নিরুদ্দিষ্ট
গতকাল মুম্বই এসেছি। এখানে আমার প্রথমবার। আমার চাকরিতে ভারতবর্ষের নানান বড় শহরে ঘোরাঘুরি করতে হয়। মুম্বই বাকি ছিল এতদিন।
আমার পার্সোনাল কার্ডে নামের পরে লেখা আছে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার। মোটেই কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেই আমার। লেগে থেকে এবং দেখে শেখা। পাতি মিস্তিরি। আমাদের কলকাতার অফিস জাপানের এক বড় কোম্পানির ফটোগ্রাফিক মেশিন, ইন্সট্রুমেন্ট আর কেমিক্যালের ডিলার। আমার কাজ মেশিন ইনস্টল করা, সার্ভিস দেওয়া। মুম্বইতে আমাদের মেশিনের খুব একটা চল নেই। কীভাবে যেন একটা অর্ডার পেয়ে গেছে অফিস। আমি এসেছি মেশিন বসাতে।
মুম্বই সম্বন্ধে আমার যা কিছু ধারণা ওই হিন্দি সিনেমার মাধ্যমে। আমি এখন যে জায়গায় আছি, সিনেমায় খুব একটা দেখায় না। এটা হচ্ছে মুম্বইয়ের ‘ভাসি’। রেল স্টেশন কুরলা টার্মিনাস হয়ে আমি এখানে চলে এসেছি। উড়াল পুল দিয়ে সমুদ্র-খাড়ি পার করা হয়নি। দেখা হয়নি পুরনো মুম্বই। এবার হয়তো হবেও না। কাজ আর সময় হিসেব করে অফিস ট্যুরে পাঠায়।
সেক্টর সতেরোর এই জায়গাটা বিজনেস প্লেস। অফিস, রেস্তোরাঁ, দোকানে ছয়লাপ। তবে কোনও হইচই নেই। এখানকার মানুষ খুব কম কথা বলে। গাড়ি করে আসে, দরাদরি না করে জিনিস কেনে, চলে যায়। দোকানদার হাঁকডাক করে না। অদ্ভুত এক শিষ্ট নিস্তব্ধতা। অবশ্য ক্রেতাদের সঙ্গে আসা বাচ্চাগুলো সব জায়গার মতোই দুষ্টু, এরাই এই গম্ভীর পরিবেশের মধ্যে যা একটু রিলিফ।
এখানে আর একটা মুশকিল হয়েছে আমার, মানুষ দেখে চিনতে পারছি না কে কোন ভাষাভাষী। নিজেদের মধ্যে খুব চাপা গলায় কথা বলছে এরা। জোরে যতটুকু বলছে, হিন্দি এবং ইংরেজিতে। দিল্লিতে গিয়েও এমন অসুবিধে হয় না আমার। মানুষের চেহারা দেখেই আন্দাজ করতে পারি, কে সাউথের, কারা নর্থের। বাঙালিকে তো একবার দেখেই চিনে নেওয়া যায়।
নতুন মুম্বই প্ল্যানড সিটি। নগরস্থাপত্য একরকম, এখানকার বাসিন্দারাও এক ধাঁচের হয়ে গেছে। আমেরিকা বা ধনী দেশগুলোয় বোধহয় এমনটা হয়। কিন্তু ওখানে যেটা দেখা যায় না, বাচ্চা কোলে মা ভিখারি, এখানে বড্ড বেশি। কোনও দোকান অথবা রেস্টোরেন্ট থেকে বেরোলেই পিছন পিছন ঘুরছে। এরাও কিন্তু কোনও কথা বলে না। ইশারায় ভিক্ষে চায়।
যাই হোক মোটামুটি দেড় দিনেই নতুন মুম্বইতে আমি যথেষ্ট বোর হয়ে গেছি। তিরিশ ছুইঁদুই ছেলের কি এত গম্ভীর হয়ে থাকা পোষায়! যদিও আমাদের কাস্টমার সর্বদা খেয়াল রেখেছে আমার সুবিধে অসুবিধের ওপর। এখানে এত থাকার জায়গার অভাব, তবু বেশ স্পেসিয়াস রুমওলা হোটেলেই রেখেছে আমায়। হোটেলটা বড় রাস্তার পাশেই। সারা রাত গাড়ি চলে এখানে। গাড়ির আওয়াজে ভাল ঘুম হয়নি।
এখন কাজ করতে করতে চোখ জ্বালা করছে আমার। এসি রুম। প্রবল আলস্য লাগছে। বত্রিশ ঘণ্টার ট্রেন জার্নির ধকল এখনও শরীর ছেড়ে যায়নি। এটা একটা কালার ফটোল্যাব। কালার নেগেটিভ থেকে কম্পিউটারের সাহায্যে ছবি হয়। মেশিনে পাওয়ার সাপ্লাই দেওয়া হয়ে গেছে। আজ শুধু প্রোগ্রামিং করছি। কাল অল্প অল্প করে প্রোডাকশন শুরু হবে।
ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার লম্বা হাই তুলেছি। সেই দেখে ল্যাব মালিক অমিত হুরালি দু’বার চা আনিয়েছেন। স্টিলের বাটির ওপর স্টিলের গ্লাস উলটো করে রাখা, গ্লাসের মধ্যেই আছে চা। ব্যাপারটা বেশ নতুন ধরনের। সব জায়গারই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এদের ল্যাবরেটরিটা একটা বহুতলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কাজ করাকালীন আর একটা ব্যাপারে অবাক হচ্ছি, ওপরতলায় সর্বক্ষণ গুমগুম শব্দে মিউজিক বেজে যাচ্ছে। কী আছে দোতলায়, হোটেল, নাকি বার? তেমন কোনও সাইনবোর্ড দেখিনি বিল্ডিং-এর গায়ে। ল্যাবের রোবট-সদৃশ্য স্টাফদের জিজ্ঞেসও করা হয়নি।
সিগারেট খেতে ল্যাবের বাইরে আসি। ঝাঁ চকচক করছে রোদ। তবে তাপ নেই তেমন। উলটো দিকে আর একটা হাউসিং, শহর দেখার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। এদের ফটোল্যাব বেশ বড় জায়গা জুড়ে। অলরেডি দুটো মেশিন রানিং। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু কাস্টমার। মালিক মিস্টার হুরালি ব্যস্ত হাতে ক্যাশ কাউন্টার সামলাচ্ছেন।
পায়চারি করতে করতে সিগারেট টানছি। এখানেও মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে।
এমন সময় কে যেন পেছন থেকে বলে, আপনি তো কলকাতা থেকে আসছেন, না? পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণ। চমকে ঘাড় ফেরাই। চল্লিশোর্ধ্ব পোড় খাওয়া চেহারা, তিনচারদিনের না কাটা দাড়ি-গোঁফ, চাউনিতে দুঃখী ভাব, মুখে বোকা-মলিন হাসি। ভদ্রলোককে বলি, আপনি বাঙালি?
