নিরুত্তর

নিরুত্তর

উত্তরাঞ্চলের একটি শহরে আমি কিছুদিন বাস করিয়াছিলাম। গঙ্গার তীরে শহর। বাঙালী দু’চার ঘর আছেন। আমার কিন্তু কেবল একটি বাঙালীর সহিত ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল, তাঁহার নাম নৃসিংহ পাল। আমার বাসার পাশেই ছোট একটি বাড়িতে বাস করিতেন।

নৃসিংহবাবুর মতো এমন কদাকার চেহারা খুব কম দেখা যায়। গোরিলার মতো পাশবিক একখানা মুখ, ছোট ছোট ক্রূর চক্ষু; মাথার চুল পাকিয়া শাদা হইয়া গিয়াছে, তবু শোরকুচির মতো খাড়া হইয়া আছে। বয়স বোধ হয় ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু শরীর অসুরের মতো নিরেট। প্রথম যেদিন তাঁহাকে দেখি, আমার হৃৎপিণ্ড সত্রাসে লাফাইয়া উঠিয়াছিল।

তাঁহার চেহারার জন্যই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, বেশি লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা ছিল না। তিনি সকালে ও সন্ধ্যায় দুইবার গঙ্গাস্নান করিতে যাইতেন, তা ছাড়া আর বাড়ির বাহির হইতেন না। তাঁহার বাড়িতে অন্য কাহাকেও আসিতে দেখি নাই। কেবল খোঁড়া মানিক নামক এক ব্যক্তি রাত্রির অন্ধকারে গা-ঢাকিয়া মাঝে মাঝে আসিত।

আমি নিজের পড়াশুনা লইয়া থাকিতাম, নৃসিংহবাবুর সহিত যাচিয়া আলাপ করিতে যাই নাই। তাঁহার চেহারা যদি তাঁহার চরিত্রের দর্পণ হয় তবে পরিচয় না হওয়াই ভাল। কিন্তু তিনি একদিন নিজে আসিয়া আলাপ করিলেন। আমার চাকর পালাইয়াছিল; আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বসিয়া ভাবিতেছিলাম, চাকর পালাইলে যদি এমন হাড়ির হাল হয় তবে স্বাধীনতা অর্জন করিয়া কী লাভ হইল, এমন সময় নৃসিংহবাবু আসিয়া বলিলেন, ‘চাকর পালিয়েছে! কিছু ভাববেন না, কালই নতুন চাকর জোগাড় করে দেব। আজ আমার চাকর এসে আপনার সব কাজ করে দিয়ে যাবে।’

নৃসিংহবাবুর কণ্ঠস্বর অতি ভরাট এবং মধুর; শানাই বাঁশির খাদের পর্দার মতো। চেহারার সঙ্গে যেন ঠিক খাপ খায় না।

অতঃপর তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠতা হইল। তিনি দু’বেলা গঙ্গাস্নান করেন অথচ পূজার্চনা কিছুই করেন না, ধর্মের প্রসঙ্গও কখনও উত্থাপন করেন না, দেখিয়া শুনিয়া বড় আশ্চর্য মনে হইত। তাঁহার চেহারা ক্রমশ সহ্য হইয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাঁহার চরিত্র ভাল কি মন্দ তাহা নিঃসংশয়ভাবে ধরিতে পারিতেছিলাম না। হয়তো লুকাইয়া মদ খান, অন্য দোষও আছে; কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করিয়াছিলাম, তিনি কখনও কাহাকেও কষ্ট দিতে চাহিতেন না এবং কাহারও কষ্ট দেখিলে সাধ্যমতো প্রতিকারের চেষ্টা করিতেন। তাঁহার স্ত্রী-পুত্র জ্ঞাতিগোষ্ঠী কেহ ছিল না, একাকী বাস করিতেন।

একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি ভ্রমণে বাহির হইয়া বাসা হইতে একটু দূরে গিয়া পড়িয়াছিলাম। শীতের সন্ধ্যা, রাস্তায় লোকজন নাই; এমন একটা স্থানে আসিয়া পড়িয়াছিলাম যেখানে তিন-চারিটা রাস্তা আসিয়া মিলিত হইয়াছে। কোন্ রাস্তা ধরিলে বাসায় ফিরিয়া যাইতে পারিব ঠিক ঠাহর করিতে পারিতেছি না, এমন সময় দেখিলাম নৃসিংহবাবু গঙ্গাস্নান করিয়া ফিরিতেছেন। তাঁহার পা খালি, গায়ে একটা আলোয়ান, হাতে গামছা-জড়ানো ভিজা কাপড়।

দু’জনে পাশাপাশি ফিরিয়া চলিলাম। এদিকটায় পূর্বে আসি নাই, জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘গঙ্গার ঘাট এখান থেকে কতদূর?’

‘মাইলখানেক।’

‘রোজ দু’বেলা এখানে আসেন?’

‘হ্যাঁ।’

একটু বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিলাম, ‘কাছাকাছি অন্য ঘাট আছে, সেখানে যান না কেন?’

তিনি বলিলেন, ‘এটা শ্মশান ঘাট। এখানে আসি৷’

হঠাৎ মনে হইল, কাপালিক নাকি? কিন্তু কই, রুদ্রাক্ষের মালা, সিঁদুরের ফোঁটা, এসব তো কিছু নাই!

খানিকক্ষণ নীরবে চলিলাম। বেশ অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, তার উপর পথের পাশে বড় বড় গাছ। আকাশে একফালি চাঁদ আছে বটে, কিন্তু রাত্রির তিমির হরণ করিবার পক্ষে তাহা যথেষ্ট নয়।

লক্ষ্য করিলাম, নৃসিংহবাবু পথ চলিতে চলিতে মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরাইয়া পশ্চাতে তাকাইতেছেন। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি দেখছেন?’

‘দেখুন তো পেছনে কেউ আসছে কিনা!’

হঠাৎ গা ছম্‌ছম্‌ করিয়া উঠিল। পশ্চাতে তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলাম, ‘কই না!’

‘কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছেন কি?’

‘না। কি ব্যাপার?’

‘কিছু না। মাস কয়েক আগে এই জায়গায় দুটো শ্মশানের কুকুর একটা মুসলমান গুণ্ডার টুঁটি ছিঁড়ে মেরে ফেলেছিল।’

মিনিট দশেক পরে লোকালয়ের এলাকায় আসিয়া পড়িলাম, আরও পাঁচ মিনিট পরে নিজের পাড়ায় পৌঁছিলাম। নৃসিংহবাবুর বাড়ি আগে; তিনি বলিলেন, ‘আসুন, চা খেয়ে যান।’

তাঁহার সদর ঘরে চৌকির উপর জাজিম পাতা। দুইজনে মুখোমুখি বসিয়া গরম চা পান করিতেছি। আমার মনে নৃসিংহবাবু সম্বন্ধে আজ আবার নূতন করিয়া নানা প্রশ্ন জাগিতেছে; লোকটি কেমন? বাহিরের সহিত ভিতরের সামঞ্জস্য কতখানি? এতদিনের আলাপেও আসল মানুষটাকে চিনিতে পারিতেছি না কেন?

নৃসিংহবাবু হঠাৎ হাসিয়া উঠিলেন। তাঁহার হাসির আওয়াজ যেমন বংশী-মধুর, হাসিলে তাঁহার মুখের ভাব হয় তেমনি দংষ্ট্রা-করাল। হাসি থামাইয়া তিনি বলিলেন, ‘আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি একটা ভয়ঙ্কর পাজি লোক।’

আমি অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলাম, ‘না না, সে কি কথা—’

তিনি সহজ সুরে বলিলেন, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন! সত্যিই আমি ভয়ানক পাজি লোক। অন্তত বছর তিনেক আগে পর্যন্ত তাই ছিলাম। এখন মনটা বোধহয় কিছু বদলেছে; কিন্তু চেহারা বদলায়নি, যা ছিল তাই রয়ে গেছে।’

