নিরাপত্তাহীনতার জীবানু এবং নিরাপত্তার আনন্দধ্বনি
জাতি সঙ্ঘে একটি নিরাপত্তা পরিষদ আছে। যার স্থায়ী সদস্য চিন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। অস্থায়ী সদস্য দশ। এই পরিষদের কাজ বিশ্বে শান্তি রক্ষা করা। যুযুধান দুই পক্ষকে থামানো। অন্যায় যুদ্ধে বিপর্যস্ত দেশের হয়ে লড়াই করতে জাতি সঙ্ঘের সামরিক বাহিনী পাঠানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের ২৪শে অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদ গঠন হয়। এর আগে আগেই জাপানে পরমানু বোমা পড়েছে ৬-ই আগস্ট এবং ৯-ই আগস্ট। বলছি নিরাপত্তা পরিষদ থাকতেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কি যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে? দুর্বলের উপর সবলের সামরিক অভিযান? গত শতাব্দীতেই তো হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। নিরাপত্তা পরিষদ কোনো রাষ্ট্র আর তার জনগণকে নিরাপত্তা দিতে পারে? ভিয়েতনামকে নিরাপত্তা দিতে পেরেছিল, তার জনগণকে? কোনো জনজাতিকে নিরাপত্তা দিতে পারে জাতিসঙ্ঘ? আদিবাসী জনজাতিকে মেরে তাদের অরণ্য পাহাড় দখল বন্ধ করতে পেরেছে নিরাপত্তা পরিষদ? আমেরিকার আদিম উপজাতিরা জাতি সঙ্ঘের কাছে আবেদন করেছিল, তাদের যা যা হরণ করা হয়েছে, বন-পাহাড়, নদী, সমুদ্রতট, প্রান্তর, আলো-বাতাস, শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে সব ফিরিয়ে দিতে। নিরাপত্তা পরিষদ কি পেরেছে? নিরাপত্তা পরিষদ পারেনি ইরাকে হাসপাতালের উপর, বিদ্যালয়ের উপর বোমা বর্ষণ বন্ধ করতে? ইরাক যুদ্ধে নিরীহ ইরাকি বন্দীদের উপর মার্কিন সেনা বাহিনীর নৃশংসতা বন্ধ করতে, আবু গ্রাইব কারাগারের ভয়ঙ্কর নির্যাতনের বিপক্ষে কোনো প্রস্তাব নিতে? আফগানিস্তানে ক্রমাগত সামরিক আগ্রাসন রুদ্ধ করতে? একটা দেশ তো তার মানুষকে নিয়েই হয়। জনগণ একটা দেশের সম্পদ। শুধু মরুভূমি কিংবা সমুদ্র, মহাসমুদ্র নিয়ে তো দেশ হয় না। রাষ্ট্র হয় না। মানুষ না থাকলে কী নিয়ে রাষ্ট্র হবে? পাহাড় আর বনভূমি আর বন্যজন্তু কিংবা সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে, মরুপ্রান্তরের শকুন আর হাড়-কঙ্কাল নিয়ে? মানুষই রাষ্ট্র গড়ে। রাষ্ট্রকে সম্পদশালিনী করে তোলে। দেশ প্রেমিক হয়। দেশদ্রোহী শিরোপা পায় ক্ষমতার হাতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বললে। রাষ্ট্রেই তার নাগরিক মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। মানুষ নানা আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকে। থাকে। কী করে থাকে?