মাথা হেলান মানুষটা। বলেন, প্রদীপ রায়। আপনি অনিরুদ্ধ মুখার্জি।
অবাক হয়ে বলি, এতসব জানলেন কী করে?
অমিত শেঠ বলল
কে অমিত শেঠ ?
পরিমিত হেসে প্রদীপ বলেন, অমিত হুরালি। এখানে মালিকদের ‘শেঠ’ বলে ডাকাই রেওয়াজ।
ও, তাই বুঝি। বলে, আমি চুপ করে গেলাম। প্রবাসে বাঙালি দেখে হামলে পড়ার আদিখ্যেতা আমার নেই। বহু শহরে ঘুরতে হয় আমাকে। কখনও সখনও এমন প্রাণচঞ্চল বাঙালি জুটে যায়, আড্ডার চোটে কাজের ক্ষতি হয় ভীষণ। এই ভদ্রলোকের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ জাগছে না আমার। কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত চেহারা। কলকাতার কোনখানে থাকা হয়? জানতে চাইলেন প্রদীপ। সৌজন্যর খাতিরে বলতেই হয়, বেলেঘাটা।
বেলেঘাটার কোথায়?
জোড়ামন্দির। আপনি চেনেন?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রদীপ বলেন, কাশীদা এখন কেমন আছেন, আগের মতোই?
এবার আমি সত্যিই চমকাই। লোকটা কাশীদাকে পর্যন্ত চেনে! কাশীদা আমাদের এলাকার বিখ্যাত মানুষ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি, দেখায় পঞ্চাশ। মিলন সমিতির সেক্রেটারি। বৃদ্ধদের জন্য রোড রেস করেন।
প্রদীপবাবুকে বললাম, আপনি তা হলে আমাদের এলাকাটা চেনেন। কখনও ছিলেন নাকি ওখানে?
হ্যাঁ ছিলাম। রাধামাধব দত্ত লেনে আমাদের বাড়ি। নাইনটিন এইট্টি ফোরে বম্বে চলে আসি। তখন মুম্বই নাম হয়নি।
এখন মাঝেমধ্যে যাওয়া হয়, কলকাতায়?
একটু যেন দুঃখের শ্বাস ফেলে মাথা নাড়েন প্রদীপ। তারপর বলেন, সেই যে চলে এসেছি কুড়ি বছর আগে, আর যাওয়া হয়নি।
এরপর অবধারিতভাবে আমার ঠোঁটে ‘কেন’ শব্দটা চলে আসা উচিত। এল না। দুঃখের পাঁচালি শোনার মতো সময় এবং কৌতূহল দুটোই আমার নেই। কিছু বলতে হয় বলেই বললাম, এই ফটোল্যাবের সঙ্গে আপনার কী বিষয়ে যোগাযোগ?
আমি এদের ডেলি-কাস্টমার। আমার একটা স্টুডিয়ো আছে কপারখেরেনায়। স্টুডিয়োতে তোলা ছবি আর কাউন্টারে যেসব ফিল্ম রোল পড়ে, এখানে প্রিন্ট করাতে নিয়ে আসি।
অর্থাৎ মোদ্দা কথা হল প্রদীপবাবু মুম্বইয়ের অতি সাধারণ এক বাঙালি। চেহারা দেখে আন্দাজ করা যায় ওঁর স্টুডিয়ো তেমন জমকালো নয়। কিংসাইজ সিগারেটের শেষাংশ ফেলে দিয়ে ফের ল্যাবের কাচের দরজার দিকে পা বাড়াই।
প্রদীপবাবু বলেন, ক’দিন লাগবে মেশিন ইনস্টল হতে? দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, আর দিন দুয়েক।
মুম্বই এর আগে এসেছেন?
না।
ঘুরবেন না শহরটা?
এবার মনে হয় হবে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসানসোলে মেশিন ইনস্টল করতে হবে। মেশিন এসে বসে আছে ওখানে।
প্রদীপ বলেন, তবু একটু সময় বার করুন। মুম্বইতে অনেক কিছু দেখার আছে। বলেন তো আমি আপনাকে সময় দিতে পারি।
গায়ে পড়া লোক আমার কোনওদিনও পছন্দ নয়। প্রদীপবাবুকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য
বলি, সে কী আপনি ব্যাবসা ছেড়ে আমার সঙ্গে ঘুরবেন! ক্ষতি হবে না আপনার? একটু হয়তো হবে। দোকানে অবশ্য একটা কাজের ছেলে আছে। আপনি আমার পুরনো
পাড়ার মানুষ। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর লোভও সামলাতে পারছি না। না প্রদীপবাবু, এবার সত্যিই হবে না। পরের বার যখন আসব খোঁজ করব আপনার।
আমার কথার পর একটু যেন মরিয়া হয়ে প্রদীপ বলেন, এবারই আপনার মুম্বই দেখা উচিত। এ শহর ভীষণ তাড়াতাড়ি পালটে যায়। পরের বার যখন আসবেন অন্য মুম্বই দেখবেন।
কথাগুলোর সঙ্গে দার্শনিক ছোঁয়া, এই টাচটা বাঙালি মাত্রই মেরে থাকে। হাসি হাসি মুখ করে ল্যাবে ঢুকে যাই।
ক্যাশে বসে থাকা অমিত হুরালি সহাস্য মুখে বলেন, আচ্ছা হুয়া, এক বাঙালিবাবু মিলা আপ কো।
হাঁ, বাঙালি হর জাগাহ মিলতে হ্যায়।
আমার কথার পরেই গলা নিচু করে মিস্টার হুরালি বলেন, লেকিন থোরা বাঁচকে। ইয়ে আদমি থোরা কমপ্লেক্স ক্যারেক্টার কা হ্যায়।
‘সে আমি বুঝতেই পেরেছি’ টাইপের মুখভঙ্গি করে, চলে যাই মেশিনের সামনে। মাথার ওপর চাপা মিউজিক বেজেই চলেছে। আবার সেই একঘেয়ে অ্যাটমসফিয়ার। একটু যেন খারাপ লাগে প্রদীপবাবুর জন্য, ভদ্রলোক হয়তো পুরনো পাড়ার গন্ধ নিতেই আমার কাছে এসেছিলেন। অনুজ্জ্বল মানুষ বলে এড়িয়ে গেলাম। যদি সফল, প্রতিষ্ঠিত বাঙালি হতেন, গুরুত্ব দিতাম অবশ্যই। আমারও বোরিংনেসটা কাটত। আর মিস্টার হুরালির সতর্কবাণী আমি গ্রাহ্য করি না, বাঙালিকে চেনা অত সহজ নয়।
আমাকে হেল্প করার জন্য ল্যাবের একটা ছেলে সবসময়ই মেশিনের পাশে আছে। নাম সুমন গুরুং। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়ে মিউজিক হর টাইম কিঁউ বাজতা হ্যায়? ক্যায়া হ্যায় উপর মে?
