নিরুদ্দিষ্টের অশেষ যাত্রা
উপন্যাস এক অশেষ যাত্রা। উপন্যাসের আসলে শেষ নেই। আসলে লেখক যেন একটি উপন্যাসই সমস্ত জীবন ধরে লেখেন। হয়তো ঠিক তা নয়, কিন্তু কখনো যেন এমন মনে হয়। নদী নিয়ে লেখা ফুরোয় না দেবেশ রায়ের। তিস্তা পারের বৃত্তান্ত, তিস্তা পুরাণের পর করতোয়া নদীকে তিনি খুঁজতে বেরিয়েছেন নদী ও শহরের যুগলগীতি শীর্ষ নামে লেখা বেশ কয়েকটি আখ্যানে। উপন্যাস কাহিনি কথন নয় যদিও কাহিনি কথনই এক জাতীয় পাঠক পছন্দ করেন বেশি। কাহিনির বৃত্তায়নই পছন্দ বহুজনের। ইচ্ছাপূরণের কাহিনি আরো বেশি পছন্দ মানুষের। যেমন সিনেমায় হয়। কিন্তু পাঠকের তো রকমফের আছে। কেউ বিভূতিভূষণ পড়েন, কেউ পড়েন নীহার গুপ্ত। লেখক যদি পাঠক ধরতে লেখার কথা ভাবেন, তাহলে তিনি সেই অচেনা ব্যক্তিকে মাপবেন কীভাবে? কে পছন্দ করবে তাঁর লেখা তা আন্দাজ করা দুরূহ। তার চেয়ে এমন তো হতে পারে তিনি যাঁকে চেনেন সবচেয়ে তাঁর জন্যই লিখতে পারেন। সেই ব্যক্তিটি তিনি নিজে। নিজেকে মাপাও সব সময় হয়ে ওঠে না। তবুও একটি কথা নিজে নিজে টের পাই, নিজের জন্যই লিখি আমি। নিজে সন্তুষ্ট না হতে পারলে শেষ অবধি সে লেখা হয়ে ওঠে না। কীভাবে তা হয় বলছি। আমি ১৯৮০ নাগাদ, তখন তিরিশে পৌঁছইনি, একটি নভেলেট লিখেছিলাম শিলাদিত্য পত্রিকায়। সম্পাদক ছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। বিভ্রম ছিল সেই নভেলেটের নাম। একটি ঘোড়ার গল্প। দীঘার সমুদ্রতীরের এক হোটেলওয়ালার একটি ঘোড়া ছিল। ঘোড়াটি প্রতি আশ্বিনে পালায়। সুবর্ণরেখা এবং সমুদ্রের মোহনার কাছে বড় একটি চর ছিল। আশ্বিনে সেই চরে চারদিক থেকে ঘোটক ঘোটকীরা পালিয়ে আসে সবুজ ঘাস এবং প্রেমের নেশায়। ঘোড়া এবং ঘুড়ীদের ভিতর ভালবাসা হয় সেই সময়। কিন্তু সেই বছর বৈশাখে সে অদৃশ্য হয়েছিল। নিখোঁজ সেই ঘোড়া খুঁজতে যায় হোটেলওয়ালার আশ্রিত ভানুদাস। মধ্যবয়সী ভানু ছিল হা-ঘরে। দুনিয়ায় কেউ কোথাও ছিল না তার। আমি দীঘায় গিয়েছিলাম শীতের সময়। ডিসেম্বর মাস। একটি হোটেলে মাস-চুক্তিতে আমি ঘর ভাড়া করেছিলাম। সেই হোটেলের মালিকেরই ছিল ঘোড়াটি। দেখতাম আমার ঘরের জানালার ওপারে নিঝুম বেলায়, নিঝুম রাতে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ভানু কোথায় যেত ঘোড়াটির খোঁজে তা জানা যেত না। রাহা খরচ নিত গাঁজাড়ু হোটেলওয়ালার কাছ থেকে। মনে হয় ঘোড়া খোঁজার নাম করে সে নিজের একটা ইনকামের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু ভানু আশ্চর্য সব জায়গার নাম করত হঠাৎ হঠাৎ। মীরগোদার জাহাজ ঘাটার দিকে দেখা গেছে নাকি একটি ঘোড়া। রানিসাই গ্রামের একজন খবর দিয়েছে সেদিকে একটি ঘোড়া দেখা গেছে। যাই হোক ভানুর সঙ্গে আমিও ঘোড়া খুঁজতে গিয়ে নুনের খালারি দেখে এসেছিলাম। কিন্তু যে কথা বলতে চাইছি, আশ্বিনে যার পলায়নের কথা সে বৈশাখে কেন পালিয়েছে? গেল কোথায় সেই বুড়ো টাট্টু? ভানু জানে না। লেখক জানবে কী করে?
