছিল কিনা। আমার যতদূর স্মরণে ছিল, মিস্টার রায় নতুন ব্রাঞ্চ লাইন সম্বন্ধে যে সমস্ত কথা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করলাম।
সদস্যেরা সকলেই গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনছিলেন এবং সেক্রেটারি কিছু কিছু লিখে নিচ্ছিলেন আবশ্যক মতো। আমি এবার সিগার-কেসটি বের করে সামনে ধরলাম। প্রত্যেকেই সেটি ভালো করে পরীক্ষা করলেন এবং সেটি যে মিস্টার রায়ের, তা চিনতে কারো দেরি হল না। এই রুপোর মনোগ্রামযুক্ত সিগার-কেসটি তাঁরা বহুবার দেখেছেন মিস্টার রায়ের কাছে এবং ওটা যে আমার উক্তির একটি বিশিষ্ট প্রমাণ, সে বিষয়ে কারো সন্দেহ রইল না। আমার বক্তব্য শেষ হয়ে গেলে, চেয়ারম্যান ফিস্ ফিস্ করে সেক্রেটারিকে কি বললেন এবং সেক্রেটারি হ্যান্ডবেলে রিং করতেই গার্ড উইলিয়াম ব্রাইট এসে ঘরে ঢুকলেন। আমারই মত মিস্টার ব্রাইটকে পরীক্ষা করা হল খুঁটিয়ে। মিস্টার ব্রাইট বললেন, মিস্টার রায়কে তিনি ভালোরকম চেনেন, কোন অবস্থাতেই তাঁকে ভুল করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, ৪ঠা অক্টোবর অপরাহ্ণ পাঁচটার আপ্ এক্সপ্রেসে তিনি ছিলেন, এ তাঁর বেশ মনে আছে। আমাকেও মনে আছে তাঁর, খান দুই ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট খালি থাকায় তিনি আমার অনুরোধে একখানা কামরায় আমাকে একা ভ্রমণ করার সুবিধা করে দিয়েছিলেন। আমি যে ওই কামরায় রেঙ্গুন থেকে পিয়ানতাজা পর্যন্ত একা ছিলাম, এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। তিনি শপথ করে বলতে পারেন যে মিস্টার রায় ওই কামরায় ছিলেন না এবং ওই ট্রেনের কোন কামরাতেই তাঁকে দেখেননি।
আমার দিকে ফিরে চেয়ারম্যান বললেন, ‘শুনলেন মিস্টার মিত্র, গার্ড যা বললে? আপনার কোন কথারই সমর্থন এর উক্তির মধ্যে পাওয়া গেল না। এ সম্বন্ধে আপনার কী বলবার আছে?’
‘আমি পূর্বে যা বলেছি, শুধু তারই পুনরুক্তি করতে পারি। মিস্টার ব্রাইট যেমন নিজের উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ, আমিও তেমনি আমার উক্তির সত্যতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দিগ্ধ নই।
‘আপনি বলেছেন, মিস্টার রায় নেমে যান পেগু স্টেশনে এবং তাঁর সঙ্গে একটি প্রাইভেট চাবি ছিল। আপনি কি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে গার্ড টিকেট নিতে আসবার আগে ওই প্রাইভেট চাবির সাহায্যে মিস্টার রায় নেমে যাননি?’
‘ট্রেনখানা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে না আসা পর্যন্ত এবং পেগুর অন্যান্য যাত্রীর গাড়ি থেকে না নামা পর্যন্ত মিস্টার রায় নামেননি, একথা আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। এমন কি প্ল্যাটফর্মে মিস্টার রায়কে এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতে দেখেছি।’
‘তাই নাকি? আপনি কি সেই বন্ধুটিকে ভালো করে লক্ষ্য করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, ভালো করেই লক্ষ্য করেছিলাম।’
‘তার চেহারা আপনি বর্ণনা করতে পারেন?’