সলজ্জ ভঙ্গিতে সুমন বলে, বার হ্যায় স্যার। লেডিস বার।
ব্যাপারটা কেমন যেন শোনা শোনা লাগে। ‘লেডিস বার’ নিয়ে কোনও একটা সিনেমা এসেছিল কলকাতায়। দু’-একজনকে আলোচনা করতে শুনেছি। বিষয়টার মধ্যে কোথাও একটু নিষিদ্ধতা আছে মনে করে কথা বাড়ালাম না। কৌতূহল দেখালেই এদের কাছে আমার এবং কোম্পানির ইমেজ নষ্ট হবে। ফের ডুবে গেলাম কাজে।
সন্ধে প্রায় সাতটা। আজকের সিডিউল অনুযায়ী কাজ অনেকটা মেরে এনেছি। আর ঘণ্টাখানেক চেপে কাজ করার পর হোটেলে ফিরে যেতে পারব। কিন্তু তারপর কী! জায়গাটা বড্ডই নির্বান্ধব লাগে। অন্য যে-কোনও শহরে মেশিন বসাতে গিয়ে দেখেছি, পার্টি, ল্যাব ম্যানেজার বন্ধুর মতো হয়ে যায়। কাজের পর তাদের সঙ্গে আড্ডা, কখনও সখনও সামান্য মদ্যপান। কোথা দিয়ে যেন কেটে যায় সময়। তুলনায় এখানকার মালিক অনেক প্রফেশনাল, দরকার ছাড়া কথাই বলছে না। স্টাফগুলোও হয়েছে একই রকম।
একটানা কাজ করতে করতে একটু যেন দমবন্ধ লাগে। হাওয়া খেতে বাইরে বেরোই। গলির ফালি আকাশে এক পোঁচ গোধূলির রং। এখানে সন্ধে হয় অনেক দেরিতে। সার সার দোকানে জ্বলে উঠেছে ফ্লুরসেন্ট আলো। এই ল্যাবের বাইরে কাস্টমারদের জন্য সোফা পেতে দেওয়া হয়েছে, এখানেই বসে পড়ি। গলি বরাবর দেখতে পাই সুবেশ সুবেশাদের সাবলীল পদচারণ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গলি জুড়ে এসে দাঁড়াল টাটা সুমো। গাড়ি থেকে নেমে আসে অতিসাজের গোটা ছয়েক মেয়ে। মেয়েগুলো কেউ শ্যামলা, কেউ বা ফরসা। চারজন স্বাভাবিকের সঙ্গে দুটি মঙ্গোলয়েড মুখ। মিল একটাই, এরা সবাই যেন সিনেমার গ্রুপ নাচের দৃশ্য থেকে নেমে এল। এদের হাবভাব ছটফটে, কেমন যেন অন্যরকম। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে ঢুকে গেল ল্যাবের হাউসিং-এ। কোথায় গেল এরা? এরা কারা? কিছুই বুঝতে পারছি না। টাটা সুমো ব্যাক গিয়ারে বেরিয়ে যায় গলি ছেড়ে।
বিস্মিত হয়ে বসে আছি, হঠাৎ দেখি সকালের বিষণ্ন চিত্রগ্রাহক, মানে প্রদীপবাবু ঢিমেতালে হেঁটে আসছেন ল্যাবের দিকে। সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আজকের মতো কাজ শেষ হল আপনার?
না, এখনও হয়নি। আর ঘণ্টাটাক বাকি আছে।
তারপর কী করছেন?
লোকটা আবার আমার পিছনে ভিড়তে চাইছে। সতর্ক হয়ে বললাম, হোটেলে ফিরে গিয়ে অফিসের কিছু পেপার্স রেডি করতে হবে।
একটু যেন হতাশ হলেন প্রদীপ। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। সামান্য আহত হয়েছেন সম্ভবত। উপেক্ষা করছি, বুঝতে অসুবিধে হয়নি ওঁর। সৌজন্য রক্ষার্থে কথা চালাই, এখন আবার এলেন, কী ব্যাপার?
ওই, সকালে যে কাজগুলো দিয়ে গিয়েছিলাম, এলাম ডেলিভারি নিতে। বলে, আবারও থম মেরে গেলেন। অথচ যাচ্ছেন না সামনে থেকে। কী মনে হল, একটু আগের সামান্য কৌতূহলটা না হয় ওঁর কাছেই মিটিয়ে নিই। তাই বললাম, আচ্ছা প্রদীপবাবু একটু আগে একদল হেভি ড্রেস করা মেয়ে গাড়ি থেকে নামল। তারপর চলে গেল এই বাড়িটার মধ্যে…
কথার মাঝেই চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে প্রদীপবাবুর। বলে ওঠেন, ওসব লেডিস বার-এর মেয়ে। এই ল্যাবের ওপরেই বার। আপনি যাননি এখনও!
বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়ে বলি, আমি হঠাৎ যাব কেন?
না, আমি ভাবলাম অমিত শেঠ নিশ্চয়ই আপনাকে নিয়ে গেছে। নিজে তো রোজ যায়। ওই যে দেখছেন এত মন লাগিয়ে কাজ করছে, রাত দশটা বাজলেই লোকটা পালটে যাবে। সোজা উঠে পড়বে দোতলার লেডিস বার-এ। দিনের হাফ রোজগার ওখানেই শেষ।
এবার সত্যিই বিষয়টা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। জানতে চাই, ‘লেডিস বার’ ব্যাপারটা ঠিক ওখানে শুধু মেয়েরা ড্রিঙ্ক করে? তা হলে অমিত শেঠ কীভাবে যায়!
কী বলুন তো? কি মাথা নাড়েন প্রদীপ। আলাপ গড়াচ্ছে বুঝে একটু ঝরঝরে হয়েছেন। বলেন, আপনি ‘চাঁদনি বার’ সিনেমাটা দেখেননি?
না। তবে কলকাতায় মোটামুটি সাড়া ফেলেছিল সেটা বুঝেছি।
তা হলে কিন্তু আপনার স্বচক্ষে একবার দেখা উচিত। সুযোগ যখন আছে।
কিন্তু বিশেষ কী আছে দেখার? জানতে চাই।
বেশ উৎসাহ নিয়ে প্রদীপ বলেন, অনেক কিছু আছে, অনেক। মুম্বইয়ে টাকা কীভাবে ওড়ে দেখবেন। ইন্ডিয়ার নানান স্টেট থেকে, পাশের দেশ থেকে পালিয়ে আসা, পাচার হওয়া মেয়েদের দেখতে পাবেন একসঙ্গে। ওরা নাচবে। তবে খুব দাম নেবে এক বোতল বিয়ারের। ওই বিয়ারটাই আধঘণ্টা ধরে খাবেন আর দেখবেন মজাটা।
টাকা ওড়ার ব্যাপারটা তো ক্লিয়ার হল না।
সে আপনাকে ওড়াতে হবে না। গেলেই সব বুঝতে পারবেন। দারুণ এক্সপেরিয়েন্স হবে আপনার।
একটু থেমে আমার মুখটা পড়ার চেষ্টা করছেন প্রদীপ। নিজের মতো বুঝে নিয়ে বললেন, চলুন না এমনি কোনও রিস্ক নেই। এখানকার অনেকেই যায়। তা ছাড়া আমি তো সঙ্গে আছি।
যাওয়ার যে ইচ্ছে করছে না তা নয়। ব্যাপরটা নানাভাবে ইন্টারেস্টিং। পালিয়ে আসা মেয়েরা নিশ্চয়ই সিনেমার নায়িকা হতে এসেছিল। পাচার হওয়া অথবা বিক্রি হয়ে যাওয়া মেয়েরা কি আগের জীবনের থেকে ভাল আছে? কে জানে! প্রতিদিনের এই উৎসব নিয়ে শহরের কোনও গোপনীয়তা নেই। বিষয়টা নিশ্চয়ই লাইসেন্সড। আশা করি কোনওভাবে ফেঁসে যাব না। প্রবাসী বাঙালি প্রদীপবাবুই বা আমাকে কেন মিসগাইড করবেন।ভাবনার সঙ্গেই খেয়াল করলাম প্রয়োজনে মলিন বাঙালিকে আমি বেশ পাত্তাই দিচ্ছি।
কী হল, যাবেন তা হলে? আগ্রহভরে জানতে চাইলেন প্রদীপ।
ঠিক আছে যাব। তবে আধঘণ্টার বেশি নয় এবং এই বারে তো নয়ই। অন্য কোনও বার চেনা আছে আপনার?
আরে, দু’পা গেলে আর একটা বার। কোথায় যেতে চান? এখানকার সব বার আমার ঘোরা। আপনি তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিন, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। বুকের মধ্যে সামান্য ধুকপুকুনি নিয়ে ফিরে গেলাম কাজে। কী জানি, ঠিক করছি তো?
মিনিট দশেকের মধ্যে বুঝে গেলাম ‘লেডিস বার’ ব্যাপারটা কী। আমি আর প্রদীপবাবু এখন ‘খোয়াব’ নামের একটা বার-এ এক বোতল করে বিয়ার নিয়ে বসে আছি। ঘরটা খুব বড় নয়। দেওয়াল ঘেঁষে হাফরাউন্ড ডান্সিং ফ্লোর। সেখানে সাত-আটটা মেয়ে একসঙ্গে নাচছে। এরা যে সবাই নৃত্যপটিয়সী তা নয়। মিউজিকের সঙ্গে শরীর সংগত করছে বলা যেতে পারে। ঘরের কোণে বিশাল সাউন্ড সিস্টেম অপারেট করছে টুপি পরা উদাসীন এক যুবক। মিউজিকের মধ্যে বিটটাই বাজছে জোরে সুর পড়ে থাকছে তলায়। রিমিক্স নিশ্চয়ই। গানগুলো সবই সদ্য-হিট করা হিন্দি সিনেমার।
মেয়েগুলোর পোশাক খুব যে অশালীন তা নয়। দু’-একজনকে তো বেশ শ্লীলই বলা যায়। পোশাকে এক ধরনের রাজনর্তকীর ভাব নিয়ে এসেছে। ক্রমান্বয়ে নেচে যাচ্ছে এরা।
ক্লান্ত হয়ে দু’-তিনজন ভেতরের ঘরে চলে গেলে, যোগ দিচ্ছে নতুন মেয়ে।
মদ্যপায়ীদের দিকে বিশেষ ভ্রূ-ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে মেয়েগুলো। টেবিলের কাস্টমার নির্ভুল ইশারায় ডাকছে পছন্দমতো মেয়েকে। নাচ ভেঙে এগিয়ে আসছে মেয়ে, লোকটি দশ অথবা বিশ টাকার নোট দেয় তার হাতে। অনেকটা প্যালা দেওয়ার মতো আর কী! মেয়েটি যখন একই কাস্টমারের কাছে বারবার টাকা পায়, খুশি হয়ে চুমু দেয় হাতে অথবা ঝুঁকে পড়ে কানে কানে কিছু বলে। পুরুষটি ঘনিষ্ঠ হতে গেলেই, অদ্ভুত ছলনায় পালায়। এরকমই ঘটে চলেছে টানা।
হঠাৎ প্রদীপ আঙুল তুলে বলেন, ওই দেখুন, টাকা উড়ছে। আঙুল বরাবর দেখি, প্রদীপবাবুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে, একটা মোটা মতো বেসামাল লোক গলায় সোনার ভারী চেন, টাকার বান্ডিল ভেঙে উড়িয়ে দিচ্ছে ডান্স ফ্লোরে। মেয়েগুলো কুড়োচ্ছে না, একজন ওয়েটার নোট তুলে থালায় রাখছে।
প্রদীপবাবুকে বলি, এখানে তো মারাত্মক গন্ডগোল লেগে যেতে পারে। মাতালটা যদি কোনও একটা মেয়েকে ধরে টানাটানি করে, পেতে চায়। এত খরচা করছে যখন…