খোঁজ নিয়ে দেখুন নিরাপত্তা পরিষদ যেমন জাতি সঙ্ঘে আছে, অন্য নামে নিরাপত্তা পরিষদ আপনার পাড়ায় আছে, পাড়া থেকে শহরে আছে, শহর থেকে রাজ্যে আছে, রাজ্য থেকে দেশে আছে। নাগরিক সমাজে আছে। সমাজ তো দেশের অংশ। আপনি ছা-পোষা গেরস্ত। আপনার কাছে অমুক সঙ্ঘ (জাতি সঙ্ঘ নয় নিশ্চয়) এসে দাবী করল গণেশ পুজায় হাজার টাকা, দুহাজার টাকা। আপনার বাড়ির সামনে ১০০ ডেসিবেল মাত্রায় লাউড স্পিকার, বাড়িতে অসুস্থ প্রবীণ, আপনি সঙ্ঘের কাছে অনুনয় করে বিচার না পাওয়ায় গেলেন নিরাপত্তা পরিষদে। তিনিই সব দেখেন। বাড়িতে স্বামী স্ত্রী, শাশুড়ি বউয়ের কলহ হলেও তিনি দেখেন, কলেজে ছাত্র ভর্তি হতে না পারলেও তিনি দেখেন। তিনি যদি সদয় হন তবে সমস্যার সুরাহা হতে পারে, না হলে আপনার জীবন হানি হতে পারে। লাউড স্পিকার বাজানো আর পটকা ফাটানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে হত হয়েছেন এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। অভাব নেই অ্যাসিড ছুঁড়ে আপনার কন্যা সন্তানের উপর শোধ নেওয়ার দৃষ্টান্তেরও। কন্যার অপরাধ, পাড়ার ছেনো কিংবা ধেনো, ইত্যাদি আপনজনের প্রস্তাবে সে ‘না’ করেছিল। তারাই নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য।
সেনা বাহিনী, আমার দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করে। সীমান্তে প্রহর জাগে। আবার বন্যা, ভূমি কম্প, পাহাড়ে ধ্বস নামলে সেনা বাহিনী ভরসা। বিপন্ন মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা এবং শৌর্য সেনা বাহিনীরই আছে। সব দেশেই তা হয়। আবার এই বাহিনীই তো বিদ্যালয়, হাসপাতালে বোমা ফেলে। অপরাধী সন্দেহে মানুষকে গাড়ির পিছনে বেঁধে গাড়ি চালিয়ে দেয়। সেনা জওয়ানের চেয়ে রাষ্ট্র পরিচালকের ভূমিকা এখানে প্রধান। কর্তার ইচ্ছায় মানুষ বিপন্ন হয়। কর্তাই ঠিক করেন কে নিরাপত্তা পাবে, কে পাবে না।
রাষ্ট্র গড়েছে মানুষ। আবার সেই মানুষের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের হাতেও সব সময় মজবুত নয়। নয়। আমার বন আমার পাহাড় তুমি কেড়ে নেবে। নির্বিচারে গাছ কেটে মরুভূমি করে দেবে অপরূপ প্রকৃতি, আমি তার প্রতিরোধ করলে বিপদ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরণ্যক উপন্যাসের শুরুতে যে বনভূমির কথা বলেছিলেন, নায়েব সব জমি বন্দোবস্ত দিয়ে ফেরার সময় অনুধাবন করেছিল, কাজটা ভালো হয়নি। বনভূমি ধ্বংসের সূত্রপাত ঘটেছিল জমি বন্দোবস্তে। আরণ্যকের সেই আদিবাসী গ্রাম, আদিবাসী রাজা, রাজকন্যা ভানুমতীর ধনঝরি পাহাড় ধ্বংসের প্রতিবাদে জোতদার রাসবিহারী সিঙেরা এখন গ্রাম পুড়িয়ে দেবে, জেলখানায় ভরে দেবে। রাসবিহারী সিং’এর হাতে যে ক্ষমতা, তাই-ই রাষ্ট্রের ক্ষমতা।
ক্ষমতার বিরুদ্ধে গেলে আপনি বিপন্ন। সেখানে গণেশ পুজো করা অমুক সঙ্ঘও রাষ্ট্র। হ্যাঁ তাই। তার সঙ্ঘের মাথায় রয়েছে এলাকার নিরাপত্তা পরিষদের হাত। তাই সে বিরূপ হয়ে বোমা পিস্তল নিয়ে আপনার হাড় হিম করে দিতে পারে। এই ভাবেই সেই কাষ্ঠ ব্যবসায়ী, যে জঙ্গল সাফ করে মুনাফা তোলে, সেও রাষ্ট্র, কারণ তার পিছনেও রাজ্যের কিংবা মহকুমার, কিংবা জেলার অথবা পঞ্চায়েতের কর্তার হাত আছে। কেন না তার মুনাফায় কারোর কারোর ভাগ আছে। একের ক্ষমতা অন্যের নিরাপত্তা ধ্বংস করে, যেমন হিরোসিমা বা নাগাসাকিতে করেছিল আমেরিকা, যেমন সন্দেহ করা হয়, সেই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন.এফ.কেনেডির জীবন নিয়েছিল অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। কেনেডি অস্ত্র সংবরণ করতে চেয়েছিলেন ভিয়েতনামে। কিউবার প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল। অস্ত্রই তো ক্ষমতা। জে.এফ.কে নামের একটি সিনেমায় এমন অনেক সন্দেহ স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। অস্ত্রই ক্ষমতা, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিরোসিমা, নাগাসাকি। আমি কত বড়, আমি কতটা শক্তি ধরি তা দেখাতেই তোমার নিরাপত্তা শেষ করতেই হবে। ধ্বংস করতে হবে নাগরিক থেকে কীট-পতঙ্গ সমূহকে।
পৃথিবীর বয়স হলো ঢের। মানুষের জ্ঞানের সীমা পরিসীমাও কম নয়। প্রযুক্তি মানুষের কাছে এনে দিয়েছে জ্ঞানের অনন্য ভাণ্ডার। তা যেমন আশীর্বাদ হয়েছে, তেমনি অভিশাপ হয়ে মানুষের বিপন্নতা বাড়িয়েছে ক্রমাগত। গণতন্ত্র এলে, রাজা-রানির শাসন গেলে, রাষ্ট্র হয়েছিল জনকল্যাণের। তা সম্ভব হয়েছিল উনিশ শতকের সংগ্রামে। তার ফলে বিশ শতকে ছিল নিরাপত্তা অর্জন। কী অর্জন? না, নিরাপত্তার অধিকার। কত অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল মানুষ। ৮ ঘন্টা শ্রম, কাজের নিরাপত্তা, কর্মীর সমস্ত জীবনের নিরাপত্তা, সব। কিন্তু একুশ শতকে এসে সেই সব অধিকার হরণ করে নেওয়া হতে লাগল ক্রমশ। এর পিছনে সোভিয়েতের পতন একটা কারণ হতে পারে, কেউ কেউ তা বলেন, আমিও অনেকটা তা ভাবি, কিন্তু সেই দেশে সাইবেরিয়ার নির্বাসন, ক্ষমতার বিরোধীদের বিপন্ন করে তোলাও তো সত্য ছিল। ক্ষমতাই আসলে রাষ্ট্রের নির্মাতা। তাই ক্ষমতা অথবা রাষ্ট্র বলল, অত নিরাপত্তা দেব কেন? মানুষ নিজে তা খুঁজে নিক। রাষ্ট্র শাসন করবে। নিরাপত্তা দেবে না যা চায় জনগণ। তখন জনগণ বিশ্বাস হারাতে থাকে রাষ্ট্রের প্রতি। আর রাষ্ট্রও তার জনগণের প্রতি বিশ্বাস হারায়। তখন কত রকম সন্দেহ তার ভিতরে জন্ম নেয়। অমল বিমল কমল এবং ইন্দ্রজিত এদের জীবনের গোপনীয়তা না জানলে রাষ্ট্র ক্ষমতা কি অটুট থাকবে? বিদ্রোহ তো ক্ষমতার বিপক্ষে সব সময় জাগরূক। অমল কী ভাবে, বিমলই বা কী চিন্তা করে? তাদের একটা পরিচয় পত্র হলো। কিছু তথ্য রাষ্ট্রের হাতে গেল। তারপর হলো কম্পিউটারে হাতের ছাপ, মুখের টাটকা ছবি নেওয়া পরিচয় পত্র। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো দূরাভাষ নং। আপনাকে বেঁধে ফেলা হলো। বলা হলো, এই পরিচয় পত্র না থাকলে, আপনার নাগরিকতাই সন্দেহমুক্ত হবে না। ব্যাঙ্কে লাগবে, রেল ভ্রমণে লাগবে, পাসপোর্টে লাগবে, যে কোনো সময়ে আপনার পরিচয় জিজ্ঞেস করা হতে পারে, তখন এই কার্ড নম্বর লাগবে। না থাকলে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ, রেলের টিকিটের সংরক্ষণ বন্ধ, অনেক সুযোগ-সুবিধা রহিত হয়ে যাবে। মনে করুন এগুলি হারিয়ে গেছে, বন্যার জলে ভেসে গেছে (যা হয়েছে কেরলে) তখন? নতুন কোনো নিবন্ধন হবে না। সরকারি ঋণও নয়, ব্যাঙ্কের ঋণও নয়। ভয় হয়, এরপর না চাল চিনি কিনতে কার্ড প্রয়োজন হয়। না থাকলে নতুন কিছুই হবে না। এসব হলো রাষ্ট্রের খেয়াল। মানে ক্ষমতার খেয়াল। খেয়ালও নয়, সুচিন্তিত কৌশল। ক্ষমতা চায় মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে থাকুক, উদ্বেগ ভয়ের জন্ম দেয়। মানুষ ভয়ে থাকুক। তাহলে শাসনে সুবিধে অনেক। ফলে আমার আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বার বার ভিন্ন স্থানে চলে যায় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা হয় বলে। সব ঠিক ঠাক আছে তো? এ হলো এক উদ্বেগ। ব্যাঙ্কের পাশ বই এক উদ্বেগ। এ টি এম কার্ড এক উদ্বেগ। অতি কষ্টে উপার্জন করা অর্থ লোপাট না হয়ে যায়। লোপাট হচ্ছে। ব্যাঙ্ক কি দায় নিচ্ছে? তাই আমাকে অদ্ভুত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। জানি না কী করলে আমার অর্থের নিরাপত্তা শতকরা ১০০ ভাগ সুনিশ্চিত হবে। কিন্তু এ টি এম কার্ডে টাকা তুলতে পাঁচবার ভাবি। সরকার দায় নিচ্ছে না। মানুষ নিজেরটা নিজে বুঝে নিক।
আবার এক নতুন উদ্বেগ এসেছে আমার বন্ধু আর প্রতিবেশীর জন্য। আসামের কথা বলছি। সেখানে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করছেন দায়বদ্ধতা শূন্য সরকারি কর্মচারী। ফলে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলী আহমেদের পরিবার অনাগরিক বলে ঘোষিত হন। ৪০ লক্ষ মানুষের ঘুম গেছে। এবং সামাজিক নিরাপত্তা। ১৯৭১-সালের ২৬শে মার্চের আগে এই দেশে আপনি যে ছিলেন তার একটা প্রমাণ দিন। জমির দলিল, জন্মের শংসাপত্র, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট…ইত্যাদি ইত্যাদি। যিনি ইস্কুলের শেষ ধাপ অবধি যাননি, সেই কৃষক, ক্ষেত মজুর, শ্রমিক কী দেখাবেন? জমি কেনার দলিল। জমি না থাকলে? জমি আছে, কাগজ মানে পর্চা, দলিল নেই, তাঁর কী হবে? এমন তো হয় বেশি। জমি দখল করে তিন পুরুষের ভিটে। কিন্তু জমি হয় সরকারি খাস কিংবা অন্যের। কাগজ যা আছে, ভুল কাগজ। কেউ জানে না রেকর্ডে কার নাম। ফলে তিনি হয়ে গেলেন অনুপ্রবেশকারী। তাঁর জন্য অপেক্ষা শিবির হয়েছে। হায়, কী ভয়ানক আতঙ্ক। আতঙ্ক হয়তো কাটবে, হয়তো কাটবে না। ৯৮ বছরের বৃদ্ধ যিনি ১৯৪৭-এ উদ্বাস্তু হয়ে সীমান্ত পার হয়েছিলেন, তাঁর বৈধ কাগজপত্র থাকতেও নাম নেই নাগরিক পঞ্জীতে। হয় এই খাতায় না হয় চিত্রগুপ্তের খাতায়। সরকারের বেতনভূক কর্মচারী, ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা শাসক, নিরাপত্তার বলয়ে যাঁদের জীবন যাপন, তাঁরা তাঁর নিরাপত্তা হরণ করেছেন। দরিদ্র অতি সাধারণ যে নাগরিক, তাঁকে বিপন্ন করতে পারলে আর সকলে ভয়ে থাকবে। মাথা তুলে কথা বলবে না। মানুষের যে হয়রানি হলো, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
মানুষের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করাই শাসকের প্রধান কাজ। দিল্লিতে শাসক যিনি, হটুগঞ্জে নিশ্চয় তিনি নন। কিন্তু আসলে তিনিই। ক্ষমতার শীর্ষ কোথায় জানা নেই, কিন্তু তা ভাগ হয়েছে সর্বত্র। তাতেই দেশ এগিয়ে চলে। এগিয়ে যে চলে, তা আমাদের দেশে ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখন দেখার কথা এই এগোন আসলে পিছোন কি না। এখন ধর্মাধর্ম জুড়েছে নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতার সঙ্গে। ভেবে দেখুন আপনি নাস্তিক হতে পারবেন না। হলে আপনার জীবনের ভার রাষ্ট্র নেবে না। প্রতিবেশী দেশে হয়েছে এমন। আমার দেশেও। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে আপনার নিরাপত্তা সরকার দেবে না। এদেশে ওদেশে, দুই দেশেই। আপনি স্রোতে গা ভাসিয়ে চলুন, ভালো থাকবেন। আপনি জঞ্জাল, শ্যাওলার মতো স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলুন, আপনার নিরাপত্তা সংরক্ষিত। আপনি মাছের মতো স্রোতের বিপক্ষে ভেসে যান, আপনি অনিরাপদ। আলব্যের কামুর ‘আউটসাইডার’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রটি, যার জবানীতে উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে, সেই প্রটাগনিস্টের অপরাধ কী ছিল? মায়ের মৃত্যুতে সে যথার্থ শোকার্ত হয়নি। মা থাকতেন বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে মা ভালো ছিলেন। বয়সজনিত কারণে মারা গেছেন। কিন্তু তুমি সন্তান হয়ে মৃত্যুর পরের দিন প্রেমিকার সঙ্গে জলক্রীড়া করেছ, হাসির ছবি দেখেছ, ইত্যাদি ইত্যাদি…। আরবদের হত্যা করেছিল সে, সেই অপরাধ প্রমাণ করতে মায়ের মৃত্যুর পর তার আচরণ কেমন ছিল তা বিবেচ্য হয়। তুমি স্রোতের বিপক্ষে গেলে নিরাপত্তা পাবে না পরিষদের কাছ থেকে। প্লেগ উপন্যাসে প্লেগে অবরুদ্ধ শহর রোগমুক্ত হয়েছে, জনগণ উৎসবে মেতেছে, দূর থেকে সেই উল্লাস শুনতে শুনতে ডাঃ রিও ভাবছে, মানুষের এই উল্লাস, আনন্দধ্বনি যে কোনোদিনই হয়তো আবার থেমে যাবে। নিয়ম তাই। প্লেগের জীবানু কখনোই সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয় না। থাকে। বছরের পর বছর ঘুমিয়ে থাকে আসবাবপত্র, জামা-কাপড়ের বাক্সের ভিতর, শোবার ঘরে, ভাঁড়ারে লুকিয়ে থাকে। তারপর আচমকা বেরিয়ে আসে মানুষের সর্বনাশ করতে। ইঁদুরের ভিতর ঢুকে পড়ে শহর রোগে প্লাবিত করে দেয়। নিরাপদ জীবন অবরুদ্ধ হয়, বিপন্ন হয়। মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হয় অনবরত। মানুষের নিরাপত্তার ধরণ অমনিই। কাস্টমসের উচ্চপদস্থ অফিসার অভিজিৎ সিনহা ছিলেন শান্ত নির্বিরোধ মানুষ। তাঁর ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল নিরাপত্তারক্ষীরা। সন্দেহ তিনি বিপজ্জনক ব্যক্তি। তাঁর ফোন নম্বর পেয়েছে তারা কোথায় কোন দেশদ্রোহীর ডায়েরিতে। জেরায় জেরায় ভীত মানুষটি আত্মহত্যা করেছিলেন। আমি নিরাপদ কতক্ষণ, যতক্ষণ নিরাপদ আছি। নিরাপত্তাহীনতার জীবানু, সেই প্লেগের জীবানু, কোথায় ঘুমিয়ে আছে আমি জানি না।