নৃসিংহবাবু নির্বিকার চিত্তেই কথাগুলি বলিলেন, আমি কিন্তু বিশেষ অপ্রতিভ হইয়া পড়িলাম; চায়ের পেয়ালা মুখের কাছে তুলিয়া লজ্জা ঢাকা দিবার চেষ্টা করিলাম। তিনি বলিয়া চলিলেন, ‘পরমা প্রকৃতি আমার সর্বাঙ্গে প্রকৃত পরিচয়ের ছাপ মেরে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, আমিও তাঁর সঙ্গে বেইমানি করিনি। এমন দুষ্কর্ম নেই যা করিনি, জগাই-মাধাই আমার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু। এইভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছিল, তারপর একদিন একটা সামান্য ঘটনা ঘটল, তার ফলে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। ভাববেন না যে মনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল কিংবা রাতারাতি সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে পড়লাম। দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি বেশি, আসলে বদলেছে এই জলজ্যান্ত পৃথিবীটা। শুনলে আশ্চর্য হবেন। সেই কথাই আজ আপনাকে বলব।’

‘বলুন।’

এই সময় একটু বাধা পড়িল। বাহিরের দ্বার ভেজানো ছিল, তাহা কাহারও লঘু করস্পর্শে খুলিয়া গেল এবং একটি মানুষের মুখ ভিতরে উঁকি মারিল। পশমের টুপি ঢাকা মুখখানি অস্থিসার এবং ছুঁচলো, চক্ষু দু’টি ভীরু ধূর্তামিতে ভরা। আমাকে দেখিয়াই মুখটি বাহিরের অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল। যেন একটা পথের কুকুর খাদ্যের লোভে রান্নাঘরে উঁকি মারিয়াছিল, ভিতরে লোক আছে দেখিয়া পলায়ন করিল।

আমি চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ও কে?’

নৃসিংহবাবু হাসিলেন, ‘ভূত-প্রেত নয় মানুষ। ওর নাম খোঁড়া মানিক। ও একটা নিশাচর জীব। মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে।’

কিন্তু পালালো কেন?’

‘আপনাকে দেখে পালালো। ও আমার কাছে আসে লুকিয়ে। শহরে একজন বড়লোক আছে, নাম রামনেহাল সিং; খোঁড়া মানিক তার মোসায়েব। রামনেহাল যদি জানতে পারে খোঁড়া মানিক আমার কাছে আসে, ওকে বেমালুম কেটে ফেলবে। —ওকথা যাক, গল্পটা বলি শুনুন।’

নৃসিংহবাবু সদর দরজায় খিল দিয়া আসিয়া বসিলেন।

আমি পুলিশের দারোগা ছিলাম। রাইটার কনস্টেবল হয়ে ঢুকি, বড় দারোগা পর্যন্ত উঠেছিলাম। আরও উঠতে পারতাম, ইচ্ছে করে উঠিনি। ওপরে তেমন মজা নেই।

আমার মতো দুর্দান্ত দারোগা পুলিশে আর ছিল না, এখনও বোধ হয় নেই। যেমন কুচুটে বুদ্ধি তেমনি আইন বাঁচিয়ে কাজ করবার ক্ষমতা। যাকে একবার ধরতাম, পিত্তি বার করে ছেড়ে দিতাম। চোর ছ্যাঁচড় দুষ্ট বজ্জাত লোক আমাকে যত ভয় করত, ভদ্রলোকেরা তার চেয়ে বেশি ভয় করত। যখন যে মহকুমায় বদলি হয়ে যেতাম সেখানে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠত। বড়লোকেরা গায়ে পড়ে টাকা খাইয়ে যেত, যেন তাদের পেছনে না লাগি।

এই ভাবে মনের সুখে আছি। বিয়ে করিনি; আমার মতো যাদের মনের ভাব তাদের বিয়ে করা বোকামি। মাইনে পাই সামান্যই কিন্তু উপরি আসে ছাপ্পর ফুঁড়ে। এখনও সেই টাকাই খাচ্ছি, আরও বিশ বছর যদি বেঁচে থাকি সে টাকা ফুরোবে না।