মাথা খারাপ আপনার! সেসব ব্যবস্থা করা আছে। বেশি কিছু করতে গেলেই, আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে বার মালিকের পোষা গুন্ডা। মেরে কাস্টমারকে ছুড়ে ফেলে দেবে রাস্তায়।
কথাটা শোনার পর আমি মেয়েগুলোর থেকে চোখ সরিয়ে নিই। এদিকে প্রদীপ বলে যাচ্ছেন, ওই যে দেখুন, যে দুটো মেয়ে বাঁ সাইডে নাচছে, লেহাঙ্গা চোলি আর জিনস্ শর্ট টপ, ও দুটো অমুক রাজ্য থেকে আসা। ওর পাশে ওই যে শাড়ি পরা মেয়েটা, আপনার বাঙালি বলে মনে হতে পারে, সে কিন্তু আসলে অমুক দেশের। সামনের দিকেরটা শিয়োর ওয়েস্টবেঙ্গলের। মুখের কাটিং দেখেছেন?
আমি বলি, আপনি এত কী করে শিয়োর হচ্ছেন?
আত্মবিশ্বাসী হাসি হাসেন প্রদীপ। বলেন, কতদিন হয়ে গেল বলুন তো মুম্বইতে! এমনই কপাল এখানকার খারাপ দিকটাই চিনলাম বেশি।
আমাদের বিয়ার শেষ হয়ে এসেছে। অনাস্বাদিত এই মাদকতাময় পরিবেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রদীপবাবুকে বলি, আর একটা করে বিয়ার নেওয়া যাক, নাকি? আপনি কি বিয়ে করেছেন? জানতে চান প্রদীপ।
না, কেন?
তা হলে এটা খেয়েই উঠে পড়ুন। নইলে নজর খারাপ হয়ে যাবে। ঘরোয়া মেয়েতে মন উঠবে না।
প্রদীপবাবুর এ হেন মাস্টারমশাইগিরি দেখে একটু অবাকই হলাম। বোতলের বাকিটুকু শেষ করে, বিল মেটালাম বেয়ারা ডেকে। প্রদীপবাবু বাধা দিলেন, ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল সেটা নেহাতই অভিনয়।
বার থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা। রাত দশটা। আলো ঝলমলে রাস্তা। গাড়ি, মানুষজন কলকাতার তুলনায় অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল। মাথায় এখনও বাজছে লেডিজ বার-এর
মিউজিক। চোখের পাতা ফেললেই ভেসে উঠছে আলোকসম্পাতে বর্ণিল মেয়েরা। প্রদীপবাবুকে বলি, নিয়ে যখন গেলেনই, হঠাৎ উঠে এলেন কেন?
পথ চলতে চলতে প্রদীপ বলেন, আপনার ভালর জন্যই। আমার জীবনের গোল্ডেন টাইমটাই খেয়ে নিয়েছে ওই লেডিস বার।
ঠিক বুঝলাম না!
বলব। আছেন তো দু’দিন। আবার দেখাও হবে। কাল একবার আসুন না আমার স্টুডিয়োতে। কাছেই তো, সেক্টার টুয়েন্টি টু। স্টুডিয়ো পুষ্পিতা। যে-কোনও অটোওলাকে বললেই নিয়ে যাবে।
রাস্তা পেরিয়ে আমরা অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছি। প্রদীপ বললেন, চলুন, আপনাকে হোটেলে নামিয়ে দিই, তারপর এটা করেই বাড়ি চলে যাব।
অটো চলতেই রিমিক্স ক্যাসেট চালু হল। সেই জোরে বিট, কণ্ঠ অনেক নীচে। এখানে বোধহয় এরকমটাই চলে।
ভীষণ ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হল রাতে। প্রদীবাবু সত্যিই খুব রহস্যজনক মানুষ। কেন আমার পিছনে পড়ে আছেন, কেনই-বা নিয়ে গেলেন লেডিস বার-এ! আবার বলছেন ওখানে ওঁর গোল্ডেন টাইম নষ্ট হয়েছে। বার-এর মেয়েদের দেখে কনফিডেন্টলি বলে দিতে পারছেন, কে কোন রাজ্যের, দেশের… আশ্চর্য লোক। কাল রাতে যতবারই ঘুমে চোখ বুজে এসেছে, মানসপটে দেখা দিয়েছে লেডিস বার-এর ডান্সিং ফ্লোর। স্বপ্নে কিন্তু সেখানে একটাই মেয়ে। শ্যামলা মতন, পরনে ছেঁড়া মলিন ফ্রক। তীব্র আলোর ঝলকানি পড়ছে তার শরীরে। যেন রঙিন বিদ্যুচ্চমক। কান ফাটানো মিউজিক, নাকি ত্রিতাল সহ বজ্রপাত। মেয়েটি আনাড়ি পা ফেলছে, মনে পড়ে যাচ্ছে তার দেশ গাঁয়ের বর্ষাকালের কথা, বন্যার স্মৃতি। কিছুতেই ঠিকঠাক নাচতে পারছে না মেয়েটা। স্বপ্নের মধ্যেই আমার টেনশান হচ্ছে, মেয়েটাকে আমি চিনি, ও থাকত হয়তো বনগাঁয় অথবা বেলেঘাটায়, নাকি জৌগ্রাম… বারবার ভেঙে যায় ঘুম।
ভোর হয় একসময়। দেখি, কী বিস্তৃত লালচে আকাশ! কলকাতার আকাশ এত বিশাল নয়। মুম্বইয়ের গায়েই সমুদ্র। তারপর মরুভূমি। তারই অনুষঙ্গ বহন করছে এই সীমাহীন অন্তরীক্ষ। এখানে হারিয়ে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামের, বিবর্ণ শহরের দুঃখিনী মেয়ে। কেন জানি না বেখাপ্পা সময়ে জীবনানন্দ মনে পড়েছিল— একদিন অমরায় গিয়ে/ ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/ বাংলার নদী মাঠ ভাঁটাফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।
তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে আমি বেরিয়ে পড়েছি হোটেল থেকে৷ অটোয় চেপে যাচ্ছি প্রদীপবাবুর স্টুডিয়োতে। প্রদীপ ওই মেয়েগুলোর সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানেন। অটোরিকশায় উঠতেই ড্রাইভার রেকর্ডার অন করেছিল, আমি বন্ধ করতে বলেছি।