‘পারি বৈকি। লোকটি খর্বকায়, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, মাথার চুল কটা, গোঁফ-দাড়ি বেশ ঘন আর পরনে চকোলেট রঙের টুইডের স্যুট।’
‘মিস্টার রায় কি এই লোকটির সঙ্গে স্টেশনের বাইরে চলে গিয়েছিলেন?’
‘তা বলতে পারি না। আমি তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে যেতে দেখেছি প্ল্যাটফর্ম দিয়ে এবং খানিক পরে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে কিছুক্ষণ কথা বলতে দেখেছি নিবিষ্টভাবে। এরপর হঠাৎ তাঁরা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন, আর ঠিক সেই সময়েই আমার ট্রেন ছেড়ে দিল বলে ট্রেনে উঠে পড়তে আমি বাধ্য হলাম।’
চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি নিম্নস্বরে কি পরামর্শ করলেন। সদস্যেরা ফিস্ ফিস্ করে কি সব বলাবলি করতে লাগলেন। দু-একজন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন গার্ডের দিকে। আমার কথা যে সকলের মনে গভীর রেখাপাত করেছে, এ আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। আমারই মত তাঁরা সন্দেহ করছিলেন, নিরুদ্দিষ্ট মিঃ রায় ও গার্ডের মধ্যে একটা যোগাযোগ আছে।
‘ওই দিন পাঁচটার এক্সপ্রেসে কতদূর গিয়েছিলে ব্রাইট?’ জিজ্ঞাসা করলেন চেয়ারম্যান।
‘সারা পথটাই, স্যর—রেঙ্গুন থেকে টাউঙ্গু পর্যন্ত।’
সেক্রেটারির দিকে তাকালেন চেয়ারম্যান।—‘এ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার জন্যে ‘ডে-বুক’টা দেখা দরকার।’
আবার সেক্রেটারি রিং করলেন এবং চাপরাশি ভিতরে আসতেই সুন্দর সিংকে ডেকে আনতে বলা হল। সদস্যদের কথাবার্তা থেকে আমি জানতে পারলাম, সুন্দর সিং সেক্রেটারির সহকারীদের একজন।
সুন্দর সিং এসে হাজির হল। বলিষ্ঠ খর্বকায় লোক, চুল কটা, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, কেমন যেন একটা ব্যস্তসমস্ত ভাব, মুখে গোঁফ-দাড়ির প্রাচুর্য। ঘরের দরজার মুখে দেখা গেল তাকে এবং সেক্রেটারি ‘ডে—বুক’টা আনতে অনুরোধ করবামাত্র মাথাটা একবার একটু নিচু করেই অদৃশ্য হল সে।
সুন্দর সিং দাঁড়িয়েছিল মুহূর্তের জন্য। তাকে দেখে আমি এমনি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম যে কিছুক্ষণ কথা বলবার শক্তি ছিল না আমার। সুন্দর সিং প্রস্থান করতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
‘ওই লোকটিই মিস্টার রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল পেগু স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে,’ আমি বললাম উত্তেজিত ভাবে।
সকলেই অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের পানে তাকাতে লাগলেন।
মিনিট খানেক পরে সুন্দর সিং ফিরে এল ‘ডে-বুক’টা বগলে করে।
‘দেখ তো, সুন্দর সিং, ৪ঠা অক্টোবর ব্রাইটের ডিউটি ছিল কোথায়?’ চেয়ারম্যান বললেন সুন্দর সিংকে উদ্দেশ করে।
‘ডে-বুক’টা খুলে তিন চারটে পাতার ওপর অভ্যস্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে হঠাৎ এক জায়গায় থেমে সুন্দর সিং উচ্চস্বরে পড়ল কিছুটা। সে যা পড়ল তাতে জানা গেল, ওই দিন মিস্টার ব্রাইট পাঁচটার এক্সপ্রেসে ছিলেন রেঙ্গুন থেকে টাউঙ্গু পর্যন্ত।
চেয়ারম্যান সামনের দিকে একটু ঝুঁকে সুন্দর সিং-এর মুখের পানে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে হঠাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘ওই দিন অপরাহ্ণে তুমি কোথায় ছিলে সুন্দর সিং?’