বাইরে বাঘের দাপট, ভেতরে মদ মাংস পঞ্চমকার। যা চাই সব পেয়েছি; মনের ফুর্তিতে আছি।

বছর আষ্টেক আগে এই শহরে বদলি হয়ে আসি, বড় থানার বড় দারোগা। শাঁসালো শহর, পয়সাওয়ালা লোক অনেক আছে। সকলের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। চুপি চুপি ভেট আসতে লাগল; যাদের পেটে ময়লা যত বেশি তারা ঠাকুরের মন্দিরে তত বেশি পূজা পাঠালো। কেবল একজন পাঠালো না, সে ঐ রামনেহাল সিং। রামনেহাল সিং-এর জমিদারী আছে, সুদের কারবারও করে, অঢেল টাকা। সে তেউড়ে বসে রইল, কিছু দিলে না।

মাসখানেক পরে একটা মামুলি কাজের অছিলায় তার বাড়িতে গেলাম। ইশারায় জানালাম, টাকা চাই। সে স্পষ্ট মুখের ওপর বললে, ‘তোমার মতো দারোগা ঢের দেখেছি। যা পারো করো গিয়ে, এস পি আমার হাতের মুঠোর মধ্যে।’

মনে মনে বারুদ হয়ে ফিরে এলাম। দাঁড়াও যাদু, তোমাকে দেখাচ্ছি এস পি বড় না নর্সিং দারোগা বড়।

জাল বুনতে আরম্ভ করলাম। এই সব জমিদারদের আইনের ফাঁদে ফেলা শক্ত নয়, ছোটখাটো মামলায় সহজেই ফেলা যায়। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম, রামনেহাল সিংকে এমন মার দেব যে আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। একেবারে শিরদাঁড়া ভেঙে দেব।

খোঁড়া মানিক—যাকে এখনি দেখলেন— সে তখনও রামনেহালের মোসায়েব ছিল, রামনেহালের যত নোংরা কাজ সে-ই করত। তাকে একদিন ধরে ফেললাম। থানায় ডাকলাম না, বাড়িতে ডেকে এনে বললাম সে যে-সব কাজ করেছে, তার জন্যে তাকে পাঁচ দফায় দশ বছর জেলে পাঠাতে পারি। খোঁড়া মানিক পা জড়িয়ে ধরল।

সেই থেকে খোঁড়া মানিক হল আমার গোয়েন্দা, গুপ্তচর। লুকিয়ে রাত্তিরে এসে আমাকে রামনেহালের হাঁড়ির খবর দিয়ে যেত। ওর মনে এমন ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম যে, সে-ভয় ওর এখনও যায়নি। আমার এখন চাকরি নেই, কোনও ক্ষমতা নেই; কিন্তু ওর বিশ্বাস ইচ্ছে করলেই আমি ওকে জেলে পাঠাতে পারি। তাই মাঝে মাঝে আসে, খবর নিয়ে যায়।

সে যাক্। দেড় বছর ধরে ধীরে ধীরে একটি মোকদ্দমা খাড়া করলাম। মোকদ্দমা নয়, একটি নিখুঁত শিল্পকর্ম। রামনেহালের ছেলের বয়স তখন উনিশ-কুড়ি। সে বাজারের এক বেশ্যাকে খুন করেছে। সাক্ষী-সাবুদ দলিল-দস্তাবেজ একেবারে নিরেট, কোথাও বেরুবার পথ নেই।

রামনেহালের ছেলের চৌদ্দ বছর ম্যাদ হয়ে গেল। এস পি বাঁচাতে পারলেন না। কেবল কম বয়স বলে ফাঁসি হল না। সে ছেলে এখনও জেলে পচছে।

এই একটা নমুনা থেকে বুঝতে পারবেন আমি কি ধরনের লোক। তারপর কয়েক বছর কেটে গেল, আমার কাজ থেকে অবসর নেবার সময় হল। অনেক টাকা করেছি, কাজ করবার দরকার নেই। এক্সটেনশন নিতে পারতাম কিন্তু নিলাম না।

এই ছোট্ট বাড়িখানা কিনেছিলাম। কাজ চুকিয়ে দিয়ে বাড়িতে এসে বসলাম। মনে গর্বভরা আনন্দ। যা চেয়েছি তা পেয়েছি, কারুর কাছে হার মানিনি। আর কি চাই!