বাস্তবতা ছিল ঘোড়াটি নিখোঁজ হয়েছে। কিন্তু কেন তা কেউ বলতে পারছে না।
জীবনের অনেক রহস্য খুঁজে বের করা যায় না সত্য। অনেকেই তা প্রকাশ করেন না। লেখক তো তৃতীয় নয়নের আধিকারী, তিনি সেই রহস্য কি উন্মোচন করতে পারবেন না। আমি ভানুকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি তার অশ্ব কেন নিরুদ্দেশে গেল। হোটেলের ঠাকুর বলল, কেউ হয়তো চুরি করে নিয়ে গেছে। সোজা কথা। এতে করে নিরুদ্দেশের রহস্য শেষ হলো। কিন্তু ভানুদাস আমাকে বলেছিল, না দাদা, বুড়ো ঘোড়াকে কে চুরি করবে? তাহলে সে পালালো কেন, এখন তো আশ্বিন নয়?
ভানু উত্তর দিতে পারেনি। পরের ডিসেম্বরে আমি চলে আসি দীঘা থেকে। তখনো রাহা খরচা নিয়ে ভানু সেই পলাতককে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। বদলি হয়ে চলে আসার পর আমার ভিতরে প্রশ্নটি ছিল, সে পালিয়েছিল কেন বৈশাখে? আশ্বিনের বদলে বৈশাখে কেন? উত্তর নেই। আমি উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম নিজের ভিতরে। নভেলেট লিখতে আরম্ভ করেছিলাম সেই ঘোড়াটিকে নিয়ে। সেই সময়েই যেন স্বপ্নোত্থিতের মতো এক ভোরে আমি লিখতে বসে পেয়ে গিয়েছিলাম পলায়ন রহস্য। সে ছিল যেন প্রকৃতি এবং জীবনের রহস্য উদ্ধার।
সেদিন ছিল ভয়ানক বৈশাখ। ঘোড়ায় চেপে ঘোড়ার মালিক ফিরেছিলেন গ্রাম থেকে দীঘায়। রোদে ঘোড়াটির জিভ বেরিয়ে এসেছিল। সে দাঁড়িয়েছিল একটি নিম গাছের ছায়ায়। নবীন তরুর ছায়া ছিল না বেশি। ফলে বৈশাখের রোদে পুড়ছিল। গরম বাতাস বইছিল। বালিয়াড়ি তেতে গিয়েছিল ভীষণ। ঘোড়াটি ধুঁকছিল। এরপর দুপুরের শেষে আকাশের ঈশান কোণে মেঘের সঞ্চার হয়। ধীরে ধীরে ঘন কালো মেঘ ছেয়ে ফেলে সমস্ত আকাশ। সমুদ্র দিগন্ত থেকে মেঘ উঠে আসতে থাকে উপরে। ঘোর অন্ধকার হয়ে আসে। ঝড় এল। তারপরই বৃষ্টি। প্রবল বর্ষণে ভেসে যায় সব। উত্তাপ অন্তর্হিত হলো। বৃষ্টি থামে ঘন্টা দেড়ের পর। সন্ধে হয়ে আসে। সবদিক ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঘোড়াটি বৃষ্টিতে ভিজেছে কত। ঠান্ডা হয়েছে শরীর। আরাম হয়েছে তার। সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। সন্ধের পর চাঁদ উঠল। আশপাশের বালিয়াড়ির ধারের গর্তে, রাস্তার কোথাও কোথাও জল জমেছিল। রাত হলে চাঁদ আকাশের মাথায় উঠে এলে জোছনা পড়ল জমা জলে। আকাশে দেখা গেল পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশে। ঘোড়াটি অবাক হয়ে আকাশ মাটি দেখল। বাতাসে ঘ্রাণ নিল। তার মনে হলো আশ্বিন— শরৎকাল এসে গেছে। সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত ছিল ভয়ানক গ্রীষ্ম। দুপুরের শেষে এল বর্ষা। তারপর আশ্বিনের পূর্ণিমা। শরৎকাল। একই দিনে দুই ঋতু পার করে আশ্বিনে এসে গেছে সে। সুতরাং চলো নিরুদ্দেশে। সেই যে সুবর্ণরেখার মোহনায় চর জেগেছে সবুজ ঘাস নিয়ে, সেখানে এসে গেছে ওড়িশার ভোগরাইয়ের ঘুড়ী, আগের বছর তার সঙ্গে প্রেম হয়েছিল তার। মিলন হয়েছিল। সে খুটো উপড়ে পালালো এই বিভ্রমে। সারারাত ছুটেছিল সে জোছনার ভিতর দিয়ে। সকাল হতে ফিরে এল বৈশাখ। রোদ তেতে উঠতে লাগল। সে টের পেল আর ফেরার উপায় নেই। ভয়াবহ গ্রীষ্ম ফিরে এসেছে। বিভ্রম হয়েছিল। বিভ্রমে সে সমস্ত রাত ধরে মৃত্যুর দিকে ছুটেছে। অশ্বচরিত উপন্যাসের খসড়া ছিল এই। ১৯৮১-র ফেব্রুয়ারিতে শিলাদিত্য পত্রিকায় ছাপা হয় ‘বিভ্রম’ নামের সেই নভেলেট।