এসে গেলাম মনে হচ্ছে। অটো স্টার্ট থামিয়েছে। জায়গাটা ল্যাব এলাকার মতো ঝকমকে নয়, এখানকার মধ্যবিত্ত বসতি এলাকা। অটোওলাকে পয়সা মিটিয়ে নেমে আসি। কাউকে
জিজ্ঞেস করতে হয় না, ফুটপাতে দাঁড়িয়েই দেখতে পাই ‘স্টুডিয়ো পুষ্পিতা’। যেমনটা ভেবেছিলাম, প্রদীপবাবুর মতোই চেহারা দোকানটার। কাউন্টারে বসে রিটাচ করছেন প্রদীপ। পাশে দাঁড়িয়ে আছে সম্ভবত ওঁর কাজের ছেলে।
আমাকে দেখে হইহই করে উঠলেন প্রদীপবাবু, আরে, আপনি! আমার কী সৌভাগ্য! তাই বলি, বাঙালির জন্য বাঙালির মন কাঁদবে না, তা কি হয়!
মুখে একটা নকল হাসি লাগিয়ে রাখি। এইসব সেন্টিমেন্ট আমাকে বিশেষ ছোঁয় না। কাউন্টারের ভেতরের চেয়ারে বসে বলি, আজ খুব একটা কাজ নেই। চলে এলাম আড্ডা মারতে।
ভাল করেছেন। বেশ করেছেন। আমি হয়তো আর একটু পরের ল্যাবের দিকে যেতাম। আপনার জন্যই, কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে। খুব দরকারি, পার্সোনাল কথা। বলে, প্রদীবাবু কাজের ছেলেটাকে বললেন, যা প্রতাপ, দো স্পেশাল চায়ে বোল।
ছেলেটা চলে যেতে বললাম, কী কথা?
সে পরে বলছি। আজ যাবেন তো? চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলেন প্রদীপ। বুঝতেই পারলাম কোথাকার কথা বলছেন।
মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। তারপর গেলাম আমার আসল প্রশ্নে, আচ্ছা প্রদীপবাবু, আপনি কাল যেন কী বলছিলেন, আপনার সুবর্ণসময় নষ্ট হয়েছে…
হ্যাঁ, লেডিস বার-এ। বলে, থামলেন প্রদীপ। চা এসে গেল। চুমুক দিতে দিতে ওঁর দৃষ্টি হল অতীতচারী। বলতে শুরু করলেন, কলকাতায় কাকার দোকানে ফটোগ্রাফির কাজ শিখতাম। বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। চেনা সূত্রে চলে এলাম মুম্বই। এখানে এক ফটোর দোকানেই কাজ করতাম। কয়েক বছর যেতেই এই স্টুডিয়োটা নিলাম নিজে। তখন স্টুডিয়োর রমরমা বাজার। হাতে প্রচুর কাঁচা পয়সা আসতে লাগল। আর মাথার ওপর কোনও গার্জেন না থাকলে যা হয়, কুইক বখে গেলাম। তবে পাতি বাঙালি তো, লেডিজ বার-এ দৌড় শেষ। প্রেমে পড়লাম বাঙালি নাচনেওয়ালির। এখানে বলে বারওয়ালি। রোজ যেতাম ওই বার-এ। দেদার টিপস দিতাম ওকে। মেয়েটা কিন্তু ভাল ছিল জানেন, পরের দিকে বেশি টিপস দিতে গেলে, এড়িয়ে যেত। সে জন্য দু’-একবার মার খেল মালিকপক্ষের কাছে। মালিক তো ওদের থেকে কমিশন পায়।— থামলেন প্রদীপ। কাজের ছেলেটা কখন জানি আমাদের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে গল্প শুনছে। ওকে ধমকে উঠলেন প্রদীপ, এ পিল্লে, ক্যায়া শুন রাহা হ্যায়? কাম পে যা।
ছেলেটার মুখে অসন্তোষ। চলে গেল ভেতরে। প্রদীপ ফের শুরু করলেন, যা বলছিলাম, মেয়েটার প্রেমে এত বিভোর আমি, কলকাতার বাড়ি থেকে চিঠি আসে, জানি কী লেখা থাকবে। টাকা পাঠাও। না পড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিই।
বহু চেষ্টায় অমুক দাদা, তমুক মাসিকে ধরে টাকা খাইয়ে মেয়েটাকে চক্কর থেকে বাইরে নিয়ে আসি। তারপর গণেশমন্দিরে গিয়ে বিয়ে করি। কিন্তু হলে কী হবে, মেয়েটাকে নিয়ে যখনই কোনও বাজার হাটে, পার্টিতে যাই কেউ না কেউ চিনে ফেলে। ওকে দেখতে ভিড় হয়ে যায়। আবার অন্য একটা সমস্যাও শুরু হয়, মেয়েটার সংসার করার অভ্যাস
নেই, ঘরে মন বসে না। স্কুটারে চাপিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাই, পিছন পিছন দেখি, অন্য বাইক, স্কুটার আমাদের ফলো করে আসছে। মেয়েটাই হয়তো ইশারা করত। স্বভাব যাবে কোথায় বলুন!— একটু দম নিলেন প্রদীপ। তারপর বললেন এক সময়ে ফেডআপ হয়ে ভাবলাম কলকাতায় ফিরে যাব। ফোনে কলকাতার এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে জানলাম, বাড়ি কবেই বিক্রিবাট্টা করে যে যার কেটে পড়েছে। হয়তো আমাকে ইনটিমেশন দিয়েছিল চিঠিতে, আমি সে কবেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। এদিকে বউয়ের নানান বায়নাক্কায় আমি তো জেরবার। আজ এটা দাও, কাল ওটা দাও। আমাকে একেবারে ছিবড়ে করে দিয়ে হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে গেল। কোথাও পেলাম না জানেন। প্রত্যেকটা বার-এ ঢুঁ মারলাম। খোঁজপাতি করলাম প্রচুর। পুরো ভ্যানিশ! আমার মনে হয় ও আরব চলে গেছে।— থামলেন প্রদীপ। আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, স্টুডিয়োর শো বোর্ডে বিভিন্ন ভঙ্গিতে এই যে আশি ভাগ ছবি একটি মেয়েরই, এই সেই মেয়ে। আমি বোর্ডের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছি দেখে, প্রদীপ বলেন, ভাল ছিল না দেখতে?