সেদিন সন্ধ্যার পর এই ঘরে মদের বোতল নিয়ে বসেছি; সারা রাত্রি একাই উৎসব চলবে। টোটা-ভরা পিস্তলটা হাতের কাছে আছে। শত্রু অনেক, কাজ ছেড়ে দিয়েছি বলে যদি কেউ দাদ তুলতে আসে তাকে দেখে নেব।

মশগুল হয়ে মদ খাচ্ছি। সময়ের হিসেব নেই। হঠাৎ চোখ তুলে দেখি একটা বিকট চেহারা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রোগা সিড়িঙ্গে এক সন্নিসি; মাথায় জটা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, সারা গায়ে ছাই মাখা।

আমি অভ্যাসের বশেই খপ্ করে পিস্তলটা তুলে নিয়েছি, সন্নিসি ধমক দিয়ে উঠল— ‘বন্দুক রাখ্।’

কী গলার আওয়াজ, যেন তোপ দাগলো। বললে বিশ্বাস করবেন না, পিস্তল আমার হাত থেকে খসে পড়ল, আমি ভেড়ার মতো তাকিয়ে রইলাম।

সন্নিসি তখন বললে, ‘তোর সময় হয়েছে। রোজ দু’বেলা গঙ্গাস্নান করবি। আর মা’র নাম করবি। মদ খাবি না, আর বুধবারে দাড়ি কামাবি না।’

আমি এবার হো হো করে হেসে উঠলাম। মদের নেশা তো ছিলই তার ওপর— বুধবারে দাড়ি কামাব না! অনেকক্ষণ ধরে হাসলাম, হাসতে হাসতে বেদম হয়ে গেলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, ঘরের দোর তাড়া তো বন্ধ ছিল, সন্নিসি ঢুকল কী করে? হাসি থামিয়ে চেয়ে দেখি সন্নিসি নেই, চলে গেছে। কিন্তু দোর তাড়া ঠিক আগের মতোই বন্ধ আছে।

তাই বলছিলাম আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, বদলেছে এই পৃথিবীটা। যতসব অসম্ভব গাঁজাখুরি ব্যাপার ঘটতে আরম্ভ করেছে। যা ঘটতে পারে না, ঘটা উচিত নয়, তাই ঘটছে।

সে-রাত্রে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরের দিকে সদর দরজায় খট্‌খট্‌ আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলাম কেউ আমার সঙ্গে বজ্জাতি করছে। তখনও মদের নেশা ভাল কাটেনি, সন্নিসির কথাও মনে নেই; আমি পিস্তল নিয়ে পা টিপে টিপে গিয়ে হঠাৎ দরজা খুললাম। দেখলাম দোরের কাছে কেউ নেই, কিন্তু একটা লোক রাস্তা দিয়ে হন্‌হন্‌ করে দূরে চলে যাচ্ছে।

আমার রোখ চড়ে গেল, আমি তাকে ধরবার জন্যে বার হলাম। পায়ে জুতো নেই, হাতে পিস্তল, আমি লোকটার পিছনে চললাম। ভোরের ঘোর-ঘোর আলোয় ভাল দেখা যাচ্ছে না, আমি যত জোরে চলি, সেও তত জোরে চলে; আমি দৌড়তে লাগলাম, সেও দৌড়তে শুরু করল।

তারপর অনেকদূর দৌড়বার পর তাকে আর দেখতে পেলাম না। এতক্ষণ কোথায় যাচ্ছি তার হিসেব ছিল না, এখন চমক ভেঙে দেখি শ্মশানঘাটের কাছে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আছি।

শ্মশানঘাট তখন শূন্য। সেখানে একা দাঁড়িয়ে সন্নিসির কথা মনে পড়ে গেল। সন্নিসি বলেছিল, দু’বেলা গঙ্গাস্নান করবি। তখন গরম কাল, এতখানি পথ দৌড়ে আমার সারা গায়ে ঘাম ঝরছে। ভাবলাম, মন্দ কি, স্নান করেই যাই।

গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরলাম।

সে দিনটা ছিল বুধবার, কিন্তু আমার তা মনে ছিল না। বেলা আটটার সময় দাড়ি কামাতে বসলাম। আমি নিজে দাড়ি কামাই, নাপিতকে বিশ্বাস নেই। কিন্তু ক্ষুর চালাতে গিয়ে খ্যাঁচ্ করে কেটে ফেললাম নিজের গাল। দর্‌দর্‌ করে রক্ত ঝরতে লাগল। তখন মনে পড়ল, আজ বুধবার; সন্নিসি বলেছিল বুধবারে দাড়ি কামাবি না।

দুত্তোর! দাড়ি না হয় একদিন না কামালাম। রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলতে লাগল। একটা ভিখিরি এসে আমাকে গুণ করে গেল। না, কিছুতেই না। আমি নসিং দারোগা, আমার ভয়ে বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খায়, একটা সন্নিসি আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে! দেখব কেমন সন্নিসি৷

কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। সন্ধ্যের পর একটি আস্ত ব্রান্ডির বোতল নিয়ে বসতে যাব, বোতলটা হাত থেকে পিছলে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। বাড়িতে আর মদ নেই, কিন্তু আমিও হার মানব না। ঠিকে গাড়ি ভাড়া করে তখনি চললাম মদের দোকানে।

মদের দোকান বন্ধ। আর একটা দোকানে গেলাম, সেটাও বন্ধ। শুঁড়িরা নাকি ধর্মঘট করেছে।

গাড়িতে ফিরে এসে বসতেই গাড়োয়ান প্রশ্ন করল— ‘হুজুর, এবার কোথায় যাব?’ উত্তর দিলাম— ‘চুলোয়।’

গাড়ি চলল। আমি বসে বসে রাগে ফুলতে লাগলাম। তারপর গাড়ি যখন থামল, দেখলাম শ্মশানঘাটে উপস্থিত হয়েছি।

স্নান করে বাড়ি ফিরলাম।

এইরকম কয়েকদিন চলল— আমার নিজের ইচ্ছা বলে যেন কিছু নেই; আমাকে দু’বেলা গঙ্গাস্নান করতে হবে, মদ খেতে পাব না, বুধবারে দাড়ি কামাতে পাব না। আমি স্বাধীন মানুষ নই, কেনা গোলাম; আমার অজানা মালিক আমার ঘাড় ধরে আমার মুখটা রাস্তায় ঘষে দিচ্ছে।

একদিন উত্ত্যক্ত হয়ে নিজের মনে বললাম, মা, তোমার ওপর আমার বিশ্বাস নেই, বুজরুকি মানি না। কিন্তু সন্নিসির হুকুম মানলে যদি আর গণ্ডগোল না হয় তবে তাই সই। আর মদ খাব না, দু’বেলা গঙ্গাস্নান করব, বুধবারে দাড়ি কামাব না। এতে যদি কারুর লাভ হয় তো হোক।

দু’বেলা গঙ্গাস্নান করা ক্রমে অভ্যেস হয়ে গেল, বুধবারে দাড়ি কামানো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু মদ ছাড়া অত সহজ নয়। আরও দু’চারবার মার খেতে হল। যতবারই মদ খেতে যাই একটা না একটা বিপত্তি এসে পড়ে। একবার গেলাসে মদ ঢেলেছি, ছাদ থেকে গেলাসের মধ্যে টিকটিকি পড়ল। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা ছেড়ে দিলাম। কিছুদিনের জন্যে মনে হল দুনিয়াটা বিস্বাদ হয়ে গেছে।

যা হোক, নির্ঝঞ্ঝাটে দিন কাটছে। মা’র নাম করি; মানে, যখনই মনে পড়ে, মা’কে বাপ তুলে গালাগালি দিই৷ মা কে তা জানি না, কেন আমার পেছনে লেগেছে তাও জানি না, কিন্তু চুটিয়ে মা’কে বাপান্ত করি। মা’র বোধহয় ভাল লাগে, কারণ যতই গালাগালি দিই, আমার কোনও অনিষ্ট হয় না।

একদিন সন্ধ্যের পর খোঁড়া মানিক এল। বললে, ‘নর্সিংবাবু, আপনি এ শহর ছেড়ে চলে যান। রামনেহাল সিং আপনাকে খুন করবার জন্যে গুণ্ডা লাগিয়েছে। এখানে থাকলে আপনার প্রাণ যাবে।’