‘আমি····আমি কোথায় ছিলাম, স্যর?’
‘হ্যাঁ, তুমি। কোথায় ছিলে ৪ঠা অক্টোবর তারিখের অপরাহ্ণে ও সন্ধ্যায়?’
‘কেন, এইখানে—মিস্টার হান্টারের অফিসে। এখানে ছাড়া আর কোথায় থাকতে পারি আমি?’
সুন্দর সিং-এর কণ্ঠস্বরে একটা অস্বাভাবিক উত্তেজনা—চোখের দৃষ্টিতে ব্যাকুল বিস্ময়!
‘তুমি যে ওই দিন অপরাহ্নে অনুমতি না নিয়ে অফিসে অনুপস্থিত ছিলে, এ মনে করার বিশেষ কারণ আছে। বল তো আমাদের এ ধারণা কি ভুল?’
‘ভুল—একেবারে ভুল। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত একদিনও ছুটি নিইনি আমি। মিস্টার হান্টার আমার একথা সমর্থন করবেন নিশ্চয়ই।’
সুন্দর সিং-এর কথা সমর্থন করলেন মিস্টার হান্টার। কিন্তু মন্তব্য করলেন, পাশের ঘরের কেরানিরা ঠিক খবর দিতে পারবে এ সম্বন্ধে। একটু পরেই চশমা-পরা একজন আধবয়সী ভদ্রলোককে ডেকে আনা হল এবং চেয়ারম্যান জেরা করতে লাগলেন তাকে।
এই কেরানি যা বলল, তাতে সুন্দর সিং সম্বন্ধে সন্দেহটা কেটে গেল। সে বলল, তার যতদূর মনে পড়ে, জুলাই মাসে ছুটি থেকে ফিরে আসার পর সুন্দর সিং কোনদিনই অফিসের কাজকর্মের সময় অনুপস্থিত ছিল না।
আমি রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। চেয়ারম্যান আমার দিকে তাকালেন—মুখে মৃদু হাসি, কিন্তু সে হাসির অন্তরালে বিরক্তির প্রচ্ছন্ন আভাস।
‘শুনলেন মিস্টার মিত্র, হেড ক্লার্ক যা বললে?’ চেয়ারম্যান বললেন আমাকে লক্ষ্য করে।
‘শুনলাম স্যর—কিন্তু আমার ধারণা একটুও পাল্টায়নি।’
‘আপনার ধারণা নিতান্ত ভিত্তিহীন, মিস্টার মিত্র,’ একটুখানি কেশে জবাব দিলেন চেয়ারম্যান—‘আমার কি মনে হয়, জানেন? আপনি স্বপ্ন দেখেন নিশ্চয়ই এবং যা কিছু স্বপ্নে দেখেন, সবই সত্য ঘটনা বলে মনে করেন। এ একটা মারাত্মক অভ্যাস এবং এর পরিণতি বিপজ্জনক হতে পারে। সুন্দর সিং অত্যন্ত অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ত, যদি না সে প্রমাণ করতে পারত ৪ঠা অক্টোবর সে উপস্থিত ছিল অফিসে।’
নিজে যা সত্য বলে মনে করি, অপরে যদি সেটা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চায়, তাহলে মনে যে দারুণ বিরক্তির উদয় হয় এমন বুঝি আর কিছুতেই হয় না। ঘটনার গতির পরিবর্তনে অত্যন্ত বিরক্ত ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠলাম আমি। চেয়ারম্যানের ভদ্র পরিহাসও অসহ্য ঠেকছিল। তবে সবচেয়ে অসহ্য মনে হচ্ছিল গার্ডের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি আর সুন্দর সিং-এর চোখের দৃষ্টিতে বিদ্বেষমাখানো বিজয়ের উল্লাস। লোকটি যে ঘাবড়ে গেছে আর ভয়ও পেয়েছে কিছুটা, তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। তার ভীরু শঙ্কিত দৃষ্টিতে যেন একটা নীরব প্রশ্ন ফুটে উঠছিল। কে এই আগন্তুক? কী ও চায়? কেন ও এখানে এসেছে তার চাকরির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে? বিনা অনুমতিতে সে অফিসে অনুপস্থিত ছিল কিনা, তা জেনে ওর কি সুবিধা হবে?