হ্যাঁ, সত্যিই সুন্দরী। তবে আপনার ছবি তোলার হাতটাও নেহাত খারাপ নয়। বললাম আমি। একই সঙ্গে আমার খেয়াল হল, কাল হয়তো প্রদীপবাবু মেয়েটাকেই খুঁজতে লেডিস বার-এ গিয়েছিলেন। এখন সামর্থ্যে কুলোয় না, তাই ধরেছিলেন আমাকে।— ভাবতে ভাবতেই মনে হল বিষয়টা বড্ড দুয়ে দুয়ে চার করে দিচ্ছি। সিনেমার প্লটের মতো। এভাবে দেখাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। প্রদীপবাবুকে বলি, স্টুডিয়োর নামকরণ কি ওই মহিলার নামেই?
না। আমার মায়ের নামে। মা মারা যাওয়ার পর যেতে পারিনি কলকাতায়। বাড়ির লোক ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, পায়নি আমাকে। অশৌচ পালন করা হল না। প্রায়শ্চিত্য বলতে ওই নামটুকুই। লিজ নেওয়ার সময় নাম ছিল ‘সান স্টুডিয়ো’। লিজ টাইম একই রইল, নাম পালটাতে নিল বিশ হাজার। ধরে নিলাম শ্রাদ্ধ-শান্তিতেই খরচা করলাম।— আবার চুপ করে গেলেন প্রদীপ। এখন পর্যন্ত একটাও কাস্টমার আসেনি স্টুডিয়োতে। বাইরে রোদ বাড়ছে। উঠব উঠব ভাবছি। এমন সময় হঠাৎ আমার হাত দুটো ধরে প্রদীপ বলেন, দেখুন না, কলকাতায় আমার জন্য কিছু একটা চাকরি বাকরি। ভীষণ কলকাতায় ফিরে যেতে মন চায় আমার। এখানে আমার কে আছে বলুন!
আচমকা প্রস্তাবে থতমত খেয়ে গেলাম। সামলে নিয়ে বলি, ছোট হলেও এখানে তো আপনার একটা এস্টাব্লিশমেন্ট আছে। এসব দুম করে ছেড়ে আপনি যাবেন কী করে! তা ছাড়া এই বয়সে নতুন করে কী চাকরি পাবেন কলকাতায়! চাকরির বাজার তো জানেন।
জানি। তাই তো আপনাকে ধরেছি। আপনি তো আমার লাইনের ওপরের দিকের লোক।
ইচ্ছে করলেই পারবেন কিছু একটা করতে। এখানকার পাট চোকাতে আমার আধঘণ্টা লাগবে। বলতে হয় বলেই বললাম, দেখি, কী করা যায়। হাত ছাড়লেন প্রদীপ। কাউন্টারের ড্রয়ার টেনে কার্ড বার করে আমার হাতে দিলেন। বললেন, এতে আমার নাম-ঠিকানা সব আছে। কলকাতায় ফেরার পথে ট্রেনের জানলা দিয়ে ফেলে দেবেন না। আমি তো আপনারই পাড়ার অসহায় এক দাদা।
শেষ কথাটায় কান্নার ছোঁয়া লাগল। উঠে পড়লাম চেয়ার ছেড়ে। বললাম, এবার যে ফিরতে হবে।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলে, আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন প্রদীপ। আমার জন্য অটো ডেকে দিয়ে বললেন আমি বেলার দিকে ল্যাবে যাচ্ছি, দেখা হবে।
পরের দিন সকাল। আজ আর মেশিনের কোনও কাজ নেই। কাল রাত জেগে সব কমপ্লিট করে দিয়েছি। আজই আমার ফেরার টিকিট। কাল বিকেলের দিকে ল্যাবে প্রদীপ এসেছিলেন। উনি থাকাকালীন আমি বাইরে যাইনি। কাচঘরের ভেতর থেকে উইশ করেছি। ওঁকে এড়িয়ে যাওয়াই উদ্দেশ্য। তারপর কখন যে চলে গেছেন জানি না। কিন্তু আমার মাথা থেকে উনি যাননি। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ মনে পড়ল, আমাদের কেমিক্যাল সেকশানের চক্রবর্তীবাবু, ম্যানেজমেন্টের কাছে অনেকদিন ধরেই একজন ফটোগ্রাফির কাজ জানা অ্যাসিস্ট্যান্ট চাইছেন। তুচ্ছ চাওয়া। ম্যানেজমেন্টের খেয়ালই থাকে না। আমার পদের ওজন বেশি, ফোর্স করলে রাজি হয়ে যাবে বড়সাহেবরা। তখন প্রদীপবাবুর নাম সুপারিশ করব। খবরটা জানানোর উদ্দেশ্যেই এখন অটো চেপে চলেছি প্রদীপবাবুর স্টুডিয়োতে৷ ওঁকে তৈরি থাকতে বলতে হবে, কলকাতা থেকে যখনই আমি সিগনাল দেব, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন চলে আসেন।
স্টুডিয়োতে এসে দেখি, শুধুই ওঁর কাজের ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম, মালিক কাঁহা হ্যায়? শেঠ আভি তক আয়ে নেহি। সায়দ ঘর পে হোঙ্গে। ওরে বাবা, এই ছেলেটার কাছে আবার প্রদীবাবু শেঠ! যাই হোক, ছেলেটার কাছে জানতে চাই, উনকা ঘর কাঁহা? আইরোলি মে। ইঁহা সে থোড়া দূর যানা পড়েগা।