রামনেহাল গুণ্ডা লাগিয়েছে। আশ্চর্য নয়। আমি তার মুখে চুনকালি দিয়েছি, তার ছেলেকে জেলে পাঠিয়েছি, সে শোধ তুলতে চায়। কিন্তু আমি নর্সিং পাল, রামনেহালের ভয়ে পালিয়ে যাব? আমি চিরকাল গুণ্ডা চরিয়ে বেড়িয়েছি, আমাকে গুণ্ডার ভয় দেখাবে! কুচ পরোয়া নেই, আসুক গুণ্ডা। দেখে নেব।

তবু সাবধান হলাম। বাইরে যখন বেরুই পিস্তল নিয়ে বেরুই, রাত্রে শোবার সময় পিস্তল বালিশের পাশে থাকে। দুপুর রাত্রে উঠে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি কেউ আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিনা। কিন্তু কাউকে দেখতে পাই না, মনে হয় সব ধাপ্পা! আমাকে মিথ্যে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে।

দিন আষ্টেক পরে মানিক আবার এল। একগাল হেসে বললে, ‘ধন্য আপনি, এত বুদ্ধিও ধরেন! রামনেহাল মুষড়ে পড়েছে।’

অবাক হয়ে বললাম, ‘সে কি!’

খোঁড়া মানিক বলল, ‘বাঘের মতো এক জোড়া কুকুর পুষেছেন আপনি, তারা সমস্ত রাত বাড়ি পাহারা দেয়। তিনবার গুণ্ডারা এসেছিল, কুকুর দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে। আমি নিজের কানে শুনেছি তারা রামনেহালকে বলছে, কুকুর নয় হুজুর, সাক্ষাৎ দুটো যমদূত।’

খোঁড়া মানিককে কিছু বললাম না, কিন্তু মনে ভারি ধোঁকা লাগল। কুকুর এল কোত্থেকে? তারপর সারা রাত্রি জুতো পাহারা দিয়েছি, কখনও একটা নেড়ি কুত্তাও দেখতে পাইনি।

এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। গুণ্ডারা কুকুর দেখেছে, আমি দেখতে পাই না কেন? ভাবলাম, গুণ্ডারা আমাকে তো চেনে, আমার বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায়নি, রামনেহালকে গল্প বানিয়ে বলেছে।

তারপর বেশ কিছুদিন নিরুপদ্রবে কেটে গেল। আমি অদৃশ্য কুকুরের পাহারায় নিরাপদে আছি। ভয় কেটে গেল। গঙ্গাস্নানে যাই তাও পিস্তল নিয়ে যাই না। সেই সন্নিসির আর দেখা পাইনি, মনে ধর্মভাবও জাগেনি। কিন্তু নিজের মনে মা মা করি। বলি, ‘মা, তুই কে? আমাকে বুঝিয়ে দে। আমার দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গেছে, কিছু বুঝতে পারছি না। তুই বুঝিয়ে দে।’

মা বুঝিয়ে দেন না। সর্বনাশী আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা দেখে।

ছ’মাস আগের কথা বলছি। খোঁড়া মানিক এল; তার মুখ শুকনো। বললে, ‘আপনি নাকি সকাল সন্ধ্যে শ্মশানঘাটে নাইতে যান?’

বললাম, ‘হ্যাঁ যাই।’

খোঁড়া মানিক বললে, ‘ওরা জানতে পেরেছে— হিন্দু গুণ্ডারা আপনাকে মারতে রাজী হয়নি, বলেছে আপনি নাকি কাপালিক, শ্মশানে শবসাধনা করেন। তাই রামনেহাল মুসলমান গুণ্ডা লাগিয়েছে। নাম জানেন বোধ হয়, রহিম আর করিম দুই ভাই। তারা শ্মশানের রাস্তায় আপনাকে ছুরি মারবে।’

খোঁড়া মানিক চলে যাবার পর ভাবতে বসলাম। কি করা যায়? গঙ্গাস্নান বন্ধ করা যাবে না, কারণ জানি, নিজের ইচ্ছায় না গেলে ঘাড় ধরে নিয়ে যাবে। এক, পিস্তল নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু কেন জানি না, পিস্তল নিয়ে গঙ্গাস্নানে যেতে আর ইচ্ছে হল না। দূর হোক গে, যা হবার হবে। আমার ইচ্ছেয় তো কিছুই হচ্ছে না, তবে মিছে ভেবে মরি কেন?