আমি কিন্তু সহজে দমবার পাত্র নই। তখনও আমার একটা কথা বলবার ছিল, আর আমি সেটা বললাম সুস্পষ্ট ভাবেই।
‘দেখুন স্যর, আপনি বলছেন আমি স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে মানুষ কখনো স্থূল জিনিসের সংস্পর্শে আসে না। আমি যে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে সিগার-কেসটা পেলাম, সেটা কি করে সম্ভব হল বুঝিয়ে দেবেন কি?’
‘সিগার-কেসটা যে আপনার উক্তির স্বপক্ষে একটা strong point, তা স্বীকার করি’, জবাব দিলেন চেয়ারম্যান। ‘কিন্তু এটাই আপনার একমাত্র strong point, মিস্টার মিত্র। আমরা যে কেবলমাত্র একটা Accidental সাদৃশ্যের দ্বারা চালিত হয়েছি, এ মনে করা অসঙ্গত হবে না। সিগার-কেসটা আর একবার দেখতে পারি কি?’
চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ সিগার-কেসটা পরীক্ষা করলেন নীরবে এবং তারপর সেটা এগিয়ে দিলেন সেক্রেটারির দিকে। সেক্রেটারি সিগার-কেসটা বারবার নাড়াচাড়া করে মাথাটা নাড়লেন চিন্তিত ভাবে।
‘না, Accidental সাদৃশ্যের ব্যাপার নয়। এটা যে মিস্টার রায়ের সিগার-কেস, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। আমি এটা যে কতবার দেখেছি তা বলা যায় না।’
‘আমিও ওকথা বলতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু মিস্টার মিত্র যে ভাবে এ সিগার-কেসটা পেয়েছেন, তা যে নিতান্ত অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।’ গম্ভীরমুখে বললেন চেয়ারম্যান।
‘আমি শুধু পূর্বে যা বলেছি সেই কথারই পুনরুক্তি করতে পারি,’ জবাব দিলাম আমি—‘মিস্টার রায় ট্রেন থেকে নেমে যাবার পর গাড়ির মেঝেয় সিগার-কেসটা দেখতে পাই আমি। ওঁকে দেখবার জন্য জানলার ওপর ঝুঁকে পড়ার সময় আমি ওটা পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলি এবং ওটা মিস্টার রায়কে পৌঁছে দিতে গিয়ে আমি একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে মিস্টার সুন্দর সিংকে নিবিষ্টভাবে কথা বলতে দেখি মিস্টার রায়ের সঙ্গে।’
আমার কোটের হাতায় টান দিলে অনিমেষ। ‘সুন্দর সিং-এর মুখের চেহারাটা কেমন হয়েছে দেখ!’ অনিমেষ বলল ফিসফিস করে।
এক মুহূর্ত আগে সুন্দর সিং যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেইদিকে তাকাতে দেখি সুন্দর সিং চোরের মত দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে—মুখ তার ছাইয়ের মত শাদা, ভয় ফুটে উঠেছে চোখের দৃষ্টিতে!