তুম জারা অটো ড্রাইভার কো পাতা বাতা দো।
ছেলেটা তাই করে। স্টুডিয়ো থেকে ফিরে আসার আগে আর একবার সেই মায়াবিনীর ছবিগুলোর দিকে তাকাই, হাসিটা সত্যিই ভয়ংকর সুন্দর।
আমি এখন এক অন্য মুম্বইতে। সরু গলি, টিনের চাল অথবা অ্যাসবেসটাস দেওয়া বাড়ি, ছোট ঘুপচি দোকান, অনুজ্জ্বল পোশাকের মানুষ, উদোম বাচ্চা, খোলা নর্দমা। হামেশাই মুরগি বেড়াল পারাপার করছে রাস্তা। অবিকল বেলেঘাটার খালপাড়ের বস্তি।
অটোওলা দূর অবধি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, স্যার, এহি আশপাশ কঁহি হোগা। কিসিকো পুছ লিজিয়ে।
সামনে দিয়ে এই বসতির সঙ্গে মানানসই লোক যাচ্ছিলেন, প্রদীপবাবুর কথা বলতেই, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন বাড়ি। অটোর ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম।
অন্যান্য বাড়ির গড়নেই একতলা বাড়ি। বারান্দায় উঠে দরজার কাছে যেতে দেখি, লোহার হুড়কো টানা। তার মানে বাড়ি নেই। কী আর করি, স্টুডিয়োয় ফিরতে হবে। মিছিমিছি অটোটা ছেড়ে দিলাম।— এসব ভাবতে ভাবতে নেমে আসছি বারান্দা থেকে, পিছনে নারীকণ্ঠ, এ মিস্টার, আপ কিসকো মাঙতা?
ঘাড় ফেরাতে দেখি, এই বাড়িরই জানলায় এক মহিলা। বলি, ক্যায়া ইয়ে প্রদীপ রায়কা ঘর…
কথা থেমে যায় আমার। মহিলাকে চিনতে পারি। এঁর ছবিই স্টুডিয়োর শো বোর্ডে লাগানো আছে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। সমস্ত ভাবনা-চিন্তা গুলিয়ে যায় আমার। মহিলা বলেন আইয়ে না সাহাব, প্রদীপ আভি আ যায়েঙ্গে।
লেকিন আপকা দরওয়াজা তো বাহার সে বন্ধ হ্যায়।
তো ক্যায়া, আপ খোলকে আ যাইয়ে।
কেমন যেন সম্মোহিতের মতো দরজা খুলতে যাই। রাস্তা থেকে পুরুষ কণ্ঠ বলে ওঠে, ও শেঠ, ক্যায়া কর রঁহে আপ!
পিছন ফিরি। দেখি, সেই লোকটা, একটু আগে যে প্রদীপবাবুর বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিল।
লোকটা সতর্ক করার সুরে বলে, রায়কি বিবি পাগল হ্যায়। ইসি লিয়ে তো রায় বন্ধ করকে রাখতা হ্যায় উসকো। রায় এহি কহি হোগা আশপাশ। ইসি লিয়ে তালা নেহি মারা। আপ থোড়া ইন্তেজার কিজিয়ে। চাহিয়ে তো উহ দুকান পর যা কে…
বলা শেষ হয়নি লোকটাকে তারস্বরে গাল পাড়তে থাকেন প্রদীপবাবুর স্ত্রী। আমি ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
পরিস্থিতি আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে লোকটা চলে যায়। মহিলা আমাকে কাতর অনুরোধ করতে শুরু করেন। বারবার বলেন দরজা খুলে দিতে। আমি হিন্দিতে বলি, ঠিক আছে, আমি বারান্দায় বসছি, প্রদীপবাবু আসুক তারপর যা ব্যবস্থা হওয়ার হবে।
প্রত্যুত্তরে মহিলা হিন্দিতে বলেন, প্রদীপ ওঁকে কিছুতেই ছাড়বে না। প্রদীপ নিজেই একটা পাগল… এসব কথার মাঝে আমার হিন্দি উচ্চারণের কারণেই সম্ভবত মহিলা আন্দাজ করলেন আমি বাঙালি। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলেন, আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন, না? দাঁড়ান, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই। মহিলা জানলা থেকে অদৃশ্য হলেন। সেই ফাঁকে আমি একটা ছোট্ট কাজ করে পালিয়ে এলাম।
আমি এখন কলকাতাগামী ট্রেনে, প্রিয় মুম্বইবাসী আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনাদের প্রতি আমি একটা অন্যায় কাজ করেছি। যে মুহূর্তে মহিলা জানলা থেকে অদৃশ্য হয়েছিলেন, আমি বারান্দায় উঠে অর্গলটা আস্তে করে খুলে দিই, দরজাটা যেমনকার ভেজানোর তেমনই থাকে। প্রদীপবাবু, নাকি ওই মহিলা, কে যে অপ্রকৃতিস্থ আমি জানি না। তবে দু’জনেই অসফল, অসহায় বাঙালি। আপনাদের বৈভব, বৈচিত্র্যে ভরা শহরে ওরা ফের মিশে যাবে। একটু মানিয়ে নেবেন প্লিজ।
শারদীয় দেশ, ২০০৪