এই নভেলেট প্রকাশিত হলে অনেকের ভালো লেগেছিল। অচেনা লেখকের লেখা ছেপেছিলেন সুধীরবাবু পাণ্ডুলিপি পড়ে। আমার তখন একটি দুটি বই বের হচ্ছে প্রকাশকের ঘর থেকে। কিন্তু বিভ্রম নিয়ে আমার ভিতরে দ্বিধা ছিল। মনে হতো আরো কিছু লেখার আছে। আমি লিখতে পারিনি। বছর সাত বাদে ১৯৮৮ নাগাদ আমি আবার লিখতে আরম্ভ করি উপন্যাসটিকে। সামনে সেই নভেলেট। লিখেছিলাম। এক প্রকাশকের হাতে দিয়েছিলাম প্রকাশের জন্য। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্য, তিনি পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন। মনে হয়েছিল বিভ্রম আর বই হয়ে বের হবে না। আমি আরো নভেলেট লিখেছি এই সময়ে, ‘আসনবনি’ নামের নভেলেট তো গল্পের বইয়ে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু ‘বিভ্রম’ আমার মাথার ভিতরে একটি কাঁকর ফেলে দিয়েছিল। গল্পের বইয়ে রাখিনি। আরো লিখতে হবে। আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না নভেলেটটি নিয়ে। পড়েই থাকল আরো দশ বছর। ১৯৯৭-এ রাজস্থানের মরুতে পরমানু বোমা বিস্ফোরনের পর আমি আবার নভেলেটটিকে সামনে রেখে নতুন উপন্যাস লিখতে শুরু করি। বিস্ফোরণের দিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। আমার ঘোড়াটি পালিয়েছিল সেইদিনই। আমি তা ১৯৮১ সালেই লিখেছিলাম। এই ১৭ বছরের মাথায় সেই বুদ্ধ পূর্ণিমাই হয়ে গেল পথ। রাজপুত্র গৌতমের অশ্ব কন্থক হয়ে গেল সেই বুড়ো টাট্টু। ভানু হয়ে গেল গৌতমের সারথি ছন্দক। তারা তপোবনে দিয়ে এসেছিল রাজপুত্রকে। তিনি ফিরবেন এই হিংসার পৃথিবীতে। ভগবান বুদ্ধ ফিরবেন। সারথি ছন্দক আর অশ্ব কন্থক অপেক্ষা করছে তার জন্য এই সময়ে। সময় ১৯৯৮। রাজপুত্র ফিরে এলে পৃথিবী হিংসা মুক্ত হবে। পলাতক ঘোড়া বিভ্রমে পড়েছিল। বিভ্রম তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। ছুটতে ছুটতে সে হিরোসিমায় গিয়ে পড়ে। সেখানে তখন কালো বৃষ্টি।
একটি উপন্যাস লিখতে সতের বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। লেখক নিজেই বোঝেন লেখা হয়েছে কি হয়নি। তিনি নিজেই নিজের পাঠক। নিজের জন্যই প্রথমে লেখেন। অশ্বচরিতের পর নিরুদ্দেশ যাত্রাই হয়ে ওঠে আমার বিষয়। শেষ হয়নি সেই লেখা। ধ্রুবপুত্র এক নিরুদ্দিষ্ট কবির কথা। কবি নিরুদ্দেশ হলে মেঘও অন্তর্হিত হয় নগর থেকে। এরপর নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান লিখি এক নিরুদ্দিষ্ট জুটমিল শ্রমিককে নিয়ে। ধনপতির চর নিয়েই নিরুদ্দেশ যাত্রা করে চরবাসী। সোনাই ছিল নদীর নাম এক নিরুদ্দিষ্ট নদীর কথা। আর অতি সম্প্রতি লেখা পুনরুত্থান উপন্যাসেও নিরপরাধ পুলিশ কর্মী নিরুদ্দেশে যায় নিজেকে বাঁচাতে, এবং ফিরেও আসতে চায় লক আপে হত মানুষটির পুনরুত্থান ঘটিয়ে। মর্গ থেকে বেরিয়ে আসে মৃত। চাপা পড়া খনি থেকে উঠে আসে নিরুদ্দিষ্ট। একটি উপন্যাসই যেন শেষ হচ্ছে না। বারবার লিখতে হচ্ছে নিরুদ্দিষ্টের কাহিনি নানা রকমে।
পুনশ্চ: পশ্চিম আমেরিকার লস এঞ্জেলস থেকে ১৫০ মাইল দূরে যশুয়া বৃক্ষ ন্যাশানাল পার্ক। মরু অঞ্চল। সব নেড়া পাহাড় আর মধ্যম উচ্চতার যশুয়া বৃক্ষ। নিঝুম জনবিরল অঞ্চল। সেখানে একটি উপত্যকার নাম “লস্ট হর্স ভ্যালি” আর রাস্তার নাম লস্ট হর্স রোড। ভানুর ঘোড়া প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে কি সেই মরু অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল হিরোসিমা পার হয়ে? প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারেই তো ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলস আর যশুয়া বৃক্ষের মরু-পাহাড়ের অঞ্চল।