মনের মধ্যে হঠাৎ একটা অস্পষ্ট সন্দেহ উঁকি দিল। ছুটে গিয়ে সজোরে তার ঘাড়টা চেপে ধরে তার ভীত বিবর্ণ মুখখানা ফিরিয়ে দিলাম বোর্ডের সদস্যদের দিকে।
‘তাকান একবার এর মুখের দিকে—আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করছে এর মুখ!’ উত্তেজিতভাবে বললাম আমি।
চেয়ারম্যানের মুখ হঠাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে এল। রুক্ষকণ্ঠে বললেন, ‘সুন্দর সিং, তুমি যদি কিছু জানো, গোপন করবার চেষ্টা করো না।’
আমার কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করে সুন্দর সিং হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমায় ছেড়ে দিন····আমি কিছুই জানি না····আমাকে আটকে রাখবার কোন অধিকার নেই আপনার····ছেড়ে দিন····’
‘বলো সুন্দর সিং, পেগু স্টেশনে মিস্টার রায়ের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা? তোমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা যদি সত্য হয়, তাহলে বোর্ডের কাছে তুমি আত্মসমর্পণ কর, আর তুমি যা জানো তা স্বীকার কর অকপটে।’
আতঙ্কে বেদনায় সুন্দর সিং নুয়ে পড়ল অসহায়ভাবে।
‘আমি ছিলাম না ওখানে!’ চেঁচিয়ে উঠল সুন্দর সিং—‘আমি তখন দুশো মাইল দূরে…ও সম্বন্ধে কিছুই জানি না আমি····কিসের স্বীকারোক্তি করব····আমি নির্দোষ—ভগবান জানেন আমি নির্দোষ!’
‘দুশো মাইল দূরে!’ সবিস্ময়ে প্রতিধ্বনি করলেন চেয়ারম্যান—‘কী বলতে চাও তুমি?’
‘আমি ছিলাম মৌলমিনে। তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়েছিলাম আমি····মিস্টার হান্টার জানেন সে কথা····সারা ছুটিটাই আমি মৌলমিনে ছিলাম····আমি প্রমাণ করতে পারি, আমি তখন মৌলমিনে····’
সুন্দর সিংকে ভয়-বিহ্বল দৃষ্টিতে অসংলগ্নভাবে কথা বলতে দেখে বোর্ডের সদস্যেরা ফিসফিস করে পরস্পর কথা বলতে লাগলেন এবং একজন নিঃশব্দে উঠে গিয়ে চাপরাশিকে বলে এলেন দরজা পাহারা দেবার জন্য।
‘তোমার মৌলমিনে থাকার সঙ্গে এ ব্যাপারের সম্বন্ধ কী?’ কঠোর স্বরে বললেন চেয়ারম্যান—‘কখন তুমি মৌলমিনে ছিলে?’
‘সুন্দর সিং জুলাই মাসে ছুটি নিয়েছিল যখন মিস্টার রায় নিখোঁজ হন’, মিস্টার হান্টার বললেন চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে।
‘মিস্টার রায় যে নিখোঁজ হয়েছেন, তা আমি শুনতে পাই ফিরে আসার পর,’ বলল সুন্দর সিং।
‘সেটা প্রমাণের বিষয়। দেখ সুন্দর সিং, আমি ব্যাপারটা এখনই পুলিশের হাতে দেব। আমার পরামর্শ এই যে, কোন রকম লুকোচুরি না করে তুমি স্বীকারোক্তি কর—তাতে তোমার অপরাধের গুরুত্ব অনেকটা হ্রাস পাবে। একাজে তোমার সঙ্গী ছিল যারা তাদের সম্বন্ধে····’
‘সঙ্গী আমার ছিল না কেউ!’ নতজানু হয়ে আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সুন্দর সিং, ‘আমায় দয়া করুন····আমার প্রাণরক্ষা করুন····সব আমি অকপটে বলব। আমি ওঁকে আঘাত করতে চাইনি····সত্যি বলছি, ওঁর কোন অনিষ্ট করার ইচ্ছা আমার ছিল না·····আমায় দয়া করুন—যেতে দিন আমায়····’
চেয়ারম্যান চঞ্চলভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন—মুখ তাঁর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ‘এসব কথার মানে কী? কিছুই যে আমি বুঝতে পারছি না····তবে কি····’
‘আপনি যা অনুমান করছেন ঠিকই—মিস্টার রায়কে খুন করা হয়েছে।’ ধীর ভাবে মন্তব্য করল অনিমেষ।
‘না, খুন আমি করিনি·····খুন আমি করিনি····’
সুন্দর সিং চেঁচিয়ে উঠল কাতরভাবে—তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে থরথর করে।
‘বিশ্বাস করুন আমায়—খুন আমি করিনি। আমি ভেবেছিলাম আমি তাঁকে সংজ্ঞাহীন করেছি মাত্র····ও ছাড়া আর কিছু করবার অভিপ্রায় আমার ছিল না····খুন এটা নয়····’
দু’হাতে মুখ ঢেকে চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। মিস্টার রায়কে যে হত্যা করা হয়েছে, এ তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
মিনিট দুই পরে চেয়ারম্যান কথা বললেন।
‘সুন্দর সিং, তুমি যে কাজ করেছ, তার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।’
‘আপনি আদেশ করলেন সব কিছু স্বীকার করবার জন্য, তাই স্বীকার করলাম। আপনার কথামতই বোর্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি।’ করুণ কণ্ঠে বলল সুন্দর সিং।
‘তুমি এমন একটা অপরাধ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করেছ, যা তোমার দ্বারা সম্ভব বলে আমরা কেউই সন্দেহ করতে পারিনি।’ জবাব দিলেন চেয়ারম্যান, ‘এ অপরাধের শাস্তি বিধান করা বা মার্জনা করার ক্ষমতা বোর্ডের নেই। তোমার মঙ্গলের জন্য আমি শুধু তোমাকে পরামর্শ দিতে পারি আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। কোন কিছু গোপন না করে অপরাধ স্বীকার করলে হয়তো তোমার লঘুদণ্ড হবে। আচ্ছা, কবে ও কাজ করলে?’
অপরাধী উঠে দাঁড়াল নির্জীবের মত। টেবিলে ঠেস দিয়ে স্বপ্নাচ্ছন্নের মত সে বললে, ‘২২শে জুলাই।’
‘২২শে জুলাই!’ পরম বিস্ময়ে আমি তাকালাম অনিমেষের দিকে। একটা অনির্দ্দেশ্য আতঙ্কে বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।
অনিমেষের মুখও ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ‘তবে ট্রেনে তুমি দেখলে কাকে?’ ফিসফিস করে বলল অনিমেষ।
ট্রেনে কাকে দেখেছি? অনেক চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত এ প্রশ্নের সমাধান করতে পারিনি। আমি শুধু জানি, আমি যাঁকে দেখেছি, তাঁর চেহারা অবিকল মিস্টার রায়ের মত—যদিও তাঁর মৃতদেহ তখন পড়েছিল পেগু স্টেশনের মাইল দুই দূরে একটা জঙ্গলভরা খাদের মধ্যে গাছের ডাল ও পচা পাতার স্তুপের নিচে। আমি জানি, সহযাত্রীর মুখে যেসব কথা শুনেছিলাম, তা অন্য কোন উপায়ে জানার সম্ভাবনা ছিল না আমার। আমার মনে হয়, হত্যাকারীকে যাতে আমি সনাক্ত করতে পারি, সে যাতে আইনের হাত থেকে অব্যাহতি না পায়, সেই জন্যই মিস্টার রায়ের অশরীরী আত্মার আবির্ভাব ঘটেছিল আমার সামনে।
সিগার-কেসের ব্যাপারটারও সমাধান হল। অনুসন্ধানে জানা গেল, আমি যে গাড়িতে পিয়ানতাজায় যাত্রা করি, সে গাড়িটা ইতিপূর্বে কয়েক সপ্তাহ ব্যবহৃত হয়নি, আর সেই গাড়িতেই হতভাগ্য মিস্টার রায় ভ্রমণ করেছিলেন ২২শে জুলাই অপরাহ্ণে। সিগার-কেসটি মিস্টার রায় নিশ্চয়ই ফেলে গিয়েছিলেন গাড়িতে এবং কেউই সেটা লক্ষ্য করেনি আমি দেখবার আগে।
হত্যাকাণ্ডের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যাঁরা বিস্তারিত বিবরণ চান, তাঁরা রেঙ্গুন টাইমস্-এর পুরানো ফাইলে সুন্দর সিং-এর লিখিত স্বীকারোক্তি পড়তে পারেন। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, সেক্রেটারির সহকারী থাকায় নতুন লাইনের কোন খবরই সুন্দর সিং-এর অজানা ছিল না এবং সে মতলব করেছিল মিস্টার রায়কে কৌশলে কোন নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে পঁচাত্তর হাজার টাকা কেড়ে নেবে তাঁর কাছ থেকে, আর টাকাটা নিয়ে সরে পড়বে সিঙ্গাপুরে।
উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সুন্দর সিং যে তারিখে জমিদারকে টাকা দেবার কথা ছিল তার দিন কয়েক আগে ছুটি নেয় অফিস থেকে, ২৩শে জুলাই সিঙ্গাপুর রওনা হবার জন্য সিট বুক করে একখানি ফরাসী জাহাজে, কার্তুজ-ভরা একটা রিভলবার সংগ্রহ করে জাহাজের খালাসীদের কাছ থেকে এবং পেগু স্টেশনে এসে উপস্থিত হয় মিস্টার রায়ের আগমন প্রতীক্ষায়। তারপর কেমন করে সে মিস্টার রায়ের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে সাক্ষাৎ করে বোর্ডের একটা জরুরী খবর দেবার অছিলায়, কেমন করে সে তাঁকে জমিদারের কাছারিবাড়ি পৌঁছে দেবার ছল করে নিয়ে আসে একটা নির্জন মাঠে, কেমন করে অতর্কিতে সে তাঁর মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত হানে রিভলবারের নল দিয়ে এবং আঘাতের ফলে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে দেখে কেমন করে মৃতদেহটাকে একটা খাদের পারে টেনে নিয়ে এসে নিক্ষেপ করে তার মধ্যে এবং গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেয় সযত্নে, সে সব বৃত্তান্ত আজও অনেকের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, অপরাধ অনুষ্ঠানের পর হত্যাকারী ব্ৰহ্মদেশ ছেড়ে যেতে ভরসা পেল না। আদালতে সে বলেছিল, মিঃ রায়কে খুন করার উদ্দেশ্য তার ছিল না—সে চেয়েছিল তাঁকে সংজ্ঞাহীন করে টাকাটা আত্মসাৎ করতে। কিন্তু আঘাতের ফলে মিস্টার রায়ের মৃত্যু হওয়ায় পালিয়ে যেতে সাহস করলে না সে, কারণ তার ভয় হল ওই সময় সে যদি পালিয়ে যায়, তাহলে সমস্ত সন্দেহ এসে পড়বে তারই ওপর আর হত্যাকারী সন্দেহে তার সন্ধান শুরু হবে দেশে দেশে এবং ধরা পড়লেই হবে তার মৃত্যুদণ্ড। সুতরাং সিঙ্গাপুর যাত্রা করার কল্পনা ত্যাগ করে সে ছুটি ফুরোতেই ফিরে এল অফিসে এবং টাকাটা এক জায়গায় লুকিয়ে রাখলে সুবিধামত ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে।
সুন্দর সিং সবার মুখে শুনলে, মিস্টার রায় নাকি কোম্পানির টাকা নিয়ে কোথায় সরে পড়েছেন—শুনে আশ্বস্ত হল সে। ক্ষণিকের জন্যও সে ভাবতে পারেনি ওই হত্যা-রহস্য একদিন প্রকাশ হয়ে পড়বে একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে।
হত্যা করার উদ্দেশ্য সুন্দর সিং-এর ছিল কিনা কে জানে! আদালতের বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হল।