দু’চার দিন কিছু হল না। স্নান করতে যাই, ফিরে আসি। আমার পেছনে গুণ্ডা লেগেছে তা প্রায় ভুলেই গেলাম! তারপর একদিন—

সন্ধ্যের পর শ্মশানের দিকটা কীরকম নির্জন হয়ে যায় দেখছেন তো। ওদিকে ঘরবাড়িও নেই, লোক চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। আমি স্নান করে ফিরছি; রাত আন্দাজ আটটা। বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। হঠাৎ পিছনে একটা বিকট চিৎকার শুনে আঁতকে উঠলাম। মানুষের গলার মর্মান্তিক চিৎকার, সেই সঙ্গে কুকুরের গভীর ডাক। যেন একটা ডালকুত্তা একটা মানুষের গলা কামড়ে ধরে তার চিৎকার বন্ধ করে দিলে।

আমি আর দাঁড়ালাম না, টেনে ছুট মারলাম।

পরদিন সকালবেলা খবর পাওয়া গেল, শ্মশানঘাটের রাস্তায় রহিম গুণ্ডার লাশ পাওয়া গেছে। তাকে শ্মশানের কুকুর নাকি টুঁটি ছিঁড়ে মেরে ফেলেছে। রহিমের হাতে একটি বর্শা ছিল, তবু সে আত্মরক্ষা করতে পারেনি।

রাত্তিরে খোঁড়া মানিক এল। রহিমের ভাই করিম রামনেহালকে যা বলেছে, তার কাছে শুনলাম। ওরা দু’ভাই ক’দিন ধরে আমার জন্যে ওঁত পেতে ছিল, রোজই দেখত এক জোড়া কালো কুকুর আমার পেছনে থাকে। কাল রহিম আর করিম রাস্তার ধারেই একটা গাছে উঠে বসে ছিল, মতলব করেছিল যেই আমি গাছতলা দিয়ে যাব অমনি বর্শা ছুঁড়ে আমায় মারবে; কুকুর তাদের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু বর্শা ছুঁড়তে গিয়ে রহিম নিজেই পা ফস্‌কে নীচে পড়ে গেল, আর একটা কুকুর এসে ধরল তার টুঁটি—

এই পর্যন্ত বলিয়া নৃসিংহবাবু নীরব হইলেন। তারপর একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস টানিয়া বলিলেন, ‘এই আমার গল্প। রামনেহাল আর আমাকে ঘাঁটায়নি। সেই থেকে নির্ভয়ে আছি।

‘এখন আপনি বলুন— এ সব কী? অলৌকিক বললে চলবে না, কেন অলৌকিক তা বলতে হবে। সন্নিসি বলেছিল, আমার সময় হয়েছে। কিন্তু কি করে সময় হল? শুনেছি যাঁরা সাধুসজ্জন যোগী তপস্বী, ভগবান তাঁদের দয়া করেন, বিপদে রক্ষা করেন। কিন্তু এ কি! জীবনে আমি একটা ভাল কাজ করিনি, মন্দ কাজ এত করেছি যে তার সীমাসংখ্যা হয় না; তবে বেছে বেছে আমাকে দয়া করবার মানে কি? জোর করে আমাকে মদ ছাড়ানো, গঙ্গাস্নান করানো, আমাকে শত্রুর প্রতিহিংসা থেকে আগলে রাখা, এ সব কেন? আপনি বিদ্বান লোক, এর উত্তর দিন। কেন? কেন? কেন?’

নৃসিংহবাবু কদাকার মুখে তীব্র জিজ্ঞাসা ভরিয়া আমার পানে চাহিয়া রহিলেন। আমি তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, হয়তো তাঁহার এই তীব্র ব্যাকুল জিজ্ঞাসাই তাঁহার প্রশ্নের উত্তর।

১১ শ্রাবণ ১৩৫৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *